শিবাভোগ ও সাদা শেয়াল

মুছে যায়?— ৫০
আগের পর্বে

শিবাদাদু ছিলেন দাদামশাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শিবাদাদুর মাথায় অতিপিঙ্গল জটা। পরনে রক্তাম্বর। গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের মালা। কোমলাসনে বসে তন্ত্র সাধনা করতেন শিবাদাদু। সেই আসন তৈরি মৃত চণ্ডাল শিশুর শরীর থেকে। শিবাদাদু দাবি করতেন তাঁর দুটি পোষা ভূতও আছে। তারাই সব কাজ করে দেয় শিবাদাদুর। রটন্তি, শ্যামা, ফলহারিণী— একাধিক কালীপুজোতেই অনুষ্ঠান হত শিবাদাদুর বাড়িতে। আর সেখানে নিজহস্তেই বলিকর্ম করতেন তিনি। ছাগবলির পর তিনি শিবাভোগ দান করতেন শৃগালদের। তারপর...


হাওড়া জেলার বালি গোস্বামী পাড়ার শিবাদাদু— যাঁর পুরোনাম আমি আজও জানি না, কিন্তু পদবি জানি। তাঁর পদবি ভট্টাচার্য, তিনি পাশ্চাত্য বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের বশিষ্ঠ গোত্র, আগেই লিখেছি। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যর মামাবাড়ি, অর্থাৎ বিমলাদেবীর পিত্রালয়, তাঁরা শাণ্ডিল্য গোত্রের পাশ্চাত্য বৈদিক। পাশ্চাত্য বৈদিকদের মধ্যে বেদজ্ঞ, সর্বজ্ঞ ইত্যাদি প্রভৃতি উপাধি বর্তমান ছিল। বিমলাদেবীর বাপের বাড়ি ফরিদপুরে। অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগের অন্য অন্য পাশ্চাত্য বৈদিক গোত্রমণ্ডলী ইদিলপুরের বশিষ্ঠদের যারপরনাই হেয় করতেন নানাভাবে। সে সব গল্প এখন তোলা থাক। যাক ঐ সব পার্শ্বকাহিনী— সাইড স্টোরি। আবার মূলকেন্দ্র— পুনরায় মূল কাহিনীতে যাওয়ার চেষ্টা করি। অবশ্য আমার যে কোনো লেখাই মূল ও পার্শ্বদের নিয়েই চলে, পাশাপাশি। একসঙ্গে, বহুধারায়।

উৎসর্গ করা ছাগলটিকে নিজের হাতে বলি দেওয়ার পর সেই ছিন্নশির, ধড় সম্বল অজটিকে নিয়ে তার পেছলের অল্প ধড়ফড়ানো দুটি পা ডান হাতে ধরে সামনের দুপা নিয়ে যে ধড়, তাকে উল্টে দিতেন মাটির সরায়। তারপর বলি দেওয়া পুং-ছাগলটির গলার কাছ থেকে কাটা রোম সমেত সামান্য মাংস— একটি অতি ছোট মাংসের টুকরো অন্য কোনো ‘শুদ্ধ’ পাত্রে রাখতেন। পরে সেই বলির মাংস’র টুকরোটি অন্য কোনো অভিচার ক্রিয়ায় লাগত বলে শুনেছি। অতীব গূঢ় রহস্যময় কোনো ‘অনুষ্ঠান’-এ।

শিবাদাদুকে ‘শিবাভোগ’ দিতে দেখেছি রাত্রির— ঘোর অমানিশার প্রায় শেষ যামে। চন্দ্রহীন সেই রাত শুধুমাত্র, নক্ষত্রমণ্ডলীতে বোনা আকাশ আলোয় চারপাশ ডুবে আছে ঝাপসা অন্ধকারে। সেটা ১৯৬৪ সালটাল হবে। বড়োজোর হতে পারে ১৯৬৫-৬৬। হাওড়া জেলার বালিতে তখন অনেক অনেক ফাঁকা জমি, ছোট-বড়ো বনভূমি, বাগান, পুকুর, ঝিল, ডোবা। বাবুর বাগান, সত্যবাবুর বাগান, খটখটির বাগান— সবই অতি বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত। বাবুর বাগানের পাশাপাশি বাবুর পুকুর, ভট্টযাচার্যদের পুকুর, ঢ্যাঙা পুকুর। ১৯৫৯ সালের চৈত্রে তো বটেই ১৯৬০ সালে বালিতে দেখেছি বাবুর পুকুরের জল লোকে পান করছে। তখনও বালির রাস্তায় রাস্তায় স্ট্রিট লাইট আর রাস্তার কল— ট্যাপ ওয়াটার দেখিনি।

শিবাদাদুর তান্ত্রিক পুজো— ‘অনুষ্ঠান’ ইত্যাদি সব পুকুরজলে আগেই বলেছি। তিনি গঙ্গোদক বা গঙ্গার জল ব্যবহার করতেন না আদপেই। কেন করতেন না গঙ্গার জল ব্যবহার, সে কথাও লিখেছি আগে।

আরও পড়ুন
শিবাদাদু, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, বাহিন

শিবাদাদুর পুজোর আসনে ছোট, বড়ো, তামা ও রুপোয় তৈরি তান্ত্রিক যন্ত্রমের পাশাপাশি বড়োসড় স্ফটিক খণ্ড থাকত একখানা, গোল, উজ্জ্বল। স্ফটিক সূর্যদেবের প্রতীক। সৌরতান্ত্রিকরাও স্ফটিক বা স্ফটিকের মালা ব্যবহার করে থাকেন, সে কথাও লিখেছি আগে, এই ‘মুছে যায়?’-এর অন্য অন্য ঘটনাক্রমে।

আরও পড়ুন
অম্বুবাচী, অমাবতী, আমাবতী

শিবাদাদুর পুজোর আসনে রুপোর ছত্রধারী নারায়ণ শিলা আর একটি বেশ বড়োসড় পিতলের ঝকঝকে নাড়ুগোপাল দেখি। গোপালটি তাঁর দেশ থেকে আনানো— অর্থাৎ অখণ্ড বঙ্গের ফরিদপুর থেকে নিয়ে আসা। এই নাড়ুগোপালটি বেশ বড়ো। সুন্দর। পূর্ব বঙ্গ থেকে দেশভাগের সময়, দেশভাগের আগে-পরে বহু বাঙালি হিন্দু গৃহস্থ— যাঁরা মূলত পাশ্চাত্য বৈদিক, বারেন্দ্র শ্রেণী অথবা রাঢ়ি শ্রেণী ব্রাহ্মণ, তাঁরা তাঁদের ছোটখাটো গৃহদেবতা— নারায়ণ শিলা, নৃসিংহনারায়ণ শিলা, ছোট আকারের পিতল বা পাথরের কালিমূর্তি, গোপাল, স্ফটিক খণ্ড— সব নিয়ে আসেন, গলায় বাঁধা বগলি বা কাপড়ের ছোট থলির ভেতর। তাঁরা যেমন কেউ কেউ জুতোর সুকতলার ভেতর খোপ করে টাকা নিয়ে আসতেন, সোনার ছোট গহনা ইত্যাদি সেই পদ্ধতিতেই। তাঁরা আরও কিছু আনতেন, মূলত সম্পন্ন— তথাকথিত উচ্চবর্গীয়রাই, যে বাড়ির পুরুষ মানুষরা পায়ে চামড়ার জুতো দিতে পারতেন, অবশ্য পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে চর্মপাদুকা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। একেবারে বারণ। সেখানে কাপড়ের জুতো, স্থানীয়ভাবে কাঠের বা পিতল এমনকি রুপোরও বউলাদার খড়ম থাকত, ফিতে আটকানো খড়ম নয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বহু ইসলাম ধর্মাবলম্বী পুরুষ ফিতেদার কাঠের খড়ম পরতেন পঞ্চাশ, ষাটের দশকে তো বটেই, সত্তরের দশকেও।

আরও পড়ুন
ষাইট ষষ্ঠী ষাইট…

পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে সধবা ও বিধবা নারী খালি পায়েই থাকতেন। তাঁদের জন্য পায়ে জুতো দেওয়া, অক্ষর পরিচয়— সবই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষতন্ত্র বা পুংতন্ত্র প্রচার করেছিল মেয়েদের পায়ে জুতো পরা, অক্ষর পরিচয়— সবই বৈধব্যের অবশ্যম্ভাবী কারণ হিসাবে উপস্থিত হবে। এই সব নিয়মাবলীর নির্ঘণ্ট পাশ্চাত্য বৈদিক পরিবারে ষাট দশক পর্যন্ত তো বটেই। সত্তর দশকেও। নারীরা কেউ কেউ সুপুরি গাছের শুকনো বাকল ব্যবহার করতেন নিজেদের পা ঢাকার জন্য, জুতোর বিকল্প হিসাবে, দড়ি বেঁধে। ব্লাউজ, বডিজ, ব্রা, ব্রেসিয়ার— কোনো কিছুই তাঁদের অস্তিত্ব অথা স্বপ্ন-মানতিত্রে নেই। সাধারণভাবে সনাতনধর্মী ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী নারী— সকলেই নগ্নপদ। খালি পায়ের সেই যাত্রাচিহ্নে কোনো কষ্ট ইত্যাদি ছিল কী না, এই তথ্য জানার উপায়গুলি প্রায় সবই মুছে গেছে। এমনকি আশির দশকেও দেখেছি সেমিজের চলন হিন্দু বাঙালি মহিলা, তথাকথিত উচ্চবর্গীয়দের মধ্যে।

আরও পড়ুন
লীলা, দেবদীপাবলি, রামবাবুর দোকান

পুনরায় শিবাদাদুর শিবাভোগ দানের পদ্ধতিতে ফিরে আসি। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে শেষ যামে কালী আরাধনা শেষ হলে শিবাভোগের জন্য রাখা নতুন কাঁসার থালায়, ভাত, খিচুড়ি, শুক্তো, পাঁচ রকম ভাজা, রান্না করা শোল মাছ, ব্যঞ্জন হিসাবে প্রস্তুত করা বোয়াল মাছ, বলি দেওয়া ছাগমুণ্ডটি রান্না করার পর সেই সঙ্গে আলাদা বাটিতে চাটনি, পায়েস। সব বাটিই কাঁসার এবং নতুন। পাঁঠার মুড়োটি ছাড়িয়ে, ছাল তুলে কেটে কুটে রান্না করা, সেটিও বাটিতে। এছাড়াও আলাদা আলাদা বাটিতে বোয়াল মাছ, শোল মাছের টুকরো। বোয়াল মাছ সাধারণভাবে কালীর ভোগের জন্য রান্না হত সর্ষেবাটা দিয়ে। শোল মাছে আদা-জিরে বাটা। ডুমো করে কাঁটা আলু।

হাড় হাড় চেহারার বলিষ্ঠ, সশ্মশ্রু শিবাদাদু— যাঁকে অনেকে শিবঠাকুরও বলতেন, তিনি শিবাভোগ নিয়ে, আসতেন চন্দ্রহীন যামিনী শেষে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে, পেছনে পেছনে দু-একজন। জল্পেশ্বর পিসেমশাই থাকতেন শিবঠাকুরের একমাত্র পুত্র সন্তান। আমি গৈ মামা গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের পাশে কখনও কখনও জল্পেশ্বর ভট্টাচার্যের আশপাশে, চাঁদ না থাকা আকাশ মাথায় নিয়ে আমার যাত্রা। পরবর্তী সময়ে আরও আরও বহুবার এরকম হেঁটে গেছি চন্দ্রহীন আকাশের নিচে দিয়ে, পলাতক জীবনে, আদাড়ে বাদাড়ে, জঙ্গলে, শ্মশানে, কবরস্থানে, এই ঘটনার— মানে শিবাভোগ দেখার বছর চার-পাঁচের মধ্যেই। সে সব অন্য কথা, অন্য অন্য পরিবেশ। 

বালি গোস্বামী পাড়া রোডের থেকে ডান দিকে একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়লে খানিক গেলেই জল্পেশ্বর পিসেমশাই, শ্যাম পিসিমা, শিবাদাদুর বাড়ি। বালিবাজার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের স্কুল— বালি জোড়া অশ্বত্থতলার দিকে যেতে স্কুল পৌঁছানোর অনেকটা আগেই মিছরিবাবুর বাড়ি বাঁদিকে রেখে, ছোট একটা ফাঁকা চৌকো জমি, তারই উল্টোদিকে পাতিদের বাড়ি। তারপর গলির ভেতর ঢুকে এলে ঘটাদের বাড়ি। তার আগে তনিকাকা, তনি কাকিমাদের বড়ো বড়ি। স্বদেশ, অম্বু, বড়ুমামারা সেখানেই থাকে।

শিবাদাদুর বাড়ির পেছন দিয়ে একটা মাঝারি পুকুর। সম্ভবত শিবাদাদুদেরই। সেই পুকুরের জল দিয়েই আরাধনা। শিবাদাদুর পুজোর ঘরে সব সময় কেমন যেন একটা পুরনো কাঁসা— পেতলের গন্ধ। তার সঙ্গে হালকা হালকা বাংলা মদের ঘ্রাণ। তখন দিশি মদ বলতে কালীমার্কা বোতল। আঙুর মার্কা। বোতলও পাওয়া যায়। জল রঙ কাচের বোতলের গায়ে কালীর আবছা ছবি, একেবারেই রেখাচিত্র, সাদায়-কালোয়। তো সে যাই হোক, ভট্টাচার্যদের শরিকানি পুকুর আর ঢ্যাঙা পুকুরের মধ্যে দিয়ে যে মাটির রাস্তা চলে গেছে, তারও পর গরমে শুয়ে থাকে থাকে জোড়া খরিশ।

রক্তাম্বর পরা শিবাদাদু, তাঁর খালি গায়েই লাল রঙের ধুতির কোঁচা জড়ানো। গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের মালা। চন্দ্রবিহীন রাতের আলো নেই স্ফটিক মালার ওপর পড়ে ডুবে যাচ্ছে।

শিবাদাদুর দু হাতের বাহুতে রুদ্রাক্ষ বলয়। অনেকটা যেন কেয়ূর স্টাইলে রয়েছে। নগ্নপদে হাঁটছেন শিবাদাদু। তখন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যদের বাড়ির উল্টোদিকেই জঙ্গল। সেই জঙ্গলে শেয়াল, বিচিত্র ধরনের সাপ— বিষাক্ত ও নির্বিষ— সবই আছে, আছে বড়ো বড়ো গেছো ইঁদুর, সিভেট, বুনো খরগোশ, কাঠবেড়ালী। সেখানে ঘাসে, দু মাসে একবার শিকারে আসেন সাঁওতাল ও মুণ্ডারা। তাঁরা আসেন ঘোষ পাড়া, নিশ্চিন্দা, দুলে পাড়া থেকে। এঁরা খুব ভালো বনেদ কাটেন, ভিত খোড়েন। একতলা দোতলার ভিত। ষাটের দশকে এঁদের ডাকা হয় ‘মিতা’ বলে। তাঁদের আলাদা কোনো নাম নেই। বলা হয়, ‘মিতা’, ‘মিতা’। বাঙালি তার স্বভাব বৈচিত্রে টাকা ধার দেওয়া কাবুলিওয়ালাকে আগাসাহেব, একদা কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালানো পাঞ্জাবি—মূলত শিখই তাঁরা, তাঁদের সর্দারজি, বাড়ির গেট পাহারা দেওয়া নেপালি দারোয়ানকে বাহাদুর ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে থাকতেন। এর বিপরীত চিত্রও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। তামিল ভারতীয়দের ‘তেঁতুল’ বলা, গুজরাটিদের গুজ্জুভাই, শিখ— সর্দারজিদের বাঁধাকপি, পাঁইজি ইত্যাদি বলার রেওয়াজও আছে পাশাপাশি। এটা আসে নিজেদের এলিট ভাবার অলীক হীনমন্যতা থেকে। আমরা সকলের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সুপিরিয়র ভাবি নিজেদের— সবাই নন হয়তো কিন্তু বেশিরভাগ বাঙালিই, ফলে এই রক্তের অসুখ তো থেকে যায় গভীরেও। তো সে যাই হোক, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, সাধারণভাবে সাদা ঝকঝকে সাজানো দাঁতের ‘মিতারা’ তখন অনেকেই শিকারি। হাতে তাঁদের তির-ধনুক, বাঁটুল— যা গুলতিতে ফিট করে লক্ষ্যভেদ করা যায়। গুলতি তৈরি হয় ইংরেজির ওয়াই চেহারার পেয়ারার ডাল থেকে। তার সঙ্গে সাইকেল বা সাইকেল রিকশার টিউব কাঁটা শক্তপোক্ত রবার।

এই শিকারি ‘মিতা’দের আবার ‘বুনো’ বলে চিহ্নিত করতেন অনেকে। সেই এক অলীক মধ্যবিত্ত খেউড়গিরি। তির-ধনুক, গুলতি, বাঁটুল— সব মিলিয়ে একটা রে রে ডাক। যেন উৎসব। বুনো খরগোশ, কাঠবেড়ালি, শেয়াল মারা পড়ত। সেই সঙ্গে নানারকম পাখিও। হাতে হাতে ঝুলিয়ে বন থেকে বেরতেন তাঁরা। এই বনেই শিবাদাদুর অমানিশার রাত্রে শিবাভোগ প্রদান। তিনি থালায় সমস্ত ব্যঞ্জন সাজিয়ে, ঝকঝকে নতুন তামার গ্লাসে গ্লাসে ‘কারণ’ ও জল দিতেন। ভোগ ইত্যাদি আহারের পর শিবা— শৃগাল বা যামঘোষ কারণ ও জল পান করবে, এমনই প্রত্যাশা ও বিশ্বাস।

ঘোর রজনীতে শিবাদাদু তাঁর কারণ বারি ও বিড়ি— ধূম আক্রান্ত গলায়ন শিবা-শিব-আ, শিব-আ বলে ডাক দিতেন। দীর্ঘকার শ্মশ্রু-গুম্ফমণ্ডিত এই প্রাচীন, বলশালী পুরুষের গালের একপাশে খুব ধীরে ধীরে মেখে আসছে তারার আলো। সেই আলোকরেখায় শতবর্ষের, অথবা শতও নয়, সহস্রবর্ষের রহস্যপ্রলেপ।

শি-ই-ই-বা, শি-ই-ই-বা, সত্যি সত্যি প্রথম একটি, তারপর আরও একটি মুখ মাথা বাড়ালো কোনো সবুজ সবুজ ঝোপের ফাঁক দিয়ে। ডাক থেমে গেছে অনেকক্ষণ। সবাই চুপ। শিবাদাদু— শিবঠাকুর আবার গলা ছাড়লেন— শি-ই-ই-বা, শি-ই-ই-বা। সেই শব্দে— কণ্ঠহুঙ্কারে খানিকটা যেন ফিরে এল কর্কশতার চরম কোনো মাপ। আকাশ থেকে তারারা কি খসে পড়ল এখনই, টুপ-টাপ-টুপ? সেই বজ্রকণ্ঠে?

আধো অন্ধকারে জ্বল জ্বল জ্বল জ্বল করছে দু-জোড়া চোখ। দুই আর দুই মোট চার। সাদা রঙ তাদের, হ্যাঁ, পাঁশুটে নয় মোটেই সাদা। সেই সাদা রঙের শেয়াল দেখার সুযোগ একবারই হয়েছে আমার। কী বড়ো জোর দু বার। দু-দু বারই সেই শ্বেত শৃগাল দর্শন, জোড়া শ্বেত শৃগাল?

এরা কি অ্যালবিনো? সাঁওতাল ও মুণ্ডাদের যুগ্ম আক্রমণের পরও তারা কীভাবে বাঁচে? বেঁচে থাকে? লুকিয়ে রাখে নিজেদের? এইসব প্রশ্ন অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে মাথার মধ্যে। অবিরাম, অবিরাম।

এরপর বন কেটে বাড়ি হল, লালু-সতু, প্রীতিদি আর সুধাংশু ব্যানার্জির। ধুতি শার্ট পরা সুধাংশুবাবু ডান গালে, কানের পাশে বড়ো জড়ুল আটকাতেই কী দিবারাত্র কালো চশমা পরে থাকতেন? মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। শিবাদাদুর শিবাভোগ দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেল ঐ জঙ্গলে। জেগে রইল কিছু ছবি, কিছু স্মৃতি আর কিছু মুহূর্তমাত্র। মুহূর্তরা স্মৃতি হয়ে গেলে ছবি হয়ে যায় কত অনায়াসে। এখন ভাবলে তো তেমনই মনে হয়। আজ থেকে ৫৬-৫৭ বছর আগের কথা। স্পষ্ট মনে আছে সব।

পরদিন ভোর ভোর কাঁসা-তামার বাসনকোসন তুলে আনেন শিবাদাদুর সহচর একচোখ অন্ধ ‘সাধু’। ‘সাধু’-ই তার নাম। কালো দাড়ি-গোঁফ, জটা নেই— সব মিলিয়ে যেন এক ভয়াল ছবি। ‘সাধু’ শিবাদাদুর কাছে তন্ত্র শিখতে এসেছে। হোমের বেলকাঠ, যজ্ঞডুমুর— সব কিছু জোগাড় করে নির্দ্বিধায়। তার লালচে বসনটি খুব যে পরিষ্কার— পরিচ্ছন্ন থাকে এমন নয়। ‘সাধু’ ভাই শিবাদাদুর রাস্তাতেই প্রচণ্ড বিড়ি আসক্ত। ধূম্রপানে সদাব্যস্ত। বিড়ি, সিগারেট পেলেই হল। কারণ বারিতেও ওই সাধু ভাইয়ের প্রচণ্ড আসক্তি। সেই সাধুভাইকে অনেকেই পেছনে বলে থাকেন কানা সাধু। সামনে বললে— অর্থাৎ কানা সাধু বলে ডাক দিলে তাড়া করে সে। গাল দেয়— খিস্তি। অপরিচ্ছন্ন দাঁত তার। গায়েও দুর্গন্ধ আছে বলে কেউ কেউ।

হিরণী ভৈরবীর দশ মহাবিদ্যার এক বিদ্যা ধূমাবতী হেনস্তব ঢাকা থাকে গায়ের কাপড়ে। শিবা দাদু একা একা বিড়ি খান বসে। পরের পর। দু এক দিয়ে ঢুকিয়ে রাখেন একটা জর্দার খালি, পুরনো টিনের ডিবেয়। পোড়া বিড়ি থাকে একটা কোটোয়, গোটা বিড়ি আর একটায়। কথায় কথায় শিবাদাদু একদিন বলেছিলেন, অনেক অনেক বছর আগে রজত নির্মিত রুপোর থালা-বাটি-গ্লাসে দেওয়া হত শিবাভোগ।

Powered by Froala Editor