শিবাদাদু, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, বাহিন

মুছে যায়?— ৪৯
আগের পর্বে

হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর তারিখ ধরেই ৭ আষাঢ় পালিত হয় অম্বুবাচী। নিম্নবর্ণের মানুষেরা অবশ্য বলেন অমাবতী। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী এই দিন থেকে প্রকৃতি রজঃস্বলা থাকে তিন দিন। তাই হলকর্ষণ বা চাষ করা বছরের এই তিনটে দিন নিষিদ্ধ। উনোনে গরম জল চাপিয়ে সাবান বা সোডা দেওয়াও। তবে এই তিনটে দিনই অসম্ভব কষ্টসাধ্য সনাতনী বিধবাদের ক্ষেত্রে। এই কটাদিন তাঁদের খাবার বলতে পাকা আম, কলা আর কাঁঠালের কোয়া। সঙ্গে কাঁচা দুধ। তা খেলে শরীর খারাপ হতে বাধ্য। কিন্তু গরম বা আগুনের জ্বাল দেওয়া খাবার খাওয়া যাবে না। অবশ্য জগন্নাথধাম একাদশী মুক্ত শ্রীক্ষেত্র। সেখানে এসব নিয়মের বালাই নেই। তারপর…

বাহিন।

এই অজানা, না জানা, অপরিচিত, যাই বলি না কেন, সেই স্থান নাম বা জায়গার নাম প্রথম শুনি শিবাদাদুর মুখে। শিবাদাদু মানে শিবাদাদুই, শিব থেকে শিবা, জিহ্বান্তরে। আবার শিবা মানে শৃগাল, তার সঙ্গে তন্ত্র মতে— অবশ্যই বামাচারে কালী আরাধনার সঙ্গে শিবা বা জামঘোষ গভীরভাবে জড়িত। শিবাভোগ দেওয়া হয় কালিকা আরাধনার পর। সারা রাত ব্যাপী সেই আরাধনা, প্রায় শেষ রাতে শিবাভোগ দান। সে কথায় পরে, পরে আসছি।

শিবাদাদু বাহিনের কথা বলেছিলেন। উচ্চারণ করেছিলেন নাগর নামে নদীর কথা। যে বালকের স্মাওনে তিনি বাহিনের নাম বলেছিলেন, সেই ছেলেটি তখন সাত, হ্যাঁ, মোটে সাত, বড়োজোর আট না পূর্ণ হওয়া জীবন। সেটা ১৯৬০ কী ১৯৬১। পশ্চিমবঙ্গে ড. বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার। কেন্দ্রে প্রবল প্রতাপান্বিত পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু। তিনিই অর্থাৎ পণ্ডিত নেহরুই প্রায় প্রথম ও শেষ কথা জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতিতে। দেশের— ভারতবর্ষের আর্থিক ও রাজনৈতিক দিশা নির্ধারণে পণ্ডিত নেহরুই প্রায় সব। প্রায় বললাম এই কারণে, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর যেটুকু গণতান্ত্রিক স্পেস গড়ার অভ্যাস ছিল তাঁর নিজ মন্ত্রিসভায় বা দেশের মানুষের জন্য, তার ছিটেফোঁটাও আজ আর অবশিষ্ট নেই স্বাধীন ভারতের তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোয়। থাক সে কথা আপাতত। আমরা বরং ফিরি শিবাদাদুর কথায়।

আমার দাদামশাই হরিপদ রায় ছিলেন অখণ্ডবঙ্গের ফরিদপুরের আকসা-ভোজেশ্বরের মানুষ। মাদারিপুর সাবডিভিশন। শিবাদাদু ছিলেন দাদামশাইদের দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, লতায় পাতায় মাতুল ভাগিনেয়র সম্পর্ক বর্তায় সেখানে। অর্থাৎ হরিপদ রায় শিবাদাদুকে মামা বলে সম্বোধন করতেন। এখানে বলে রাখা ভালো পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের মধ্যে লতায়-পাতায়, বিস্তারে সকলেই প্রায় সকলের আত্মীয়। বৈদিক ব্রাহ্মণদের বশিষ্ঠ, শাণ্ডিল্য, শোনক, শৌনক, ভরদ্বাজ— সম্ভবত এই পঞ্চগোত্র। তার সঙ্গে কৃষ্ণাত্রেয় ষষ্ঠগোত্র। শাণ্ডিল্য, বশিষ্ঠরা সামবেদী। শোনকরা ঋকবেদী। ঋকবেদী ব্রাহ্মণদের যজ্ঞসূত্র আকারে ছোটো, সামবেদী শাণ্ডিল্য ও বশিষ্ঠদের থেকে। থাক এইসব তত্ত্ব ও তথ্য। আপাতত ফিরি আবার শিবাদাদুর কথায়। শিবাদাদুর মাথা ভর্তি অতিপিঙ্গল জটাভার। সেই পুরুষ্টু জটা নেমে এসেছে তাঁর কোমর ছাড়িয়ে। শুনেছি বহুজন ধুনো ইত্যাদির আঠা দিয়ে বানিয়ে নেন জটা। শিবাদাদুর বিষয়টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি নাকি প্রায় বাল্যকাল থেকেই জটাধারী। সত্যিমিথ্যা জানি না।

আরও পড়ুন
অম্বুবাচী, অমাবতী, আমাবতী

যেমন জ্যোতিষীদের একাংশ কুষ্ঠি বা কোষ্ঠি, ঠিকুজি ইত্যাদিকে যথেষ্ট পুরনো দেখানোর কাঠ বা ঘুঁটের ধোঁয়া ব্যবহার করতেন অনায়াসে। কাঠের থেকে ঘুঁটের ধোঁয়াই বেশি। সেই সময় নকল কোষ্ঠি দেখিয়ে চাকরিতে জয়েন করতেন কেউ কেউ। সরকারি চাকরিতেও। কোষ্ঠির জন্ম তারিখই তখন বয়সের প্রমাণ। আর সেই পুরনো করানো কোষ্ঠীকে বয়সে প্রমাণপত্র হিসাবে মেনে নিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন
ষাইট ষষ্ঠী ষাইট…

শিবাদাদুর চোখ যাকে বলে ডাকা ডাকা বিস্ফারিত। গালের দাড়িতে সাদা-কালোর অনায়াস সমাহার। সেই দাড়িও নেমেছে বুক ছাড়িয়ে। শিবাদাদুর পরনে রক্তাম্বর। কাছাকোঁচা দিয়েই পরতেন। গ্রীষ্মে উন্মুক্ত গাত্র। রোমহীন কবাট বক্ষ। গায়ের রং ফরসা, কিন্তু কেমন যেন কল ধরা মনে হয় তাঁকে। অর্থাৎ, সাদার উজ্জ্বলতায় কেউ যেন খানিকটা আবছা করে কোনো আলগা রং মিশিয়ে দিয়েছে। শিবাদাদু দু-দুটি বিবাহ করেছিলেন। একই মাতৃগর্ভজাত দুই কন্যা। দুজনেই মারা যান। প্রয়াত দুই স্ত্রীর পর আর তৃতীয়বার দার পরিগ্রহ করেননি। তাঁর প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে সন্তান ছিল না কোনো। দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই সন্তান জল্পেশ্বর ও বুধেশ্বরী। 

আরও পড়ুন
লীলা, দেবদীপাবলি, রামবাবুর দোকান

জল্পেশ্বর পুত্র, বুধেশ্বরী কন্যা। শিবাদাদু জলপাইগুড়ির অতি বিখ্যাত জল্পেশ্বর শিবের নামে নাম রাখে নিজের পুত্র সন্তানের। বুধেশ্বরী— এই নামকরণের পেছনে কোনো দেবপ্রতিম ঐতিহ্য দেবীনাম রহস্য ছিল।

আরও পড়ুন
দক্ষিণীরা ক্রমশ কাশীর দখল নিচ্ছেন

শিবাদাদুর গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের মালা। সবই অরিজিন্যাল। ঘন ঘন বিড়ি খেতেন শিবাদাদু। বান্ডিল বান্ডিল বিড়ি তাঁর কাছে। ট্যাঁকে গোজা। আমার মা গায়ত্রী রায়কে তিনি পূর্ববঙ্গের অতি প্রচলিত সম্বোধন ‘ছেমড়ি’ বলে ডাকতেন। ছ্যামড়া অর্থ খোকা, ছেমড়ি অর্থে খুকি।

আমরা তখন ৬৭ নম্বর গোস্বামী পাড়া রোডে ভাড়া থাকি। সেই বাড়ির একতলায় বাইরের ঘরটি, মাস ভাড়া তিরিশ টাকা আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় ভাড়া নেন ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে। বাড়ির মালিক গৌরীশঙ্কর ভট্টচার্য। তিনি আবার দূর সম্পর্কে মামা হন আমার। তাঁকে গৈ-মামা বলে ডাকি। অসম্ভব ভালো, সৎ মানুষ। গৈ মামার স্ত্রী গীতা ভট্টাচার্য, তাঁদের মূলকেন্দ্র ছিল অখণ্ড বিহারের মুঙ্গেরে। গৌরীশঙ্কর ভট্টচার্যর মা বিমলা দেবী। বাবা দুকড়ি ভট্টাচার্য। 

বিমলাদেবীর চারটি কন্যা সন্তান— অঞ্জু, শ্যাম, শান্তি, দীপ্তি। এই শ্যামের সঙ্গে বিবাহ হয় শিবাদাদুর একমাত্র পুত্র সন্তান জল্পেশ্বরের। শ্যাম পিসিমা অসম্ভব সুন্দর দেখতে। পাতলা, ফরসা, এক মাথা চুল, বড়ো বড়ো চোখ। তেমন লম্বা নন। কিন্তু রূপময়ী।

শিবাদাদু এক হাতে পাঁঠা বলি দিতে পারতেন। হাঁড়িকাঠ বা যূপকাষ্ঠের ভেতর বলিদানের— পুং-ছাগলটির মাথা কাঠের হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে তারপর পোক্ত লোহার শিকের একটা টুকরো যূপের ফুটোয় ঢুকিয়ে বলিদান সম্পন্ন করতেন। বাঁ-হাতে পাঁঠার চারটি পা টেনে ধরে, সামান্য উঁচু হয়ে লাফ দিয়ে তিনি পাঁঠার মুণ্ডচ্ছেদ করতেন খড়্গাহাতে। বলির খড়্গ ছিল তাঁর ইস্পাতের। তার গায়ে কারিগরের নাম লেখা। বগিদা বা রামদায় তিনি বলিকর্ম সম্পাদন করতেন না। গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্যদের বাড়িও অজ-বলিদানের খড়্গ ছিল একসময়। সেই খড়্গ ব্যবহার করতেন বিভিন্ন ছেদন কর্মে দু কড়ি ভট্টাচার্যের মামা। তিনিও তান্ত্রিক ছিলেন। তাঁর কাছে প্রচুর তান্ত্রিক যন্ত্রম ছিল। তাঁর স্ত্রী জগদ্ধাত্রী যন্ত্রম দিয়ে গিয়েছিলেন বিমলা দেবীকে। আর শিবলিঙ্গ।

সেই জগদ্ধাত্রী যন্ত্রম বিমলা দেবীকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মামি শাশুড়ি। এসব অতি দীর্ঘ কাহিনি। আমি তার খানিকটা লিখেছি আমার আখ্যানে।

শিবাদাদুর ভৈরবী ছিলেন। তিনি লাল কাপড় পরতেন। মানে লাল শাড়ি। প্রায় কাঠ চেহারা। হিরণী নামের সেই ভৈরবী প্রায় দিনরাত তকলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতো কাটতেন। তাঁর সর্বশরীরে বার্ধক্য যেন। মুখশ্রীতে কুঞ্চন। তিনি পূর্ববঙ্গীয় টানে কথা বলেন। তাঁকে দেখলে হঠাৎ করে সনাতনী পুরাণ কথার দশ মহাবিদ্যা— কালী, তারা, ভৈরবী, ষোড়শী, ছিন্নমস্তা, বগলা, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী, কমলা। এই যে তালিকা, তার মধ্যে থেকে ধূমাবতীর যে অবয়ব, তার সঙ্গে শিবাদাদুর ভৈরবী— হিরণীর চেহারা মেলে। শিবাদাদুর বাড়ি শ্যামা, রটন্তী, ফলহারিনী— এই সব কালীপুজোই হত।

জল্পেশ্বর পিসেমশাই আর শ্যাম পিসিমার তিন পুত্র— কল্যান, রামু, কপিল। তাঁদের এক কন্যা শুভু। রটন্তী কালীপুজোয় জোড়া পাঁঠা বলি হয় শিবাদাদুর বাড়ি। তার সঙ্গে পঞ্চ ম-কার। কারণবারি। কারণবারি পান। চক্র। ‘অনুষ্ঠান’। কারণবারি পান ও ভৈরবী চক্রকে বলা হত ‘অনুষ্ঠান’। 

রটন্তী কালীপুজো, কালীপুজো, ফলহারিনী কালীপুজোকে নিজেদের বাড়ির অন্যতম পুজো করে নিয়েছিলেন শিবাদাদু। তাঁর বাড়িতে ছিল উটের চামড়ার আসন, অজিন— হরিণ ছাল, কৃত্তি— বাঘের ছাল। বাঘ না বলে তাকে লেপার্ড বলাই ভালো।

তাঁর পুজোর আসনে ছিল বেশ বড়োসড়ো স্ফটিক। আর ছিল ‘কোমলাসন’। তথাকথিত দোষ পাওয়া তিথিতে অপঘাতে মারা যাওয়া চণ্ডাল শিশুর শরীর মাটি বা বালি খুঁড়ে তুলে, বাইরে বার করে এনে তারপর তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বার করে কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ডাবল কম্বলের চৌকো বসার জায়গার ভেতরে পুরে তারপর তাকে আসনের চেহারা দেওয়া। সেই কম্বলাসন চারপাশে ভালো করে সেলাই করে নিয়ে তারপর তা কোমলাসন। 

সেই আসনে কাঁচা মদ ডালতে হত। প্রতি অমাবস্যায় তো বটেই, অন্য অন্য দিনেও, বিশেষ বিশেষ তিথিতে ‘কারণসেবা’ করত সেই চাঁড়াল বা চণ্ডাল অবশেষ। এই আসনে বসে নাকি অনেক অনেক সিদ্ধাই-কর্ম করা যেত।

শিবাদাদু বলতেন তাঁর দু-দুটো পোষা ভূত আছে। সেই ভূতেদের দিয়ে তিনি নাকি অনেক ‘কাজ’ করান। বাহিনের কথা তিনি বলেছিলেন, সেই সঙ্গে নাগর নদীর কথা। লাফা শাক নিয়ে অবশ্য কোনো কথাই তিনি বলেননি। নাগরের পাড়ে এক জলপদের সান্ধ্য বাজারে গিয়ে লাফা— টাটকা সবুজ লাফা শাক দেখি। লাফা খেতে অপূর্ব। উত্তরবঙ্গের লাফা দঙ্গিণবঙ্গে বয় না। যেমন ঢেঁকি শাক এখনও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, খণ্ডিত দক্ষিণ দিনাজপুরে। উত্তরবঙ্গের কোয়াশ শাকও বেশ খেতে। কিন্তু লাফা আর ঢেঁকি শাক তো চমৎকার। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ ঢেঁকি শাক পান, কিন্তু লাফা নয়।

ঢেঁকি শাকের পাশাপাশি আছে পাগলা-ঢেঁকি। তারপ পাতার চেহারা, আকৃতি সামান্য বড়ো। পাগলা-ঢেঁকি খেলে নাকি পাগল হয়ে যায়, মানুষজন। যেমন চিল চেহারর কোরালের মাংস খেলে মানুষ মস্তিষ্ক বিকৃতির শিকার হয়।

শিবাদাদু নিজেদের বাড়ির পুজো যেমন নিজে করতেন, তেমনই বলি-কর্মটি নিজে করতেন। অসীম শক্তিধর মানুষ। তিনি আমাদের বলেছিলেন বাহিনের সর্পমণ্ডিত এক অতি বৃহৎ ও প্রাচীন মহীরুহের কথা। যথেষ্ট বৃদ্ধ এই গাছের সর্বাঙ্গে সাপ আর সাপ। অনেক অনেক বিষাক্ত সাপ, ঝুলে রয়েছে। সেই সাপ জড়ানো গাছ র দেখতে পাইনি, বাহিনে গিয়ে।

নব্বই দশকে বাহিন ও নাগর নদী দেখি বারে বারে। নাগরের থেকে তুলে আনা টাটকা—টাটকা বললে কম বলা হয়, অতি তাজা চুনো মাছের ভর্তা ও ঝোল খাই। নাগর নদীর কথা সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প পড়তে গিয়ে পরে পাই। কি চমৎকার তার বর্ণনা। নব্বাই দশকে নাগরের কাছাকাছি পৌঁছে সেই স্রোতধারায় গাড়ি ধোয়াতে দেখেছি। নাগরের স্রোত চলে গেছে অখণ্ড বিহারের দিকে।

শিবাদাদু মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিন— টানা ছ মাস, এক বছরও শিষ্যবাড়ি গিয়ে থাকতেন। হয়তো এক বছর নয়, কারণ দীপান্বিতা কালীপুজো, রটন্তি কালীপুজো, ফলহারিনী কালীপুজো— সবেতেই তিনি আসতেন, মোটামুটি। শিষ্য-যজমান ঠেঙিয়ে। গুরু পুরহিত গিরি করা, পিরবাবারাও এভাবেই থাকতেন দিনের পর দিন শিষ্য-যজমান বাড়িতে, পুরিদান বাড়িতে।

দীপান্বিতা কালীপুজো, রটন্তি আর ফলহারিনী কালীপুজোয় তিন দু গুনে ছ— ছটা পাঁঠা বলি হত। শিবাদাদু বলি দিতেন, জল্পেশ্বর পিশেমশাইও। জল্পেশ্বর পিসেমশাইও থাকতেন শিষ্যবাড়ি। অনেক অনেক দিন। শিষ্য-সামন্তবাড়ি থেকে জল্পেশ্বর পিসেমশাই ও শিবাদাদু আনতেন অনেক কিছু। প্রণামী, দর্শনের টাকা, তরকারিপাতি, অনেকটা চাল, দু আড়াই মণ। শিষ্যরাই আবার পৌঁছে দিয়ে যেত এইসব জিনিস।

খুব বিপদে পড়া শিষ্য-সামন্ত, যজমানদের জন্য শিবাদাদু শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করতেন। অনেক অনেক জিনি— চাল-ডাল-আলু, নগদ প্রণামী, কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাস, তামা পিতলের থলাআ গ্লাস, শতরঞ্চি, ধুতি-শাড়ি, কাঠের জলচৌকি সব কিছুই শান্তি স্বস্ত্যয়নের দানে পেতেন। এই শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করে নাকি ভূত-প্রেত-পিশাচ, দুষ্ট আত্মা, রোগবালাই, বিপদ-আপদ, গ্রহফাঁড়া— সব তাড়ানো যেত। এ এক অদ্ভুত বিশ্বাসের জগৎ। শান্তি-স্বস্ত্যয়নে প্রচুর আয় হত শিবাদাদুর। লোকেদের— শিষ্য-সামন্ত, যজমানদের নাকি কাজও হত। কেটে যেত বিপদ-আপদ, অসুখ-দুঃসময়, অর্থাভাব। এটা যাঁরা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করাতেন, তাঁরা তো বিশ্বাস করতেন। 

রটন্তি, শ্যামা, ফলহারিণী কালীপুজোর আগে আগে— অন্তত দিও তিনেক আগে বলির নিখুঁত পাঁঠা আসত বালির গোস্বামী পাড়া রোডের ওপর রামু-কল্যাণ-কপিলদের বাড়ি। সেই না-খুঁতো পাঁঠা মূলত কালো। কখনও কখনও কালো পাঁঠা না পাওয়া গেলে সাদা, লাল বা ছাইরঙা। রামু-কল্যাণ-কপিল মন দিয়ে কাঁঠাল পাতা খাওয়াত ওইসব অজদের। তাদের শিঙ, ক্ষুর সবই একেবারে নিখুঁত হওয়া চাই, না হলে হবে কী করে।

শিবাদাদুর বাড়ি বলির মাংস আদা-জিরে-তেজপাতা দিয়ে রান্না হত। তা বৃথা-মাংস মানে কশাইয়ের ছুরিতে নিহত বা হালাল হওয়া খাসি-পাঁঠার মাংস নয়। তার স্বাদ— সেই আদা-জিরে-তেজপাতা দেওয়া কচি পাঁঠার ঝোল, স্বাদে অপূর্ব। পেঁয়াজ রসুনের কোনো বালাই-ই নেই তাতে। 

শেষ রাতে বেজে উঠত বলির বাজনা। ছাগ ড্যাঙা ড্যাঙ, ছাগ ড্যাঙা ড্যাঙ… বলির পর সেই কর্তিত মুণ্ডের ওপর জ্বালিয়ে দেওয়া হত ঘিয়ের প্রদীপ। তারপর তো প্রসাদী মুড়োও রান্না হত। পরদিন সকালে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ। দুপুর দুপুর ভাত, পাঁঠার বলি দেওয়া মাংস, খিচুড়ি, অম্বল, পায়েস। থাকত পাঁচ রকম ভাজা, ভাতের সঙ্গে মেখে খাওয়ার শুক্তো এবং ডাল। ভাজা বলতে আলু-বেগুন-উচ্ছে-কাঁচ কলা, কাঁকরোল, রাঙা আলু, যে যেমন পারে।

ছাগ বলির পর একটি পোড়া মাটির নতুন সরায় ধরা হত রক্ত। সেই অজ-রক্তের ভেতর খোসা ছাড়ানো পাকা কাঁঠালি কলা একটি। সেই রুধির জমা হয় ধীরে। তারপর একসময় সেই সরায় জমে থকথকে কাঁচা রক্ত পান করে কেউ কেউ। পান করে মানে চেটে খায় সেই আঁশটানি গন্ধ আর ছাগলের দুর্গন্ধ মেশানো রক্ত। পরের সপ্তাহে লিখব শিবাভোগ নিয়ে।

Powered by Froala Editor