অম্বুবাচী, অমাবতী, আমাবতী

মুছে যায়? — ৪৮
আগের পর্বে

ষষ্ঠী নিয়ে বাঙাল আর ঘটিদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। বাঙালদের একটাই ষষ্ঠী অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠী। ঘটিদের রয়েছে অশোকষষ্ঠী, নীলষষ্ঠী, চাপড়াষষ্ঠী, লোটনষষ্ঠী ইত্যাদি। আতপ চাল বেটে হলুদ মিশিয়ে পিটুলি দিয়ে ষষ্ঠীমূর্তি তৈরির চল ছিল। সেইসঙ্গে বানানো হত সাদা ও কালো বিড়াল। কালো পাথরের বাটিতে দেওয়া হত কাঁচা দুধ ও করমচা। কেটে যাওয়া সেই দুধ গোদের পুঁজের রূপকথা। ষষ্ঠী ঠাইরেনের সামনে রাখা হত পাতায় কাটা ফল ও আতপ চাল। সেইসঙ্গে দেওয়া হত আলপনা। পাঠ করা হত ষষ্ঠীব্রত। উচ্চারিত হত ‘ষাইট ষষ্ঠী ষাইট’। মধ্যবিত্ত হিন্দু রমণীরা ‘বাটা’ দেন জামাইকে। সন্তান কিংবা জামাইয়ের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় হলুদ সুতলি। তবে সেক্ষেত্রে নতুন তালপাখার বাতাস করতে করতে বলা হয়, ‘ষাট ষষ্ঠী ষাট’। তারপর…


ষষ্ঠী ব্রত, অরণ্যষষ্ঠী ব্রতপালন, সব নিয়েই, নিতকিত আচার-বিচার, ব্যবস্থা সব কিছুতেই পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু বাঙালি আর পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের মধ্যে প্রায় পূর্ব-পশ্চিম পার্থক্য। বিবাহ অনুষ্ঠান, উপনয়ন ইত্যাদিতেও ফারাক আছে।

অরণ্যষষ্ঠী বা আমষষ্ঠীতে বাঙাল বাড়িতে যখন ষাইট ষষ্ঠী ষাইট, ইত্যাদি বলে ভিজে তালপাতার পাখার বাতাস দিয়ে পুত্র সন্তানদের মঙ্গলকামনা করে থাকেন সন্তানবতী জননী, তখন ভিজে পাখার বাতাস দিতে দিতে ‘ষাট ষষ্ঠী ষাট’ বলতে হয় পুত্রবতী মা বা জামাইদের। ‘বাটা’ দেওয়ার কথা, হাতের কবজিতে সাদা বা হলুদ সুতো বাঁধা, এইসব ছবিদার লোককলা বা লোক সংস্কৃতি জেগে আছে আমাদের সামনে।

হিন্দু বাঙালি পাঁজি বা হিন্দু পঞ্জিকা মতে কতগুলো বিশেষ দিন একেবারে তারিখ ধরে ধরে পায়, প্রায় প্রতিবছরই। ‘মলমাস’ পড়লে অবশ্য হিসাব যায় বদলে। তখন অন্য অঙ্ক কাজ করে। কিন্তু সাধারণভাবে ভাদ্র সংক্রান্তি নির্দিষ্ট থাকে বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য, কার্তিক সংক্রান্তিতে দেবসেনাপতি কার্তিকের আরাধনাক্ষণ। তেমনই ৭ আষাঢ়, প্রতিবছর বাংলা তারিখলিপি— ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অম্বুবাচী বা অমাবতী বা আমাবতী। অমাবতী বা আমাবতী বলে থাকেন তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষেরা। সেসব কথা আপাতত ঝুড়ি চাপা থাক।

আরও পড়ুন
ষাইট ষষ্ঠী ষাইট…

আম পাকে জাম পাকে
পানিয়ালে পাকে রে…

আরও পড়ুন
লীলা, দেবদীপাবলি, রামবাবুর দোকান

এই যে আম পাকা, জাম পাকা নিয়ে গান, ছড়া— এসব তো পূর্ববাংলাতেই, অখণ্ড বঙ্গের পূর্ব দিকে, ফরিদপুরে। আসলে পশ্চিমবঙ্গীয় জামাইষষ্ঠী বা ঘটি জামাইষষ্ঠীতে জামাইবাবুর শালিদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার একটা ‘বড়ো’ ইভেন্ট।

আরও পড়ুন
দক্ষিণীরা ক্রমশ কাশীর দখল নিচ্ছেন

তখন মানে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকেও এই ছড়াটি তো দিব্যি মুখে মুখে—

আরও পড়ুন
বারাণসীর ভৃগু-পন্ডিত, গতজন্ম, তারও আগের আগের জন্মে…

জামাইবাবু, কমলালেবু একলা খেও না
দিদি আমার ছেলেমানুষ কিচ্ছু জানে না…

এই ছড়াটির মধ্যে মৃদু যৌন সংকেত ও মধুর যৌন-সুড়সুড়ি যথেষ্ট পরিমাণে আছে বলেই আমার বিশ্বাস। তো থাক সেসব কথা। বাঙালি বা ভারতীয় জীবনে শালির সঙ্গে একটি মাধুর্যময় সম্পর্ক, তার মধ্যে চাপা যৌনতাও তো আছে অনেক সময়, যেমন শালি, আধি ঘরওয়ালি— এই উচ্চারণের মধ্যেই আরও অনেক অনেক বেশি প্রকট হয়ে ওঠে বিষয়টি। আর শালি, আধি ঘরওয়ালি এই আপ্তবাক্যটিও গোবলয় বা হিন্দিবলয় থেকে কেমন করে যেন জড়িয়ে যায় বাঙালি জীবনে অতি সরলভাবেই।

ফলে উত্তর কলকাতার জামাইবাবু শালিদের নিয়ে ‘শালিবাহন’ হয়ে জামাইষষ্ঠীর দুপুরে চলে যাচ্ছেন সিনেমা হলে ‘টকি’ দেখতে, এই দৃশ্য খুবই সুপরিচিত ছিল। যা ক্রমশ ক্রমশ মুছে গেছে, কালের নিয়মে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি— অণুপরিবারে একটি পুত্র বা একটি কন্যা— সময়ের দাবি মেনে। ফলে এখন আর পঞ্চব্যঞ্জনে জামাই খাওয়ানোর ব্যাপারটাই উঠে গেছে। ঝাল, ঝোল, চচ্চড়ি, অম্বল, শুক্তুনি। প্রেশার, স্যুগার, থাইরয়েড বা অন্য অন্য গুরুপাক আহার-আয়োজনে প্রায় দাঁড়ি টেনে দিয়েছে। তবু নামকরা, আধা নামজাদা হোটেল, রেস্তোরাঁয় বিশেষ টেবল বুক হয়। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপন হয় জামাইষষ্ঠীর লাঞ্চ প্যাকেজের। বুফে। পার ডিশ পাঁচশো, সাড়ে পাঁচশো থেকে শুরু। বাঙালি, মুঘলাই, চিনা, তিব্বতি, মেক্সিকান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, কনটিনেন্টাল ডিশ— সব সব আছে। সবটাই বদলে গেছে ধীরে।

পশ্চিমবঙ্গীয় জামাই মাথার চুলটি, মাথা যদি কেশ বিরল বা ইন্দ্রলুপ্ত ষড়যন্ত্রে সম্পূর্ণ কেশ শূন্য না হয়ে যায়, যাকে সাধারণ জিভে বলে ‘টেকো’, ‘টাকলু’, ‘টাকলা’, ‘টাকদুম্বা’, ‘মাথার টালি বেরিয়ে পড়েছে’, তেমন শোচনীয় অবস্থা না হলে মাথার কালো চুলে নারকেল তেল, সিকে সেনের ‘জবাকুসুম’, ‘কোলগেট তেল’ বা ‘ক্যান্থারাইডিন’ নয়ত ‘মহাভৃঙ্গরাজ’ বা ‘ভৃঙ্গরাজ’ অথবা ‘সুগন্ধরাজ’ ফুলেল তেল মেখে, নাকের নিচের গোঁফটি গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদারের ইস্টাইলে রেখে মলমলের পাঞ্জাবি, সেই মসলিন হেন ফুলহাতা পাঞ্জাবির বুক পকেটে দেখদারি একখানা কড়কড়ে দশটাকার নোট, কানে আতর চোবান তুলো গুঁজে, লালচে বা কালা পাড় ধুতি পরে, পায়ে পাম্পটি দিয়ে ‘কলকেতার নতুনদা’ সেজে মসমসিয়ে শ্বশুর বাড়ি বা শ্বশুরালয় যাওয়া। হাতে মিষ্টির বড়ো হাঁড়ি। পোড়ামাটির লালচে সেই হাঁড়ির ভেতর ঝকঝকে রাজভোগ। চ্যাঙারি ভর্তি সন্দেশও নিতেন কেউ কেউ। ‘আবার খাব’, ‘দেদো সন্দেশ’ বা ‘গুঁপো সন্দেশ’। ‘দেদো সন্দেশ’-এর সঙ্গে ‘দেদো মণ্ডা’-ও হত। কিন্তু জামাইষষ্ঠীর দিন সে অনুপস্থিত। এই জামাতা ‘বাবাজীবনরা’ আদ্দির ও সিল্কের পাঞ্জাবিও পরতেন। 

জামাই বাবাজীবন বা ‘জামাইবাবাজি’ সস্ত্রীক শ্বশুরালয়ে, সঙ্গে সময় যদি হয়ে থাকে তাহলে একটি বা একাধিক ছানাপোনা। পোনা মায়ের কোলেও থাকতে পারে। ছানার হাত বাবার হাতে। এই ছবি ষাট, সত্তর, আশি বছর আগের এই কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে। তখনও ট্রামে সস্তার অলডে টিকিট। মেট্রো, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, টাইগার, টকি শো হাউস, মিনার্ভা, ইংলিশ পিকচারের জন্য। তালিকায় আছে এলিটও। সেইসঙ্গে মিনার-বিজলী-ছবিঘর, শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা, রাধা-পূর্ণ-অরুণা, উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা, বসুশ্রী-ভারতী-বীণা। ‘বায়োস্কোপের’ যুগ শেষ হয়ে ‘টকি’ এসে গেছে। সিনেমা দেখাকে তখন অনেকেই ‘বই দেখা’ বলেন, এখনও সেই ‘বই দেখা’ কোনো কোনো উচ্চারণে অব্যাহত।

সিনেমার টিকিট ব্যালকনি, রিয়ার স্টল, ড্রেস সার্কেল সবচেয়ে দামি। বাকি সব প্রায় অর্ডিনারি। দশ আনা মানে সাতষট্টি নয়া পয়সার বদলে পঁয়ষট্টি নয়া পয়সার টিকেট। সিনেমা হলের নিয়ম যত কম দাম টিকেটের, তত সামনে বসা। থিয়েটার বা বোর্ডে ঠিক তার উল্টো। বেশি দাম টিকেট মানে পেছন দিকে।

তিরিশ-চল্লিশ দশকে ‘বাবু বাড়ির’ মেয়েরা-বৌয়েরা থিয়েটার বা থ্যাটার দেখতে এলে, তাঁদের সঙ্গে থাকতেন তাঁদের খাসদাসী বা জবানে ‘ঝি’। সেই ‘খাসদাসী’ বা ‘কাজের লোক’রা তাঁদের মালকিনদের খুঁজে বার করার জন্য থ্যাটার কোম্পানির লোকেদের বলতেন, তখন থিয়েটার কোম্পানির লোকজন সেই সব দাসীদের কথা অনুযায়ী, ‘অমুক রাস্তার, অমুক বাড়ির বড়ো বউকে নিচে আসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে’ বা এরকম ভাষায় কিছু একটা বলতেন, খুব চিৎকার বা চিচকার করে। তখন নেমে আসতেন সেই সেই বাড়ির বৌ বা মেয়েরা। তাঁদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি— ফিটন, ল্যান্ডো, ব্রুহাম থাকত। সেইসব গাড়ি টানত অনেক সময়ই ওয়েলার ঘোড়ারা। তখন ঔপনিবেশিক সময়। বাঙালিবাবুরা অনেকেই নিজেদের টাকা ‘ফুটকড়াই করা’র তালে। বাগানবাড়ি, পোষা রক্ষিতা— মেয়েছেলে বা ‘রাঁড়’। সেইসঙ্গে পায়রা ওড়ানো— কবুতরবাজি, বেড়ালের বিয়ে, পাখি— ‘পাকিপোষা’— বাবু কালচারের এইসব ব্যাপারের সঙ্গে পিনিস চেপে ঘোরা, লখনউ, বেনারস থেকে বাঈজি আনানো, তাঁদের দিয়ে মুজরো করানো, সবই চলছে পাশাপাশি।

হুতোমের লেখায় পাই বাবুদের রাঁড় নিয়ে শ্রীরামপুরের রথযাত্রা দেখতে যাওয়া। সে বড়ো আজব কলা। থাক সে সব কথা। পশ্চিমবঙ্গীয় বা ঘটি বাড়ির জামাইটির পেছনে সঘোমটা বধূটি। তার ঘোমটা অবশ্য খসে যায় বাপের বাড়ি এলে। উফ, কী মুক্তি, কী মুক্তি।

এবার একটু অম্বুবাচী, অমাবতী বা আমাবতীর কথা বলি। বিশ্বকর্মা পুজো, কার্তিক পুজো যেমন, তেমনই ৭ আষাঢ় অম্বুবাচীর জন্য নির্দিষ্ট দিন। হিন্দু বাঙালির কাছে যেমন অম্বুবাচী, ওড়িশায় তেমন ‘রজ’। রজ উৎসবের নানা নিতকিত, নিয়ম-কানুন সংস্কার আছে। সেসব কথা নয় পরে বলব।

হিন্দু লোকবিশ্বাস, খানিকটা পুরাণকথা অনুযায়ী ৭ আষাঢ় অম্বুবাচীর শুরু থেকে তিন দিন প্রকৃতি রজঃস্বলা। এই সময়ে সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী তিন দিন মাটি খোঁড়া— হলকর্ষণ— মাটিতে হাল দেওয়া, চাষবাস ইত্যাদি সব বন্ধ। উনোনে গরমজল চাপিয়ে, তার মধ্যে সোডা, বার সাবান দেওয়া নিষিদ্ধ। বছর চল্লিশ আগেও তা মানা হত, যথেষ্ট নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে, নিবিড়ভাবে।

এই তিন দিন— ৭ আষাঢ় থেকে ৯ আষাঢ় পর্যন্ত সনাতনী বিধবাদের যারপরনাই খারাপ অবস্থা থাকত। ঠান্ডা, না ফোটানো দুধ তাকে আষাঢ়ী— খেয়ালি রোদ্দুরে গরম করে, তাতে খোসা ছাড়ানো পাকা আমের টুকরো, খোসামুক্ত পকু রম্ভা— পাকা কলার খণ্ড, বীজ ও বাতি ফেলা— এই বাতি মানে কাঁঠালকোয়ার ভেতরের একটি শক্ত জিনিস, যা প্রায় সময়ই হজম হয় না, সেই কাঁঠাল কোয়া, তা রস খাজা বা গালা— রসদার গালা— নরম কাঁঠালের কোয়া এই কাঁচা দুধের ভেতর। তারপর সেই গো-দুগ্ধ— দুধ পান করা। কাঁঠাল-কোয়ার বাতিকে অনেক সময়ই ‘অজীর্ণ’ বলেও ডাকতেন অখণ্ড পূর্ববঙ্গের ঢাকার তথাকথিত উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণরা।

কল্যাণী দত্ত তাঁর লেখায়— ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’ বা ‘পিঞ্জরে বসিয়া’তে সনাতনী মেয়েদের নানা অপমান, দুঃখ, কষ্টের কথা বলেছেন, মানে লিখেছেন কিন্তু অম্বুবাচী নিয়ে সম্ভবত সেখানে খুব বেশি উচ্চারণ নেই।

পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবাদের দেখেছি এইভাবে তিন দিন অত্যন্ত দুঃখে ও যাতনায় অম্বুবাচী পালন করতে। বিধবা দিদি, মাসিমা, পিসিমাদের অম্বুবাচীর টাকা বা আম-কলা কিনে দিয়ে আসতেন কেউ কেউ।

অম্বুবাচীর দুনে-রাতে পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ, দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ, তথাকথিত নিষ্ঠাকাষ্ঠা মানা রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও বারেন্দ্রশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের, ঘরে ঘরে অম্বুবাচীর তিন দিন পালিত হত ঘোর নিয়ম মেনে, সংস্কার অনুযায়ী খাদ্যাখাদ্য সব।

হিন্দু বাঙালি বিশ্বাস মতে জগন্নাথধাম— শ্রীক্ষেত্র হচ্ছে অম্বুবাচী, একাদশী মুক্ত ক্ষেত্র। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছর আগে আর তার পূর্ববর্তী সময়ে তো এই নিয়ম জারি। 

যাঁরা পুরীর জগন্নাথ মন্দির খুব ভালোভাবে, খুঁটিয়ে দেখেছেন, তাঁরা যেমন এর মধ্যে— এই মন্দিরকলা, স্থাপত্য ও আচার-বিচারে বৌদ্ধধর্মের অবশেষ খুঁজে পেয়েছেন, তেমনই এই মন্দিরের চারপাশ চালো করে প্রদক্ষিণ করলেন শেলক বা শৃঙ্খলাবদ্ধ একাদশী দেখা যায়। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা মন্দির চত্বরে অসংখ্য দেব-দেবী, উপদেবী। তার মধ্যে— মানে এই মন্দিরকে বেড় দিয়ে কাকভুষুণ্ডি যেমন আছে, তেমনই আছে শেকলে বাঁধা একাদশী।

জগন্নাথ নাকি স্বয়ং শেকলে বেঁধে রেখেছেন একাদশীকে। ফলে সম্পন্ন বাঙালি সনাতনী মধ্যবিত্ত অনেক সময়েই তাঁদের মা, কাকিমা, জ্যেঠিমা, ঠাকুমা, দিদিমাদের নিয়ে এই শ্রীক্ষেত্রে। এখানে অম্বুবাচী ও একাদশী নাস্তি— পালন করতে হয় না।

একাদশী নয়, অম্বুবাচী নয়, উচ্ছিষ্টের বালাই নেই, জগন্নাথ মন্দিরের ‘আনন্দবাজার’-এ ‘মহাপ্রসাদ’-এ। সেই প্রসাদ সকালে বাসি। বিকালে তিনটের পর টাটকা-গরম।

অম্বুবাচীর দিন দিন সনাতনী বিধবারা গরম, আগুন জ্বালের কোনো খাদ্য খাবেন না। তাঁরা আতপচাল বাটা খেতে পারেন তথাকথিত ‘বিধান’ অনুযায়ী পাকা কাঁঠালের কোয়া, পাকা আমি মেখে। সঙ্গে পাকা কাঁঠালি বা মর্তমান কলা।

প্রকৃতি রজঃস্বলা। ফলে কামকোটি পীঠম কামরূপ-কামাখ্যা মন্দির বন্ধ এই তিন দিন— ৭ আষাঢ় থেকে। সনাতনী পুরাণকথা অনুযায়ী একান্ন পূর্ণপীঠের অন্তর্গত কামাখ্যায় যোনি পড়েছিল সতীর।

তিন দিন বন্ধ থাকে কামাখ্যা মন্দির। সেই আদিম, প্রস্তর যোনিরূপও যেন রজঃস্বলা হয় সেই সময়, এমন কথা বলে থাকেন বিশ্বাসীরা। প্রকৃতি রজঃস্বলা বা ঋতুমতী হোন, কোনো আপত্তি রইল না। কামাখ্যা মন্দিরের পাথুরে যোনি স্পর্শিত কাপড়ের টুকরো নিয়ে, সর্বরোগহর, বিপদতারণ বলে ব্যবসা হোক, সেও ঠিক আছে। কিন্তু সনাতন ধর্মীয় ‘স্বামীহারা’, ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহারে প্রবল আপত্তি আছে আমার, কে, কে, কে কার স্বামী? তো সে যাই হোক, পতিহীনা বা বিধবাদের প্রতি অম্বুবাচীর নামে, একাদশীর নাম করে, যে পুংতন্ত্রীয় অমানবিকতা বছরের পর বছর চলেছে, তা অতি অমার্জনীয় অপরাধ।

ভারতীয় সনাতনী জীবনে পয়লা আষাঢ় ‘মেঘদূতম’ বা ‘মেঘদূত দিবস’। উজ্জ্বয়িনীর সেই বিরহী কবি তাঁর নির্মাণে প্রিয়াকে পাঠাচ্ছেন বিরহকাতুর এক যক্ষের প্রণয়লিপি, মেধের মাধ্যমে। উত্তরমেঘ, পূর্ব মেঘ কত কত বিরহকাতর লিপিকথা, বহে নিয়ে আসে, নিয়ে যায় নিয়ে আপন মানসভুবনে।

সেই আষাঢ় মাস, আষাঢ়ের প্রথম দিন— আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, যেদিন নাকি বর্ষণ অবশ্যম্ভাবী। যেমন অবশ্যম্ভাবী বরিষণ নাকি দশহরা— গঙ্গাপুজোর দিন, এইদিন বৃষ্টি বিতরি থাকলে অর্থাৎ বর্ষণ না হলে বিষ বাড়বে সাপেদের, এমন বিশ্বাসও সনাতন ভারতীয় বিশ্বাসে, এরকম বিশ্বাস কথা আছে, বৃষ্টি হবে রথযাত্রা, জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা-সহ আরও দু-একটি নির্দিষ্ট দিবসে। কিন্তু এই আষাঢ় মাসেই অম্বুবাচী, অমাবতী বা আমাবতী। নিরম্বু উপবাস আর নানা কৃৎকৌশলের বাইরে ভেতরে, সে এক আজিব দাস্তান। এই অপার্থিব প্রায় গল্প— কষ্টকথা, পাথরের খাদা— বড়ো পাত্রে আতপতণ্ডুল বাটা— পাকা কদলী, পক্ক আম্র সহযোগে, যে বড়ো যাতনার কথা, মানসিক, শারীরিক, আত্মিক। এই প্রথা— অম্বুবাচী নামক নিগড় ক্রমশ অপ্রকাশ্য হওয়ার পথে। এইটুকুই যা ভরসা।

Powered by Froala Editor