মুছে যায় - ৩৯
আগের পর্বে
বালিতে ঠিকানাবদলের পর প্রথম নির্বাচন দর্শন। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন তখন একসঙ্গে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীক জোড়া বলদ। না ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টির কাস্তে ধানের শীষ, অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রদীপ। সেসময় কংগ্রেস ও জনসঙ্ঘের ছাপা পোস্টার দেখা যেত দেওয়ালে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টার হাতে লেখা। তখন নির্বাচন মানেই ভোটের ছড়া। এইসব ছড়া নিয়ে একটি আমার বইও বেরিয়েছিল ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে। তবে তখন প্রক্সি ভোট থাকলেও, ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি কথাটা। তারপর…
হাওড়া জেলায় ষাটের দশকেও জাতীয় কংগ্রেসের একটা বড়সড় প্রভাব ছিল, অন্তত নির্বাচনী ফলাফল— ভোটের রেজাল্ট আউট হওয়ার নিরিখে। কমিউনিস্টদের অনায়াসে কমিনিস্ট বলা হত, আন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ছড়ায় এই কমিনিস্ট শব্দটাকে খুব সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন। সে কথায় যাচ্ছি না এখন। আবার কালীসাধক, দার্শনিক, বহুগানের লেখক ‘ভবা পাগলা’ তাঁর একটি বাণীতে বলেছেন, ‘কমনের যে ইষ্ট করে সেই কমিউনিস্ট।’ কথাটা শুনলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। আমি ভবা পাগলার কাছে মন্ত্র, দীক্ষা কিছুই নিইনি। কিন্তু ওঁর এই কথাটা বিস্মিত করে আমায়, ‘কমনের যে ইষ্ট করে সেই কমিউনিস্ট।’ যদিও কমিউনিস্টরা ষাটের দশকে বহু অঞ্চলেই ছিলেন ‘রাক্ষস’-প্রায়।
এমনিতেই ১৯১৭-র ৭ নভেম্বর সোভিয়েত বিপ্লব হওয়ার পর পশ্চিমী মিডিয়া প্রচার করেছিল বলশেভিকদের শিং আছে। আসলে বলশেভিকদের দৈত্যসম প্রমাণ করতেই এই প্রয়াস। খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এইসব কথা লিখত। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে নেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে পর্যন্ত ‘প্রবলেমস অফ কমিউনিজম’ বলে একটি ঝনতকার-ঝকঝকে ছাপা, কনটেন্টে ভয়ানক সাম্যবাদ বিরোধী, ভেতরে দারুণ দারুণ ছবি, সব মিলিয়ে দুর্দান্ত, তো সেই পত্রিকার নামেই বোঝা যায়, তার বিষয়বস্তু কী। সোভিয়েত পতনের পর সেই পত্রিকাটিও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও ‘ইকনমিস্ট’ বলে ভয়ঙ্কর কমিউনিজম বিরোধী ম্যাগাজিন খুব চলত আশির দশকেও, ‘টাইম’ আর ‘নিউজউইক’-এর পাশাপাশি।
‘টাইম’, ‘নিউজউইক’ দুটোই সাপ্তাহিক পত্রিকা। পড়তে পড়তে জেনেছি ‘টাইম’-এর তুলনায় ‘নিউজউইক’ অনেক বেশি কট্টর, কনজারভেটিভ— রক্ষণশীল, কমিউনিজমের বিরোধিতায় ‘নিউজউইক’ অনেক এগিয়ে।
সত্তর দশকে ‘টাইম’, ‘নিউজউইক’ নিয়মিত পড়ি, না কিনে নয়। আমাদের বালিতে তখন আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পি এল, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘ব্রডশিট’, চিন কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি সি-র মুখপত্র ‘পিকিং রিভিউ’ নিয়মিত আসে। সেইসঙ্গে ‘টাইম’, ‘নিউজউইক’। আশির দশকের প্রথম লগ্নে ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে ‘ইকনমিস্ট’, ‘প্রবলেমস অফ কমিউনিজম’, ‘টাইম’, ‘নিউজউইক’, ‘মস্কো নিউজ’, ‘নিউ টাইমস’— তখনই ‘টাইম’, ‘নিউজউইক’ পড়া অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকার এইসব ম্যাগাজিন আনাতেন।
আরও পড়ুন
ভোট, চোট, ফোট
পুরনো ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে ষাটের দশকে তিব্বতীয় ‘খাম্পা বিদ্রোহী’, দালাই লামা, তিব্বত থেকে তাঁর ভারতবর্ষে চলে আসা, সবই বিস্তারিত বেরয় ‘টাইম’ ও ‘নিউজউইক’-এ। ‘টাইম’-এর পুরো নাম ‘টাইম ম্যাগাজিন’।
আরও পড়ুন
সৌরেন বসু, অসীম চট্টোপাধ্যায়, অচলপত্র
আবার হাওড়া জেলার বালি আর তার জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতিতে ফিরি। বালিতে তারক গোঁসাই ছিলেন ষাটের দশকের কংগ্রেস-স্থাপত্য। তাঁর প্রভাব খুব। পুরো নাম তারক গোস্বামী— মুখে মুখে তারক গোঁসাই। যুব নেতা হিসাবে ছিলেন টুকুস ঘোষ। এটা ষাট-সত্তর দশকের কথা।
আরও পড়ুন
পূর্ণ নামে সুশীতল রায়চৌধুরীর দলিল
বালিতে বিধানসভা নির্বাচনে ১৯৬৭ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জেতেন। তিনি হারিয়ে দেন সি পি আই (এম) প্রার্থী পতিত পাবন পাঠককে। পতিত পাবন পাঠক সি পি আই (এম) প্রার্থী। নির্বাচনী প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। কংগ্রেস তখনও জোড়া বলদ— ভোট চিহ্নে।
আরও পড়ুন
চন্দ্রপোল্লা রেড্ডি মারা গেলেন কলকাতায়
শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অকৃতদার। পরনে খাদির হাফ পাঞ্জাবি। সেই খদ্দর বেশ খাপি ও মোটা। খদ্দরের পাড়হীন মোটা ধুতি প্রায় হাঁটুর কাছে। একটি লঝঝড়িয়া বাইসাইকেল। মাথার চুল কাশফুল। নাকের নিচে মোটা পাকা গোঁফ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পাকা আম যেন তাঁর গায়ের রঙ। পায়ে গান্ধীজি ডিজাইনের চপ্পল। বড়লোক বাড়ির ছেলে, জাতীয় কংগ্রেস করেন, বালিতে প্রায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় শৈলদা, অবাক হয়ে ভাবি এখন একবার কর্পোরেশনের কাউনসিলার নির্বচিত হলেই দু-দু খানা ‘স্করপিয়ো’। টাকার মনৎকার।
শৈলবাবু তো কংগ্রেস— জাতীয় কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। ১৯৬৭-তে পশ্চিমবাংলায় জাতীয় কংগ্রেস হেরে যায়। বামপন্থী— বিরোধীরা ইউ এল এফ আর পি ইউ এল এফ— এই দুটি জোট তৈরি করে নির্বাচন লড়েন। ইউ এল এফ-এর নেতৃত্বে সি পি আই (এম), পি ইউ এল এফ-এর নেতৃত্বে সি পি আই। ইউ এল এফ-এ সি পি আই (এম) ওয়াকার্স পার্টি, সম্ভবত বরদা মুকুটমণিদের বলশেভিক পার্টি, এস ইউ সি। এস ইউ সি তখনও এস ইউ সি আই বা এস ইউ আই (সি) হয়নি। এস ইউ সি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষ জীবিত। সুকোমল দাশগুপ্ত, শংকর সিং, ফটিক ঘোষ— সবাই বেঁচে। সুবোধ ব্যানার্জি আছেন। যিনি জিততেন জয়নগর থেকে। ‘ঘেরাও’ শব্দটিকে যিনি আভিধানিক মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে মূল ভূমিকায় ছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই নেতৃত্বাধীন পি ইউ এল এফ-এ আজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধাড়াদের বাংলা কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক, আর এস পি।
শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে ১৯৬৭ সালে জয়ী হলে তাঁকে নিয়ে, সাজানো জোড়াবলদ নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের মিছিল। দুটি বি-ই-শা-ল তাগড়া জোড়া বলদ। তার গায়ে ফুলের মালা। শিঙে টুনি বালব, চিড়িক-পিড়িক জ্বলে, নেভে। খুব ছোট বাল্ব, চন্দননগরের বলদের শিঙে। ব্যাটারিতে জ্বলছে, নিভছে। সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি, জাতীয় কংগ্রেসের তিন রঙা পতাকা। শৈলেন্দ্রবাবুর গলায় রজনীগন্ধার মালা। হাইব্রিড নয়, এমনি— সাধারণ রজনীগন্ধার মালা, গন্ধদায়ী। সেই মিছিল বালির শান্তিরাম রাস্তা দিয়েও গেল। সেটা ১৯৬৭ সালের মার্চ। বহু জায়গাতেই কংগ্রেস ধরাশায়ী। প্রফুল্লচন্দ্র সেন— মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন নির্বাচনে ধরাশায়ী, হুগলীর আরামবাগ বিধানসভা কেন্দ্রে। সদ্য জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগী বাংলা কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
পরাজিত অতুল্য ঘোষ জেএম বিশ্বাসের কাছে। জে এম বিশ্বাস রেল শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনের নেতা। অতুল্য ঘোষ পরাজিত হলেন সম্ভবত লোকসভা আসনে, বাঁকুড়া থেকে কী?
তখন রাস্তায় রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে ল্যাম্পপোস্টে যে বালব, তাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে লাল কাগজে। সারা পশ্চিমবাংলাতেই এক চেহারা। হাওড়াকে ‘বলদ নগর’ এই বিশেষণ দিয়েছিলেন বিরোধীরা, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই (এম)। হাওড়ায় এক সময় আর সি পি আই— রেভেলিউশানারি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া এবং সাধারণতন্ত্রী দল নামে একটি দল সক্রিয় ছিল। হাওড়া পুরভোটে একবার জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী সর্বদলীয় বিরোধী জোট তৈরি করে নির্বাচনী ফলাফলে বিরোধীরা জেতেন ও ক্ষমতা দখল করেন, পুরসভায়— মিউনিসিপ্যালিটিতে। না ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই, সাধারণতন্ত্রী দল, আর সি পি আই ছিল এই জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী নির্বাচনী জোট।
সাধারণতন্ত্রী দলের হাতে লেখা পোস্টার দেখেছি আশির দশকে, হাওড়া আর কলকাতায়। শীতে গায়ে চাদর আর ধুতি, গরমের দিনে সুতির শার্ট আর ধুতি পরা একজন সাধারণতন্ত্রী দলের নেতার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল।
হাওড়ার মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী জোটের মূল পরিকল্পক প্রশান্ত সরকার। পরে যিনি একই সঙ্গে ‘স্টেটসম্যান’, ‘ব্লিৎস’, ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, ‘সাপ্তাহিক দর্পণ’, ‘স্প্যান’ ও ‘লাইফ’-এ সাংবাদিকতা করতেন। ‘ব্লিৎস’ সাপ্তাহিক, মালিক বি কে করঞ্জিয়া। তিনি শিল্পপতি। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল নাসের তাঁর বন্ধু। নাসের খুবই রঙদার, রঙিন মানুষ। সোভিয়েত লবির সঙ্গে বরাবর। ইজরায়েলের জানি দুশমন। ইজরায়েলের সঙ্গে ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধে ইউ এ আর ও নাসেরের পরাজয় নাসেরকে খানিকটা খর্ব করে রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সোভিয়েত ব্লক। ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশ— পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, এনভার হোকসার, আলবানিয়া বা আলবেনিয়া আর মার্শাল টিটোর যুগোশ্লাভিয়া এই সামরিক জোটের বাইরে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনদের সেন্টো, সিয়াটো, ন্যাটো। এই সব সামরিক জোটে পাকিস্তান, তুরস্ক। ঠাণ্ডা যুদ্ধ— কোল্ড ওয়ারের আবহাওয়া পেকে উঠছে ক্রমশ ক্রমশ। ক্যুবার মিসাইল ক্রাইসিস।
ভারত জোট নিরপেক্ষ— গুট নিরপেক্ষ আন্দোলনে। পঞ্চশীল। চিন, যুগোশ্লাভিয়া, মিশর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া।
থাক সে সব কথা আমরা বরং আবার বালির ভোটের রাজনীতি, ভোট প্রচারে ফেরার চেষ্টা করি। তবে তার আগে হাওড়ার মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে যে জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী নির্বাচনী জোট, তার রূপকার প্রশান্ত সরকারের কথা বলি। প্রশান্তদা না ভাঙা সি পি আই করতেন ‘ধরণী’ এই টেক নেম নিয়ে। তখন তো রণদিভে পিরিয়ড। যতদূর জানি প্রশান্ত সরকার বহিষ্কৃত হন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সাধারণভাবে আমাদের দেশে যে কোনো কমিউনিস্ট পার্টি থেকে কাউকে বার করে দিতে গেলে হয় মহিলা, নয়তো অর্থ তছরুপের অভিযোগ দেওয়া হয়। তার সঙ্গে শৃঙ্খলাভঙ্গ। রেনিগেড। রেনিগেড। রেনিগেড শব্দটি খুব চেনা বদনাম কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে।
প্রশান্ত সরকার জুট— পাট শ্রমিক বেল্টে পার্টি সংগঠনের কাজ করতেন। তার আগে তিনি সশস্ত্র পথে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা ডকেও কিছুদিন শ্রমিক সংগঠন করেন প্রশান্ত সরকার। বহু বছর পর— আশির দশকে তাঁর মুখে আফশোস শুনেছি— কিন্নর, কী বলব তোমায়। জুট বা ডক— যে কোনো রেফারেন্স দিতে গেলে আজও আমাদের— মানে কমিউনিস্ট পার্টির ভরসা ‘স্টেটসম্যান’, ‘টাইমস অফ ইনডিয়া’। যত ডাটা, স্ট্যাটিসটিকস— সব সেখান থেকেই। এমন কি যে কোনো তর্কসভায়, পার্লামেন্টে, অ্যাসেমব্লিতে— সর্বত্র সেই ‘স্টেটসম্যান’, সেই টাইমস অফ ইনডিয়ার রেফারেন্স, তথ্য। কমিউনিস্ট পার্টির আজ পর্যন্ত কোনো ডাটা ব্যাঙ্ক হল না। যে ডাটার ওপর ভরসা করে কমিউনিস্টরা কথা বলতে পারে।
এই দৈন্য আজও। এখন— মানে বেশ কয়েক বছর গুগল, ইন্টারনেট খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। সবাই সেই পুকুরে ঘটি ডোবাচ্ছেন। আর গুগল যে সর্বশক্তিমান, নির্ভুল, তাই বা কে বলল?
হাওড়া জেলায় ‘স্বদেশী’ করা ‘গুপ্ত সমিতি’র লোকজন ছিলেন। হুগলিতেও। তাঁরা সবাই বোমা-পিস্তলের লাইনে বিশ্বাসী। ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁদের বলত, ‘টেরোরিস্ট’— ‘সন্ত্রাসবাদী’। পরবর্তী সময়ে এঁরা অনেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে। অথবা আর সি পি আই-তে। ষাট, সত্তর, আশি ছিল অন্য একটা সময়। অন্তত কমিউনিস্ট বা র্যােডিক্যালরা এমনটাই মনে করতেন। ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’— কোল্ড ওয়ার-এর পর্ব চলছে তখন।
বি কে করঞ্জিয়া এবং তাঁর ‘ব্লিৎস’ নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকটির কথা বলেছি। তখনও হিন্দি ও উর্দুতে সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’ বেরয়নি। পরে আশির দশকে ‘ব্লিৎস’ হিন্দি আর উর্দুতে বেরতে থাকে।
‘ব্লিৎস’ সবসময়ই একটু সেনশানাল খবর পরিবেশনে বিশ্বাস করত। করতও। ‘ব্লিৎস’-এর মালিক-সম্পাদক বি কে করঞ্জিয়া বিষয়ে বেশ কয়েকটি কাহিনী বলেছিলেন প্রশান্ত সরকার। খুব আকর্ষণীয় সেই সব ঘটনা। পরে কখনও বলা যাবে সেইসব কথা প্রসঙ্গে।
বি কে করঞ্জিয়া পার্শি। তাঁর সাপ্তাহিক কাগজের বিক্রিও তখন যথেষ্ট। ট্যাবলয়েড সাইজের ‘ব্লিৎস’।
‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক থাকার সময় লন্ডনের দৈনিক ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর করেসপনডেন্ট ছিলেন প্রশান্ত সরকার। জ্যাক প্রেগার বলে একজন সাহেব এই কলকাতায় রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথ-অসুস্থ— ডেসটিটিউডদের তুলে নিয়ে এসে মাদার টেরিজার হোম বা অন্য কোথাও পৌঁছে দিতেন।
প্রশান্তদা একদিন ঘুরে বেড়ালেন অনেকক্ষণ মাথায় কাপড়ের কানাতঅলা, সাদা— বড় টুপি দেওয়া জ্যাক প্রেগারের সঙ্গে। তারপর সেই রিপোর্ট ছবি সহ বেরল ‘দৈনিক বসুমতী’, লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ।
‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ তার সম্পাদকীয় নীতি— এডিটোরিয়াল পলিসিতে টোরি কনজারভেটিভদের সমর্থক। অসম্ভব অ্যানটি কমিউনিস্ট, অ্যানটি লেফট, অ্যানটি লেবার পার্টি।
ইংল্যান্ডে তখন লেবার পার্টির প্রভাব ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু। উড্রো উইলসনের যুগ ও প্রভাব ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে বা এসেছে। টোরি পার্টি এবং তাদের তথাকথিত ‘লৌহমানবী’ মার্গারেট থ্যাচার বা ম্যাগি থ্যাচার ক্রমশ প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন ব্রিটেনের রাজনীতিতে। প্রশান্ত সরকার বহু বছর প্রয়াত। ‘ব্লিৎস’ বন্ধ, সেও অনেক বছর হয়ে গেল। সমাজসেবী— সোশ্যাল ওয়ার্কার জ্যাক প্রেগারের সাদা-কালো ছবি কোনো একটি ইংরেজি দৈনিকে দেখলাম— ন্যাশনাল ডেইলি। দেখে মনে হল তিনি কালের নিয়মে, খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশ বৃদ্ধ হয়েছেন। যেমন সবাই হয়ে থাকে।
Powered by Froala Editor