সৌরেন বসু, অসীম চট্টোপাধ্যায়, অচলপত্র

মুছে যায়? — ৩৭
আগের পর্বে

সরোজ দত্ত শশাঙ্ক ছদ্মনামে লিখতেন সাপ্তাহিক দেশব্রতী পত্রিকায়। সেখানে উপস্থাপিত হত মনীষীদের নিয়ে অর্ধসত্য কাহিনী। সমর্থন জানানো হত মনীষীদের মূর্তিভাঙাকে। সুশীতল রায়চৌধুরী 'পূর্ণ' নামে মূর্তিভাঙার বিরোধিতায় দলিল পেশ করেন। নাম 'মূর্তি ভাঙা প্রসঙ্গে'। ১৯৭০ নাগাদ গোপনে হাতে হাতে ঘুরছে সে বই। অন্যদিকে পুলিশের চোখে মোস্ট ওয়ান্টেড সুশীতল রায়চৌধুরী। তবে পুলিশের চোখ এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে মারা যান তিনি। তারপর...

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের কথা এখনও মনে পড়ে। রোমাঞ্চিত হই। মনে পড়ে তাঁর আত্মপ্রত্যয় সম্পন্ন রাজনৈতিক উচ্চারণ। সেই কথা তো সত্যিই হতে চলল প্রায় ভারতের ইতিহাসে। প্রায় কেন, সবটাই হল। ভারতের ইতিহাস নিয়ে অতি বিখ্যাত গ্রন্থ নির্মাতা ই এম এস। তাঁর কথার গুরুত্বই আলাদা।

‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে ১৯৭৯-৮০ সালে বেশ কয়েকবার এসেছেন সৌরেন বসু। খুবই সিম্পল মানুষ। প্যান্ট-শার্ট। ফুলপ্যান্ট, ফুলশার্ট। চোখে চশমা। তখন প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’র সম্পাদক। সৌরেন বসু চিনে গিয়ে বুঝতে পারেন চিন কমিউনিস্ট পার্টি ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চিনের পথ আমাদের পথ’— সত্তর দশকের গোড়া থেকে সি পি আই (এম-এল)-এর পক্ষে দেওয়ালে দেওয়ালে, পোস্টারে পোস্টারে লেখা এই স্লোগানকে সমালোচনা করছে। সি পি সি-র এই যে সমালোচনা, তা মূলত চৌ-এন-লাইয়ের কাছ থেকেই শোনা। চৌ-এন-লাই তখন চিনের প্রধানমন্ত্রী।

সৌরেন বসু গোপনে চিনে গেছিলেন। ফিরেও আসেন গোপনে। ফিরে এসে ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ নামের ইংরেজি দৈনিকে সম্ভবত দুই বা তিন কিস্তিতে একটি লেখা লেখেন, এই বিষয়টি নিয়ে।

সেই লেখা ছাপা হওয়ার পর বিপুল হইচই পড়ে যায়। সৌরেন বসুকে রাজনৈতিক গালাগাল দেওয়া শুরু হয়ে যায়। সি পি আই (এম-এল)-এর কোনো কোনো ফ্র্যাকশান থেকে। সৌরেন বসুর ডাক নাম ভদু বসু। তাই ভদু বসু নামটিকে সামনে রেখেও চলে কুকথার স্রোত। 

আরও পড়ুন
পূর্ণ নামে সুশীতল রায়চৌধুরীর দলিল

এমনিতে সি পি আই (এম-এল)-এর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল লিন-পি-য়াও পন্থী। তাঁরা ‘দেশব্রতী’ প্রকাশ করতেন গোপনে। এটা ১৯৭৩ সালের কথা। দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি দাবি করত মাও-সে-তুঙ চৌ-চক্রের হাতে বন্দি। চিয়াং-চিং— সুন্দরী অপেরা গায়িকা চিয়াং চিং, যিনি মাও-সে-তুঙের থেকে অনেকটা ছোট, তিনি ছিলেন মাওয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী।

চিনের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি সি মাও-উত্তর চিনে গ্যাং অফ কোর-কে কার্যত কচুকাটা করে। সে সব বিস্তৃত বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে।

আরও পড়ুন
চন্দ্রপোল্লা রেড্ডি মারা গেলেন কলকাতায়

সৌরেন বসু ‘দৈনিক বসুমতী’-র চারের পাতায় উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন। পরে ‘দৈনিক বসুমতী’-র শারদীয় সংখ্যায় নকশালবাড়ির আন্দোলন, সেই আন্দোলনের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বহু কথা বলেন।

প্রশান্ত সরকার অসীম চট্টোপাধ্যায়কে দিয়েও ‘দৈনিক বসুমতী’র শারদীয় সংখ্যায় লেখান। এর কিছুদিন পরই অসীম চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেন তাঁর নিজস্ব সংগঠন সি আর এল আই— কমউনিস্ট রেভেলিউশানারি লিগ অফ ইন্ডিয়া। সি আর এল আই-এর ট্যাবলয়েড— মুখপত্র ছিল ‘সাম্যবাদী পথে’।

আরও পড়ুন
ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কয়েকটি টুকরো

অসীম চ্যাটার্জি তাঁর তখনকার রাজনৈতিক অবস্থানে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব— কালচারাল রেভেলিউশানকে সমর্থন করছেন। চলে যেতে চাইছেন বারানসী— নির্জনে পড়াশুনো করবেন বলে। হান্টারের ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ তিনি অনুবাদ করেছেন। আর তা বেরিয়েছে ‘সুবর্ণরেখা’ থেকে।

সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথ মজুমদার এই বইটির প্রকাশক। অসীম চট্টোপাধ্যায় তখন প্রায়ই ইন্দ্রনাথ-সকাশে যান। আমি যে সময়ের কথা লিখছি, ১৯৮১-৮২ সাল টাল হবে, তখনও প্রথম স্ত্রী রমাদির সঙ্গে অসীমের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। রমাদি তখন ‘দৈনিক বসুমতী’ নয়, ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর গ্রন্থাগারে চাকরি করেন। তাঁর ও অসীমের দুই কন্যা। রমাদি খুবই শান্ত ও পরিশীলিত। তাঁর মুখে সব সময়ই একটা বিষাদঘন ছায়া।

আরও পড়ুন
নাগভূষণ পট্টনায়ক ও আই পি এফ

বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের লাইব্রেরিতে শান্তি চট্টোপাধ্যায় নামে আর একজন কর্মচারী ছিলেন। শান্তিদা নিঃসন্তান। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর শান্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক সময়ের প্রায় হরিহর আত্মা বন্ধু। প্রাণতোষ ঘটকের সম্পাদনায় যখন মাসিক ‘বসুমতী’ বেরত আর জয়ন্তী সেনের সম্পাদনায় যখন সাপ্তাহিক ‘বসুমতী’ বেরত, তখন ওঁরা কর্মসূত্রে একই বিভাগের অধীন ছিলেন। পরে তো বসুমতী বন্ধ হয়ে গেল। প্রখ্যাত আইনজীবী অশোক সেনের মালিকানাধীন ‘বসুমতী’ আর রইল না। ঘটক পরিবার— প্রাণতোষ ঘটকের পরিবারের ‘বসুমতী’ও আর রইল না। কাগজ, পাবলিকেশন— সব বন্ধ হল। তারপর আবার জাতীয় কংগ্রেসের জমানায় খুলল বসুমতী। অধিগ্রহণ করা হল তাকে। সরকারই করল।

অসীম চট্টোপাধ্যায় রমাদির সঙ্গে বিবাহবন্ধন আইনগতভাবে ছিন্ন করার পর নতুন করে বিবাহ করলেন। তখন তিনি হাজরায় মহারাষ্ট্র নিবাসের উল্টোদিকে একটি ফাঁকা বাড়িতে থাকেন। পাশেই ‘স্ট্যামাক’ নামে একটি ওষুধের কোম্পানি, সেই ওষুধ কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়, জীর্ণ চেহারা বাইরে থেকেই বোঝা যায়। অসীম চট্টোপাধ্যায় তখন ‘স্ট্যামাক’-এ ইউনিয়ন করেন— সি আর এল আই-এর ব্যানারে।

এর কিছু আগেই জেল থেকে বেরনোর পর অসীম চট্টোপাধ্যায় কানু সান্যালের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে খানিকটা কাছাকাছি আসেন। এই সময়টাতেই অসীম চট্টোপাধ্যায় তাঁর টেকনেম ‘কাকা’ ছেড়ে দিতে চাইছেন, এটা তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হত।

সি আর এল আই-এর কিছু কিছু কর্মী ছিল হুগলির উত্তরপাড়ায়— দুলাল, সমন্বয়, ডাবলিং-এই সব ছিলেন তাদের নাম। সি আর এল আই থেকে নতুন কোনো কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করার কথা ভাবতেন অসীমবাবু। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে তিনি সি পি আই (এম)-এর নির্বাচনী প্রতীক কাস্তে হাতুড়ি তারা নিয়ে বিধানসভায় দাঁড়ান ও সম্ভবত জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী ডা. হৈমী বসুর কাছে পরাজিত হন।

পরে— এর বছর বছর পর ২০১১-তে সম্ভবত তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক চিহ্ন নিয়ে মানব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, বিধানসভা নির্বাচনে। পরাজিত হন।

অসীম চট্টোপাধ্যায় একটা কথা খুব বলতেন আশির দশকে— ‘নকশালদের পথ ছাড়। নকশালবাড়ির পথ ধর।’ কানু সান্যালের সঙ্গে অসীম চ্যাটার্জির এই রাজনৈতিক সমঝোতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে এর মধ্যে কানু সান্যালের লেখা তরাই রিপোর্ট নতুন করে প্রকাশিত হয়।

এটি ছিল সত্তর দশকের একেবারে গোড়ায় ‘দেশব্রতী’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত পুস্তিকা। ‘তরাই রিপোর্ট’ নতুন করে ছাপা হল। বিক্রিও হল বেশ। এই পুস্তিকা কাম বইটি এখন আর ছাপা নেই। পাওয়াও যায় না।

১৯৭৯-৮০ সালে অসীম চট্টোপাধ্যায় হান্টারের অতি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ ছাড়া আরও কয়েকটি বই অনুবাদের কাজ করেন।

কানু সান্যাল সবুজ সেন ইত্যাদিদের নিয়ে সি ও আই (এম-এল) তৈরি করেন। সেই সংগঠনও ভাঙে। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন কানু সান্যাল। সুশীতল রায়চৌধুরী এবং কানু সান্যাল— দুজনেই যেন একটু কম আলোচিত। বিপ্লবী ফোকাস বা ফ্ল্যাশগানের বাইরে।

কানু সান্যাল নিজে একটি প্রায় ভাঙা ঘরে থাকতেন। সেটিই তাঁর পার্টি অফিস কাম কমিউন। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন কানু সান্যাল। সেদিন কলকাতার একটি বহুতলে আগুন লেগেছিল। সেই বহুতলের মধ্যে অনেক অনেক অফিস।

কানু সান্যালকে নিয়ে স্বপ্নে কল্পনায়, তাঁর জীবন রেখা নিয়েও হয়ত, আবার নয়ও তা পুরোপুরি, একটি আখ্যান নির্মাণ করেছিলাম বহু বছর আগে, ‘অন্ধ কোকিলের গান’। সেই আখ্যানে আছে মায়াকোভস্কি, জীবনানন্দ দাশ আর কানু সান্যালের আত্মহত্যা ঘোর।

রিভলভারের বুলেট, শক্ত দড়ি, ট্রামের সামনে ঝাঁপ— সব মিলয়ে অমীমাংসিত কুহক। কানু সান্যাল সাঁতরে মেচি নদী পেরোচ্ছেন এমন একটা কথা-কল্পনা-বাস্তব থেকে শুরু হয়েছে আমার আর একটি আখ্যান ‘দ্রোহী’।

নকশালবাড়ির যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কথা বলা হয় বার বার, তার চূর্ণ কিছু ছড়িয়ে আছে আমার নানা আখ্যানে। নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য আরও অনেক কিছু নিয়ে।

যা বলছিলাম একটু আগে।

কানু সান্যাল সত্যি সত্যি তাঁর যতটা ‘রাজনৈতিক গ্ল্যামার’ পাওয়ার কথা ছিল, পাননি। সুশীতল রায়চৌধুরীও না। আসলে কানুবাবু, সুশীতলবাবুরা যখন রাজনীতি করতে এসেছেন আর যে রাজনৈতিক তরঙ্গের ডামাডোল— অগ্নিপথ পেরিয়ে তাঁরা নিজেদের জীবন দৌড় শেষ করেছেন, সে এক অতি বি-ই-শা-ল ব্যাপার।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিষান চ্যাটার্জিকেই বা মনে রেখেছি আমরা ক’জন? কিষান চ্যাটার্জি ছিলেন মূলত বীরভূমের মানুষ। পড়াশোনা সূত্রে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর নকশালবাড়ির আন্দোলনের সঙ্গে। কিষান চ্যাটার্জির ভাই শ্রীকুমার চ্যাটার্জি আমাদের শিক্ষক ছিলেন— বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়-এর ১৯৬৮-৬৯ সালে।

শ্রীকুমারদা আমাদের ইংরেজি পড়াতেন।

উত্তরবঙ্গে কানু সান্যালের বাড়ি কাম অফিসে গেছি। খুবই জীর্ণ ঘর। অকৃতদার এই মানুষটি সারা জীবন থেকে গেছেন গরীব মানুষের সঙ্গে। খুব সাধারণ জামা-কাপড়। অতি অর্ডিনারি আহার। একেবারে কমিউন জীবনের আদি সংস্করণ যেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুমিতা সান্যাল কানু সান্যালের আত্মীয়— এমনই শুনেছি। অতি সাধারণভাবে জীবন কাটাতেন তিনি। একা, একা, কোনো নিঃসঙ্গ নক্ষত্র। কোনো ডকুমেন্টেশন নেই, এত বড় একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী, নাহ, কিছু নেই।

বিদেশে কিন্তু এরকম হয়ই না। কিছু না কিছু থাকে। ধরুন রেবতী বর্মণ, মণিকুন্তলা সেন, ইলা মিত্র, রেণু চক্রবর্তী, এঁদের বিষয়ে তেমন ডকুমেন্টেশন কই। রেবতী বর্মণ কত কষ্ট করে ‘বর্মণ পাবলিশিং হাউস’ চালাতেন ও মার্ক্সবাদী চিন্তার ওপর ভিত্তি করা বিভিন্ন বই, পুস্তিকা ছাপতেন। নিজেও চিন্তক ছিলেন তিনি। বই প্রকাশিত হত।

রেবতী বর্মণ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন, এমন শুনেছি। মণিকুন্তলা সেনের আত্মকথা বেরিয়েছিল নবপত্র প্রকাশন থেকে। নবপত্রর প্রতিষ্ঠাতা, সমরেশ বসু, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তদের বিশেষ বন্ধু প্রসূন বসু মারা যাওয়ার পর হতশ্রী দশা নবপত্র প্রকাশন-এর।

মণিকুন্তলা সেনের আত্মজীবনী সম্ভবত আর ছাপা নেই এখন। শুনেছিলাম তিনি শেষ জীবনে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রয়ী হয়েছিলেন। মণিকুন্তলা সেন না ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে কাস্তে-ধানের শীষ চিহ্ন নিয়ে দাঁড়াতেন কালীঘাট বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে জোড়া বলদ চিহ্ন নিয়ে দাঁড়াতেন বিভা মিত্র।

তখনও নির্বাচনে সাধারণভাবে ভোট প্রার্থীর নামের আগে ‘সমাজসেবী’ এই কথাটি প্রায় সব দলই লিখত। তখন জাতীয় কংগ্রেস ও অখিল ভারতীয় জনসংঘ-র টাকা পয়সা আছে। স্বতন্ত্র পার্টিও টাকা যথেষ্ট। কমিউনিস্ট ও অন্য অন্য বামপন্থী দলের পকেট ঢন ঢন। চা খাওয়ার পয়সা জোটে না প্রায়।

তখন টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মুন্দ্রা, ডালমিয়া— এরাই রাজত্ব করছে, ছড়ি ঘোরাচ্ছে পুঁজির মালিক হিসাবে। আম্বানি, মিত্তল, ওয়াদিয়ারা সব ভবিষ্যতের গর্ভে। বিড়লা বাড়ির আর্থিক কেচ্ছা, মুন্দ্রাদের আর্থিক নয়-ছয়, টাটাদের জিপ কেলেঙ্কারি— সবই পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ঘটে যায়।

দেবজ্যোতি বর্মণ সাতটি বিষয়ে এম এ। তিনি ‘যুগবাণী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। দৈনিক নয়। সেখানে বিড়লাবাড়ির আর্থিক নয়-ছয়ের এক দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপতে থাকেন তিনি। তা নিয়ে জল অনেকদূর গড়ায়।

দেবজ্যোতি বর্মণের এই রিপোর্টিং— প্রতিবেদন বাংলা ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম— অন্তর্তদন্তমূলক প্রতবেদনের প্রায় আদি রূপ। বেশ অল্প বয়সেই স্মভবত পঞ্চাশ ছোঁয়ার অনেক আগেই প্রয়াত হন দেবজ্যোতিবাবু। নানা ধরণের অসুখ বাসা বাঁধে তাঁর শরীরে। এছাড়া ‘যুগবাণী’-তে ছাপা খবর নিয়ে একের পর এক মামলা হতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে। সে সব নিয়ে প্রচুর স্ট্রেস, শরীর ও মনের ওপর ভয়ানক চাপ। ফলে অকাল মৃত্যু।

দেবজ্যোতি বর্মণ আর তাঁর সাহসী সাংবাদিকতা ও সম্পাদনা নিয়ে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে অনেক কথা বলেছেন বাঙালি— মূলত হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত। দেবজ্যোতি বর্মণ যেমন করেছিলেন, সেভাবে ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে সংবাদ-সাহিত্য নির্ভর পত্রিকা করা আজ প্রায় দূর আকাশের চাঁদ।

সত্তর দশকে সাপ্তাহিক ‘দর্পণ’, সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ এই রকম অন্তর্তদন্তমূলক সংবাদ ও প্রতিবেদন বিষয়ে অন্য ধরণের ধারা গড়ে তোলে। ‘অচলপত্র’ সম্পাদনা করতেন দীপ্তেন্দ্রনাথ সান্যাল বা দীপ্তেন সান্যাল। তিনি আবার নীলকণ্ঠ নামে সাহিত্যচর্চা করতেন। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম ‘বার্ধক্যের বারানসী’। দীপ্তেন্দ্রনাথ সান্যাল সম্পাচিত অচলপত্র, লোক মুখে মুখে ‘অচল’।  সেই অচলপত্র-র প্রথম পাতায় থাকত ফণী মনসার ছবি। পাশে ক্যাপশান থাকত ‘বড়দের পড়িবার ও ছোটদের দুধ গরম করিবার…।’ ‘অচলপত্র’ সম্পাদক দীপ্তেন্দ্রনাথ সান্যাল প্রয়াত হন যথেষ্ট অল্প বয়সে। ‘অচলপত্র’-র একটি নির্বাচিত সংকলন বেরয় নাথ পাবলিশিং হাউস থেকে। দীপ্তেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন প্রায় অন্ধ নেতাজি— সুভাষচন্দ্র পন্থী। একেবারে দেখতে পারতেন না পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, রাজাগোপালাচারীদের।

Powered by Froala Editor