মুছে যায় - ৩৬
আগের পর্বে
অন্ধ্র তো বটেই, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের অত্যন্ত পরিচিত চন্দ্রপোল্লা রেড্ডি মারা গেলেন কলকাতায়। পুলিশের চোখ এড়িয়ে কলকাতায় এক গোপন শেল্টারেই লুকিয়ে ছিলেন তিনি। আই এফ টি ইউ নেতা ফণী বাগচী তাঁর মৃত্যু সংবাদ এনে দেন। সেই খবর প্রথম ব্রেক করি পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এ। ফণীবাবু চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির হাফ প্যান্ট পরিহিত একটি সাদাকালো ছবিও দিয়েছিলেন। সে ছবি ‘প্রতিক্ষণ’ ছাপেনি। কয়েকদিন পর স্টেটসম্যান তাঁর দাহকার্যের পরে বড়ো করে প্রকাশ করে খবরটি। তারপর…
ফণী বাগচী— আই এফ টি ইউ নেতা ফণী বাগচী কলকাতা-দিল্লি-অন্ধ্র প্রায়ই করতেন সংগঠনের কাজে। তিনি সাধারণত যাতায়াত করতেন ট্রেনে। মাঝে মাঝে বেশ কয়েকদিন অনুপস্থিত। ওয়াটগঞ্জে তাঁর অফিস-কাম কমিউন কাম শোয়ার জায়গা, সেখানে গিয়ে দেখি দরজায় তালা। আমার তখন কোনো ফোন কানেকশান নেই। ল্যান্ড লাইন না, মোবাইল ফোন তো কোন দূর স্বপ্ন। ফণীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া মানে আন্দাজেই একরকম।
তাঁর কমিউন কাম থাকার জায়গাটিতে পৌঁছতে গেলে সরু, পাকা, খোলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে হয়। খোলা অর্থে সিঁড়ির মাথায় কোনো ছাউনি বা আড়াল নেই। ফলে গ্রীষ্মের রোদ, বর্ষার বৃষ্টি অবাধে নেমে আসে। কলকাতার অ্যাসিড-আক্রান্ত বৃষ্টিতে সেই সিমেন্টের বাঁধান সিঁড়ি ক্রমশ বিপজ্জনক অতি পিচ্ছিল হয়ে ওঠে।
সেই সময় এলাকাটা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা কলিমুদ্দিন শামস আর জাতীয় কংগ্রেস নেতা রামপেয়ারে রামের মধ্যে অলিখিত ভাগাভাগি করা আছে। খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট খুব দূরে নয়। সেখানে ‘বিলিতি’— ‘ফোরেন’ জিনিসপত্র প্রচুর। তার মধ্যে ছাতা, ঘড়ি, ক্যামেরা, লাইটার, সিগারেট, রেজার, ইলেকট্রনিক রেজার, সাবান, পারফিউম— সবই ফোরেন ছাপ। ‘কোবরা’ নামে পারফিউমটির কথা তখনই শুনি। ‘ইভনিং ইন প্যারিস’ নামের পারফিউমও তখন খুব চলে, মানে যাদের পকেটে পয়সা আছে যথেষ্ট, তাদের জন্য।
কলকাতা ডকে তখন জাহাজ কম আসে। হুগলি নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া প্রচুর পলি, নদী বক্ষে। নতুন নদী বন্দর হিসাবে অবিভক্ত মেদিনীপুরের হলদিয়া বন্দর মাথা তুলছে ক্রমে। কলকাতা পোর্ট তার আভিজাত্য হারিয়েছে।
আরও পড়ুন
চন্দ্রপোল্লা রেড্ডি মারা গেলেন কলকাতায়
অথচ ডক বলতে তো বোঝাত খিদিরপুর ডক। সেখানে অতিকায় সব বিদেশি জাহাজ। জাহাজের ভোঁ। বিদেশি মাল— জামা, কাপড়, শাড়ি, বে-আইনি লিভলবার, গুলি, মদ, সিগারেট, কাঁচি, ঘড়ি, ক্যামেরা, পারফিউম— কী নেই? কোনো কোনো বাংলা সিনেমাতে কলকাতার খিদিরপুর ডক আর তার আশপাশকে দেখান হয়েছে গুণ্ডা, সমাজবিরোধী— অ্যান্টিসোশালদের ডেন হিসাবে।
আবছা আবছা কুয়াশায় ঢাকা সিনেমা ফ্রেম। তার মধ্যেই সরু পায়া প্যান্ট, চকরা বকরা শার্টি, গলায় বাঁধা রুমাল, মাথায় হ্যাট, থুতনিতে ফ্রেঞ্চকাটঅলা, অথবা গালে দাড়ি সমেত টিপিক্যাল ভিলেন। এরকম একটি ছবিতে প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার শম্ভু মিত্র ছিলেন, মনে পড়ছে।
আরও পড়ুন
ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কয়েকটি টুকরো
ফণী বাগচী চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন চাপা গলায়। তখন ঘন দুপুর। এই বাড়ির একতলার ঘরে ঘরে যে বেশ্যারা, তাঁদের রান্নাশাল থেকে ঝাঁঝাল মশলা— মূলতও পেঁয়াজ— রসুন ভাজার, নাক জ্বালানিয়া কটু গন্ধের সঙ্গে ভেসে আসছে পায়খানার বদগন্ধ। এইসবের মধ্যেই সি পি আর— চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির মৃত্যুর খবর শোনাচ্ছেন ফণী বাগচী। কি রকম অদ্ভুত আর আশ্চর্য মনে হয় না গোটা ব্যাপারটা।
আগেই বলেছি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তেভাগা-তেলেঙ্গানা পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি করা পুরুষদের মধ্যে খাকী হাফ প্যান্ট পরার একটা প্রবণতা ছিল। বি টি আর— বি টি রণদিভে, পি সুন্দরাইয়া, একে গোপালন, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ— সকলেই হাফ প্যান্ট। এমনকি জ্যোতি বসুও।
আরও পড়ুন
নাগভূষণ পট্টনায়ক ও আই পি এফ
কিন্তু এই হাফ প্যান্ট সংস্কৃতি চীন নাকি সোভিয়েত ইউনিয়ন, কার ধারাবাহিকতায় প্রবেশ করল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ব্যবহারিক জীবনে, সেই প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে আমার কাছে।
আমি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি বা চীন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর নিয়মিত হাফ প্যান্ট কালচার অন্তত ছবিতে দেখিনি। ক্যুবার বিপ্লবীদের হাফ প্যান্ট নয়। সব ফুল প্যান্ট-ট্রাউজার।
আরও পড়ুন
তেলেনাপোতা, ছেঁড়া তমসুক— সিনেমা
পরাধীন ভারতবর্ষে পুলিশ, চা বাগানের ম্যানেজার, এর সব খাকী হাফ প্যান্ট। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পরও পুলিশের হাফ প্যান্ট অদৃশ্য হতে সময় লেগেছে। চা বাগানের ম্যানেজারদের বেলাতেও তাই।
জীবজন্তু শিকারে হাফ প্যান্ট অনেকটা যেন অবশ্যপ্রয়োজনীয় ছিল।
পুনরায় চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির কথায় ফিরি। মৃত্যু এমন একটা জিনিস, যা অবশ্যম্ভাবী। তাকে এড়ানর উপায় কারও নেই। সেখানে সাধু, বিপ্লবী, গণিকা, রাজা, ভিক্ষুক— সবাই সমান।
সি পি আর কলকাতার এক আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে প্রয়াত হলেন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে। সি আই ডি, ডি আই বি— সকলের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে, রাষ্ট্রের নজরদারি থেকে।
চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি, নাগি রেড্ডিদের নাম খুব বেশি করে উচ্চারিত হতে থাকে সি পি আই (এম)-এর বর্ধমান প্লেনামের পর, অন্তত এই বঙ্গে। ওঁরা খুবই নামি অন্ধ্রের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান প্লেনামের পর যখন সি পি আই (এম)-এর ‘অফিসিয়াল লাইন’ জারি হল, পরাজিত হলেন র্যাডিক্যালরা ভোটাভুটিতে, তার পরেও তৈরি হওয়া সি সি সি আর-এর বাইরে থাকা নাগি রেড্ডি, পোল্লা রেড্ডি— চন্দ্রপোল্লা রেড্ডিরা ধীরে ধীরে সি পি আই (এম-এল)-এর হাতার ভেতরে এলেন আবার ‘চারু মজুমদার লাইন’-এর সঙ্গে তাঁদের তীব্র মতভেদ হওয়ায় বেরিয়েও গেলেন পার্টি – সি পি আই (এম-এল) থেকে। তখন অবশ্য বলা হল সি পি আই (এম-এল)-এর অফিসিয়াল লাইন— চারু মজুমদার পন্থী লাইন বের করে দিয়েছে তাঁদের। শহরে পোস্টার পড়ল সি পি আই (এম-এল)-এর নামে নাগি রেড্ডি, চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডিদের বিরুদ্ধে।
কলকাতার প্রমোদ সেনগুপ্ত, ‘নয়া ইশতাহার’ নামে পত্রিকা গ্রুপের পীযূষ দাশগুপ্ত, তাঁরই ভাই পরিমল দাশগুপ্ত— যিনি ‘কমিউনিস্ট’ বলে একটি বাংলা রাজনৈতিক ট্যাবলয়েড বার করেছিলেন সত্তর দশকের গোড়ায়, সব মিলিয়ে সি পি আই (এম-এল)-এর বাইরেই অনেক অনেক মতাদর্শ, তর্ক-বিতর্ক। পারস্পরিক দোষারোপ— ‘সংশোধনবাণী’, ‘বিলোপবাদী’ ইত্যাদি প্রভৃতি বিশেষণ। তিক্ততা, সন্দেহ, অপবাদ। মিথ্যা প্রচার।
সুশীতল রায়চৌধুরী— যিনি মূর্তিভাঙার রাজনীতির বিরুদ্ধে পূর্ণ-র নামে একটি দলিল পেশ করেন। সি পি আই (এম-এল)-এর সরোজ দত্ত ও চারু মজুমদার যুব-ছাত্রদের মূর্তি ভাঙার ‘স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগকে’ সমর্থন জানালেন। চিহ্নিত করলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসাবে। এস ডি— সরোজ দত্ত সাপ্তাহিক ‘দেশব্রতী’তে শশাঙ্ক নামে লেখা নিয়মিত কলামে লিখলেন, ওরা গান্ধীর মূর্তি ভাঙছে মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি স্থাপন করবে বলে। মূর্তি ভাঙা ও ছবি পোড়ানর তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ— কেউই বাদ রইলেন না। সে এক ভয়ঙ্কর কালাপাহাড়ি বেলা। সরোজ দত্ত শশাঙ্ক ছদ্মনামে সাপ্তাহিক দেশব্রতী পত্রিকায় কবে সুভাষচন্দ্র কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র থাকার সময় সাফাই কর্মীদের ধর্মঘট জোর করে ভাঙিয়েছিলেন, কবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দিয়েছিলেন সিপাহি বিদ্রোহ— মিউটিনি দমন করতে আসা ইংরেজ সৈন্য— গোরি পল্টনের জন্য, আচার্য পি সি রায় কীভাবে ‘দালালি’ করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের, ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ তৈরি করতে গিয়ে, এমন সব অনেক অর্ধসত্য তখন বেরিয়ে আসছে মনীষীদের মূর্তি ভাঙার সমর্থনে। ১৯৬৭-তে প্রথম অকংগ্রেসি মন্ত্রীসভা-যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পর এস ইউ সি-র সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছিলেন পূর্তিমন্ত্রী। মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি কলকাতায় রাখা ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও সেনাপতিদের মূর্তি সরানর ব্যবস্থা করেন।
মৃণাল সেন তাঁর ‘ইন্টারভিউ’ নামের চলচ্চিত্রে বিষয়টি খানিকটা ধরে রাখেন। তারপর সি পি আই (এম-এল)-এর কর্মসূচির থেকেও সরোজ দত্তর অতি উৎসাহী লেখালেখি এবং চারু মজুমদারের সমর্থনে মূর্তি ভাঙা ছবি পোড়ান, স্কুল-কলেজ ভাঙা, ল্যাবরেটারিতে আগুন দেওয়া, স্কুল-কলেজ পোড়ান— সবই এসে যেতে থাকে এই কর্মসূচির স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে।
সুশীতল রায়চৌধুরী পূর্ণনামে মূর্তিভাঙার বিরোধিতায় দলিল পেশ করেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ দলিল হাত ঘুরে ঘুরে গোপনে এসে পৌঁছয়। সেটা ১৯৭০ সাল। সুশীতল রায়চৌধুরী তখন পুলিশের খাতায় ‘মোস্ট ওয়ানটেড’। তাঁকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে পুলিশ। জীবিত অথবা মৃত সুশীতল রায়চৌধুরীকে চাই তাঁদের। ১৯৭০-এ হুগলির একটি নার্সিংহোমে প্রয়াত হলেন সুশীতল রায়চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুর পর এই তথ্য জানতে পারে প্রশাসন— সুশীতলবাবু ছিলেন এই নার্সিংহোমে এবং প্রয়াত হয়েছেন এখানেই।
চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির ক্ষেত্রে যেমন, পুলিশ তাঁকে জীবিত অবস্থায় ধরতে পারেনি, সুশীতল রায়চৌধুরীর বেলাও তাই। ফণী বাগচী আই এফ টি ইউ-এর সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। একই সঙ্গে চন্দ্রপোল্লাপন্থী সি পি আই (এম-এল)-এরও তিনি নেতৃত্ব স্থানীয়। তাঁদের কাগজপত্র, লিফলেট, বুলেটিন, সবই দিতেন তিনি। আমি অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে সময়ের দলিল হিসাবে সংগ্রহ করে রাখতাম সেইসব জিনিস।
তখনও ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় জনতা পার্টি কোনো বড় বিপদ হয়ে আসতে পারে, তার চিহ্ন না আবিষ্কার করতে পেরেছে সি পি আই, সি পি আই (এম), বা সি পি আই (এম-এল)-এর কোনো খণ্ডিত অংশ। জাতীয় কংগ্রেসের উদারীকরণ, ‘বাজার’ খুলে দেওয়ার নীতি, তথাকথিত ‘মুক্ত’ বাজারের প্রতি সমর্থন, রাজীব গান্ধীর গ্যাট চুক্তি ইত্যাদি নিয়ে ভূমিকা— সবই সমালোচনার মধ্যে কিন্তু সার্বিকভাবে ভারতীয় জনতা পার্টির এই উত্থান তাঁরা তাঁদের কোনো রকম কল্পনার মধ্যে আনতে পেরেছিলেন? বোধ হয় না।
একমাত্র ব্যতিক্রম রাজনৈতিক নেতা ও ইতিহাসকার ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। ইন্দিরা-ফিরোজপুত্র দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ এসেছেন কলকাতায়। উঠেছেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দোতলায়।
ই এম এস কে একটা ইন্টারভিউ করার সুযোগ এল দৈনিক বসুমতীর পক্ষ থেকে। ঠিক সকাল নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। না শীত, না গরম। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দোতলার বারান্দায় ই এম এস। সকালেই স্নান সারা, চুল পাট পাট আঁচড়ান। চোখে ভারী লেন্সের চশমা। কালো ফ্রেম।
তাঁর পরনে হাফ হাতা বুক কাঁটা বুশ শার্ট, রঙিন। সেইসঙ্গে ফুলদার ছাপ ছাপ লুঙ্গি। তখন অটুট সোভিয়েত। ‘মস্কো নিউজ’ নামের ট্যাবলয়েডটি, সেই সঙ্গে ‘নিউ টাইমস’ সোভিয়েত-ছাপা আর একটি পিরিওডিক্যাল। সেই সঙ্গে ইংরেজি স্টেটসম্যান সহ আরও কয়েকটি ইংরেজি দৈনিক। তার মধ্যে ‘পেট্রিয়ট’, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’— সবই তো ছিল। ই এম এস চা অর্ডার দিলেন। সঙ্গে বিস্কিট। আমি চা-পায়ী নই। কিন্তু ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ চা আনাচ্ছেন, সেটা একটা ব্যাপার আমার কাছে। সুন্দর, দামি ককারিজে চা। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল তখন সরকারি-ই।
কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলাম এই যে সঞ্জয় গান্ধীর লুমপেন ফোর্স— লুমপেন বাহিনী, তারা সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর কোথায় যাবে?
নাম্বুদিরিপাদ সামান্য থমকালেন। অনেক অনেক পাওয়ার সমেত সচশমা-সহ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, দে উইল বি দ্য আর এস এস ফোর্স।
ই এম এস কথা বলতে গিয়ে স্ট্যামার করেন— তোতলান, ফলে তাঁর কথা শূন্যে ভেসে আসার আগে সামনের বাতাসে খানিকটা যেন অতিরিক্ত বাতাসই খোঁজেন তিনি। আমি হতবাক। বিস্মিত। আজকের পরিস্থিতিতে নাম্বুদিরিপাদের কথা মিলে যাচ্ছে হুবহু।
আসলে কেরালার সি পি আই ও সি সি আই (এম) যেভাবে জনসঙ্ঘ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মোকাবিলা করেছে, ‘সশস্ত্র সংঘর্ষ’ হয়েছে, আহত-নিহত হয়েছেন দু পক্ষেরই কর্মী, সেই চিত্র পশ্চিমবাংলায় কখনও দেখা যায়নি, এযাবত কালে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে, তা তো সময়ই বলবে।
ফিরে আসি— সুশীতল রায়চৌধুরীর পূর্ণ নামে মূর্তিভাঙা প্রসঙ্গে দলিলে। সাদা, পাতলা কাগজে— সম্ভবত হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা ‘মূর্তিভাঙা প্রসঙ্গে’— এই নামে যে পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়, তার মলাটে লেখা মূর্তি ভাঙা প্রসঙ্গে। তার নিচে পূর্ণ। বোল্ড টাইপে, কালো রঙে ছাপা এই মলাট সমেত পুস্তিকাটি হাওড়া জেলার বালিতে হাতে হাতে ঘুরছে, একটু গোপনে। সকলেই প্রায় মুখ চাওয়াচাওয়ি, আমরা তাহলে কী ভুল করলাম এতদিন? মূর্তিভাঙা আসলে চীনের কালচারাল রেভেলিউশান বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব নয়?
যাঁদের মূর্তি ভাঙছি, তাঁরা তো অনেকেই দেশবরেণ্য দেশ নেতা, দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ। সারাটা জীবনই লড়াই, সংগ্রামে প্রায়, নয়ত পরাধীন দেশ, দেশের মানুষ তাদের উন্নতি কীভাবে হবে, সেই জিজ্ঞাসাই তাঁদের মাথার ভেতর অনবরত। সমর্থন ছিল না কোনোদিন মনীষীদের মূর্তি ভাঙায়, স্কুল-কলেজ পোড়ান, ল্যাবরেটরিতে আগুন দেওয়ায়। সেই সঙ্গে তথাকথিত ‘খতম’ অভিযানে। অথচ পার্টি সিদ্ধান্ত বলে এইসব তত্ত্বকেই ছড়ান হচ্ছে। খুব শর্টকাটে, অতি দ্রুত কৃষি বিপ্লব— সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব— ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’র যে তত্ত্ব, তার বাস্তবায়ন।
কোনো দেশে, কখনও শর্টকার্টে— দ্রুত সংক্ষিপ্তকরণের মধ্য দিয়ে সমাধা হয়েছে বিপ্লব? হোয়া সম্ভব? তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি, সংগঠন প্রয়োজন নয়?
এই সব প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা তখনও জেগেছে। এখনও জাগে। কেন স্যার আশুতোষ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ড. সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন, জাকির হোসেন, রাজেন্দ্রপ্রসাদ— কেন এঁদের ছবি ভাঙা হবে? সেই সঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দর।
মনের মধ্যে চরম দোলাচল তখন। আমার মা প্রবলভাবে এই জাতীয় নেতা ও মনীষীদের মূর্তিভাঙা, ছবি ভাঙা, ছবি পোড়ানর বিরোধিতা করেন। সত্তরের আগুনেবেলায়। জরুরী অবস্থা উঠে গেলে জেল থেকে বেরিয়ে মা— গায়ত্রী রায়ের কাছে এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করলে, তিনি বলতেন হ! পৈতা পুড়াইয়া বামুন হইস! ততদিনে আমার গলা থেকে পৈতে খসে গেছে। যা দেখে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন গায়ত্রী রায়।
Powered by Froala Editor