মুছে যায় - ৩৫
আগের পর্বে
ঝাড়গ্রাম বিধানসভা নির্বাচন কভার করতে গিয়ে একাধিকবার কথা হয়েছে সন্তোষ রানার সঙ্গে। সেখানে সন্তোষ রানাপন্থী সি পি আই (এম-এল)-এর পাকা অফিস। বাংলার পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সংগঠনও মজবুত ছিল। আশির দশকে ঝাড়গ্রামে ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো)-র প্রভাব বাড়ে। হোরো পার্টি চিরকালই কংগ্রেস ঘেঁষা। সেসময় মনোরঞ্জন মাহাতোর বাইকে বসে অযোধ্যা, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, ঘাটশিলা, মাঠাবুরু, সুবর্ণরেখা ঘুরেছি। ঝুমুরশিল্পী বিজয় মাহাতোর সঙ্গে গেছি একটি আদিবাসী পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে। তারপর…
আই পি এফ প্রার্থী ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়ের হুডখোলা জিপে প্রায় সারাদিন টো-টো, টো-টো— ঘন চক্কর যাকে বলে। সন্ধেবেলা ফিরে এসে স্নান করতে হয়, যদিও তখন বাতাসে বসন্ত আর হাওয়ায় হাওয়ায় আম্রমুকুল সুবাস, কালো কোকিলের তীব্র কুহুরব, পঞ্চমে।
ভৈরবেন্দ্রনারায়ণের হুডখোলা জিপ অনেক ধুলো ওড়ায়। তাঁর দোতলা বাড়ির বারান্দায় তখন খাঁচাবন্দি টিয়া-চন্দনা, ময়না, ফুলটুসিও হতে পারে। পাখি ছিল দাঁড়েও। যেমন কিনা কোনো কোনো বাংলা সিনেমা অথবা বোম্বাইয়া হিন্দি মুভিতে, নাকি এসবই আমার বিভ্রম, বাংলা সিনেমা ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’ অথবা ‘স্ত্রী’ দেখার স্মৃতিপাঠ? নাকি হিন্দি সাহেব বিবি আউর গুলাম— ভঁওরা বড়া নাদান হ্যায়— আশা ভোঁসলের কণ্ঠে, ওয়াহিদা রেহমানের লিপে নয়ত গীতা দত্তর কণ্ঠবাহারে মীনা কুমারীর লিপে?
বসন্তদূত ডাকে। ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় প্রচার করেন, ভোর টু ভোর। আমি তাঁর কর্মীবাহিনীর সঙ্গেই ঘুরে বেড়াই। হিজল। হিজল। খানিকটা অন্যরকম। সবুজ শ্যামলে নয়, রুক্ষতা হিংস্রতা, রক্তের গন্ধ-এর ভেতর থেকেই উঠে এসেছে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক সৈয়দ সিরাজের বহু আখ্যান, কথাসমিধ।
সিরাজ বহুবার বলেছেন, তিনি অ্যানার্কিস্ট— নৈরাজ্যবাদী, রক্তপ্রিয়। দু-দুবার আর এমনি বহু দফায় সাক্ষাৎকার নিয়েছি সিরাজের— সিরাজদার। ২৪ ঘণ্টা নামের টি ভি চ্যানেলে, সিরাজদা ২৪ ঘণ্টা দ্বারা সম্মানিত হওয়ার পর, তখন ২৪ ঘণ্টা অন্যরকম, তখন কবি রাহুল পুরকায়স্থ আর সাংবাদিক সুদীপ্ত সেনগুপ্তকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বলেছিলেন, কিন্নর যদি সাক্ষাৎকার নেয়, তাহলে, এভাবেই মতি নন্দী এবং মণিশংকর মুখোপাধ্যায় মানে শংকর। সিরাজদার গোরাচাঁদ দত্ত রোডের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিই। তখন নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর— সব হয়ে গেছে। সিরাজদাকে সল্টলেকে সরকারি ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কারণ গোরাচাঁদ দত্ত রোডের পুলিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা বহু পুরনো বাড়ির ঘরের সিলিংয়ের বড় চাঙড় খসে পড়েছিল। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ভয় পেলেন। বাসা বদল করলেন বৌদি মানে আমাদের পরিচিত কবি হাসনে তাঁরা সিরাজকে নিয়ে। কিন্তু লবণহ্রদে সাজানো, নতুন বাড়িতে— মানে ফ্ল্যাটে থাকতে পারলেন না সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কেমন যেন সব প্রাণহীন, জীবনতরঙ্গহীন মনে হতে লাগল তাঁর। বেশিদিন থাকতে পারেননি। বৌদিকে নিয়ে আবার ফেরত চলে এলেন গোরাচাঁদ দত্ত লেনে।
আরও পড়ুন
ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কয়েকটি টুকরো
২৪ ঘণ্টা নামে টি ভি চ্যানেলের জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ওঁর গোরাচাঁদ দত্ত লেনের বাড়িতে গিয়ে। মতি নন্দী— মতিদার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছি মতিদার উত্তর কলকাতার বাড়ি নিয়ে। মতি নন্দীও সেবার জীবনকৃতি সম্মান পেয়েছেন ২৪ ঘণ্টা থেকে।
মণিশংকর মুখোপাধ্যায়— শংকরের সাক্ষাৎকারটি নিই তাঁর অফিসে গিয়ে। তার আগের দিন দে’জ থেকে শংকরের বহু বই ট্যাক্সি ভর্তি করে বাড়ি নিয়ে এসে, পড়ে, নোট তৈরি করে সাক্ষাৎকার নিই। বিশেষ করে বিবেকানন্দ বিষয়ক লেখালেখি। চীনের ওপর তাঁর কাজ— এই সব।
আরও পড়ুন
নাগভূষণ পট্টনায়ক ও আই পি এফ
মতি নন্দীও বলেছিলেন, রাহুল পুরকায়স্থ আর সুদীপ্ত সেনগুপ্তকে বলেছিলেন কিন্নর আমার লেখা খুব মন দিয়ে পড়েছে, কিন্নর যদি আমার সাক্ষাৎকার নেয়, তাহলে ঠিক আছে। ফলে ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলের জন্য-ই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মতি নন্দী আর শংকরের সাক্ষাৎকার। জানি না এই সব দীর্ঘ কথোপকথন ২৪ ঘণ্টার আর্কাইভে আছে কিনা।
ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় ও তাঁর কর্মীদের কথা বললে বলতে হিজল, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মতি নন্দী, মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ল, তাই উঠেও এল।
আরও পড়ুন
তেলেনাপোতা, ছেঁড়া তমসুক— সিনেমা
বাংলা আকাদেমির কথা সাহিত্য উৎসবে খোলা মঞ্চে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সৈয়দ মুস্তাদা সিরাজের, খোলা মঞ্চে— খোলাখুলি কথা। আলকাপ দলে থাকা, সেখানে ‘মাস্টার’ হয়ে বাঁশি বাজান, মুর্শিদাবাদের বামপন্থী রাজনীতি, হিজল, হিজলকন্যারা, কলকাতায় আসা, লেখালিখি, ‘নীল ঘরের নটী’, ‘অলীক মানুষ’, ‘তৃণভূমি’, ‘জানমারি’, অসাধারণ সব আখ্যান, সেইসঙ্গে ‘বেদবতী’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’ এবং ‘কর্নেল’। ‘বুড়ো ঘুঘু’, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
মতিদাও তাঁর সাক্ষাৎকারে ‘স্ট্রাইকার’, ‘স্টপার’, ‘অপরাজিত আনন্দ’, ‘কোনি’, ‘ননীদা নটআউট’— এসব নিয়ে বলেছিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গল্প— ‘শবাগার’, ‘কপিল নাচছে’, ‘ব্লেজার’, ‘রেড্ডি’-র মতো গল্প নিয়ে। সিরাজদার গল্প ‘গোঘ্ন’, ‘একটি বানুকের উপকথা’, ‘পুষ্পবনে হত্যাকাণ্ড’, ‘রানীর ঘাটের বৃত্তান্ত’— এটি যদিও উপন্যাস, সব নিয়ে কথা আর কথা।
আরও পড়ুন
‘বেবিট্যাক্সি’ ও অন্যান্য
‘বিজলীবালার মুক্তি’ নিয়েও কথা বলছিলেন মতি নন্দী, সেই সঙ্গে সঙ্গে বিজলীবালা নামের আখ্যানে এক নারীর ভূমিকা, সেটা অন্য এক সাক্ষাৎকারে। ‘কলাবতী’ মতি নন্দীর আর একটি কিশোরী চরিত্র, তাকে নিয়েও কথা আর কথা। মতি, সিরাজ— সব আপাতত তোলা থাক। আবারও ভৈরবেন্দ্রনারায়ণের প্রচারে ফিরি। তখন বামফ্রন্টের শাসন এই পশ্চিমবাংলায়। অপারেশন বর্গা, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সুফল পেতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই লাল আলখাল্লা পরা ‘বদ-বাবুদের’ উপদ্রব শুরু হয়ে গেছে কোনো কোনো গ্রামে। এখন যেমন সবাই তৃণমূল কংগ্রেস অথবা ভারতীয় জনতা পার্টি, তখন তেমনই সকলেই সি পি আই (এম)। ১৯৭৭ সালে এ রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পরই জাতীয় কংগ্রেস— যা ইন্দিরা কংগ্রেস— কংগ্রেস (আই) নামে চিহ্নিত, তাদের একটা বড় অংশ, এমনকি ধনী চাষী, মধ্যচাষী, কোথাও কোথাও জোতদাররাও বামফ্রন্টের প্রবল সমর্থক হয়ে উঠতে চাইল। যদিও ভূমিহীন কৃষক, ক্ষেত মজুর, গরিব চাষী প্রচুর উপকার পেলেন অপারেশন বর্গার সূত্রে। ঐতিহাসিকও তেভাগা আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান ছিল— ‘লাঙল যার জমি তার’। সেই স্লোগান খানিকটা হলেও যেন বাস্তবায়িত করল ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্ট সরকার।
অপারেশন বর্গার সমালোচকরা অপারেশন বর্গাকে ভূমিসংস্কার না বলে ‘সামন্ততন্ত্রের পুনর্জাগরণ’ বলেছেন। আমার অবশ্য কখনওই তা মনে হয়নি। রাজনীতি করার সূত্রে গ্রামে কৃষক জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে চাওয়ার সূত্রে যে গ্রাম ও কৃষক জীবন দেখা, তাতে বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর, এরকম কোথাও কোথাও জোতদারদের অস্তিত্ব। উত্তর দিনাজপুরের কথা তো বলেছি আগেই। বাদ বাকি উত্তরবঙ্গেও কিছু কিছু জোতদারদের অবশিষ্টাংশ। কিন্তু তা কখনওই অখণ্ড বিহার, খণ্ড না হওয়া উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা অন্ধ্রে যেমন, তেমন নয়। ওড়িশাতেও জোতদার, জমিদাররা বেশ পরাক্রম নিয়ে। এছাড়া ওড়িশায় ভায়নক জাত-পাতের ভাগাভাগি। ইসলাম বিদ্বেষ। খ্রিস্টধর্ম বিদ্বেষ। ওড়িশায় কটকে বহু ইসলাম ধর্মের মানুষ আছে।
হিজলের ভোট হিন্দু মুসলমানের ভোট। জাতি বা ধর্ম সংখ্যা, সেখানে কোনো একরৈখিক একশিলা সংখ্যা চিহ্নিত নয়।
হিজলের চৈতালি বাতাসে রোদে পোড়া গরম ধুলোর গন্ধ। ঝাপট। ফাল্গুন অথবা চৈত্র— কোনো এক মাসের রোদালু, বৃষ্টি ঝরা হিসেব। মানে রোদ তো রোদই। কড়া, খাসা রোদ, তার সঙ্গে সঙ্গে দু-এক ফোঁটা আকাশজল— বারিবিন্দু। তখন মেঘেদের গা থেকে আসে ভিজে ভিজে ঠান্ডা।
ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বাড়ির সেই শোওয়ার ঘর— বড়সড়, মেহগনির পুরনো কালো খাট, সেই সঙ্গে উঁচু উঁচু সিলিং। তাতে পঙ্খের কাজ। সেই ঘরের ভেতর একটা বড়সড় ভিমেল আয়না। সে কত যুগ হয়ে গেল।
সি পি আই (এম-এল)— না ভাঙা সি পি আই (এম-এল)-এর কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য নাগভূষণ পট্টনায়ক ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট— আই পি এফ, এর সভাপতি। যখন তিনি সি পি আই (এম-এল) করতেন, তখন তাঁর মাথার দাম বেশ কয়েক হাজার টাকা। হয়তো পঞ্চাশ হাজার টাকাই হবে, কি আর একটু কম। আমি ১৯৭২-৭৩ সালের কথা বলছি।
অন্ধ্রের— শুধু অন্ধ্রের কেন, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচিত চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি মারা গেলেন কলকাতায়, এক গোপন শেল্টারে। বর্ধমান প্লেনামের পর নাগি রেড্ডি, চন্দ্রপুল্লা রেড্ডিরা রাজনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করেন সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে সি পি আর— চন্দ্রপুল্লা বা চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির অনুগামী সি পি আই (এম) থেকে বেরিয়ে আসা লোকজন ‘কিসান’ নামে একটি চারপাতার বাংলা সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড প্রকাশ করেন। বালির লোকনাথ নাগ ছিলেন চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি বা পুল্লা রেড্ডির ‘কিসান’ পত্রিকা গোষ্ঠীতে। পেশায় শ্রমিক লোকনাথ নাগ ছিলেন আমার সহপাঠী চঞ্চল নাগের কাকা। নিশ্চিন্দায় থাকতেন তিনি। খুব লম্বা নয়। চোখে পাওয়ারদার অর্ডিনারি কালো ফ্রেমের চশমা, টেরিকটের বুক কাটা বুশ শার্ট, টেরিকটের ফুলপ্যান্ট। দুটোই একরঙা। শার্ট হালকা মেরুন বা মারুন। প্যান্ট ছাই ছাই বা নীল। লোকনাথ নাগ খুব বেশি কথা বলতেন না। তাঁর নাকের নিচে পুরুষ্টু, পাকানো গোঁফটি যেন বা সন্তু সিরিজের ‘কাকাবাবু’-র কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে।
ফণী বাগচী ছিলেন আই এফ টি ইউ-এর সর্বভারতীয় নেতা। তিনি খুব লম্বা নন। রঙিন-ছাই ছাই টেরিকট প্যান্ট, চেকদার ফুলহাতা টেরিকট শার্ট। হাতা একেবারে কবজি পর্যন্ত। বোতাম বন্দি। আশির দশকের মাঝামাঝি ফণী বাগচীর সঙ্গে আলাপ, ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। খিদিরপুর ওয়াটগঞ্জেও যে অতি প্রাচীন বেশ্যালয়, সেখানে মূল খরিদ্দার ‘জাহাজি’রা, কারণ কাছেই খিদিরপুর ডক বা কলকাতা বন্দর।
কলকাতা বন্দরে যতদিন বড় বড়, অতি বড় বিদেশি জাহাজ এসে লেগেছে, মানে লাগতে পেরেছে, নোঙর ফেলেছে, ভাগীরথীর নাব্যতা না কমে যাওয়ার পর্যন্ত, ততদিন বিদেশি জাহাজের নাবিকেরা মূলত খিদিরপুর-ওয়াটগঞ্জের বেশ্যালয়ে এবং ধর্মতলার ‘সাকি’বারে ফূর্তিরঞ্জিত হতে।
ওয়াটগঞ্জের বেশ্যাপল্লীতে অবাঙালি গণিকাদের প্রাধান্য, ভিড়। এমনই এক পুরনো, রঙ ওঠা খালিকোঠির দোতলায় ফণীবাবুর আই এফ টি ইউ অফিস, ওঁদের চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি পন্থী সি পি আই (এম-এল)-এর অফিস ঘর।
একটা তক্তপোশ আছে, সেখানেই তাঁর রাত্রিযাপন, শয়ন। সারা বিছানা জুড়ে ছড়ানো আই এফ টি ইউ-এর ছাপান পোস্টার, ইশতাহার। না ঝাঁট দেওয়া না মোছা ঘরের মেঝেয় অজস্র পোড়া বিড়ি আর সিগারেটের টুকরো।
নিচে— এক তলায় থাকেন গণিকারা। দোতলায় ফণী বাগচী। আমাকে ফণী বাগচীর ব্যাপারে প্রথম তথ্য দেন এ আই সি সি টি ইউ সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশনের শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ফণী বাগচীদের যে সি পি আই (এম-এল), তার সংগঠন বিস্তৃত অন্ধ্রে, অন্ধ্রের জঙ্গলে। ফণী বাগচী কথায় কথায় একদিন বলেছিলেন, অন্ধ্রে আমরা বন্দুক নামিয়ে রাখিনি। জঙ্গলে আমাদের ‘দলম’— সশস্ত্র আর্মড স্কোয়াড আছে। তখন কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া পন্থী পিপলস ওয়ার গ্রুপ— পি ডব্লু জি-র নিয়মিত সংঘর্ষ হয়। পি ডব্লু জি অখণ্ড সি পি আই (এম-এল)-এর একটি অংশ। পরে যা এম সি সি-মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র আর সি পি আই (এম-এল) পার্টি ইউনিটের সঙ্গে মিশে যায়। পিপলস ওয়ার গ্রুপ— তিনটি রাজনৈতিক সংগঠন, নির্বাচনী পথে বিশ্বাসী নয়, সশস্ত্র পথে ‘লাল ভারত’ তৈরি করার মতাদর্শে আস্থাশীল তাঁরা, মিলে মিশে তৈরি করলেন সি পি আই (মাওবাদী)।
ফণী বাগচী— আই এফ টি ইউ নেতা, তাঁর খবর দিয়েছিলেন আই পি এফ-এর বাসুদেব বসু, ধীরেশ গোস্বামী, নিত্যানন্দ ঘোষ। ফণী বাগচী হাতে কালো, চ্যাপ্টা ব্রিগ কেস। সব সময় একটু যেন ব্যস্তসমস্ত ভাব।
ফণী বাগচী কথায় কথায় একদিন বললেন চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি— সি পি আর-এর স্ত্রী নির্মলা রেড্ডি অন্ধ্রের জঙ্গলে তাঁর ‘দলম’— আর্মড স্কোয়াড নিয়ে গোপন জীবনে আছে। তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় অন্ধ্রের নকশাল-দমনকারী ‘গ্রে হাউন্ড’ বাহিনীর। ‘শহিদের’ তালিকা বাড়ে। ‘গ্রে হাউন্ড’ বাহিনী তৈরি হয়েছিল তেলেগু দেশম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, খুব পপুলার সিনেমা অভিনেতা এন টি আর— এন টি রামা রাওয়ের সময়ে। এন টি আর তখন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী।
ফণী বাগচীই আমাকে প্রথম চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির মৃত্যুসংবাদ শোনান। কলকাতার একটি গোপন শেল্টারে রোগে ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু। সেই খবরটি আমি প্রথম ব্রেক করি পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এর ইংরেজি পত্রিকা ‘পয়েন্ট কাউন্ডারপয়েন্ট’-এ। বড় করে খবরটা হয়েছিল ‘পয়েন্ট কাউন্টারপয়েন্ট’-এর ডামি সংখ্যায়। ফণীবাবু আমায় সি পি আর— চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির একটি খাকি হাফপ্যান্ট, শাদা শার্ট পরা বড়— সাদা-কালো ছবি দিয়েছিলেন। ‘পয়েন্ট কাউন্টারপয়েন্ট’ সেই ছবিটি ছাপেনি বা ছাপতে পারেনি। স্টেটসম্যান কয়েকদিন পর চন্দ্রপোল্লা রেড্ডির কলকাতায় আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে মৃত্যুর খবরটি খুব বড় করে ছাপে। তাঁকে দাহও করা হয় তাঁর পার্টির তত্ত্বাবধানে, অতি গোপনে। দাহকাজের পর খবরটি বাইরে আসে। প্রায় লক্ষ টাকার কাছে ছিল সি পি আর-এর মাথার দাম।
সি পি আর-এর খাকি, ঢোলা হাফ প্যান্ট পরা ছবিটি দেখতে দেখতে তেলেঙ্গানা পর্ব বা রণদিভে পিরিয়ডের খাকি হাফ প্যান্টের কথা মনে পড়ল। তখন বি টি আর— বি টি রণদিভে, পি সুন্দরাইয়া, গোপালন, ই এম এস নাদুদিরিপাদ— সকলেই হাফ প্যান্ট, সাদা শার্ট। এমনকি জ্যোতি বসুও। হ্যাঁ, খাকি হাফ প্যান্ট পরা জ্যোতি বসু।
১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) নতুন এক কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই (এম-এল)-এর ঘোষণা হয় ১৯৬৯-এর পয়লা মে। তখনও মনুমেন্ট ময়দান শহিদ মিনার ময়দান হয়নি। সেই সভামঞ্চে কানু সান্যাল খাকি, হাফপ্যান্ট আর গোল গলা সাদা গেঞ্জি পরে ঘোষণা করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)-র কথা।
মঞ্চে দাঁড়ানো কানু সান্যালের হাতে তখন পিকিংয়ে ছাপা কেতাব— রেডবুক— লালবই। চেয়ারম্যান মাও-সে-তুঙের এই কোটেশনগুচ্ছ সংকলনের সি পি সি ভূমিকা লিখেছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান লিন-পি-য়াও বা লিন-বি-য়াও। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নাইনথ কংগ্রেস— নবম কংগ্রেসে লিন-পি-য়াওকে নিজের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন মাও-সে-তুঙ। এই ঘটনা পড়ে, জেনে, পিকিং রিভিউ-এর সি পি সি-র নাইনথ কংগ্রেসের রিপোর্ট পড়ে যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু পার্টির একনিষ্ঠ সৈনিক হিসাবে কোনো প্রশ্ন করতে পারিনি।
Powered by Froala Editor