ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কয়েকটি টুকরো

মুছে যায় - ৩৪
আগের পর্বে

ওড়িশা, অন্ধ্রের সীমান্তে কোরাপুটে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। সে আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করেন পঞ্চান্দ্রি কৃষ্ণমূর্তি। অখণ্ড সি পি আই (এম-এল)-এর নেতা নাগভূষণ পট্টনায়কের ফাঁসির আদেশ হয়। যদিও পরে তা মুকুব হয়েছিল। নকশালপন্থী এই নেতা পরে আই পি এফ-এর সভাপতি হন। আশির দশকের শুরুতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন তিনি। ভয়ঙ্কর অসুস্থ নাগভূষণ পট্টনায়ককে বেশ কয়েকবার দেখে এসেছি তখন। নিয়েছিলেন একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও। স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্ন বুনেছিলেন তিনি। তারপর…

মুর্শিদাবাদে জাতীয় কংগ্রেস, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল, না-ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টি সকলেরই কিছু কিছু প্রভাব ছিল। কান্দির রাজ পরিবারে লোকজন ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক। তাঁদের পরিবার থেকে ইন্দিরা কংগ্রেস মন্ত্রিসভায়, পশ্চিমবঙ্গে ইন্দিরাপন্থী কংগ্রেস মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। আর এস পি বা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের ত্রিদিব চৌধুরী পরিচিত ছিলেন ঢাকুবাবু বা ঢাকুদা নামে। গোয়া মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ত্রিদিববাবু লোকসভায় নির্বাচিত হয়ে জেতেন এই মুর্শিদাবাদ থেকেই। পরে নকশাল আন্দোলনও ছড়ায়, মুর্শিদাবাদে।

কবি মনীশ ঘটক— ছদ্মনামে যুবনাশ্ব থাকতেন বহরমপুরেই। মহাশ্বেতা-জনক, ঋত্বিককুমার ঘটকের কাকা মনীশ ঘটক, দীর্ঘকায় গদ্য লিখতেন ‘যুবনাশ্ব’ নামে। তাঁর ‘পটল ডাঙার পাঁচালি’-র কথা মনে আছে অনেকেরই। ‘বুচি’ নামে তাঁর একটি  বড়োসড়ো আখ্যান আছে— যা পুরোটাই লেখা পূর্ববঙ্গীয় ডায়লেক্টে।

মনীশ ঘটক কবিতা লিখতেন, মূলত, মনীশ ঘটক নামে। আপাতত থাক সে সব কথা। বহরমপুরে মনীশবাবুদের— ঘটক পরিবারের ঐতিহাসিকও বড়ো বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে বহু বছর। তখন মহাশ্বেতা দেবী, মহাশ্বেতাদি বেঁচে। শান্তিনিকেতনে মহাশ্বেতার নেতৃত্বে ‘খোয়াই ধ্বংস’ বিরোধী আন্দোলন চলেছে তার কিছুদিন আগেও। অনেকেরই মনে আছে সি পি আই (এম) সাংসদ, পরে স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বড়ো বাড়ি করেছিলেন এখানে। বহরমপুরের এই বাড়িতে আসতেন ‘কল্লোল’-এর লেখকরা।

অতীশবাবু ছিলেন রাজপরিবারের মানুষ। দীর্ঘদিন তিনি পশ্চিমবাংলার জাতীয় কংগ্রেসের যে রাজনীতি, তার ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। মন্ত্রীও হয়েছেন।

আরও পড়ুন
নাগভূষণ পট্টনায়ক ও আই পি এফ

ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বাড়িটি বেশ বড়ো— আলিশানি। দোতলার বারান্দা, সাবেক রেলিং, সব রেলিংই লোহার— কাস্ট আয়রন— ঢালাই লোহার আর সেখানে মৎস্যকূল। আশ্চর্য সমাপতন মনে হয় এখন ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বাড়ির রেলিং মাছেরা দোতলার সৌন্দর্য হয়তো, আর তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের জোড়া মাছ।

আগেই বলেছি, ভৈরবেন্দ্রনারায়ণের চেহারাটি বেশ মজবুত। পেটার করা স্বাস্থ্য। মিলের ধুতির ওপর ছিটের ফুল শার্ট। নাকের নিচে পাকানো কালো গোঁফ। কেমন একটা ডাকাত-ডাকাত ইমেজারি আনে যেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ভরাট কিন্তু কর্কশ, রুক্ষ।

আরও পড়ুন
তেলেনাপোতা, ছেঁড়া তমসুক— সিনেমা

আমাদের আহারাদি সব ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বাড়ি। তারপর সারাদিন টই টই। টই টই তাঁরই জিপে।

পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট খুব আস্তে-ধীরে তার প্রভাব ছড়াচ্ছিল। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তো বটেই। বিশেষ করে অখণ্ড বিহার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের সমর্থনে জয়ন্ত রংপি গেলেন লোকসভায়। সাংসদ হলেন, নির্বাচিত সাংসদ। তারপর তাঁর বিরুদ্ধে টাকা নয়-ছয় তছরুপের অভিযোগ এল।

আরও পড়ুন
‘বেবিট্যাক্সি’ ও অন্যান্য

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নির্বাচনে সন্তোষ রানা-পন্থী সি পি আই (এম-এল) আসলে সত্যনারায়ণ সিং-পন্থী সি পি আই (এম-এল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। লেবাচাঁদ টুডু ও সন্তোষ রানা বিজয়ী হন। পরে তাঁরা আর জিততে পারেননি। সন্তোষ রানা জাতপাতের রাজনীতিটা খুব ভালো বুঝতেন। তার কিছু প্রয়োগও তিনি করেছেন পশ্চিমবাংলায়। জয়শ্রী রানার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁর। সন্তোষরানার ভাই— মিহির— মিহির রানা পরে সি পি আই (এম) হয়ে যান। ঝাড়গ্রামে বিধানসভা নির্বাচন কভার করতে গিয়ে মিহিরবাবুর সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়। তখন ঝাড়গ্রামে সন্তোষ রানাপন্থী সি পি আই (এম-এল)-এর পাকা অফিস। ‘মাস্টার’ নামে একজন সেই অফিসের অফিসবেয়ারার টাক মাথা, ফর্সা। পরনে টেরিকটের ফুল প্যান্ট, সিনথেটিক ফুল শার্ট। নির্বাচনী খবর করতে গিয়ে একাধিক বার কথা হয়েছে সন্তোষ রানার সঙ্গে। তখনই তিনি শুধুমাত্র সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম, সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ত্ব একটি পাশে সরিয়ে রেখে, জাত-পাতের রাজনীতি, কাস্ট পলিটিক্স নিয়ে ভাবছেন।

‘মাস্টার’ একাই থাকেন। একটি বড়ো পাকাবাড়ির একটা ঘরে তাঁদের অফিস। ঝাড়গ্রামে সি পি আই (এম)-এর অফিসও পাকা, দোতলায় উঠে যেতে হয়। তখনও রোজা লুক্সেমবার্গ আন্তোনিও গ্রামশ্চি নিয়ে তেমন চর্চা শুরু হয়নি বাঙালি বামপন্থী মহলে। ইউরো কমিউনিজমের তত্ত্বকে বার বার আক্রমণ করা হচ্ছে। বার বার উঠে আসছে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির নেতা তোগিলিয়াত্তির নাম ইউরো কমিউনিজম প্রসঙ্গে। তখনও ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন অটুট। সেটা ১৯৮০-৮১ সাল। সন্তোষ রানা পরে অধ্যাপক, লেখক দেবী চ্যাটার্জির সঙ্গে সহজীবনের ভেলা ভাসিয়েছেন। অধ্যাপক দেবী চ্যাটার্জিও তাত্ত্বিক। সেটা অখণ্ড সি পি আই (এম-এল) টুকরো টুকরো হওয়ার কাল।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীকান্ত বসু, কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া ও আরও কিছু

এর কাছাকাছি সময়েই ভাস্কর নন্দীর নামটি উঠে আসে সি পি আই (এম-এল)-এর একটি অংশের নেতা হিসাবে। যতদূর মনে পড়ে ভাস্কর নন্দী ও সন্তোষ রানা একটা সময় একই গ্রুপে ছিলেন ভাস্কর নন্দী আসামের মানুষ, তেমনই শুনেছি।

ইউরো কমিউনিজমের ধারণা, বোধ ও তত্ত্বকে সোভিয়েত ইউনিয়ন— সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দেয়। ভারতবর্ষেও তার ঢেউ— সেই তর্কতরঙ্গ খানিকটা এসে পৌঁছয়, একটু স্বাভাবিকভাবেই। সে কথায় পরে আসছি।

আশির দশকে ঝাড়গ্রামে ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো)-র বড়ো প্রভাব। মনোরঞ্জন মাহাত ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো) করেন। তাঁদের নির্বাচনী প্রতীক ধামসা। এন ই হোরো ছিলেন ঝাড়খণ্ড পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো) থেকে ভেঙে তৈরি হয় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। পশ্চিমবাংলায় নরেন হাঁসদা ছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার অন্যতম মুখ। নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে ভোটে জিতে নরেন বিধায়ক হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী চুনিবালা হাঁসদা জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে নির্বাচনে লড়েন। জেতেনও। তখন তাঁর দলের নাম ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)।

পশ্চিমবাংলার পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সংগঠন মজবুত ছিল। তবে ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো)-র সংগঠন ঝাড়গ্রামে যথেষ্ট। মনোরঞ্জন মাহাত দিনরাত মোটরবাইকে ঘুরতেন। তিনি আবার তখন ‘পিয়ারলেস’ এজেন্ট। মনোরঞ্জন মাহাতর সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর যোগাযোগ ছিল খুব। ঝাড়গ্রামে নির্বাচনী-খবর করতে যেবার প্রথম যাই প্রতিক্ষণ-পাক্ষিক প্রতিক্ষণ-এর হয়ে, মহাশ্বেতাদি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন মনোরঞ্জন মাহাতকে। সেই চিঠিতে খুব কাজ হয়েছিল। মনোরঞ্জন মাহাত তাঁর নামে ঝাড়গ্রাম স্টেশনের কাছে হোটেল-ঘর বুক করে রেখেছিলেন। রাতে সেখানে পৌঁছানোর পর হোটেলে গিয়ে রিসেপশানে বলতেই আলাদা খাতির।

ঝাড়গ্রামের বাদুরডোবায় থাকতেন স্কুল শিক্ষক ললিতমোহন মাহাত। ললিতের হাতের লেখাটি ভারি চমৎকার। বেশ মোটা সোটা, ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি। ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবারের পাতায় গল্প ছাপা হত তাঁর। তারপর মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় ললিতের, মহাশ্বেতাদির ‘বর্তিকা’তেও লিখেছেন ললিতমোহন মাহাত। ঝাড়গ্রাম থেকে মোটর বাইকে শালবনি গেছি। সেখানে নরেন হাঁসদার বাড়ি। ঝাড়খণ্ড মুকিমোর্চার নরেন হাঁসদা। তখনও তাঁর তির-ধনুক হাতে, খালি গায়ে বিশেষ পোজ দেওয়া ছবি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় বেরয়নি। নরেনের স্বাস্থ্য খুব ভালো। বুক, পেটের মাসল— সবই চমৎকার।

ঝাড়গ্রাম শহরে অজয়, লিয়াকত আলি— এঁরা ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো) করে। খুবই জঙ্গী ক্যাডার ঝাড়খণ্ড পার্টির। পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড। মনোরঞ্জন মাহাতর সূত্র ধরে তাঁদের গোপন ডেরায়। লিয়াকতের একটি হাত, সম্ভবত বাঁ হাত, কনুইয়ের খানিকটা নিচে থেকে নেই। কথায় কথায় জানতে পারি সি পি আই (এম)-এর সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকের লড়াইয়ে তাঁর হাতের এই অবস্থা। গুলি লাগার পর গোপনে লিয়াকতের— লিয়াকত আলির হাতের ক্ষত সারাতে গিয়ে, বুলেট বার করার পাতা সমেত হাতের খানিকটা অ্যাসপিউট করতে হয়। লিয়াকতের বাম হাতখানি স্লোগান দেওয়া সময় কচ্ছপের মুন্ডু হয়ে শূন্যে ভাসে, নেমে আসে। কনুইয়ের খানিকটা পরেই কালো, শক্ত, গুটলি পাকানো মাংস।

লোককবি ভবতোষ শতপথী তখন বেঁচে। তাঁর কবিতা থেকে গান বাঁধেন বিজয় মাহাত। তিনি লোক গাইয়ে। বিজয় পরে কংগ্রেস রাজনীতিতে চলে আসেন। ভবতোষ শতপথী ক্ষয়াটে চেহারা, মাথায় টাক। তাঁর কবিতার লাইন দিয়ে দেওয়াল লেখে ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো)। দিনের পর দিন থেকে যাই ঝাড়গ্রামে, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন কভার করতে। ঝাড়গ্রামের দেওয়ালে দেওয়ালে তখন প্রাস্তাবিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মানচিত্র। বিহার, ওড়িশা, বাংলা থেকে কিছু কিছু নিয়ে প্রস্তাবিত এই রাজ্য।

অধ্যাপক পশুপতি প্রসাদ মাহাতর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ হয় এই পর্যায়েই আজ যেখানে বনে আগুন লাগিয়েছে কাঠ মাফিয়ারা, সেই অযোধ্যা পাহাড়, মাঠাবুরুতে পেয়ে পায়ে ঘুরি। খালি পায়ে। পায়ের পাতার তলা ক্রমশ পাথর হয়ে ওঠে মাইলের পর মাইল নাঙ্গা পদচারণায়। ছোট ছোট কুণ্ডি, ঝরনা। ঘুরে বেড়াই লোধাশুলি, লোধাদের আরও নানা বসত। মাহাতরা কুরমি, তাঁরা সেই অর্থে আদিবাসী বা ট্রাইবাল নন, এই চিন্তা-চেতনার ওপ্র ভিত্তি করে মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ‘অক্লান্ত কৌরব’— বেরয় শারদীয় পরিবর্তন-এ। পরে তা বই হিসাবে ছাপেন, ‘নবপত্র’-র প্রসূন বসু। পশ্চিমবাংলার আদিবাসী বা ট্রাইবাল জন হলেন খেড়িয়া, সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, লোধা, ইত্যাদি প্রভৃতি।

ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো) বরাবরই কংগ্রেস ঘেঁষা। তার কাছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ভবতোষ শতপথীর কবিতার অতি বিখ্যাত লাইন— ‘লোভের পাটন করে টনটন…’ নাকি ‘ক্রোধের পাটন করে টনটন…’!

বিজয় মাহাত খুব ভাল ঝুমুর গাইতেন। তাঁদের সঙ্গে একটি আদিবাসী পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে যাই, রাতে।

আমি বললাম, বিজয়, আমার তো নেমন্তন্ন নেই। বিজয় বলল, তাতে কী হল? গাঁ ঘরে এসব চলে। নেমন্তন্ন আবার কি? মনোরঞ্জন মাহাতও সমর্থন করলেন বিজয়ের কথা। মনোরঞ্জন মাহাতর মোটরবাইকের পেছনে আমি। বিজয়ও গেল বাইকে, ভবতোষ শতপথীও গেলেন। অনেক রাতে বিয়ে। দলে দলে মানুষ আসছেন গ্রাম থেকে। মায়েদের সঙ্গে ছা-ইয়েরাও। প্রচুর লোক।

খাবার বলতে মোটা চালের ভাত, তার সঙ্গে খোসা সমেত ডাল, ডিংলা— মানে কুমড়োর ঝোল ঝোল তরকারি আর খাসির মাংস। শালপাতার থাকায় চুড়ো করা ধোঁয়া ওড়ানো ভাত, সেই সঙ্গে ডাল, কুমড়োর তরকারি, যত খুশি নিতে পার। খালি মাংস একটা পোড়া মাটির তৈরি ছোট খোরায়। যেমন পাত্রে অনেক সময় সিন্নি দেয় শনি-সত্যনারায়ণের তেমন সাইজের খোরা। মাংস সকলের জন্য একটা একটা খোরায়। দু থেকে তিন টুকরো বড়োজোর, আমার কাছে এসে গেল দুটো খোরা। চোখ ইশারায় কেন দুটো জানতে চাইলে বিজয় চোখ মারল। আমি সেই সংকেতে অন্য বার্তা পেলাম। নিঃশব্দে খেয়ে নিলাম ভাত-মাংস, ডাল-তরকারি। অনেক রাতে মিটল খাওয়া-দাওয়া। আকাশে মেঘের ল্যাংবোট ভরা চাঁদ। মনোরঞ্জন মাহাতর বাইকে ঝাড়গ্রাম শহরে ফিরব। অনেকটা রাত হয়েছে।

গ্রামের হাট, হেঁড়ো হাঁটা— হাঁড়িয়া বিক্রি হয় সেখানে, তন্ন তন্ন করে খুঁজতে চেয়েছি ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সূত্রভূমি। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন দয়াল মুণ্ডা, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা, দেখা করেছি তাঁর সঙ্গেও। কথা বলেছি।

মনোরঞ্জন মাহাত আমায় তাঁর বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে নিয়ে ঘুরেছেন। জল, অ-জঙ্গল, খুণ্ডি, ঝোরা-ঝরনা, ঝাড়গ্রাম, ঘাটশিলা, পুরুলিয়া, মাঠাবুরু। তারপর হণ্টন। হণ্টন। আর হণ্টন। অযোধ্যা পাহাড়। সুবর্ণরেখা, সুবর্ণরেখায় নগ্ন হয়ে স্নান। মার্চে দেদার পলাশ ফোটে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়ায়। সেইসব ফুটে ওঠে পলাশের রক্তিমাভাসে বিদ্রোহ। বিদ্রোহের স্বপ্ন। বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঁচার বীজ। পথে বন্য ময়ূর, হরিণ।

মনোরঞ্জন মাহাতর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর দুই আগে, ঝাড়গ্রামে। একটি, দুটি, তিনটি দুঃস্থ পরিবারকে কিছু খাদ্য সামগ্রী নিয়ে দিতে গেছিলাম। তখন তিনি সি পি আই (এম-এল)-এর একটা ভাঙা অংশের সমর্থক। চেহারা ভেঙেছে। বয়সে যেমন হয়। কথা হল, চিনতে পারলেন। পুরনো কথা সব।

ঝাড়গ্রামে কবি অশোক মহান্তি ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও আলাপ ছিল যথেষ্ট। ভালো কবিতা লিখতেন অশোক। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। তাঁর হোটেল কাম চা-খানায় লোকাল কবি-সাহিত্যিকদের ভিড়। কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও যেতেন অশোকের সান্নিধ্যে। কবি সম্মেলন, সাহিত্য সম্মেলন।

আচমকাই মারা গেলেন অশোক স্ট্রোকে, বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কয়েক নয়, অনেক বছর। তাঁর বেড়াঘরের চা-খানাটিতে গেছেন বহু নামকরা কবি, লেখক। বসেছেন। আড্ডা দিয়েছেন। চা, বিস্কুট, কেক, ডিমের অমলেট, পাউরুটি, টোস্ট খেয়েছেন। বহু স্মৃতি আছে এই অশোক মহান্তীর দোকান ঘিরে। কালোর দিকে রং, গালে দাড়ি, চোখে চশমা, ফুল প্যান্ট-শার্ট। মুখে প্রসন্ন হাসি। আবেগ-উদ্বেলিত মানুষ।

ঝাড়গ্রামে শীতে, বর্ষায়, গ্রীষ্মে, বসন্তে— নানা সময়ে, নানান ঋতুতে গেছি। ঋতুর বদলে বদলে তখন ঝাড়গ্রামের নানা রকম রূপ। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি খুব বড়, সুন্দর। পাশে গেস্ট হাউস সম্ভবত।

ঝাড়গ্রামের পুকুরিয়াতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের কেন্দ্র। সেখানে নিয়ে যায় গল্পকার ললিত মাহাত। মাটির দোতলা বাড়ি সেখানে। লোধা ছাত্রদের থাকার ছাত্রাবাস। অনেক অনেক লোধা ছাত্র সেখানে। তারা স্পোর্টস করে, তিরন্দাজি, রাতে আরতিতেও তারা।

এই আশ্রমের যিনি প্রধান, তাঁর সঙ্গে কলকাতার যে কেন্দ্রীয় আশ্রম, তার মতবিরোধ, সেই তথ্য জানতে পারি, এদিক ওদিক থেকে। সময় গড়ায়। গড়ায়। দিন যায়। পুকুরিয়া, বাদুরডোবা সহ ঝাড়গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুজি, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের শিকড়।

Powered by Froala Editor