মুছে যায়— ৩৩
আগের পর্বে
শিখ সর্দারজিরাই চালাতেন বেবি ট্যাক্সি। অস্টিনের সেই শক্তপোক্ত মডেল হলুদ নয়, কালো। সে গাড়ির পেছনের সিটে বড় জোর আড়াই জন। পরে ‘অ্যামবাসাডার’ ট্যাক্সি এল বড়ো আয়তনের। ষাটের দশকের গোড়ায় বেবি ট্যাক্সি মুছে যায় কলকাতা থেকে। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর ধীরে ধীরে কলকাতা থেকে সরানো হয় কলোনিয়াল মূর্তিদের। সেসময় রামকিঙ্কর বেইজকে পূর্ণেন্দু পত্রী নতুন নতুন মূর্তি দেখে বেড়াতেন কলকাতায়। তারপর…
নাগভূষণ পট্টনায়ক ছিলেন অখণ্ড সি পি আই (এম-এল)-এর বড় নেতা। অন্ধ্রের কোরাপুট, গঞ্জাম জেলার কোরাপুট জড়িয়ে থাকে ভারতের সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন, বিদ্রোহের সীমান্তে। ওড়িশা, অন্ধ্রের সীমান্তে কোরাপুট।
শ্রীকাকুলামের সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম ঘিরে বাংলায় গান বাঁধা হয়েছিল সত্তর দশকে—
‘সেই শ্রীকাকুলামের পাহাড়ে পাহাড়ে
গেরিলারা লড়াই করে
গেরিলা লড়াই হায় গেরিলা লড়াই
সামন্তদের চোখে আজ ঘুম নাই ভাই রে ঘুম নাই তাই
গেরিলাদের হাতে বুঝি যাবে জীবনটাই যাবে জীবনটাই…’
এগান গাইতেন সত্তর দশকে নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী জনেরা। ১৯৭০-৭১। যখন যুবমেধের সময়। যখন শহিদত্ব— শাহদত, শহিদ হওয়ার সময়। জেলে, পুলিশ লক আপে, জেলের বাইরে—
সেই শ্রীকাকুলামের পাহাড়ে পাহাড়ে গেরিলারা লড়াই করে
আরও পড়ুন
তেলেনাপোতা, ছেঁড়া তমসুক— সিনেমা
গেরিলা লড়াই হায়, গেরিলা লড়াই…’
পঞ্চান্দ্রী কৃষ্ণমূর্তি শহিদত্ব বরণ করলেন। অন্ধ্রের পুলিশ তাঁকে হত্যা করল। পঞ্চান্দ্রী কৃষ্ণমূর্তি শারীরিকভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বললেন, আমাদের হত্যা করে, বিপ্লবের গতি রোধ করা যাবে না। সেটা ১৯৭০ সাল।
আরও পড়ুন
‘বেবিট্যাক্সি’ ও অন্যান্য
সাপ্তাহিক ‘দেশব্রতী’তে খুব বড় করে খবরটা করা হল। রেডবুক হাতে পঞ্চান্দ্রী কৃষ্ণমূর্তির ছবি ছাপা হল সেই লেখার সঙ্গে। পুলিশ খুন করল নির্মলাকেও।
কলকাতা ও তার গা লাগোয়া মফস্বলে দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হতে থাকল ‘আমাদের হত্যা করে বিপ্লবের গতি রোধ করা যাবে না’। কেউ কেউ লিখতেন, ‘আমাদের মেরে বিপ্লবের গতিরোধ করা যাবে না’। নিচে থাকত পঞ্চাদ্রী কৃষ্ণমূর্তির নাম। তখন সময়টা ‘হিমালয় থেকে ভারি’ হওয়ার সময়। তখন সময়টা ‘থাই পাহাড়ের থেকে ভারি’ হওয়ার সময়। ‘হিমালয় থেকে ভারি’ বলে একটি নাটকও নেমেছিল সত্তর দশকের প্রথম দিকে।
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীকান্ত বসু, কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া ও আরও কিছু
কানু সান্যাল শ্রীকাকুলাম গেছিলেন সত্তরের গোড়ায়। ‘ভারতের ইয়েনান’ বলা হতে থাকল শ্রীকাকুলামকে। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখাও হলে চীনের ইয়েনান আর ভারতের শ্রীকাকুলামের কথা। বই নির্মিত হল ‘ইয়েনান থেকে শ্রীকাকুলাম’ নামে।
কানু সান্যালের সঙ্গে নাকি একদা আর সি পি করা হিরন্ময় গাঙ্গুলি— হেনা গাঙ্গুলি বা অনেকের কাছে হেনাদা গেছিলেন কানুদা— কানু সান্যালের সঙ্গে শ্রীকাকুলামে। হেনাদার শ্রীকাকুলাম যাত্রা কতটা সত্যি জানি না। লোকমুখে শোনা। আর শ্রীকাকুলামে গিয়ে সি পি আই (এম-এল)-এর নেতৃত্বে তৈরি হওয়া তথাকথিত ‘লাল এলাকা’, ‘মুক্তাঞ্চল’ ইত্যাদি দেখে তিনি খুব স্বস্তি পাননি, ভালোও লাগেনি। হেনা গাঙ্গুলি নাকি খানিকটা হতাশই হয়েছিলেন শ্রীকাকুলামের গেরিলা বেস দেখার পর।
আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…
শ্রীকাকুলামে লং মার্চের স্বপ্ন, গেরিলা ফৌজ, চারু মজুমদারের ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’-এর স্বপ্ন, রেডিও সম্প্রচারের ইচ্ছে— সবই ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল সময়ের আবর্তে, ঘুর্ণিপাকে।
নাগভূষণ পট্টনায়ক না ভাঙা সি পি আই (এম-এল)-এর সেন্ট্রাল কমিটিতে ছিলেন বলে জানি। তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। পরে তা মকুব হয়। সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশান-এর ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন আই পি এফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট। তখনও সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশান ও সেই সংগঠনের নেতা বিনোদ মিশ্র প্রকাশ্যে আসেননি। আই পি এফ-এর বড় সমাবেশ হয় দিল্লিতে। আই পি এফ-এর বাংলা মুখপত্র ছিল ‘লোক সমাচার’। ট্যাবলয়েড। আশির দশকের গোড়ায় গোড়ায় ‘লোক সমাচার’ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। তখন ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’ বলেও একটি পত্রিকা বেরয়। পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির ‘ওয়ার্ল্ড টু উইন’ পাওয়া যায় কলকাতায়। পেরুর কমিউনিস্ট নেতৃত্ব গঞ্জালেজ-সহ তখন গেরিলা যুদ্ধে।
আশির দশকের প্রায় শুরুতে নাগভূষণ পট্টনায়ক কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য গেছিলাম পাক্ষিক প্রতিক্ষণ-এর পক্ষ থেকে। মাথা জোড়া টাক নাগভূষণের। সেই টাকমাথাই মাঝে মাঝে ধড়াম করে ঠুকে যায় হাসপাতালের দেওয়ালে। শব্দ হয় বেশ জোরে। এটাই নাগভূষণের অসুখ। কিছুতেই বডি ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারেন না। মাথা ঘুরে যায় হঠাৎ হঠাৎ।
জেলে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতেই এটা হয়েছে। নানা অত্যাচার, শারীরিক কষ্ট তার ফলেই এই খারাপ দশা নাগভূষণের। জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময় কিষ্ট্যা গৌড় ও ভূমাইয়া নামে সি পি আই (এম-এল)-এর সশস্ত্র পথের পথিক দুই কৃষককে ফাঁসি দেয় ইন্দিরা গান্ধী পরিচালিত কংগ্রেস সরকার। মানে ইন্দিরা কংগ্রেস সরকার।
ইন্দিরা কংগ্রেস মাঝে কিছুদিন দেবরাজ আর্সের নামে আর্স কংগ্রেস হিসাবে চলে। ইন্দিরা গান্ধী রায়বেরিলি নয়, চিকমাগালুর থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও জেতেন। চিকমাগালুর কর্ণাটকে।
ইন্দিরা গান্ধী বাধ্য হলেন রায়বেরিলি ছেড়ে কর্ণাটকের চিকমাগালুর থেকে নির্বাচনে দাঁড়াতে। তখন একটা ছড়া লিখেছিলাম এরকম, প্রকাশিত হয়েছিল ‘যুগান্তর’-এর প্রথম পাতায়, রোজনামচা যে নিত্য ছড়ার কলামটি ছিল, সেখানে। ছড়াটি এই রকম।
‘চিকমাগালুর চিকের আড়াল
ভোটার হাসে ফিক
নেতারা দেন আণ্ডায় তা
কার ফুটবে Chick (চিক)!’
আমার ছড়ার সঙ্গে ছবি এঁকেছিলেন প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তী। অমলদা প্রায় তিনটে নাগাদ যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকা আপিসে আসতেন। তার আগে তিনি সাপ্তাহিক ‘দর্পণ’ ও সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’-এ কার্টুন করতেন। অমলদা সুভদ্র। চমৎকার গুণী মানুষ। সব সময় টেরিকটের প্যান্ট আর টেরিকটেরই হাফ হাতা শার্ট। শীতে পুরোহাতা সোয়েটার। অমলদা পরে চলে যান ‘প্রতিদিন’— ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। সেখানে তাঁর নিত্য কার্টুন কলামটির নাম ‘অমল আলোয়’।
কথা হচ্ছিল নাগভূষণ পট্টনায়ককে নিয়ে। প্রবল অসুস্থ এই নকশালপন্থী নেতা আই পি এফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি প্রয়াত হন, রোগভোগের পর। আই পি এফ ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের অবিভক্ত বিহার, খানিকটা দিল্লি ইত্যাদিতে। এছাড়া আসাম, পশ্চিমবাংলা। কেন জানি না আমার মনে হয় সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশান-এর আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃত্ব ব্যবহার করেছেন আই পি এফ-কে তাঁদের আত্মগোপনের প্রচার-চাল হিসাবে, কিন্তু যেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্য, সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশান আত্মগোপনের পথ থেকে প্রকাশ্যে বন্দুক ছেড়ে সংসদীয় রাজনীতির প্রচারে এসেছে, নির্বাচনী ফলাফল ভালো করেছে অখণ্ড বিহারে, তখনই আই পি এফ-এর কর্মকাণ্ড শেষ। তাকে চেপে দেওয়া হল। সি পি আই (এম-এল)-এর আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃত্ব কী আই পি এফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের ক্রমবর্ধমান প্রসার ও প্রচারে শঙ্কিত, অস্বস্তিতে ছিলেন?
এসবই আমার অনুমান। একান্ত নিজস্ব অনুমান। আই পি এফ-এর ইংরেজি মুখপত্র ছিল ভয়েস অফ অল্টারনেটিভ, যাকে সংক্ষেপে ভি ও এ— ভোয়া বলা হত। উত্তর-পূর্ব কলকাতার শেয়ালদা স্টেশনের উল্টোদিকে আই পি এফ অফিস, ক্রিক রোডে। তারপর সেটা ক্রমে ক্রমে সি পি আই (এম-এল) লিবারেশান অফিস হয়ে উঠল।
ধীরে ধীরে আই পি এফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের সবটুকু মুছে গেল। পুরনো ‘লোক সমাচার’, ‘ভয়েস অফ অল্টারনেটিভ’ দেখলে সেই সব ইতিহাস মনে পড়ে। সেইসঙ্গে কত কত কথা— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট— আই পি এফ-এর পুরনো ইতিহাস। তাদের বেড়ে ওঠা। প্রসার।
বিধানসভা নির্বাচনে আই পি এফ জোড়া মাছ চিহ্ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মুর্শিদাবাদে কান্ডিতে ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় লড়েছিলেন বিধানসভা নির্বাচনে। ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় এক সময় সি পি আই (এম) করতেন, পরে আই পি এফ। কান্দিতে তাঁর বাড়ি। সেখানেই রাত্রিবাস করি।
হিজলের রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় অনেক কিছু জানেন। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকর সৈয়দ মুস্তাফা মিরাজের বড় আখ্যান, গল্পে হিজল, হিজল-কন্যারা উঠে এসেছে বারে বারে।
মুর্শিদাবাদের হিজল। বন্য, আদিম, রুক্ষ। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘তৃণভূমি’ এই অঞ্চলের কথা বলে। রক্ত, বন্দুক, হত্যা, রক্তের আঁশটে নোনা গন্ধ। অনেকে সিরাজ ও তারাশঙ্করকে ভৌগলিক দিকেও বসান এই জায়গায়। নাহ, তা নয়। উত্তর রাঢ়— সিরাজের উত্তর রাঢ় তারাশঙ্করের দক্ষিণ রাঢ়বঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আলকাপের মাস্টার, ঝাকসু ওস্তাদ, স্টেজে নেচে বেড়ান নারীপ্রতিম কচি কচি নমনীয় সুন্দর বালকেরা, তাদের নাচ— সব মিলিয়ে এক অতি নিবিড়, গোপন যৌনতা, ‘নিষিদ্ধ’ সমকাম ইশারা।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এই জগৎটাকে চমৎকার ধরলেন তার ‘মায়ামৃদঙ্গ’ নামের আখ্যানে। থাক, সে সব কথা।
ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায়দের বড় বাড়ি। বড় বড় ঘর। কিন্তু খুব রঙটঙ করা নয়। প্রাচীনত্বের ছাপ সেই প্রাসাদ— প্রাসাদ বাড়ির সর্ব অঙ্গে। দোতলা বাড়ি। বি-ই-শা-ল, বি-ই-শাল পালঙ্ক, মেহগনির। সেই খাটে শুই। সঙ্গে আই পি এফ প্রচারক অধ্যাপক অরিজিৎ মিত্র, বরেন ভট্টাচার্য, নিত্যানন্দ ঘোষ।
বড় ঘর, বড় খাট, মশারি নেই। ফলে মশার আক্রমণ সারা রাত। এভাবেই তো দিন তিনেক। বিস্তৃত, বিস্তীর্ণ হিজল ঘুরে ফেরা। অনেক অনেক কিলোমিটার। ভৈরবেন্দ্রনারায়ণের বাড়িতে হুডখোলা জিপ একটা, ভাড়ার কিনা জানি না।
ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ রায় হেরে গেলেন ভোটে। জোড়া মাছ— এই নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে পরে আই পি এফ আরও নির্বাচন লড়েছে।
ভয়ঙ্কর অসুস্থ নাগভূষণ পট্টনায়ককে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে বেশ কয়েকবার দেখে আসি। ওঁর হঠাৎ হঠাৎ দেওয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়া আছেই। একজন অতি-সুন্দরী জুনিয়র লেডি ডকটর তাঁর দেখভাল করতেন সর্বদা। সাদা খোলের শাড়ি, সবুজ পাড়, এখনও মনে আছে।
নাগভূষণ পট্টনায়কের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিই। তখন পৃথিবীটা বহু স্বপ্নে ভরপুর। বিপ্লব— বিপ বিপ বিপ্লব হয়ে যায়নি।
সি পি আই (এম-এল)/ লিবারেশান-এর নেতা বিনোদ মিশ্র পরিচিত ছিলেন ভি এম বলে। বিনোদ মিশ্র দুর্গাপুর রিজিওনাল এনজিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। বহু বছর আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি।
নাগভূষণ পট্টনায়ক তাঁর সাক্ষাৎকারে ভারতের রাষ্ট্র চরিত্র— রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র নিয়ে বলছিলেন অনেক কথা। তাঁর কথাবার্তায় কোনো অসঙ্গতি ছিল না। তবে মাঝে মাঝে কোথায় যেন সুতো হারাচ্ছিল সামান্য। আবার নিজের কথা গিঁট নিজেই দিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন।
অন্ধ্রের কৃষক সংগ্রাম, ভোজপুরের সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে জাতীয় কংগ্রেস সরকার বিরোধী লড়াই, সেখানে কৃষকদের ভূমিকা, আন্দোলন কতটা সশস্ত্র, কতটা সাংসদীয় হবে, তা নিয়ে তাঁর মতামত অতি স্পষ্ট। নাগভূষণ পট্টনায়কের এই সাক্ষাৎকারের কথা এখনও মনে আছে। ডট পেন, ছোট পকেট-প্যাড। টেপ রেকর্ডার নেই। সাংবাদিকতা করতে করতে কতবার ভেবেছি একটা অতি ছোট ‘সোনি’ টেপ রেকর্ডার কিনব তা আর হয়নি। ‘সোনি’-র এই টেপটি পকেটে রাখা যেত দিব্য, মেড ইন জাপান।
শ্রীকাকুলামের কৃষক সংগ্রাম আর অভ্যুত্থানের মেজাজও পতন— ধীরে ধীরে চূর্ণ হয়ে যাওয়া অত বড় কৃষক আন্দোলন, তা নিয়ে নাগভূষণ বেশ কিছু বলেননি এই সাক্ষাৎকারে। অখণ্ড সি পি আই (এম-এল)-এর তুলনায় বর্তমানের ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট— আই পি এফ প্রসঙ্গ তাঁর বক্তব্যে বার বার উঠে আসছিল।
ভোজপুর, নালন্দা, গয়ার কৃষক সংগ্রাম, আরোয়াল হত্যাকাণ্ড— পাটনায় প্রতিবাদ র্যালি— সব কিছুই বলছিলেন তিনি। বলছিলেন বিপ্লবী কবি চেরবান্দা রাজু ও তাঁর কবিতার কথা। কিন্তু গণনায়ক গদর বা কবি ওয়ারওয়ারা রাও— যাঁকে এই বঙ্গভূমির অনেকেই ভারভারা রাও বলে ডেকে থাকেন, তাঁর কথা বিশেষ উঠে আসেনি, অন্তত নাগভূষণ পট্টনায়কের সঙ্গে কথোপকথনে।
চেরবান্দা রাজুর বহু কবিতা অনূদিত হয়েছে বাংলায়, ইংরেজি আর হিন্দিতে। হয়ত আরও অন্য কোনো ভাষায়।
নাগভূষণ পট্টনায়ক বলছিলেন সমবেত প্রতিবাদ, কৃষকদের শ্রেণী চেতনা ও সমবেত শৌর্যগাথা। বিহারের রামেশ্বর আহির— ‘মাস্টারসাব’ বলে যিনি পরিচিত ছিলেন রাজনৈতিক মহলে, তাঁর কথাও কিন্তু উঠে আসেনি সেদিন।
নাগভূষণ স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্ন বুনছিলেন।
হাসপাতালের অসুস্থ ঘন গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল তাঁর সুস্থতার স্বপ্নকথা। এই সমাজটাকে সুস্থ করতে হবে। অসাম্য, অশিক্ষা, বেকারি, খাদ্যের অভাব— সব সব কিছু, স্বাস্থ্যহীনতা— তাকেও উপড়ে তুলে ফেলতে হবে শিকড় থেকে। তাই আই পি এফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট। নাগভূষণ পট্টনায়কের কথা সংগ্রামের এক নতুন দিশা— নতুন পথ।
Powered by Froala Editor