মুছে যায়? — ৩২
আগের পর্বে
কলকাতায় বড়ো ‘ল্যান্ডমাস্টার’ ট্যাক্সি চলত স্বাধীনতার আগে। পরে বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় আসে ‘বেবিট্যাক্সি’। সে ট্যাক্সির লাইসেন্স ঢালাও দেওয়া হয়েছিল বাঙালি যুবকদের। তবে মোটা অঙ্কে হাতবদল হয়ে তা চলে যায় পাঞ্জাবী ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হাতে। আশির দশক পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন কলকাতাতেই। ‘গ্রিন রেভোলিউশন’-এর পর ধীরে ধীরে দেশে ফেরেন তাঁরা। অসম্ভব ওয়াফাদার এই সর্দারজিরা ‘ওয়েটিং চার্জ’-ও নিতেন না। তারপর…
কলকাতায় বেবি ট্যাক্সি চলত পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেও। মূলত শিখ সর্দারজিরাই তার চালক। তখন ‘বর্মা শেল’ নামের কোম্পানির পেট্রোল পাম্প। পেট্রল গ্যালনের হিসাবে বিক্রি হয়। ‘বর্মা শেল’-এর লোগো পাখা যেমন দেখতে, অনেকটা তেমন চেহারার ঝিনুকের ছবি যেমন তেমন লালের ওপর হালকা হলুদ।
সারা পৃথিবী জুড়ে তখন ব্যবসা বর্মা বা ‘বার্মা শেল’-এর। তেল, তেল, তেল। মাটির নিচের তেল— পেট্রোলিয়াম— ‘কালা সোনা’।
বেবি ট্যাক্সির ভাড়া বড় ট্যাক্সি— ‘ল্যান্ড মাস্টার’-এর তুলনায় কম। ‘বুইক’ ছিল কি গাড়ির মডেল? না, না, ভুল বললাম— ‘বেবি অস্টিন’ সম্ভবত। ‘অস্টিন’-এর সঙ্গে সঙ্গে বাজারে চলত ‘বেবি অস্টন’। পুরনো ‘অস্টিন’— সেকেন্ড হ্যান্ড পঞ্চাশের দশকে বিক্রি হত দেড়-দু হাজারে।
কলকাতার ঘোড়ায় টানা ট্রাম, ঘোড়ায় ঘোড়ায় টানা ‘ল্যানডো’, ‘ব্রুহাম’, ‘ব্রাউনবেরি’ ইত্যাদি জুড়িগাড়ি, তার সঙ্গে কোচয়ান, সহিস— এসব তো পুরনো কলকাতার নানা ছবিতেই জেগে থাকে। দুই ঘোড়া, চার ঘোড়া সবই ছিল ঘোড়ার গাড়ি টানার জন্য। এক ঘোড়ার গাড়ি খেলো— ছ্যাকরা গাড়ি। সেই যে ছিল ছ্যাকরা গাড়ি, তাও ঘোড়ায় টানা বলাই বাহুল্য। হাওড়া স্টেশনের বাইরে ছিল ঘোড়ার গাড়ির আড্ডা। ছিল বক্স গাড়ি। কাঠের বাক্সের ভেতর যাত্রী, বাইরে ঘোড়া। সেইসব ঘোড়াদের দু চোখে কালো ঠুলি, মুখে ঘাসের ছোট বস্তা, ছোলা ভেজান থাকে ঘোড়াদের জন্য। কলকাতার রাস্তায়্ রাস্তায়, ময়দানের কাছাকাছি গাড়ি টানা ঘোড়াদের জল খাওয়ার জায়গা। সিমেন্ট বাঁধানো, খানিকটা যেন অর্ধ ডিম্বাকৃতি।
আরও পড়ুন
‘বেবিট্যাক্সি’ ও অন্যান্য
কলকাতায় রেসের ঘোড়া, মাউন্টেড পুলিশ— ঘোড়া পুলিশদের জন্য আলাদা আলাদা আস্তাবল কলকাতা ময়দানে— ফুটবল মাঠে ঘোড়া পুলিশদের গাজোয়ারি, চার্জ— ঘোড়া চালিয়ে চেওয়া, এসবই তো ছিল এই সেদিনের ব্যাপার। ব্রিটিশ আমলে মাউন্টেড পুলিশ, পরবর্তী সময়ে মানে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর মাউন্টেড পুলিশ— অশ্বারোহী পুলিশ চার্জ করেছে— সামনে দু পা তোলা ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধীদের প্রতিবাদী জমায়েত, মিছিলে। তার ফলে আহতও হয়েছে অনেকে।
ঘোড়ার ঘাস কাঁটা ঘেসেড়েরা তখন কলকাতায় আছেন। বাংলা প্রবাদে মিশে রয়েছে ‘ঘোড়ার ঘাস কাঁটা’ শব্দটি।
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীকান্ত বসু, কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া ও আরও কিছু
ঋত্বিক কুমার ঘটক সুবোধ ঘোষের গল্প ‘অযান্ত্রিক’ নিয়ে যে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন, তাতে এমনই একটি লঝঝড়ে গাড়ি— জগদ্দল। আবার ‘অভিযান’ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সেখানেও গাড়ি। গাড়ি। ‘অভিযান’-এর কাহিনীকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
রেসিংকার— হাওয়া গাড়ি কত না বৈচিত্র তার। লাল রঙের হুড খোলা রেসিংকার— কোনো জবাব নেই।
আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…
বেবি ট্যাক্সি— ‘বেবি অস্টিন’ দিয়ে তৈরি করান বেবি ট্যাক্সি উঠে গেল কলকাতা থেকে। শক্তপোক্ত মডেল বেবি অস্টিন-এর। বডি মোটা লোহার পাতে তৈরি। কালো রঙের ট্যাক্সি। কলকাতায় হলুদ ট্যাক্সি তখন কোথায়? লাট্টু মিটার— যা ইচ্ছে টাকার পরিমাণ মিটারে তোলার ব্যবস্থা, তখনও আসেনি।
‘ল্যানড মাস্টার’ মোটর দিয়ে তৈরি ট্যাক্সির রংও কালো। পুরনো বাংলা সিনেমার কোনো কোনো চকিত শটে— ফ্রেমে হয়তো ‘বেবি ট্যাক্সি’— ‘বেবি অস্টিন’-এর মডেল, বড় ট্যাক্সি ‘ল্যানড মাস্টার’ দেখা যাবে। হয়তো অন্য অন্য গাড়িও।
আরও পড়ুন
সাগর— গঙ্গাসাগর মেলা— সাগরসঙ্গমে...
কলকাতা ময়দানে ফুটবল লিগে বড় ম্যাচ, ছোট ম্যাচ, মাঝারি ম্যাচে ঘোড়া পুলিশের তাড়া, ঘোড়ার চাঁট— লাথি খাননি, ষাটোর্ধ্ব এমন বাঙালি বিরল।
থাক ওসব কথা। পুনরায় ফিরে আসি বেবি ট্যাক্সি প্রসঙ্গে। কলকাতার রাস্তাতেই দেখা যেত ‘বেবি অস্টিন’ মডেলের বেবি ট্যাক্সি। তার ব্যাক সিটে বড়জোর আড়াইজন। মানে দুজন অ্যাডাল্ট, একজন বাচ্চা। চালকের পাশে কোনো বসার ব্যবস্থা নেই। ‘ল্যানড মাস্টার’ ট্যাক্সিতে বসার ব্যবস্থা অনেক বিস্তৃত। পরে ‘অ্যামবাসাডার’-ও তেমনই বড় খোলের— আয়তনের।
কিশোরকুমার-অশোককুমার-অনুপকুমার-মধুবালাদের ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ সিনেমাটার নাম মনে পড়ে যায় এই গাড়িদারি বা গাড়িবাজি প্রসঙ্গে। কী চমৎকার গান গেয়েছিলেন কিশোরকুমার। সেইসঙ্গে মধুবালার অনির্বচনীয় হাসি আর অনন্ত রূপ।
আমার কেন জানি না বার বার মনে হয় সুচিত্রা সেন, মধুবালা আর মাধুরী দীক্ষিতের সিনেমার পর্দা জোড়া হাস্য মাধুর্য একই ঘরানার। কোথায় যেন একটা গোপন মিল রয়েছে তাঁদের মধ্যে। আর এঁরা তিনজনেই সামান্য ট্যারা। অতি সামান্য এই ট্যারাকে পুরনো বাঙালি সংস্কারে বলে ‘লক্ষ্মী ট্যারা’। রমা সেন— সুচিত্রা সেন, মাধুরী তো বটেই, মধুবালাও সামান্য মণি সংস্থানে— দু চোখের মণির বিন্যাসে একদম ট্যারা। যা দর্শককে প্রেমিক এবং ট্যারা করে দেয় একই সঙ্গে। হিন্দিতে— ইলাহাবাদে এই ট্যারা ভাবকে বলে, ‘ফুত্তু’। আর তিরছি নজরকে বলে ‘কানিয়াকে দেখ’। একদা বোম্বাইয়া— এখন— মানে ইদানিং বেশ কয়েক বছর মুম্বাইয়া হয়ে যাওয়া সিনেমার, নানা সিনেমার বিভিন্ন গানে ‘পাতলি কোমর’ আর ‘তিরছি নজর’-এর বন্দনা আছে।
কথা হচ্ছিল ‘বেবি ট্যাক্সি’ নিয়ে। কলকাতার রাস্তায় বেবি ট্যাক্সি চালাতে শুরু করলেন অখণ্ড পাঞ্জাব থেকে আসা শিখ বন্ধুরা। যাঁদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ‘মকাই কি রোটি’ আর সরষোঁ কা শাগ মিশে আছে।
মাস্টার তারা সিংয়ের কথা বলেছি গত বারের ‘মুছে যায়?’-তে। স্বতন্ত্র পাঞ্জাবি সুবা গঠনের জন্য তিনি ও তাঁর অনুগামীরা যে আন্দোলন করলেন, পঞ্চাশের দশকের একেবারে শেষ দিকেও, তাই হয়তো ভবিষ্যতের খালিস্তানি আন্দোলনের বীজযাত্রা। তারা সিং— মাস্টার তারা সিং তখন প্রায়ই হুমকি দিতেন জ্বলন্ত আগুনে আত্মাহুতি দেওয়ার। সে কথাও লিখেছি আগের পর্বে আর তা নিয়ে খবরের কাগজ, রেডিও— বেতারের খবর ইত্যাদি কখনও কখনও তারা সিং ও তাঁর স্বতন্ত্র পাঞ্জাবি সুবা কেন্দ্রিক দাবির দিকেই কেন্দ্রীভূত হত। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মাস্টার তারা সিংয়ের এই স্বতন্ত্র পাঞ্জাবি সুবা কেন্দ্রিক আন্দোলনে ক্ষণ-বিব্রত হতেন। আকালি দল বা অকালি দলের একটা ফ্র্যাকশান ছিল আকালি দল (তারা সিং) নামে। আকালি বা অকালি দলের যে পূর্বাপর ইতিহাস চর্চা, তাতে তারা সিংয়ের নাম ঠিক কোনখানে আছে, বড্ড জানতে ইচ্ছে করে।
বেবি ট্যাক্সি, ট্যাক্সি, গাড়ি— সবই অশ্বশক্তি— হর্স পাওয়ার নির্ভরশীল। মানে তার গতি ইত্যাদি, ঘণ্টার ঠিক কত মাইল বা কিলোমিটার বেগে চলবে— ছুটবে তা নির্ধারিত করতে হর্স পাওয়ার বা অশ্বশক্তি। যতদূর জানি সারা বিশ্বেই এই নিয়ম। অশ্ব হচ্ছে মানুষের প্রাচীনতম গতি ভাবনার প্রতীক। সেই রামায়ণ-মহাভারত যুগ থেকেই ঘোড়া অথবা অশ্ব গতিবেগের প্রতীক হয়েই আমাদের সামনে। এই প্রসঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞ ইত্যাদির জন্য ঘোড়া, ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া, সেই ঘোড়াদের ধরা, ছাড়া সবই মহাকাব্যের অঙ্গ।
অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হত রাজার পক্ষে ‘রাজ চক্রবর্তী’ হওয়ার জন্য। রাজার ঘোড়া— যে রাজা ঘোড়া ছেড়ে দিলেন, সেই রাজার ঘোড়া ধরলে বা আটকালে চ্যালেঞ্জ অনিবার্য। সেই সূত্র ধরেই সংঘর্ষ। লড়াই, যুদ্ধ। তীব্র যুদ্ধ।
ধরে রাখা সেই ঘোড়াটিকে অন্য রাজার রাজত্ব ও সৈন্যের কবল থেকে ছাড়িয়ে বার করে আনার জন্য যিনি ঘোড়া পাঠিয়েছেন বিভিন্ন রাজ্য পরিক্রমা করতে, তাঁর সৈন্যবল ব্যবহার হত, এই তথ্য রামায়ণ-মহাভারতে আছে।
রাজ্য থেকে রাজ্যন্তরে পরিক্রমা করে আসা সুলক্ষণ যুক্ত বিজয়ী ঘোড়াটিকে যজ্ঞ বলি দেওয়া হত— অশ্বমেধ যজ্ঞে। এই সারা দেশ ঘুরে আসা ঘোড়াটির সঙ্গে নাকি রাজার পট্টমহিষী— পাটরানি সঙ্গম করতে বাধ্য হতেন। এটাও নাকি নিয়ম, সংস্কার। বাল্মীকির রামায়ণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত রামায়ণ— সবেতেই লব-কুশ, শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষণ প্রভৃতি নিয়ে আশ্বমেধের ঘোড়া ঘরে রাখা ও তার ফলাফলে যুদ্ধ আছে।
রামায়ণ, মহাভারতের পৃথিবী পার করে আসার বহু বছর পর ওয়েলার ঘোড়ার কথা আমরা শুনতে পাই। দেখতেও পাই। আরবি ঘোড়া, অস্ট্রেলিয়ার ঘোড়া ছিল অতি বিখ্যাত। যেমন তাদের শান-শওকত, তেমনই তাদের দম।
সারা পৃথিবী জুড়েই প্রায় এক সময় ঘোড়সওয়ার বা ঘোড়সওয়ার বাহিনী— ক্যাভালরি ছিল। আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনী বিদ্যমান। সম্ভবত তা পৃথিবীর একমাত্র অশ্বারোহী বাহিনী। ২৬ জানুয়ারি, ১৫ আগস্টের প্যারেডে এই অশ্বারোহী বাহিনী অংশ নেয় প্যারেডে।
বেবি ট্যাক্সি কলকাতার রাস্তা থেকে ম্যচগে গেল ধীরে ধীরে। যেমন সি প্লেন, যা যখন তখন নামত, দক্ষিণেশ্বরের কাছাকাছি গঙ্গার বুকে, গেরুয়া গঙ্গাস্রোতে তখন প্রচুর শুশুক— ইনডিয়ান ডলফিন। সেটা ষাট দশকের গোড়ার কথা।
পরাধীন ভারতবর্ষে বিপ্লবী বাঘাযতীন— যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অশ্বারোহণ জানতেন। অশ্বপৃষ্ঠে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে আমরা দেখেছি। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে কুৎসিত ঘোড়ার পিঠে নেতাজির মূর্তিটি একেবারেই শোভন নয়। বহু বছর হল এই ব্রোঞ্জের মূর্তিটি রয়েছে।
মনে পড়ে সত্তর দশকের একেবারে গোড়ায় অথবা ষাট দশকের অন্তিম বিন্দুতে প্রখ্যাত মূর্তিকর রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে পূর্ণেন্দুশেখর পত্রী— লোকসমক্ষে যিনি পূর্ণেন্দু পত্রী হিসাবে পরিচিত ছিলেন, মানে পূর্ণেন্দু পত্রী নামেই তাঁকে আমরা চিনি, সেই পূর্ণেন্দুদা কলকাতার নানা রাস্তার, নতুন নতুন মূর্তি দেখে বাড়াতে থাকলেন কিঙ্করদাকে সঙ্গে নিয়ে।
১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ঔপনিবেশিক ভারতের চিহ্ন হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসক সেনাপতিদের চমৎকার মূর্তি সরানো হয় ধীরে ধীরে। এস ইউ সি-র সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পূর্তমন্ত্রী।
মৃণাল সেন তাঁর ‘ইন্টারভিউ’ নামে চলচ্চিত্রটির শুরু তেই সব কলোনিয়াল মূর্তিদের ক্রেনে করে সরানো নিয়ে। লর্ড কার্জন, জেনারেল আউটট্রাম, রানি ভিক্টোরিয়া— সবার মূর্তিই সরানো হয় একটু একটু করে।
এইসব অসামান্য শিল্প কর্মদের জায়গা হয় অখণ্ড চব্বিশ পরগনার বারাকপুরের লাটবাগানে। এই লাটবাগান থেকেও কোনো কোনো মূর্তি নাকি নিঃশব্দে সরে গেছে। জেনারেল আউটট্রামের স্ট্যাচু বা মূর্তির ঘোড়াটির কথা মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে। চলতে গতি। গতি। আর গতি।
কিঙ্করদা— রামকিঙ্কর বেইজকে দিয়ে অনেক অনেক বিপজ্জনক কথা বলিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী, সেই সময়। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে থাকা ঘোড়ার পিঠে সুভাষচন্দ্রের মূর্তিটি দেখে তিনি বলেছিলেন এটা কী? ঘোড়ার বিচি। ঘোড়ার বিচি। হা-হা-হা। এইসব কথা ছবি-সহ ছাপা হয়েছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ফলাও করে, সম্ভবত একেবারে শেষের পাতায়। সম্ভবত তখন খেলার পাতাটি বাংলা দৈনিকের লাস্ট পেজ হয়ে ওঠেনি।
অশ্বপৃষ্ঠে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের পাঁচ মাথার মোড়ের মূর্তিটি নিয়ে তখন প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। বিশেষ করে ঘোড়ার ল্যাজটি নিয়ে। উর্ধ্বগামী— আকাশমুখী সে ল্যাজ। পরে ধীরে ধীরে সেই ল্যাজকাহিনি বা ল্যাজ-বিতর্ক মিটে যায়।
পূর্ণেন্দু পত্রী একাধারে কবি, গল্পকার, ছবি আঁকিয়ে, প্রচ্ছদ ডিজাইনার, ফিল্মমেকার, কত যে গুণ তাঁর। সুধানাথ চক্রবর্তী এই ছদ্মনামে তিনি লিখতেন ‘নতুন সাহিত্য’-সহ নানা পত্রিকায়।
পূর্ণেন্দুদার প্রয়াণের পর নাকোলে পূর্ণেন্দু মেলা শুরু হয়। সেই মেলাতেও গেছি। গ্রামীণ শিল্প, হস্তশিল্পের প্রতি বিপুল আগ্রহ ছিল পূর্ণেন্দুদার। তাঁর তৈরি করা সিনেমা নিয়ে কেউ সেভাবে কথাই বলে না। প্রেমেন্দ্র মিত্র’র গল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি ‘স্বপ্ন নিয়ে’। পরে একই কাহিনী নিয়ে ছবি বানালেন মৃণাল সেন— খণ্ডহর।
পূর্ণেন্দুদা ‘স্ত্রীর পত্র’ ছবিটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে। মালঞ্চও রবীন্দ্রকাহিনি। ‘ছেঁড়া তমসুক’ করেছিলেন সমরেশ বসুর গল্প অবলম্বন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ নিয়ে ছবি বানালেন পূর্ণেন্দু। তারপর ‘খরা’ আর ‘গুহাচিত্র’ নামের ছবি দুটি অসামাপ্ত রইল। যেমন সুচিত্র সেনকে নিয়ে করা ‘চতুরঙ্গ’। অসমাপ্ত ছবি।
‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’-তে পূর্ণেন্দুদা নিজে অভিনয় করেছেন। যেমন সত্যজিৎ রায় করেছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে। ফিল্মে অ্যানিমেশনের ব্যবহার আমরা দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে। এর অনেক আগে ‘স্ত্রীর পত্র’-তে পূর্ণেন্দু পত্রী ব্যবহার করেছিলেন অ্যানিমেশন। সেও দারুণ।
পূর্ণেন্দু পত্রী নব্বই বছর স্পর্শ করলেন। বেঁচে থাকলে তিনি নব্বই স্পর্শ করতেন। আবার এই অঙ্ক— যোগ-বিয়োগ ধরেই বলি, কুপন ছাপিয়ে চাঁদা তুলে ছবি করতে চেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। সেই চাঁদা তোলার সহযোগী হয়েছি আমরাও। সামান্য টাকা, কুপন কেটে তুলে দেওয়া।
সমরেশদার ‘ছেঁড়া তমসুক’ নামের গল্পটি নিয়ে পূর্ণেন্দুদা যে ছবি করেন, সেখানে ট্রেনে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করা বিজু কবি সম্মেলনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়া শুনে আত্মহননে উৎসাহী হয়। কবি সম্মেলন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কোনো কোনো ‘দেশ’-আনন্দবাজার গ্রুপের কবি ছিলেন এই সিনেমার শটের কবি সম্মেলনে। সাদা-কালো ছবি ছিল ‘ছেঁড়া তমসুক’। সমরেশ বসু অবুশ্য ‘ছেঁড়া তমস্যক’-এর চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কিড স্ট্রিটের কাছে ‘শামিয়ানা’ নামক বারের আড্ডায় তিনি বলেওছেন সেই কথা।
প্রায় শেষ বিকেলে ১৬ নম্বর বিড স্ট্রিটের তিনতলায় মহানগর অফিসে আসতেন তিনি, সম্পাদনার কাজ করতে। এসে নিজের লেখা নিয়েই বসে যেতেন সাধারণত। ধুতি-পাঞ্জাবিই পরতেন, শীতে তার ওপর শাল। এছাড়াও টেরিকটের ফুল প্যান্ট, ফুল শার্ট, একটু হিলদার বুটও পরতেন তিনি। শীতকালে ব্যবহার করতেন কোট। আসলে কবি সম্মেলনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা শুনতে শুনতে বিজুর রেললাইনে গলা দেওয়া সমরেশ বসু মানতে পারেননি। প্রেমেন্দ্র মিত্রও তাঁর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ ছবিটি একেবারেই পছন্দ করেননি। বার বার বলেওছেন সেই কথা, আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে। ‘ছেঁড়া তমসুক’-এ বিজুর অভিনয় করেছিলেন সুমিত্র মুখোপাধ্যায়।
Powered by Froala Editor