লক্ষ্মীকান্ত বসু, কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া ও আরও কিছু

মুছে যায়? - ৩০
আগের পর্বে

‘দৈনিক বসুমতী’, ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার’, ‘আনন্দবাজার’-এর মতোই হিন্দি দৈনিক ‘সমার্গ’, ‘বিশ্বামিত্র’-তেও বেরত কার্টুন। আর সেই কার্টুন থেকেই নাকি পাওয়া যেত সাট্টা জেতার সূত্র। ২০০০ সালের পর বন্ধ হয়ে যায় সাট্টা। টালিগঞ্জের ঘোড়দৌড়ও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এক সময়। বসুমতীর হয়ে সাংবাদিকতা করার সময় যেতে হয়েছে লেক স্টেডিয়ামে আয়োজিত রাম চ্যাটার্জির সভায়। সেই প্রকাশ্য সভায় মঞ্চ থেকে রাম চ্যাটার্জি বলে উঠেছিলেন ‘মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ’। ‘জ্যোতিবাদ’ শুনে মঞ্চে উপস্থিত স্বয়ং জ্যোতি বসুও মিনিট খানের জন্য বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন যেন। তারপর…

জরুরি অবস্থা ও প্রাক জরুরী অবস্থায় কংগ্রেস (আই)— ইন্দিরা কংগ্রেসের শাসনকালে ‘স্টেটসম্যান’ ফেরত কেদার ঘোষ যে ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক, সে কথা আগেই বলেছি। সিদ্ধার্থশঙ্কর-এর জমানায় সুব্রত মুখোপাধ্যায় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে আবার কেদারবাবুর প্রচুর মন কষাকষি। ফলে সুব্রত মুখার্জির খবর খুব গুরুত্ব দিয়ে কখনওই ছাপা হত না ‘দৈনিক বসুমতী’র পাতায়। জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতিতে সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সোমেন মিত্রর মুখ ছিল অতি পরিচিত খবর। কিছু দিন পরে সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রিয় দাশমুন্সীরা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের গ্রুপ এবং সোমেন মিত্র বরকত গনি খান চৌধুরীর গ্রুপ করতেন। লক্ষ্মীকান্ত বসু ছিলেন শ্রমিক, নেতা ও বিধায়ক। তিনি আই এন টি ইউ সি-র পাল্টা শ্রমিক সংগঠন এন এল সি সি গড়ে তোলেন। এন এল সি সি-তে একসময় অনেক লোকজন ছিল। রাসবিহারীর কাছাকাছি প্রতাপাদিত্য লেনের ওপর ছিল লক্ষ্মী বসু বা লক্ষ্মীকান্ত বসুর অফিস।

লক্ষ্মী বসু বিধায়ক, রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস বিধায়ক। লোকাল জাতীয় কংগ্রেস কাউন্সিলর চিনা, তাঁর ভালো নামটি নীরেন চ্যাটার্জি। চিনা রোগা, ছিপছিপে, লম্বা। এলাকায় তাঁর গাজোয়ারি প্রভাব— মাস্তানি যথেষ্ট। লক্ষ্মী বসুর সঙ্গে চিনার সম্পর্ক যাকে বলে একেবারে সাপে-নেউলে।

একসময় কলকাতার সময়ে সময়ান্তরে গোপাল পাঁঠা, ভানু বোস, জয়হিন্দ মুখার্জি। টুপি কাশি, ইনু মিত্র– ইনু মিত্তির, ননী দাস, ফাটাকেষ্ট, হাত কাটা দেবা ইত্যাদি প্রভৃতি মস্তান বা মাস্তানদের কথা শোনা যেতে থাকে। ইনু মিত্তির বেলঘোরিয়ার, হাত কাটা দেবা দক্ষিণ কলকাতার কসবার, ফাটাকেষ্ট উত্তরের আমহার্ট স্ট্রিট। পরে মাস্তান হিসাবে উঠে আসা হেমেন মন্ডল গৌরিবাড়ির।

লক্ষ্মী বসুর ডান হাত দেবাশিস গুলি খেয়ে লটকে পড়েন চন্দ্র মণ্ডল লেনে। মতান্তরে লক্ষ্মীকান্ত বসুর প্রতাপাদিত্য রোডের অফিসের সামনে। দেবাশিস হত্যার পেছনে চিনা— নীরেন চ্যাটার্জির হাত ছিল এমন  অভিযোগ ছিল, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।

আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…

লক্ষ্মী বোস বা লক্ষ্মীকান্ত বসুর কার্টুন অতি চমৎকার আঁকতেন কুট্টি। অমল চক্রবর্তী। মাথা জোড়া টাক, সামান্য ভুঁড়ি, গোঁফ, গোলমুখ, সব মিলিয়ে আদর্শ কার্টুনানন্দ। লক্ষ্মীকান্ত বসু, জনমুখে লক্ষ্মী বোস খুব পপুলার শ্রমিক নেতা। যদিও সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রিয় রঞ্জন দাশমুন্সী, সৌগত রায়দের সঙ্গে তাঁর আদায় কাঁচকলায়। এন এল সি সি বনাম আই এন টি ইউ সি— ধুন্ধুমার, সংঘর্ষ। কারখানায় কারখানায় এন এল সি সি-র বাড়বাড়ন্ত। গোড়ার দিকে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের হাত লক্ষ্মীকান্ত বসুর মাথায় ছিল।

লক্ষ্মীকান্ত বসুকে বক্তৃতা করতে শুনেছেন ইন্দিরা কংগ্রেসের সভায়, এমন একজনের অভিজ্ঞতা এরকম। সেই সভায় ইন্দিরা কংগ্রেসের তাবড় বড় নেতা বক্তৃতা করছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়রাও আছেন। প্রায় সকলের শেষে বলতে ডাকা হল লক্ষ্মীকান্ত বসুকে। তিনি আরম্ভ করলেন এইভাবে— হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে-র গান হয়ে যাওয়ার পর পূর্ণদাস বাউলের গান কেউ কি শুনবে!

আরও পড়ুন
সাগর— গঙ্গাসাগর মেলা— সাগরসঙ্গমে...

লক্ষ্মীকান্ত বসু সাধারণত খদ্দর বা হ্যান্ডলুমের হাত পাঞ্জাবি, সঙ্গে পা চাপা রেডিমেড আলিগড়ি, পায়ে চপ্পল। ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে ওঁর খুব খাতির।

রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ডাক্তার হৈমি বসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে। হৈমি বসু ডাক্তার হিসাবে খুবই নাম করা এবং জনপ্রিয়। হৈমি বসু একসময় বামপন্থীদের সমর্থনে জিতে কাউন্সিলর হন। পরে তিনি জাতীয় কংগ্রসের সমর্থন নিয়ে দাঁড়ান ও জেতেন। রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে ডঃ অশোক মিত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নির্বাচনে। অবশ্যই বামপন্থী প্রার্থী। একদা নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অসীম চট্টোপাধ্যায় (কাকা) সু পি আই (এম)-এর সিম্বল নিয়ে দাঁড়ান ও পরাজিত হন। রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রটি বহু বছর ধরেই বামপন্থীদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে, মানে হাতছাড়া হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন
‘দৈনিক বসুমতী’ হয়ে আরও...

আবার লক্ষ্মীকান্ত বসুর কথা ফিরি। দেবাশিস মার্ডার হওয়ার পর সেই হত্যাকাণ্ড নীরেন চ্যাটার্জি (চিনা)র নাম অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে উঠে আসছে। আগেই বলেছি, নীরেন চ্যাটার্জি জাতীয় কংগ্রেস— ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রতীক চিহ্ন নিয়ে নির্বাচিত পুর-প্রতিনিধি। তার নামে দেওয়াল লিখন হয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই। স্বাধীন ভট্টাচার্য নামে একজন ইন্দিরা কংগ্রেস নেতা ছিলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি। কলেজস্ট্রিট অঞ্চলে তাঁকে খুব দেখা যেত এক সময়, সম্ভবত তিনি ‘শিক্ষা বাঁচাও কমিটি’র লোক— নেতৃত্বে।

স্বাধীন ভট্টাচার্য ও তাঁর কয়েক জন সহযোগী মিলে খণ্ডে খণ্ডে গ্রন্থাবলী ছাপার উদ্যোগ নেন, গ্রাহক করে। সেটা সত্তর দশকের প্রায় শুরু। পরে স্বাধীন ভট্টাচার্য জাতীয় কংগ্রেস— ইন্দিরা কংগ্রেস রাজনীতি থেকেও একটু একটু করে ফেড আউট হয়ে যান। স্বাধীন ভট্টাচার্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রিয় দাশমুন্সীদের সঙ্গেই সি পি— ছাত্র পরিষদ— কংগ্রেস রাজনীতি করতেন।

আরও পড়ুন
বাঙালির সাহেবি নববর্ষের আদিখ্যেতা ও অন্যান্য

টালিগঞ্জের পঙ্কজ ব্যানার্জিও এইভাবেই চলে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। রাজনীতি বড় কঠিন ঠাঁই।

লক্ষ্মীকান্ত বসুর ডান হাত দেবাশিস খুন হওয়ার পর, তা নিয়ে বিস্তারিত— অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন লিখি ‘দৈনিক বসুমতী’তে দুই কিস্তিতে। সেই রিপোর্টিং তৈরি করার আগে লক্ষ্মীকান্ত বসুর সঙ্গে এই ব্যাপারে বিস্তারে কথা বল। এই রিপোর্ট তৈরি করার ব্যাপারে ওঁর অফিসে গেছি দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে, প্রতাপাদিত্য রোডে। বড়সড় বাড়ির একতলায় তাঁর অফিস। লক্ষ্মীকান্ত বসু মারা যাওয়ার পর তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এন এল সি সি অফিসের সামনে। এখনও সেই মূর্তি— হাফ বাস্ট স্ট্যাচু রয়েছে।

‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকায় দেবাশিস হত্যার খবর সবিশেষ বেরনর পর ক্ষিপ্ত নীরেন চ্যাটার্জি— চিনা দৈনিক বসুমতী অফিসে আসেন পা চাপা জিন্সের ফুল প্যান্ট আর টেরিকটের চেকদার শার্ট গায়ে দিয়ে। তাঁর গালে দাড়িগোঁফ কম।

নীরেন চ্যাটার্জিক ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকার তাঁর ঘরে বসালেন, চা-টোস্ট, কফিও হতে পারে খাওয়ালেন। ভয়ানক উত্তেজিত নীরেন চ্যাটার্জি। তিনি বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাইছেন, এই প্রতিবেদন কে নির্মাণ করেছেন। তিনি কথা বলতে চান তাঁর সঙ্গে।

প্রশান্ত সরকার— প্রখ্যাত সাংবাদিক— যিন এক সময় কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’, সি কে করঞ্জিয়ার সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’, লন্ডনের ‘ডেইল টেলিগ্রাফ’, ‘টাইম’ ম্যাগাজিন, ‘স্প্যান’, কলকাতার ‘দর্পণ’— সব মিলিয়ে অনেক, অনেকগুলো দেশ-বিদেশের পত্রিকার সাংবাদিক। কমওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে যিনি এক বছরের জন্য লন্ডনে ছিলেন এবং তাঁকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যাপারে যাঁরা ইনটারভিউ বোর্ডে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘যুগান্তর’ অমৃতবাজার পত্রিকা’র মালিক ও সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ— টি কে ঘোষ। যিনি তাঁর নামের আগে সব সময় শ্রী ব্যবহার করে শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ লিখতেন, ‘বিচিত্র কাহিনী’ ও ‘আরও বিচিত্র কাহিনী’ নামে তাঁর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এম সি সরকার থেকে, তার নিয়মিত বিজ্ঞাপন থাকত ‘যুগান্তর’ পত্রিকার পাঁচের পাতায়। বিজ্ঞাপনটি ছিল এরকম— ‘বিচিত্র কাহিনী’, ‘আরও বিচিত্র কাহিনী’ পড়ে আনন্দ পাবেন।’ এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স। তারপর এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স-এর ঠিকানা।

এম সি সরকারের সাহিত্যের আড্ডা ছিল অতি বিখ্যাত। সুধীরচন্দ্র সরকার— এম সি সরকারের একদা কর্ণধার তুষারকান্তি ঘোষের বিশেষ বন্ধু। এক সময় এম সি সরকার ছিল অতি বিখ্যাত প্রকাশক। সুধীরচন্দ্র সরকারের পুত্র সুপ্রিয় সরকার, সকলের বাচ্চুদা। চমৎকার মানুষ। তাঁর ছেলে শমিত সরকার।

তো সে যাই হোক, প্রশান্ত সরকারের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাওয়ার ব্যাপারে ইনটারভিউ বোর্ডে ছিলেন তুষারকান্তি ঘোষ। তুষারবাবু প্রশান্ত সরকারকে ইনটারভিউ শেষে বলেন, প্রশান্ত তুমি কমি, আমি কমিদের পছন্দ করি না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি কমি হলেও এই স্কলারশিপ তুমি পাবে।

‘কমি’ অর্থে কমিউনিস্ট।

তুষারকান্তি ঘোষ প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি কমিউনিস্টদের পছন্দ করছেন না, করেন না। কিন্তু ‘স্টেটসম্যান’-এর এয়ারপোর্ট করেসপনডেন্ট প্রশান্ত সরকারকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ দিতে তিনি আপত্তি করছেন না। বাগড়া দিচ্ছেন না। বরঞ্চ যোগ্যতম মানুষটি যাতে এই এক বছর স্কলারশিপটি পান, তার জন্য তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন থাকছে।

এই ঔদার্য আজ কোথায়?

প্রশান্ত সরকার এক বছরের ‘কমনওয়েলথ’ স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন চলে গেলেন। তখন তিনি বিবাহিত। নীহার সরকারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। নীহার সরকার বা নীহারকণা সরকারের বাবা ছিলেন আইনজীবী। জীবনের শেষ বেলায় কোর্ট ফেরত বাড়ি ফিরে এসে জামা-কাপড় বদলে তিনি কোনো হরিনাম সংকীর্তনের আসরে যেতেন। তারপর নেচে নেচে অংশ নিতেন কীর্তনে। এই তথ্য আমি পেয়েছি প্রশান্ত সরকারের কাছ থেকেই।

প্রশান্তদা কমনওয়েলথ স্কলারশিপ অর্জন করে এক বছর ছিলেন লন্ডনে। তিনি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। পেয়িং গেস্ট। ল্যান্ডলেডি— বাড়ির মালকিন এবং তাঁর দুই কন্যা। তাঁকে অনবরত প্রশ্ন করতেন নীহারকণা সরকারের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য বা তার আগের কোর্টশিপের ব্যাপারে।

এই দুই অবিবাহিত যুবতী এবং তাঁদের মা ল্যান্ডলেডি বিস্মিত হতেন, প্রশান্ত সরকার বিবাহের আগে মেলামেশা তো করেনই নি এমনকি তাঁর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেননি। ফুলশয্যার রাতে প্রথম নব বিবাহিত দম্পতি— প্রশান্ত সরকার ও নীহারকণা সরকার কীভাবে নৈকট্য— শারীরিক ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করলেন বা করলেন না, তা নিয়ে তাঁদের জানার উৎসাহ সঠিকভাবে বললে, কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। 

প্রশান্তদা যথাবিহিত কথা বলে তাঁদের জিজ্ঞাসা মেটাতেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাওয়ার পরও প্রশান্ত সরকার লন্ডনের একটি পত্রিকাতে চাকরি করতেন। তখনই নাইট ক্লাব, সেক্সক্লাব, বেশ্যাপল্লী— ইংল্যান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্সে কেমন কেমন অবস্থায়, তা তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে শুনেছি। সেই সঙ্গে লাইভ ন্যুড শো। স্ট্রিপটিজ।

লন্ডনে খবরের কাগজের একটি পাড়া ছিল ষাটের দশকে। হয়ত এখনও আছে। প্রশান্তদা ইংল্যান্ড গেছিলেন ষাটের দশকে। তখন লন্ডনে বড় বড়, ফাঁকা গির্জা কিনে নিচ্ছেন শিখরা। শিখ ধর্মের মানুষরা লন্ডনে বাস কন্ডাকটার হিসাবে নিজেদের মাথার ধর্মীয় টারবান বা পাগড়ি ছেড়ে দিতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। বেশ, কৃপাণ, কাচ্ছা, কড়া, কঙ্ঘা— পঞ্চ ‘ক’ নিয়ে শিখ ধর্মের যাবতীয় পবিত্র চিহ্নরা জেগে থাকে।

পাগড়ি ছেড়ে দেওয়ার আইন আনার পর শিখ ভাইয়েরা প্রতিবাদে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেওয়ার ভয় দেখান। পরে ‘পাগড়ি বাদ দিতে হবে’— এই আইন চালু করা যায়নি। ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বিট আন্দোলন, হিপি কালচার, হিপিরা, ক্যুবার মিসাইল সংকট। সোভিয়েত দেশের প্রধান কিকিতা ক্রুশ্চভ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। ক্যুবায়— ফিদেল কাস্ত্রোর ক্যুবায় ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তা নিয়ে বিপুল উত্তেজনা। পরে সেই মিশাইল ফেরতও নীল। আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন মেরিলিন মনরোর প্রেমিক জন কেনেডি। অসওয়াল্ডের নাম এল হত্যাকারী হিসাবে। আর অসওয়াল্ডকে হত্যা কল জ্যাক রুবি। সে নিয়ে লেখালিখি হল অনেক। বেরল বই-পত্রও।

প্রশান্ত সরকার স্কচ হুইস্কির ওপরও গবেষণা করেন। স্কচের ব্লেন্ডিং দেখতে যান স্কটল্যান্ডে। স্কচ হুইস্কি কীভাবে বছরের পর বছর কাঠের বড় বড় পিপেতে রেখে, তারপর তাঁকে মজান হয়, সে নিয়ে তিনি অনেক কিছু জানতেন। মল্ট, মল্ট, ব্লেন্ডিং।

আবার ফিরি দৈনিক বসুমতীতে। একদা পুলিশের বড় কর্তা— পরাধীন ভারতে তিনি খুব নামকরা গোয়েন্দা অফিসার ছিলেন, সেই পঞ্চানন ঘোষাল— ডঃ পঞ্চানন ঘোষাল এসেছেন সুরূপা গুহ হত্যা মামলা চলার সময় ‘দৈনিক বসুমতী’তে। তাঁর অতি বিখ্যাত বই ‘অপরাধ বিজ্ঞান’, যা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং ‘রক্ত নদীর ধারা’— ‘খোকা গুপ্তা’ এবং ‘পাগলা’ মার্ডার নিয়ে লেখা এই গ্রন্থ।

‘রক্ত নদীর ধারা’ রেডিও নাটকও হয়েছে। খুব বিজ্ঞাপন হত এই বইটির— থিলারের। ‘অপরাধ বিজ্ঞান’ ছেপেছিল সম্ভবত ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’, খণ্ডে খণ্ডে। ডঃ ঘোষাল সুরূপা গুহ হত্যা মামলার প্রেক্ষিতে ‘দৈনিক বসুমতী’তে লিখতেন। তখন কেদার ঘোষ ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক।

সুরূপা গুহ মামলায় সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সতীকান্ত গুহ, তাঁর স্ত্রী প্রীতিলতা গুহ, বারির কর্ম সহায়ক ঝন্টুচরণ দত্ত, সতীকান্ত গুহর পুত্র ইন্দ্রনাথ গুহ— সকলেই অভিযুক্ত ছিলেন। ‘নাট্যকার’ নামের উপন্যাস লিখে রবীন্দ্র পুরস্কার পান সতীকান্ত গুহ। তাঁর আর একটি গ্রন্থ ‘খেয়ার মাঝি লক্ষ্মীনাথ’। ‘খেয়ার মাঝি লক্ষ্মীনাথ’ সম্ভবত ছোটদের জন্য লেখা।

‘সুরূপা গুহ হত্যা মামলা’য় হরলিকস, শশা, মারকিউরিক ক্লোরাইড, ইত্যাদি প্রভৃতি জিনিসের নাম উঠে আসে খবরের কাগোজেড় হেডলাইনে, পাতায় পাতায়। অপর্ণা সেন সহ অনেকের নাম উঠে আসতে থাকে সুরূপা গুহ হত্যা মামলার সঙ্গে সঙ্গে। কবি মনীন্দ্র রায়ের নামও ঘুরতে থাকে, এমন অনেকে বলেন।

বিচারক রণবীর মহাপাত্রর এজলাসে— আলিপুর জজ কোর্টে এই মামলার সেশানস চলতে থাকে। প্রখ্যাত আইনজীবী— ব্যারিস্টার ও কংগ্রেস নেতা শঙ্করদাস ব্যানার্জি এই মামলায় সতীকান্ত গুহ, ইন্দ্রনাথ গুহ, প্রীতিলতা গুহদের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন। শঙ্করদাস ব্যানার্জির সঙ্গে ডিফেন্স কাউন্সিল ছিলেন ব্যারিস্টার দীপঙ্কর ঘোষ।

সরকারি পক্ষের উকিল ছিলেন রথীন্দ্র নারায়ণবাবু। শঙ্করদাস ব্যানার্জি কৃষ্ণনগর থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এজলাসে তিনি প্রায় সারাক্ষণই ঝিমোতে থাকতেন। কিন্তু সাক্ষীদের ক্রস-এগজামিনেশনের সময় তাঁর একটা, দুটো জবরদস্ত প্রশ্ন গোটা আদালত কক্ষকে স্তব্ধ করে দিত। রবীন্দ্রনারায়ণবাবুর পদবি ছিল সম্ভবত রায়চৌধুরী। সুরূপা গুহ হত্যা মামলায় কলকাতা পুলিশের বড়ো কর্তা তপেন চক্রবর্তীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তদন্তে নেমেছিলেন এই মামলার। যতদূর জানি তিনি সুরূপা গুহর আত্মীয় ছিলেন, সুরূপার বাপের বাড়ির দিক থেকে।

সুরূপা গুহ কেন বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইডের বদলে খাবার পর যন্ত্রণাদায়ক মারকিউরিক ক্লোরাইড খেলেন তথাকথিত আত্মহত্যার জন্য, তা নিয়ে খুব বড়ো ল পয়েন্ট আর্গুমেন্ট তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী ও তাঁর জুনিয়ররা।

সুরূপা ও ইন্দ্রনাথের ছিল একটি কন্যাসন্তান।

আদালত রিপোর্টিং করতে গিয়ে নানা ধরণের সেকশন – ধারা, উপধারা ইত্যাদি প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়তে থাকে। সত্তর দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার ফলাফলে বারবার কারাবাস – মিসা, পিভি অ্যাক্ট, পিডি অ্যাক্ট ইত্যাদি প্রভৃতির স্বাদ পাওয়ার অভিজ্ঞতায় ভারতীয় ফৌজদারী আইন – ইন্ডিয়ার পেনাল কোড বা পিনাল কোড খানিকটা তো জানা হয়েই যায়, নিজের মামলার সওয়াল নিজে নিজে করতে গিয়ে, কারণ সিপিআই (এমএল)-এর সিদ্ধান্ত তখন, কোনোভাবেই কোনো উকিল দেওয়া যাবে না, নিজের ডিফেন্সের জন্য, বরং সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নিজের হয়ে সওয়াল নিজেই করা যায়।

সুরূপা মামলায় যিনি সরকারি উকিল ছিলেন সেই রবীন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী পরে বিচারক হয়ে যান। ফরসা, ক্লিন সেভেন, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে কিন্তু সামনের দিকে একটি টেরি বা সিঙাড়া স্টাইল, চুলটাকে তেল দিয়ে ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে রাখা, যেমন দেবানন্দ পঞ্চাশ বা ষাট দশকের ছবিতে।

সুরূপা মামলার প্রতিদিনের শেষে ব্রিফ করতেন রবীন্দ্রনারায়ণবাবু। তাঁর কাছ থেকে ভারতীয় দণ্ডবিধি – ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের অনেক ইশারা পেতাম। বিস্তারিতভাবে তিনি বলতেন। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। দশটায় কোর্ট বসত। বিচারপতি এলে দাঁড়িয়ে উঠতে হত সবাইকে। প্রথম প্রথম বড়ো এক টিফিন কৌটো ভর্তি খোসাসমেত আলুসেদ্ধ নিয়ে কালীঘাটের ১৬/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে হাঁটতে হাঁটতে আলিপুর জাজেস কোর্ট। নুন ও মরিচ ছাড়া ওই আলুসেদ্ধই আমার টিফিন। আলিপুর জাজেস কোর্ট থেকে হাঁটতে হাঁটতে আলিপুর চিড়িয়াখানা, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম – ভারতীয় জাদুঘর হয়ে, কোনো কোনো দিন ভিক্টোরিয়া স্পর্শ করে রেসকোর্সের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বৌবাজারের নামকরা সব স্বর্ণবিপণি পেরিয়ে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ছাড়িয়ে ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বসুমতী সাহিত্য মন্দির – যার দোতলায় ‘দৈনিক বসুমতী’-র দপ্তর।

প্রশান্ত সরকারের ঘরে ধীরানন্দ রায় নামে এক ভদ্রলোক আসতেন। ধীরানন্দ রায় কবি ও উত্তর সম্পাদকীয় লেখক। নানা বিষয় নিয়ে তিনি লিখতেন উত্তর সম্পাদকীয়। লিখতেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবাসরীয়তে। ধীরানন্দ রায় কৃষ্ণনগরের মানুষ। প্রশান্ত সরকারের খাস বেয়ারা দীপনারায়ণকে তিনি আদর করে ‘দিপু দিপু’ বলে ডাকতেন। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় দীপনারায়ণকে ডাকতেন ‘দীপবাহাদুর’ বলে।

দীপনারায়ণ লম্বা নয় মোটেই। মাথার চুল যত্ন করে কেয়ারি করা। বেশ ফরসা মুখে হালকা বসন্তের দাগ। বিহারী হিন্দি টানে বাংলায় কথা বলতেন। খুব ফিটফাট। নাকের নিচে বাহারি সরু গোঁফ। ধীরানন্দ রায় – মুখে মুখে ধীরাদা – বেশ শৌখিন। ধুতি, সঙ্গে বড়ুয়া কাটিং পাঞ্জাবি। হ্যান্ডলুমের রঙিন, সাদা আদ্দির— দু’রকমই। সঙ্গে মিলের কালো পাড় ধুতি। খুব পরিপাটি। চন্দনের সুবাস— সেই গন্ধ মার্কা আতরগন্ধ ছিল খানিকটা তাঁর আসা যাওয়ার সঙ্গে।

ধীরানন্দ রায় নাকি তাঁর কৃষ্ণনগরের বাড়িতে পেয়ারা গাছ ও আম গাছে ইলেক্ট্রিক তার জড়িয়ে রাখতেন, ফল চুরি আটকাতে। বাদুড়, হনুমান, পাখিদের আটকে দেওয়ার জন্য মশারি স্টাইল জালও ব্যবহার করতেন, এমন শুনেছি লোকমুখে, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।

ধীরানন্দ রায় প্রশান্ত সরকারের ঘরে ঢুকে যত রাজ্যের ইংরেজি খবরের কাগজ, পত্রি-পত্রিকা নিয়ে বসতেন। ঘাঁটতেন। পুরনো ইংরেজি দৈনিক বাড়িও নিয়ে যেতেন তিনি, পড়ে ফেরত দেবেন বলে। তাঁর সম্ভবত দুই কন্যা। এক কন্যা ‘মিরান্দা’ বলে একটি লিটল  ম্যাগাজিন বার করতেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর জামাই— বিপ্লব।

তখন ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘হিন্দু’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’, ‘টাইমস অফ ইনডিয়া’, ‘হিন্দুস্তান টাইমস’, ‘ব্রিৎস’, ‘পেট্রিয়ট’, ‘ন্যাশনাল হেরল্ড’, ‘স্টেটসম্যান’— সবই আসে। সেই সঙ্গে সমস্ত বাংলা দৈনিক— ‘যুগান্তর’ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘সত্যযুগ’, ‘আজকাল’। তখন ‘পয়গম’ বলে একটি দৈনিক ছিল। ছিল ‘দৈনিক আকর্ষণ’। ‘দৈনিক আকর্ষণ’-এর মালিক, সম্পাদক ছিলেন নিরঞ্জন দে। তিনি আবার সিনেমার প্রোডিউসারও। শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে তিনি সিনেমা বানাতেন, নিজে সাজতেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। সেই সব সিনেমা যে খুব চলেছে, এমন নয়।

গীতিকার সোহিনী চৌধুরীর পুত্র দিগ্বিজয় চৌধুরী ছিলেন ‘দৈনিক আকর্ষণ’ পত্রিকার পালিক-সম্পাদক নিরঞ্জন দে-র ডান হাত। অন্য চাকরি করেও দিগ্বিজয় চৌধুরী অনেকটাই দায়িত্ব সামলাতেন ‘দৈনিক আকর্ষণ’-এর। ওঁর মুখে শুনেছি সাংবাদিক— রিপোর্টারদের প্রতিবেদনের ওপ্র ভিত্তি করে নয়, অল ইন্ডিয়া রেডিও আর আকাশবাণী কলকাতার খবরের ওপর নির্ভর করে চার পাতার বাংলা দৈনিকটি বেরত।

‘পেট্রিয়ট’ ছিল সি পি আই-এর পত্রিকা, পুরোপুরি না হলেও সি পি আই ঘেঁষা। ‘ন্যাশনাল হেরল্ড’ তো পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুদের।

‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে এসে প্রশান্ত সরকারের ঘরে ঢুকে ইন্দিরা কংগ্রেসের কাউন্সিলার নীরেন চ্যাটার্জি ওরফে চিনা নানাভাবে দেবাশিস মার্ডারের প্রতিবেদক বিষয়ে খবরাখবর নিতে চাইলে ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক কিছু বলার ব্যাপারে সরাসরি তাঁকে অস্বীকার করেন।

প্রশান্তদা প্রায়ই বলতেন, আমি একজন জার্নালিস্ট, জার্নালিস্টকে রক্ষা করা আমার আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। একথা নানা সময়ে তিনি বলেছেন। ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের মদ্যপান ইত্যাদি ব্যাপারে নানা ধরণের ছোট ছোট ট্যাবলয়েড লেখান হয়। তার মধ্যে সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ অন্যতম। ‘দৈনিক বসুমতী’র কয়েকজন সাংবাদিক আর সত্যযুগ লবির জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা মিলে এই কাজটি করেন এমন কথা বাতাসে ভেসে বেড়াত তখন, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।

‘সত্যযুগ’ সম্পাদক জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রূপবান। তাঁর ভাই যতনলাল। ‘সত্যযুগ’-এর কর্মীদের প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি পুরোপুরি মেরে দেন জীবনলাল। তারপর তাঁরই দেখান পথে হাঁটেন ‘যুগান্তর’ অমৃতবাজার পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক’ ‘অমৃত’-র মালিকরা।

প্রশান্ত সরকারের সুন্দরী, এয়ারহোস্টেস বান্ধবী ছিলেন রেবা। রেবা আসলে প্রেমিকা ছিলেন ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সাংবাদিক ‘ইন দ্য ওয়েক অফ নকশালবাড়ি’-র লেখক শ্রীমন্ত ব্যানার্জির। শ্রীমন্ত ব্যানার্জি ছাড়া ‘স্টেটসম্যান’-এর আর এক সাংবাদিক ভবানী রায়চৌধুরী চাকরি বাকরি ছেড়ে নকশালবাড়ি আন্দোলন— সি পি আই (এম এল)-এ নিজেকে মিশিয়ে দেন। ভবানীবাবু কৃষক সংগঠন করতে অখণ্ড বিহারে চলে যান। পরে এস সি পি আই (এম এল) ভেঙে টুকরো টুকরো হলে তিনি সি পি আই (এম এল)/পার্টি ইউনিটের কৃষক নেতা হিসাবে উঠে আসেন। আরও পরে অখণ্ড বিহারের জঙ্গি কৃষক আন্দোলন ইত্যাদির প্রশ্নে সি পি আই (এম এল)/ পি ইউয়ের আরেক নেতা বিনায়কের সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়। এর ফলে ভেঙে যায় সি পি আই (এম এল)/পি ইউয়ের কৃষক সংগঠন এম কে এস এস।  এইসব  নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট বেরয় ‘টেলিগ্রাফ’-এ। সেটা আশির দশক, উত্তর ইমার্জেন্সি পর্ব। বিনায়কের ছবি দিয়ে রিপোর্টিং হয় ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর আরেকটি দৈনিক ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’-এ। ‘যুগান্তর অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সাংবাদিক মনোজিৎ মিত্র চলে যান ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’-এ। 

‘যুগান্তর’-এর যুগ্ম সম্পাদক, ছড়াকার, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিতাভ চৌধুরীর— আ চৌ-এর বাড়ি আড্ডায় মনোজিৎ মিত্র থাকতেন নিয়মিত। প্রতি রবিবার বসত আড্ডা। এই আড্ডা থেকে উঠে আসা নানা সরস ও ভৌতিক কাহিনী নিয়ে অমিতাভ চৌধুরী পরবর্তী সময়ে একটি ভূতের গল্প সংকলন নির্মাণ করেন।

‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ গ্রুপের ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’ বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর। মনোজিৎ চন্দ নামে একজন ফোটোগ্রাফার ছিলেন যুগান্তর অমৃতবাজার গ্রুপের। ‘যুগান্তর’-এ ছিলেন পান্নাদা, খুব বড় ফোটোগ্রাফার তিনি।

ভবানী রায়চৌধুরী ও বিনায়কের পার্টি ইউনিটি গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। মধ্য বিহারে এম সি সি— মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রের সঙ্গে আই পি এফ— ইনডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের বন্দুকবাজি ঘটে যেতে থাকে নানা সময়ে। রক্তাক্ত সেই সংঘর্ষ।

বিহারে জোতদার জমিদারদের ভূমিসেনা, রণবীর সেনা, সানলাইট সেনা, কুয়ার সেনা তৈরি হয়, মূলত ভূঁইহার— ভূমিহার ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ও ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য থাকত সেখানে। পাল্টা গড়ে উঠল এম সি সি, সি পি আই (এম এল)/ পি ইউ ও সি পি আই (এম এল)/ লিবারেশন-এর সশস্ত্র বাহিনী। ঘটে গেল আরোয়াল, ছেটকি ছেছানির মতো ঘটনা।

সি পি আই (এম এল)-এর ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন ছিল ইনডিয়ার পিপলস ফ্রন্ট— আই পি এফ। পরে আই পি এফ তুলে দেওয়া হল এক রকম জোর করেই। সি পি আই (এম এল)/লিবারেশন প্রকাশ্যে চলে আসার পর ঘটল এই ঘটনা। আই পি এফ-এর মুখপত্র ছিল ‘লোক সমাচার’। কেন আই পি এফ তুলে দেওয়া হল, তা নিয়ে আমার একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, সে ব্যাপারে আর বিস্তারিত বলছি না।

বিহারে সশস্ত্র হামলা, রক্তাক্ত যুদ্ধ হত প্রায়ই সি পি আই (এম এল) পার্টি ইউনিটি বনাম সি পি আই (এম এল)/ লিবারেশন, এম সি সি— মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র বনাম সি পি আই (এম এল)/ লিবারেশন, সি পি আই (এম এল)/ পার্টি ইউনিটি বনাম মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র। সানলাইট সেনা, রনবীর সেনা, কুয়ার সেনা ভূমি সেনা-র সঙ্গে লাল সেনা বা লাল দস্তার সংঘর্ষ অনিবার্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে ওঠে প্রায়।

বিহারে— অখণ্ড বিহারে ভূমিসেনা, সানলাইট সেনা, রণবীর সেনা নিয়মিত হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। মূলত দলিত— পিছরে বর্ণের আম জনতা— ভূমিহীন কৃষক তাদের বন্দুক, টাঙি, বল্লম ও তলোয়ারের লক্ষ্য হয়। চামার, পাশি, কুনডি, গারেড়িয়া, ঘটিক, নিষাদ, মাল্লা, শিকারি, এই সব সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা আজ ‘দলিত’ থেকে ‘মহাদলিত’ হয়ে উঠেছেন, কোনো কোনো পদবির জনেরা, মাহাত, আহির— যাদবরা আছে এর বাইরে, তাঁদের ওপর আক্রমণ। ক্রমাগত আক্রমণ। জ্বলে ওঠে চামার, টোলি, ঘটিক, পাশিদের বস্তি।

নব্বইয়ের দশক, আশির দশক, তখনই তথাকথিতপ উচ্চবর্ণ বনাম দলিত— সব মিলিয়ে এক ভয়ানক যুদ্ধের পরিবেশ। বর্ণযুদ্ধ, বর্ণ হিংসা। ক্লাস স্ট্রাগল নয়, কাস্ট স্ট্রাগল। মূলত এই বর্ণবাদী যুদ্ধকে মাথায় রেখেই অখণ্ড বিহারের রাজনীতি অনেকখানি প্রভাবান্বিত হয়ে ওঠে। শ্রেণীসংগ্রাম নয়, বর্ণ সংঘর্ষ।

পাটনা, ভোজপুর, গারোয়াল, ছেটকি ছেছানি, নানা জায়গার নাম উঠে আসতে থাকে বর্ণযুদ্ধের প্রকাশ্য বা গোপন সাইরেন হিসাবে। সিপিআই (এমএল) পার্টি ইউনিট ও মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার, যারা বহুদিন পরস্পরের দিকে বন্দুক তাক করে ছিল, তারা মিশে গেল সিপিআই মাওবাদী)-তে। অন্ধ্রের পিপলস ওয়ার গ্রুপ – পিডব্লুজি, যার নেতৃত্বে একসময় ছিলেন কোন্তাপল্লী সীতারামাইয়া, পরে গণপতি নেতৃত্বে আসেন।  কোন্তাপল্লী সীতারামাইয়া বার দুই পালান পুলিশের হেফাজত থেকে। কিন্তু কোন্তাপল্লী সীতারামাইয়া দামি গেঞ্জি ব্যবহার করেন, এরকম একটা অভিযোগ এবং আরও নানা ছেঁদো এলিগেশন দিয়ে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় সিপিআই (এমএল) / পিপলস ওয়ার গ্রুপ থেকে।

সত্তর দশকের মাঝামাজি সময় থেকেই নকশালপন্থী আন্দোলনে চূড়ান্ত ভাটার সময়। নেতারা হয় নিব্রিত, নয় জেলবন্দি। পশ্চিমবাংলা, অখণ্ড বিহার, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কেরল, উত্তরপ্রদেশের খানিকটা অংশ না ভাঙা সিপিআই (এমএল) আর মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রের সশস্ত্র আন্দোলনের নানা চিহ্নভূমি হয়ে উঠেছিল।

মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল ‘চিন্তা’ গ্রুপ থেকে। পরে তাঁরা ‘দক্ষিণদেশ’ গ্রুপ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ‘দক্ষিণদেশ’ ছিল মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রের মুখপত্র। যেমন সিসিসিআর-এর সাপ্তাহিক ‘দেশব্রতী’। এই সময় বাংলায় ‘রেডফ্ল্যাগ’ নামে একটি ট্যাবলয়েড বেরত। ১৯৭০ সালে পরিমল দাশগুপ্ত প্রকাশ করেন ‘কমিউনিস্ট’। তাঁরা ছিলেন চারু মজুমদারের লাইনের বিরোধী। পীযূষ দাশগুপ্তরা বার করতেন ‘নয়া ইশতাহার’। বর্ধমান প্লেনামের পর সিপিআই (এম) থেকে বেরিয়ে আসা র্যা ডিকালরা ‘কিসান’ বের করেন বাংলায়, সাপ্তাহিক পত্রিকা। নাগী রেড্ডি, চন্দ্রপোল্লা বা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির আদর্শে ওঁরা ভেঙেছিলেন সিপিআই (এম), বেরিয়ে এসেছিলেন পুরনো দল থেকে।

উত্তর কলকাতার অমর ভট্টাচার্যর সঙ্গে কেপিএস কোন্তাপল্লী সীতারামাইয়ার রাজনৈতিক আদর্শের যোগাযোগ ছিল খুবই ঘনিষ্ট। অমর ভট্টাচার্য বলতেন, উনি গোপন পথে মাও-সে-তুঙের চিনে গেছেন। বেশ কয়েক বছর হল প্রয়াত হয়েছেন অমর ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত বইমেলায় গেছি ২০১০ সালটাল নাগাদ।

নকশালবাড়ির আন্দোলন নিয়ে অমর ভট্টাচার্যের গুরুত্বপূর্ণ বইও আছে। বাঁকুড়ার সিমলিপালের ছোট বইমেলা। তখন বেশ শীত। মাথার ওপর খলখল হাসা চাঁদ। তখনও তথাকথিত ‘মাওবাদী’ আন্দোলন তুঙ্গে। রাতে খাবার বলতে রুটি, তরকারি, দিশি মুরগির ঝোল। যেখানে আছি, সেই সরকারি বাড়ির চারপাশে গিসগিসে পুলিশ। সাদা পোশাক। রাত্রি দশটার পর আর বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই।

পুলিশরাই টহল মারবেন। নকশালবাড়ি রাজনীতি করতে গিয়ে দীর্ঘদিন জেলে থেকেছেন অমর ভট্টাচার্য। তারপর জরুরী অবস্থা উঠে যাওয়ার পর তাঁর কারামুক্তি। তখন সিওপিডি – শ্বাসের কষ্ট। হার্টের সমস্যা। থাকতেন বরানগরের কাছাকাছি। তথাকথিত ‘মাওবাদী’ আন্দোলনের সময় অমর ভট্টাচার্যরা ‘জঙ্গলমহল’-এ ডাক্তার ওষুধ – এইসব নিয়ে গেছিলেন সাধারণ মানুষকে সহায়তা করবেন বলে। কারণ তখন ‘যৌথবাহিনী’-র আক্রমণে সাধারণ মানুষেরাও যথেষ্ট বিপর্যস্ত। এছাড়া তথাকথিত আহত ‘মাওবাদী’রা তো আছেই।

Powered by Froala Editor