সাগর— গঙ্গাসাগর মেলা— সাগরসঙ্গমে...

মুছে যায়? - ২৮
আগের পর্বে

দৈনিক বসুমতীর অ্যাকাউন্টসের শচীনবাবু সবসময় চাইতেন ভাউচার আটকাতে। অন্যদিকে কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় অভ্যস্ত ছিলেন ধার-বাকিতে। দু’টাকা চাইতে বলতেন ‘তোর কাছে টু হবে’? তবে মাসের পয়লা তারিখেই সেই হিসাব চুকিয়ে দিতেন নগদে। অফিসে ঢুকেই ‘জয় তারা’ বলে হাঁক ছাড়তেন স্পোর্টসের দীপালি কুমার ঘোষ। বসুমতীর নির্মল গাঙ্গুলি ও ধীরেন ভৌমিক ছিলেন সুভাষপন্থী ফরোয়ার্ড ব্লকের সমর্থক। মূল ফরোয়ার্ড ব্লক ভেঙে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরি করেন রাম চট্টোপাধ্যায়। বুলেট চেপে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন তিনি। মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি কলকাতায় এলে নিজের গাড়িতে লোক তুলতে তুলতে আসতেন।

‘দৈনিক বসুমতী’-র দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে এক কলাম খবর ছাপা হলে পাঁচ টাকা পেতাম ১৯৭৯-৮০ সালে। সুরূপা গুহা হত্যা মামলার খবর যতটাই ছাপা হোক না কেন, দশ টাকা পেতাম।

প্রবল প্রতাপান্বিত কেদার ঘোষকে খানিকটা দেখেছি ‘দৈনিক বসুমতী’র এডিটর ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে। কেদার ঘোষ আগে ‘স্টেটসম্যান’-এর চিফ রিপোর্টার ছিলেন। পরে ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক।

শীতে স্যুট, গরমে সাফারি স্যুট, অসম্ভব রাশভারী। থুতনিতে জমানো পাকা ফ্রেঞ্চকাট, হাতে পাহাড়ি স্টিক। চোখে রিমলেস চশমা একদম স্টেটসম্যানের টিপিকাল মডেল। কেদারবাবুর সঙ্গে ‘সাউথ পয়েন্ট’-এর মালিক  সতীকান্ত গুহ-র কোনো একটা ব্যক্তি-ঝামেলা হয়েছিল জমি নিয়ে। এটি অবশ্য শোনা কথা। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। সুরূপা গুহ হত্যা মামলার শুরুর সময় কেদার ঘোষ ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক। তখন সিদ্ধার্থ রায়ের জমানা। সুব্রত মুখোপাধ্যায় তরুণতুর্কি ইন্দিরা কংগ্রেস নেতা, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্র, লক্ষীকান্ত বসু, সৌগত রায় এরা সব নবীন কংগ্রেস নেতা। ইন্দিরা গান্ধী যখন কামরাজ নাদার, অতুল্য ঘোষ, মোরারজি ভাই দেশাই, প্রমুখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে সিন্ডিকেট-বিরোধী কংগ্রেস হিসাবে  অব-কংগ্রেস বা ইন্দিরা কংগ্রেস তৈরি করলেন তখন মোহন ধারিয়া, চন্দ্রশেখর প্রমুখ ‘তরুণতুর্কি’ হিসাবে তাঁর পাশে দাঁড়ান। পরে মোহভঙ্গ হয় চন্দ্রশেখরের। তিনি ইন্দিরা কংগ্রেস বা নব-কংগ্রেস ছেড়ে দেন। যোগ দেন জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে তৈরি ‘জনতা পার্টি’-তে। মোরারজি ভাই দেশাই, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, এনজি গোরে, সমর গুহ, অটল বিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলীমোহন যোশি, বিজু পট্টনায়ক, প্রশান্ত চন্দ্র চন্দ, লালুপ্রসাদ যাদব, নীতিশকুমার, চৌধুরী চরন সিং, রাজনারায়ণ, কৃষ্ণ কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি-সহ অনেকেও জনতা পার্টিতে। জগজীবন রাম ও হেমবতী বা হৈমবতীনন্দন বহুগুনা সি এফ ডি— কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি তৈরি করেন। পরে তা মিশে যায় জয়প্রকাশ নারায়ণের জনতা পার্টির সঙ্গে। তখন আদি কংগ্রেস— সিন্ডিকেট কংগ্রেস চিহ্নিত হত কংগ্রেস(ও) আর নব কংগ্রেস বা ইন্দিরা কংগ্রেস চিহ্নিত হত কংগ্রেস(আই) হিসাবে। কংগ্রেস(ও) মানে কংগ্রেস অরগানাইজেশন। 

সুব্রত মুখোপাধ্যায় কেদারগ ঘোষ জমানায় ‘দৈনিক বসুমতী’-র হত্তাকর্তা। কেন না তখন তিনি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় জমানার মন্ত্রী।

আরও পড়ুন
‘দৈনিক বসুমতী’ হয়ে আরও...

১৯৭৫-৭৬-৭৭ জনতা পার্টির অভ্যুদয় ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে একটি বড় মোড় বা বাঁক। জাতীয় কংগ্রেস দল ছেড়ে আসা জয়প্রকাশ নারায়ণের ক্যারিশমা নতুন দল জনতা পার্টির জন্ম হয় জরুরী অবস্থার সময়, ইন্দিরা গান্ধীর জেলে। পুরনো সোসালিস্ট— পার্টির রামমনোহর লোহিয়াজির বহু অনুগামী, গান্ধীবাদী অনেক ব্যক্তিত্ব ‘সর্বোদয়’ আন্দোলনকে লোকজন, আচার্য বিনবাভাবের সঙ্গে থাকা ভূমিদান আন্দোলনের অনেক কর্মী, নেতা যোগ দেন এই দলে। এছাড়া অখিল ভারতীয় জনসংঘ,  স্বতন্ত্র পার্টি, আদি কংগ্রেস, এস এস পি— সংযুক্ত সোসালিস্ট পার্টি, পি এস পি— প্রজা সোসালিস্ট পার্টি— সব রাজনৈতিক স্রোত মিশে যায় জনতা পার্টিতে। স্বতন্ত্র দল রাজা, সামন্ত শ্রেণী, পুঁজিবাদের সমর্থক। তাদের নির্বাচনী প্রতীক তারা। অখিল ভারতীয় জনসংঘ-র প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তিনি পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর মন্ত্রীসভায় শিল্পপতি ছিলেন। নেহরু লিয়াকত প্যাক্টের প্রতিবাদে মন্ত্রীসভা ছাড়েন শ্যামাপ্রসাদ। হিন্দু মহাসভা হয়ে ‘অখিল ভারতীয় জনসংঘ’-র প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ‘অখিল ভারতীয় জনসংঘ’-ই আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি— বি জে পি-র পূর্বসুরী। জনসংঘ-র নির্বাচনী প্রতীক ছিল প্রদীপ। হিন্দিতে যা দিয়া। ‘অখিল ভারতীয় জনসংঘ’র নির্বাচনী ইশতাহারে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, ভারতকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র বানানো ইত্যাদি প্রভৃতি থাকত সেই ষাট দশক থেকেই, ষাট দশকের একেবারে গোড়া থেকে, অন্তত যে সময় থেকে রাজনৈতিক ইশতাহার ইত্যাদি মনে করার কথাটুকু গাঁথা আছে স্মৃতিতে।

স্বতন্ত্র পার্টির নেতা ছিলেন মিনুমাসানি। তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু— ইউমেনশিয়া-র পক্ষে কথা বলেছেন দীর্ঘদিন। বই লিখেছেন। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান। লোকসভায় পঞ্চাশ দশকে হীরেন মুখার্জি, নেহরু জামাতা ফিরোজ গান্ধী, এন সি চ্যাটার্জি, সমর গুহ, মিনু মাসানি, এন জি গোরে, কৃষ্ণ কৃপালানী, তরুণ অটল বিহারী বাজপেয়ি-সহ অনেকে ছিলেন সরকার বিরোধী বক্তব্যে অসম্ভব পারগ।

একটু পরে আসেন জর্জ ফার্নান্ডেজ আরও পরে সি পি আই (এম) এর জ্যোতির্ময় বসু, অখন্ড ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, ভুপেশ গুপ্ত, পরবর্তী সময়ে এরা দুজনেই থেকে যান সি পি আই-তে, পার্টি ভাগের পর। এম ভি কামাখ্যাও ছিলেন বড় মাপের সাংসদ।

পশ্চিমবঙ্গে বিমান মিত্ররা ছিলেন পুরনো সোসালিস্ট পার্টি— এস পি–র লোক। যাঁদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল শেকড় ছড়ানো বটগাছ। সমর গুহ ছিলেন প্রজা সোসালিস্ট পার্টি— পি এস পি-র সাংসদ। যাঁদের নির্বাচনী প্রতীক কুঁড়েঘর। সমর গুহ ছিলেন ঘোষিত সুভাষবাদী। সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন, এই নিয়ে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে তাঁর বক্তৃতা, সংসদীয় লড়াই মনে থাকার।

আরও পড়ুন
বাঙালির সাহেবি নববর্ষের আদিখ্যেতা ও অন্যান্য

একবার অবশ্য সমরবাবু খুব ফাঁসা ফেঁসে গেলেন, সম্ভবত আশির দশকে। সুভাষচন্দ্রের মেজদা আর শরৎ বসুর শরীর আর সুভাষচন্দ্রের গলা পর্যন্ত মুখ, এই দুই মিলে এক সুপার ইম্পোজ করা ছবি তিনি প্রকাশ করলেন লোকসভায়। বহু দৈনিকে তা ছবি হিসাবেও ছাপা হল। তারপর তা নিয়ে শুরু হল বিতর্ক। শাসক কংগ্রেস দল রে-রে-রে করে উঠল একেবারে। আর শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল এই ছবিটি জোড়া-তাড়া দিয়ে বানানো, যা একেবারেই সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি নয়। তখন খবরের কাগজে কাগজে খুব হইচই হয়েছিল এই খবর ও ছবি নিয়ে। বিতর্ক, কাদা ছোড়াছুড়ি। এম পি সমর গুহকে এ নিয়ে বহু কথাও শুনতে হয়।

‘দৈনিক বসুমতী’-র গাড়ি দেখাশুনো করতেন মহাদেববাবু। তাঁর পুত্র বাবু বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময় পলাতক, ঘর ছেড়ে বোম্বাই বা দিল্লিতে বিচিত্র ধরণের কাজ করে। বেশির ভাগই গোটেলম রেস্তোরাঁয়। ডিশ ওয়াশার, ওয়েটার। বেয়ারা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা তার। মহাদেবের বিবাহিত স্ত্রীচলে গেছেন অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে। মহাদেব বড় খাঁচায় টিয়া, চন্দনা এইসব পোষেন। ছোলা-জল দেনি নিয়ম করে। এ সব লিখেছিও আগে।

সুরূপা গুহ হত্যা মামলায় ‘যুগান্তর’-এর হয়ে রিপোর্ট করতেন কানাই দত্ত। তিনি সাগর মেলা স্পেশালিস্টও ছিলেন। কানাই দত্তকে ‘কানাই কুমির’ বলে সম্বোধন করতেন ‘যুগান্তর’-এর বিমানবন্দর সাংবাদদাতা শ্যামাপ্রসাদ সরকার। শ্যামাপ্রসাদদা কবিতা লিখতেন। দৈনিক বসুমতী’র হয়ে সাগরমেলা কভারেজ করি বার দুই। এছাড়াও ‘সাগরে’ গেছি অনেকবার। আমাদের ছোটবেলায় একটা কথা প্রায়ই শুনতাম— ‘সব তীর্থ বার বার/ গঙ্গাসাগর একবার’।

প্রেমেন্দ্র মিত্র— প্রেমেন্দার ‘সাগরসঙ্গমে’ অতি বিখ্যাত গল্প। সাগর— গঙ্গাসাগর শুনলেই আমার রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাম’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। সেইসঙ্গে ভূপেন হাজারিকার অতি বিখ্যাত গান— ‘সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত, কখনও তো হই নাই ক্লান্ত’।

আরও পড়ুন
আমাদের বড়দিন, সাহেবি নববর্ষ— নিঃসীম

সাগরে— গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির আশ্রম। বার বার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। সেই সব কথা কপিল মুনির আশ্রম-এর প্রণামীর টাকা ও অন্যান্য জিনিস অযোধ্যায় নিয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে স্টোরি করি। আমি যেবার ‘দৈনিক বসুমতী’-র হয়ে সাগরমেলা— গঙ্গাসাগর কভার করতে গেছিলাম, সেবার ‘স্টেটসম্যান’-এর হয়ে সুব্রত নাগচৌধুরী গেছিল সংবাদিক হিসাবে। আর ফোটোগ্রাফার সুব্রত পত্রনবিশ।

সুব্রত নাগচৌধুরী একটু শর্ট, স্টাউট। সুদর্শন, সর্বদা হাসিমুখ। ‘রামাসক্ত’। ওল্ড মঙ্ক। প্রচুর ‘রাম’-এর বোতল সঙ্গে, বুড়ো সন্ন্যাসী। খানিকটা খাওয়ার পর সুব্রত নাগচৌধুরী রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য নামটির জন্য অনুরাগ প্রকাশ করত। কিছু শ্রু বিসর্জন হয়ত।

সুব্রত পত্রনবিশ ‘স্টেটসম্যান’-এর চিফ ফোটোগ্রাফার। বিখ্যাত ছবি তুলিয়ে। সুব্রত পত্রনবিশের ভাই কাজল পত্রনবিশ। তিনি ‘স্টেটসম্যান’-এ, ফোটোগ্রাফার। সুব্রতদার পুত্র শিলাদিত্য পত্রনবিশ অনেক অনেক বছর পর অকালে মারা যান। শিলাদিত্য পত্রনবিশ নাম করা টিভি অ্যাক্টর ছিলেন।

যে বছর সমরেশ বসু কালকূট নামে লেখা ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান, সে বছর গঙ্গাসাগর মেলায় গেছিলাম ‘দৈনিক বসুমতী’-র সাংবাদিক হিসাবে। কথাকার দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময়ই প্রয়াত হন। দীপেনদা ‘পরিচয়’-এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁর অতি বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’, ‘চর্যাপদের হরিণী’, ‘জটায়ু’। দীপেনদার ছোট উপন্যাস ‘শোক মিছিল’, ‘বিবাহবার্ষিকী’।

আরও পড়ুন
ছোটোবেলার ‘ব-ব-জামা’— বড়দিন

খুব শীত সাগরদ্বীপে। পৌষ সংক্রান্তির স্নান উপলক্ষে সেখানে বসেছে নতুন নগর। জেল-খানা, কোর্ট। জেলখানা মানে লকআপ। সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে সারা রাত ঘুরেছি সাগরে। বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে খাওয়াবার ব্যবস্থা। রাতে গরম গরম, বড় বড় পুরি। আলুর তরকারি। বরাবরের মতোই এই মেলাতে সেবারও ‘ভারত সেবাশ্রম সংঘ’-র সাধুরা সক্রিয় সেবাকাজে। সঙ্গে বজরং দল। নাহ, এরা সংঘ পরিবারের বজরং দল নয়। অন্য কোনো সংস্থা। এঁদের কাজ সাগরে আসা লোকজনের কেউ মারা গেলে তাঁর দাহসংস্কার করা। বজরং দল, নাকি ‘বজরং সেবা সংঘ’?

হোগলার ছাউনি দেওয়া ঘরে সাংবাদিকদের থাকার ব্যবস্থা। বাইরে খোলা আকাশের নিচে, অথবা কোনোরকমে হোগলার ছাউনি খাড়া করে তার ভেতরে পুণ্যার্থীরা। এখানে বাবলা কাঁটার ওপর শুয়ে থাকা নগ্নগাত্রের ‘সাধু’ দেখি। দেখতে পাই গরুর ল্যাজ ধরে পুণ্যার্থীদের তথাকথিত ‘বৈতরণী পার হওয়ার’— গরুর ল্যাজের সঙ্গে নিজেদের পুণ্য-যাত্রার দৃশ্য। আমার সঙ্গে সেবার ‘দৈনিক বসুমতী’-র চিফ ফোটোগ্রাফার সুধীর মল্লিক।

প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’ ও ‘দৈনিক বসুমতী’র অন্যান্য পাবলিকেশন, যা পরে বেরোতে পারে— মাসিক, সাপ্তাহিক, ইত্যাদি, তার সম্পাদকও উনিই হবেন, এই শর্তে এসেছেন ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। যেদিন ‘বসুমতী’-তে জয়েন করলেন প্রশান্ত সরকার, তার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি তাঁর গাড়িটি বিক্রি করে দিলেন। কেন বিক্রি করলেন নিজের গাড়ি, কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বলতেন, আমার গাড়ির জন্য যে তেল কিনি, অফিসের গাড়ি যা আমি সম্পাদক হিসাবে পাব, সেই গাড়ির তেলের হিসাব সব গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ‘দৈনিক বসুমতী’-র এডিটর হিসাবে আমি গাড়ি তো পাবই, ফলে নিজের গাড়ির দরকার কী?

প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে ‘স্টেটসম্যান’ সম্পাদক সি আর ইরানির বিবাদ এমন পর্যায়ে গেছিল যে দীর্ঘ আট-দশ বছর প্রশান্ত সরকারকে কোনো অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়নি। অথচ তিনি যে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, নিজস্ব উদ্যোগে, সেই সেই প্রতিবেদনের অনেকগুলোই ‘স্টেটসম্যান’-এর প্রথম পাতায় ডবল কলম স্টোরি হয়েছে বাই লাইন। এই তথ্য প্রশান্তদার কাছে শুনেছি।

‘স্টেটসম্যান’-এর ফোটোগ্রাফার সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল প্রশান্ত সরকারের। ওঁর মুখে গল্প শুনেছি সুব্রত পত্রনবিশ আরি তাঁর প্রেমিকা- পরে যিনি সুব্রতদার স্ত্রী হন, তিনি ও সুব্রতদা লোকাল ট্রেনে চেপে হাওড়া অথবা শেয়ালদা থেকে সোজা বহুদূর, প্রান্তিক স্টেশন— প্রেম করার নিরাপদ জায়গা হিসাবে লোকাল ট্রেনের কামরাকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা ষাটের দশকের শেষে।

সেবার, গঙ্গাসাগরে আগুন লাগে। হোগলার ঘরে আগুন প্রায় নৈমিত্তিক— প্রতি বাৎসরিক মকর স্নানের অবশ্যম্ভাবী বিষয়। মকর সংক্রান্তির স্নানের সময় সে বছর সাগরমেলায় আগুন লাগে। মারাও যান কয়েকজন। সেই ঘটনা— দুর্ঘটনা রিপোর্ট করতে হয়।

আমি হাসতে হাসতে ‘স্টেটসম্যান’-এর সুব্রত নাগ চৌধুরীকে বলেছিলাম, রিপোর্টিং তো আলাদা আলাদা মেজাজের, ঘরানার হবে কিন্তু দুর্ঘটনা— অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যাটা যেন একরকম হয়। কারণ স্টেটসম্যান আগুনে মৃত সাত লিখলে বসুমতী যদি পাঁচ বা নয় লেখে, মৃতের সংখ্যা, তাহলে পাবলিক ‘স্টেটসম্যান’-এর কথাই নেবে। বিশ্বাস করবে। ‘বসুমতী’-র কথা নয়।

আমার কথা শুনে সুব্রতদার কি হাসি! সুব্রত পরে গৌরকিশোর ঘোষের কন্যা সাহানাকে বিবাহ করে। সাহানা আর সোহিনী গৌরদার দুই কন্যা। সাহানা ‘বর্তমান’-এ চাকরি করতেন। বহু বছর কোনো যোগাযোগ নেই।

সাহানার প্রথম বিবাহটি ভেঙে যায়। পরে সুব্রত নাগচৌধুরীর সঙ্গে তাঁর যৌথ জীবনযাত্রা। সাহানার প্রথম সহজীবনের মানুষটিও ছিলেন চিত্র সাংবাদিক। সেবার সাগরে ‘দৈনিক বসুমতী’-র চিফ ফোটোগ্রাফার সুধীর মল্লিক তাঁর পুরনো ‘রোলিফ্লেকস’, ‘রোলিকট’— জার্মান ক্যামেরার বদলে নতুন ক্যামেরা নিয়ে গেছিলেন। কিছুদিন আগেই এই ক্যামেরা কেনা হয়েছিল, মানে কিনে দেওয়া হয়েছিল ‘দৈনিক বসুমতী’-র পক্ষে। সম্পাদক প্রশান্ত সরকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সব।

সাগর থেকে খবর পাঠানো তখন খুব সমস্যা। টেলি যোগাযোগ ব্ব্যবস্থা যা-তা। টেলিফোন লাইন থাকে না, মানে পাওয়া যায় না। মোবাইল ফোন স্বপ্নেরও বাইরে। অস্থায়ী প্রেস কর্নারে গিয়ে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা, কখন ডাক আসবে। সেখানে ‘দৈনিক বসুমতী’ তার প্রচার সংখ্যার নিরিখে কিছুটা ‘ব্রাত্য’ তো বটেই। ‘স্টেটসম্যান’, ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজারপত্রিকা, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় পত্রিকার তুলনায়। এছাড়া সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থা পি টি আই আর ইউ এন আই তো আছেই।

সুব্রত নাগচৌধুরী আমাকে খুব সাহায্য করেছিল খবর পাঠানোর ব্যাপারে। প্রশান্তদা— প্রশান্ত সরকার বলেছিলেন, আগে স্টোরি ফাইল করবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া, অন্য কাজ। আমি দেখেছি, আমার সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতায়, ‘স্টেটসম্যান’-এর সাংবাদিকরা একেবারে অন্যরকম। খবর ‘চাওয়া’ দেওয়া, এক্সক্লুসিভ ইত্যাদি, খরচের ব্যাপারে কার্পণ্য— এসব মিননেস এঁদের মধ্যে নেই। ফলে আমি মদ্যপান না করলেও দেখেছি সুব্রত নাগচৌধুরী ঢালাও রাম-আনয়ন। সব ‘ওল্ড মঙ্ক’।

আলিপুর কোর্ট থেকে বাস ছেড়েছিল গঙ্গাসাগর যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কাগজের সাংবাদিক, ফোটোগ্রাফার আর ছোট-বড় আধিকারিকদের নিয়ে। বোঝাই প্রাইভেট বাস। তখন সাগরে যাওয়াও বেশ কঠিন ব্যবাপার। নামখানা, কচুবেড়িয়া, হারউড পয়েন্ট, বাস তারপর স্টিমার, ভ্যান রিকশা। অসম্ভব ফৈরিজত। দলে দলে মানুষ আসছেন। পার হচ্ছেন। অস্থায়ী সব ব্যবস্থা, জেটি।

সাগরদ্বীপে বাস যায় নব নগর। আলো, থাকার জায়গা। তার আগে আগে গঙ্গাসাগর থেকে আসা সাধুরা কলকাতার বুকে, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে। গঙ্গাসাগর যাওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে। পৌষ মাসের সংক্রান্তিকে গঙ্গাসাগরের সময় লক্ষ্য করে দেখেছি কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন রুটের প্রাইভেট বাস কমে যায়। বিহারের নারী-পুরুষ সাগর ফেরত তীর্থযাত্রী হিসাবে ভিড় করেন কলকাতার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, এবং কালীঘাটের কালী মন্দিরে। ভিড় লেগে যায় একেবারে। ঠেলাঠেলি ভিড়।

সাগরমেলায় আগুন লাগল। বসুমতী সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের কথা অনুযায়ী অংরেজি হরফে-রোমানে লিখে টেলিগ্রাম করতাম। তারপর ফোন, টেলিফোন। খবর লেখা এই টেলিগ্রাম ঠিক করে পৌঁছবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফোনের লাইন পাওয়া যায় না। গেলেও কেটে কেটে যায়। কীভাবে যে সাগরমেলার খবর পাঠিয়েছি, সে তো আমিই জানি। সাগরদ্বীপে মকর মেলার সময় প্রচুর ভিখিরি, কুষ্ঠরোগী। দূর দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রী, পুণ্যলোভী মানুষ, সাধুজন। পাণ্ডা, পকেটমার, সাংবাদিক, বেশ্যা— সবেতে টইটম্বুর। রাতে আলোমাখা সাগরদ্বীপ, কপিল মুনির আশ্রম, সাধুদের ডেরা, তীর্থযাত্রীদের হোগলা-ঘর রহস্যময়। তীব্র কুহক দিয়ে ঘেরা সব।

কুয়াশা, শীত, হিম, ভাঙা চাঁদ, তেলোতাড়ি রঙের জ্যোৎস্না সব গায়ে-মাথায় মেখে সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, টই টই করা মেলায়। সুব্রতদা ‘ছবি-শিকারে’ বেরিয়েছেন। এক্সক্লুসিভ ফোটো।

আগুন, শীতম পুণ্যার্থী জন, স্তব্ধ অথচ তরঙ্গময় সমুদ্র। সুব্রতদার সঙ্গে ‘আশাই পেনট্যাক্স’ ক্যামেরা ছিল কী? নাকি ‘কে থাইজ্যান্ড’? অথবা কোনোটাও নয়। তখন তো ফিল্মের ক্যামেরার যুগ। ছবি তুলে ফিল্ম রোল বার করে তা পাঠানো পুলিশের সাহায্যে। ‘স্টেটসম্যান’ বলে কথা। ক্যামেরা থেকে ফিল্ম রোল বার করতে হয় খুবই সাবধানে। সূর্যের বা অন্য কোনো আলোর ঝলকানিতে, স্পর্শে ফিল্মের ছবি নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে ক্যামেরার গেট থেকে ফিল্ম বার করা যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার।

যতবার সাগরদ্বীপে গঙ্গাসাগর মেলা কভার করতে গেছি ততবারই আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায়ের বলা ‘ঢোল গঙ্গা’-র কথা মনে পড়েছে। বাবা বলেছিলেন ‘ঢোল গঙ্গা’ নাকি সাগরে ঢোকার অতি দুর্গম স্রোত। আমি অবশ্য ‘ঢোল গঞগা’-র কোনো সুতো খুঁজে পাইনি। বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করেও না। তখনও সাগরদ্বীপে ভারত সেবাশ্রম সংঘ-র বড়সড় পাকা মন্দির-বাড়ি ও যাত্রীনিবাস হয়নি। নৌকোয় চেপে আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য নিয়মিত দুর্ঘটনা, প্রাণহানি বরাদ্দ ছিল সাগর মেলার জন্য। জলে ডুবে মৃত্যু, কলেরায় মৃত্যু। সেই জন্যই বোধহয় ‘সব তীর্থ বার বার/ গঙ্গাসাগর একবার’ এই কথাটি। 

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’তেও বিবরণ আছে সাগরযাত্রার। সাগরমেলার বিবরণ সাগরদ্বীপ থেকে গঙ্গাসাগরের স্নান সেরে ফিরে আসার সময় কপিল মুনি আশ্রমের নকুল দানা প্রসাদ ও সস্তার, খেলো ছাপা মকরবাহিনী গঙ্গার ছবি নিয়ে ফিরত। সেই রঙিন ছবির নিচে ‘সব তীর্থ বার বার/ গঙ্গাসাগর একবার’ এই কথাটি লেখা।

কুম্ভমেলা দেখতে গিয়ে ‘যুগান্তর’, ‘বসুমতী’তে লেখার জন্য গিয়ে বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে। ইলাহাবাদ, হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জ্বয়িনী— সবগুলো কুম্ভ আমার করা। অর্ধ এবং পূর্ণ। মৌনী অমাবশ্যা, শ্রীপঞ্চমী ইত্যাদি প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ নহান— সেও দেখা। আগেও লিখেছি সম্ভবত প্রয়াগরাজ— প্রয়াগ বা ইলাহাবাদের কুম্ভ আকারে, বিস্তারে আয়তনে সব থেকে বৃহৎ। পনটুন ব্রিজ তো সেখানেই। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী— তিন নদীর সমাহার-সঙ্গম ইলাহাবাদ। উজ্জ্বয়িনীতে শিপ্রা নদী। মহাকালের মন্দির। কালী দাস— কবি কালী দাসের স্মৃতি। হরিদ্বারে হর কি গৌড়ি, গঙ্গা, নীলধারা, চণ্ডী পাহাড়, মনসা পাহাড়।

গঙ্গাসাগরে কুম্ভের ব্যাপ্তি নেই। থাকা সম্ভনবও নয়। কুম্ভমেলায় এক মাস ‘কল্পবাস’ করে থাকেন অনেক পুণ্যার্থী। সংযমী জীবন। আহার, বিহার— সবেতে বিশেষ করে ইলাহাবাদ কুম্ভে।

ইলাহাবাদ কুম্ভ নিয়ে ‘যুগান্তর’ এবং ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকাতে ধারাবাহিক লিখেছিলাম। ‘দৈনিক বসুমতী’তে নিউজের পাতায় ‘শুধু বাঁশি শুনেছি’ নাম দিয়ে প্রথম দফার কুম্ভ ঘুরে এসে। তারপর ‘পূর্ণযাত্রা’। ‘শুধু বাঁশি শুনেছি’ গোটা চার/পাঁচ কিস্তি লেখার পর জোর করে বন্ধ করান হয়। দুইয়ের পাতায় বাইলাইন বেরত সেই লেখা। সুধাংশুমাধব দে তখন ‘দৈনিক বসুমতী’-র বার্তা সম্পাদক— এন ই— নিউজ এডিটর। তিনি সু মা দে নামে লিখতেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র পাতায়, রবিবাসরীয়তেও। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবাসরীয় দেখেন।

‘পূর্ণযাত্রা’ লিখি অসীম সোম সম্পাদক থাকার সময়। অসীম সোম চমৎকার মানুষ। ঘন ঘন সিগারেট। তিনি ‘আকাশবাণী’তে ছিলেন এক সময়। ‘দৈনিক বসুমতী’-তে আমার ‘পূর্ণযাত্রা’ ছাপার সময় এই লেখাটি নিয়ে একটি বিরূপাত্মক এবং বিদ্রুপাত্মক চিঠি প্রকাশিত হলে, তার পাল্টা একটি চিঠি আমি দিলে, তা কম্পোজ হয়ে দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। অথচ ছাপার নামটি নেই। আমি অসীমদা— অসীম সোমকে দু-একবার ব্যাপারটি বলার পর তিনি নিজে প্রেসে গিয়ে ঝুল-কালি ঝেড়ে আমার পাল্টা উত্তরের চিঠির গ্যালিপ্রুফটি খুঁজে বার করেন ও ছাপার নির্দেশ দেন। আমার উত্তরটি বেশ বড়ই ছিল।

আজকের ‘খ্যাতনামা’ কুণাল ঘোষ অসীম সোমের জামাই। অসীমদাও ক্লিন শেভেন প্যান্ট শার্ট। খুব সিম্পল মানুষ।

প্রশান্ত সরকারের বন্ধু ছিলেন অসীম সোম। অসীম সোমের পর ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক হন কবি কৃষ্ণ ধর। কৃষ্ণদা ছিলেন ‘যুগান্তর’-এর অ্যাসিট্যান্ট এডিটর। প্রতি শুক্রবার যুগান্তরের চারের পাতায় ‘স্টেটসম্যান’-এর ‘ক্যালকাটা নোটবুক’ বা সোমবারের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কলকাতার কচরা’-র ধরণের লেখা বেরত। সেটি দেখতেন কৃষ্ণ ধর। তখন যুগান্তরের চারের পাতায় পোস্ট এডিটরিয়ালের উত্তর সম্পাদকীয়, এডিটরিয়াল সম্পাদকীয় লিখতেন নিরাঞ্জন সেনগুপ্ত, প্রফুল্ল চন্দ্র, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লরতন গঙ্গোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যোগ দেন ‘যুগান্তর’ রবিবাসরীয় ছেড়ে। আশুদা— আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আসতে বাধ্য হন, এটাই বরং বলা ঠিক হবে। প্রখ্যাত রিপোর্টার অনীল ভট্টাভার্য পোস্ট এডিট লিখতেন। ‘দৈনিক বসুমতী’-র চারের পাতায় এডিটরিয়াল, পোস্ট এডিটরিয়াল লিখতেন কল্পতরু সেনগুপ্ত। যিনি ছিলেন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী, চট্টগ্রামের মানুষ। কল্পতরুদা ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র যে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, তার সভাপতি। প্রভাতবাবু, বেণীবাবুরা ছিলেন ইউনিয়নের অন্যতম নেতা। তারও আগে বসুমতীর মালিক অশোক সেনের বিরুদ্ধে যে ধর্মঘট ইত্যাদি সংগঠনে যে ইউনিয়ন ছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন নীলমনিবাবু। নীলমনিবাবু ছিলেন জাতীয় কংগ্রেস মতাদর্শের মানুষ। তাঁর পদবী সম্ভবত মণ্ডল। দক্ষিণের দিকে তাঁর বড়সড় বাড়ি, জমি, মন্দির। ধুতি ও ছিটের শার্ট পরা নীলমনিবাবু ঘন ঘন বিড়ি, সিগারেট। মাথা জোড়া টাক। ওপর পাটির বেশ কয়েকটা তাঁর অ্যাসিডে খাওয়া। কালচে, মায়া। গায়ের রঙ কালো, বেশ রোগা।

পরে বসুমতীতে আই এন টি ইউ সি-র নেতা হন নীলমণি মণ্ডল। অশোক দেবও সম্ভবত জড়িয়ে ছিলেন বসুমতী ইউনিয়নের সঙ্গে।

সাগরদ্বীপে শীতের রাতে ঘুরে বেড়ান সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে। সেটা ১৯৭৮-৭৯ সালটাল হবে। নাকি ১৯৮০? ১৯৮০-৮১-ই হবে সেটা, সাগরজলে চাঁদ ভেসে যায়। চাঁদ ভেসে যায়। চাঁদ ভেসে যায়।

সুব্রত নাগচৌধুরী, সুব্রত পত্রনবিশদের সঙ্গে পরবর্তী সময়েও যোগাযোগ ছিল বহুদিন। ‘স্টেটসম্যান’ অফিসে, একদম  ঢোকার সময় ঘোরান কাঠ-কাঁচের দরজা, ভেতরে শ্বেত পাথর, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, অনেক অনেক স্পেস তার। ভেতরে ভেতরে ফাটল ধরেছে কোথাও কোথাও সেই মার্বেলে। প্রশান্ত সরকার একবার আমায় নিয়ে যান ‘স্টেটসম্যান’-এর প্রেস দেখাতে। কি চমৎকার ছাপাখানা। ভেতরে সমস্ত মেশিনপত্র এত ঝক ঝকে, বলার নয়, মনে হয় আজই সেই প্রেস চালু হল। প্রশান্তদা তখন ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক। কথাকার অসীম রায় ছিলেন ‘স্টেটসম্যান’-এর স্পেশাল করেসপনডেন্ট। বিশেষ সংবাদদাতা। একটা ছোট ঘরে টাইপ রাইটার নিয়ে বসতেন অসীম রায়। ইংরেজি কাগজের সব কপি টাইপ করে দিতে হত।

গরমের দিনে মাখন জিনের অফ হোয়াইট ফোল্ডদার ফুল প্যান্ট। বুক কাটা, হাফ হাতা বুশ শার্ট, চক চকে ফিতে বাঁধা, পা ঢাকা কালো শ্যু। মাথাভর্তি সামান্য কোঁকড়ান চুল ভালো করে তেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা।

অসীম রায় ততদিনে ‘আরম্ভের রাত’, ‘অনি’, ‘তাড়ি’, ‘শ্রেণীশত্রু’, ‘প্রেমের হাল কে বোঝে শালা’, লিখে ফেলেছেন। লিখেছেন ‘রজনীকান্ত রায়’— যে গল্প লেখা শিল্পী যামিনী রায়কে নিয়ে। অসীম রায়ের অসামান্য লেখা ‘কেওড়া পার্টি’, ‘সলবেলো বাড়ি ওয়ালা বাংলাদেশ’, ‘পদযাত্রা’, ‘বাজিদপুর ও ষড়যন্ত্র’ ‘ডনাপলা’। ‘পদযাত্রা’ গল্পটি নিয়ে তেমন করে কেউ বলে না। ‘পদযাত্রা’ জরুরী অবস্থা আসব আসব সময়ে লেখা। সঞ্জয় গান্ধীর উত্থান ও তাঁর গ্রামে ঘোরার ছায়া নিয়েই যেন এই আখ্যান। বেরিয়েছিল সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়।

অসীম রায় লিখে ফেলেছেন ততদিনে ‘শব্দের খাঁচায়’, ‘গোপাল দেব’, ‘ফুটপাতে ফুলের গল্প’, ‘আবহমানকাল’। ‘শব্দের খাঁচায়’ খুবই সেরিব্রাল সজ্জাত লেখা। অসীম রায়ের বাড়ি ছিল দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোডে। দোতলা বড়, পৈতৃক বাড়ি। বৌদি— গীতাদি অসম্ভব ভালো মানুষ, সুন্দরী, ফর্সা, স্বাস্থ্যবতী। অসীমদা, গীতাবৌদির তিন ছেলে। ‘শব্দের খাঁচায়’-এর উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল ‘যাঁরা খাঁচায় থাকতে রাজি নন’, ইত্যাদি প্রভৃতি।

অসীমদা-গীতাবৌদির তিন পুত্রের সঙ্গেই আলাপ ছিল খুব। তাঁদের বড় এবং মেজো পুত্রটি লেখেলিখি করেন। অসীম রায়ের সঙ্গে তীব্র সখ্য তৈরি হয় একটা সময়ের পর। সে কথা নয় পরে বলব।

সাগর দ্বীপ, কচুবেড়িয়া, নামখানা, হারউড পয়েন্ট সব একসঙ্গে চক্কর খেতে থাকে মাথার ভেতর কপি করার সময়। ‘যুগান্তর’-এ শ্যাম মল্লিক নামে একজন সাংবাদিক ছিলেন। কৃষ্ণবর্ণ, স্টাউট চেহারা, প্যান্ট-শার্টি, খুব ভালো পরিমাণে পান করতে পারতেন। শ্যাম মল্লিক আগে ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। একবার সাগরবেলায়, সাগরসঙ্গমে, গঙ্গাসাগর মেলায় তিনি গেছিলেন কানাই দত্তের সঙ্গে নয়, স্বতন্ত্রভাবে। কানাই দত্ত দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা, শ্যাম মল্লিক পুরো দস্তুর রিপোর্টার। কানাই দত্তের ডি এম, এস পি, আধিকারিক যোগাযোগ ছিল অতি ঘন। কানাই দত্ত বাংলা লিখতে পারতেন না তেমন, কিন্তু তার সংবাদের গন্ধ পাওয়া— কোনটা খবর, কোনটা খবর নয়, এই নিউজ সেন্স তীব্র ছিল। 

‘দৈনিক বসুমতী’-র মফস্বল ডেক্স-এর প্রধান ছিলেন সমর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাড়ি উত্তরপাড়ায়। নামকরা শিল্পী, চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর খুল্লতাত— কাকা। চৈতন্যদেবের ক্যানভাসে নগ্ন নারীরা ছিলেন। অর্ধনগ্ন নারীরাও। খানিকটা যেন ইউরোপিয় ঘরানার, খানিকটা যেন রাজা রবি বর্মা।

রবি বর্মার ছবি অসামান্য। অসাধারণ। রবি বর্মাকে নিয়ে ছবিও হয়েছে— সিনেমা। নবনীতা দেবসেন ও অমর্ত্য সেনের দুই কন্যার ছোটটি নন্দনা— এই সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেন। ছবির নাম ‘রসিয়া’ ছিল কী? 

‘দৈনিক বসুমতী’-র মফস্বল ডেস্ক ছিল খুবই শক্তিশালী। মোহনকালী বিশ্বাস ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’র সংবাদদাতা। প্রশান্ত সরকার সম্পাদক হয়ে আসার পর ‘দৈনিক বসুমতী’র মফস্বলী সাংবাদিকদের নিয়ে জেলায় জেলায় সভা করতেন। সেই সভার ফলে সংবাদদাতাদের সঙ্গে ‘দৈনিক বসুমতী’-র যোগাযোগ আরও তীব্র হয়। আর কোনোরকম সেনসেশান ছাড়াই ‘দৈনিক বসুমতী’র সার্কুলেশন— প্রচার এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।

কেদার ঘোষ সম্পাদক থাকার সময় সুরূপা গুহ হত্যা মামলার সেনসেশানাল রিপোর্ট ছেপে ‘দৈনিক বসুমতী’তার প্রচার সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়েছিল। ‘স্টেটসম্যান’ ঘরানার আর এক সাংবাদিক প্রশান্ত সরকার ব্রিটিশ প্যাটার্নের জার্নালিজম পছন্দ করতেন।

Powered by Froala Editor