মুছে যায় - ২৬
আগের পর্বে
কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী ওরফে কালী। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের সেই বন্ধু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, হয়ে উঠেছিল কবিতা-পাগল। মুখে মুখেই তৈরি করে ফেলত কবিতা। কালী ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে বড়দিনে কালীঘাট থেকে পার্কস্ট্রিট সফর হত আমাদের। পকেটে টাকা না থাকায় ট্রামে কায়দা করে টিকিট না কেটে ভ্রমণ। এহেন কালী বড়দিনে মরা সাহেবের কোট পরে ভিক্ষে করতে বসেছিল পার্কস্ট্রিটে। বাংলা-ইংরাজি মিশিয়ে ‘হেল্প’ চাওয়া পড়াশোনার জন্য। সংগ্রহ নেহাত কম হত না কালীর। তারপর সেই টাকা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া। এমন ভিক্ষে করতে গিয়েই একবার বড়দিনের সন্ধেয় এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে এক মঙ্গোলিয়ান সুন্দরীকে ‘আই তুলিং ইউ’ বলেই প্রেম নিবেদন করে বসেছিল কালী। তারপর...
হাওড়া জেলার বালি আর বেলুড়ের মাঝামাঝি একটি ‘জাহাজবাড়ি’ তৈরি হয় ষাটের দশকে। বি-ই-শা-ল জলাভূমির ওপর সে যেন এক অনন্ত বিস্ময়, অন্তত তখন, সেই প্রায় কিশোরবেলায়। কোনো অবাঙালি, ধনী তাঁর পুত্রের ইচ্ছাপূরণে তৈরি হলেও এই জাহাজবাড়ি। বলা বাহুল্যই হয়ত তাঁর পুত্রটি অকালপ্রয়াত, বেশ ছোটবেলাতেই— বালকবেলায় মারা যায়। তারই ‘অধুরা সপনা’— না মেটা ইচ্ছের পূরণ হচ্ছে এই জাহাজবাড়ি।
‘জাহাজবাড়ি’ তো ‘জাহাজবাড়ি’। জলের ওপর স্থির, অচঞ্চল। সাদা রঙের অর্ণবপোত। জাহাজ না বলে তাকে বড় স্টিমার বলাই হয়তো ভালো। পাশেই বালি সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সাঁতারকেন্দ্র। আমার বন্ধু, কমরেড সরোজ বসু চমৎকার সাঁতার কাটতেন। জেলাতে তো বটেই, রাজ্যেও তাঁর সাঁতারু দক্ষতা যথেষ্ট প্রমাণিত হয়েছিল। সরোজ বসুর ডাকনাম পুলি। তিনি সি পি আই (এম-এল)-এর রাজনীতি করতেন। বছর দুই-তিন তিনি প্রয়াত।
পুলির অনেক মেডেল ছিল সাঁতারে। ফ্রি স্টাইল, ব্রেস্ট স্ট্রোক, বাটারফ্লাই— এসব সন্তরণ কৌশলের কথা পুলির মুখেই প্রথম শুনি। পুলির একটি পা পোলিও আক্রান্ত হয়ে, সরু-রিকেটি। পোলিও না রিকেট আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। ঐ কমজোরি এক পায়ের দুর্বলতাকে অনায়াসে তুচ্ছ করে পুলি মেডেল এনেছেন, একটার পর একটা পদক। ষাট দশকে হাওড়ার বালিতে খেলাধুলোর চর্চা খুব। ল্যাংচা মিত্র, বদরু ব্যানার্জি (সমর), নীলেশ সরকার, বিদ্যুৎ দাস, অনিল মুখার্জি (লালু) সবাই যথেষ্ট নামি।
আরও পড়ুন
আমাদের বড়দিন, সাহেবি নববর্ষ— নিঃসীম
বালিতে ‘ইয়ং অ্যাসোসিয়েশন’, ‘বালি এ সি— বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব’, ‘শিশু সমিতি, ‘বালি তরুণ সংঘ’, ‘বালি নবীন সংঘ’— খুবই নাম করা ক্লাব। ‘বালি তরুণ সংঘ’-র উদ্যোগে ‘আশুতোষ স্মৃতি শিল্ড’-এই টুর্নামেন্টে বহু ফুটবল টিম অন্য অন্য জায়গা— দূর দূর থেকে খেলতে আসত।
‘দিশারী’ নামের নাট্য সংস্থার উদ্যোগে একটি শিল্ড কেন্দ্র করে খেলা হয়েছিল বছর দুই-তিনি। শিশিরদা ছিলেন ‘দিশারী’-র অন্যতম সংগঠক। তিনি খুব লম্বা নন। মাথাভর্তি চুল। নাটকের ডিরেক্টর। তখন— ১৯৬৪-৬৫ সালে নবগরহ সম্মেলনের একটা গুজব ছড়ান হয় পরিকল্পনা মাফিক। তাতে নাকি পৃথিবী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। নিন্দুকে বলল, নবগরহ সম্মেলন আটকাতে যজ্ঞ শুরু হল বিভিন্ন জায়গায়। বিশেষ করে বড়বাজারে। ভেজাল, পচা ঘি পোড়ান শুরু হয়ে গেল নবগরহ সমাবেশের ‘ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’ আটকাতে। মূলত মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা ছিলেন এই যজ্ঞের হোতা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘গ্রহ সমাবেশে’ বসুন্ধরা ধ্বংস হয়নি। পাবলিক হাঁফ ছেড়ে বেঁচে ছিল।
শিশিরদার নাটক, তা নিয়েই। এই জ্যোতিষবচন ইত্যাদিকে বেশ খানিকটা ব্যাঙ্গ করেই। ‘দিশারী’ ক্লাবের অন্যতম সংগঠক অরূপ আর আমাদের স্কুল— ‘বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’-এর ছাত্র আমাদের ক্লাস মেট দিলীপ মাল, ডাকনামে নিলু, জি টি রোডে ভয়ঙ্কর ট্রাক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল। সাইকেলে ডবল বাইক। সামনে ‘হিন্দুস্থান’-এর ভারী, ভোঁতা, গামবাট ট্রাক। মুখোমুখি সংঘর্ষ— কলিশন— অ্যাক্সিডেন্ট। স্পট ডেড দুজনেই।
সেই ‘অরূপ’-এর নামেই শিল্ড— ‘অরূপ-স্মৃতি শিল্ড’ ‘দিশারী’ ক্লাব-এর পরিচালনায়। কলকাতা ময়দানে তখন পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল হরেন্দ্রনাথ মুখার্জির নামে ‘হরেন্দ্রনাথ মুখার্জি শিল্ড’, ‘ল্যাগডেন শিল্ড’, ‘এলেন লিগ’। কলকাতা ময়দানে ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন, ফোর্থ ডিভিশন ফুটবল লিগ তখন আলাদা আলাদা। এছাড়া অতিবিখ্যাত আই এফ এ শিল্ড তো ছিলই। এই শিল্ডে ভারতবর্ষের বাইরের টিমও খেলতে আসত। এখনই মনে পড়ছে ইরানের পাজ ক্লাবের কথা। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাদের হারিয়ে দিয়েছিল শিল্ড ফাইনালে। ‘রোভার্স কাপ’, ‘ডুরান্ড কাপ’, ‘সন্তোষ ট্রফি’, ‘বারবাটি কাপ’— সবই বেশ নামকরা। বারবাটি কাপ ওড়িশায় হত। ইদানীং, কয়েক বছর ধরে সকলেরই দীপ নিভু নিভু আই এস এল-এর চাপে।
আরও পড়ুন
ছোটোবেলার ‘ব-ব-জামা’— বড়দিন
কলকাতা ময়দানে ফুটবল লিগের পাশাপাশি হকি লিগও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন ইনামুর রহমান, আনিসুর রহমান— দুই ভাই অসামান্য হকি খেলতেন। বিশেষ করে ইনামুর, তাঁর স্টিকের কাজ ছিল অসামান্য। ভি পেজ, লাকড়া, গুরুবক্স সিং— এঁরাও ছিলেন বাংলার হকি-গর্ব, ভারতেরও। যোগিন্দর সিংও কি ছিলেন কলকাতায়, কোনো হকি টিমে? গুরুবক্স সিং, ভি পেজ অলিম্পিয়ান। যোগিন্দর সিংও। ইনামুর রহমানও সম্ভবত অলিম্পিক খেলেছেন। এঁদের সকলের খেলা দেখেছি। ইনামুর-আনিসুর ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান— দুই-ই খেলেছেন। কলকাতার ‘বাইটন’ বা ‘বেটন কাপ’— এই হকি টুর্নামেন্টটি সারা ভারতে প্রসিদ্ধ ছিল।
ইস্টবেঙ্গল মাঠ এবং মহামেডান মাঠে জল জমে যেত বৃষ্টি হলেই। ভালো ছিল সি এফ সি- মোহনবাগান গ্রাউন্ড। ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিকে ক্রিকেটের ‘নন্দন কানন’ ইডেন গার্ডেনে কলকাতার লিগ ফুটবল— ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ‘বড়’ ম্যাচ হয়েছে। তবে ফুটবল মাঠ হিসাবে ‘ইডেন’ বেশি দিন থাকেনি।
বালিতে ‘তরুণ সংঘ’, ‘নবীন সংঘ, ‘শিশু সমিতি, ‘যুবক সমিতি’, ‘বালি এসি’— সবারই নিজস্ব মাঠ ছিল। ইদানিং অবশ্য কি অবস্থা জানি না। ‘বালি ইয়ং অ্যাসোসিয়েশন’-এর কোনো নির্দিষ্ট মাঠ ছিল না। আর ‘বেনীদার ক্লাব’, যেখেনে ড্রিল ইত্যাদি শেখান হত ছেলেদের, মেয়েদের, তাও তো উঠে গেল জায়গার অভাবে। বেনীদার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগ ছিল।
অরুণ কবিরাজ ভালো ফুটবল খেলতেন ইয়ং অ্যাসোসিয়েশন-এ। ভেলুদা, ভালো নাম মনে নেই, ভালো খেলতেন ফুটবল, ‘ইয়ং অ্যাসোসিয়েশন’-এই। কি করে কি করে যেন ডুবে গেলেন গঙ্গায়। উঠে এল ডেডবডি।
আরও পড়ুন
ব ব ব বড়োদিন — হাঃ – হাঃ – হা
আমাদের সহপাঠী প্রণব (পিন্টু, যাকে আমরা পিঁয়াজ বলেও ডাকতাম, খেলত ‘শিশু সমিতি’-তে)। গোলকিপার, চমৎকার ছিল তার গ্রিপিং। স্কুলে আমাদের আর এক সহপাঠী বীরব্রত চক্রবর্তী, যাকে আমরা ‘বীরো’ বলতাম, সেই বীরব্রত ‘বালি এসি’-তে খেলত। পরে ‘বালিপ্রতিভা’-তে। ‘বালিপ্রতিভা’ কলকাতা লিগে ফার্স্ট ডিভিশন খেলে তখন, বালিতে নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন গোড়ায় গোড়ায়, সি সি সি আর-এর হয়ে, সেই মিহির দাশশর্মার ছোট দুই ভাই-ই খেলতেন ‘বালিপ্রতিভায়’। সেই দুজনের মাথাতেই বৃহৎ টাক। এই দুই দাশশর্মাদের কাছ থেকেই ডে স্লিপ নিয়ে মাঠে গেছি খেলা দেখতে। বিশেষ করে ‘ইস্টবেঙ্গল’-‘বালিপ্রতিভা’।
তখন কলকাতা ময়দানে ‘ইস্টবেঙ্গল’, ‘মোহনবাগান’, ‘মহামেডান স্পোর্টিং’, ‘বিএনআর’, ‘ইস্টার্ন রেলওয়ে, ‘এরিয়ান, ‘হাওড়া ইউনিয়ন’, ‘কালীঘাট’, ‘বালিপ্রতিভা’, ‘স্পোর্টিং ইয়নিয়ন’, ‘পোর্ট কমশনার্স’, ‘জর্জ টেলিগ্রাফ’, ‘রাজস্থান’ এরাই ফার্স্ট ডিভিশন খেলে। সঙ্গে ‘তালতলা স্পোর্টিং’ ছিল কি? অথবা ‘প্রিয়ার’?
বালির ‘আশুতোষ শিল্ড’ তৈরি করা হয়েছিল আশুতোষ পালের নামে। তাঁর নামে ‘আশুতোষ ভবন’-ও আছে ‘বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’-এ। বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বিদ্যালয়, যার কোনো বাউন্ডারি ওয়াল নেই। ‘আশুতোষ ভবন’, ‘বামাচরণ ভবন’, ‘প্রবোধ ভবন’, ‘তারাকুমার ভবন’, এর মধ্যে ‘প্রবোধ ভবন’ নির্মিত হয় আমরা স্কুলে পড়ার সময়ই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। রবীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তখন প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক মণি বন্দ্যোপাধ্যায়।
বালির গোস্বামী পাড়া, গাঙ্গুলি পাড়া, কামার পাড়া, ম্যাথর পাড়া, ধোপা পাড়া, সরখেল পাড়া, বারেন্দ্র পাড়া, তর্কসিদ্ধান্ত লেন, ব্যানার্জি পাড়া, পাঠক পাড়া, বাজার পাড়া, চন্দ্রপাঠক লেন, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেন, শান্তিরাম রাস্তা, বাঁকের ডাঙা, সর্বত্রই ফুটবলের কিছু না কিছু চর্চা ছিল।
আরও পড়ুন
পোস্টকার্ড— পোস্টোকার্ড— পত্তর
পুলি রাজনীতি করতে গিয়ে বার বার গ্রেপ্তার হন। মিসা, পি ডি, পি টি অ্যাক্ট খাটেন। সাঁতারে ফেরা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
বেলুড়ের ‘জাহাজবাড়ি’-তে বড়দিন, ফার্স্ট জানুয়ারিতে ভিড় হয়। তখন টিকেট লাগে না ‘জাহাজবাড়ি’ ঢুকতে। ভেতরে গেলে ডেকটুকুই যা আছে। বলরুম, নাচঘর, ক্যাপ্টেনের ঘর— এসব নেই। ঢাকা থেকে স্টিমারে সারা রাত জার্নি করে বুড়িগঙ্গা, কীর্তনখোলাম গঙ্গা পেরিয়ে বরিশাল পৌঁছই গরম কেটে গিয়ে সবে বর্ষা নামা ঋতুতে। বরিশাল তো নন্দী-নালারই দেশ। সুগন্ধা নেমের একটি নদী আছে সেখানে। আরও অনেক অনেক নদী। বরিশাল জীবনানন্দ দাশের। তো সেই দোতলা স্টিমারে সারেংদের হাতে বানানো কচি দিশি মুরগি, রূপচাঁদা মাছের ছালুন বা সালুন। কষা কষা, বা মাখা মাখা রসা। সারা রাত স্টিমার ভাসে জ্যোৎস্নায়, নন্দী জলে। ফেরার সময়ও তাই, একই দৃশ্যমালা।
ঢাকা থেকে বরিশাল যাত্রার কেবিনের টিকেট কেটে দিয়েছিল আমার ভাইয়ের অধিক কবি, অধ্যাপক ও ভাবুক শামীম রেজা। সাহোদর অধিক শামীম সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সঙ্গে দিয়েছিল ওর ছোট ভাইকে। এই বরিশাল যাত্রার কথা লিখব আলাদা করে।
বড়দিনে, ইংরেজি নববর্ষে বেলুড়ে— বালি-বেলুড় সীমান্তে জাহাজবাড়ি ভিড়ে ভিড়। ঠাসাঠাসি লোকজন দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়মঠ।
মনে পড়ে তখন ‘দৈনিক বসুমতী’-র দক্ষিণ শহরতলি সংবাদদাতা। উত্তর শহরতলির সংবাদদাতা উমাশঙ্কর দাস। উমাবাবু স্কুল শিক্ষক। গালে চাপ দাড়ি। প্যান্ট-শার্ট। আমি টো কিছুই না। খেপ খাটি খাল। ‘দৈনিক বসুমতী’তে এক কলমে খবরলিখলে পাঁচ টাকা পাই। আর সুরুপা গুহ হত্যা মামলার রিপোর্ট করলে দশ টাকা। প্রশান্তদা— প্রশান্ত সরকারই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে ‘বসুমতী’-র অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের শচীনবাবু এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলেন যেন লেখকদের টাকা দিতে গিয়ে কোম্পানি— ‘দৈনিক বসুমতী পত্রিকা’— ‘বসুমতী কর্পোরেশন’ ফতুর— দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। প্রখ্যাত আইনজীবী অশোক সেনের মালিকানা থাকা ‘বসুমতী’, প্রাণতোষ ঘটকদের মালিকানায় থাকা বস্যমতী, সবার আগে শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ ধন্য উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত, সাংবাদিক হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা ‘বসুমতী’, সবটা মিলিয়ে এক দীর্ঘ ইতিহাস। হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ সম্পাদক ছিলেন ‘বসুমতী’-র— ‘দৈনিক বসুমতী’-র।
যতদূর জানি শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে। দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। অতি প্রাচীন। বাইরে থেকে বাড়িটা— ১৬৬ নম্বর বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বসুমতী সাহিত্য মন্দির-এর বাড়িটা দেখলে খানিকটা যেন মন্দিরের আদলেই আসে। পাশেই ‘বি সরকার’-এর প্রখ্যাত স্বর্ণবিপণী। রাস্তার এপারে প্রাচীন কোলে মার্কেট। সারা রাত খোলা থাকে শিয়ালদার এই পাইকারি সবজি বাজার। কেনা ব্যাচা। পরোটা, অমলেট, চা, কাছেই উল্টোদিকের ফুটপাতে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাংলা মদের দোকান। সেই ওয়াইন শপ অবশ্য চব্বিশ ঘণ্টা খোলা নয়। রাতে বন্ধ হয়ে যায়। খানিক দূরেই শিয়ালদা মেন ও সাউথ ষ্টেশন, বসুমতী অফিস থেকে বেরোলে, বাঁদিকে। তখনও শিয়ালদহ ফ্লাই ওভার হয়নি। ফুটপাতে বাজার, আঙুর দোয়ান, চাউ আর রোলের স্টল। তেলেভাজা-মুড়ি। অখণ্ড মেদিনীপুরে তৈরি মোষের শিঙের খেলনা, চিরুনি। গামছা, লুঙ্গি।
‘বসুমতী’ অফিস থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ফুটপাত ধরে হাঁটলে ‘ব্যাঙ্ক অফ ইনডিয়া’র বড় বাড়ি। বাস স্টপ। নাক বরাবর রাস্তা পেরিয়ে গেলে বৌবাজারের অতি বিখ্যাত স্বর্ণবিপণী পর পর, লাইন দিয়ে রাস্তার দুদিকে, ফুটপাতের গা ঘেঁষে। কাছেই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। হাড় কাটা গলি। দিনের বেলাতেই সস্তার বেশ্যারা দাঁড়িয়ে থাকেন ফুটপাতে, মুখে অতি খেলো সাজগোজের রূপটান। চোখে ধ্যাবড়া কাজল।
‘ব্যাঙ্ক অফ ইনডিয়া’-র উল্টোদিকে বাঁদিকের রাস্তায় শশীভূষণ দে স্ট্রিট। কেরোসিন তেলের ডিপো, কয়েকটি মিষ্টির দোকান, দিনের বেলা ফুটপাতে তরকারির ঢেড়। খানিক গেলেই শেয়ালদা।
শশীভূষণ প্রভাপদ দে স্ট্রিটে বিখ্যাত বাসনের দোকান আর বাঁদিকের ফুটপাতে ‘মাসির বাংলার ঠেক’। ‘দৈনিক বসুমতী’র নিউজ এডিটার সুধাংশুমাধব দে, রবিবাসরীয় সম্পাদক কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্পেশাল করেসপনডেন্ট তোলা রায়চৌধুরী, বিজ্ঞাপনের প্রফুল্লবাবু, চঞ্চলবাবু, সবাই মাসির নিয়মিত খদ্দের।
এই বে-আইনি মদের দোকানের পেছনেই একটি ছোট বেশ্যাপল্লী। সস্তার, খেলো বেশ্যা সব। উল্টোদিকের ফুটপাতে তেলেভাজার অস্থায়ী দোকান। আলুভাজা, ফুলুরি। ফাইল, পাঁইট, বোতল— নানা হিসাবে বাংলার বিক্রি। খাসির মাংসের দোকান যেমন হয় রাস্তার ওপর, তেমনই দোতলা অস্থায়ী, ছোট টিন-কাঠের শেড। ভেতরে ‘মাসি’ বাংলা ও অ্যালুমিনিয়ামের জলের ঘটি। তার ভেতর জল, মিশিয়ে খাওয়ার জন্য। কাচের গ্লাসও আছে। খদ্দেরদের জন্য আদা কুঁচি, খাল নুন, কাঁচা লঙ্কা। টাকনা ছাড়াবার জন্য।
ফাইলের দাম ৬-৭ টাকা। আমি ১৯৭৯-৮০ সালের কথা বলছি। মাঝে মাঝেই পুলিশ ‘রেড’ হয় সেখানে। আবার গরমকালে ধুতির কষিতে লাইসেন্সড রিভালভার— লোডেড রিভলবার নিয়ে মদ খেয়ে আসেন ভোলাদা— ভোলা রায়চৌধুরী। ‘দৈনিক বসুমতী’-র তিনি পুলিশ বিট করেন। পুলিশের ওপর মহলে খুব দহরম মহরম। দারুণ বাজার করেন, বিশেষ করে মাছ, নানা রকম মাছ। ঘন ঘন সিগারেট। পুলিশের জিপে করে মাঝে মাঝে এসে নামেন ‘মাসির’ বে-আইনি ঠেকের সামনে। ‘মাসি’ ভোলা রায়চৌধুরীকে ডাকেন ‘ভোলা বাবা’ বলে। ভোলাদার ছেলে রামকৃষ্ণ মিশন-এর স্কুলে পড়ে। শীতের দিনে ভোলাদা সাফারি স্যুট, কোনো কোনো দিন। গরমে ধুতি তো আগেই বলেছি। মিলের ধুতির ওপর টেরিকটের শার্ট, নয়ত আদ্দির পাঞ্জাবি।
মাসির দোকানে বারো মাস খরিদ্দারদের মদ সাপ্লাই দিত দত্ত। দত্তর পুরো নাম জানি না। জানতে পারিনি। ফরসা, একটু যেন জ্বলে যাওয়া তামাটে। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। মুখে সামান্য বসন্ত— স্মল পক্সের দাগ।
গ্রীষ্মদিনে লুঙ্গি, খালি গা। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জি কাঁধে। শীতে ছিটের হাফশার্ট বা হাতা গোটান ফুলশার্ট কাঁধে ফেলা।
দত্ত নাকি খুব বড় পরিবারের ছেলে। কলকাতায় তাদের অনেক বড়ি, শুনেছি। দত্ত শশীভূষণ দে স্ট্রিটে ‘মাসি’র জামাই। কবে কীভাবে দত্ত যে শশীভূষণ দে স্ট্রিটের ‘মাসির ঠেক’-এ ঠেকে গেল, জানা কঠিন। খানিকটা হলেও সবটা জানা যায় না।
দত্ত খরিদ্দারকে ‘মাল’ দেয়, ঝালনুন, কাঁচালঙ্কা, তোবড়ান অ্যালুমিনিয়ামের ঘটিতে জল। মাঝে মাঝে ‘মাসি’ দত্তকে তার চুলের মুঠি ধরে প্রচুর কিলো মারে বুকে পিঠে, সঙ্গে উদোম খিস্তি। লাগাম ছাড়া গালি। গালি।
দত্ত নাকি ‘মাল’ চুরি করে খায়। লুজমাল। তখনই শাশুড়ির হাতে ‘জামাই পেটন’, ‘জামাই পেটান’ শুরু। দত্ত খালি পা। মুখে মুখে হিসাব বলে যায়, কে ক’টাকার খেল, মানে ‘মাল’ খেল। ক্যাশ সামলায় ‘মাসি’।
এই দোকানে ধারবাকি, মাসকাবারি নয়, হপ্তা পেমেন্ট চলে। ‘দৈনিক বসুমতী’র অসাংবাদিক ও সাংবাদিকরা কেউ কেউ সাপ্তাহিক পেমেন্টের, মানে ধারে খেয়ে— ‘মাসির’ খাতায় হিসেব লিখে লোনে পান করে, তারপর পেমেন্ট দেয়। এই হিসাব-নিকাশ সব সময় যে খুব সরল, এমন তো নয়। হিসাবে জল থেকে অনেক সময়, এটা যাঁরা খান, তাঁরা বলেন। ‘মাসি’কে অবশ্য এনিয়ে কিছু বলার সাহস তাঁদের নেই।
বহু বছর হল ‘মাসি-র ঠেক’ অদৃশ্য শশীভূষণ দে স্ট্রিট থেকে। শশীভূষণ প্রভাপদ দে-র কাঁসার বাসন এক সময় ছিল খুবই নাম করা। তার বিজ্ঞাপন হত কাগজে কাগজে— দৈনিক পত্রিকায়।
১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ওপর ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের’ বাড়ি। দোতলার মাথার ছাদটি অপূর্ব। খোলামেলা। দোতলা বাড়ির ছাদের এক কোণে ফোটোগ্রাফি সেকশান। সেখানে ফোটোগ্রাফার সুধীর মল্লিক, বিনয় মুখোপাধ্যায়, সুদর্শন মুখোপাধ্যায়। সুধীর মল্লিক হয়তো বা কলকাতার মল্লিকবাড়ির কি এক লতায়-পাতায় সূত্রে আত্মীয়, হয়ত। এমনই শুনেছিলাম সুধীরদার কাছে। সুধীরদার সঙ্গে সাগরমেলা কভার করতে গেছি, সে গল্প একটু পরে।
সুধীর মল্লিকের সঙ্গে বিনয় মুখার্জির একটা চাপা টানা-পোড়েন সব সময়ই ছিল। বিনয় মুখার্জির ওপর পাটির দাঁত সামান্য উঁচু। হাঁফ শার্ট, টেরিকটের। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট। সুধীর মল্লিক ব্যাক ব্রাশ, মাথার কাঁচা-পাকা চুল নারকেল তেল দিয়ে বসান, আঁচড়ান। ক্লিন শেভেন। গরমের দিনে কলারঅলা টেরিকটের গেঞ্জি, টেরিকটের ফুলপ্যান্ট গুঁজে পরা, পায়ে শ্যু। সুদর্শন মুখোপাধ্যায়— শাবুদা, শিশুসাহিত্যিক বিশু মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো। বিশুদা তন্ত্রসাধক। বাড়িতে কালীপুজো করেন, দেবীঘট ও কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। নিয়মিত কালী পুজো করেন বিশুদা। ‘দৈনিক বসুমতী’র ছোটদের পাতা দেখেন বিশুদা, বিষ্ণু শর্মা নামে তিনি ছোটদের পাতা সম্পাদনা করেন।
বিশুদার সম্পাদনায় ‘দৈনিক বসুমতী’র ছোটদের পাতা বেরয় প্রতি বৃহস্পতিবার। সোমবার সোমবার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র ‘আনন্দমেলা’। ‘যুগান্তর’-এর ছোটদের পাততাড়ি প্রতি মঙ্গলবার। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় ছোটদের পাতা পরিচালনা করেন শিশু সাহিত্যিক হরেন ঘটক। তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে পাতা পরিচালনা করেন। সম্ভবত শনিবার শনিবার বেরয় দৈনিক ‘সত্যযুগ’-এর ছোটদের পাতা— পাঠশালা। ‘সত্যযুগ’ বহু বছর হল সান্ধ্য দৈনিক।
বিশুদার ভাই শিশুবাবা সুদর্শন মুখোপাধ্যায়ের বাবা। সুদর্শনদা বলতেন, তিনি এক সময় নকশালপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সত্যমিথ্যা জানি না। আমি যখন নিয়মিত ‘দৈনিক বসুমতী’-তে যাওয়া-আসা করি দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে, তখনই শানুদা নিয়মিত কালীপুজো করেন। গলায় রুদ্রাক্ষ, অরিজিনাল স্ফটিকের মালা। হাতে বদ গ্রহ, ফাঁড়া কাটানর আংটি। বাহুতে তাবিজ। গলায় মাদুলি। শানুদা খুব দক্ষ ফোটোগ্রাফার। শানুদা বিশু মুখোপাধ্যায়কে একটি বিশেষ সম্বোধনে ডাকতেন।
বিশুদা ছিলেন ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ সাপ্তাহিক ‘অমৃত’-র সম্পাদক ‘বিচিত্র কাহিনী’ ‘আরও বিচিত্র কাহিনী’-র লেখক তুষারকান্তি ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্রদের বন্ধু। ভবানী মুখোপাধ্যায়, এম সি সরকার প্রাইভেট লিমিটেড-এর সুপ্রিয় সরকার— ডাক নামে যিনি ‘বাচ্চুদা’ বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁর বাবা বন্ধু। তখন ‘মৌচাক’ পত্রিকাটি খুব টিমটিম করে বেরয় এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স থেকে। ‘মৌচাক’, ‘রোশনাই’, ‘রামধনু’, ‘রঙমশাল’, ‘শিশুসাথী’ ছোটদের খুব ভালো পত্রিকা তখনকার দিনে। সুপ্রিয় সরকারের বাবা ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী সুধীরচন্দ্র সরকার। শিব্রাম চক্রবর্তী সেখানে আসতেন নিয়মিত আড্ডা দিতে, আসতেন আরও অনেকে। ‘মিত্র ও ঘোষ’ আর ‘এম সি সরকার প্রাইভেট লিমিটেড’-এর আড্ডা।
রাজশেখর বসু— পরশুরাম-এর সমস্ত বই বেড়িয়েছে এম সি সরকার থেকে। ‘গড্ডলিকা’, ‘কঞ্জলি’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘পরশুরাম রচনাবলী’ও প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে। বেড়িয়েছে রাজশেখর বসুর অভিধান ‘চলন্তিকা’। শরৎ রচনাবলী বেরিয়েছিল এম সি সরকার থেকে। প্রকাশিত হয়েছে শম্ভু মিত্রর বহু গ্রন্থ। রাজশেখর বসুর ভাগ্নে দীপংকর বসু, তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় এম সি সরকার সূত্রে। গালে কলপ করা চাপ দাঁড়ি, সরু পায়ের পায়জামা, খাদির পাঞ্জাবি।
যতীন সেন— শিল্পী যতীন্দ্র সেন পরশুরামের লেখার সঙ্গে সমস্ত ছবি আঁকতেন। এম সি সরকার-এর কর্ণধার সুপ্রিয় সরকারের ছেলে শমিত সরকার। তিনিও প্র্যাত হয়েছেন কয়েক মাস হল। শমিত সরকার ছিলেন খুবই সুভদ্র জন।
বিশু মুখোপাধ্যায় সুধীরচন্দ্র সরকারের বন্ধু। তিনি দেবসাহিত্য কুটির-এর পুজো বার্ষিকীতে— ‘দেবালয়’, ‘ইন্দ্রধনু’, ‘পারিজাত’ ইত্যাদি প্রভৃতিতে নিয়মিত লেখেন রোমাঞ্চকর সত্য ঘটনা— দস্যু, জলদস্যু ইত্যাদি নিয়ে। যেমন লিখতেন বীরু চট্টোপাধ্যায়। বীরু চট্টোপাধ্যায় ‘নবকল্লোল’, ‘শুকতারা’, দেবসাহিত্য কুটিরের পূজা বার্ষিকীতে, নিয়মিত লিখতেন। এইসব রোমাঞ্চকর সত্য ঘটনা অবলম্বনে। মূলত বিদেশী পত্র-পত্রিকা তাঁর তথ্যের ভাঁড়ার। তখন তো গুগল, ইনটারনেট, ইত্যাদি প্রভৃতি স্বপ্নেরও বাইরে।
বীরু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজির আশ্রম বাড়িতে। ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে মাতৃকাশ্রম প্রণবসংঘ।
বীরু চট্টোপাধ্যায় খুবই সজ্জন। সদা হাস্যময়। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, চোখে কালো ফ্রেমের ভারী চশমা। ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি। মিলের ধুতি, সরু পাড়, আদ্দির পাঞ্জাবি। হাতা গুটানো। ঘন ঘন সিগারেট খান। এক সময় গলায় ক্যানসার হল তাঁর। অপারেশনও হল। সুস্থ হলেন। কাঁধের ঝোলাব্যাগে কাঁচের বোতলে খাওয়ার জল রাখতেন। ডাক্তার তাঁকে বলেছিলেন গলা যেন না শুকোয়। ঘন ঘন জল খাবেন।
বিশু মুখোপাধ্যায় দেব সাহিত্য কুটির-এর কোনো একটা বাঁধান, ঝকঝকে পূজা সংখ্যায় লিখেছিলেন অতি কুখ্যাত এক শ্বেতাঙ্গ দস্যুকে নিয়ে— ‘হন্তারক নরদানব’ ছিল সেই লেখার শিরোনাম।
বিশুদা ধুতি, পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর ফেলা। মাথা ভর্তি চুলে কলপ। হায়ে গা ঢাকা কালো নিউকাট, হাতে চামড়ার ভারী ব্যাগ। নিজের কাছে, পাঞ্জাবির ঝুল পকেটে— পাশ পকেটে সস্তার লেবু লজেন্স রাখতেন তিনি। ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে বিলি করতেন সেই লজেন্স। তিন নয় পয়সা দাম ছিল তার বড়জোর।
বিশু মুখোপাধ্যায় ছিলেন সাধক সুদীনকুমার মিত্রর শিষ্য। মাতৃসংঘ জনকল্যাণ আশ্রম-এর সঙ্গে এবং পূর্বতন ‘মাতৃসংঘ’র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল নিবিড়। মানবপ্রেমিক সুদীনকুমার মিত্রর ওপ্র নানা জনের লেখা একটি সংকলন ‘শক্তিশিখা’ সম্পাদনা করেছিলেন তিনি।
বিশুদা থিয়েটারও করেছেন। ‘দৈনিক বসুমতী’তে অভিনয়ের একটা চর্চা ছিল। ফি বছর বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক মঞ্চস্থ হত। সার্কুলেশনের রাসুদা— রাসবিহারীদা ছিলেন এই সব নাটকের মূল উদ্যোক্তা, পরিচালক। ধুতি, সামান্য ওপ্র দিকে তুলে পরা, পায়ে চটি। লংক্লথ বা কেমব্রিকের পুরো হাতা শার্ট হাত গুঁড়িয়ে পরা। ক্লিন শেভেন। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, মনে হবে পুরনো দিনের ভারী, কাচের গেলাসের তলাটুকু কেউ ভেঙে, খুলে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে চশমার কালো ফ্রেমে।
‘মিশরকুমারী’ ছিল রাজুদার প্রিয় নাটকদের একটি। এছাড়া ডি এল রায়ের ‘শাহজাহান’, ‘মেবার পতন’, শচীন সেনগুপ্তর ‘সিরাজউদ্দৌলা’। রাসুদা গ্রুপ থিয়েটার, ‘নবনাট্য’ আন্দোলন, আই পি টি ও কিছু বুঝতেন না বা বুঝতে চাইতেন না। তাঁর থিয়েটার ভুবনে ‘বড়বাবু’— শিশিরকুমার ভাদুড়ী, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, ভূমেন রায়, নরেশ মিত্র, অহীন্দ্র চৈধুরী, মহেন্দ্র গুপ্তম দানিবাবু। এছাড়াও অমরেন্দ্র দত্ত, বিনোদিনী দাসী, সরযূবালা, এরকম আরও অনেকে ছিলেন তাঁর রোল মডেল।
ভূমেন রায়ের কার্ভালো, শিশির ভাদুড়ীর মাইকেল, রাম— এই সব চরিত্রকথা তাঁর স্মৃতিতে, মুখে মুখে। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি সম্বোধন করতেন, বুজলে কল্যাণদাদা।
‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে যে নাটক, তাতে সমস্ত কর্মচারীরাই প্রায় অভিনয়ের সুযোগ পেতেন। সত্য বলে একটি মাথার স্ক্রু ঢিলে বেয়ারা রাসবিহারীদাকে অনেক ধরে করে একটা পার্ট— ‘কাটা সৈনিক’ গোছের পার্ট জোগাড় করতেন।
দৈনিক বসুমতীর ক্লাস ফোর স্টাফদের মধ্যে ছিলেন সত্য ছাড়াও ভীম, সমচম, দিলীপ, মনোহর, নন্দবাউল, মাওজি- মৌজি। প্রশান্ত সরকারের খাস বেয়ারা ছিলেন দীপ নারায়ণ। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় বেয়ারা মনোহর। যাঁকে কল্যাণদা ‘ফুলটুসি’, ‘সুচিত্র’, ‘ফুটবল’, ‘পোয়াতি’, ‘দশ মাস’— এমন নানা নামে ডাকতেন। মনোহরের তোঁদ বা ভুঁড়ি একটু বড়। তাই ‘ফুটবল’, ‘পোয়াতি’ ইত্যাদি।
মনোহরের বাড়ি বিহার। সমচম, দীপনারায়ণ, দিলীপ— সবই অখণ্ড বিহারের। সন্ধের পর প্রায়দিনই মনোহর শশীভূষণ দে স্ট্রিটের মাসির দোকান থেকে আনান পাঁইট এনে, খেয়ে ভারতের অর্থনীতি বিষয়ে নানা মন্তব্য করতেন, গরমের দিন হলে খালি গায়ে বড় গামছে পরে। মনোহর কল্যাণদাকে বলতেন কোল্যোনণাক্ষবাবু, প্রশান্তদাকে ‘প্রশানটোবাবু’, চিফ রিপোর্টার অজয় কানুনগোকে বলতেন, ‘অ্যাজো বাবু’, প্রলয় দামকে বলতেন ‘পেলেবাবু’।আমাকে কল্যাণদা আদর করে ‘ঝুল্লু’ বা ‘ঝোলা’ বলে ডাকতেন। আমাকে মনোহর ভাই বলতেন ‘ভোল্লর বাবু’।
সত্যর থিয়েটার করা নিয়ে পরে বলছি, তার আগে বলি, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর সম্পর্কের কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন গিরীশ নাটক করবে, উপেন কাগজ করবে। ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মতিথি পালিত হত ঘটা করে। কীর্তন, ভক্তিগিতী, বাউলগান। সঙ্গে পেটভরা ‘প্রসাদ’— খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, বোঁদে, জিলিপি। শ্রীরামকৃষ্ণ জিলিপি পছন্দ করতেন, তাই এই ব্যবস্থা।
পয়লা জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কল্পতরু’ হওয়া নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু উৎসব। সেখানেও ভিড়, চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা মিউজিয়াম, ময়দান, যেমন ভিড়ে ভিড়াক্কার, কমলালেবুর খোসা, বাদামের খালি ঠোঙা, সেদ্ধ ডিমের খোসা, চিনাবাদামের খোলা— সব মিলিয়ে কলকাতার ঘাস তো নৈনেত্তর। দৈনিক বসুমতীর দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা থাকার সময় পঁচিশে ডিসেম্বর, পয়লা জানুয়ারি আলিপুর চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ভারতীয় জাদুঘরের ভিড় ইত্যাদি খবর করতে করতে দক্ষিণেশ্বরের ‘কল্পতরু’ উৎসবে কেমন ভিড় হল, তাও খবর করতে হত। দক্ষিণেশ্বর থেকে বেলুড় মঠে যাওয়ার জন্য গঙ্গা পেরিয়ে নৌকো চেপে যাওয়ার ব্যবস্থা। নৌকোর ভাড়া মাথাপিছু দু পয়সা— তিন নয়া পয়সা। আমার বালির বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণেশ্বর। তখনও রাসমনির মন্দির তৈরি হয়নি। দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটি জঙ্গলাকীর্ণ, সেখানে প্রচুর হনুমান। তখনও দক্ষিণশ্বর যাওয়ার ব্রিজে উঠলে সাইকেল, মোটর, ট্যাক্সি, বাস— সবাইকেই অশোক স্তম্ভ মার্কা চৌকো কুপন বা টিকেট কিনতে হয়। এই ব্রিজ তখনও নামে ‘অ্যান্ডারসন ব্রিজ’। ‘বিবেকানন্দ সেতু’ নাম হয়নি তার। গঙ্গার বুকে তখন বর্ষায় শুশুক ভেসে ওঠে যখন তখন। সি প্লেন নেমে আসে অনায়াসে। সেই সেই সি-প্লেন দেখে বিস্ময় বাড়ে। দক্ষিণেশ্বরে তথাকথিত ‘বিউটিফিকেশন’ হয়নি।
বাস, লরি, ট্রাকের কুপন— দশ নয়া— ব্রিজ একবার পেরতে গেলে। সাইকেল পাঁচ নয়া পয়সা। আমরা বালির শান্তিরাম রাস্তা থেকে পয়দল দক্ষিণেশ্বর। সেখান থেকে নৌকোয় বেলুড়। তারপর বেলুড় দেখে হেঁটে হেঁটে ফেরা। এই ধরণের পদব্রজে ভ্রমণে আমার প্রিসেমশাই— গীষ্পতি ভট্টচার্য, বাবা- অমরনাথ রায়— দুজনেই খুব দড় ছিলেন। উৎসাহীও। এদিকে আমাদের তো পা ছিঁড়ে যাচ্ছে একেবারে।
আগামী পর্বে সত্যর থিয়েটার বা থ্যাটারে অভিনয় করা, ‘সিন আছে’ বলে ডিউটি না করে চুপচাপ বসে থাকা রাসুদার পরিচালনায় নাটকের রিহার্সাল দেখতে, সেই কাহিনী দিয়েই হয়ত শুরু হবে মুছে যায়। তখনকার বসুমতী দপ্তর সেই নাট্যামোদ অনেকেরই ছিল চোখে পড়ার।
নট ও পরিচালক মহেন্দ্র গুপ্তকে বাংলা ও বাঙালির থিয়েটার— পেশাদার রঙ্গালয়ের ‘লাস্ট মুঘল’ বলে অভিধা দিতেন কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
Powered by Froala Editor