মুছে যায়? - ২৫
আগের পর্বে
আমাদের বালির বাড়িতে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের আসাটা হয়ে উঠল অশান্তিকর। বাড়ির ‘বড়খোকা’ যার ক’দিন আগেই উপনয়ন হয়েছে, সে কিনা ‘খেস্টান’ হয়ে যাবে! বাবা অত্যন্ত ভদ্র ভাষাতেই কথা বলে বিদায় করছিলেন তাঁদের। সত্তর দশকের শেষে আমার ঠিকানা হয়ে ওঠে কালীঘাটে বড় মাসিমার বাড়ি। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। সেইসময় বড়দিনের পার্কস্ট্রিটকে খুব কাছ থেকে দেখা। অ্যাংলো পাড়া, ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট। পার্কস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে, ঘুরে সেসময় এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে ভিক্ষে করেছে আমাদের বন্ধু কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী। পরনে মরা সাহেবের কোট। ‘মোকাম্বো’, ‘ট্রিঙ্কাস’ গোটা পার্কস্ট্রিট জুড়ে তখন আলোর চেন, চিটির পিটির টুনি। তারপর...
কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী কবিতা লিখত। এবং গল্প। সত্তর দশকের প্রায় শেষ পর্বে আমরা ‘প্রয়াস’ বলে একটি লিটল ম্যাগাজিও বের করতাম। প্রথমে দেওয়াল পত্রিকা ‘প্রয়াস’ ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মাতৃকাশ্রম প্রণব সংঘ-র বাইরের এদেওয়ালে ঝোলান হত। মূল লেখা মানে অন্যের লেখা হস্তলিপিতে প্রকাশ করার দায়িত্ব ছিল আমার। যেহেতু শ্রীছাঁদ নাকি আমার অক্ষরের, বেশ ভালো। ফলে আমিই হাতে লেখা ‘প্রয়াস’-এর লিপিকর। ‘প্রয়াস’-এর লেখক কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী ধ্রুবদাস চক্রবর্তী, বীরুদাস চক্রবর্তী, মহাদেব মুখোপাধ্যায় এবং আমি।
কালী তখন মিঠু নামে একটি ঠোঁট মোটা মেয়ের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কবিতা-পাগল। মিঠু আর কাটু— দুই বোন থাকত ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে, যতদূর মনে পড়ে ভাড়া। মিঠুর বাবা বড় চাকরি করতেন শুনেছি, অন্তত তাঁর পোশাক-আশাক সে কথাই বলে যেত। শীতে তিউনি স্যুট পরতেন।
কালী তখন আমাদের কাছে লেখক হিসাবে হিরো। মুখে মুখে যে কোনো সময় ছড়া, কবিতা বানাতে পারে কালী।ঈশ্বর গাঙ্গুলী স্ট্রিটের ওপর তাদের সাবেক দোতলা। বাড়ির বাইরে রং নেই। কালীর বাবা খেপুবাবু। পুজো-আচ্চা করতেন। শুনেছি রাজপুরে কালীদের অনেক সম্পত্তি আছে, জমি-টিমি বাগান, সবই নাকি দেবোত্তর। কালীর মা নেই। বহু বছর হল প্রয়াত। কালীর দাদা-বৌদি আছেন। দাদা ব্যাঙ্ক চাকুরে, তাঁদের একটিই সন্তান। পুত্র।
কালী আবরে সবরে মদ্যপান করে। তখন তার মিঠুর কথা মনে পড়ে যায়। কান্নাকাটি। কালীঘাট পার্কে মদ বিক্রি হয় তখন। রাসবিহারী মোড়ে তিলকদার চশমার দোকান। ‘বাটা’-রদোকান, ‘চন্দ্রকুমার স্টোর্স’— কেউই মেট্রোর ‘কাজ’-এর জন্য তখনও স্থানান্তরে যায়নি।
আরও পড়ুন
ছোটোবেলার ‘ব-ব-জামা’— বড়দিন
তিলকদার নিজস্ব বাহিনী ছিল। মনোহর পুকুরের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর সেই বাহিনীর মারামারি মাঝে মাঝেই। তিলকদার বাহিনীতে অসিত— অসিত বসু, ক্যাবলা, কাবু— কিশোর দে, বল্টু, সান্টু, ভাইটু, পরী সহ অনেকে ছিল।
কালী বেশ কালো। খুব রোগা। সামনে একটু ঝুঁকে হাঁটে। মুখে মুখে কবিতা বানায় কালী। মান্তু আমাদের সঙ্গে মিশত। নিউ আলিপুরে গৌরী নামের একটি মেয়ের সঙ্গে ছিল তার তুমুল প্রেম। মান্তুর বাবা সম্ভবত কোনো স্মাগলিং চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বড় বড়, বাহারহীন চোখ, শার্ট-প্যান্ট, একটা মাঝারি চ্যাপ্টা ব্রিফকেস নিয়ে সব সময়যাওয়া আসা করতেন। মাঝে মাঝে পুলিশ আসত তাঁর ভাড়া বাসায়। একবার তো বাড়ির পাঁচিল টপকাতে গিয়ে লাগ দেওয়ার সময় তাঁর পা ভাঙে। মান্তুর মা নেই। ছোট ভাই শান্তু। মান্তু মোটেই লম্বা নয়। খর্বকায়ই বলা যায় তাকে। চোখে অনেক পাওয়ার সমেত চশমা। বাড়িতে মান্তুর বাবার দ্বিতীয় পক্ষ ছিল।
নিজের পশ্চাতদেশ উঁচু নয় বলে জাঙিয়া, তারপর হাফপ্যান্ট পরে তাঁরও ওপর ফুলপ্যান্ট পরত মান্তু। কখনও প্যাড ব্যবহার করত নিতম্ব উঁচু দেখানোর জন্য। মান্তু-গৌরীর প্রেম, প্রেমে বাধা, বিবাহ নিয়ে বহু কথা লেখা যায়। কিন্তু এখন বড়দিন বলতে গিয়ে সে সব নয়। সান্তু দিবারাত্র সিগারেট। ‘উইলস’, ‘ফিলটার উইলস’।
কালী একবার কি কারণে যেন মান্তুর ওপর খুব রেগে গিয়ে মুখে মুখে বানাল—
‘ও তোর চোবড়া গালে আগুন জ্বরে
চোখে লাগে ধোঁয়া
ও তোর চোবড়া গালে আগুন জ্বলে
চোখে লাগে ধোঁয়া
যা না শালা খা না গিয়ে
জয়নগরের মোয়া
ওরে মান্তু...
তোর কচি নিমপাতার মতো বুকের ছাতি
মারব তাতে দু-তিন লাথি
ওরে মান্তু— তোর... মেয়ে গেল তোর ভাই শান্তু...।’
একদম বাংলা পল্লীগীতির বসান সুর।
ব্যস, মান্তু চুপ। কারণ তখন ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট, মুখার্জি পাড়ায় অনেক ‘কেওড়া ভাই’দের মুখে মুখে কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তীর লেখা কথা ও সুর অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালী তার বাবাকে ‘খেপুদা’ বলে সম্বোধন করত অনেক সময়। নিজের পরিচত দিত ‘খেপুর ছেলে’ বলে। খেপুবাবুকে কারণে অকারণে জড়িয়ে ধরা, তাঁর ধুতির কাছা খুলে দেওয়া, নিজের বাবার সঙ্গে এইসব ‘গাড়োয়ানি ইয়ারকি’ কালী আমাদের সামনেই করত।
আরও পড়ুন
ব ব ব বড়োদিন — হাঃ – হাঃ – হা
একবার বড়দিনে কালীর বাড়ি দুপুরে আমাদের পিকনিক। সম্ভবত পার হেড দশ টাকা চাঁদা। ১৯৭৭-৭৮ সালে সেটাই অনেক। আমাদের বন্ধু বাসুর ছোট ভাই সুদেব চাকরি করত রাসবিহারী আর কালীঘাটের মাঝামাঝি চীনা লন্ড্রিতে। সেই লন্ড্রির মালক কে জানি না। কিন্তু ফ্রক, অথবা স্কার্ট পরা একজন মধ্যবয়সিনী চীনা এই লন্ড্রি সামলাতেন। বাসুর ভাই সুদেব এই দোকানে ইস্তিরি করার কাজ করত। চীনারা তাঁদের প্রিপারেশানে ব্রয়লার মুরগির মুণ্ডু, গিলে-মেটে— স্টমাক ও মেটে ব্যবহার করতেন না। সুদেব বেশ সেটা অল্প দামে কিনে আনত। তারপর ঝোল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পেঁয়াজ পাতা দিয়ে নানারকম রান্না। ঝোল হয়েছে বড় বড় করে আলু দিয়ে, এছাড়াও কষা কষা। সঙ্গে ভাত। কালীদের বাড়িতেই রান্না। আমরা সবাই মিলে। কাঈর বাবা খেপুবাবু অবশ্য মুরগি-রামপাখি, কোঁকরকোঁ যাই বলা যাক না তাকে, খান না।
কলকাতায় চীনাদের তখন অনেক লন্ড্রি, দাঁত তোলা ও বাঁধানর দোকান, সেই সঙ্গে চীনাদের জুতোর দোকান ভর্তি চীনাবাজারে। অবশ্য সেই সব চীনা জুতোর দোকানের জুতো কতটা টেকসই আর মজবুত, তা নিয়ে বহু সংশয়। এর স্থায়িত্ব— আয়ু নিয়েও নানা মত। আর এই জুতো কেনার আগে চলে প্রবল দরাদরি।
রাসবিহারী ও কালীঘাটের মধ্যে রাস্তার ওপ্র দোকানটির নাম ছিল— ওয়াং সি কী ?
এদের আর একটি ব্রাঞ্চও ছিল। খুব রোগা, মলিন মুখের এক নারীও চাকরি করতেন এই লন্ড্রিতে। সেই লন্ড্রি বহু বছর হল নেই। তার জায়গায় অন্য দোকান, কল, বেসিন, হ্যান্ড শাওয়ার, শাওয়ার, ইত্যাদির। পাশেই গাঙ্গুলি ইলেকট্রিক।
সুদেবই চীনাদের কাছ থেকে শুয়োরের মাংস নিয়ে এসে তরিবত রান্না করে। সেও কালীদের ছাদে। লাল লাল, তেলাল মাংস, চর্বি সমন্বিত। মুখে দিলেই গলে যায় একেবারে। আহা, কি সোয়াদ, কি সোয়াদ, তুলতুলে নরম মাংসের হাড্ডি গোলাল গোল গোল। কিন্তু মাংস, চর্বি— আ-হা-হা। মুখে দিলেই গলে যায় চর্বি জড়ান মাংস।
শুয়োরের ঝোল মেখে ভাত, অপূর্ব।
আরও পড়ুন
পোস্টকার্ড— পোস্টোকার্ড— পত্তর
এসব তো গেল আমাদের খুচরো, পিকনিক, চরুইভাতি কিংবা বন ছাড়াই বনভোজনের কথা। ষাট-সত্তরে ‘পিকনিক’ কথাটি তেমন চালু ছিল না। তার বদলে ফিস্ট। তারও আগে ছিল চড়াইভাতি বা বনভোজন। ডায়মন্ড হারবার, ফলতা, ডায়মন্ডহারবার লাইনে আছিপুর বা আচিপুর এসব ছিল ব্র্যান্ড ফিস্ট-এর জায়গা। সি ফিস্ট সেরে হাঁড়ি, ডেকচি বাজাতে বাজাতে লরি চেপে বাড়ি ফেরা। সঙ্গে কোলাহল। কথা।
বিভিন্ন ফাঁকা বাগানবাড়ি, গঙ্গার পাড় ছিল ফিস্ট বা বিকনিকের জায়গা। ফিস্ট, পিকনিক— সবই এই ডিসেম্বর বেলায়, ২৩, ২৮, ২৫ থেক শুরু পয়লা জানুয়ারি, দোসরা জানুয়ারি— চলতেই থাকে। চলতেই থাকে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় বনভোজন— চড়িভাতি বা চড়াইভাতির কথা বেশ কয়েক জায়গায় রয়েছে। বিশেষ করে ‘পথের পাঁচালী’-তে। চড়িভাতি বা চড়াইভাতিতে বাড়ির চাল-ডাল-আলু, বড়জোর ডিম একটা, যদি ডিম বাড়ি থাকে আদৌ।
সুদেবের দৌলতে চীনাদের কাছ থেকে আনান ব্রয়লারের মুণ্ডু, কলিজা-মেটে, দিল, গিলে— সব মিলিয়ে আমাদের ঘরোয়া ফিস্ট জমজমাট। তার সঙ্গে আবার শুয়োরের মাংস। একদিনে অবশ্য কখনোই দুরকম নয়। এইসব খাদ্য আলাদা আলাদা দিনের খাদ্য হিসাবে উপস্থিত। তখনকার দিনে অবশ্য দশ টাকা কম নয়। কিন্তু ফিস্টে তো বড়জোর আমরা পাঁচজন। ব্যস। তাতেই মাংস-ভাত। ওহো, দারুণ।
আরও পড়ুন
সেলিম মোরশেদের গদ্যের হারিকিরি অথবা কিছু ভ্যাবলা-প্রশ্ন
আছিপুর বা আচিপুর ডায়মন্ডহারবার লাইনে। বাস যায়। ৭৬ নম্বর বাস। সেখানে একটা চীনা মন্দির আছে। তখন আচিপুর খুব ফাঁকা। প্রতি ফিস্টেই একেবারে শেষে হাঁড়ির ভাত, মাংসের ঝোল, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, নেওয়ার লোকজন জুটে যেত। স্থানীয় মানুষ। অভাব, অভাব। এই ভাত, ডাল, মাংসের ঝোল, ইত্যাদি সবই অতিরিক্ত। সে সব তো আর বেঁধেছেঁদে বাড়িতে আনা যাবে না। ফলে লোকাল পিপল, তারাই এক্সট্রা ভাত-ডাল, মাংসের ঝোল নিয়ে বড় বড় বাসন— সব মেজে দেয়, তারপর ধোয় পরিষ্কার করে। এটাই অলিখিত শর্ত।
বড়দিনের একটু আগে— দু-একদিন আগে থেকেই পিকনিক বা ফিস্ট। সেই সঙ্গে বিপুল ভিড়ের চিড়িয়াখানা, ময়দান, পার্কস্ট্রিটের আলোর, অ্যাংলোইনডিয়ান বেশ্যা, ‘খালিকোঠি’, ‘মধুচক্র’, তার মধ্যেই আমাদের ভিক্ষে করা, পার্কস্ট্রিটে।
বাসুর ভাই সুদেব যখন শূকর মাংস আনছে, আমাদের ঘরোয়া বা ছাদ-পিকনিকের জন্য, তখন তো পর্ক, সসেজ, হ্যাম, সালামি— কিছুই বুঝি না। আচিপুর, অছিপুর বা আছিপুরে ফিস্ট করতে গেলে জানা থাকে না প্রায় ভারতীয় হয়ে যাওয়া চীনারাও এই ধরণের মন্দিরে তাঁদের নববর্ষ পালন করেন, বড় বড় ড্রাগন, অন্য অন্য চীনা দেবতা, উপদেবতাদের অবয়ব নিয়ে। সঙ্গে আতসবাজি, হাসি মশকরা, কল-কোলাহল।
ইংরেজি নববর্ষ আর বড়দিনে— মানে পঁচিশে ডিসেম্বর ইডেন গার্ডেনও জমজমাট, ভিড়ে ভিড়াক্কার, সেইসঙ্গে আউট্রাম ঘাট, গোয়ালিয়র ঘাট, গঙ্গা, সূর্যাস্ত, আলো, খুচরোঅথবা জমাট প্রেম। নৌকো নিয়ে গঙ্গা গভীরে। নৌকোর ভেতরেই শরীরী খেলা।
কলকাতায় আশির দশকের শীতেই সম্ভবত বিদ্যারও জাহাজ এসে ভিড়েছিল গঙ্গার ঘাটে। বেশ বড়সড় গ্রিক জাহাজ। খুব সম্ভব তিন তলা। তার ভেতরে ঠাসা বই। বই আর বই, নানা বিষয়ের। তখন ‘দৈনিক বসুমতী’তে নানারকম খেপ খাঁটি, প্রায় বিনাপয়সাতেই। তখনও ‘যুগান্তর’-এ চাকরি পাইনি, ফলে ‘যুগান্তর’-এর খেপও আছে। সেই পারিশ্রমের বিনিময়ে অবশ্য অর্থ পাওয়া যায়।
সেই গ্রিক জাহাজ তার পেটের ভেতর যাবতীয় বই-পুস্তক নিয়ে খিদিরপুর ডকে দাঁড়িয়ে। ধর্মতলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে খিদিরপুর ডক। সেই গ্রিক জাহাজে উঠে পড়তে পারলেই নানা ধরণের বই। আর দাম? অবিশ্বাস্য সস্তা। যাকে বলে ‘থ্রো অ্যাওয়ে প্রাইস’— জলের দর।
ভেতরে ঘরে ঘরে বই, গান, আলো।
গান বাজছে রেকর্ড প্লেয়ারে। সবই গ্রিক ভাষার গান। অথবা মিউজিক। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে একতলা দোতলা তিনতলা। বেশ লাগছে। ভেতরে গ্রিক ছেলে-মেয়েরা, মধ্যবয়সী, কমবয়েসী। রূপ ও রঙে তারা যথেষ্ট মোহন।
দূরে গঙ্গায় সূর্যের বিদায়ী বিউগিল। শেষ বেলার আলোর রেখা গঙ্গার জলে।
শীতের কমলালেবু ষাটের দশকে আট আনা, মানে পঞ্চাশ নয়া পয়সা জোড়া। তখনই তো কনকচূড় ধান, নলেন গুড় আর ক্ষীরে তৈরি জয়নগরের মোয়া, বারুইপুরে তৈরি নয়, সত্যিকারের জয় নগর। খেজুর পাটালি, পয়রা গুড়, নলেনের ঝোলা গুড়।
তখন শিউলিরা গাছ কাটেন। ভোরের— জুরেন কাটের রস। বিকালেও রস কাটেন তাঁরা, ঠিলে বাঁধেন গাছের গায়ে। খেজুর গাছের লিঙ্গভেদ আছে। পিং এবং স্ত্রী। মেয়ে গাছে রস হয়। ইংরেজির ভি কায়দায়— অক্ষর ডিজাইনে কাটা হয় গাছ। সেখানে শিউলিরা ঠিলে বা ভাঁড় অথবা হাঁড়ি বাঁধেন। সেই রসে মুখ দেয় ফিঙে পাখি। খেজুররস থেকে তাড়িও হয়। রস গাঁজিয়ে উঠলেই তাড়ি। তাতে নিশাদল, বাখর, কার্বাইড মেশালেই তাড়ি। তেলো তাড়ি বা তালের তাড়িতে নেশ হয় যথেষ্ট। কারণ তাতে কখনও কখনও মেশান হয়ে থাকে নেশার ট্যাবলেট। তবে গ্রামদেশে অনেকেই এখনও তেলো তাড়িকে ফুড হিসাবে মানেন। তালের তাড়িতে কচি কঞ্চির আগা সামান্য থেঁতো করে চুবিয়ে রাখলেই নেশা, নেশা আরও অনেক গভীর, ঘন, তীব্র।
শীতে খেজুরের রস অপূর্ব, ভোর ভোর খালি পেটে, আহা! তারপর যদি জিরেন কাঠের হয়, তো কোনো কথাই নেই। এই খেজুর রস ইত্যাদি নিয়ে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প ‘রস’। যা হিন্দিতে ‘সওদাগর’ নামেসিনেমা হয়। অমিতাভ বচ্চন, নূতন, ফরিদ জালাল ছিলেন। মাজু বিবির চরিত্রটিকরে ছিলেন নূতন। শিপ্রা ঘীষ ধর্ষণ এবং খুন কাণ্ডের পর আতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা কামদুনি গ্রামে ‘সওদাগর’-এর শুটিং হয়েছিল। কিন্তু খেজুরের রসেও স্যাকারিন ট্যাবলেট মিশিয়ে মিষ্টত্ব বাড়ানর রেওয়াজ শুরু হয়েছে বহু বছর। রসে জলের ভেজাল, তারপর তাতে স্যাকারিন বড়ি।
ষাটের দশকে শীতে চেতলার জৈনুদ্দিন বা মুখে মুখে জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেন থেকে আলিপুর চিড়িয়াখানার ক্ষুধার্ত বাঘের ডাক শোনা যায়। ৪০/১ জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে আমার পিসিমার বাড়ি, গভীর রাতে সেখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্যাঘ্র গর্জন— হুঙ্কার শুনি। সেই হালুম-হালুম ডাক ছোটবেলার বুকে কাঁপন ধরায়। তখন কালীঘাটে আমার বড় মাসিমার বাড়ির ছাদের ঘরের সিঁড়িবিহীন ছাদে বেয়ে বেয়ে উঠে পড়তে পারলে পরিষ্কার চোখে পড়ে হাওড়া ব্রিজ, টাটা সেন্টার, ভিক্টোরিয়া— ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের এক ঝলক। ষাট দশকের প্রায় শেষ লগ্নে এই দৃশ্যপটজেগে থাকে রাতে, নিবিড় ছায়াঘন চন্দ্রালোকে।
শীত পড়লেই ফিস্ট, বেড়াতে যাওয়া, কমলালেবু। ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা কোট, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, শাল, জাম্পার, কার্ডিগান, পুলওভার। কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে তখনও ভুটিয়া নারী-পুরুষ সোয়েটার সম্ভার নিয়ে বসেন না। তাঁরা হাতে বোনা সোয়েটার, মাগলার, টুপি বিক্রি করেন ধর্মতলায়। কেনার আগে দরাদরি করতে হয় প্রচুর। বারগেনিং। একটু রাফ, কখনও কখনও কুটকুটে— গা চুলকোয়, এমন পশমে তৈরি হয় এইসব শীতগার্ডের জিনিসপত্র। শীতের সার্কাসের কথা তো আগেই বলেছি। শীতের চিড়িয়াখানায় প্রায় সব জীব-জন্তুই চাঙ্গা। গ্রীষ্মদিনে আলিপুর চিড়িয়াখানায় অধিকাংশ জীবজন্তুই গরমে খুব কাহিল।
গরমকালে বেশিরভাগ প্রাণীই লুকিয়ে থাকে, নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় আবডালে। তখনও ষাটের দশকে, সাপ, সরীসৃপ— কুমির, গোসাপ, ইত্যাদি আর আমাজনের হিংস্র পিরানহার জন্য আলাদা এনক্লেভ তৈরি হয়নি। মূল চিড়িয়াখানাতেই সাপেরা। যারা শীতঘুমে চলে যায় মাস তিনেকের জন্য। গায়ে কম্বলের টুকরো চাপা দিয়ে। তখন দৈনিক খেতে দেওয়া হয় বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, হায়না, ব্ল্যাক প্যান্থার, লেপার্ড, জাগুয়ার-শেয়ালদের— মাংস, গরুর বা মহিষের। সাপেরা মূলত সপ্তাহে একদিন খাবার পেত তখন। শঙ্খচূড়ের জন্য নির্বিষ সাপ, ময়ালের জন্য আস্ত জ্যান্ত মুরগি। এছাড়াও ইঁদুর, আরশোলা, ব্যাঙ। অধীর দাস যখন চিড়িয়াখানার ডিরেক্টার, তখন তন্ন তন্ন করে দেখেছি জু, ‘দৈনিক বসুমতী’র দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে।
বাল্যকালে দেখেছি চিড়িয়াখানায় অতিকায় সাদা ভালুক, খাঁচার ভেতরে পায়চারি করছে। তাদের জন্য গরমে ফ্যান। বরফের স্ল্যাব। তখনকার অখন্ড মধ্যপ্রদেশের রেওয়ার রাজা আলিপুর চিড়িয়াখানাকে উপহার দিল সাদা বাঘ, এক জোড়া। তাদের শাবকদের নাম রাখা হল হিমাদ্রি ও নীলাদ্রি। নামকরণ করেন পশ্চিমবাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু। পদ্মজা নাইডু কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী নাইডুর কন্যা। পদ্মজার পাদুকা সংগ্রহ ছিল নাকি দেখার মটো। জোড়ায় জোড়ায়। তিনি বিবাহ করেননি।
হিমাদ্রি ও নীলাদ্রির যখন নামকরণ হয়, তার কিছুদিন আগেই ‘ফুলমালা’ নামে চিড়িয়াখানার পীষা হাতি হঠাৎই ক্ষেপে গিয়ে খুন করে তার মাহুতকে, শুঁড়ে পাকিয়ে শূন্যে তুলে আছাড় মারে জমিতে। ‘ফুলমালা’র এই খুনে হয়ে ওঠার গপ্পো তখনকার সব খবরের কাগজ বেশ রসিয়ে, গুছিয়ে পরিবেশন করে। বিশেষ করে বাংলা দৈনিকগুলি। ষাটের দশকে সত্তর দশকেও মাঝে মাঝেই স্কুল ছাত্রদের জন্য চিড়িয়াখানা ফ্রি। খবরের কাগজে তিন পাতায় বিনা টিকিটে চিড়িয়াঘর বা জু ভ্রমণ করা যাবে, চার পাঁচ লাইনের এই খবরটি থাকত। কলকাতার, বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার স্কুলেরা এই সুযোগ সহজেই নিতে পারত, কারণ বলতে গেলে তাদের অনেকেরই বাড়ির দরজায় আলিপুর চিড়িয়েখানা। কিন্তু এই খবর পড়ার পর উত্তরের— উত্তর কলকাতার স্কুলেরা ঠিক হাজির। তখন চিড়িয়াখানার ঘোরাল-ট্রান্স-টাইল গেট, যেমন হাওড়া স্টেশনে, এটা ষাটের দশকের ছবি। তখন চিড়িয়াখানায় টিকেটের দাম— পার হেড পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনা। হলুদ রঙের টিকেট।
ইডেন গার্ডেনে কাঠে তৈরি বার্জিম প্যাগোডাটি তখনও বর্তমান। সুখের কথা এখনও রয়েছে এই প্যাগোডাটি। বশ রঙচঙে। ‘নহুম’ বা ‘নাহুম’, ‘বড়ুয়া’, ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ ছাড়াও কেক বানাত দেবু বারিকের ‘বিজলী গ্রিল’। দেবুবাবুর বিজলী গ্রিল-এর কেক ছিল। ছিল কোল্ড ড্রিংক- ‘লিমকা’। কলকাতার শীতে টেস্ট ম্যাচে খেলোয়াড়দের লাঞ্চ, টি-খাবার পরিবেশ করত বিজলী গ্রিল। প্রখ্যাত আর্ট ও অ্যান্টিক সংগ্রাহক সুভো ঠাকুরের বিশেষ বন্ধু ছিলেন দেবু বারিক। দেবুবাবুর ঘড়ি সংগ্রহ ছিল দেখার। বিচিত্র ধরনের ঘড়ি, দেশ-বিদেশের। দেবু বারিক পঞ্চাশের কোনো কোনো লেখকের বিশেষ বন্ধু ছিলেন, পান-ভোজনেরও সঙ্গী ছিলেন।
সুভো ঠাকুর পার্ক স্ট্রিটের ‘ফ্লুরিজ’ বা ‘স্কাইরুমে’ বসা পছন্দ করতেন। ‘ফ্লুরিজ’-এ নানা ধরণের কেক, পেস্ট্রি। ‘স্কাইরুম’-এর খাবারটা খুব ভালো। ‘ফ্লুরিজ’, ‘স্কাইরুম’ ছাড়া ‘মোকাম্বো’, ‘ট্রিংকাস’, ‘পিটার ক্যাট’, ‘চাং হোয়া’— সব মিলিয়ে পার্ক স্ট্রিটের বড়দিন।
ধর্মতলার ‘ছোট ব্রিস্টল’, ‘সাকি’, পার্কস্ট্রিটের ‘পিটার ক্যাট’— সবই বড়দিনের মেজাজে গন্ধ মাতাল। মদ, গান, বাজনা, নাচ, নারী— সবই— কলকাতায় তখনও ‘তন্ত্রা’ বা ‘তন্ত্র’ যুগ শুরু হয়নি। ‘নিশি নিলয়’ বা ‘নিশি ঠেক’ শব্দটিও আসে তখন। ষাটের শেষে এই সব ‘নাইট ক্লাব’ নয়, রাত জগানিয়া খাদ্য ও পান সন্নিধানে অনেক নামকরা লোকাজন গাইতেন, বাজাতেন।
‘লরেল’ বেকারিরি পাউরুটি ছিল যথেষ্ট নামকরা, ফুল, হাফ, কোয়ার্টার, সলিড পাউরুটি, মাথার দিকটা পোড়া। কি স্বাদ তার, সেঁকে, মাখনেম গোলপরিচে, দুধের সর, চিনি-মাখনে। ‘স্লাইস রুট’, ‘ডাবল ব্রেড’, ‘মিল্ক ব্রেডের’ রমরমানি শুরু হয়নি তখনও।
‘লরেল’ বেকারিরি ‘বান’ বা মিষ্টি রুটির পেটের ভেতর কিশমিশ, রুটির গায়ে মোটা দানার চিনি ছড়ান, সেলোফেনে মোড়া থাকে। বান বা বান রুটির কিশমিশ ভ্যানিস হল সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায়। কিশমিশের বদলে সেদ্ধ চালকুমড়োর মিষ্টি টুকরো। এই চিনি জোবরান সেদ্ধ চালকুমড়োই পেঠা। কলকাতাতে পাওয়া যেত যথেষ্ট। কয়েক বছর হল আর দেখি না এই চিনির রসে ফোটান চালকুমড়ো। আশ্রায় খুব ভালো পেঠা পাওয়া যায়। যেমন রাজস্থানে দাল বাটি চুরমা। হরিদ্বারে রেউড়ি, গুলাবি রেউড়ি, রাবড়ি, মালাইন। কাশীর মালাই, চমচমও। পেঁড়া, বৈদ্যনাথ ধামের পেঁড়া, ইলাহাবাদের ‘গজধরের’ আইসক্রিম, ‘চাচ্চার’ জাগরের হালুয়া। ‘গজধর’ এবং ‘চাচ্চা’ দোকানের নাম। ওড়িশার খাজা, গজা, দন্তভাজা, ছানা পোড়া অতিবিখ্যাত। ‘লরেলের’ বান রুটিতে কিশমিশের বদলে চালকুমড়োর মিষ্টি মেশান শুরু হল সত্তরের গোড়ায় গোড়ায়। তখন একটা বান চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা।
বড়দিনের আগে আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারির বাম্পার ড্র, ‘ক্যাথলিন’, ‘বিজলী গ্রিল’-এর কেক ইত্যাদির বিজ্ঞাপনে জোব্বা-ঝাব্বা পরা সান্টা ক্লজ। মাথায় টুপি, ভুলুভুলে সাদা দাড়িগোঁফ।
ইলাহাবাদে দেখেছি খোসা সমেত বড় সড় বাদাম, তুলো এবং লাল কাগজ দিয়ে একমাসের আগে সান্টা ক্লজ বানাতে রেনু মাসির মেয়ে কুক্কুকে। সেই সান্টা অবশ্য বেশিদিন থাকে না, অনেক সময় তার ভেতর খোসা ফুটো করে খুদে খুদে, লাল লাল পিপড়ে ঢুলে পড়ে বাদাম-মুঙফালির ভেতর।
ইলাহাবাদে সুন্দর সুন্দর চার্চ আছে। রয়েছে বড় মসজিদও। বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের আগে ইশাই— খ্রিস্টানরা বাহারি আলো দেন চার্চে। রঙিন কাগজ বেলু আলোয় আলোয় সাজান হয় গির্জা।
ইশাই— খ্রিস্টানদের সংখ্যা শহর ইলাহাবাদ— পুরানা কাটরা, নয়া কাটরা, এলেনগঞ্জ, টেগোর টাউন, জর্জ টাউন, তুলারাম বাগ, দারাগঞ্জ, মুঠঠিগঞ্জ, মনফোটগঞ্জ, নকাশ কোনা, চওক, সিভিল লাইনস, সবোতিয়া বাগ— সব মিলিয়ে কম নয়। নকাশকোনোয় বেশি থাকেন ইসলাম ধর্মের মানুষেরা।
‘বাবা চার আনা দামের ছোট, চৌকো বড়ুয়ার টিফিন কেক বাড়িতে আনতেন, আগেই লিখেছি। সেইসঙ্গে ‘বাপুজি’ কেক পাওয়া যেত বাজারে। ‘ব্রিটানিয়া বিস্কুট’ তো ছিলই কিন্তু কেক ছিল না। ‘ব্রিটানিয়া’র কেক এসেছে অনেক পরে। ‘মনজিনিস’ বা ‘মঞ্জিনিস’-এর কেকও এল এই তো সেদিন। সঙ্গে পেস্ট্রি, প্যাটিস।
পার্কস্ট্রিটে আলো, আলো নির্মিত তারা, স্যান্টা বা সান্টা দেখতে দেখতে আমরা মোহিত হতাম। স্যান্টা, স্যান্টার উপহার সমেতমোজা। বলগাহরিণ টানা গাড়ু, স্লেজগাড়ি কী সেটা? জানি না। এসব দেখতেই পার্ক স্ট্রিটের সাহেবপাড়া বা খ্রিস্টান পাড়ায় পাড়ায় ‘বড় দিন; দেখতে যাওয়া। সেইসঙ্গে খ্রিস্মাস ট্রির মোহাচ্ছন্নতা। আমাদের একমাত্র কন্যা ছোটবেলা থেকেই এক্সমাস ট্রি, সান্টা ক্লজ দিয়ে সাজায়, এখনও বহু বাড়িতেই এরকম হয়। সেইসঙ্গে ‘জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল—‘ পরবর্তকালে যার অসামান্য প্যারোডি— ‘জিঙ্গল বেলুয়া জিঙ্গল বেলুয়া...’। এখনও দুটোই শুনি। তো সেই এক্সমাস ট্রি ছোটম বড়— সমগ্র পার্কস্ট্রিট জুড়ে।
পয়সা নেই আমাদের পকেটে, কারও। কোনোরকমে কালীঘাট থেকে পার্কস্ট্রিটে, ট্রামে কায়দা করে টিকেট না কেটে, কন্ডাকটারকে ফাঁকি দিয়ে। আমরা পার্কস্ট্রিটে আলো দেখব, খানিকটা এদিক ওদিক করে চিড়িয়াখানা। যদি আলো থাকে। কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী— যাকে ‘খেপুর ব্যাটা’, ‘খেঁচু কালী’ বলা হত, সামনে পেছনে ‘খেঁচু’ বা ‘খ্যাঁচা’ কালী, তার হাড্ডি সার চেহারার জন্য।
তখন ঘোর দুপুর, পার্কস্ট্রিটে আলো জ্বলে উঠতে তখনও অনেক অনেক দেরি। কালীর পরনে ধর্মতলার ফুটপাত থেকে কেনা মরা সাহেবের কোট, নেভি ব্লু। মরা সাহেবের প্যান্ট, প্রায় নীল। প্যান্ট পঞ্চাশ টাকা, কোট আশি টাকা। কালীর দু পায়ে তার ব্যাঙ্ক চাকুরে দাদার বাতিল শ্যু, রিজেকট করা সকস। মাথায় শোলার হ্যাট অত্যন্ত স্মার্ট লাগছে কালীকে, পারফেক্ট বড়দিনের পোশাক।
কালী হঠাৎ আআকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, ঐ যে। ওই যে। জম-জমাট পার্কস্ট্রিটে ফুর্তি করতে, আলো দেখতে আসা মানুষেরা অনেকেই দাঁড়িয়ে গেল। কালীর তর্জনী বেয়ে, তারা উঠে পড়তে চাইছে আকাশের গায়ে। এভাবে মিনিট দুই। তারপর জমে যাওয়া পাবলিক এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কিছু নয় বা ভক্কি ভেবে হাঁটতে শুরু করল। সেদিন পার্কস্ট্রিটে অনেক বাঙালি পুরুষেরই কোট, নয়তো স্যুট আচ্ছাদিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটা।
কালী তখন নিজের মাথার হ্যাট খুলে ‘কালীঘাট হাইস্কুল’ (বয়েজ) অথবা কালীঘাট ওরিয়েন্টাল একাডেমির বেংলিশ— বাংলা+ ইংলিশ ভরসা করে ভিক্ষে চাইতে শুরু করল। ভিক্ষে নয়, হেল্প।
পুয়োর, বাট ইন্টেলিজেন্ট স্টুডেন্ট। নিড ইয়োর হেল্প ফর এডুকেশন। মা ইল, ফাদার ডেড। আই এডুকেটেড। ফর মোর আই নিড হেল্প, মানি।
দাঁড়ান, হাঁটা পাবলিক কালীর টুপিতে চার আনা, আট আনা, দশ নয়া পয়সা, কুড়ি নয়া পয়সা দিতে থাকল। এক টাকা, দু টাকার নোটও। আমরা বিস্মিত, হতবাক। খানিকটা সংকুচিত।
কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বড় চাকুরে সমর রায়ের ডাঁটিয়াল মেয়ে— মিঠুর কাছে একেবারে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যাত কালী কি করে যে এমন সাহস দেখাতে থাকল, তা তো ভগাতেই জানে।
এরপর কালী যেটা করল, তা আরও অভাবনীয়।
এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে ফুটপাতে ভিক্ষা করতে করতে পৌঁছে, খুব পাতলা ছিপছিপে একজন মঙ্গোলিয়ান চেহারার খোলা চুল দীর্যাঙ্গীকে দেখে কালীর মাথায় হঠাৎ কী যে ভূত চাপল। কালী তাঁর সামনে গিয়ে বলল, ‘আই তুলিং ইউ’।
আমরা তো হতবাক। তুলিং, তুলিং মানে কী?
কালী তখন রীতিমতো বেপরোয়া। অনায়াসে বলছে, আবারও আই তুলিং ইউ।
সেই মঙ্গোলিয়ান সুন্দরী হলদেটে ফরসা। আর কি আশ্চর্য স্কার্টের বদলে তাঁর পরনে গোলাপি সিফন শাড়ি। ডান হাতে একটা কফিন কালারের কার্ডিগান ঝোলান। দুহাতের কবজিতে লেডিজ ঘড়ি ছাড়া কিচ্ছু নেই। তাও ডান হাতে।
তার দিকে তাকিয়ে থাকতেই হয়।
সেই রমণী সামান্য ভ্রুকুটি করে কালীর দিকে তাকিয়ে— চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপে বলে উঠল তুলিং! হোয়াট তুলিং?
কালী নিজের কোট মোড়া বুকে বা হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে বলল, আই তুলিং ইউ।
সেই মঙ্গোলিয়ান সৌন্দর্য আর কিচ্ছু না বলে এবার সোজা সোজা রাস্তা পেরিয়ে গেল, ট্রাফিক সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে— সোজা।
আমরা সকলেই বিস্মিত। বিমোহিত। একি স্বপ্ন না ধুস্তরিমায়া?
কালীর টুপিতে তখন কুড়ি-পঁচিশ টাকা। আমরা ঠিক করলাম এবার চিড়িয়াখানা চলে যাব। পার্কস্ট্রিট থেকে হেঁটেই যাব। আমাদের সঙ্গে মহাদেব মুখার্জি। কালীঘাটের হালদার বাড়ির দৌহিত্র বংশ। ওরা কালীঘাটের কালী মন্দিরের রেগুলার পালাদার। নিজেদের পালা তো আছেই। তা ছাড়াও ওড়া পালা কেনে, বেঁচে দেয়। তাতে মোটা টাকা আসে লাভ হিসাবে। মহাদেবের পকেটে কাঁচা টাকা মসমস করে। ঠোঁটে ফিলটার ‘উইলস’। দরাজ হাত। খরচায়, সিগারেট বিলিতে।
মহাদেব বলল ট্রামে চল, নয়ত বাসে ওঠ। তখন চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে টড়াম চলে।
আমরা ছুটে ট্রামে উঠলাম। টিকেট যদি কাটতে হয় মহাদেবই কাটবে, নয়ত ফাঁকি। আমাদের লক্ষ্য আলিপুর জু। বাঘ, সিংহ, হাতি, পাখি, চিড়িয়াখানায় তখনও অনেক অনেক পরিযায়ী পাখি আসে। চিড়িয়াখানার ঝিল ভরে থাকে হিমালয়ের পায়ের কাছ থেকে আর সাইবেরিয়ার বরফভূমি ছাড়িয়ে এখানে, তখনও অত বড় আকাঙ্খা হোটেলটা হয়নি। ‘তাজ বেঙ্গল’ নামে সেই হাইরাইজের বাধা পেরতে হয় না পরিযায়ী পাখিদের। ঘুড়ির সঙ্গে বড়শি বেঁধে পাখি শিকার অবশ্য আছে। কলকাতার বাজারে— জান বাজারেও দেখেছি শীতের বেলে-হাঁস খাদ্য হিসাবে বিক্রির জন্য, জ্যান্ত, আশির দশকেও।
শীতে কলকাতায় উড়ে আসত পিন টেইল— সূচিপুচ্ছ, নাকজ, হুইস লিং টিল। তখনও সাঁতরাগাছির ঝিলে জমে ওঠেনি মাইগ্রেটারি বার্ডদের সংসার।
আমরা চিড়িয়াখানা পৌঁছে গেলাম, দুপুর দুপুর। তারপর দীর্ঘ লাইন দিয়ে টিকেট কেটে চিড়িয়াঘরের ভেতর।
তখন চিড়িয়াখানা অন্যরকম।
পাশেই জাতীয় গ্রন্থাগার— ন্যাশনাল লাইব্রেরি।
২৫ ডিসেম্বর শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও ভিড়। আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনেও গেছি, দল বেঁধে পিকনিকে। সে অন্য গল্প।
চিড়িয়াখানায় সেদিন আমরা কোমর কষে ঘুরলাম। চিড়িয়াখানায় কয়েক বছর আগেও ‘মরুজাহাজ’ উট ছিল। কিন্তু উট থেকে অন্য প্রাণীদের ইনফেকশান ছড়ায় বলে উট রাখা বারণ হয়েছে চিড়িয়াখানায়।
চিড়িয়াখানার ভেতরে তখন রীতিমতো মেলা লেগে গেছে। ঝুমঝুমি বেলুন, সোজা-সরু বেলুন, পেপার পালপে তৈরি মুখোশ, তালপাতার বাঁশি, তালপাতার সেপাই, তালপাতা দিয়ে বোনা হ্যাট, তাতে আবার লাল বর্ডার, সেই টুপির দাম পাঁচ সিকে, দেড় টাকা বড়জোড়। আছে তুলোয় তৈরি খরগোশ, তাঁরও দাম ছ আনা, আট আনা। প্রত্যেকটি সওদায়, প্রচুর দরাদরি চলছে।
চিড়িয়েখানার ভেতরে ঢুকে পড়া পাঁচ পাবলিক জোরে জোড়ে ট্রানজিস্টার বাজিয়ে গান শুনছে— বিবিধ ভারতী।
কুমিরের জন্য শিঙ মাছ, বাঁদরের জন্য ছোলা ভেজান, হরিণদের জন্য সবুজ ঘাস, সব বিক্রি হচ্ছে দেদার। সিগারেট ধরিয়ে শিম্পাঞ্জিকে দিলে সে তো দিব্যি টান মারে। তখনও চিড়িয়াখানায় কোনো রেস্ট্রিকশান নেই, আইন আছে হয়ত, কেউ মানে না। সেই চিড়িয়াখানাতেই আবারও কালী তার নিজস্ব হিংলিশ বা বেংলিশে এডুকেটেড পার্সন ইত্যাদি বোঝাতে চাইছে চিড়িয়াখানায় জমা পাবলিককে। আর এ ভাবে ভিখিরিগিরি করতে করতে মন্দ আয় হচ্ছে না খুব, তখনই সামনা সামনি সেই ‘তুলিং’।
চাইতে চাইতে কালী সেই ‘তুলিংয়ের’ কাছেই পয়সা চেয়ে ফেলার পর কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড যাকে বলে। এবার ‘তুলিং’ কিছু বলার আগেই আমরা টুক-টাক কেটে যাচ্ছি দূরে।
বড়দিন, ইংরেজি নববর্ষে চিড়িয়াখানার ভেতরে, বাইরে অনেক পুলিশ। আমরা মনে করছি, কিছু একটা বিপদ হতেই পারে। কালী কিন্তু অকুতোভয়। মহাদেব মুখার্জি খুব গাল দিচ্ছে আমাদের। এমনিতেই মহাদেবের বাঙাল বিদ্বেষ প্রচুর। কারণ তার কাকিমা বা ঙাল। তাদের সঙ্গে শরিকানী ঝামেলা আছে।
যদিও মহাদেব আমাকে ভালোবাসে, পছন্দ করে প্রচুর, আমি বাঙাল জানা সত্ত্বেও।
কালী দিব্যি কথা বলছে ‘তুলিং’-এর সঙ্গে নিজস্ব ভাষা। তুলিংও বলছে। কয়েক মুহূর্ত। তারপর সব ঠিকঠাক। কালী কালীর দিকে ‘তুলিং’ ‘তুলিং’-এর পথে। সে দিন আমরা আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে কালীঘাটের ‘রাধু’র কাটলেট, ফিশচপ খেয়েছিলাম। কালী বলেনি তাদের কথোপকথন রহস্য।
কালী ভিক্ষের টাকায়— দানের টাকাও বলা যায় তাকে এক প্যাকেট ফিলটার ‘উইলস’ কিনেছিল। ‘কাউন্টার’ না নিয়ে আমরা কেউ কেউ গোটা সিগারেট খেয়েছিলাম, বহুদিন পর, বড়দিনের আনন্দে। পরের এপিসোডে বলব বাঙালির বড়দিন আদিখ্যেতা, নিউইয়ার্স ইভ বা সাহেবদের নববর্ষ— ১ জানুয়ারি নিয়ে কিছু কথা।
Powered by Froala Editor