মুছে যায়? – ২৩
আগের পর্বে
বছর তিরিশ পঁয়ত্রিশ আগেও সব বাঙালির মধ্যে চিঠি লেখার শুরুতে ধর্ম-বাক্য লেখার অভ্যেস ছিল। তখন চিঠি লেখা হত পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্ট অফিস থেকে আনা অশোকস্তম্ভের ছাপ লাগানো খামে। পোস্টকার্ড মুখে মুখে প্রচলিত ছিল পোস্টোকার্ড নামে। সেই পোস্টকার্ডের পিছনে থাকত মহাত্মার হাস্যমুখ, পরিবার-পরিকল্পনার প্রচার। স্বাধীন আমল তো বটেই সত্তরের দশকেও গোপন বা রাজনৈতিক চিঠি লেখার চল ছিল অদৃশ্য কালিতে। জরুরি সংবাদ প্রেরণে আজকের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া টেলিগ্রামের গুরুত্ব ষাটের দশকে ছিল অপরিসীম। চলতি নাম ছিল ‘তার’। কলকাতা ও মফস্বলে হামেশাই দেখা মিলত লাল ডাকবাক্সের। সেসবও আজ বিলুপ্তপ্রায়। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, এসএমএস। তারপর...
আমাদের বড়দিন মানে বাবা অমরনাথ রায়ের অফিস ফেরত আনা ছোটো বড়ুয়ার কেক, দাম চার আনা। ‘টিফিন কেক’ নামেই তার প্রসিদ্ধি। বড়ুয়ার বড় কেকও ছিল। চিহ্ল ‘ফিরপো’, ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ আর ‘নহুম’-এর কেকও। কিন্তু ‘গ্রেট ইস্টার্ট’, ফিরপো’, বা ‘নহুম’-এর কেকের নামও জানতাম না। অভাবের সংসার আমাদের। সৎ, রেল চাকুরে বাবার একার রোজগারে ডাইনে আনতে বাঁয়ে না কুলনোই স্বাভাবিক। কম টাকায় সংসার প্রতিপালন, জমি কিনে বাড়ি করা, ছেলেদের লেখাপড়া শেখান, ক্লাস প্রোমোশনের পর হাফ দামে ময়লাটে, কোঁচকান, পুরনো বই কিনে দেওয়া নয়, ঝকঝকে নতুন বই, ফুলদানি কিনে তারপর তাতে যত্ন করে মলাট দিয়ে দিতেন বাবা, বড় বড় ডালের ঠোঙা, তা তো তৈরি হয় সামান্য মোটা ‘বালি কাগজে’, তার বর্ণ ঈষৎ ব্রাউনিশ— বাদামি ঘেঁষা, সেই ডাল আসত বড় বাজার থেকে। বড় বাজার— কলকাতার বড় বাজার থেকে দু দুটো চটের ব্যাগ বোঝাই মাসকাবারি বাজার— মুগ, মসুর, বিউলি, মটর ডাল, সর্ষের তেল, সাধারণ ভাবে ‘গণেশ’ মার্কা টিন, জাভার মোটা দানার চিনি, যা আসত ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে, সুপুরি, তেজপাতা, গরম মশলা, ‘মার্গো’ সাবান, ‘নিম’ টুথপেস্ট, পুজোর— মানে দুর্গাপুজোর আগে আগে পায়ের পছন্দের ‘ক্যান্থারাইডিন’ তেল। ক্যালকাটা কেমিক্যালের তৈরি ‘ক্যান্থারাইডিন’-এর বদলে কখনও কখনও ‘ভৃঙ্গরাজ’, ‘মহাভৃঙ্গরাজ’ বা ‘ভৃঙ্গল’ তেল। ‘জবাকুসুম’— সি কে সেন-এর ‘জবাকুসুম’ এনেছেন ক্বচিৎ কখনও। ‘কোলগেট’ তেল কখনও আনতে দেখিনি তাঁকে। আর পুজোর মাসে আসত ‘প্রিয়া’ বা ‘কান্তা’ সেন্ট। যতদূর মনে পড়ে ‘কান্তা’ সেন্টের সঙ্গে বীণা পয়সায় দেওয়া হত সাদা অরগেনডির ওপর হালকা ফুলছাপ লেডিজ তুমাল।
আমাদের চাল আসত রেশন থেকে। রেশনের গম ভাঙিয়ে আটা। গম পেষবার জন্য চাকি— গমকলে দিতে হয়। এক কিলো গম ভাঙানর খরচ তিন নয়া পয়সা— মানে একশো নয়া পয়সায় একটাকা— দশমিক হিসাবের তিন নয়া আসলে চৌষট্টি পয়সায় টাকার যে পুরনো হিসেব, তার দুপয়সা।
বাবা বড়বাজার থেকে মাসকাবারি মাল আনতেন যথেষ্ট ঝাড়াই-বাছাই করা সব কিছু, সেইসঙ্গে দামেও খানিকটা সতা হয়, এই হিসাব থেকে। সংসারের জন্য মাসকাবারি বাজারে চটের হাত-থলিতে চৌকো ‘সানলাইট’ সাবান, কাপড় কাচার জন্য, ঘষে ঘষে জামা-কাপড় কাচা, সেইসঙ্গে ‘শালিমার’ নারকেল তেলের ছোট কৌটো, টিনের তৈরি, তার গায়ে নারকেল গাছের ছবি, সবুজের ব্যাকগ্রাউন্ডে। সেটা ষাটের দশক— ১৯৬৪-৬৫ সাল। বাবা তাঁর চটের থলিতে বড়বাজারের দোকান থেকে আনতেন কাপড় কাচার ‘অ্যাসকো’ বার। পদ্মফুল ছাপ একটা বার সাবান আসত কাপড় কাচার জন্য। আমরা মুখে মুখে তাঁকে বার্ড সাবানও বলেছি ছোটবেলায়।
একদম শাঁখ চেহারার একটা কাপড় কাচা সাবান আনতেন বাবা বড়বাজার থেকেই। সাধারণ, ফুঁ দিয়ে বাজাবার যে শঙ্খ, তার থেকে একটু বড়, তার আয়তন। তখনও বাজারে ‘হুইল’ সাবান, ‘রিন’ সাবান আসেনি। ‘সার্ফ’ ছাড়া আর অন্য আর কোনো প্যাকেটবন্দি ডিটারজেন্ট নেই। ‘রিন’, ‘সানলাইট’, ‘টাইড’, ‘সার্ফ সুপার একসেল’ বাজারে আসতে বেশ কয়েক বছর দেরি। ‘সার্ফ’ তখনও অনেকটাই ফাইন ডিটারজেন্ট। বাজারে আসেনি ‘ইজি’। বাঙালি মধ্যবিত্ত তখনও রিঠা ফল ভেঙে, ভালো করে ফুটিয়ে, তার কষ বার করার পর সেই জল ঠান্ডা করে পশম ও রেশম কাচতে অভ্যস্ত। বাঙালি ললনারা কেউ কেউ রিঠা বা রিঠে ফল ফোটানো জল দিয়ে কেশ ধোন। আবার অনায়াসে কাপড় কাচার সোডা, গুঁড়ো সাবান, ক্ষার মাটিও ব্যবহার করেন, কেশ ধৌতিকরণে, সেইসঙ্গে কলাগাছের পেটকো— বাকল পুড়িয়ে তৈরি বাস্না বা ক্ষারে চুল ধোয়া, জামা-কাপড় কাচা— সবই হয় এক সময়ে, আজ থেকে সত্বর আশি বছর আগেও, গ্রাম বাংলায়।
প্রত্যেক হিন্দু বাঙালি বাড়িত্যেই প্রায় তখন কাপড়-গামছা, সায়া-সেমিজ, কোলবালিশ, বালিশের ওয়াড়, সোডা সাবানেও ফোটানোর রেওয়াজ ছিল। অতিরিক্ত নোংরা, ময়লা জামাকাপড়ের কালচে-ভাব তুলতেই সোডা-সাবান। লোহার কড়াইতে তো বটেই, এছাড়া এরোপ্লেন ভাঙা দিয়ে তৈরি গামলায় ক্ষার কাচার আয়োজন। জলে কাপড় কাচার সোডা দিয়ে তার সঙ্গে আবার কখনও কখনও বার সাবান কুচি কুচি করে দিয়ে তারপর উনোনে বসিয়ে ফোটান। কখনও কখনও শঙ্খ চেহারার সাবানও কুচিয়ে দেওয়া হত। এছাড়াও কালো রঙের, অনেকটা খেজুর পাটালি চেহারার একটা সাবানও পাওয়া যেত, কাপড় ধোয়ার সাবান।
আরও পড়ুন
পোস্টকার্ড— পোস্টোকার্ড— পত্তর
১৯৬৩-৬৪-৬৫তেও বহু দোকানে সের, পোয়া, ছটাকের বাটখারা, লোহার। এছাড়া পেতলের বাটখারাও পাওয়া যায়। সঙ্গে পেতলের দাঁড়িপাল্লা। লোহার দাঁড়িপাল্লা, সে তো ছিলি। এছাড়া ছিল অ্যালুমিনিয়ামের দাঁড়িপাল্লাও।
বাবা বড়বাজার থেকে দু হাতে দুটো চটের ভারি থলি বোঝাই মাসকাবারি বাজার নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া স্টেশন। তারপর ট্রেনে চেপে বেলুড় স্টেশনে নেমেই আবার কুড়ি-পঁশিচ মিনিটের পথ হেঁটে বালি শান্তিরাম রাস্তায় আমাদের বাড়িতে। তখন বেলুড় স্টেশন থেকে ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তায় আমাদের বাড়ি আসতে রিকশা ভাড়া চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা।
অমরনাথ রায় সেই পয়সাটুকু বাঁচাতেন সংসারের সুসারের জন্য। এই ব্যাপারটি নিয়ে খুব বকাবকি করতেন আমার গর্ভধারিনী গায়ত্রী রায়। কিন্তু বাবা শুনলে তো। তখন চার আনায় এক কিলো নতুন আলু। একটা আস্ত লাউ, গোটা একটা কুমড়ো পাওয়া যায় পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনায়।
আরও পড়ুন
সেলিম মোরশেদের গদ্যের হারিকিরি অথবা কিছু ভ্যাবলা-প্রশ্ন
মুদিখানা, কয়লার গোলা, কুচো কাঠের গোলা সর্বত্র তখনও পুরনো ওজন হিসাবের বাটখারা। মণ, আধমণ, দশ সের, পাঁচ সের, এক সের, সবই লোহার। তখন তো কাঁচ্চা, ছটাক, পোয়া, সের, মণের হিসেব। সোনা-রুপোর দোকানে তোলা, মাষা, কুঁচ, ভরি ইত্যাদি চলে। কুঁচ মানে কুঁচ ফল— অর্ধেক লাল, অর্ধেক কালো।
চার ছটাকে এক পোয়া, চার পোয়াতে এক সের। চল্লিশ সেরে এক মণ। একশো সেরে এক কুইন্টাল।
১৯৬৩-৬৪-৬৫-তে বাজারে পুরনো দিনের টাকা আনা-পাই-ফুটো পয়সা বাজারে চলে। দশমিক হিসাবের এক নয়া পয়সা, দু নয়া, পাঁচ নয়া, দশ নয়া, পঁচিশ নয়া— চার আনা, পঞ্চাশ নয়া— আট আনা, কাগজের এক টাকার নোট, একশো নয়া পয়সায় একটাকা।
আরও পড়ুন
‘ঈশ্বর’-এর প্রবেশ ও প্রস্থান
বাবা বড়বাজার থেকে আনতেন ‘আফগান স্নো’, ‘হিমানী’— এসবই মায়ের জন্য। ‘আফগান স্নো’-র কাঁচের শিশি, নীল রঙের। আমাদের অভাবের সংসারে এটুকু শখ-সৌখিনতা ছিলই, ‘আসোজন-বসোজনদের’ আদর-আপ্যায়ণ করেও। আর আনতেন বাবা ‘হিমালয় বুকে ট্যালকম পাউডার’, গরমের দিনের জন্য। কখনও কখনও ‘পন্ডস’ পাউডার। ‘পন্ডস’ ক্রিম তখনও বাড়িতে ঢুকে পড়েনি। ‘পন্ডস’ ও ‘নিভিয়া’ একটু পরে।
কথা শুরু হয়েছিল বড়োদিনের কেক নিয়ে। সেই কথা যে কোথায় গড়াল, ‘গ্রেট ইস্টার্ন’-এর কেক পাওয়া যেত তখন, হাফ পাউন্ড, এক পাউন্ড, দু পাউন্ড। আমাদের বালির বাড়িতে ‘বড়ুয়ার কেক’-এর পাশাপাশি ‘গ্রেট ইস্টার্ন’-এর কেক কখনও কখনও বড়োদিনে। খুবই রেয়ার ঘটনা সেটা। তখনও নিউ মার্কেট বহু বাঙালির মুখেই হগ সাহেবের বাজার। বড়োদিনে সেখানে ভিড়, অর্থবান জনেদের। বাঙালিরাও আছেন এর মধ্যে। নহুম বা নাহুমের কেকের কথা লিখেছি আগেই। নিউ মার্কেটে নহুমের দোকান।
বড়োদিনে পার্ক স্ট্রিটে আলো। মানে বড়দিন উপলক্ষে, বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই, লাল-নীল বাল্বের চেন। আলো ঝিকমিক তারা। সান্টা ক্লজ, ঝাউ গাছ— সবই পুতুল পুতুল। ছিল আলোয় তৈরি সান্টা ক্লজও। ঘোড়া নয়, হরিণ টানা রথে সান্টা, এমন ছবি দেখেছি পরে।
আরও পড়ুন
সৌমিত্র, সৌমিত্রই— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
ষাটের দশকে পার্কস্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ডাকসাইটে সব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ। খালি কোঠি। সেখানে মধুচক্র। ‘মোগাম্বো’, ‘ট্রিঙ্কাস’-এ ইংরেজি গান, গিটার। গান করেন, গিটার, ড্রাম, ম্যারাকাস, কঙ্গো-বঙ্গ বাজান অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তখন ‘বো ব্যারাক’ সেভাবে জানি না। অঞ্জন দত্তর ‘বড়াদিন’ সিনেমাটি আসতে বহু দেরি। তবে এটা জানি কলকাতা পুলিশে অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট, কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে মিটার রিডার, লাইটের কানেকশানের আগে ইন্সপেকশানে আসা বহু লোকজনই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। সংক্ষেপে তাঁদের অ্যাংলোও বলা হয়।
মনে আছে আমাদের বালির বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইন দেওয়া যাবে কিনা সেটা ইন্সপেকশানে আসা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মানুষটির মাথায় শোলার হ্যাট। সাদা হাফ শার্ট, সাদা প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস।
যে মোটর বাইকে চেপে ইন্সপেকশানে আসছেন তিনি, তার পাশে একটি ক্যারিয়ার। যেমন ‘শোলে’তে ধর্মেন্দ্র-অমিতাভ-জয়-বীরু। ‘এ-এ- দোস্তি— হম নহি তোড়েঙ্গে...’
এরকমই ক্যারিয়ার লাগান কালো মোট বাইক দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় ব্যবহার করত নাজি জার্মানির গেস্টাপো বা রেগুলার আর্মি। গামবাট, ভোঁতা, ভারি সেই বাইকে অস্ত্র আর হেলমেট সমেত দুজন সৈন্য।
এখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইন্সপেক্টরের সসঙ্গে তার অর্ডালি বা আর্দালি। সে বেচারা টাইপ লোকটির পরনে খাকি শার্ট আর ধুতি। বাঙালি, হিন্দিভাষী— সব ধরণের আর্দালিই থাকত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। তাদের হাতেই ভারি, মোটা, খাতা, কপিং পেনসিল, এমনি পেনসিল।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইন্সপেক্টরের হাতে তিন সেলের বড়ো টর্চ। মনে আছে ইলেকট্রিক মিটার কোথায় বসবে, তা দেখার জন্য।
বালিতে আমাদের ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তার ওপর যে বাড়ি, সেখানে ইনস্পেকশানে আসা সেই ইন্সপেক্টর, আমাদের জমির লাগোয়া শান্তি সমেত্তুর ডোবার ভেসে থাকা, প্যাঁক প্যাঁকান পাতি হাঁসদের দেখে বলে ওঠে, এ বাবু, এ কার হাঁস আছে?
প্রশ্নটি আমার রেলচাকুরে বাবা ধুতি-গেঞ্জির অমরনাথ রায়কে।
বাবা বললেন, ও হাঁস আমাদের নয়।
খুব মোটা মোটা হাঁস আছে। সেই ইন্সপেক্টর তখনও হংস-মোহিত। তার সামএ হয়ত চর্বিদার হাঁসের মাংস, চমৎকার মেটে, এসব আলাদা আলাদা করে ঝুলে থাকছিল।
হাঁসের মাংস সত্যি সত্যি তো চমৎকার, অনেক বেটার ব্রয়লারের থেকে। এই তো খেলাম কয়েকদিন আগে হাঁস, সে অন্য প্রসঙ্গ।
ইলেকট্রিক কানেকশান দেওয়ার সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইন্সপেক্টর শেষ পর্যন্ত সেই হাঁস আমাদের নয় শুনে খানিকটা হতাশ হয়েই ফিরেছিল তার মোটরবাইকে। তার আর মোটা মোটা হাস নিয়ে যাওয়া হয়নি।
তখন বড়দিনের সময় ঠান্ডাও বেশ। ২০ ডিসেম্বর থেকে ৪-৫ জানুয়ারি, সেই তো ঠান্ডার সিজন কলকাতায়। শীতে আলিপুর চিড়িয়াখানা, কমলালেবু, পিকনিক।
কলকাতায় পার্ক সার্কাস ময়দানে শীতের সার্কাস। ‘কমলা সার্কাস’, ‘জেমিনি সার্কাস’, ‘ওরিয়েন্ট সার্কাস’। ষাটের দশকে হাওড়া ময়দানে সার্কাসের তাঁবু। সেই আলোর ফোকাস ছড়িয়ে যায় বহু দূর পর্যন্ত, শীতের আকাশ চিরে। হাওড়া ময়দানে সার্কাস বন্ধ বহু বছর।
আমাদের বাল্যকালে রেবা রক্ষিত হাতি বুকে তুলতেন। দুপাশে কোলবালিশ তার ওপর মজবুত কাঠের তক্তা। তক্তার নিচে রেবা রক্ষিত। সার্কাসের পোষা হাতি এক পা এক পা করে এসে দাঁড়াত রেবা রক্ষিতের সামনে। তারপর খুব আস্তে আস্তে তক্তা পেরিয়ে হেঁটে চলে যেত রেবা রক্ষিতের ওপ্র ফেলা, বালিশ ভর দেওয়া তক্তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
এর অনেক বছর পর জেমিনি সার্কাস-এ হাতি গণেশ পুজো করত। এই সার্কাস কোম্পানিতে রাখা ছিল হিপোপটেমাস বা জলহস্তি।
সার্কাসে সার্কাসে তখন হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, কাকাতুয়া। বাঁদর, শিম্পাঞ্জিরা সাইকেল চালাত। কামান দাগত কাকাতুয়া। ঠোঁট দিয়ে বারুদের জায়গায় সলতে ঠেলে দিয়ে ধু-উ-ড়ু-ম করে ফাটাত কাকাতুয়া।
ব্যাটারির চাবুক হাতে থাকত রিং মাস্টার। থাকত জোকাররা। ট্রাপিজের ভয়ঙ্কর খেলা— নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, এসব খেলা দেখাত চকচকে, ছোটো পোশাক পরা ছেলেরা, মেয়েরা।
রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ নামের সিনেমায় বিষয়টি চমৎকার এসেছিল।
খুব সঠিকভাবেই সার্কাসে জীব-জন্তুরদের দিয়ে খেলা দেখানো বন্ধ হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি জীবজন্তুদের খেলা দেখান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সার্কাসের আকর্ষণই অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন অবশ্য সার্কাসে বহু আফ্রিকি ছেলে মেয়ে আর ভেঙে যাওয়া পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ— পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া ও টুকরো হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা অংশ থেকে মেয়েরা আমাদের দেশের সার্কাসে কাজ করতে চলে আসে। ছেলেরাও আসে, তবে সংখ্যায় বেশি মেয়েরাই। সার্কাসে এখনও খেলার চেয়ে শরীর প্রদর্শন বেশি।
কলকাতার বড়োদিনের সঙ্গে মিশে একসময় হাড়ে-মাসে মিশে ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা দলে দলে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেননি। তাঁদের অনেকে কলকাতা পুলিশের দীর্ঘদেহী সার্জেন্ট, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের মিটার রিডার, নয়তো ইন্সপেক্টর। কয়লা টানা রেল ইঞ্জিন— স্টিম ইঞ্জিনের ড্রাইভার, গার্ড তাঁরা। বেলচা দিয়ে কয়লা দিচ্ছেন ট্রেন ইঞ্জিনের বয়লারে, হুস হুস করে বেরচ্ছে আগুন, এতো চেনা দৃশ্য, খুব। তখনও ‘থার্টি সিকস চৌরঙ্গী লেন’— অপর্ণা সেনের প্রথম ছবিটি। যা কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবন নিয়ে তৈরি, মুক্তি পেতে বহু দেরি।
বালিতে চার্চ ছিল না। চার্চ শ্রীরামপুরে, সেই চার্চের গায়ে বড়োদিনের আলো। শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রায় এমন পুতুল সাজান হয়, কৃষ্ণকে ঘিরে, কলকাতার কয়েকটি গির্জায় তেমনই যিশু উৎসবের পুতুল সজ্জা। তবে ঝুলনে যেমন নানাবিধ দৃশ্যকল্প তৈরি হয় পাশাপাশি, পাহাড়, ঝরনা, অরণ্য, শিকার ও শিকারী, বাঘ, হাতি, সিংহ, কুকুর, ঘোড়া, সাপ, সব পাশাপাশি। যিশু উৎসব— পুতুল সাজানয় কিন্তু তেমন নয় একেবারেই। সেখানে সবই যিশুখ্রিস্ট, যোসেফ, মা-মরিয়ম, বেথহেলমের আকাশে অলৌকিক এক তারা দেখে ছুটে আসা ধর্মপ্রাণেরা, জাবপাত্র, তার আশেপাশে যে গোয়াল ঘরের পরিপার্শ্বিক, সেখানে গরু, গাধা, ভেড়া ইত্যাদি। রয়েছে অশ্বও।
এই পুতুল সজ্জায় শুধুই যিশু জীবন, ঝুলনে বা রাসের পুতুল সাজে তেমন নয় মোটেই।
আমার ছোটমাসি নমিতা ভট্টাচার্যের শ্বশুরবাড়ি শ্যামবাজার— শ্যামপুকুরের তেলিপাড়া লেন। ছোট মেসোমশাইয়ের বাবা ছিলেন নাম করা কবিরাজ, মনোরঞ্জন কাব্যতীর্থ। তাঁদের বাড়ির ঠিকানা ৩৪/বি তেলিপাড়া লেন। এর ঠিক পেছনে থাকতেন ফাদার দ্য তিয়েন। অন্য ফাদাররাও।
তাঁরা স্থানীয় বস্তিবাসীদের গুঁড়ো দুধ, ডিমের কুসুম গুঁড়ো, জামা-কাপড় সহ অন্য অন্য জিনিসপত্র দিতেন, সারা বছরই দিতেন, বড়োদিনের সময় স্পেশাল আরও কিছু। স্থানীয় গরিব মানুষেরা অহ্লাদিত হতেন তার জন্য। উপকার সাহেবকে মনে রাখতেন। ফাদার দ্য তিয়েন ছিলেন সেখানে— তেলিপাড়া লেনের ছোটোদের কাছে ‘সাহেবদাদু’।
বড়োদিনের সময় এই বাড়িতেও পুতুলে পুতুলে যিশুজীবন ফুটে উঠতে দেখেছি। চমৎকার ব্যবহার ওঁদের।
আমার মায়েরা যে জীবিত তিন বোন, শেষ পর্যন্ত ছিলেন, আজ আর কোনো বোনই জীবিত নেই। সব চেয়ে আগে প্রয়াত হয়েছেন আমার গর্ভধারিণী, গায়ত্রী রায়।
ছোটো মেসোমশাই লোকরঞ্জন ভট্টাচার্য ছোটমাসি নমিতা ভট্টাচার্যকে ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে আসতেন আমাদের বালির বাড়িতে, বড়দিনের সময়। ছোটো মেসোমশাই অসম্ভব শৌখিন। তিনি বড় চাকরি করতেন ‘আসাম সিলেমেনাইট লিমিটেড’-এ। এই কোম্পানির এমব্লেম বা লোগোতে গণ্ডার। মনে আছে কোম্পানির একটা অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি ক্যালেন্ডার তিনি উপহার দিয়েছিলেন মা-কে। আর একটা অসমিয়া চাদর। ১৯৬০-৬১ সালেও তিনি প্লেনে যাতায়াত করতেন, আসাম থেকে পশ্চিমবাংলা— মানে গুয়াহাটি বা গৌহাটি থেকে কলকাতা। ১৯৫৮-৫৯ সালে কোম্পানির রমরমা, হেড কোয়ার্টার গুয়াহাটি বা গৌহাটি।
লোকরঞ্জন ভট্টাচার্যকে দেখতে একদম যেন ধর্মেন্দ্র। আর ছোটো মাসি খানিকটা বৈজয়ন্তীমালা টাইপ, স্টাইলও। তো বড়োদিনের সময় ছোটো মাসি তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে চলে আসতেন। সঙ্গে কুমির চেহারার বড়ো কেক।
সেই কেক দেখে আমাদের বাড়ি তো উৎসব। ল্যাজ-মাথা মিলিয়ে এক হাতের থেকেও বড়ো। বিস্ময় বিস্ময় বিস্ময়। প্রায় প্রতিবছরই এই কেক— আমাদের বাড়ি।
কেকের বাংলা পিষ্টক বা পিঠা— পিঠে। মনে আছে বড়োদিনের সময় আমাদের বাড়ি পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে, নলেন গুড়ের পায়েস— মোষের দুধ দিয়ে তৈরি হত সেই পায়েস। সঙ্গে গোবিন্দভোগ চাল। এক সের দুধ এক ছটাক বা এক মুঠো চাল।
চিনি, গুড়, বাতাসা, মিছরি, সব দিয়েই পায়েস হয়। মা বাড়িতে পুডিং-দুধ-ডিম ইত্যাদি দিয়ে বানিয়ে খাইয়েছেন আমাদের ষাট দশকের শেষে। টিফিন কৌটোর ভেতর আয়োজন পুডিংয়ের। বালি দিয়ে তার ওপর কেকের মিশ্রণ বসিয়ে চেষ্টা তাঁর, খুব যে ‘ফারপো’, ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ হয়েছে এমন নয়, তবে চলে যায়।
কেক বানাতে ডিম লাগে। আর লাগে ময়দা।
বালিতে কোনো গির্জা বা চার্চ নেই। এক আধ ঘর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্তু অনেক পরে কৃষ্ণনগরের চার্চ, ব্যান্ডেলের অতি বিখ্যাত ব্যান্ডেল চার্চ, চুঁচড়ো— চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, চন্দননগর— সব জায়গাতেই চার্চের বাহার। কলকাতায় ধর্মতলার প্রায় কাছাকাছি ‘সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল’, কালীঘাটের অতি বিখ্যাত গ্রিক চার্চ - তাদের আলোকসজ্জা, ক্রিসমাস ক্যারল, ফাদার, বিশপ, আর্চ বিশপ, ব্রাদার, সিস্টার— একটু একটু করে জানতে, বুঝতে পারলাম সময় গড়ানর সঙ্গে সঙ্গে।
বড়োদিন থেকে পয়লা জানুয়ারি ষাট-সত্তর দশকে বাৎসরিক পরীক্ষা— অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। তখন আলিপুর চিড়িয়াখানা, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম— ভারতীয় জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল— সর্বত্র ভিড়। ভিড়।
তখন ক্লাস টেনে পড়ি।
সেটা ১৯৬৭-৬৮ সাল-টাল হবে।
প্রায় খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের রাস্তায় চলে যাচ্ছিলাম, স্বইচ্ছায়। শ্রীরামপুর চার্চ থেকে দুজন জেসুইট পাদ্রি— ধর্মযাজক এসে হাজির আমাদের বালির বাড়িতে। আমার বাবা-মায়ের কাছে।
আসলে ডাক যোগে বাইবেল শিক্ষা, তা থেকে সার্টিফিকেট অর্জন— সুন্দর, কায়দার শংসাপত্র। নাম টাইপ করা সার্টিফিকেটের ওপর। বিহার থেকে, শ্রীরামপুর থেকে সার্টিফিকেট আসছে, বাই পোস্ট— ডাক যোগে। সঙ্গে উপহার হিসাবে টেবল ক্যালেনন্ডার, পকেট-বাইবেল। ইশা নবি— প্রভু যিশুর সুন্দর ছবি। আরও আরও বই— জন বা যোজন লিখিত সুসমাচার, মথি লিখিত সুসমাচার, মার্ক লিখিত সুসমাচার, লুক লিখিত সুসমাচার। চমৎকার ছাপা। ছবি ভালো। খালি বাংলাটা একটু খটোমটো, মানে শ্রীরামপুর মিশনের কেরি-মার্শম্যান ঘরানার বাংলা প্রায়— অন্তত পড়ে তাই মনে হত তখন, এখনও পড়লেও হয়তো তেমনই মনে হবে। শ্রীরামপুরের মিশনারি প্রেস ঘেঁষা বাংলা, তবুও খ্রিস্ট ধর্ম নেওয়ার ব্যাপারে অদম্য উৎসাহ।
তখন বাড়ি ছিলাম না। সেই সময়েই দুজন খ্রিস্টিয় ধর্মপ্রচারক, সাইকেলে তাঁরা এসেছেন শ্রীরামপুর থেকে বালি। তাঁরা কথা বললেন আমার বাবা ও মায়ের সঙ্গে, অনেকক্ষণ। পরে আমি এই বিবরণ শুনেছি তাঁদের কাছে। মা তো ভাবলেন ছেলে এবার মাইকেল মধুসূদন দত্ত হয়ে যাবে। বাবা কিঞ্চিৎ বিরক্ত, রাগতও খানিকটা আমার ওপর। সব মিলিয়ে বেশ উত্তেজনাময় পরিবেশ।
বড়দিন নিয়ে এত এত স্মৃতি, তা কিছুতেই বলে শেষ করা যাচ্ছে না এক বারে, ফলে ‘মুছে যায়?’ –এর ২৪ নম্বর এপিসোডেও আসবে এক্স বা ক্রিসমাস। এবার এ পর্যন্তই।
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor