পোস্টকার্ড— পোস্টোকার্ড— পত্তর

মুছে যায়? – ২২
আগের পর্বে

সেলিম মোরশেদের লেখা একধরণের বিপন্নতা তৈরি করে পাঠকদের সামনে। সুবিমল মিশ্রের ভাষা দিয়ে আক্রমণ, ভাষাকে আক্রমণই কি ফুটে ওঠে সেলিম মোরশেদের লেখায়? প্রশ্ন থেকে যায়। সেলিম মোরশেদের অ্যাগ্রেসিভ ভাষা এবং বিষয় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় পাঠকের অস্তিত্বকেও। তাঁর গদ্যের মাধ্যমেই তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বাণিজ্যিক, মুনাফালোভী, মেকী প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সংস্কৃতিবানদের। আক্রমণ করেছেন রাষ্ট্রশক্তিকে। আর তাঁর কথাযাত্রা, আখ্যানসমূহ, তথ্যমালা— যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষুরধার কাচ ফলা। সেলিম মোরশেদের গদ্যযাপনের বিশ্লেষণের পর আজ শুরু হচ্ছে নতুন পর্ব...


এলাহি ভরসা
ইলাহি ভরসা
গড ইজ গুড
শ্রীশ্রী দুর্গা শরণং
শ্রী হরি শরণং
শ্রীশ্রী কালীমাতা সহায়

মুসলমান বাঙালি, খ্রিষ্টান বাঙালি, সনাতন ধর্মী— হিন্দু বাঙালিপোস্ট কার্ডে চিঠি লেখার আগে, অথবা ইনল্যান্ড লেটার, নয়তো পোস্ট অফিস থেকে কিনে আনা আশোকস্তম্ভের ছাপ সমেত এনভেলপ, যার ভেতর কাগজে লেখা চিঠি ঢুকিয়ে, গঁদ বা অন্য কোনো আঠায় মুখ বন্ধ করে, ড্রপ করা হত— ফেলে দেওয়া হত লেটার বক্সে, সব ধরণের চিঠির মাথায়, সম্বোধন, তারিখ-এসব লেখার আগে এইসব ধর্ম-বাক্য লেখা হয়, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও।

আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড চিঠির বয়ান লেখা শুরুর আগে ওঁ লিখতেন। কেন ‘ওঁ’ তা জানি না। জিজ্ঞেসও করা হয়ে ওঠেনি। 

আরও পড়ুন
সেলিম মোরশেদের গদ্যের হারিকিরি অথবা কিছু ভ্যাবলা-প্রশ্ন

আমার জন্ম ১৯৫৩ সালের ৬ নভেম্বর। আমি সব চেয়ে কম দামি পোস্টকার্ড দেখেছি তিন নয়া পয়সার। ইনল্যান্ড লেটার দশ নয়া পয়সা, এনভেলপ পনের নয়া পয়সা।

সেই পোস্টকার্ডে কখনও কোনার্কের সূর্য মন্দিরের ঘোড়া, কখনও ‘জয় জওয়ান জয় কিষাণ’, কখনও বা মহাত্মা গান্ধীর হাস্যমুখ। অফ হোয়াইট বলা যাবে না তাঁকে, খানিকটা যেন বিস্কুটের রঙ, সেটাই পোস্টকার্ড। সাধারণ মুখে-জিভে-উচ্চারণে ‘পোস্টোকার্ড’ কখনও কখনও।

আরও পড়ুন
‘ঈশ্বর’-এর প্রবেশ ও প্রস্থান

ইনল্যান্ড লেটার হালকা নীল, এনভেলপ সাদা। গত এক দেড় দশকে এস এম এসে, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেলের অসম্ভব বাড়-বাড়ন্তে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড, এনভেলপ— সবই প্রায় নির্বাসনে।

১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের আগে রানী, রাজ— কুইন ভিক্টোরিয়া, কুইন এলিজাবেথ, কিং সপ্তম এডেয়ার্ড, অষ্টম এডেয়ার্ড, পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ জর্জ এঁদের মুখছবি ছাপা পোস্ট কার্ডের ব্যবহার খুব স্বাভাবিক ভাবেই চোখে পড়েনি। কারণ ততদিনে ‘গড সেভ দ্য কিং’-এর কথাসুর বদলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে...’ এবং বঙ্কিমবাবুর ‘বন্দেমাতরম... মজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাম, শস্য শ্যামলং মাতরম...’ একটি ন্যাশনাল অ্যান্থেম, অন্যট ন্যাশনাল সং। তো সে যাক গে, ভারতের আকাশে তখন ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে তিনরঙা পতাকা— ট্রাইকালার— স্যাফরন হোয়াইট অ্যান্ড গ্রিন— গেরুয়া, সাদা আর সবুজ। সাদা ফালিটির ওপর অশোকচক্র।

আরও পড়ুন
সৌমিত্র, সৌমিত্রই— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শাসন সময়কার পোস্টকার্ড ব্যবহার করতে দেখিনি, স্বাভাবিক ভাবেই। ব্যবহার করা-লেখা পোস্টকার্ড দেখেছি। অথচ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর ব্রিটিশদের তৈরি করা মিন্ট— টাঁকশালে তৈরি হয়ে আসা চকচকে রুপোর টাকা, তামার পাই পয়সা, ফুটো পয়সা, আধলা, এক পয়সা, ডাবল দু পয়সা, আনি, দোয়ানি, চার আনি— সিকি, আধুলি, টাকা— সবই দেখেছি।

ন্যাড়া ‘রাজা’ ছাপ রূপোর টাকা, কুইন এলিজাভেথ, কুইন ভিক্টোরিয়া টাকার ওপর, ক্রাউন— মুকুট পরিহিতি কিং— রাজা সবই দেখা হয়েছে। দেখেছি। এদের ব্যবহারও দেখেছি ১৯৪৭-এর পরে বহুবছর।

আরও পড়ুন
‘লাল’ অরোরার কামান

এক পয়সায় ছুটন্ত ঘোড়া, চার আনি— সিকিতে ক্রাউন পরিহিত ইংল্যান্ডের রাজা নয়— রানীর স্বামীর মুখ, ষাট দশকে তো বটেই, সত্তর দশকে চলত এইসব সিকি, আধুলি বাজারে, মান্য বিনিময় মুদ্র হিসাবে। এমনকি মেট্রিক হিসাব, নয়া পয়সার যোগ বিয়োগ চালু হওয়ার পর। পুরনো হিসেব অনুযায়ী চৌষট্টি পয়সা বা ষোল আনায় এক টাকা। নতুন দশমিক পদ্ধতিতে একশো নয়া পয়সায় একটাকা।

দুধ বা জল, অন্য তরলের যেমন ধরুন, সর্ষের তেল, নারকেল তেল, বাদাম তেল, তিল তেল সব সের-পোয়া, ছটাকের হিসাবে। চার চহটাকে এক পোয়া, চার পোয়াতে এক সের, এমনই হিসেব। চল্লিশ সেরে এক মণ। চাল, ডাল, গম, কয়লা, কাঠ শুধুমাত্র সের, মণের হিসাবে। চাল, ডাল, গম, চিনি, গুড়, আটা, ময়দা, নুন,-- সবই ছটাক থেকে শুরু করে মণ পর্যন্ত যে হিসেব— ওজন ধারা, তাঁরই ওপর ভিত্তি করে, ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পেট্রোল গ্যালনের হিসাবে বিক্রি হত, কেরোসিন, মদ— সবই পাঁইটের হিসাব ধরে বিক্রি হয় তখন।

যাক, পুনরায় পোস্ট কার্ড প্রসঙ্গে ফিরি। আগেই লিখেছি তিন নয়া পয়সা— দু পয়সার পোস্ট কার্ডের কথা। সেই পোস্টকার্ড বাড়তে বাড়তে পাঁচ নয়া পয়সা, দশ নয়া পয়সা, পনের নয়া পয়সা, পঁচিশ নয়া পয়সা— পুরনো হিসেব, তার যোগ-বিয়োগে চার আনা। তখন পোস্ট কার্ডের উল্টো পিঠে যে ঠিকানা লেখার জায়গা সেখানে মহত্মার শেষ বয়সের হাস্যময় মুখ। পোস্ট কার্ডে পরিবার পরিকল্পনা, ‘লাল ত্রিকোণ’-এর প্রচার— ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার’— এই বলাটুকু অবশ্যই দেবনাগরী হরফে, উচ্চারণে, চোখে পড়েছে। ‘বিবিধ ভারতী’র প্রচার তরঙ্গে বিজ্ঞাপন জিঙ্গলে তখন ‘সুখ কা রাজ হ্যায় ব্যস দো বাচ্চে, সুখ কি হিশানী লাল ত্রিকোণ, লাল ত্রিকোণ’, বাজে— বাজতে থাকে। প্রচার— প্রচার— সরকারি প্রচার। সেই সময়টা ১৯৭১-৭২-৭৩। তখন হাসপাতালের দেওয়ালে, দেওয়ালে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র— হেলথ সেন্টারে হলুদ হলুদ গায়ে ‘হম দো, হামারা দো’— এই সরকারি প্রচার লিখন। স্বামী-স্ত্রী আর দুই বাচ্চা— একটি ছেলে, একটি মেয়ের— বালক ও বালিকার হাসিমুখ দিয়ে। বাংলার এই সরকারি বিজ্ঞাপন হলে তাতে লেখা থাকে— ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’।

আবার ফিরি পোস্টকার্ড অনুষঙ্গে। কলকাতায় তো বটে মফস্বল শহরেও হাঁ করা লাল রঙের ডাক বাক্স— লেটার বক্স। সেখানে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড, এনভেলপ ফেলা।

জি পি ও তে ডাক বাক্সে চিঠি ফেললে তার চলন অতি দ্রুত। আমার পিতৃদেবের প্রচুর পোস্ট কার্ড লেখার অভ্যাস ছিল। ক্বচিৎ ইনল্যান্ডও। বড় বড় অক্ষরে তিনি লিখতেন। চিঠি লিখতেন মা-ও। তো সে যাই হোক, বাবা যেহেতু রেল কর্মচারী, হাওড়া ষ্টেশন লাগোয়া রুট রিলে কেবিন-এর কেবিন এ এস এম, তার ফলে চিঠি— পোস্ট কার্ড লিখেই হাওড়া ষ্টেশনের আর এম এস এ ড্রপ করতেন। পরদিনই, যদি রবিবার না হয় পরদিনটি, চিঠি পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতার কালীঘাট, চেতলা, শ্যামবাজার, শ্যামপুকুরে। তখনও পিন কোড চালু হয়নি। কিন্তু ডাক বিভাগ সক্রিয়। কালীঘাট পোস্ট অফিস থেকে দিনে তিনবার ডাক বেরয়— মানে ডাক পিয়ন—পোস্টম্যানরা বেরন। তাঁদের সঙ্গে অর্ডিনারি চিঠি, বুক পোস্ট, রেজিস্ট্রি চিঠি, পার্সেল, মানি অর্ডার। মানি অর্ডারের আবার দুভাগ— অর্ডিনারি আর টেলিগ্রাম মানি অর্ডার— যা অতি দ্রুত পৌছয়— টি এম ও।

তখন ষাট-সত্তর দশকেও একটা আনডার সার্টিফিকেট অফ পোস্টিং বলে একটা ব্যাপার চালু ছিল। পোস্ট অফিস থেকে নির্দিষ্ট চৌকো ফর্ম নিয়ে, যাকে পাঠানো হচ্ছে তার নাম-ঠিকানা ইত্যাদি বিশদে লিখে একটা দশ নয়া পয়সার ট্রেন ছাপ স্ট্যাম্প লাগিয়ে, পোস্ট অফিস থেকে একটা সিল মারিয়ে নেওয়া। এতো রেজিস্ট্রেশন নয়, চিঠি পৌঁছন না পৌঁছন নিয়ে ভারতীয় ডাক বিভাগের কোনো দায় নেই, কারণ এ তো রেজিস্টার্ড উইথ এভি নয়, তবু মনের শান্তি— আনডার সার্টিফিকেট অফ পোস্টিংয়ে দিলাম। এটুকুই, ব্যস।

ষাটের দশকে টেলিগ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্তর, আশিতেও। হর্ষ ও কান্নার খবর আনা এই টেলিগ্রাম খুবই ‘কেজো’ ছিল একসময়। কালদিনে তা কালের নিয়মেই হয়ত বিলুপ্ত হয়ে গেল। তুলে দেওয়া হল টেলিগ্রাফ— টরেটক্কা— মর্সকোড। এস এম এস, ওয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার এরাই তো টেলিগ্রাফের, টেলিগ্রামের বিকল্প। অনেক, অনেক দ্রুত, নিশ্চিত।

বাপ্পি লাহিড়ীর বাবা গায়ক অপরেশ লাহিড়ীর  গাওয়া একটি গানের কথা মনে পড়ল টেলিগ্রাম প্রসঙ্গে। গানের কথা এরকম—

‘খবর এসেছে ঘর ভেঙেছে দারুণ ঝড়ে
তারের ভাষায়, সংকেতে, টক্কা টক্কা টরে
টক্কা টরে...’

টেলিগ্রামকে বাংলায় বলা হত তার। ভারতীয় ডাক বিভাগের নামই তো উচ্চারিত হত এক সময়— ‘ইনডিয়ান পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ’। বড় বড় রেল স্টেশনে থাকত টেলিগ্রাম করার মেশিন। তপন সিংহের পরিচালনায় ‘জতুগৃহ’-তে আর হয়ত ‘ঝিন্দের বন্দী’-তেও আছে এরকম রেল স্টেশনের— জংশন স্টেশনের ডাক অফিস— টেলিগ্রাফ অফিস।

হাওড়া, শেয়ালদা স্টেশনে তো বটেই, একটু বড় রেলওয়ে স্টেশনেই লাল রঙের হা মুখঅলা লেটার বক্স— ডাক বাক্স। তার ভেতর চিঠি। চন্দননগরে দেখেছি রাস্তার ফরাসি শামন চিহ্ন স্মৃতি, এমব্লেম সমন্বিত জলের কল। লেটার বক্স।

কলকাতার কয়েকটি রাস্তার কলে জল বেরনোর জায়গাটিতে সিংহ-মুখ, ব্রিটিশ কলোনি— ইংরেজ উপনিবেশের চিহ্ন। দক্ষিণ কলকাতার চেতলায়, এখনও পিনকোডে কলকাতা-২৭ সেখানে জৈবুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে দেখেছি সিংহ মুখ সমেত রাস্তার কল। লোহার তৈরি, বেশ ভারী, গোলাল গাছ যেমন হয়, অনেকটা তেমন। ‘বলাই স্মৃতি সংঘ’-র ক্লাব ঘরের সামনে এই টাইম কল। পরবর্তী সম্যে যার নাম হয় ট্যাগ ওয়াটার। এই কলে জল আটকানোর কোনো চাবি নেই। ফলে অবিরত ধারা, জল এলেই। এইসব কলোনি চিহ্ন আস্তে আস্তে উধাও হয়ে গেছে আমাদের সামনে থেকে। স্মৃতিতে লেগে আছে সেই সিংহমুখ কালো কলের ছবি।

এইরকমই লাল রঞের ভারী, অর্নামেন্টাল— কাজ টাজ করা লেটার বক্স ছিল কলকাতার কোনো কোনো রাস্তায়। ডালহৌসির— এখনকার বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগে দাঁড়িয়ে থাকা জি পি ও— জেনারেল পোস্ট অফিসে এরকম কাইজার-শিরশ্ত্রাণ মার্কা মুণ্ডু নিয়ে জেগেছিল কোনো একসময়ে?

ষাট, সত্তরের দশকেও পোস্ট অফিস— ডাক ঘর ডাক বিভাগের সুবর্ণ যুগ। গোল্ডেন এরা। গোল্ডেন এরা বলতে যে মাইনে-পত্তর ভালো পাওয়া যায়, এমন তো নয়। তা নিয়ে স্ট্রাইকও হয়েছে। কিন্তু ডাক বিভাগের দাপট কমেনি। কালীঘাট পোস্ট অফিস থেকে দিনে তিনবার ডাক নিয়ে আসতেন চক্রবর্তীমশাই। মাথাজোড়া টাক, তার জন্য কালো রঙের ক্যাপ, বারোমাস। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মবর্ষায় ছাতা। গায়ে পোস্ট ম্যানসের ইউনিফর্ম— খাকী রঙের ফুলপ্যান্ট আর হাফ হাতা শার্ট, মোটা কাপড়ের। চোখে চশমা। খুবই সজ্জন মানুষ। এই ধরণের ‘পোস্টম্যান’দের নিয়ে গল্পও আছে অনেক। 

সেই যে পোস্টম্যান একজন, তিনি একমাত্র পুত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর দিতে পারেননি তাঁর মাকে। এই পুত্রটি একমাত্র রোজগেরে। মানি অর্ডার করে অতি সামান্য টাকা পাঠায় মাকে।

ছেলের মৃত্যুসংবাদ, ‘তার’ ইত্যাদি সম্পূর্ণ গোপন করে সেই ডাকপিওন তাঁর নিজের মাইনে থেকে মাসান্তিক টাকা দিয়ে গেছেন অভাবী মাকে। তখনও বাজারে ‘পোস্টম্যান’ মার্কা বাদাম তেল, শর্ষের তেল আসতে বহু দেরি। 

রানার বা ডাকহরকরা পোস্টম্যানদের পূর্বসূরী। ‘রাণার’ নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের অতি বিখ্যাত কবিতা, সেই শব্দ মালায় সলিল চৌধুরী সুরারোপ ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠবৈভব মিলিয়ে এক অন্য স্বপ্ন তৈরি হয়। ‘ডাকহরকরা’ নামে বিখ্যাত গল্প আছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’ নামে গল্পটির কথা আর তা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের অতি বিখ্যাত চলচ্চিত্র, যা আছে তাঁর ‘তিনকন্যা’র মধ্যে, মনে পড়ে। ‘সমাপ্তি’, ‘মণিহারা’ এবং ‘পোস্টমাস্টার’। ‘পোস্টমাস্টার’-এর চরিত্রে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, কি অসামান্য অভিনয় তাঁর। 

চিঠি ও ডাক ইত্যাদি নিয়ে বাংলা ও হিন্দিতে বহু গান আছে। যেমন অনেক গান নির্মিত হয়েছে ভারতীয় রেলওয়ে নিয়েও।

চিঠ ও ডাক ইত্যাদি নিয়ে ‘রানার ছাড়াও আরও কয়েকটি গান—

১। ‘চিঠ্‌ঠি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়, চিঠ্‌ঠি আয়ি হ্যায়...’
২। ‘ডাকিয়া ডাক লায়া, ডাকিয়া ডাক লায়া...’
৩। ‘লিখিবু যে লিপিখানি প্রিয়তমা রে...’
৪। ‘যত লিখে যাই কথা না ফুরায় চিঠি তো হয় না শেষ’
৫। ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠ লিখো...’
৬। ‘ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড় কর...’

এরকম আরও অনেক গান আছে আরও। সব গানের কথা বলছি না। ডবল পোস্ট কার্ড— জবাবী পোস্ট কার্ড— রিপ্লাই কার্ড সহ চিঠি পাঠানো হত সুদূর গ্রামে, যাতে পোস্টকার্ড সংগ্রহে অসুবিধা না হয় কোনো। ফাঁকা একটি পোস্ট কার্ড যাচ্ছে লেখা পোস্ট কার্ডের সঙ্গে।

মাঝে হালকা নীল রঙের পোস্ট কার্ডও দেখেছি আমরা, বিস্কুট কালারের পরিবর্তে। ষাট, সত্তর, আশি, নব্বইতেও মনসা, শেতলা, সন্তোষী মা, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম প্রচারের জন্য ছাপা পোস্ট কার্ড আসত ডাক বিভাগ মারফত বাড়ির লেটার বক্সে। সেখানে ছাপা থাকত— এই পোস্ট কার্ডে যা যা ছাপা আছে, তা হুবহু ছাপিয়ে দশ খানে পোস্টকার্ডে পাঠাতে হবে বিভিন্ন বাড়িতে। এই পোস্ট কার্ডে যা ছাপা থাকত, তার মূল ব্যাপারটা হল, যদি কেউ এই পোস্টকারডের বয়ানে না ছাপিয়ে বিলি কা করেন ডাক মারফত, তাহলে তিনি মহা বিপদে পড়বেন। এমন কি এর ফলাফলে নির্বংশপতি হতে পারেন তিনি। আর পোস্ট কার্ড ছাপিয়ে ডাক মারফত্য বিলি করলে লাভ আর লাভ। ধনপ্রাপ্তি অবধারিত। গুপ্তধনও পেতে পারেন। মনে রাখতে হবে সন্তোষী মা, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, সাঁইবাবা— সবই সত্তর দসহকের দেবী ও দেব পুরুষ হিসেবে পোডাক্ট।

মোবাইল দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার পর এই হাবিজাবি উপদ্রব খানিকটা হলেও বিদেয় হয়েছে।

পোস্ট কার্ড পেতেন হিন্দুবাঙালি গৃহস্থ পুরীর পান্ডা, কাশী, বৈদ্যনাথ ও কেদার-বদ্রীর পাণ্ডার কাছ থেকে। কামরূপ-কামাখ্যা থেকেও আসত পোস্ট কার্ড। রথযাত্রা, রাসযাত্রা, শিবরাত্রি, অম্বুবাচির ব্যাপারে অর্থ চেয়ে। সামান্য ‘পুজো’ দেওয়ার টাকা দু টাকা, পাঁচ টাকা। আবার এই পোস্ট কার্ড মারফত তীর্থপাণ্ডারা কলকাতা আসবেন কবে, এই তথ্য দিয়ে চিঠি— পোস্ট আর্ড দিতেন।

পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ‘ডেড লেটার অফিস’ ছিল অতি পরিচিত একটি ডিপার্টমেন্ট। ঠিকানা হারানো চিঠিরা থাকতে সেখানে বছরের পর বছর। সেই সব ‘মৃত চিঠিদের’ জিইয়ে রাখা ডেড লেটার অফিসও বন্ধ হয়ত বা বহুদিন।

ইনল্যান্ড লেটার বা এনভেলপে চিঠি লিখতেন একটু অর্থবান মানুষেরা, সেই সঙ্গে যে যে খবর সামান্য গোপন করার, সবাইকে বলারনয়, সেই সব সংবাদ লেখা হত ইনল্যান্ড লেটার বা লিফাফা— লেফাফা— এনভেলপের গভীরে। স্বদেশী আমলে তো বটেই সত্তর দশকে বহু গপন খবর লেখাহত অদৃশ্য কালিতে। লেবুর— পাতিলেবুর রস, কাঁচা দুশ, দিয়েও লেখা হত গোপন চিঠি। আগুনের ওপর ধরলেও স্পষ্ট হত এইসব আনডারগ্রাউন্ড অক্ষর মালা।

প্রেমপত্র কখনই লেখা হত না পোস্টকার্ড। ইচ্ছে রইল প্রেমপত্র বা লাভ লেটার বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র মুছে যায় লেখার। পোস্ট কার্ডে লিখে পোস্ট অফিস— নতুন ডাকঘর তৈরির আবেদন লিখে শয়ে শয়ে পাঠিয়ে কাজ হয়েছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে চোখের সামনে।

পুজোর পর বিজয়া দশমীর বড়দের প্রণাম, ছোটদের আশীর্বাদ, সমবয়সীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট কার্ড দেওয়ার— পোস্ট কার্ড লেখার রেওয়াজ ছিল আশির দশকেও। আমার ছোটমাসি পোস্ট কার্ড লিখতেন নিয়মিত, খবরাখবরের জন্য। সৌজন্য আদান প্রদান ইত্যাদির জন্য।

পুরনো লেখা পোস্ট কার্ড হ্যারিকেন— লণ্ঠনের ফাটা কাচের চিমনিতে গুঁজে নিয়ে হ্যারিকেনের আলোকে ঠিক রাখেন অনেকে, সেই সময়টায়, ষাট সত্তর দশকে যখন গোপন রাজনৈতিক মিটিঙয়ে পুলিশ আচমকাই ঢুকে পড়তে চাইলে হ্যারিকেন উল্টো দিয়ে দুদ্দাড় করে পালাবার রীতি ছিল প্রচলিত।

মনে আছে নব্বই দশকে পোস্টকার্ডে বিজ্ঞাপন ছাপা শুরু হয়। তখনও পোস্টকার্ড বা পোস্টোকার্ড গরিবের, মধ্যবিত্তের কথাবাহন।

কলকাতা শহরের লাল রঙের লেটার বক্সগুলি বিলুপ্তপ্রায় স্মারক। কলকাতা পুরসভার কেন্দ্রীয় দপ্তর, জি পি ও, জি পি ও-র সামনে, এসপ্ল্যানেড ইস্টে কে সি দাসের ফুটপাতে যে লাল লাল ডাক বাক্সগুলি ছিল, তাঁরা এই লকডাউন, করোনা পর্ব ঠিকঠাক, আস্ত আছে তো, খুব জানতে ইচ্ছে করে।

পোস্ট কার্ড এখনও বিলুপ্ত পদাবলী।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor