সেলিম মোরশেদের গদ্যের হারিকিরি অথবা কিছু ভ্যাবলা-প্রশ্ন

মুছে যায়? – ২১

আগের পর্বে

দিয়েগো মারাদোনা। ড্রাগ, মাফিয়া, চোরা চালান, বে-আইনি অস্ত্র, সংঘর্ষ-- সেসবের মধ্যেই তাঁর উত্থান। বিশ্ববন্দিত বাঁ পায়ের জাদু। ১৯৮২-র ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার যুদ্ধ ফকল্যান্ড নিয়ে। আর তার পরেই ফুটবলের মহারণ, বিশ্বকাপ। সেখানে অপ্রতিরোধ্য মারাদোনা। মেসি, রোনাল্ডো, কাফু, বেকেনবাওয়ার, রোনাল্ডিনহো, রড শুলিট, জিদান-- কেউই নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারলেন না। কিন্তু এত ভক্ত, সমর্থকদের মধ্যেও একা, সঙ্গীহীন ছিলেন মারাদোনা। কীভাবে যেন হয়ে উঠলেন নেশাড়ু, অ্যালকোহলিক! এই পরিণতি মনে করিয়ে দেয় জীবন কত জটিল।


‘সখিচন্দ’, ‘কান্নাঘর’, ‘চিতার অবশিষ্টাংশ’, ‘বোধিদ্রুম’, ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’— এভাবে এগোতে থাকলে গলার ভেতর অনেকটা গরম কালি আর সেই সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ব্লটিং পেপার ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়ার বিপন্নতা তৈরি হয় পাঠকের সামনে। তাঁর চারটি গল্প গ্রন্থ— ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’, ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’, নির্বাচিত গল্প, ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ থেকে সাতাশটি গল্প, আর তা পাঠ করতে করতে মনে জিজ্ঞাসা— সেলিম মোরশেদের এই ‘গদ্য-হারিকিরি’-র পূর্বসূরী কে বা কারা? আদৌ কি কোনো পূর্বসূরী আছে তাঁর? আছেন?

সেই পূর্বজদের মধ্যে পড়েন কি অ্যান্টি উপন্যাসের বঙ্গীয় স্রষ্টা সুবিমল মিশ্র। যাঁর লেখায় প্রভূত অন্তর্ঘাত, সন্দেহ, অবিশ্বাস, যৌনতা— ‘সেই হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ও সোনার গান্ধীমূর্তি’, অথবা ‘নুয়েগুয়ে দুই ভাই’ থেকেই— যদিও যে দুটি শিরোনামের কথা বললাম, তারা আকার-আয়তনে গল্পই। সুবিমল অবশ্য ‘রামায়ণ চামার...’ থেকেই অ্যান্টি উপন্যাস ভাঁজছেন। তারপর তো ‘পাইপগান...’, ‘বাব্বি’ ইত্যাদি প্রভৃতি।

ভাষাকে আক্রমণ করা, ভাষা দিয়ে আক্রমণ করো, এই যে সব কথা সুবিমল মিশ্র বলতেন, তাঁরই কথারূপ কি ফুটে উঠল সেলিম মোরশেদের গদ্যে, গদ্য যাপনে। আসলে এক ধরণের গদ্য যাপন না থাকলে ‘সখিচন্দ’ বা ‘কান্নাঘর’ লেখা সম্ভব হয় না।

আরও পড়ুন
‘ঈশ্বর’-এর প্রবেশ ও প্রস্থান

‘হাসপাতালে লাইট পোস্টের ওপর একটা রাতজাগা পাখি, শীতে। কুয়াশার চাপ নিচে থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে এসেছে অনেক উঁচুতে। বরফের অজস্র কুঁচি নীরবে ভেঙে ভেঙে ঢুকছে অবিরাম বাতাসে। ঘিরে ধরেছে বিস্তৃত চারপাশ, দৃষ্টি যতোটুকু যায় কুয়াশার ধোঁয়া ডুবিয়ে দিয়েছে খণ্ডকালীন আকাশ। এবছরের ঠায় কেমন মানুষজন মরতে পারে— এইসব আলোচনা চলছে। এই সময় সখিচান ঘরে। পরেই উষ্ণ হবে। চৌদ্দ বছরের ঋতুবতী মেয়েটা দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাবার আসর শুরু করার অপেক্ষা করছিল। সখিচানের প্রধান শিষ্য গোবিন্দ গেছে মদ আনতে।’

এই গদ্য পড়তে পড়তে জিজ্ঞাসা আগে সুবিমল মিশ্র না জগদীশ গুপ্ত, অথবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস না কি শহিদুল জহীর?

আরও পড়ুন
সৌমিত্র, সৌমিত্রই— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

গানের যেমন ঘরানা থাকে, আমি এখানে গান বলতে উচ্চাঙ্গ— ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথা বলছি— আগ্রা ঘরানা, কিরানা ঘরানা, গোয়ালিয়র ঘরানা, বিষ্ণুপুর ঘরানা, জৌনপুরী ঠাঠ— এই রকম আর কি। 

সুবিমল মিশ্র সম্বন্ধে তাঁর উচ্চারণ আছে ব্যক্তিগত ইশতেহার যা সামষ্টিক ও হতে পারে’তে। তিনি বলছেন, ‘সাতশ বছরে বাংলা ভাষার ইতিহাসে সুবিমল মিশ্রের মতো এত ব্যাপক বেপরোয়া এবং গঠনমূলক ভাঙাচোরা আর কেউ করেননি।’

আরও পড়ুন
‘লাল’ অরোরার কামান

এই মন্তব্যের সঙ্গে পূর্ণ সহমত হওয়া গেল না। বাংলাভাষায় এক দল লেখক, একদল না বলে কয়েকজন বলাই ভালো, নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন বাংলা ভাষা প্রয়োগ ও তার গঠন, অন্তর্গঠন নিয়ে। তো সে যাই হোক, এই ইশতেহার পর্বে আখ্যানকার সেলিম মোরশেদ যেভাবে এগোতে থাকেন, তাঁর সেই ভাষা চলন ও ধরতাইয়ের মধ্যে হাংরি ইশতেহারের ক্ষুধার্ত ছায়াপাতও লক্ষ্য করি, বাসুদেব দাশগুপ্ত’র গদ্য প্রহার, অরুনেশ ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, ফাল্গুনী রায়, সুবোধ আচার্য। আরও আছেন কেউ কেউ। সকলের নাম দেওয়া গেল না।

ফাল্গুনী রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ বা সুবিমল বসাকের ‘ইমলিওলা’— নামটা ঠিক লিখলাম তো, কজনে পড়েছি আমরা। পুরো পড়ে, আত্মস্থ না করেই ভান করেছি অতীন্দ্রিয় পাঠিক বা অমল চন্দর গদ্য শৈলী, বিষয় নিয়ে চেষ্টা করেছি কথা কাকলি ফোটাতে?

আরও পড়ুন
ধাসা-কামান, হাত-কামান, চাবি-কামান

হাংরি সাহিত্য আন্দোলন অনেকটা যেন সত্তরের প্রায় শেষ লগ্নে শতধ বিভক্ত হয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া নকশালবাড়ি— রাজনৈতিক আন্দোলন। সবাই তখন ‘হম কিসিসে কম নেহি’। প্রত্যেকেই প্রায় সেন্ট্রাল কমিটি অথবা পলিটব্যুরো। আর কে কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সি এম— চারু মজুমদারের তার বাখানিতে ব্যস্ত। অথবা একদা চারুবাবুর অতি ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন কতটা চারুবাবু বিরোধী, তা প্রমাণে ব্যস্ত। আসলে বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না। কিন্তু পরাজিত বা আপাত পরাজিতের দিকে ছুটে আসতে থাকে অজস্র প্রশ্ন। একের পর এক।

নকশালবাড়ির আন্দোলন ও তার পরবর্তী অবস্থাতে একই চিত্র। নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহের রেশ ধরে সারা ভারতবর্ষ এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যে সশস্ত্র আন্দোলন হচ্ছিল, তা বিজয়ী হলে ইতিহাস অন্য রকম হয়ে যেত নিঃসন্দেহে।

তখন চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, অসীম চট্টোপাধ্যায়, সত্যনারায়ণ সিং, চন্দ্রপোল্লা রেড্ডিদের মধ্যে যে আপাত অন্তর্বিরোধ তা আর ফুটে উঠত না সেভাবে। কারণ আগেই লিখেছি, বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না সাধারণ ভাবে, বরং তার স্তুতি করে।

শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত সংকলন’-এর ভূমিকাতে লেখেন—

‘জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে এই শক্তিগুলি নিজেদের নারকীয় করে তুলেছিল। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ মানুষকে ধাপপা দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার তালে ছিল। ফলে ভারতীয় ভাবধারা এবং ইউরোপীয় ভাবধারা দুটোই নস্যাৎ হয়ে যায় হাংরি লেখক কবিদের কাছে। যে কজন এই আন্দোলন সৃষ্টি করেছে তারা প্রত্যেকেই পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু। কিছু দিন আগে এক প্রাক্তন হাংরি যে নিজের পিঠ বাঁচাতে ১৯৬৫ সালে আন্দোলন ছেড়ে পালায়, সে উদ্বাস্তুদের নিয়ে তামাশা করতে শুরু করে এবং পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করতে থাকে উদ্বাস্তুদের। এই প্রাক্তনটির  নাম শ্রী মলয় রায়চৌধুরী।’

এই ধরণের কথা উঠে আসে উত্তর-নকশালবাড়ি পর্বে। ১৯৭৫-এর ২৬ জুন সংসদ এড়িয়ে ভারতবর্ষের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ইমার্জেন্সি বা জরুরী অবস্থার আগে পরে, ইমার্জেন্সি পর্বেও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সি পি আই (এম-এল)-এর নেতারা এভাবেই কথা বলতে থাকেন প্রায়। ফলে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ঘটনা ও মূল্যায়নের সময় জঙ্গল সাঁওতাল ও সৌরীন বসুর লেখার মধ্যে থেকে যায় অনেক অনেক ফারাক।

শৈলেশ্বর ও মলয়ের হাংরি তুলনা প্রতিতুলনা ও তথ্যের মধ্যে থাকে বহু ফারাক ও তীক্ষ্ণতা। ব্যক্তি ঈর্ষা, ব্যক্তিগত বিরোধ, পছন্দ-অপছন্দ অনেক সময় কাজ করে গভীরভাবে।

শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত সংকলন’-এর ভূমিকায় লেখেন—

‘উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, যে উদ্বাস্তু হয়নি তার পক্ষে বোঝা কোনোদিনই সম্ভব নয়। জীবনের এই ধ্বংসযজ্ঞ মধ্যে থেকেই এসেছিল সেদিন ঐ বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, প্রদপ চৌধুরী এবং শৈলেশ্বর ঘোষ। বাল্যকালেই তারা যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থাকে তাদের রচনায়। বাংলার সুদূর গ্রামগঞ্জ থেকে এসে কলকাতায় আকস্মিকভাবে মিলিত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে তারাই হাংরি জেনারেশনকে আন্দোলনে পরিণত করবে। তাদেরই সৃষ্টি দিয়ে। এবং করেছেও তাই।’

শৈলেশ্বর ঘোষের এই ভূমিকাংশ পড়তে পড়তে মলয় রায়চৌধুরীর আখ্যান ‘নামগন্ধ’, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, কবিতা গ্রন্থ ‘মেঘার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সমর রায়চৌধুরীর ‘সিগারেটের তিরোভাব ও অন্যান্য’, ‘খুল যা সিম সিম’-এর কথা। আসলে সমীর না থাকলে মলয় হন না। সে সব অন্য প্রসঙ্গ, এখন থাক।

বিদেশে ‘আন্ডারগ্রাউনড সিনেমা’, ‘আনডারগ্রাউন্ড লিটারেচার’-এর কথা খুব শোনা যায়। আমাদের দেশেও এই ‘আনডারগ্রাউন্ড’-এর সিনেমা লিটারেচার ইত্যাদির কিছু অস্তিত্ব আছে। ‘গাণ্ডু’ নামে একটি বাংলা মুভির কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে।

‘আনডারগ্রাউন্ড সিনেমা’ ও ‘আনডারগ্রাউন্ড লিটারেচার’ তৃতীয় বিশ্বের নানান দেশে খুবই বেগবান, শক্তিশালী।

আসলে সেলিম মোরশেদের বিষয় ও গদ্য চলনে আমাদের কারও কারও পড়ার টেবিলে গোপনে ভুলেদের কুণ্ডলী পাকান শঙ্খচূড় অথবা গোখরো, যা যে কোনো সময়ে মেলে ধরতে পারে ফণা— তার কুলোপানা চক্কর। এই আকস্মিকতায় দীক্ষিত পাঠক চমকিত— সচকিত হন না। বরং আক্রমণাত্মক ভাষা ও অ্যাগ্রেসিভ বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি আক্রমণ করতে থাকেন সব কিছুকে। এমন কি অস্তিত্বকেও।

তিনি তাঁর ইশতাহারের ১১ নম্বর ধারায় লেখেন,

‘যারা নিয়মিত বাণিজ্যিক কাগজগুলোয় লেখে (অবশ্যই তাদের লেখা একটা মান স্পর্শ করে) প্রতিষ্ঠান হাতের পাঁচ হিসাবে তাঁদের লেখা নিয়ে বলে, ভালো লেখাটাই বড় কথা। আর লেখকরা বলেন, আমাদের লেখার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন যদি হুবহু ছাপে তবে আপত্তি কেন? আমারা আমাদের ব্যাপক রিডারদেরকে বঞ্চিত করব কেন? জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে গিয়ে কী পরিমাণ লেখক নিজেই লাঞ্ছিত হন, তা বলাই বাহুল্য। এই লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের মুখের দিকে তাকিয়ে লেখেন। আহসান হাবিব ছাড়া এ যাবত কোনো উপযুক্ত এবং সৎ (যদি এই টোটাল প্রক্রিয়ার কোনো সৎ ও উপযুক্ত সাহিত্য সম্পাদক হবার কথা নয়) কোনো সাহিত্য সম্পাদক নেই। যারাই সাহিত্য সম্পাদক কোনো-না-কোনোভাবে লেখালেখির জগতে তারা ব্যর্থ।

‘এদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে আপনার লেখা তখন নিন্দনীয় হয়ে উঠবে; সমসাময়িক একজন দুর্বল লেখককে দুর্দান্ত বিশ্লেষণে শিল্পী বানিয়ে এর বিভ্রান্ত রুচির জন্ম দিয়ে আপনাকে ছোট করে রাখবে। আমরা  জানি, বিগত বিশ বছরে মধ্যবিত্ত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-দর্শনে বুৎপত্তি লাভ করেছে। তার জীবন প্রক্রিয়ার ভেতর, বাস্তবতার ভেতর অনেক সপ্রতিভ অভিব্ব্যক্তি রপ্ত করেছে— এইসব করলেও শিল্প-সাহিত্যের টেস্টের ক্ষেত্রে ওই পুতু-পুতু— ধরা, বন্দি হওয়া, ঘোরে-পড়া, এমন ধরণের শিল্প কর্ম যারা পছন্দ করে, তাদের তরল রুচি বলব আমরা। কমিউনিকেটিং লেখা পাঠকরা চায়— পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ও মালিকরা এই কথা বলে আশি মিনিটে শেষ ওয়া একটি দৈনিকের সাময়িকীতে বিশ মিনিটের জন্য কমিউনিকেটিং গদ্য, কবিতা ছাপে। অনেক সময় বিনিয়োগ হিসেবে আধা-সিরিয়াস লেখা দুই-একটা ছেপে অজস্র বস্তাপচা লেখা ছাপার যৌক্তিকতা জায়েজ করে। এটা মোদ্দা কথা যে আমাদের দেশের বুর্জোয়ারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে খবরের কাগজ বের করে কেন? এক : তাদের ব্যবসা এবং কালো টাকার ঢাল হিসাবে কাগজটি ভূমিকা রাখে— দুই : এখান থেকে প্রচলিত মূল্যবোধের ওপরই সে ব্যবসা করে। সেই ক্ষোভ আপনি লেখক হিসাবে কীভাবে প্রকাশ করবেন দৈনিকের পাতায়? প্রবীণ লেখকরা বলেন, ক্ষোভ খুব ছোট জায়গায় থাকে। বাণিজ্যিক মিডিয়ার লেখকরা বলেন, শিল্পিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিরোধ কোথায়? কতোটা সুবিধাবাদী দেখুন তারা, ক্ষোভ নিয়ে সব সময় লিখতে হবে এমন কথা বলছি না। তবে ক্ষোভ শিল্পিত করে লিখতে হবে। এমন ধারা মাথায় নিয়ে তারা লিখতে বসেন। দেখুন, কারা সচেতন ভাবে অচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত লেখার ভাব করে— এঁরা।’

জীবনানন্দ দাশের চিতা ধূম সমস্ত পায়ে জড়িয়ে নিলে, তাঁর চিতা ভস্মে কপালে ত্রিপুণ্ডক একে নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে চলে যেতে চেয়েছিলেন হাংরি লেখকদের কেউ কেউ। সেটা ১৯৬৫-৬৬, তার কদিন পরেই হয়তো কলকাতা ময়দান লাগোয়া মনোহর দাস ভড়াগের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুরু হয়েছে ‘মুক্তমেলা’।

এই মেয়া পরিচালকদের মধ্যে আছেন জ্যোতির্ময় দত্ত, অসিত পাল প্রমুখ। এই মেলাকে সমর্থন করছেন শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তদের মতো পুরনো মানবেন্দ্রনাথ রায়-পন্থী র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্টরা, সাফল্য কামনা করছেন ‘মুক্তমেলা’-র। শক্তি, সুনীল, আসছেন এখানে। এই সময়টাতেই শিল্পী অসিত পাল হাসপাতালের গায়ে, ফাঁকা দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকছেন সাপ আর পদ্মফুল— প্রস্ফুটিত পদ্ম। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ের কাছাকাছি চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের নীল দেওয়ালের গায়ে কালোতে সাপ আর কমল একই সঙ্গে আঁকছেন অসিত। তখন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন।

‘মুক্তমেলা’ কে ‘সি আই এ’-র চক্রান্ত বলে ঘোষণা করেন নকশালপন্থী যুব ছাত্ররা ধু-উ-ড়ু-ম, ধু-উ-ড়ু-ম শব্দে বোমা মারলেন সেখানে। ধোঁয়া, আগুন, বিস্ফোরণ। কলকাতার আকাশে তখন চক্কর দেওয়া যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’-র বিমানে উঠলে। শুধুই কলকাতার আকাশটুকু। এই প্লেনে ওঠার জন্য কাটতে হয় টিকেট।

সেলিম মোরশেদ তাঁর ইশতাহারে লেখেন, ‘অনেক লেখক আছেন বাণিজ্যধর্মী কাগজের সাহিত্যের পাতায় লেখেন, যে লেখাগুলো সাহিত্য সম্পাদক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় সেগুলো দিয়ে নিজেরা ম্যাগাজিন বের করে তাকে লিট্ল ম্যাগাজিন বলে দাবি করেন। এরা দুধ-তামাক দুটোই খান। এরা আমাদের বন্ধু না। বরং আমাদের গতিপথ বিভ্রান্তকারী।’

কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের আবস্থাও একই প্রায়, অর্থাৎ ছবিটা এক।

সেলিম মোরশেদ মনে করেন— ‘বহুলোক মনে করেন অপেক্ষাকৃত সৎভাবে স্বদ্দল থাকাটাও বোধহয় প্রাতিষ্ঠানিক জীবন-যাপন। তাঁরা মনে করেন, না খেয়ে থাকা উস্কোখুস্কো চুল, আর অপরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট পরে সারাদিন উঞ্ছবৃত্তি আর গাঁজা-মদ-হেরোইনে আশক্ত থেকে, কোনো যূথবদ্ধ শ্রমের সাথে যুক্ত না থেকে জীবন পারাপারই বোধহয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। আমাদের কাছে এগুলোকে অনেক সময় প্রতিবাদের মতো মনে হলেও এগুলো আসলে ক্রেজ। ঠিক কোথায় আঘাত করতে হবে আমরা সেই লক্ষ্যমুখকে সনাক্ত করব ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন দিয়ে। ফলে একজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী যথেষ্ট সচেতন। শুনে রাখুন, সচেতনতাকে প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে না। আপনাকে কম বুদ্ধির লোক করতে পারাই তার লক্ষ্য। অবোধ-আজগুবি-উদ্ভট কথিত কল্পনাকে প্রতিষ্ঠান তারিফ করে তার ওপর লেবাস লাগায়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক লেখক একবার আমাদের বলেছিলেন, একজন পাগল তোমাদের চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠান বিরোধী। কেন না সে এই সমাজের সব কিছুতে উদাসীন। বোঝা যায় পাগলের উদাসীনতা লেখকটির পছন্দ। অথচ এই উদাসীনতা কোনো সচেতন লোকের কাম্য নয়। সে সমাজে বাস করলেও সামাজিক ভালো-মন্দের দায়-দায়িত্ব সে নেয় না। ফলে পাগল সামাজিকভাবে শিকার। তার কোনো বিরোধিতা নেই।’

তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী— ‘মুনাফালোভী সংস্কৃতিবানরা দীর্ঘ ধরে আমাদের হাতের আঙুরের মতো আঙুলগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে এবং আমরা সময় নির্ধারণ করতে অপারগ হয়েছি; কেন না আমাদের কবরগুলো খেয়ে নিয়েছে।’

তিনি আমাদের জানান, ‘অধিকাংশ সাহিত্যসম্পাদক মদ্যপ, নারীসঙ্গ লিপ্সু এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকে। তারা চিত্রকরের কাছ থেকে পেইনটিং উপহার নেয়— বিনিময়ে তাদের ফলাও করে লেখা ছাপে। এই পেইনটিং নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য চাকরি থেকে রিটায়ারের পর গ্যালারি করে পেইনটিংগুলো বিক্রি করবে। ভাবুন কত নির্লজ্জ তারা। আর এই ধরণের লোকের বাড়িতে লেখকদের বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়। তারপরও সাহিত্য সম্পাদকদের আওতাহীন হয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েও লেখকরা লেখেন। এরাই প্রতিষ্ঠানের পোষ মানা লেখক।’

প্রতিষ্ঠান নামের চিহ্নিত যাম ও তোরণদের অনায়াসে অস্বীকার করেন এই লেখক। তাঁর ‘সাপলুডো খেলা’ নামের উপন্যাসিকায় দেখি— সেই সঙ্গে পড়িও—

‘ঘরে ভেতর কড়ইকাঠের পার্টিশনের উত্তরপাশে তার এক চিত্রশিল্পী বন্ধুর অনুরোধে সে বেশ করেয়কটি বড়ো বড় তাক তৈরি করেছিল— সেখানে তারই ভেতর মানচিত্র ছুঁড়ে দিয়ে তার সহকারী বলল, কাল পাওয়ার হাউস থেকে সরকারি লোক এলে পিলারের বাল্ব দুটি জ্বালিয়ে দেবে। পিলারের অলৌকিক রহস্যের একটা হেস্তনেস্ত হওয়া উচিত।’

‘কাল কত তারিখ?’ কথা বলার তেমন ইচ্ছে ছিল না সলোমানের, নেহায়েত প্রয়োজনেওই সহকারীকে সে প্রশ্ন করল; তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতলতায় পূর্ণ।

‘ছাব্বিশ।’

‘দুই আর ছয়ে আট হয়’, সলোমন বলল, ‘কাল লোকেরা আলো জ্বালাতে পারবে তবে রাতেই তা নিভে যাবে।’ আট পরিকল্পনা নস্যাৎ করার সংখ্যা। এটা পরীক্ষিত।

‘পাওয়ার হাউস থেকে বরাদ্দকৃত মইটি পেতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে আবে। ‘নয়’ উগ্র হয়ে ওঠে অন্ধকারে। কাল সন্ধ্যার পর তারা পিলারে দুর্ঘটনায় পড়বে।

‘...রিলিজিয়ন উদারতার নামে রাষ্ট্রকে সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে চালানো হচ্ছে। স্টেট যেখানে রিলিজিয়নের পৃষ্ঠপোষক সেখানে সেক্যুলারিজিমের অর্থ বিকৃত করা হচ্ছে। রিলিজিয়ন বিষয়টি অন্তর্গত। স্টেটকে ভূমিকা শূন্য হতে হবে।’

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

‘আশি সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এক নাতিশীতোষ্ণ বিকেলে পশ্চিম আকাশ জুড়ে দেখা দেওয়া বেগুনি রঙ আর ডোরাকাটা বাঘের মতো তরতাজা মেঘগুলো একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল উত্তরদিকে। ইতোমধ্যে সে স্কোয়াড্রন লিভার (পাইলট কোর)-এর প্রাপ্য সম্মানের স্বত্বাধিকারী; রাশি রাশি সুখস্বপ্নে গতিশীল আর ‘কৃতকর্মই মানুষকে নির্ধারিত করে দেয় তার আপন গন্তব্য’— এই ধারণায় সতত গতির মুখোমুখি দাঁড়াত ছুরির ফলার মতো ছাব্বিশের জুবায়ের আহমেদ, কালো ঘন ভ্রু জোড়া ভ্রুর অনমনীয় চিত্তের যুবকটি তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রসমূহ নিয়ত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উন্মুল করে দিত। কথিত সংস্কারের তাবৎ রক্ত পুঁজমুখ; তার বিশাস আর তার যুক্তির প্রবল্য এতই দৃঢ়তর ছিল যে তার বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে রীতিমতো লৌহমানব বলে চিন্তা করতে শুরু করেছিল। এমন কি সে তাই কজেনেছিল আর পর্যায়ক্রমে নিজেকে তৈরি করেছিল এক জন নাস্তিক হিসেবে।

দিনটি তার মৃত্যু অবধি স্মরণীয় কেননা ওই দিনেই তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয় যুদ্ধ-বিমান চালনার; সেই বৃহস্পতিবারে পিটি-সিক্স আর মিগ টুয়েন্ট ওয়ানের দুর্দান্ত প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ছয় ফুটের দীর্ঘাকৃতির ইব্নে আজিজ, আফ্রিকান, পরবর্তী কালে যার বসবাস হয় ইরাকের নিভৃত অঞ্চলে। প্রশিক্ষক হিসাবে সারা দুনিয়ায়ই তিনি ছিলেন তুলনাবিহীন একজন মানুষ এবং যার বিশ্বাস ছিল : আহম্মদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী (১৮০৫-১৯০৮) ইমাম মেহেদী ও মসীহ মাউদ হবার যে দাবি করেন তা যথার্থ। আর অবশ্যই ফিরিশতারা তাকে সেই সময় পরিবেষ্টন করে রাখত।’

তৃতীয় বিশ্বের রোজগার, বেঁচে থাকা, সাংস্কৃতিক সংস্থান— সুন্নি মজহব ও আহম্মদিয়াদের মধ্যেকার পার্থক্য— ফারাক, ইসলাম ধর্মের শিয়া ও সুন্নি মজহব আহম্মদিয়াদের প্রকৃত মুসলিম বলে স্বীকারই করে না। ফলে আহম্মদিয়া উপাসনালয়— মসজিদে নানাভাবে আক্রমণ আসে নেমে। গুলি চলে। রক্তে রক্তে লৌহ-লুহান হয়ে যায় উপাসনাস্থল। লাশের ভিড় বাড়ে, স্তূপ। একইভাবে আক্রমণ নামে শিয়া মজহবের প্রার্থনাস্থলে— মসজিদে। রসুলাল্লাহ সালাম নবিজি— হযরত মুহাম্মদের জামাই হযরত আলি এবং তাঁর অনুগামীরাও পাল্টা হামলা চালান।

ফলে ইরাক ও তুরস্ক-সহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রে কুর্দ ও ইয়াজেদি উপজাতির ওপর হামলা হয়। মূল হামলাকারী কখনও রাষ্ট্রশক্তি, কখনও ‘আই এস আই এস’। মৌলবাদী ‘বোকো হারাম’ নির্যাতন চালায় নারী ও শিশুদের ওপর। তাদের পণবন্দি— জব্দ করে।

মোহাজির মুসলমানরা নির্যাতিত হন পাকিস্তানে। ইনডিয়া থেকে পার্টিশানের আগে পরে যাঁরা পাকিস্তানে চলে গেছেন, মজহবের আনুকূল্য পাবেন বলে, আজও তাঁদের সন্দেহের চোখে চোখে দেখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তি।

আফগানিস্থানে নিজের দখল পুনরায় কায়েম করতে চায় অন্ধ তালিবানেরা। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি যারা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কামান দেগে। আফগানিস্থানে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, সোভিয়েতপন্থী নাজিবুল্লার পতন ও ফাঁসির পর তা আস্তে আস্তে চলে যায় তালিবানদের হাতে। এই এস এই এস ধ্বংস করতে থাকে একটা পর একটা স্থাপত্য, প্রাচীন উপাসনালয়।

ভারতে অন্ধ শক্তি ভেঙে দেয় বাবরি মসজিদ, ১৯৯২–এর ৬ ডিসেম্বর। তথাকথিত রাম মন্দির নির্মাণের ধুয়ো তুলে মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ, আবার খাবারের, খাদ্যের ন্যায্য দাবিকে নস্যাৎ করা হয়। কৃষকদের বঞ্চিত করা হয়।

পাকিস্তানের ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ আর একদা পাকিস্থানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সাহেব কী মোহাজির হিসাবে থাকেন সন্দেহ তালিকায়, স্ক্যানারে?

সেলিম মোরশেদের লেখা পড়তে পড়তে হা-অন্ন তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষ হিসাবে, অতি সাধারণ আখ্যানকার হিসাবে মনে এল এইসব কথা। জিজ্ঞাসা। আর তাঁর কথাযাত্রা, আখ্যানসমূহ পড়তে পড়তে অনুভব করি এইসব তথ্যমালা, যা আমার কাছে বড়সড় এক জিজ্ঞাসা চিহ্ন এবং একই সঙ্গে হারিকিরি— কাচ ফলা হয়ে দাঁড়ায়।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor