‘ঈশ্বর’-এর প্রবেশ ও প্রস্থান

মুছে যায়? – ২০
আগের পর্বে

পয়লা বৈশাখ সকালে বসুশ্রী সিনেমায় বিচিত্রানুষ্ঠান। অন্যান্য তারকাদের মতো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও আসতেন সেখানে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, পায়ে চটি। হাতে চারমিনার। সেখানেই প্রথম সৌমিত্রদর্শন আমার। সিনেমা, রঙ্গালয়, রাজনৈতিক মিছিলে হাঁটা, ত্রাণ সংগ্রহ— এক জীবনে কত কিছুই করেছেন একজন মানুষ। সে সময়ের অনেকের থেকেই বড় কবি উনি নিঃসন্দেহে। ছিলেন যথেষ্ট ভালো একজন ক্রিকেটার। ব্যাডমিনটনও খেলতেন তিনি। ‘শিশুভবন’ বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে কৃতী ছাত্রদের পুরস্কার বিরতণে এসেছিলেন একবার তিনি। সাজগোজ নেই, একেবারে সাদামাটা একজন মানুষ। একেবারে পাশ থেকে দেখা তাঁকে। পড়লেন তোতাকাহিনী। অসাধারণ কণ্ঠমাধুর্য, মডুলেশন। নমস্কার বিনিময় ছাড়া একটাও কথা হয়নি সেদিন তাঁর সঙ্গে। সেই স্মৃতিচারণার পর আজ নতুন পর্ব...

১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড কাপ। সেই বিশ্বকাপ দর্শনের কোনো উপাদানই তখন নেই পশ্চিমবাংলার বাঙালি জীবনে। অথচ তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানে আইয়ুব আলি জমানায় টি ভি-র চল আছে, এমনই শুনেছি।

১৯৬৬-র বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। সেবারই আমরা পর্তুগালের ফুটবল নায়ক ইউসেবিও-র নাম শুনলাম। আর ব্রাজিল, ব্রাজিল, ব্রাজিল, পেলে পেলে পেলে তো ছিলেনই। পেলে তখন অধিকাংশ ফুটবল পাগল বাঙালির চোখের মণি, পেলে এবং সমুদ্র তীরবর্তী একদা পর্তুগিজ উপনিবেশ ব্রাজিল। পেলেকে নিয়ে কত বই লেখা হচ্ছে বাংলায়। 

ব্রাজিল বা ব্রেজিল, তার সঙ্গে ওয়েস্টইন্ডিজের ক্যালিপসো ঝঙ্কার, ক্রিকেট মাতামাতি,তার সমর্থনে এই বঙ্গে ছাপোষা কেরানিটিও। কালো কালো কালো। 

কালো – জগতের আলো।

আরও পড়ুন
সৌমিত্র, সৌমিত্রই— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

আমরা— ভারতীয়রা পারি না, বাঙালিরা অপারগ। সাহেবদের গুনে গুনে গোল দিতে, ব্রাজিল পারে। পেলে, পেলে, পেলে। সঙ্গে গ্যারিঞ্চা, টোসটাও, ডিডি, ভাভা।

কী যে ঐন্দ্রজালিক শক্তি গ্যারিঞ্চার সামান্য বাঁকা দু পায়ে। একটু যেন হাঁস স্টাইল। কিন্তু গোল মুখে খুব খিদে পাঈয়া বাঘ তেমন, তেমনই। অনিয়ম, রাত পার্টি, প্রভূত সিগারেট, তবু গ্যারিঞ্চা অপ্রতিরোধ্য।

আরও পড়ুন
‘লাল’ অরোরার কামান

আমরা— ইনডিয়ানরা হারাতে পারি না সাদা চামড়ার ওদের— ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওদের হারায় বলে বলে। ওরেল উইকস ওয়ালকট— থ্রি ডব্লু, ওয়েসলি হল, গিলখ্রিস্ট, ওয়েসলি হল, গ্রিফিন্স, ল্যান্স গিবস। হলের বিমার অথবা বাউন্সারে মাথা ফাটুক নরি কন্ট্রাকটারের। তখন তিনি ভারতীয় ক্রিকেট ইনিংসের গোঁড়া পত্তন করেন বিজয় মেহেরার সঙ্গে। তখনও শুরু হয়নি ‘হেলমেট-যুগ’। পিচ থাকে না ঢাকা। ক্যারেবিয়ান বাউন্সার, নাকি বিমারে কাত নরি কন্ট্রাকটার। মাথায় খুব বড় চোট। তাঁকে প্রয়োজনীয় রক্ত দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। যিনি পরে ‘স্যর’ হয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অধিনায়কও ওরেল।

গ্যারি সোবার্স— গারগিল্ড সোবার্স লেফট হ্যানডার, বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। বলও করেন দারুণ— স্পিন এবং মিডিয়াম পেস। দুর্দান্ত ফিলডার। তো সে যাই হোক, প্রায় অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্শাল, হোল্ডিং, গারনার যুগ আসতে তখনও দেরি। অস্ট্রেলিয়ার লিলি, ম্যাসি, ওয়াকার যুগও আসবে দেরিতে।

আরও পড়ুন
ধাসা-কামান, হাত-কামান, চাবি-কামান

কনরাড হান্ট সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ক্যালিপসো সঙ্গীত তাঁর ব্যাটেও। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী নীতির জন্য অফিসিয়াল ক্রিকেট খেলা হয় না তাঁদের সঙ্গে। ভারতীয় পাসপোর্টে লিখে দেওয়া হয়— এই পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া যাবে না সাউথ আফ্রিকা। অথচ, পোকক ও পোলকের খেলায় মুগ্ধ বিবরণ কখনও কখনও জানায় খবরের কাগজ। তখনও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল অফিসিয়াল টেস্ট খেলতে পারে না। বেসরকারি— আন-অফিসিয়াল টেস্ট খেলতে পারে। ভারতের সঙ্গে সিংহল- তখনও তার ওটাই নাম, খেলে টেস্ট ম্যাচ। জয়সিংঘে তখন সিংহলের নাম করা ক্রিকেটার। গুর সিংঘেও।

ভারত ক্রিকেটে তখন বলে বলে হারায় সিংহলকে। সিংহলের প্রধানমন্ত্রী তখন সিরিমাভো বন্দরনায়েকে। আর পাকিস্তানি ক্রিকেটে তখন মনে হত হানিফ মহম্মদের যুগ শেষ হতে চলেছে। পাকিস্তানি পেস কাম ফাস্ট বোলিং তখনও ভয়ঙ্কর। আর আমাদের পেস, মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং বলতে রমাকান্ত দেশাই— যাঁকে ‘খুদে দেশাই’ বলেও ডাকতেন অনেকে, তাঁর হাইটের জন্য। রমাকান্ত দেশাই অনেকটা লাফিয়ে বাউন্সার, বাম্পার দিতেন। এছাড়াও ছিলেন রামমূর্তি, যিনি বাঁ হাতি মিডিয়াম পেস বোলার, বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান খুব ভালো ফিল্ডার। রুসি মূর্তি, পতৌদি নবাব, সেলিম দুরানি, আর একটু পরে  একনাথ লোলকার, আবিদ আলি— এঁরা সবাই দুর্ধর্ষ ফিলডার। খুব কাউন্টি ক্রিকেট খেলতেন ইংল্যান্ডে। ভালো রোজগার ছিল এই খেলা খেলে। যাঁদের নাম বললাম, এর বাইরে দীর্ঘদিন ভালো ফিল্ডার ছিল না ভারতীয় দলে। সাউথ আফ্রিকার জন্টি রোডস আর কজন হয়?

আরও পড়ুন
পুজোর মিষ্টি, খাবার – রেডিমেড, হোমমেড

আশির দশকের গোড়ায় ফকল্যান্ড নিয়ে ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনার মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ বাঁধে। সামরিক সংঘর্ষ না বলে, তাকে যুদ্ধই বলা উচিত। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টোরি পার্টি বা রক্ষণশীল দল— কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তাঁকে সংক্মখেপে অনী ম্যাগি থ্যাচারও বলেন। মার্গারেট থ্যাচারকে মিডিয়ার একটা অংশ বলে, ‘লৌহমানবী’। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ইজরায়েলের গোল্ডা মেয়ার, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, অনেকটাই সম সাময়িক। শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দরনায়েকে একটু আগেকার সময়ের। মায়ানমারের সুচি বা সুকি, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আরও কয়েক বছর পরের।

ফকল্যান্ড দখল করে আর্জেন্টিনা। ব্রিটেনের সঙ্গে তারপর বাঁধে যুদ্ধ, ১৯৮২ - ২ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন। ইংল্যান্ড পুনর্দখল করে ফকল্যান্ড। তবে তা খুব সহজ হয়নি একেবারেই। ফকল্যান্ড দ্বীপেরা আর্জেন্টিনার পূর্ব উপকূল থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। ১৯৫২-এ ব্রিটিশ নাবিকেরা সম্ভবত প্রথম আবিষ্কার করে এই দ্বীপমালা।

থাক ফকল্যান্ড নিয়ে গুগলবাজি, নিজস্ব স্মৃতির ভাঙাভাঙি খেলা। তখন চাকরি করি পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এ। তার আগে ‘দৈনিক বসুমতী’র খেপখাটা ছিল। আসলে ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনার সামরিক শক্তির বিচার, আক্রমণ প্রতি আক্রমণ, সৈন্যদের মৃত্যু, জাহাজ, যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার ধ্বংস, তারপরই ফুটবলের বিশ্বকাপ, মহারণ।

বাঁ পা-টি ছিল তাঁর বিশ্ববন্দিত, ফুটবল জাদুতে। হ্যানড অফ গড— ‘ভগবানের হাত’ও গোল করতে অনায়াসে ব্যবহার করেন ফুটবলের যুবরাজ। পেলে, গ্যারিঞ্চা, টোসটাও, ডিডি, ভাভা— অপ্রতিরোধ্য প্রায় ব্রাজিল। সোনার পরী— জুলে রিমে কাপ হাতে কালো হিরে পেলে।

১৯৬৬-র বিশ্বকাপে পেলেকে প্রায় ঘিরে রেখে প্রবল বাধা ও প্রহার, পাশাপাশি একই সঙ্গে পর্তুগালের ইউসেবিওকে সামনে রেখে পেলের সঙ্গে তুলনা শুরু হয়।

১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ খেলে উত্তর কোরিয়া। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তারা।  সিঁড়ির কায়দায়, শূন্য থেকে সবুজ মাঠ পর্যন্ত সাজান তাদের পাঁচ কি চারজন ফুটবলার, দেখে বিস্ময় লাগে। খবরের কাগজে খেলার পাতায় প্রকাশিত সেই ছবি এখনও স্মৃতিময়। 

কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গেল নর্থ কোরিয়া পর্তুগালের কাছে। ১৯৬৬-র ‘জুলে রিমে’ কাপ বিজয়ের গৌরব নিয়ে ইংল্যান্ড ডাকটিকিট, যার ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা। ইংল্যান্ড ফুটবল দলের অধিনায়ক ববি মুরের নাম তখন জানছে পাবলিক কিন্তু মানছে না। তখনও বাঙালি স্মৃতিতে আন্তর্জাতিক নামি ফুটবলার বলতে পেলে, গ্যারিঞ্চা, ডিডি, ভাভা, ফেরেঙ্ক পুসকাস, লেভ ইয়াসিন, রূপবান জর্জ বেস্ট এলেন একটু পরে।

লেভ ইয়াসিন সোভিয়েত গোলরক্ষক। অসাধারণ গোলকিপার। ফেরেঙ্ক পুসকাস হাঙ্গেরির, তখন হাঙ্গেরি নামে পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির অস্তিত্ব ছিল। এই হাঙ্গেরিতেই ঢোকে ভারী, গামবাট সোভিয়েত ট্যাঙ্ক ও ‘রেড আর্মি’। ইমরে নেগি বা ইমরে নেজির ‘অভ্যুত্থান’ আটকাতে ব্যর্থ হয়। ‘গণতন্ত্রের দাবি’তে, সোভিয়েত জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার আকাঙ্খা নিয়ে জাগান প্রতিরোধ।

অখণ্ড সোভিয়েতের লেভ ইয়াসিন প্রায় রূপকথা-সম গোলরক্ষক। যাঁকে ‘উড়ন্ত পাখি’ বলা হয়ে থাকে। এই অভিধা দেয় খবরের কাগজ।

মারাদোনার উত্থান এইসব সময়ের বেশ কয়েক বছর পরে। ফুটবল, ফুটবল, ফুটবলই। সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে একমাত্র পেলে। যিনি মদের বিজ্ঞাপনে নিজের ছবি ব্যবহার করতে দেন না, নৈতিকতার কারণে। ব্রাজিলের কুচোরা সমুদ্রতীরে বালির ওপর ফুটবল নিয়ে পায়ের জাদু দেখান। স্কিল। স্কিল। পার্শোনাল স্কিল। ওয়ার্ল্ড কাপ– জুলে রিমে কাপ। তারপর কোপা আমেরিকা। সেখানে কেবলই লাতিন আমেরিকা বা সাউথ আমেরিকার দেশেরা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ভেনেজুয়েলা, পেরু, হন্ডুরাস, মেক্সিকো। সেখানেও লাতিন আমেরিকান স্কিল।

ড্রাগ, মাফিয়া— ড্রাগ নেওয়া। মারজুয়ানা, চোরা চালান। মানুষ পাচার। মারজুয়ানা, হাসিস। বে-আইনি অস্ত্র। সংঘর্ষ। এরই মধ্যে উত্থান দিয়েগো মারাদোনার। যাঁর জন্ম ১৯৬০। খেলতে খেলতে অবসর। তারপর চূড়ান্ত বেহিসাবি জীবন।

ক্যুবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু তিনি। বাঁপায়ে ফিদেলের ছবির উল্কি। তাঁর এই লেফট ফুটই অতি বিখ্যাত। চললে, চালালে, ‘হাউটসার’ কামান একেবারে।

পাশে নিয়ে খেলছেন ভালদানো আর কুরুচাগাকে। কিন্তু তিনি তো একাই এক লক্ষ্য।

খেলা থেকে অবসরের পর বাঁ পায়ে ফিদেলের উল্কি ডান বাহুতে আর্নেস্টো গেভারা। খর্বকায়, বলশালী এই পুরুষ বল ধরলে বিপক্ষ রক্ষণভাগে ক্কেরে ক্কেরে ডাক। নীল-সাদা জার্সিতে দেশের হয়ে খেলতে খেলতে, দৌড়তে দৌড়তে, বল দেওয়া-নেওয়া, করতে করতে পাঞ্চ— শট। পরাস্ত বিপক্ষের গোলকিপার। বল জালে। গো-ও-ল। তাঁর সময়ে, পরে অনেক বড় খেলোয়াড় এসেছেন। জার্মানির বেকেনবাওয়ার (কাইজার), লোথার ম্যাথিউস, আর্জেন্টিনার মেসি, ব্রাজিলের রোনাল্ডো, কাফু, রোনাল্ডিনিহো, রবিনহো, নেইমার, কাকা, সক্রেটিস, ইতালির মালদিনি, হল্যান্ডের রড শুলিট, ভন রাস্তেন, ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান, পর্তুগালের রোনাল্ডো, কেউই সেই উচ্চতায় যেতে পারলেন না, যেখানে মারাদোনা— দিয়েগো মারাদোনা আছে। কেন পারলেন না ওঁরা?  এই প্রশ্ন সবাইকে যদি করা হয়, তাহলে উত্তর মিলবে কি না বলা মুশকিল। 

মারাদোনা বা পেলের তুলনায় অনেক অনেক বেশি অর্থ রোজগার করলেন, দেশ ও ক্লাবের হয়ে খেলে।  বার্সেলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, কিন্তু তাঁরা কেউ পেলে বা মারাদোনা হতে পারলেন না।

এই যে নিজেকে প্রায় ঐন্দ্রজালিক সত্তায় নিয়ে যাওয়া, গায়ে চে আর ফিদেল কাস্ত্রোর ট্যাটু, সেই সঙ্গে ড্রাগ নেওয়া, ড্রাগ পাচারের অভিযোগ, নতুন নতুন বান্ধবী নিয়ে দেশে-বিদেশে তাঁদের যুগল ছবি মিডিয়া, হয়ত পাপারৎজিদের ক্যামেরা কৌশলে তা চলে এল বাইরে, আম পাবলিকের সামনে না-বিস্ময় হয়েও ফুটে থাকল।

বাঁ পা ছিল তাঁর কেশর ফোলান বুনো ঘোড়ার দৌড়। আর সেই পায়েই ফিলেন কাস্ত্রোর ট্যাটু। খেলতে খেলতে, দৌড়তে দৌড়তে অল্প জিভ বার করে ফেলা, নেহাতই মুদ্রা শুনে, হ্যাঁ দোষে নয়, শুনেই। আর তাতেই সমস্ত মাঠ জুড়ে— ‘ডিয়েগো। ডিয়েগো।’ অথবা দিয়েগো, দিয়েগো। ষাটের দশকে প্রতিদ্বন্দ্বী বক্সার সনি লিস্টন সম্পর্কে বলেছিলেন মহম্মদ আলি, ওপন চ্যালেঞ্জে— ‘ফার্স্ট আই উইল চপ দ্য বিগ মাঙ্কি’। বড় বড় হেডিংয়ে তা বেরিয়েছিল বিভিন্ন কাগজ, ট্যাবলয়েডে। তখনও তিনি ইসলাম ধর্ম কবুল করে মহম্মদ আলি হন নি, ক্যাসিয়াস ক্লে-ই আছেন।

বক্সিংয়ের আন্তর্জাতিক লড়ুয়ে জো লুই, লুই প্যাটারসন, সনি লিস্টন, ক্যাসিয়াস ক্লে, মাইক টাইসন। মারাদোনা যেমন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে রণহুঙ্কার ছেড়ে খানিকটা অন্তত নার্ভাস করে দিতেন, ক্যাসিয়াস ক্লে কাম মহম্মদ আলি-র রণধ্বনিও ছিল তেমনই প্রায়। মহম্মদ আলি শেষ জীবনে জটিল, দুরারোগ্যপ্রায় পারকিনসন ডিজিজে ভুগতেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলার সময় আমেরিকার সৈন্যদলে যোগ দেবেন না, এই মতামত নিয়ে তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন। 

কলকাতা ময়দানে পেলে এবং দিয়েগো মারাদোনা দুজনেই খেলা, খেলা, খেলা খেলে গেছেন। সে সব নিয়ে আর বিস্তারিত বলছি না। কলকাতা ময়দানে ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান স্পোর্টিংয়ের জার্সি গায়ে খেলে গেছেন বহু বিদেশী খেলোয়াড়। ধনরাজ-আপপারাও-সালে-সামাদদের পাশাপাশি খেলেছেন বিদেশিরা, ছিলেন তাজ মহম্মদও।

কলকাতা মাঠে হোসে ব্যারাটো না চিমা ওকেরি সেরা বিদেশি ফুটবলার, তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। তবে আমার দেখা সেরা বিদেশি ফুটবলার মজিদ বাসকার। ইরানি এই ফুটবলারের পায়ের জাদু যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন। জামশিদ নাসিরি নামে আর একজন ইরানিয়ান ফুটবল খেলোয়াড় এসেছিলেন মজিদের সঙ্গে। তুল্যমূল্য বিচারে জামশিদ নাসিরি মজিদের কাছাকাছিও নন। কিন্তু মজিদ তাঁর জীবনযাপনে যোগবিয়োগে নিজেকে ক্ষয় করতে করতে কলকাতা ফুটবলের রাজসিংহাসন থেকে হারিয়ে গেলেন অন্ধগলির ভেতর। তারপর প্রায় অজ্ঞাতবাসে থাকতে থাকতে তিনি আবার ফিরে এলেন, খেলোয়াড় হিসাবে নয়, ইস্টবেঙ্গল অ্যাথলেটিক ক্লাবের অনুষ্ঠানে সম্মাননীয় অতিথি হিসাবে।

মজিদ বাসকার প্রায় অজ্ঞাতবাসে— নিরুদ্দেশে চলে যাওয়ার পরও জামশিদ নাসিরি কয়েক বছর খেলেছিলেন কলকাতা ফুটবল লিগে, বেশ মোটা পেমেন্ট নিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলা খবরের কাগজ জানিয়েছে রীতিমত ব্যানড পার্টি বাজিয়ে— বাদ্য ভাণ্ড সহযোগে তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে সই করাতে।

মজিদ, চিমা, জামশিদ— সকলেই লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন, সাদা-কালো জার্সি গায়ে দিয়ে খেলেছেঙ্কলকাতা ময়দানে। কলকাতায় খেলতে আসে ডং, ইগরদের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না মজিদ-চিমা-জামশিদদের, বলাই বাহুল্য।

বাঙালি আশির দশকের গোড়ায় গোড়ায় পর্যন্ত ফুটবলে ব্রাজিলের সাম্বা জাদুর প্রায় অন্ধ সমর্থক। আশির দশকেই ম্যাজিকে আর্জেন্টিনার উত্থান বাঙালি মধ্যবিত্তের তরুণতর প্রজন্মকে মারাদোনামুখী করে তোলে। পিকে, চুনি, সুদীপ, প্রশান্ত, সমরেশ, সুভাষ, বলরাম, সুরজিৎ, কৃশানু, বিকাশ, বিশ্বজিৎ ছাড়িয়ে বাঙালি তখন ব্যস্ত তার ফুটবল আইকন খুঁজে নিতে। জীবনের নবতরঙ্গ তখন মারাদোনার পায়ে, বুটে। বাঁ পায়ের জাদুতে মুদ্ধ তখন অনেকেই। গো-ও-ও-ল। 

পেলে কিংবদন্তির নায়ক। বার বার ‘জুলে রিমে; কাপ— সোনার পরী এসেছে ব্রাজিলের ঘরে, টিম গেমও যে ছিল এর পেছনে সে কথা আগেই বলেছি।

পেলে অতীতের ছায়া হয়ে যেতে না যেতেই উত্থান দিয়েগোর। তার খেলা, কথাবার্তা, জীবনযাপন— সবটাই তখন জেগে ওঠা ঢাকের শব্দ। কলকাতার আকাশে তাই ব্রাজিলের সবুজ-হলুদের সঙ্গে আর্জেন্টিনার নীল-সাদা পতপত, পতপত।

শুধু কলকাতাই বা বলি কেন, দূর মফস্বলে— সেই সব মফঃস্বলী আশমানেও কখনও কখনও উড়তে থাকে ব্রাজিলের গায়ে গায়ে আর্জেন্টিনার পতাকা। ক্বচিৎ-কদাচিৎ পর্তুগাল, ফ্রান্সেরও, হঠাৎ করে ক্রোয়াশিয়ার বা তুরস্কেরও। ইংল্যান্ডের সমর্থকও আছেন কিছু।

জিনেদিন জিদান খেলতে শুরু করে, ফুল ফর্মে এসে যাওয়ার পর ফরাসিদের সমর্থক বাড়ল। বিশেষ করে একদা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে। আলজেরিয়ায় মূল শিকড়টি, সেই জিনেদিন জিদান খেলছেন, গোল করছেন, মাথা দিয়ে ঢুঁসো মারছেন।

মেদিনীপুরে বসবাস করা পর্তুগিজ রক্তধারা, জিন বহন করা লোকজন কেউ কেউ দল বেঁধে রাত জেগে খেলা দেখেন পর্তুগালের। তাঁরা সবাই খ্রিস্ট ধর্মের মানুষ। পর্তুগাল জিতলে বাজি পোড়ে। মোরগ বা খাসির মাংসের পিকনিক— অবধারিত। এসবই আমার দেশ। ভারতবর্ষ, আমাদের ভারতবর্ষ।

দখলদার পর্তুগিজ সংস্কৃতি যেমন মিশেছে ব্রাজিলে, তেমনই দখল নেওয়া স্প্যানিশ সংস্কৃতি মিশে গেছে আর্জেন্টিনার সঙ্গে, কালের নিয়মে।

খাদ্য, পানীয়, ধর্ম, জীবনাচরণ সবেতেই পর্তুগাল আর স্পেনের প্রভাব— ব্রাজিল বা ব্রেজিলে আর আর্জেন্টিনার সংস্কৃতি, ভাবনা, জীবনে। গানে, সাহিত্যে। 

দুর্দান্ত স্প্যানিশ আরমাডা সেই ক-অ-বে খানা গেড়েছিল এই অঞ্চলে। লুণ্ঠন, যৌনরোগ, সোনা— মণ মণ সোনা লুট করে নিয়ে যাওয়া পিজারো, রানী ইসাবেলার জন্য, স্পেনের রানী ইসাবেলা।

মারাদোনা, গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ— দুজনেই  ছক ভাঙা জন। চিরকাল তাঁরা নিজেকে ভেঙেছেন। সেই ভাঙনের কথা প্রকাশ্যে এনেছেন, পাবলিক করেছেন। ‘পবিত্র সিক্রেট’ বলতে তাঁদের জীবনে প্রায় কিছুই নেই।

মারাদোনা কি ভুগতেন নিঃসঙ্গতায়, এত ফ্যান, সমর্থক, পরিজন, তবু তিনি একা, একা, একা। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও কি ছিলেন সঙ্গহীন? তিনিও তো ছিলেন ফিদেলের বন্ধু।

বিশ্ব ফুটবলের ‘যুবরাজ’, ‘রাজপুত্র’, ‘ঈশ্বর’— যাই বলা হোক না কেন, এতবড় একজন ফুটবলার কীভাবে কীভাবে প্রবল নেশাড়ু আর অ্যালকোহলিক হয়ে উঠলেন, এটাও তো খোঁজার। অবশ্যই খুঁজতে থাকার। একই পরিণতি হয়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল তারকা ও চিকিৎসক সক্রেটিস আর অবশ্যই গ্যারিঞ্চারও।

মানুষ কেন, কখন, কী কারণে কী কী করতে থাকে এ বড়ই তাস খেলার অজানা রংফোঁটা। হরতন, রুইতন, ইস্কাপন, সেই সঙ্গে সাহেব-বিবি আর গোলাম।

কেন জানি না মাত্র ষাত বছরে হঠাৎ থেমে যাওয়া দিয়েগো মারাদোনার কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ল তাস খেলার রঙ চেনা চেনি। থ্রি হার্ডস, টু স্পেড, ওয়ান ক্লাবের কথা। পাস। ডাবল, রি ডাবল— এই সব ‘কল’-এর কথা। কখন কী যে হয় মানুষের, মনে! তাই হয়ত কথাকার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কপালে রডা পিস্তল ঠেকিয়ে নিজেকে গুল করেন। রক্তে ভাসাভাসি নিষ্প্রাণ হোমিংওয়ে। জীবন বড় জটিল হে, জীবন। জীবন রে।

পায়ের জাদুতে প্রজাপতি মেলে পাখা
বুক জোড়া ট্যাটু, চে গেভারার হাসি
বন্ধু ফিদেল ঠিক মুখোমুখি তার
এবার বাজল অরফিউসের বাঁশি।

Powered by Froala Editor