মুছে যায়? – ১৯
আগের পর্বে
৭ নভেম্বর, নভেম্বর বিপ্লব দিবস। ভারতবর্ষ, তথা পশ্চিমবাংলার সমস্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক দলগুলিই পালন করে এই দিনটি। বিপ্লবের মাসে প্রকাশিত হত কমসোমল, কালান্তর, গণশক্তি ইত্যাদি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। কলকাতার গোকি সদনে দেখানো হত সোভিয়েত ডকু ফিল্ম। তখন নভেম্বরে ধর্মতলায় জেগে ওঠেন লেনিন। সেই মূর্তির দেখভাল করে অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন। বামপন্থীদের পার্টি অফিস সেজে ওঠে রঙিন আলোয়। নিন্দুকেরা এসব দেখে বলত ‘লেনিন পুজো’। সেটা আশির দশক। আমার বাবা প্রায়শই বলতেন এসব আয়োজন কমিয়ে পার্টি অফিস কমিয়ে ছোট হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা।
সিনেমার পর্দার বাইরে, তাঁকে প্রথম দেখি দক্ষিণ কলকাতার হাজরার ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলে। বাংলা সালের প্রথম দিনটি, পয়লা বৈশাখ সকালে ‘বসুশ্রী’-তে জলসা— বিচিত্রানুষ্ঠান।
কে নেই সেখানে? উত্তমকুমার, হ্যাঁ, আছেন। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের খুব বড় সমর্থক মন্টু বসু বা মন্টু বোস তিনিই এই জলসার উদ্যোক্তা। ‘বসুশ্রী’-র পাশে একটা বড়সড় বাড়ি। তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। বিশেষ করে বিবাহ-অনুষ্ঠানে।
কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সর্বাণী মুখোপাধ্যায় ও রঞ্জন বসুর বিবাহ অনুষ্ঠানে এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত সেই বাড়ি তিনতলা। তিনিই এই জলসার উদ্যোক্তা। সেই বাড়ি বহুদিন হল ভাঙা পড়েছে।
সর্বাণী— ডাকনামে বুলবুল, তার বিবাহে এসেছিলেন উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী। যতদূর মনে পড়ে উত্তমকুমারের পরনে কালো নেটের পুরো হাতা জামা— শার্ট। উত্তমের গা থেকে যেন আলো বেরোচ্ছে। যদিও ভেতরে স্যানডো গেঞ্জি, সাদা প্যান্ট। সাদা জুতো।
আরও পড়ুন
‘লাল’ অরোরার কামান
উত্তম সেদিন কিছু না খেয়ে চলে গেছিলেন, সেই বিবাহ অনুষ্ঠান ছেড়ে। মানে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, জনবেষ্টিত— মবড হয়ে গিয়ে। সুপ্রিয়া দেবী সেদিন শাড়ি পরা সোফিয়া লোরেন। ওঁরা এসেছিলেন ময়রা স্ট্রিটে ওঁদের বাড়ি থেকে।
ময়রা স্ট্রিটের নাম বদলে গেছে বহু বছর, মহানায়ক উত্তমকুমারের নামে তার নাম।
আরও পড়ুন
ধাসা-কামান, হাত-কামান, চাবি-কামান
সেদিন উত্তমকুমার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফেরত চলে গেছিলেন। এই কথা লিখেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯৮৪ সালের ২৪ জুলাই, যা ছাপা হয়েছিল ‘যুগান্তর’-এর চারের পাতায় সেকেন্ড পোস্ট এডিটোরিয়াল হিসাবে, ১৯৮৪-র ২৫ জুলাই।
মবড উত্তমকুমার সেদিন থাকার ভরসা পাননি বুলবুলের বিয়েতে। পুলিশ প্রহরা থাকা সত্ত্বেও। চলে গেছিলেন কিছু না খেয়ে।
আরও পড়ুন
পুজোর মিষ্টি, খাবার – রেডিমেড, হোমমেড
‘বসুশ্রী’-তে পয়লা বৈশাখের সকালে যে জলসা-ফাংশান-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-বিচিত্রানুষ্ঠান, যাই বলি না কেন, তাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আসতেন। খুব ফরসা, লম্বা। চুলের কাটিংয়ে কোনো প্রভাব নেই ইউ-কে— মানে উত্তমকুমারের। ঘাড়ে ‘উত্তম ব্র্যান্ড’ ইউ নেই।
হাতে প্লেন চারমিনার, জ্বলন্ত। তখন দুটো চারমিনার পাঁচ নয়া পয়সা। সেটা ষাটের দশকের মাঝামাঝি। তাঁর পরনে বড় ঘেরের ঢোলা পায়জামা, র সিল্ক বা খাদির পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। পাঞ্জাবির হাতাও সম্ভবত ঢোলা। কাঁধে ঝোলা নেই।
আরও পড়ুন
পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য
তাঁকে ক্যামেরায়— সিনেমায় যতটা রূপবান দেখায়, তার থেকে অনেক অনেক বেশি রূপমাধুর্য তাঁর শরীর ঘিরে। এতটুকু মেদ নেই, ছিপছিপে।
তিনি উত্তমকুমার নন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়— ডাকনামে পুলু— পুলুবাবু, এই নাম ধরে শেষবার তাঁর কথা বলতে শুনেছি অমিতাভ দাশগুপ্তকে। কবি ও গদ্য লেখক, পরে ‘পরিচয়’ সম্পাদক অমিতাভ দাশগুপ্তকে। তাঁরা সম্ভবত সহপাঠী ছিলেন, কলেজে। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনায়াসে ঢুকে যান ‘বসুশ্রী’ হলে, মন্টু বোসের জলসায়। সেখানে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, সে এক এলাহি ব্যাপার। তখন কি অভিনেতৃ সংঘে আর শিল্পীসংসদ-এ ভাগ হয়েছে টালিগঞ্জের সিনে-জগৎ? শিল্পী সংসদ-এর নেতৃত্বে উত্তমকুমার, শৈলেন মুখোপাধ্যায়। ‘অভিনেতৃ সংঘ’-এর নেতৃত্বে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়রা।
‘আর্টিস্ট’ দেখতে পয়লা বৈশাখ সকালে ‘বসুশ্রী’-র সামনে পিলপিলে ভিড়। কারণ ভেতরে তো সবার জায়গা নেই।
সেই তো আমার প্রথম সৌমিত্র দর্শন, অতি কাছ থেকে। তার আগে ‘অপুর সংসার’ হয়ে গেছে শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে। তারপর তো নয় নয় করে চোদ্দটি ছবি— সত্যজিৎ বাবুর পরিচালনায়। তার মধ্যেই ফেলু মিত্তির— গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র।
১৯৬৬-র ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের পর তিনি বামপন্থীদের মিছিলে হেঁটেছেন, সে ছবি এখন দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা পোস্টে। তারপর বন্যাত্রাণে টাকা সংগ্রহে বেরিয়েছেন, সে ছবিও প্রকাশ্য, খবরের কাগজ— দৈনিকের পাতায়, পাতায়।
খুব ভালো কবিতা লেখেন, অন্তত আমার তাই মত। সবাই মানবেন, স্বীকার করবেন কিনা জানি না। তবু আমি বিশ্বাস করি উনি— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সময়ের অনেকের থেকে বড় কবি, নিঃসন্দেহে। কবিতার কথায় পরে আসছি।
একজন মানুষ তাঁর ৮৫-৮৬ বছরের জীবনে কত কী করেছেন। সিনেমায় অভিনয় তো করেছেনই। তার সঙ্গে রঙ্গালয়— ‘বোর্ড’, ‘রাজকুমার’, ‘টিকটিকি’, ‘প্রাণতপস্যা’, ‘ছাড়ি গঙ্গা’। আরও কত কত নাম। সেইসঙ্গে ‘কিং লিয়র’ নামের সিংহনাদ। যা কায়দা করে বন্ধ করে দেওয়া হয় এক সময়। ২০১১-র ‘মহা-পরিবর্তন’-এর পর।
ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে বম্বের চিত্র তারকাদের সঙ্গে টালিগঞ্জের ফিল্ম অ্যাকটরদের। হয় বন্যা, নয় খরা— কোনো একটা ফান্ডের জন্য টাকা তোলা হবে। বম্বে টিমে রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, শশী কাপুর, বৈজয়ন্তীমালা ও আশা পারেখও সম্ভবত। টালিগঞ্জ কেন্দ্রিক অভিনেতাদের ক্রিকেট দলে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার প্রমুখ। খেলা হল ইডেন গার্ডেনে।
সৌমিত্র যথেষ্ট ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ব্যাডমিনটনও। তার স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায় রাজ্য ব্যাডমিনটনে বেশ অনেকটা উঁচু র্যা ঙ্ক করা, বিবাহের আগেই।
‘উল্টোরথ’ অথবা ‘প্রসাদ’-এ এখনও আর ঠিক মনে নেই, কোনো শারদ সংখ্যায় রঙিন ছবিতে ব্যাডমিন্টন র্যা কেট হাতে দীপা ও সৌমিত্র। সৌমিত্রর পরনে সাদা শর্টস আর কলারঅলা সাদা গেঞ্জি— একেবারে স্বীকৃত লন টেনিস বা ব্যাডমিন্টন খেলার পোশাক।
‘উল্টোরথ’ তখন সিনেমা কেন্দ্রিক মাসপত্র। ‘প্রসাদ’ সিনেমাজগৎও তাই। এইসব ছবি তুলতেন ডুলু দাস— নামটা মনে আছে। উত্তমকুমারের ঘরোয়া ছবিও দিতেন তিনি। বিশেষ করে মর্নিং ওয়ার্কের কিংবা একটু অন্য মোডের— একটু অফবিট ছবি। আরও পরে সিনেমার কাগজ হিসাবে ‘ঘরোয়া’, ‘উচ্চরথ’, ‘উত্তম’, ‘মৌসুমি’, ‘রজনীগন্ধা’ বেরয় সিনেমাপত্রিকা হিসাবে। সেইসঙ্গে ছিল নতুন খবর।
তখন লন টেনিসে রমানাথ কৃষ্ণণ, জয়দীপ মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট নামি। তাঁরা আন্তর্জাতিক ম্যাচে— ডেভিস কাপে অংশ নেন। একটু পরে এলেন নরেশ কুমার, লন টেনিসে।
ব্যাডমিন্টনে তখন খুব নামি দীপু ঘোষ, টেবিল টেনিসে খোদাইজি, নন্দু নাটেকর। সেই ষাটের দশক আন্তর্জাতিক মহিলা টেবিল টেনিসে বিলি জিন কিং ছিলেন খুবই নামঅলা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খুব পছন্দ করতেন বলরাজ সাহানির অভিনয়। নানা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন এই কথা। তুলসী চক্রবর্তী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমার তাঁর পছন্দের অভিনেতার তালিকায়। সেই সঙ্গে ছবি বিশ্বাস, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রবি ঘোষ।
বোম্বাইয়া সিনেমায় বলরাজ সাহানি ছাড়া রাজ কাপুর এবং দিলীপ কুমারের অভিনয় পছন্দ করেছেন সৌমিত্র, একথা বলেছেন অনেক অনেক পরে। দেবানন্দ নন।
শোনা যায় রাজ কাপুর তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ‘সঙ্গম’-এ অভিনয় করার জন্য। রাজেন্দ্রকুমারের রোলটি তাঁকে করতে অফার দেওয়া হয়েছিল। বৈজয়ন্তীমালা ছিলেন এই ছবিতে। তাঁর লাল সুইমিং কস্টিউম পরা সাঁতার দৃশ্য তখন খুব খেয়েছিল পাবলিক, সেকসি শট হিসাবে।
গাছে উঠে রাজ কাপুর বিদেশী কোনো বাঁশি বাজাচ্ছেন আর মুকেশের গলায় লিপ দিচ্ছেন—
‘তেরে মন কি গঙ্গা
অওর মেরে মন কি যমনা কা
বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহি
আরে বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহি?’
সাঁতার কাটা বৈজয়ন্তীমালা ‘নহি’, ‘কভি নেহি’-র পর ‘হোগা’, ‘হোগা’, ‘হোগা’ বলছেন।
এই সিনেমাটিতেই মুকেশের গলায় রাজেন্দ্রকুমারের লিপে একটি অসামান্য গান আছে—
‘দোস্ত দোস্ত না রহা
পেয়ার পেয়ার না রহা...’
ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। সে বিষয়ে আর ঢুকছি না। ‘সঙ্গম’ তখন সুপার ডুপার হিট। জুবিলি। জুবিলি। সিলভার জুবিলি, গোলডেন জুবিলি, প্ল্যাটিনাম জুবিলি, ডায়মন্ড জুবিলি। জুবিলির পর জুবিলি।
রাজেন্দ্রকুমারের নাম বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘জুবিলি কুমার’। ছবি করলেই নাকি হিট। মনে পড়ে ‘সূরজ’, ‘গোরা অওর কালা’-র কথা।
তখন বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক ‘কুমার’। অশোককুমার, মনোজকুমার, রাজকুমার, দিলীপকুমার— দিলীপ সাব তো আছেনই। আর আছেন সুনীল দত্ত, মেহমুদ— নায়কের চরিত্রও করেছেন অনেক, যদিও তিনি মূলত কমেডিয়ান হিসাবেই মারকাটারি। এ ছাড়া এভারগ্রিন দেবানন্দ সাব তো আছেনই।
বম্বের রূপমহল— মায়াপুরীতে অনেক বাঙালি হিরোই গিয়ে কাজ করেছেন। তাঁরা হলেন অসিতবরণ, উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, অসীম কুমার, স্বরূপ দত্ত, শমিত ভঞ্জ। কিন্তু বিশ্বজিৎ ছাড়া কেউই হিট ছবির নায়ক হিসাবে টিকে যেতে পারেননি। ‘বিশ সাল বাদ’, ‘কোহরা’, ‘মেরে সনম’, এরকম বহু ছবির কথাই বলা যায়, যাদের হিরো বিশ্বজিৎ।
অসামান্য অভিনেতা উত্তমকুমার বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ করেছেন। ছবি চলেনি। এরপরই উত্তমকুমারের প্রথম হার্ট অ্যাটাক। ছবির প্রোডিউসারও ছিলেন তিনি। ডাহা ফ্লপ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, উত্তমকুমারের নাচের স্টেপ নাকি দেবানন্দ— দেব সাহাবের থেকে ভালো ছিল, বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে, কিন্তু ‘ছোটি সি মুলাকাত পেয়ার বন গ্যয়ি’, রফিসাহাবের গান যথেষ্ট হিট করলেও, এই নাচটা কতটা সর্বভারতীয় হয়েছিল, জানা নেই।
উত্তমকুমার অনেক পরে শক্তি সামন্তর পরিচালনায়, ‘অমানুষ’ করেন, বাংলা ও হিন্দিতে। ‘দেশপ্রেমী’, ‘আনন্দ আশ্রম’ও হিন্দি হয়েছিল। সুপার ডুপার হিট, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’ কিন্তু উত্তমকুমারকে হিন্দি বলয়ের সিনেমা দর্শক সেভাবে গ্রহণ করেনি, কেন করেনি, তার নানা কারণ আছে। তা নিয়ে বিস্তারিত লিখছি না।
‘দেশপ্রেমী’ ছাড়াও আরও দু-একটা হাবিজাবি হিন্দি ছবি করেছিলেন উত্তমকুমার। তাদের কথায় গেলাম না। বসন্ত চৌধুরী সাধনার বিপরীতে হিন্দি ছবি করেছেন।
বাঙালি নায়িকারা বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে বহু কাজ করেছেন। সুচিত্রা সেনের ‘দেবদাস’, ‘বোম্বাইকা বাবু’-র কথা এখনই মনে পড়ছে। ‘দেবদাস’-এ পারো— পার্বতীর ভূমিকায় ছিলেন সুচিত্রা সেন। ‘বোম্বাইকা বাবু’-তে দেবানন্দ হিরো। এই ছবির একটি অসামান্য গান— ‘দিওয়ানা মস্তানা হুয়া কেয়া/ জানে কাঁহা লেকে বাহার আয়ি...’। সুচিত্রা সেন ভারতভূষণের সঙ্গেও কাজ করেছেন নায়িকা হিসাবে।
‘দেবদাস’-এ দেবদাস দিলীপকুমার, চন্দ্রমুখী বৈজয়ন্তীমালা। মালা সিনহা বাংলা, হিন্দি সব ছবিতে অভিনয় করেছেন। যদিও তিনি পুরোপুরি বাঙালি নন। সুপ্রিয়া চৌধুরী ‘আপ কি পরছাঁইয়া’ ছবিতে ধর্মেন্দ্রর হিরোইন। সন্ধ্যা রায়, লিলি চক্রবর্তী ‘কাজ’ করেছেন বম্বেতে। আর কাজ করেছেন কানন দেবী, দাপটের সঙ্গে, এক সময়।
‘নীলাচলে মহাপ্রভু’-খ্যাত অসীমকুমার ‘সরস্বতীচন্দ্র’ নামে একটি মুভি করেন নূতনের বিপরীতে। সেই সিনেমায় মুকেশের গলায় ‘চন্দন সা বদন চঞ্চল চিতয়ন...’ এই গানটি এক সময়কার অতি হিট গানও। অসীমকুমার বম্বেতে হিরো হয়ে থাকতে পারেননি শেষ পর্যন্ত, চলে আসেন। বসন্ত চৌধুরী, অনিল চট্টোপাধ্যায়রাও তাই। ব্যতিক্রম অশোক কুমার, কিশোর কুমার, অনুপ কুমার— এই তিন ভাই। সেই সঙ্গে জয়া ভাদুড়ী।
জয়া ভাদুড়ী বা অশোক কিশোর-অনুপরা সেই অর্থে কলকাত্তাইয়া বঙ্গালি নন। সাংবাদিক তরুণ ভাদুড়ীও দীর্ঘদিন প্রবাসী। তিনিও স্টেটসম্যানের সাংবাদিক। তাঁরই কন্যা জয়া। আর অশোক-কিশোর-অনুপরা তো মধ্যপ্রদেশের খান্ডালা— ‘শুন-শুনা-আতি হ্যায় খান্ডালা’-র আমির খানকে মনে পড়ে।
রানী মুখার্জি খুব ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী নন। বাকি রইলেন ‘অপুর সংসার’-এর রিঙ্কু— শর্মিলা ঠাকুর। অপুর সংসার তাঁর প্রথম ছবি। তারপর বম্বে-বাংলা। বাংলা-বম্বে।
সুর দেওয়া, সঙ্গীত পরিচালনা, ফিল্মের কাহিনী নির্মাণে বাঙালিরা একসময় ছিলেন অত্যন্ত কৃতবিদ্য। সলিল চৌধুরী, শচিন দেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রাহুল দেব বর্মণ, কানু রায়, কত নাম যে আসে! সেই সঙ্গে প্লেব্যাকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সুবীর সেন, গীতা দত্ত, সুমন কল্যানপুর, জগন্ময় মিত্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, তালাত মামুদ— যিনি তপন কুমার নামে বাংলা গানও গেয়েছেন। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও গেয়েছেন হিন্দি গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— হেমন্ত কুমার, জগন্ময় মিত্র— জগমোহন নামে খ্যাত ছিলেন বোম্বাই ফিল্ম জগতে।
শশধর মুখার্জি গভীর ভাবে জড়িত ছিলেন বোম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে।
শোনা যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নাকি দুটি ছবি অভিনয় করতে হয়েছিল, হিন্দি ছবিতে। এও সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য। তাঁর মৃত্যুর পর নানা তথ্য ভাসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই দুটি হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের তথ্যও সোশ্যাল মিডিয়ায়— ফেসবুক সৌজন্যে। সত্যি, মিথ্যে জানা নেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা কবিতা সন্ধ্যা হয়েছিল বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে। সম্ভবত ২০০৯-এ। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হয়ে গেছে ততদিনে। ‘নন্দীগ্রাম কাণ্ড’ হওয়ার পর ‘আজকাল’ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন সৌমিত্র। লেখাটা খুবই সুলিখিত। চমৎকার বাংলা। কিন্তু তাঁর যুক্তি সবটা সমর্থন করতে পারিনি।
তাঁর কবিতার আমি গুণমুগ্ধ পাঠক। ‘জলপ্রপাতের ধারে’, ‘হায় চিরজল’, ‘পদ্মবীজের মালা’। আরও কবিতা গ্রন্থ। কবি হিসাবে তাঁকে আমার খুবই বড় মনে হয় এ কথা আগেই বলেছি।
‘শব ছুঁয়ে বসে আছে কেউ
চলে গেছে শ্মশানের মিতা
আগুনের ভালোবাসা চেয়ে
পড়ে আছে চন্দনের চিতা
কতদিন এই ভাবে যাবে
শবের উপর রেখে জানু
অহল্যা পাথর কবে পাবে
বারুদের ক্রুদ্ধ পরমাণু’
(পড়ে আছে চন্দনের চিতা)
বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে সেই সান্ধ্য কবিতা আসর বলা বাহুল্য কানায় কানায় পূর্ণ। সৌমিত্র প্যান্ট-শার্ট, সুনীল পায়জামা-পাঞ্জাবি। সেদিন অসামান্য কণ্ঠ আভরণে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দেদীপ্যমান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়লেন ‘স্মৃতির শহর থেকে’, তাঁর বাবাকে নিয়ে একটি কবিতা। নতুন কবিতাও তাঁর কণ্ঠ থেকে পেল কলকাতা। সৌমিত্রও পড়লেন নতুন পুরনো মিলিয়ে। সে এক আশ্চর্য কবিতা সমাবেশ।
আরও একটি স্মৃতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে, লেখক গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায়দের বিদ্যালয় ‘শিশুভবন’, ‘পাঠভবন’-এর অনুষ্ঠান উত্তরপাড়ার ‘গণভবন’-এ। বার্ষিক অনুষ্ঠান। কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের পারিতোষিক বিতরণ। সেই উপহার বা পুরস্কার তুলে দেওয়ার খানিকটা দায়িত্ব আমার হাতে।
পাশেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। খুব সেজেগুজে নয়, একেবারেই সাদামাটা। পুরো হাতা পাঞ্জাবি আর কমঘেরের সাদা পায়জামা।
‘তোতাকাহিনী’ থেকে পড়লেন তিনি। বলাই বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের অতি বিখ্যাত ‘তোতাকাহিনী’। যখনই তিনি ‘পাখিটা মরিল, নিন্দুক লক্ষীছাড়া রটাইল পাখিটা মরিয়াছে’, তখন তাঁর কণ্ঠমাধুর্যে, মডুলেশনে অন্যতর ভাবসিন্ধু।
পরে তিনি নিজের কবিতাও পড়লেন। ‘অপুর সংসার’-এর অপুর পাশাপাশি বসে আছি। রোমাঞ্চ কিছুটা তো হচ্ছিলই। কিন্তু বয়স তো ‘আর্টিস্ট’— ‘সিনেমা আর্টিস্ট’ দেখার থ্রিল বেশ কিছুটা কমিয়ে দেয়। চুপ করে বসেছিলাম পাশাপাশি। খানিকক্ষণ। তিনি অবশ্য আগে আগে রওনা দিলেন সেই সান্ধ্য অনুষ্ঠান থেকে। একটিও কথা হয়নি। নমস্কার বিনিময় ছাড়া...
‘এখন এও এক বন
টাইগার গ্রাসে সকলেই আড়াল
তাই চেনাজানা দেওয়া নেওয়া সবই শব্দ দিয়ে
কোন শিকারীর মনে নিবিড় অসুখ
কোন বুলেট বন্ধুকের সঙ্গে ফিশ ফিশ করে যুক্তি করছে
সবই শুনতে হয়
এই বনে শিকারীরা বড়ই বিলাসী এখন।
...কাঁচের থামের মত ঝর্ণা শুয়ে আছে
ভূমিতল আলো করে
ময়ূরের বাসা, বনমোরগ নির্ভীক হাঁটছে
নীল সামিয়ানায়, চিল শকুন আঁকা
সব দেখব, সর্ষে পড়লেও চোখ এড়ায় না’
(হিম শয়ন ও পরে)
গ্যারি সোবার্স বা গারফিল্ড সোবার্সের খেলা খুব পছন্দ করতেন সৌমিত্র। এই বিষয়টিও জানা গেল তাঁর চলে যাওয়ার পর। লেফট হ্যানডার— ন্যাটা গারফিল্ড সোবার্স, বল, ব্যাট দুটোই দারুণ করতেন। এই গারফিল্ড সোবার্সই ভারতে এসে ‘প্রেমে’ পড়েন অভিনেতা, অভিনেত্রী বলছি না ইচ্ছে করেই অঞ্জু মহেন্দ্রর।
ইডেন গার্ডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইনডিয়ার খেলায় উপস্থিত ছিলেন সোবার্স প্রেমিকা অঞ্জু মহেন্দ্র এবং মনসুর আলি খান পতৌদির প্রেমিকা শর্মিলা ঠাকুর। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র প্রথম পাতায় এই দুই নায়িকার ছবি ছাপা হয়, সিঙ্গল কলম, আলাদা আলাদা সুন্দর ক্যাপশনে।
অঞ্জু মহেন্দ্রর এই ‘সোবার্স সংসর্গ’ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বেশ কিছু সিনেমা ও অনেক টিভি সিরিয়াল করা অঞ্জু মহেন্দ্র অনেক পরে সুপারস্টার রাজেশ খান্নার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মনে আছে ‘স্বাভিমান’ বলে একটি মেগা সিরিয়ালে অঞ্জু মহেন্দ্র ও কিটু পিদোয়ানির অভিনয়, দূরদর্শনে। সেটা সম্ভবত নব্বইয়ের দশক। অনিল চট্টোপাধ্যায়, অমল পালেকারের পরিচালনায় ‘নকার’ নামে একটি হিন্দি মেগা সিরিয়ালে অসামান্য অভিনয় করেন। রোড অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত এক ফিল্মি সুপারস্টারকে নিয়ে এই সিরিয়াল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহুবার নানা ধরণের আহ্বান সত্ত্বেও বোম্বাই, বোম্বে বা মুম্বাইতে সিনেমার নায়ক হতে যাননি। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, থাক সে তিনি কী বুঝেছিলেন সেই সিদ্ধান্তে যাওয়ার দরকার কী।
নাইনটি ওয়ান পয়েন্ট নাইন এফ এম চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শিরোনাম— ‘তোমার আকাশ, তোমার বাতাস’। সেই শো-তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে দেখেছেন, সেই সব অনুভবের কথা, কি অসামান্য বলতেন তিনি। রবিবার, রবিবার হত অনুষ্ঠানটি। তখনই, কি তার পরে পরেই তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেন। ছড়া তো লিখতেন আগেই।
বিশিষ্ট লেখক সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন সৌমিত্রের সহপাঠী, কলেজে। তাঁর কাছে বহু কথা শুনেছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়ে। সহপাঠী বন্ধুর বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বারবার বলেছেন, চিঠি দিলে চিঠির উত্তর দেয়। কেউ বই উপহার দিলে পড়ে, মতামত দেয়, চিঠি লেখে। সেটা আশি নব্বইয়ের দশক। তখনও চিঠির যুগ বর্তমান।
পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড, এনভেলপ। পোস্ট অফিসের গুরুত্ব অনেক। টেলিগ্রাম ‘তার’ আছে। দুঃখ সুখের সংবাদ নিয়ে। এস এম এস, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেল, স্কাইপ, ভিডিও কল— কিছুই নেই।
পৃথিবীটা এত ছোট হয়ে যায়নি।
সব শেষে একটাই কথা, কারো সঙ্গে বনাম নয়। সৌমিত্র একাই সৌমিত্র হয়ে জেগে আছেন।
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor