‘লাল’ অরোরার কামান

মুছে যায়? – ১৮

আগের পর্বে

হাত-কামান, ধাসা-কামান বলতে মাটিতে সামান্য খুঁড়ে লোহার ফাঁপা পাইপ বা নল। তার গায়ে তিনটে ফুটো করে বারুদ, পলতে। ক্লাসিকাল বারুদ— সোরা, গন্ধক, কাঠকয়লার। অনেকের বাড়িতেই তৈরি হত সেসব। দীপাবলির বাজির বারুদের মতোই তা। যা ছিল গাদা বন্দুকের প্রিমিটিভ সংস্করণ। শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-তে উল্লেখ পাওয়া যায় এই কামানের। গোপাল ভাঁড়ের একটি বাংলা সিনেমাতেও দেখানো হয়েছিল চাবি-কামানের ব্যবহার। সত্তরদশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় বহুল ব্যবহৃত হয় এই কামান। বালি, যাদবপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশ-সি আর পি’র ভ্যান আটকাতে দাগা হত এই কামান। হত ডেটনেটর ও ডিনামাইটের ব্যবহারও।

‘লাল অরোরার কামান’— এই শিরোনাম দেওয়ার আগে বুঝে নিতে চাইছিলাম জারের রাশিয়ার ‘অরোরা’ নামের জাহাজ থেকে দেগে দেওয়া কামানের নির্ঘোষ। তারপর তো ফিল্ম পরিচালক আইজেনস্টাইনের সিনেমায়, একটু অন্যভাবেই ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন।

১৯১৭-র ৭ নভেম্বর নভেম্বর বিপ্লব দিবস। পুরনো ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী অক্টোবর, ফলে কেউ কেউ অক্টোবর হিসাবটাও মাথায় রেখে দেন। যদিও অক্টোবর বিপ্লব বা অকতুবর কান্তি বলতে চীন বিপ্লবই, ১ অক্টোবর তারিখটি বেশি করে চিহ্নিত। ১৯৪৮-এর ১ অক্টোবর।
১৯৭০-৭১-এ নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী জনেরা অনেকেই গেয়ে উঠতেন—
‘আজ অক্টোবর বিপ্লবের পুণ্যদিন
আজ অক্টোবর বিপ্লবের পুণ্যদিন
এনেছে এদেশে নতুন স্বপ্ন
লাল চীন, মহান চীন
আজ অক্টোবর বিপ্লবের পুণ্যদিন
মাও-সে-তুঙের চিন্তাধারা
লাল দিবাকর
শোষিতের হাতে শোষক মরে
বিশ্ব চরাচর
মাও-সে-তুঙের চিন্তাধারা
লাল দিবাকর
শোষিতের হাতে শোষক মরে
বিশ্ব চরাচর
রেডবুক আর রাইফেল
অগ্নি আর বীণা
রেডবুক আর রাইফেল
অগ্নি আর বীণা
তাইতো বাজে অগ্নি বিণ
অগ্নি বিণ অগ্নি বিণ...’

এই গান খণ্ডিত না হওয়া সিপিআই (এম-এল)-এর সভা-সমিতি, স্কোয়াড, স্ট্রিট কর্ণারিং, ছোট মিছিলেও বার বার গেয়ে ওঠা হত। জেলে, থানা লক-আপেও।
‘মুছে যায়?’-এর সতেরো নম্বর সংখ্যায় ধাসা-কামান, চাবি-কামান, হাত-কামান, বারুদ— গান পাউডার, বারুদের ব্যবহার ও তৈরি করার পদ্ধতি খানিকটা খানিকটা বলেছি, কালীপুজোর বাজির মশলার সূত্র ধরে। এইসব ‘পুরনো কাসুন্দি’ ঘাঁটতে ঘাঁটতে যাদবপুর, যাদবপুরে হাত-কামান বা ধাসা-কামানের ব্যবহার নিয়ে লিখলাম, পুলিশ ভ্যানের বিরুদ্ধে।

‘হিন্দুস্থান’-এর তৈরি ভারী, মজবুত, গামবাট কালো পুলিশ ভ্যান। কেমন যেন ভোঁতা চেহারার। যাদবপুরে নকশালপন্থী ছাত্র-যুবরা ব্যবহার করেছিলেন হাত-কামান এই পুলিশের গাড়ির বিরুদ্ধেই।

ধু-উ-উ-ড়ুম— ধু-উ-উ-ড়ুম— হলদে গন্ধক, সাদা সোরা আর শুকনো কুলকাঠ, বড়জোর মাদার কাঠে তৈরি কালো কালো কাঠকয়লা, সাদা সোরা মিশ্রণের পর ধ্রুপদী বারুদে আর আগুনের হ্যানডশেকে বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ। যা কারও কারও হ্যানড ছুট করে দিয়েছে অনেক সময়। মুণ্ডুও।
হাত-কামানের আরও বড়ো— বলতে গেলে ‘রাজ সংস্করণ’ তৈরি হয়েছে সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায় দক্ষিণ কলকাতার কসবা ও টালিগঞ্জে। তখন ময়দানে গট আপ ফ্রিস্টাইল কুস্তি লড়ে দারা সিং আর কিংকং। দারা সিংয়ের ব্যায়াম করা কাটিং— শক্তপোক্ত বডি। কিংকং খানিকটা থলথলে। তখন মাঝ সমুদ্রে জাহাজের ভেতর সি পি আই (এম-এল)-এর ‘স্বাধীন বেতার কেন্দ্র’ ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’ বাজিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন চারু মজুমদার। সি পি সি— চীন কমিউনিস্ট পার্টির কাছে তাঁর অনুরোধ— ‘স্বাধীন বেতার কেন্দ্র’— ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’ চালু করার বায়না। সেটা ১৯৭০ সাল। ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনে তৈরি হয়েছে সি পি আই (এম-এল)। মনুমেন্ট ময়দানে তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে ১৯৬৯-এর পয়লা মে— মে দিবসে।

অসুস্থ চারু মজুমদার স্বপ্ন দেখছেন ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’-এর সম্প্রচার শুরু হচ্ছে ১৯৭০-এর মে-দিনে, ১ মে। চীন কমিউনিস্ট পার্টি রাজি হয়নি, এভাবে ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’-এর সম্প্রচার বাস্তবায়িত করতে। তারা কোনো চেষ্টাই করেনি এ ব্যাপারে। বরং ‘পার্টি টু পার্টি’ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’ চারুবাবু যেভাবে চাইছেন, তা একেবারেই সম্ভব নয়।

‘লাল’-অরোরার কামান ঝংকার, সি এম— চারু মজুমদারের চীন কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় ‘ভয়েস অফ শ্রীকাকুলাম’-এর ব্রডকাস্টিং শুরু হওয়ার পরিকল্পনা, স্বপ্ন, দেওয়াল লিখন— সবটাই মনে পড়ে যায় ৭ নভেম্বর এলে।

মনে পড়ে ভারতবর্ষ, তথা পশ্চিমবাংলার সমস্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, তা সে সি পি আই, সি পি আই (এম), সি পি আই (এম-এল), আর এস পি, এস ইউ সি, আর সি পি আই, আর এস পি (এম-এল), বলশেভিক পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি, কমিউন, ফরোয়ার্ড ব্লক, এম সি সি— সবাই নভেম্বর বিপ্লব দিবস, ৭ নভেম্বর তারিখটি নিজেদের ‘ধর্মে’ পালন করেন। যদিও ওয়াকার্স পার্টি, বলশেভিক পার্টি, আর এস পি (এম-এল), এম সি সি-মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র, কমিউন কারওরই প্রায় অস্তিত্ব নেই। অথবা থাকলেও আছে— ‘সাক্ষী সাইনবোর্ড’।

বলশেভিক পার্টির বরদা মুকুটমণি ছিলেন ঐ দলের বড় নেতা, ওয়াকার্স পার্টির জ্যোতি ভট্টাচার্য ছিলেন শিক্ষাবিদ। বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ আছে তাঁর, অধ্যাপনা করতেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রীও হয়েছিলেন এই সুবক্তা জন। বরদা মুকুটমণি বলশেভিক পার্টির শ্রমিক সংগঠন করতেন কলকাতা বন্দরে। ষাট দশকে কলকাতায় অনেক বিদেশী জাহাজ, যায়, আসে। জাহাজের ভোঁ।

আর এস পি (এম-এল) তৈরি হয়, আর এস পি-র ভেতরে বিপ্লব কখন করতে হবে, ইত্যাদি বিতর্কে। ডালহাউসির অফিস পাড়ায় আর এস পি (এম-এল)-এর প্রচুর দেওয়াল লিখন চোখে পড়ত। এই দলের ছেলেমেয়েরা তাত্ত্বিকভাবেই জোসেফ স্তালিন বিরোধী, লিও ট্রটস্কির প্রতি শ্রদ্ধাবান। এঁদের নেতারাও তাই। সত্তর দশকের প্রায় শেষ পর্বে ওঁরা উত্তরবঙ্গের প্রান্তদেশে গোপন সংগঠন, সশস্ত্র গেরিলা ফৌজ ও গেলিরা যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ‘বিল্পব প্রয়াস’ ব্যর্থ হয়। আর এস পি (এম-এল) তাঁদের সদস্যরা নানা দলে যোগ দেন। স্বাভাবিক নিয়মে অনেকে ‘বসে’ যান।

ভেঙে যাওয়া সি পি আই (এম-এল)-এর নানা খণ্ডাংশ আলাদা আলাদাভাবে নভেম্বর বিপ্লব দিবস পালন করতে থাকে।

মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র— এম সি সি, জঙ্গলে তাদের গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া যে ঘাঁটি এলাকা গেরিলা বেস— সেখানে মে দিবস, নভেম্বর বিল্পব দিবস, শহিদ দিবস ইত্যাদি পালন করতে থাকে। শত বিভক্ত সি পি আই (এম-এল)-এর একটি টুকরো পি ডব্লু জি— পিপলস ওয়ার গ্রুপ, তারাও অন্ধ্রের জঙ্গলে নিজস্ব রীতিতে নভেম্বর বিপ্লব দিবস, মে দিবস, চীন বিপ্লব দিবস, শহিদ দিবস পালন করে থাকে, সশস্ত্র দলম-এর— আর্মড স্কোয়াডের উপস্থিতিতে।

পরে এম সি সি, সি পি আই (এম-এল)/ পার্টি ইউনিট ও পিপলস ওয়ার গ্রুপ— পি ডব্লু জি এক হয়ে গিয়ে সি পি আই (মাওবাদী) তৈরি হলে তখন সি পি আই (মাওবাদী)-র সশস্ত্র স্কোয়াড বা দলমের উপস্থিতিতে অরণ্য গভীরে নভেম্বর বিপ্লব দিবস, মে দিবস, শহীদ দিবস, চীন বিপ্লব দিবস ইত্যাদি পালন করে হয়।

মাওবাদীদের মুখপত্র ‘পিপলস মার্চ’-এ এইসব প্রতিবেদন বেরত একসময়। ওয়ার্কাস পার্টির কাগজ ছিল ‘ডেমোক্রেটিক ভ্যানগার্ড’। সম্পাদক ছিলেন জীবনলাল গঙ্গোপাধ্যায়— নামটা ঠিক লিখলাম তো? উনি ছিলেন স্বাধীনতা যোদ্ধা। মনে পড়ছে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘ওয়ার্লড টু উইন’-এর কথাও। কমিউন গ্রুপের দেওয়াল লিখন দেখেছি আলিপুর চিড়িয়াখানার আশেপাশে। তারা পরিবার পরিকল্পনা— ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখত দেওয়ালে দেওয়ালে, আলকাতরা দিয়ে।

আবার ফিরে আসি হাত-কামান, আফগানিস্থানে সি আই এ ও আই এস আই-এর মদতে তৈরি মুজাহিদিন ও তালিবানরা যে ধরনের রকেট লঞ্চার ব্যবহার করতে শুরু করে, দখলদার রেড আর্মির বিরুদ্ধে, তা অনায়াসে একজন ঘাড়ে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সোভিয়েত হেলিকপ্টার বা আর্মি কনভয়, অতি শক্তপোক্ত আর্মাডা, ওড়াতে এর ভূমিকা অদ্বিতীয়। সাঁজোয়া গাড়ি প্রায় আকাশে উঠে যায়, রকেটের আক্রমণে।

শ্রীলঙ্কাতেও আটের দশকে তামিল উগ্রপন্থী সংগঠন, এল টি টি ই— ভেনুপিল্লাই প্রভাকরণের নেতৃত্বে যারা জাফনার বাইরে বেরিয়ে এসে শ্রীলঙ্কার সৈন্য ও পরে ভারতীয় সেনাদের ওপর— যারা মূলত পরচিত ছিল আই পি কে এফ— ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স হিসাবে, তাদের ওপর রকেট দাগবার জন্য, তারাও এই ধরণের সহজে বহনযোগ্য কাঁধ-কামান ব্যবহার করতে থাকে। এছাড়াও এল টি টি ই মাইন, বুগি ট্র্যাপ আর ডি এক্সের মাধ্যমে বিস্ফোরণ বৈচিত্র আনে। ব্লাস্টকে আরও বিধ্বংসী আরও শক্তিশালী করে।

প্রভাকরণের নেতৃত্বে এল টি টি ই অন্যান্য মুক্তিবাদী তামিল সংগঠনের নেতৃত্ব ও সশস্ত্র কর্মী, সমর্থকদের হত্যা করে নির্দ্বিধায়। পরে প্রভাকরণও নিহত হন, প্রবল ঘেরাও দমনের মধ্যে। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এই নিকেশ ও নির্মূলীকরণ অভিযান চালায়। ভেনুপিল্লাই প্রভাকরণ নাকি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অনুরাগী ছিলেন।

এভাবেই অতি নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় তামিল-টাইগারদের। যেভাবে সত্তর দশকে শ্রীলঙ্কায় ট্রটস্কিবাদীদের সংগঠন জনতা ভিমুক্তি পেরামুনাকে দমন করা হয় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের শাসনকালে। শ্রীমতি বন্দরনায়েকে চিনের সহায়তা নেন জেপিভিপি পেরামুনার শসস্ত্র বিদ্রোহকে দমন করার জন্য। বিমান, অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সিরিমাভোর সরকারকে সার্বিক সাহায্য দেয় মাও-সে-তুঙের চীন। চৌ-এন-লাইয়ের চীন।

এল টি টি ই-র চাপে ও আক্রমণে অন্যান্য তামিল সংগঠন প্রায় নিশ্চিহ্ন অথবা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

পুনরায় হাত-কামান প্রসঙ্গে ফিরি। তার আগে বলেনি, পর্তুগিজ, ইংরেজ, ফরাসিরা যে কামান তৈরি করত, তা ব্যবহার হয় বিভিন্ন ভারতীয় যুদ্ধে। পর্তুগিজ ‘হার্মাদ’ ও যুদ্ধজীবীরা ছোট, সরু কোশা নৌকোয় অতি হালকা, ছোট কামান নিয়ে পূর্ববঙ্গের নদীনালা, খালে একচ্ছত্র অভিযান চালাতে থাকে। স্থানীয় জমিদারদের মধ্যে যে লড়াই, সেখানেও তারা কেউ কেউ কোনো এক পক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে। এই সব পেশাদার যুদ্ধবাজদের কথা উঠে এসেছে বাঙালির নাটকে, স্মৃতি চিত্রণে।

চাঁদ রায়, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, ঈশা খাঁ, যশোর, ঘূমঘাট, যশোরেশ্বরী, সম্রাট আকবর, তাঁর সেনাপরি মানসিংহ’র সঙ্গে জড়িয়ে গেছে পর্তুগিজ যুদ্ধ বিশারদ কার্ভালোর নামও। বাংলার বারো ভুঁইয়ার বীরত্ব গাথা, যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে মিশে গেছে কার্ভালোর নাম। যেমন সিরাজউদ্দৌলার ফরাসি গোলন্দাজদের নাম জড়ামো আছে মীরমদন, মোহনলালদের বীরত্ব গাথার সঙ্গে। ফরাসি সেনাপতি মঁসিয়ে লালির নাম থেকে গেছে ভারতের ইতিহাসে। মহীশূরের শাসক হায়দার আলি বা হৈদর আলির সঙ্গে, হায়দার পুত্র টিপু সুলতান, শ্রীরঙ্গপট্টমের একাধিক যুদ্ধ’র সঙ্গে মিশে আছে টিপুর ফরাসি সেনাপতি ও তাদের কামানের কথা।

ইংরেজ-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধে শ্রীরঙ্গপট্টম বা শ্রীরঙ্গপত্তমে টিপু রকেট ব্যবহার করেছিলেন, এটা ইতিহাস বলে। আর সেই রকেট তৈরি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় কারিগরি টেকনোলজিতে।

হাত-কামান নিয়ে কথা বলতে বলতে একটি কথা বলা অত্যন্ত জরুরি, আর তা হল, এই হাত দিয়ে ফাঁপা, ফাঁকা লোহার নলে বারুদ ঠাসার পর কোনো একটি দেওয়ালে ঠেকনো— ভরসায় তাকে রেখে বারুদমাখা পলতেয় আগুন দিলে অনেক সময়ই লোহার নল ধমাকায় ফেটে গিয়ে একেবারে যাকে বলে চিত্তির।

হাত-কামানে আগুন দেওয়ার পর ব্যাকফায়ার হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ঘেঁষ-চুন-ইট বা সুরকি-চুন-ইটে গাঁথা বা সিমেন্ট-বালির ভুলভাল মিশেলে তৈরি ফঙ্গবেনে— পলকা দেওয়াল হলে হাত-কামানের বিপুল ব্যাকফায়ারে তার পতন— ধসে পড়া একেবারে নিশ্চিত।

দক্ষিণ কলকাতার কসবায় ব্যবহার করা হয়েছিল হাত-কামান, পুলিশভ্যান ওড়াবার জন্য। শোনা যায় এই ‘অ্যাকশন’ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনও জীবিত। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।

কসবা এমনিতেই তখন আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ক্ষেত্র। কংগ্রেসের হাত মাথায় নেওয়া হাতকাটা দেবা খুন হল। অভিযোগ নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা তাকে খুন করেন। দেবা অতি কুখ্যাত মাস্তান, এরকমও বলা হয়ে থাকে তার সম্বন্ধে। বলতে পারব না, তা কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে।

ষাটের দশকে বেলঘরিয়ার ইনু মিত্র কংগ্রসের হয়ে হেক্কুড়ি করত। তার পাল্টা হিসাবে ননী সাহাকে মদত দিতে থাকে বামপন্থীরা। এই দুটি বাক্যেরই সত্য, মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো দায় আমার নেই। তখনকার দৈনিক পত্রিকা তো তা বলে। তখন বাজারে মাস্তানির প্রতিশব্দ গুণ্ডামি, হেক্কুড়ি, রমজানি, রোস্তমি বা রুস্তমি।

এছাড়াও জয়হিন্দ মুখার্জি, টুপি-কাশী, লগনদেও সিং, মদন সিং, কেবল সিংদের নাম ‘বাহুবলী’ হিসাবে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। যদিও ‘বাহুবলী’ শব্দটাই বাংলার রাজনৈতিক শব্দকোষে জায়গা পায়নি তখনও। ননী সাহা এবং ইনু মিত্তির দুজনেই খুব ভালো স্টেনগান চালাতে পারত। এটাও শোনা কথা। বেলঘরিয়াকে তখন ‘বুলগেরিয়া’ বলে ডাকা শুরু হয়। একে ফর্টি সেভেন, একে ফিফটি সিকস, ইনস্যাস রাইফেল আসেনি বাজারে। স্টেনগানই তখন প্রধান অটোমেটিক বন্দুক। স্টেন ব্যবহার করত আর্মি। তা চোরাপথে চলে আসত বাইরে। ইনু মিত্তির, ননী সাহা— যাকে ননী সা বলা হত শর্ট ফর্মে, তাদের ‘সময়’ আসার একটু আগে গোপাল পাঁঠা, ভানু বোসদের নাম ছড়ায় ‘বাহুবলী’ হিসাবে।

ভানু বোস জলসা করানোর ব্যাপারে বিখ্যাত ছিলেন। বোম্বে-বাংলা, সব তাঁর পকেটে। এমনকি মহানায়ক উত্তমকুমারও। বোম্বাই বা বম্বে থেকে ফিল্মস্টার, গায়ক আনতেন ভানু বোস। তাঁর মুখের ওপর না বলার সাহস শুনেছি কারও ছিল না। তখনও বোম্বাই বা বম্বের মুম্বাই নাম পেতে বহু বছর বাকি। ভানু বোসের মাথায় জাতীয় কংগ্রেস, বিশেষ করে অতুল্যবাবু— অতুল্য ঘোষের ছাতা ছিল এমন শোনা যায়। সত্যি, মিথ্যে জানা নেই।

গোপাল পাঁঠা নাকি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, পরে দাঙ্গার সেনাপতি। এরকমই শুনেছি। ওঁদের পরে উত্তর কলকাতার আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের ফাটা কেষ্ট, গৌরীবাড়ির হেমন মণ্ডল।

গোপাল পাঁঠার বাস্ট মূর্তি বসেছে দেখেছি ‘হিন্দ’ সিনেমা আর এবিটিএ ভবনের উল্টোদিকে। সম্ভবত প্লাস্টার অফ প্যারিসের। ভানু বোস, গোপাল পাঁঠা সহ তখনকার অনেকেরই ছিল একটা ‘রবিন হুড’ ইমেজ। পরে তাঁরা অনেকেই ‘রত্নাকর’ থেকে ‘বাল্মীকি’।

আগেই লিখেছি কসবা, যাদবপুরে বারুদ ঠাসা হাত-কামানের ব্যবহার হয়েছিল পুলিশ ভ্যান ওড়াতে, সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায়। লোহার শক্ত-পোক্ত ফাঁপা নল, তাতে ছিদ্র করা, সেই সঙ্গে পলিতা, আগুন— ধু-উ-ড়ু-ম। এমন কি সত্যি মিথ্যা বলতে পারব না, কোথাও কোথাও রাস্তার পাশে ঘাড় কাত হয়ে যাওয়া ‘মরা’ ল্যাম্পপোস্টকে দিয়ে হাতকামানের আধার-খোল তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন যুব-ছাত্ররা।

কালীপুজো বা অন্য উৎসবে ‘ছটাকি’, ‘সেরি’ খোলের কথা আগেই বলেছি। পোড়া মাটির খোল, অনেকটা দেখতে যেন ওলটানো হাঁড়ি। ‘মুনকে’ খোলের কথা শুনেছি, তাতে নাকি এক মণ বারুদ ধরে।

বাতিল ল্যাম্পপোস্টকে ‘দেশী’ কামান করে তুলতে নাকি প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না কোনো। লুঠ করা বন্দুক থেকে অনেক বেশি কঠিন কাজ কামান লুকিয়ে রাখা। সে কথায় আর বিস্তারে যাচ্ছি না।

যাদবপুরে যখন হাত-কামানের ব্যবহার হচ্ছে, তখন নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী যুব-ছাত্রনেতা আশু মজুমদার বেঁচে। যতদূর শুনেছি সি আর পি-র হাতে শহিদ না হলে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলির যা বয়স, সেই বয়সটুকুই হত তাঁর। আশু মজুমদারকে হত্যা করে সি আর পি। তখনও তা সি আর পি এফ হয়নি।

সেদিন ছিল সাধারণ নির্বাচন। সম্পূর্ণ এলাকা ঘিরে ফেলে সি আর পি।

সোভিয়েত বিপ্লব দিবসের কথায় আবার ফিরি। নভেম্বর বিপ্লব মানেই কমসোমল। অনেক পরে হিটলারের নাজি বাহিনীর প্রতিরোধে এক বেহালাবাদক বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে নির্মিত ছবি, ‘বাহাদুর ছেলে’, বাংলার ‘ডাব’ করা ছবি মনে পড়ে। এসেছিল কলকাতার সত্তর দশকের শেষে।

সোভিয়েত বিপ্লব— নভেম্বর মাস মানেই সাপ্তাহিক ‘দেশব্রতী’, ‘দেশহিতৈষী’-র বিশেষ সংখ্যা। সেই সঙ্গে ‘গণদাবী’, ‘গণবার্তা’, ‘গণশক্তি’ আর ‘কালান্তর’-এরও। ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’, ‘প্রোলেতারিয়েন এরা’, ‘কমসোমল’-এর বিশেষ সংখ্যা। নভেম্বর বিল্পব মানে ‘লেনিনের মাস’। বিপ্লবের মাস।

নভেম্বর এলে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’, ‘ফল অফ বার্লিন’, ‘এনিমি অ্যাট দ্য গেট’ ইত্যাদি সিনেমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে নানা সোভিয়েত ডকু ফিচারের কথা যা দেখান হত নভেম্বরে, কলকাতার গোকি সদনে। সোভিয়েতে ছাপা বইতে প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স— প্রগতি প্রকাশন রাদুগা মির-এর ছাপা সহ সব বইতে বিপুল ছাড় দিচ্ছে ‘মনীষা’।

তবু প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ, জার নিকোলাসের সমস্ত নাবালক সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করা কি বিধেয় ছিল? বলশেভিকরা শীত প্রাসাদ— উইন্টার প্যালেস দখলের পর এই রক্তপাত।

সোভিয়েত বিপ্লব মানে ‘ইসকাস’। সোভিয়েত বিপ্লব মানে নভেম্বর মাসে ধর্মতলার লেনিন মূর্তির গলায় মালা। চিটির পিটির টুনি ল্যাম্প, কলকাতায় তখন একটু বেশি শীত। চিড়িয়াখানায় পরিযায়ী পাখিরা আসে অনেক, অনেক। সেই সঙ্গে ভুটিয়ারা আসেন তাঁদের সোয়েটার, স্টোল, কার্ডিগান, জাম্পার, পঞ্চু নিয়ে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে।

ধর্মতলায় লেনিন জাগেন। তখন অটুট সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই মূর্তির দেখভাল, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁদের। তখন ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’— ‘কোল্ড ওয়ার’-এর যুগ।

নভেম্বর বিপ্লব মাসে ‘সোভিয়েত দেশ’, ‘সোভিয়েত নারী’, ‘সোভিয়েত ল্যানড’-এর বিশেষ সংখ্যা। সেই সব পত্রিকার চকচকে মোটা পাতা দিয়ে চমৎকার ছুঁচো বাজির খোল তৈরি করা যায়। আমেরিকানদের ‘স্প্যান’ থেকে তৈরি করা যেত এই ছুঁচো খোলস। ‘সোভিয়েত লিটারেচার’-এরও বেরত কি, স্পেশাল নাম্বার?

আশির দশকে বামফ্রন্ট জমানায় নতুন নতুন পাকা পার্টি অফিস। সি পি আই (এম), সি পি আই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আর এস পি-র উদ্যোগে সেখানে নভেম্বর বিপ্লবের ছিক-ছ্যাক, টুনি বাল্ব, চেন। এসব দেখে নিন্দুকে বলছে, ‘লেনিন পুজো হচ্ছে’।

আমার বাবা এই টুনি— লাল বাল্বের রোশনাই দেখে বলতেন, আচ্ছা এইসব পার্টি অফিস কমিয়ে হাসপাতাল— ছোট স্বাস্থ্য কেন্দ্র হতে পারে না। চারটে বেড। একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা। তখনও চীনা টুনি এভাবে দখল করতে পারেনি বাজার।

বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার কানে বাজছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনের সার সংক্ষেপ— যতদিন না রাশিয়ার সব শিশুরা কমলালেবু খেতে পেরেছে, ততদিন কমলালেবু খাননি লেনিন।

সঙ্গে সঙ্গে কানে ঘুরে ঘুরে এসে বাজে একটা গান—
‘ভেদি অনশন, মৃত্যু, তুষার ও তুফান
প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল
কমরেড লেনিনের আহ্বান
চলে মুক্তি সেনাদল
কমরেড লেনিনের আহ্বান
চলে মুক্তি সেনাদল
থ্রু দ্য উইন্টার কোল্ড অ্যানড ফেমিন
ফ্রম দ্য ফিল্ডস অ্যানড ফ্রম দ্য টাউন
অ্যাট দ্য কল অফ কমরেড লেনিন
দে আর আর অ্যারাউজ অফ পার্টিজান
নিশ্চিহ্ন হল শত্রু সৈন্য
জাহান্নামে শত্রু বিলীন
প্রশান্ত সাগরের তীরে
শ্রমিক পতাকা উড্ডীন
প্রশান্ত সাগরের তীরে
শ্রমিক পতাকা উড্ডীন...
দে ডেস্ট্রয়েড হোয়াইট গার্ড ফোর্সেস
অ্যানড টু হেল দ্য...

‘সোভিয়েত তারা যেখানে দিচ্ছে আলো/ প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো’। লিখেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। আজ তো— বহু বছর হল বিশ্ব মানচিত্রে সোভিয়েত দেশটাই নেই।
নেই।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor