মুছে যায়? – ১৭
আগের পর্বে
পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে মিষ্টির যোগ। ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তার বাড়িতে মা বানাতেন কুচো নিমকি, কুচো গজা, পেরাকি। নিজে হাতে। সেসব ভাজা হত ডালডায়। নিরঞ্জনের পরেই মিষ্টিমুখ। ছিল সিদ্ধির শরবত অথবা ভাঙের গুলির চল। বাঙাল বাড়িতে তৈরি হত তিল ও নারকেলের নাড়ু। কাকিমা রেণু রায় নাড়ু বানাতেন, সঙ্গে তক্তি। আমাদের বালির বাড়িতে চল ছিল আমিষ ও নিরামিষ দুই ধরণের ঘুগনিরই। শাশুড়ি মা আশালতা দেবী বিজয়া দশমীতে তৈরি করতেন কুচো গজা, কুচো নিমকি, জিবে গজা, লবঙ্গ লতিকা। তাছাড়াও ময়রার দোকান থেকে রেডিমেড আসত নারকেল ছাবা, কুচো গজা, ক্ষীর, চন্দ্রপুলি, মিহিদানা, বোঁদে। বিজয়ার মুখমিষ্টির সেই আলোচনার পর আজ শুরু হচ্ছে নতুন পর্ব...
শক্ত-পোক্ত কোনো ইটের দেওয়ালের গায়ে সামান্য মাটি খুঁড়ে লোহার ফাঁপা নল, যা লম্বায় বড়োজোর হাত খানেক, বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। লোহার তৈরি ঢালাই করা নল, তার গায়ে তিনটে ফুটো, সেখানে হাতে তৈরি বারুদ মাখানো পালতে ফিট করা। বারুদ বলতে ক্লাসিকাল বারুদই— সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা, পরিমাণ অনুযায়ী মিশিয়ে নিয়ে, কালো রঙের গান পাউডার।
কাঠকয়লা তৈরি হয় কুলকাঠে। শুকনো— খটখটে বড়ুই কাঠ— মানে সরু মোটা কুলের ডালপালা শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে গর্ত করে সামান্য ধু ধু আগুন জ্বেলে তারপর কাঠের তক্তা, শুকনো বালি আর মাটি চাপা দেওয়া। বেশ কিছুক্ষণ থাকলে ভেতরে জেগে উঠছে, বেড়ে উঠছে, তৈরি হচ্ছে চারকোল— কাঠকয়লা।
আদি পদ্ধতির বারুদ তৈরি করতে গেলে এইসব উপাদান অবশ্যম্ভাবী। কাঠকয়লা মশল্লা— বাটনাবাটা শিলের উল্টোদিকে বাটতে হবে, মিহি করার জন্য, তার আগে লোহার হামানদিস্তায় তাকে ভালো করে কোটা। কুলগাছের কাঠকয়লা দারুণ। কালো, সৌন্দর্যময়। এই বাটা, কোটা সবই খুব পরিশ্রমের। বাড়ির মেয়েরাও কালো কাঠকয়লা, হলুদ গন্ধক— সালফার, শাদা পটাশ, শাদা সোরা, সব বাটতেন। সব বাড়িতে নয়, যেখানে যেখানে— মানে যে বাড়িতে বাড়িতে বাজি তৈরি করার অভ্যাস আছে, প্রতিবছর দীপাবলিতে, রঙমশাল, বসন তুবড়ি, উড়ন তুবড়ি, যূঁই, সব আলো আর আগুনের বাজি, শব্দ নেই। কিন্তু এ ভয়ানক কোভিড বেলায় বারুদ পোড়ানো আতশবাজির ধোঁয়া, তা প্রতি ক্ষেত্রেই কালান্তক। শ্বাসের কষ্ট। করোনা আক্রান্ত বা করোনা পেরিয়ে আসা মানুষদের ক্ষেত্রে তা শমন তুল্য। ফলে বাজি নয়, বাজি নয়। কোনো বাজিই নয়, রকেট, দোদমা, একদোমা, রঙমশাল, সাপবাজি, ফুলঝুরি, হাত-চরকি, ভুঁই-চরকি, মনো রেল, চকোলেট বোমা, কালি পটকা, ধানি পটকা, আলু বোমা, পান পটকা, ক্যাপ, বসন তুবড়ি, উড়ন তুবড়ি, দিনতার, সব বাদ।
দক্ষিণের শিবকাশি, বেলুড়ের বুড়ি মা-র চকোলেট বোমা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাজি— বাজির কারখানা, স্যরি। স্যরি।
আরও পড়ুন
পুজোর মিষ্টি, খাবার – রেডিমেড, হোমমেড
আমি শুধু ধাসা-কামান, হাত-কামান, চাবি-কামান— সবই আলাদা নামে এক বস্তু, তার কথাই বলি, ইতিহাস ধরে রাখার জন্য। নাহ, কোনো হা-হুতাশ, দীর্ঘশ্বাস নেই এঁদের জন্য, বরং তার বদলে যা আছে তা হল, সময়টাকে রেকর্ড করে রাখা।
ধাসা-কামানের যে কামানত্বটুকু, অর্থাৎ লোহার খোল— মানে লম্বাটে পাইপটি, তাতে বড়জোর খান তিনেক ফুটো, তার ভেতর সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা মিশেল, কালো রঙের বস্তুটি গাদান। ঠেসে ঠেসে গাদাতে থাকা। আমাদের পুরনো গাদা বন্দুকের আরও প্রিমিটিভ সংস্করণ।
আরও পড়ুন
পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য
মনে আছে নিশ্চয়ই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য ঐতিহাসিক রোমান্স ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ তো বাহমনী রাজ্যের আক্রমণকারী সৈন্যদের সংকীর্ণ গিরিপথে আটকে দেওয়ার জন্য বাংলার— অর্থাৎ বঙ্গের বিষ্ণুপুর থেকে বিজয়নগর চলে যাওয়া বলরাম কীভাবে কীভাবে যেন তৈরি করে হাত-কামান বা ধাসা-কামান।
বিষ্ণুপুর থেকে বিজয়নগর যাওয়া ভাগ্যান্বেষী বলরাম কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা নিশ্চয়ই এই প্রসঙ্গে মনে করব বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের আমলে তৈরি ‘দলমাদল’ কামানের কথা। যে কামান, বাঙালির কারিগরি বোধের গৌরব হিসাবে আজও দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপুরে।
আরও পড়ুন
ব্লেড, ক্ষুর, রক্তপাত...
‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ নামক হিস্টোরিক্যাল রোমান্সে বিষ্ণুপুরের ভূমিপুত্র বলরাম তার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় আক্রমণকারী বাহমনী সেনাদের পর্যুদস্ত করে অতি সংকীর্ণ পাহাড় পথে— সুরঙ্গ গভীরে হাত কামান ডাকিয়ে— বাজিয়ে। বাংলার কারিগরি মেধাকে এ ভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন শরদিন্দু এই আখ্যান নির্মাণে।
এই আখ্যানে অর্জুন বর্মা আর একটি বিখ্যাত চরিত্র। তিনি রনপার ব্যবহার জানেন। তাঁর রনপা আছে। ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত গতিতে যাওয়া যায়, এই বাঁশের রনপা চেপে। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-তে আবার তা অস্ত্র বিশেষ। দুই রাজকন্যা মনিকঙ্কনা আর বিদ্যুন্মালার সঙ্গে আছেন চিপিটক, মন্দোদরী, বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়, মৃত দুই ভাই হরিহর ও বুক্কা, যাঁদের আত্মা শরীর গ্রহণ করে দেখা দেয় বিজয়নগরের সংকটকালে, সবই দারুণ।
আরও পড়ুন
ট্রেঞ্চ, সাইরেন, অলক্লিয়ার
বিজয়নগরে জেগে থাকে আলোকিত মশাল, দিবারাত্র।
উড়িষ্যা থেকে বড় বহিত্র যাত্রা করেছেন দুই রাজকয়া মণিকঙ্কনা ও বিদ্যুন্মালা, বজয়নগর অধিপতি বীর কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তাঁরা আবদ্ধ হবেন বিবাহবন্ধনে। সে এক দীর্ঘযাত্রা, জলপথে। তারপর পথে ঝড়।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নানা আখ্যানে বারুদ, উন্নততর অস্ত্র, বিষ ইত্যাদি প্রভৃতির সুনিপুণ ব্যবহার করেছেন বারে বারে। ব্যোমকেশ বক্সির গোয়েন্দা কাহিনীতে শুধুমাত্র নয়, তিনি তাঁর হিস্টরিক্যাল রোমান্সেও বজায় রেখেছেন এই ধারাবাহিকতা। তাঁর আর একটি অতি বিকঝ্যাত আখ্যান ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এ হাতবোমা-বন্দুকের ব্যবহারের কথা রয়েছে। আছে বন্দুক নির্মাণে বারুদের ব্যবহার। বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, যিনি আসলে ছিলেন অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগে ঢাকার বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা, তিনি পরে তিব্বত চলে যান, সেই সময়কার তিব্বতে, তারপর তাঁর অনুগামীরা বৌদ্ধবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাতে ধোঁয়া-শব্দ ও আগুনদার বন্দুক ব্যবহার করে। সেই প্রাচীন হাতবোমা, যার ভেতর নিহিত বারুদ— সবটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন তাঁর চিত্রময়, সাধু ঘেঁষা চমৎকার বাংলায়। তৎসম শব্দের কি নিপুণ ব্যবহার এই আখ্যানে। প্রেত হয়ে যাওয়া হুক্কা-বুক্কা— হরিহর–বুক্কা রায় বিজয়নগরের বিপদ সম্ভাবনা উপস্থিত হলেই দেখা দেন আগেভাগে, সে তো আগেই বলেছি।
এত গেল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আখ্যান ও বোমা-বারুদের কথা। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে একটি সিনেমা দেখেছিলাম বাল্যকালে। হয়তো সিনেমার নাম ‘গোপাল ভাঁড়’-ই হবে।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ ও প্রিয় বয়স্য গোপাল ভাঁড়কে দিয়ে চাবি কামান ব্যবহারের একটা দৃশ্য ছিল সেই সিনেমায়। বেশ মজাদার সেই দৃশ্য। চাবি, হাত কামান— সবই প্রায় কাছাকাছি ডিজাইনের। চাবি কামানের শেপ সামান্য অন্যরকম।
অনেকটা যেন বাঁশের বাঁশি চেহারার ধাসা কামানকে সত্তর দশকে নকশালপন্থীরা অন্যভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। বিশেষ করে জাদুগোড়ায়। অখণ্ড বিহারের ঘাটশিলা লাগোয়া জাদুগোড়া। জঙ্গল। রঙ্কিনী মন্দির। কাছাকাছি রাকা মাইনস— মাইকা মাইনস— অভ্রখনি। সেখানে বেড়াতে যান বাঙালি ট্যুরিস্ট। স্বাস্থোদ্ধারে আসা বাঙালি ‘ড্যানচি বাবু’, যাঁরা কথায় কথায় সব কিছুতেই ড্যাম চিপ বলে ওঠেন, এইজন্য লোকাল লোকজন তাঁদের বলেন ‘ড্যানচি’ বা ‘ড্যাঞ্চিবাবু’।
জাদুগোড়ায় তাঁর দলের মধ্যে ‘ওল্ডগার্ড’ হিসাবে পরিচিত ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল চট্টোগ্রাম যুব বিদ্রোহ খ্যাত অনন্ত সিংহ ও তাঁর দলের লোকেরা— বিদেশিনী মেরি টাইলার, টাইলার ও অমলেন্দু দাশগুপ্ত, তাঁরা বিবাহ করেছিলেন। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন অমলেন্দু। বিদেশেই তাঁর আলাপ মেরি টাইলারের সঙ্গে। টাইলার গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর হাজারিবাগ জেলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছেন— ‘মাই ইয়ারস ইন অ্যান ইনডিয়ান প্রিজন’। এই সংগঠনকে ম্যান মানি গান বলা হত, তখনকার না ভাঙা সি পি আই (এম এল)- এর পক্ষ থেকে— এম এস জি। যদিও তাঁদের কর্মকাণ্ডকে কমিউনিস্ট পার্টি – বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্ম বলে দাবি করতেন ‘ওল্ড গার্ড’ অনন্ত সিংহ ও তাঁর কমরেডরা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে টাইলার দেশে ফিরে যান। ওঁরা চেয়েছিলেন লংমার্চ করে জাদুগোড়া থেকে কলকাতা চলে আসার। খানিকটা যেন আর সি পি আই— অখণ্ড বিপ্লবী কমিউনিস্ট অয়ার্টির দমদম-বসিরহাট অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। এই বিদ্রোহ প্রচেষ্টায়, যার কল অবশ্যই ছিল ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব- এস আর-এর।
আর সি পি আই-এর মূল মস্তিষ্ক ছিলেন ঈষৎ খর্বকায়, স্টাউট চেহারার— পান্নালাল দাশগুপ্ত, যিনি হেমেন গুপ্ত ছদ্মনামে গ্রন্থ রচনা করেন। ছিলেন হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়— হেনা গাঙ্গুলি, বোম্বাইয়ের নৌবিদ্রোহের অন্যতম নায়ক বিন্ধ্যা সিং। ছিলেন অমর রাহা, জেলথেকে বেরিয়ে যিনি আইনজীবী হন। খাটো চেহারা। থ্যাবড়া মুখ। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে দেখেছি মদ্যপান করতে। তিনি আমার একটি অস্ত্র সংক্রান্ত মামলার উকিল ছিলেন।
দমদম-বসিরহাটের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হল। এই অভ্যুত্থান – আপ সার্জ শুরু করার আগে ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি আর সি পি আই-এর পক্ষ থেকে পান্নাবাবুরা তেভাগা-তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া অখণ্ড সি পি আই-কে প্রস্তাব দেয়— আপনারা যে ভাবে বিপ্লব— গণতান্ত্রিক বিপ্লব— পি ভি আর করার চেষ্টা করছেন, করুন। আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব— এস আর করার প্রয়াস যেমন চালাচ্ছি চালাই। কিন্তু আমাদের এই বিপ্লব প্রচেষ্টা হোক যৌথভাবে।
বি টি আর— বি টি রনদিভের নেতৃত্বাধীন তখন কার অখণ্ড ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
আসাম, নাগাল্যান্ডে মজবুত সংগঠন ছিল না ভাঙা আর সি পি আইয়ের। আসাম এবং নাগাল্যান্ড থেকে আর সি পি আইয়ের বহু সশস্ত্র যোদ্ধা ধরা পড়েন। জেল, অত্যাচার— পুলিশী নির্যাতন চলে তাঁদের ওপর।
তখন আমাদের সদ্য ‘স্বাধীন’ দেশ। তবু অত্যাচার, নিপীড়ন আর সি পি আইয়ের একজন সংগঠক পুলিশ বা পুলিশ গোয়েন্দাদের কিছু বলবেন না, শত অত্যাচারেও, তার জন্য দাঁতে করে নিজের জিভ ছিন্ন করেন, এমন কথা শুনেছি। সেভাবে আর সি পি আইয়ের কোনো বিপ্লব বিষয়ক ডকুমেন্ট রাখা নেই। হয় তাঁরা নষ্ট করেছেন, নয় পুলিশ, ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
আসামে নির্বাচন বয়কট না করলে উত্তর দমদম-বসিরহাট পর্বে আর সি পি আই ঐ রাজ্যের বিধানসভায় বিধায়ক অগুন্তি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, এমন একটা অবস্থায় তারা ছিল। ১৯৬৯ সাল নাগাদ পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘কম্পাস’ পত্রিকায় দমদম-বসিরহাট অভ্যুত্থানের সময় আর সি পি আইয়ের চিকিৎসক ইউনিটে সক্রিয়ভাবে থাকা একজন ডাক্তারবাবু তাঁর স্মৃতিকথায় দমদম-বসিরহাট পর্ব লেখেন, ধারাবাহিকভাবে। সেই লেখাটি গ্রহ্ন হয়েছে কিনা জানা নেই।
দমদম-বসিরহাট অভ্যুত্থানের বহু আগে থেকেই— সিউড়ি সম্মেলনে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সি পি আইয়ের বিপ্লব প্রচেষ্টার পথ ত্যাগ করে আলাদা রাজনৈতিক দল আর সি পি আই (ঠাকুর) তৈরি করেন। তিনি অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিলেন। সুদর্শন, সুবক্তা, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সৌম্যেন্দ্রনাথ ‘মশাল’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ-সহ কয়েকটি গ্রন্থ লেখেন। ১৯৪৮-৪৯ সি পি আই ও আর সি পি আইয়ের বিদ্রোহপর্ব। তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা, দমদম-বসিরহাট।
মনে রাখতে হবে ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল ‘হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান আর্মি’র নেতৃত্বে যে যুব বিদ্রোহ হয়, তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন মাস্টারদা— সূর্য সেন। সেই বিপ্লব প্রচেষ্টায় সক্রিয় ভাবে ছিলেন নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তী, হরিগোপাল বল (টেগরা), প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা দত্ত (যোশি), তারকেশ্বর দস্তিদার চারু বিকাশ দত্ত এবং অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ প্রমুখ অনেকে। চারু বিকাশ দত্ত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ নামে গ্রন্থ নির্মাণ করেন। পরে তা সিনেমা হয়।
১৯৩০-এর ২০ এপ্রিল প্রবল গরমে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, তাতে অনন্ত সিংহ এবং গণেশ ঘোষ অংশ নিতে পারেননি। তাঁরা মূল বিপ্লবী দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
অনন্ত সিংহ পরে কলকাতায় এসে লালবাজারে সারেন্ডার করেন, কলকাতা পুলিশের কাছে। এসব কথা অনন্ত সিংহ লিখেছেন তাঁর খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’-তে। তাঁর আরও দুটি বই ‘কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে বিপ্লবী’, ‘আমি সেই মেয়ে’। এই বই দুটির প্রকাশক ব্রজ কিশোর মণ্ডলের ‘বিশ্ববাণী’।
গণেশ ঘোষ গ্রেফতার হন ফরাসি চন্দননগর থেকে। সেখানে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা, সুহাসিনী (পুঁটু) গাঙ্গুলি চালান। অসহ্য অত্যাচার হয় পুঁটুর ওপর। তিনি বিপ্লবী দলের নির্দেশে একজনের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী সেজে থাকতেন।
এই পুলিশী অভিযানে গুলিযুদ্ধে শহীদ হন চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের অন্যতম সৈনিক জীবন (মাখন) ঘোষাল। গণেশবাবুরাও গুলিযুদ্ধে ছিলেন চার্লস টেগার্টের বাহিনী সঙ্গে। সেই বাড়িটি আমি দেখেছি। অনন্ত সিংহ লালবাজারে সারেন্ডার করার পর তাঁর দিদি বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তুই আত্মসমর্পণ করলি পুলিশের কাছে? রাস্তায় গুলি খেয়ে পড়ে থাকতে পারলি না? এসব কথা অনন্ত সিংহ লিখেছেন চতুর্থ ট্রাইবুনালের মামলা। শেষ জীবনে বড়ো দাড়ি রাখতেন। শাদা, লম্বা। চোখে অনেক পাওয়ারঅলা চশমা। পাশ থেকে অনেকটা যেন শেষ বয়সের দ্বিজেন্দ্রলাল পুত্র দিলীপ রায়। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়।
অনন্ত সিংহ অতি রূপবাণ ছিলেন তাঁর কৈশোর, যৌবনে। যেমন রূপময় ছিলেন ১৯৩০-এর ২০ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে মাস্টারদার নির্বাচিত সেনাপতি লোকনাথ বল। লোকনাথ বল, সর্বজনের ‘লোকাদা’ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর জাতীয় কংগ্রেসে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেন। তাঁর চেহারা ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসানো।
অনন্ত সিংহ খুব শৌখিন। গাড়ি চালাতে পারতেন, সেই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ পর্বেই স্বদেশী ডাকাতির ব্যাপারে মাস্টারমাইন্ড। হাতে হাত ঘড়ি দিতেন। নাগরাকাটা স্বদেশী ডাকাতি সম্ভবত তাঁরই ব্রেন চাইল্ড।
জাদুগোড়ার ঘটনা হওয়ার আগে কলকাতায় বেশ বড় বড় দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়। তার মধ্যে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট ও সদর স্ট্রিট ডাকাতি খুবই আলোড়ন ফেলেছিল সেই সময়। এম এম জি- ‘ম্যান মানি গান’, গ্রুপের পরিচালনায় এই সশস্ত্র ডাকাতির পেছনে অনন্ত সিংহ’র মস্তিষ্ক। এটা আন্দাজ করেন কলকাতা পুলিশের দেবী রায়। দেবীবাবু তখন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। তিনি লক্ষ্য করলেন দুটি ডাকাতিতেই কালো অ্যামবাস্যাডার ব্যবহার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে পাখির খালি খাঁচা, মাছ ধরার জাল, রিকশা ভ্যান— এইসব হাবিজাবি জিনিস। অনন্ত সিংহ এই কাজটা— ঘটনা ঘটাবার পর পুলিশ প্রশাসনকে ‘বোকা বানানোর’ কাজটা খুব করতেন। ফলে মাছ ধরার জাল, পাখি রাখার খালি খাঁচা, রিকশা ভ্যান।
দেবী রায় তখনই অনন্ত সিংহের ওপর নজর রাখতে শুরু করেন। ‘সোর্স’ লাগান খবরের জন্য। অনন্ত সিংহ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তারপর তাঁদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে কিছুদিন ফিল্ম প্রোডিউসার হন। তখন তিনি একটি ‘বুইক’ গাড়ি চড়তেন। পরে বোধহয় ‘অ্যাম্বাস্যাডার’। অকৃতদার, অনন্ত সিংহর সঙ্গে এই সময়টায় বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর অতি ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। এসব খবর পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে তখকার খবরের কাগজ দেয়। বিশেষ করে ‘যুগান্তর’।
‘ওল্ড গার্ড’ অনন্ত সিংহের গ্রেপ্তারের দাবি প্রথম পাতায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপে ‘যুগান্তর’। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ প অন্যান্য দৈনিকও খবর দেয়। সম্ভবত ১৯৭৩-৭৪-এ গ্রেফতার হন ‘ওল্ড গার্ড’। তার আগে জাদুগোড়ার লং মার্চ কাণ্ড হয়ে গেছে।
অনন্ত সিংহ ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’তেই সম্ভবত লিখেছিলেন ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে ধারাবাহিক। ‘ফোর্থ’ নাকি ‘ফিফথ’ ট্রাইবুনাল মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় ‘কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে বিপ্লবী’ লেখেন। লেখেন ‘আমি সেই মেয়ে’। এরপর এই লেখা দুটি বই হিসাবে ছাপেন বিশ্ববানীর ব্রজকিশোর মণ্ডল। সে এক অন্য ইতিহাস।
অনন্ত সিংহের মস্তিষ্ক প্রসূত পরিকল্পনা অনুযায়ী সোনার দোকানেও কয়েকটি ডাকাতি হয়। পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রীটের ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর ডাকাতির যে কালো অ্যাম্বাস্যাডার তারও, সেই গাড়িটির ছবি ছাপা হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র পয়লা পাতায়।
সত্তর দশকে সি পি আই (এম এল)-এর তুলনায় ডিটোনেটার ও ডিনামাইট অনেক বেশি ব্যবহার করে এম এম জি। আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে পুলিশ-মিলিটারিদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হবে, এই ছিল এম এম জি গ্রুপের লাইন। বিপরীতে না ভাঙা সি পি আই (এম এল) চারু মজুমদারের লাইন অনুসরণ করে আগ্নেয়াস্ত্র নির্ভরতায় না গিয়ে প্রচলিত অস্ত্র- দা, কাটারি, কাতান, হেঁসো, গুপ্তি, নেপালা, কানপুরিয়া, রামপুরিয়া, বাঁশপাত্তি, টাঙি, তলোয়ার, বর্শা, বল্লম, প্রয়োজনে ইট-পাথরের ওপর নির্ভরশীল হতে বলে ‘খতম’; অভিযান, অ্যাকশনে। পরে অবশ্য মাগুরজান, রূপসকুণ্ডীর ঘটনা ঘটে। চারু মজুমদার সত্তরটি রাইফেল ও দুশোটি পাইপগান নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন গণমুক্তি ফৌজের। পুলিশের রাইফেল, রিভলভার, পিস্তল, গৃহস্থের দোনলা, একনলা বন্ধুক জোর করে, ভয় দেখিয়ে কেড়ে নেওয়া হতে থাকে। কথা হয় এইসব বন্ধুক ইত্যাদি গ্রামে চলে থাকে। বাস্তবে তা হয় না। শহরে অ্যাকশনেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। পুলিশ ধরেও নেয় কিছু।
চে গেভারা ও মাও-সে-তুঙের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, অন্তত তাঁরা বলতেন এরকমই, ‘এম এম জি’ গ্রুপের ছেলে-মেয়েরা পুলিশ মিলিটারির গাড়ি আটকাতে ঢালাই করা কালভার্টের নিচে লুকিয়ে ডিনামাইট রাখেন। কিন্তু ব্যর্থ হয় সেই বিস্ফোরণ প্রচেষ্টা। পুলিশ ধরে ফেলে ডিনামিট। ধাসা-কামান ধরণের বারুদ প্রয়োগও তাঁরা করেন।
ধাসা কামান ঠাসতে হয় লক্ষা, পেরেক, বা লোহার তৈরি সরু সালাকা দিয়ে, সলতে— বারুদ সমেত পলতে ঠিক করে রাখতে হয়। কালীপুজোর তুবড়ি ঠাসা হত উড পেন্সিলের শীষ দিয়ে। তুবড়ির খোলের পেছনে থাকত একটা ফুটো, উটোন, বসন— দুইয়েরই। ছটাকি থেকে শুরু করে পোয়া হয়ে সের-ই মাপের খোল।
কুমোর বাড়ি তুবড়ির খোল তৈরি হত, যা দেখতে অনেকটা ওল্টানো হাঁড়ি চেহারার। তার মুখটা কাঁচা মাটি দিয়ে আটকে, পেছনের ফুতো দিয়ে উড পেন্সিলে ঠেসে ঠেসে বারুদ— মশলা ঢোকানো হত। ভুঁইও তাই। পোড়া মাটির আইসক্রিম কোন যেন এমন খোলের ভেতর বাজির মশলা, ঠেসে ঠেসে... তারপর রাতে সেই তুবড়িতে আগুন। তুবড়ির আগুনে – আলো শাদা করতে গেলে অ্যালুমিনিয়াম চূর্ণ। লালচে হলুদ রাখতে গেলে কাঠকয়লা-সোরা-গন্ধকের বারুদ। মোমছাল-পটাস-লাল শাদায় যে ভয়ানক পেটো হয়, তাও বলব ‘মুছে যায়?’-তে। বাজির মশলা ওজন করতে হয় ‘নিক্তি’-তে। ছোট পেতলের দাঁড়িপাল্লায়। যা ব্যবহার হয় সোনার দোকানে। আর করতেন কাবুলিঅলারা হিং ওজনের জন্য।
তো সে যাই হোক, এই হাত-কামান, ধাসা-কামানের ব্যবহার যাদবপুরের নকশালপন্থীরা করেছিলেন সত্তর দশকে। করেছেন বালির নকশালপন্থীরা, পুলিশ-সি আর পি ভ্যান আটকাতে। সে এক দীর্ঘ লড়াই। তার ইতিহাস ও লিখতে হবে বিস্তারে। ধাসা-কামান, হাত-কামান, চাবি-কামান তাদের ভূমিকা পালন করেছে সময় থেকে সময়ান্তরে।
যাদবপুরের ধাসা-কামান বা হাত-কামান ব্যবহার খবর হিসাবে পয়লা পাতায় এসেছে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়— ১৯৭১ সালে। এর কাছাকাছি সময়েই চীনা-প্যারাসুটের খবর ফলাও করে ছাপে ‘আনন্দবাজার’, তার প্রথম পাতায়। কলকাতার বুকে আছড়ে পড়েছিল মেড ইন চায়না প্যারাসুটপ, ১৯৭১-এই সম্ভবত।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor