হ্যাঁ, তিনি তো কমার্শিয়াল লেখকই ছিলেন, তা যতই কিনা তাঁকে অনিমেষ আর মাধবীলতা, সাতের দশক বা সত্তর দশকের দুই অগ্নিকন্যাকে নিয়ে আদিখ্যেতা হোক, সোশ্যাল মিডিয়ায়, নকশালবাড়ি ধারার ঐতিহাসিক আন্দোলনের এমন ভুল ব্যাখ্যা বলব না, ভুল ইন্টারপ্রিটেশন তো খুব কমই হয়েছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘শ্যাওলা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেন্দ্রবিন্দু’, দেবেশ রায়ের ‘স্বামী-স্ত্রী’ বাদ দিয়ে। আসলে নকশালবাড়ি ধারা ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ— ১৯৬৭-র ২৫ মে হয়। তারপর ১৯৬৯ সালে সিপিআই (এম-এল)-এর গড়ন-গঠন ১৯৬৭-র ২২ এপ্রিল, লেনিন দিবসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) তৈরি হল। আর তার অফিশিয়াল ঘোষণা হল মে দিনে— মে দিবসে, ১৯৬৯ সালের পয়লা মে, কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে। মনুমেন্ট ময়দান তখন শহিদ মিনার নাম পায়নি। তো সে যাই হোক, ৮ মে প্রয়াত হয়েছেন সমরেশ মজুমদার। বিকেল ফুরিয়ে আসা সন্ধ্যার দিকে, কলকাতার পাইপাসের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে, বয়স হয়েছিল ৭৯। তাঁর ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালপুরুষ’, ‘কালবেলা’— এই তিনতি দীর্ঘ আখ্যানই সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরোয়। ‘দেশ’ তখনও সাপ্তাহিক। সমরেশ মজুমদার লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ছিলেন না। তিনি দাবিও করেননি তিনি লিটল ম্যাগাজিনের। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ বাড়ীর সবকটি কাগজে তিনি লিখেছেন, বার বার লিখেছেন। ধারাবাহিক লিখেছেন, শারদ সংখ্যায় লিখেছেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দেশ’, ‘আনন্দমেলায়’। ছোটোদের জন্য বা কিশোরদের জন্য তাঁর লেখা মূল চরিত্র অর্জুন, সেইসঙ্গে আছেন অমল সোম। এই যে এত এত ‘চরিত্র’ তৈরি হয়েছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিলা’ গ্রুপ-এর ‘আনন্দমেলা’-র পাতায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু-সন্তু, সমরেশ বসুর গোগোল, বিমল করের কিকিরা, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, তার মধ্যে আমি সবার আগে এগিয়ে রাখব বিমল করের ম্যাজিশিয়াম কাম রহস্যভেদী কিকিরাকে। আমি এই তালিকার বাইরে প্রদোষ মিত্র— ফেলুদা এবং ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুকে বাদ রাখলাম। কারণ প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা, তোপসে— তপেসরঞ্জন, জটায়ু— একটু একটু করে গড়ে উঠেছেন। ফেলুদা ও তোপসে আনন্দমেলার বাইরে। প্রফেসর শঙ্কুও তাই। সত্যজিৎ রায়ের তারিণীখুড়ো আনন্দমেলার পাতাতেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীল মানুষ, বিশ্ব মামাও তাই। তো সে যাই হোক, সমরেশ মজুমদার কিশোড়-কিশোরীদের জন্য অর্জুন লিখেছেন, সঙ্গে অমল সোম। ‘উত্তরাধিকার’ দেশ পত্রিকায় বেরোতে শুরু করে। আঙরাভাসা নদী, স্বর্গছেঁড়া চা বাগান, অনিমেষ— অনি, তার ঠাকুর্দা, স্কুলে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, অনির নদীর জলে স্নান সারা— গা মাজতে আসা দেশীয় নারীদের প্রায় নগ্ন দেখা, উত্তরবঙ্গ, চা বাগানের জীবন, পাঁচ বা ছয়ের দশক, বিশেষ করে ছয়ের দশক— সবই গড়গড় করে পড়ে নেওয়া যায়। তাঁর ‘কালপুরুষ’, ‘কালবেলা’ সাতের দশক, আটের দশক— আশির দশক আবার ‘মৌষলকাল’, যাতে ২০১৮-র পাশাপাশি সময়, সবমিলিয়ে সামগ্রিকভাবে কমার্শিয়াল রাইটার— বাণিজ্যিক দারার লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে ধরার চেষ্টা। মনে আছে ‘কালবেলা’-তে একটি সংলাপ ছিল, ‘ফাক দ্য টাইম’। একজন সম্পন্ন মানুষ কথাটি বলছেন। ‘—ফাক দ্য টাইম —ফাক দ্য টাইম’। সমরেশ মজুমদারের একটি গল্প পড়েছিলাম সাতের দশকের মাঝামাঝি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র রবিবাসরীয়তে। গল্পের নাম ‘ঈশ্বরের ভূমিকায়’। ‘ঈশ্বরের ভূমিকা’-তে রাস্তায় পথ দুর্ঘটনা—রোড অ্যাক্সিডেন্টে, একজন গাড়ি চালক আহত-মুমূর্ষুর মুখে জলের বদলে মদ ঢেলে দেওয়া, মমদ ঢালছে সেই ড্রাইভারটি। ছবিটা ভালো এঁকেছিলেন। কিন্তু এখন পাঠ করলে— পুনর্পাঠ করলে সেই গল্পের কিছু খুঁত তো বেরোবেই বেরোবে। তাই আর পুনরায় পাঠের ইচ্ছে নেই। সমরেশ মজুমদার ছয়ের দশক— ষাট দশকের লেখক। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ও। ছয়ের দশকেই শৈবাল মিত্র, সমীর রক্ষিত, তপোলিকা ঘোষ, মণি মুখোপাধ্যায়, অমল ভট্টাচার্য, বলরাম বসাক, কল্যাণ সরকার, রমানাথ রায়, শেখর বসু, সুনীল জানা, কল্লোল মজুমদার, কল্যান সেন, সুনীল দাশ, শঙ্কর দাশগুপ্ত, সুব্রত সেনগুপ্ত, শেখর বসু। এর মধ্যে বলরাম বসাক, রমানাথ রায়, শেখর বসু, সুনীল জানা, কল্যাণ সেন, সুব্রত সেনগুপ্ত— এঁরা সবাই গল্পহীন গল্প আন্দোলন— এই পত্রিকার লেখক। সমরেশ মজুমদার কথাকার শৈবাল মিত্রের ভায়রাভাই। অর্থাৎ তাঁরা দুজন দুই বোনকে বিবাহ করেন। শৈবাল মিত্র নকশালবাড়ির ধারার আন্দোলনের সঙ্গে গোড়ার দিন থেকে যুক্ত ছিলেন। তাঁর এক কাহিনি— যা ‘তারিণী পাহাড়ে বসন্ত’ নামে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘অমৃত’-তে ধারাবাহিক বেরিয়েছিল, এছাড়াও শৈবাল মিত্রর বহু কাহিনিতেই নকশালবাড়ি ধারা আন্দোলন এসে গেছে, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে। সমরেশ মজুমদার কখনও প্রত্যক্ষভাবে নকশালবাড়ির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে এটাও ঠিক, এই আন্দোলনের সঙ্গে— অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকলেই তিনি নকশালবাড়ির ধারার আন্দোলন বিষয়ে লেখার অধিকারী, এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণের পর মাধবীলতা ও অনিমেষকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে পোস্টে যে আদিখ্যেতা শুরু হয়েছে, এখনও চলছে, এমনকি ‘অফিশিয়াল বামপন্থী’-রাও সেই শোকধ্বনি, স্তোত্রগানের বাইরে নন, সেইসব পোস্ট পড়তে পড়তে মনে হয় পশ্চিমবাংলার বাংলা গল্প উপন্যাসের পাঠক রাজনৈটিক গল্প-উপন্যাসের স্বাদ ভুলেই গেল? গোপাল হালদার, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক, সোমনাথ লাহিড়ী, গৌরী ঘটক, সুলেখা সান্যাল, সাবিত্রী রায়, অসীম রায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী— এঁদের লেখা রাজনৈতিক গল্প, উপন্যাস কি এখন আর স্মৃতিতে ভাসে না পশ্চিমবাংলার বাঙালি পাঠকের? ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’— সমরেশ মজুমদার বিরচিত এই যে ট্রিলজি, তার প্রথমটি, ‘উত্তরাধিকার’ ছাপে কলকাতার অতি বিখ্যাত প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ। যতদূর জানি ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর অন্যতম কর্ণধার— স্থপতি ও কথাকার গজেন্দ্রকুমার মিত্রর বন্ধু ছিলেন সমরেশ মজুমদারের পিতৃদেব। ‘উত্তরাধিকার’ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে না বেরোলেও ‘কালপুরুষ’, ‘কালবেলা’-সহ তাঁর অনেক, অনেক বই বেরোয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। গর্ভধারিণী নামে আর একটি বড়ো মাপের ধারাবাহিক তিনি লিখেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। এই গ্রন্থের প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ। দৌড় তাঁর প্রথম বড়ো কাগজে ছাপা উপন্যাস। ‘দেশ’ পত্রিকার বিনোদন সংখ্যায় লেখাটি ছাপা হয়েছিল— যতদূর মনে পড়ে। তখন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ বাড়ি থেকে বার্ষিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র সাহিত্যসংখ্যা ‘দেশ’, বিনোদনসংখ্যা ‘দেশ’ প্রকাশিত হত। বিনোদন সংখ্যা ‘দেশ’— ‘দেশ’ তখন সাপ্তাহিক বেরোত বড়োদিনের আশেপাশের সময়ে, মাসে। ‘দৌড়’ কলকাতার রেসের মাঠের ঘোড়া, বুকি, রেস খেলতে আসা মানুষজনের জীবনের নানা ওঠা-পড়া টানাপোড়েন নিয়ে লেখা। আমরা অনেকেই জানি অথবা জানি না কবি ও গদ্যকার, গীতিকার, সিনেমা পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্র নিয়মিত কলকাতা রেসের মাঠে যেতেন। ঘোড়দৌড় তখন হয় প্রতি শনিবার কলকাতা রেসকোর্স আর টালিগঞ্জ রেসকোর্সে। টালিগঞ্জের রেস বহু বছর হল বন্ধ হয়ে গেছে। শোনা যায়, বুকিদের নিজেদের মধ্যে জোচ্চুরি টালিগঞ্জ রেস বন্ধের অন্যতম কারণ। শনিবার শনিবার রেসের বই, ‘ট্রিপল টোটে’, ‘উইনে’ ইত্যাদি-প্রভৃতি হিসেব, ঘোড়ার পেডিগ্রি, তা নিয়ে অঙ্ক, বুকি— সে এক অন্য জগৎ। লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়ে ঘোড়ার পায়ে। বাংলা, হিন্দি ইংরেজি খবরের কাগজে ঘোড়ার পেডিগ্রি ইত্যাদি, রেসের খবর, সম্ভাব্য জয়ী ঘোড়ার নাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা— চর্চা হয়। কিন্তু প্রেমেনদা— প্রেমেন্দ্র মিত্র এত এতবার রেসের মাঠে গিয়েও রেস নিয়ে— ঘোড়দৌড় নিয়ে কোনো আখ্যান নির্মাণ করলেন না বা করতে পারলেন না। কেবল তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র পরাশর বর্মাকে নিয়ে একটি আখ্যানে ‘ঘোড়া চিনলেন পরাশর বর্মা ঘুড়িও ওড়ালেন’, তাতে কিছু ঘোড়া ইত্যাদির কথা, ব্যস। কিন্তু সমরেশ মজুমদার ‘দৌড়’ লিখলেন। বই হয়ে বেরোল। তা নিয়ে সিনেমা করলেন শঙ্কর ভট্টাচার্য। সে সিনেমা অবশ্য খুব চলেনি। এই লেখা লিখতে লিখতে মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমা ‘সীমাবদ্ধ’-তে কলকাতার রেসের মাঠ দেখিয়েছেন। সুন্দরী শ্যালিকা শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে এই সিনেমার নায়ক বরুণ চন্দ কলকাতা রেসের মাঠে গেছেন। দৃশ্যটা মনে আছে। ‘সীমাবদ্ধ’-র পাশাপাশি গৌতম ঘোষের ‘কালবেলা’-র একটি শট মনে পড়ল। যেখানে থানা, লকআপ এবং জেলে অত্যাচারিত, প্রায় পঙ্গু অনিমেষ আর মাধবীলতার যৌথজীবনের গেরস্থালীতে বাঁশের বেড়ার দেওয়ালে চে আর্নেস্তো গেভারা, ছবিতে। এ যে কত বড়ো ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, তা বলার নয়। ছয় দশক, সাত দশক, আট দশকে চে আর্নেস্তো গেভারা তো সিপিআই, সিপিআই (এম), সিপিআই (এম-এল) এর কাছে সম্পূর্ণ ব্রাত্য। এমসিসি— মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র, এসইউসি, তারাও চে-কে ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘অ্যাডভেচারিস্ট’ ‘হঠকারী’ মনে করে। চে আর্নেস্তো গেভারার ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতির তাঁরা ভয়ঙ্কর সমালোচক। তো সে হোক, ‘কালবেলা’ তো সিরিয়ালও হয়েছে, খুব হিট ছিল— নকশাল বিপ্লব— নকশাল আন্দোলন। সমরেশ মজুমদার কালো টিভি সিরিয়াল-জগতের প্রথম অভ্যুত্থানের সময় অনেক কাজ করেছেন দূরদর্শনের জন্য। যতদূর জানি তিনি চাকরি করতেন আয়কর বিভাগে। সেই চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন টিভি-র কাজে, সিরিয়াল নির্মাণের ব্যাপারে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-ও এর কিছুদিন পর নিজেদের টিভি চ্যানেল তৈরি করে, সিরিয়াল বানায়। ‘স্টার আনন্দ’ বা ‘এবিপি আনন্দ’-র অনেক অনেক বছর আগে তৈরি হয়েছিল সেই চ্যানেল। পরে অবশ্য নানা কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বৌদ্ধ যুগ, সম্রাট অশোক, তিষ্যা নামের রাজ-সেবিকা নিয়ে উপন্যাস নির্মাণ করেছেন সমরেশ মজুমদার। বৌদ্ধযুগ থেকে যৌনতাই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানে। ‘জলছবির সিংহ’ নামে একটি ধারাবাহিক তিনি লিখেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র রবিবাসরীয়র পাতায়। ভেড়ি অচল, সজিদ মাস্টার নামে এক ‘বাম’-বাহুবলী আরও— স্পষ্ট করে বলতে গেলে সিপিআই (এম) আশ্রিত মজিদ মাস্টার, যাঁর নামে যথেষ্ট কুখ্যাতি ছিল, তিনি এই আখ্যানে আছেন। কিন্তু সমস্ত বর্ণনাটাই তো একমাত্রিক। ফলে রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে ওঠার পেছনে যা যা স্তর থাকা দরকার ছিল, তা ‘জলছবির সিংহ’-তে ছিল না। তখন বামফ্রন্টের সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের শাসন। সেই সময়টা তিনি আঁকতে চেয়েছেন, পারেননি। ভেড়ি— মাছের বড়ো বড়ো ভেড়ি, জলাশয়, জলকর, বন্দুক, বোমা, বন্দুকবাজ বাহিনী— যাদেরপ ‘মাস্কেট বাহিনী’-ও বলা হয়ে থাকে মুর্শিদাবাদ সহ অন্য অন্য উত্তরের— উত্তরবঙ্গ লাগোয়া অঞ্চলে। দক্ষিণবঙ্গে— দক্ষিণ ২৪ পরগনার মাছ চাষ, ভেড়ি, সাদা মাছ, মাছের পোনা, ডিম-পোনা, মীন— কোনোটাই হয় আসেনি, নয় তিনি আনতে পারেননি। পাঁচ দশকের পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষার গদ্যকার— লেখক বলতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বরেন গঙ্গীপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, কবিতা সিংহ, মতী নন্দী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রলয় সেন, রতন ভট্টাচার্য প্রমুখ পাঁচ দশকেরই। ছয়ের দশকের বাংলা গদ্য লেখক সমরেশ মজুমদার, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সবচেয়ে বেশি বিক্রিদার লেখক। যাঁদের বই বিক্রি হয় যথেষ্ট। ছয়ের দশকের বাকিদের বিক্রি প্রায় শূন্য। অনেকেই বিস্মৃতির অতলে। দুঃখ লাগে সমরেশ বসুর গ্রন্থ এখন আর সেভাবে বিক্রি হয় না। ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘পাতক’-ও না। ‘দেখি নাই ফিরে’ অনেকটা দাম, তবু কিছু বিক্রি হয় রামকিঙ্কর— শিল্পী-ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে লেখা এই জীবন-উপন্যাস। যার ছবি এঁকেছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য। ‘কইতে কথা বাজে’ সমরেশ মজুমদার যাঁদের সঙ্গে— মানে যেসব লেখকদের সঙ্গে সমরেশ মজুমদার খানিকটা হলেও মিশেছেন, তাঁদের কথা আছে এই বইতে। সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ পান ‘নবকুমার’ নামের গ্রন্থের জন্য। সম্ভবত সেটা ২০১০। বামফ্রন্টের রাজত্বকালের শেষ বঙ্কিম পুরস্কার। কলকাতার বেশ্যাপল্লী— রেডলাইট এলাকা এই আখ্যানের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে ‘পত্রপাঠ’ নামে একটি হাফ কমার্শিয়াল পত্রিকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ‘পত্রপাঠ’-এ প্রায় নিয়মিত তিনি লিখতেন, এমনকি কখনও কখনও লিখেছেন ক্রোধসঞ্জাত বিদ্বেষমূলক লেখাও। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ বাড়ির ছাতার বাইরে ‘বর্তমান’ শারদ সংখ্যায় তাঁকে আমরা গল্প লিখতে দেখেছি। সম্ভবত ‘আজকাল’-এও। যদিও তাঁর মূল লেখালিখির সবটাই প্রায় আনন্দবাজার কেন্দ্রিক। তবে অসুবিধার কিছু নেই। কেউ এভাবে তাঁর সাহিত্য চলন জারি রাখতে পারেন। তাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর বামপন্থীদের ডাকা— বামফ্রন্টের ডাকা দু-একটা মিছিলে হাঁটতে দেখেছি। এই দু-একবারই, ব্যস। কলকাতার অফিসিয়াল বামপন্থীরা তাতেই আহ্লাদে ষোলো আনা। যাক সেসব প্রসঙ্গ। কলকাতা অনেক কিছু দেখেছে, দেখছে এই বঙ্গভূমি। যুক্তবঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, বরিশাল, ফরিদপুর, রাজশাহি, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, চন্দননগর, মুর্শিদাবাদ, যশোর, খুওনা, পাবনা, বর্ধমান, মেদিনীপুর, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা অনেক অনেক ঘটনার সাক্ষী, সেইসব ঘটনা বড়ো লেখকদের— বড়ো মাপের আখ্যানকারদের কলমে বার বার উঠে আসে। সমরেশ মজুমদারের লেখায় সেভাবে কী উঠে এল এই যুক্তবঙ্গের, যখন তা অখণ্ড বঙ্গ ছিল, পরে খণ্ডিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এল কী সেই জীবন-সমাজ-রাজনীতির তরঙ্গাভিঘাত? এল কি? এল? এল? বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে খুব পপুলার ছিলেন তিনি, এমন শুনেছি। তাঁর বইয়ের বাংলাদেশ এডিশন অনেক হয়েছে। আবার তাঁর লেখার— গ্রন্থের পাইরেটেড এডিশন হয়েছে বাংলাদেশে— এমন অভিযোগও তিনি বার বার করেছেন। সেই অভিযোগের সত্যতা আমি যাচাই করিনি। এই অভিযোগের কতটা সত্য আর কতটাই-বা মিথ্যা, সে সম্বন্ধেও আমার ধারণা নেই। একজন কমার্শিয়াল লেখক— বাণিজ্যিক লেখক, পুরোপুরি বাণিজ্যিক লেখকই। সেটা যে খুব দোষের, তাও হয়তো নয়, কিন্তু মহাকাল, কঠিন মহাকাল, তার পায়ে পেরেক গেঁথে দিতে গেলে অনেক, অনেক, অনেক কিছু ছাড়তে হয়। সেই যাত্রাপথ বড়ো দুর্গম, বড্ড অনিশ্চিত, কণ্টকময়, বিপদসঙ্কুল। একজন প্রকৃত, সৎ অক্ষরকর্মীকে— লেখক থেকে কথাকার— কথা সাহিত্যিক হয়ে উঠতে গেলে সেই অতি দুর্গম পথ পায়ে পায়ে বিপদ নিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে পেরোতে হয়।
Powered by Froala Editor