মুছে যায়? – ১৪
আগের পর্বে
১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘর্ষের সময় পরিখা খনন রাজ্য জুড়ে। বালি জোড়া অশ্বস্থতলা বিদ্যালয়ে প্রথম পরিখা দেখা। রেডিও জুড়ে তখন দেশাত্মবোধক গান। চীনের আগ্রাসী মনোভাবকে চিহ্নিত করা হল ড্রাগনের নিঃশ্বাস হিসাবে। চিনা আক্রমণ, বোমা বর্ষণ থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিতে হবে ট্রেঞ্চে। এই পন্থা শিখিয়েছে পূর্বের দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ। সেই সঙ্গেই শুরু হয় সাইরেন, অল ক্লিয়ারের ব্যবহার। মানুষকে বিমান আক্রমণ থেকে সতর্ক করার জন্য। ১৯৭১ এর যুদ্ধে সাইরেনের পুনর্ব্যবহার হলেও খোঁড়া হয়নি পরিখা বা ট্রেঞ্চ। তবে বাঙালির এই পরিখাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বহু আগে। বিপ্লবী বাঘাযতীনের হাত ধরে বুড়ি বালামের তীরে বৃটিশ পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমেই।
একখানা ‘ভারত’ ব্লেড তিন নয়া পয়সা। চৌষট্টি পয়সায় একটাকা, এই হিসেব ধরলে দু পয়সা। তিন নয়া পয়সা একশো নয়া পয়সায় এক টাকা, সেই হিসেবেরই ফলাফল। মেরুন নয় ঠিক, আবার পিঙ্কও নয়, এরকম একটা মাঝামাঝি রঙে কাগজের খোসা ব্লেডের কভার হিসাবে থাকত।
‘ভারত’ ব্লেড পাওয়া যায় সর্বত্র। পাড়ার মুদি দোকান, স্টেশনারি শপ অথবা ইলাহাবাদের জেনারেল স্টোর্সে, গল্লে কা দুকানেও। জেনারেল স্টোর্স অর্থে বঙ্গাল মুলুকের স্টেশনারি দোকান। গল্লে কা দুকান শব্দের মানে মুদিখানা।
সেটা ষাটের দশক। চালের সের বা কিলো সাতষট্টি নয়া পয়সা, দশ আনা। সেই চালের দর এক লাফে এক টাকা হয়ে যেতেই ১৯৬৬-র ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন, মার্চে— বসন্তদিনে।
‘ভারত’ ব্লেড একখানা তিন নয়া পয়সা। ‘পানামা’ ব্লেডও তাই। ‘পানামা’ ব্লেডের মলাট একটু হলদেটে শেড, ছোঁয়া। ভেতরে মোচার যে জল রঙের প্লাস্টিক প্লাস্টিক অংশটি আমরা কদলী কুসুম থেকে রান্নার আগে বাদ দিই, সেই কদলী কুসুম বা কদলী মঞ্জরীতে যে রঙটুকু, তারই কাছাকাছি একটা বর্ণ নিয়ে হাজির ব্লেডের ভেতরের খোসাটি।
আরও পড়ুন
ট্রেঞ্চ, সাইরেন, অলক্লিয়ার
‘প্রিন্স’ ব্লেড এল আরও একটু পরে। নীলচে গ্যালভানাইজড কোটিং। ততদিনে সত্তর দশক আসব আসব প্রায় সময়। গোটা দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পৃথিবীর নানা দেশে বিপ্লবের গান। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, কঙ্গো, বলিভিয়া। প্রিন্স ব্লেডে জং পড়তে দেরি হয়।
চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব— কালচারাল রেভেলিউশান শেষ। তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক চলছে। ১৯৬৪ সালেই কলকাতা কংগ্রেসের পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই ভেঙে সি পি আই ও সি পি আই (এম)।
আরও পড়ুন
‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে...’
‘প্রিন্স’ ব্লেড দশ নয়া পয়সা। নেভি ব্লু কভার। খাপের ওপরে কোনো ব্রিটিশ সিংহ ধরণের এমব্লেম? শাদায়? প্রিন্স ব্লেড চলে বেশি। বহুদিন ধার ধরে রাখে।
‘সেভেন ও ক্লক’ সব চাইতে দামি ব্লেড। তার দাম পঁচিশ নয়া পয়সা। পুরনো পয়সার হিসাবে চার আনা। অনেক অনেক বার গাল কামানো যায়। ঝরঝরে ঝলমলে সেই ব্লেড।
আরও পড়ুন
ঘড়িক্কে 'ঘোড়া' ছোটে
আমার রেল চাকুরে, অতি সৎ পিতৃদেব অমরনাথ রায় প্রায় রোজই দাড়ি কামাতেন। তাঁর নাকের নিচে গায়ক-নায়ক রবিন মজুমদার স্টাইলের সরু গোঁফ। সেই গোঁফ বা মুসটাসকে তিনি সঠিকভাবে রেখায়িত রাখতেন নিজস্ব ছোট লোহার কাঁচিতে।
জিলেট কোম্পানির সাবান পাওয়া যেত, দাড়ি কামানোর। গোল। কাগজের বাক্সে আসত সেই শাদা, চাঁদপানা সাবান। বাবার ছিল একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাটি। মাপে অনেকটা যেন গোল, ছোট্ট পাঁপড় যেমন হয়, তেমন।
আরও পড়ুন
ব্যা-ব্যা-ব্যায়ামাগার – আখড়া
সেই বাটিতে শীতে গরম জল করতেন অমরনাথ, উইনটার সিজনে বড্ড কষ্ট দাড়ি কামাতে— হিন্দি বলয়ে, মূলত ইলাহাবাদে যাকে বলে ডাঢ়ি বানানো।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ‘অশোক’ ব্লেড নামে একট দাড়ি কামানোর ব্লেড বাজারে আসে সত্তর দশকে। তার একটি বিজ্ঞাপন জিঙ্গেল খুব বাজত আকাশবাণী কলকাতা বা বিবিধভারতী-র প্রচার তরঙ্গে, সেই সুর ও কথা লহরি এ রকম—
আরও পড়ুন
মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা
‘অশোক ব্লেড যে ডাঢ়ি বনাইয়ে
অশোক ব্লেড সে আনন্দ পাইয়ে
জি হাঁ আশোক স্টেনলেস ব্লেড’। এইটুকু কথার মধ্য দিয়ে কানে আসত আমাদের। ততদিনে অবশ্য বিবিধভারতীতে— মানে আকাশবাণীর ‘বিবিধভারতী’ প্রচারতরঙ্গকে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, ‘হিন্দিভারতী’। অন্ততপক্ষে বাংলা দৈনিকের চিঠিপত্র কলামে, যেখানে তখন লেখা হত, ‘মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ি নহে’, সেখানে ছাপা চিঠিতে ‘বিবিধভারতী বা হিন্দিভারতী’ এই শিরোনাম দেখেছি।
আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা
‘অশোক’ ব্লেড-এর কথায় একটু পরে আসছি। আপাতত ‘সেভেন ও ক্লক’ নিয়ে কিছু কথা হোক। আমার শৌখিন পিতৃদেব বিবাহের পূর্বে, ইস্টার্ন রেলে চাকরি হওয়ার পর ‘সেভেন ও ক্লক’-এ দাড়ি কামাতেন, এমন শুনেছি।
বাবা ১৯৫২ সালের মাঘ মাসে সম্ভবত জানুয়ারিতে আমার মা গায়ত্রী রায়ের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তখন তিনি ১২৫ টাকা মাইনে পান। রেলে চাকরি পেয়ে বাবা চন্দৌসিতে পোস্টেড ছিলেন ট্রেনিংয়ের জন্য। তারপর মুগলসরায়। যে স্টেশনটির নাম বদলে দেওয়া হয়েছে, সমস্ত ইতিহাস ও তার ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করে।
আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...
মুগলসরায় তখন ইস্টার্ন রেলের শেষ স্টেশন। তারপরই নর্দার্ন রেলওয়ে। পূর্ব রেলের পর উত্তর রেল।
মুগলসরায় বা মোগলসরাই থেকে বাবা পোস্টেড হন বর্ধমানের খানা, পানা-গড়ে। তারপর হাওড়ায়, হাওড়া স্টেশনে। রুটরিলে কেবিনের কেবিন এ এস এম হিসাবে।
আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ
বাবা ‘ভারত’ বা ‘পানামা’ বাদ দিয়ে ‘প্রিন্স’ ব্লেডে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু ‘সেভেন ও ক্লল’ তাঁর একাত্তর বছরের জীবনে আর ফিরে আসেনি।
‘সেভেন ও ক্লক’ ছিল তথাকথিত ‘বড়লোক’, ‘অ্যারিস্টোক্র্যাটদের’ ব্লেড, এমন কথা বলতেন অনেকে। আমার পিতৃদেব অবশ্য নিজেকে কখনই রিচ ম্যান বা অভিজাত ভাবতে পারেননি। ভাবার কোনো সুযোগও ছিল না। তবু তাঁর 'সেভেন ও ক্লক', রেলে চাকরি পাওয়ার পর, প্রথম জীবনে।
তার আগে সংস্কৃত কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চাকরি করতে করতে হঠাৎই তিনি এই চাকরি ছেড়ে টিউশন নির্ভর হন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল এই চাকরির ব্যাপারে যদি কারও— কোনো আত্মীয়ের সুপারিশ থেকে থাকে, তাহলে পরবর্তী সময়ে তিনি দু-একটি কথা বলতে পারেন, সম্পর্কের সুতোর রং বদলে গেলে, তাই এই সিদ্ধান্ত।
ভারতীয় রেলের চাকরি, সরকারি চাকরি। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি। অমরনাথ মাঝে মাঝেই বলতেন, চুরি না করলে সরকারি চাকরি যাবে না।
যদিও রেলে তখন প্রচুর চুরি। ডি এস অফিস, চেকিং স্টাফ— টি টি, টিসি শুভমবাবু, মোবাইল চেকার, ফ্লাইং চেকার, ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং— যেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে চেকাররা থাকেন। সঙ্গে পুলিশ। রেলপুলিশ। চুরি আছে, ঘুষ-ঘাষ আছে, নিন্দুকে তাই বলে।
নব্বই দশকে দেখেছি স্টেশনে স্টেশনে লোকাল ট্রেনের ডব্লু ও টি, মানে উইদ আউট টিকেট ধরার জন্য আলাদা করে দুটি বগি রাখা আছে লাইনের ওপর। ভেতরে পুলিশ।
অমরনাথ বলতেন, রেলে যদি চুরি না হত, তা হলে ভারতীয় রেলওয়ের সমস্ত ইস্পাতের লাইন সোনার— সোনা দিয়ে তৈরি হয়ে যেত।
বাবা রেলে পরীক্ষা দিয়ে জয়েন করার আগে বিমা কোম্পানি- ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কেরানির চাকরি করেছেন। সেটা ১৯৪৮-১৯৪৯ হবে। সদ্য স্বাধীন দেশ। ইনসিওরেন্স কোম্পানিরা তখন সব প্রাইভেট— ব্যক্তি মালিকানায়। বাবা সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে বিমা কোম্পানিতে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিরা যা ইচ্ছে করে। কর্মচারীদের চাকরির কোনো গ্যারান্টি নেই। এই সময়টাকে ‘কোম্পানির আমল’ও বলা হয়ে থাকে। দেবেন ভট্টাচার্য, সচ্চিদ ভট্টাচার্যরা ছিলেন একরমই একটি ইনসিওরেন্স কোম্পানির মালিক। সচ্চিদ ভট্টাচার্য পূর্ববঙ্গীয় পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি আবার সিনেমা প্রযোজনাও করতেন। অঞ্জনা ভৌমিক, অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিকের সঙ্গে তাঁর ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ছিল বলে শুনেছি। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। আর এ মন্তব্যের দায়ও আমার নয়। সবটাই শোনা কথা।
অঞ্জনা ভৌমিক উত্তমকুমারের সঙ্গে বহু ছবি করেছেন। ‘রাজদ্রোহী’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘শুকসারী’, ‘কখনও মেঘ’, ‘থানা থেকে আসছি’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ছবি করেছেন তিনি, ‘মহাশ্বেতা’।
দেবেন ভট্টাচার্য, সচ্চিদ ভট্টাচার্য— ওঁরা দুই ভাই। বহু ব্যবসা, উদ্যোগ ওঁরা নিয়েছেন। বাঙালি উদ্যোগপতি হিসাবে তাঁদের নাম স্মরণ করতেই হবে। ‘বঙ্গ লক্ষ্মী কটন মিল’ সম্ভবতই তাঁরই। প্রায় ডেকে ডেকে পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণের ছেলে-মেয়েদের চাকরি দিয়েছেন তাঁরা। উপকৃত হয়েছে বহু পরিবার। তবে এই ব্যবসা, উদ্যোগ তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি।
কথা বলতে এই প্রসঙ্গে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী ও দুঃখহরণ চক্রবর্তী— এই দুই ভাইয়ের নামও মনে পড়ে গেল। এঁরাও ছিলেন পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ ও বিশিষ্ট সারস্বত ব্যক্তিত্ব। চিন্তাহরণবাবু ‘ভারতকোষ’ যা খণ্ডে খণ্ডে বার করেছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। তার নানা খণ্ডে বিবিধ বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
চিন্তাহরণবাবু, দুঃখহরণ চক্রবর্তী তাঁদের পিতৃদেব— এসব নিয়ে নানা পল্লবিত কাহিনী আছে। আমি সেই ব্যাপারে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। দেবেন ভট্টাচার্য ও সচ্চিদ ভট্টাচার্যের কথা স্মৃতির কালাধার পাত্রে তুলে রাখলাম আপাতত।
কেউ যেন দয়া করে এর মধ্যে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ খুঁজতে যাবেন না। ‘বামনাইপনা’র কোনো সাফাই গাইবার ইচ্ছে আমার নেই। যা আছে, তা কেবল বাঙালির ব্যবসায়ে উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার হারানো পাতাদের ফিরিয়ে আনা। সেই সঙ্গে বাঙালির মনীষার কথাও বলার চেষ্টা করা।
কথা হচ্ছিল বাবা দাড়ি কামানোর ব্লেড নিয়ে। সেই সঙ্গে গালে ঘষার ফেনায়িত ব্রাশ ও সাবান।
দাড়ি কামানোর ব্রাশ, গালে সাবান লাগান ব্রাশ, তখনও কাঠের হ্যান্ডেল, গরু বা মোষের পুচ্ছটুকু সেখানে ব্রাশের কেশ। যা দিয়ে সাবান রগড়ানো হয়। তখন ফোম, আফটার শেভ লোশন, শেভিং সেটের জেল— কিছুই নেই। শেভিং কিট, সেভিং সেট আছে ‘বড় মানুষ’-দের জন্য। আমি সত্তর দশকের গোড়ার কথা বলছি এই সময়েই তো আফটার শেভ লোশন হিসাবে ‘ওল্ড স্পাইস’ এল।
আমার বাবা সংসারের গতিবেগ, তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে শেভিং সাবান— গোদরেজ কোম্পানির শেভিং সাবান বাদ দিলেন। খরচ বাঁচানোর অছিলায়। গায়ে মাখার ‘মার্গো’ সাবান, যা ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়— পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালে যা রাখা থাকত গায়ত্রী রায়েদের মাসান্তিক সাবান খরচের সোপকেসে। আর ওই সাবানদানি অবশ্যই অ্যালুমিনিয়ামের ওপর প্লেটিং— রং করা, যা তাঁদের ১৯৫২ সালে বিবাহ উপলক্ষে পাওয়া।
বাবা সেই গায়ে মাখার মার্গো সাবানে দাড়ি কামাবার ব্রাশ ঘষে নিতেন। তাতে যেটুকু ফেনা, সেটুকু দুগালে। তারপর শেভ করা। যে কাঠের হ্যান্ডেলওলা ব্রাশের কথা বললাম তা হাত থেকে পড়লেই দু টুকরো। বাবা তো বহুদিন সেই ভাঙা ব্রাশ কালো গার্ডার দিয়ে একটা কেজো মতো জোড়ার ব্যবস্থা করলেন।
মা একদিন বিরক্ত হয়ে সেই গার্ডারের জোড়া শেভিং ব্রাশ ফেলে দিলেন। তারপর বাবার নতুন দাড়ি কামানোর ব্রাশ কেনা। আগের কাঠের হ্যান্ডেল-সমেত ব্রাশটি দশ আনা মানে সাতষট্টি নয়া পয়সা। প্লাস্টিকের হ্যান্ডেল সমেত নতুন ব্রাশের দাম একটাকা। তার যে গালে সাবান মাখানোর কেশ তাও নাইলনের।
ষাটের শেষে তথাকথিত নাইলন বিপ্লব হচ্ছে দুনিয়া জুড়ে। নাইলনের সঙ্গে টেরিলিন, টেরিন, ডেক্রন, টুইংকল— নানা ধরনের সিনথেটিক কাপড়। সহজদাহ্য নাইলন শাড়ি, নাইলন জামার রমরমা।
মুখে মুখে তখন—
‘নাইলন শাড়ি, পাইলট পেন
প্লেন থেকে নেমে এল সুচিত্রা সেন।’
তখন মুখে মুখে এইরকম ছড়াও ঘুরে বেড়াত—
‘আমাদের পকেটে ফাউনটেন পেন
উত্তমের পকেটে সুচিত্র সেন।’
কিংবা—
‘প্লেন প্লেন প্লেন
প্লেন থেকে নেমে এল সুচিত্রা সেন।’
সেই শেভিংব্রাশটি দামে বেশি, পোক্ত, মজবুত। হাত থেকে পড়লে ভাঙে না।
বাবার সেই দাড়ি কামানোর জন্য গরম জল করার বাটি বাতিল কোনো 'জঞ্জাল'। যেমন আমার ঠাকুমা— শিবানীদেবীর বাবাকে কিনে দেওয়া ছোট্ট, ভারী অ্যালুমিনিয়াম গ্লাস, বাবা তাঁর স্কুলে জল খাবেন বলে। সেই গেলাস ‘জঞ্জাল’। ৫৯/১৩ সান্তিরাম রাস্তায় মাটির বালির বাড়িতে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা এই ‘কম্মো’টি করেন।
তিন নয়া পয়সা মানে চৌষট্টি পয়সায় পুরনো টাকার হিসেব, তাতে একখানা ‘ভারত’ ব্লেড। লালচে কভারের ভেতর একটি যেন দীনহীন ফেলনা, তবু তার প্রধান উপাদান সে কথা তো আগেই বলেছি। অবশ্যই যারা দাড়ি কামিয়ে থাকেন বাড়িতে, তাঁদের জন্যই এই কথাপাতটুকু। সেটা ষাটের দশক বহু হিন্দু বাঙালি বাড়িতে নিজেরাই দাড়ি কামিয়ে থাকেন পিতলের ‘জিলেট’ নামের ভারি, পিতলের ওপর রুপোলি পালিশ করা রেজারে। রেজার খুললে পরেই তার তিনটে ভাগ। একটি হ্যান্ডেল, তাতে প্যাঁচ আটকে দুটো চৌকো, ঠিক চৌকো নয় আয়তাকার ছোট জিনিস ফুটোতে ঢোকানোর মাপ অনুযায়ী ছোট বল্টু সমেত। এই দুই আয়তকার চৌকোর ভেতরেই ব্লেড। ব্লেড। এছাড়াও আরও কয়েক বছর পরে হ্যান্ডেল ঘোরালেই হাঁ হয়ে যায় এমন মুখের রেজারের ভেতর ব্লেড ঢুকিয়ে দাড়ি কামানো। এছাড়াও কালো রঙের প্লাস্টিকের সস্তার রেজার পাওয়া যায় বাজারে। দাম চার আনা।
মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি তখন দাড়ি কামাবার পর গালে ঘষার জন্য ফটকিরি খণ্ড রাখেন। দেখতে অনেকটা যেন শাদা মিছরির কুঁদো, এমনও ফটকিরি কিনে আনতে দেখেছি বড় পরিবারে। তখন যৌথ পরিবার। সবই বড়ো বড়ো, ভাতের হাঁড়ির চালের টিন বা জালা, আটা রাখার জায়গা, বিস্কুটের জায়গা। সেই সঙ্গে সুলেখা কালির বড়োসড়ো বোতল। সেই বড়ো কাচের বোতলে ‘রয়্যাল ব্লু’, ব্লু-ব্ল্যাক কালি। কখনও কখনও ‘ব্ল্যাক’— কালো। এই কালি ঝর্ণা কলম— ফাউন্টেন পেনে পুরে লেখার ব্যবস্থা। এই সব কালির পেন, একটু দামি হলে তার পেটের ভেতর ড্রপার ফিট করা। তা না হলে ড্রপার দিয়ে দোয়াত থেকে কালি তুলে ঝর্ণা কলমে পুরে দিতে হত। ড্রপার প্রথমে কাচের হত, পরে প্লাস্টিকের। কাচের ড্রপারের মাথায় রাবারের টুপি। কালি বলতে তখন ‘সুলেখা’, ‘ক্যামেল’, ‘সুপ্রা’, ‘চেলপার্ক’, ‘পারকার’। কলম— ফাউন্টেন পেনগুলোতে ‘রাইটার’, ‘মাতৃ রাইটার’, ‘উইলসন’, ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘ক্যামেল’। ‘প্রেসিডেন্ট’ ছিল বেশ মোটাসোটা ভারী। বিদেশি কলম বলতে ‘পাইলট’, ‘ব্ল্যাকবার্ড’, 'ওয়াটারম্যান'। ‘পার্কার ৫১’ দামি ফাউন্টেন পেন। তার নিব অনেক সময়ই রুপোর বা সোনার।
আমার বাবা অমরনাথ রায় যুদ্ধের বাজারে একটি ‘পার্কার ৫১’ কেনেন, সম্ভবত দশ টাকায়। সেটা ১৯৪২-৪৩-৪৪ হবে। বাবার তখন বছর কুড়ি বয়স। সেই কলমটি খুবই পছন্দের ছিল তাঁর। শুনেছি আমাদের বালির বাড়ি থেকে সেই কলম ‘রহস্যজনক’ভাবে চুরি হয়ে যায়। মোটাসোটা টিনের চাদরের তৈরি একটি ছোট, চৌকো, সবুজ রঙের সুটকেসের ভেতর কলম থাকত জানি। একহাত বাই একহাত টিনের স্যুটকেস। রীতিমতো ‘রহস্যময়’ চুরি।
‘পাইলট’, ‘পার্কার ৫১’-এর গোল্ডেন ও সিলভার ক্যাপ হত। সোনা ও রুপোর তৈরি ক্যাপ। আবার সোনার জল করাও হত। বাবার ‘পার্কার’টি সিলভার ক্যাপ। ‘পাইলট’ হত মেড ইন জাপান, সেই কলমও খুব ভালো। আমাদের দেশেও ‘পাইলট’ পেন পাওয়া যেত, দিশি পাইলট।
তো সে যাই হোক, কথা হচ্ছিল যৌথ পরিবার বা জয়েন্ট ফ্যামিলি নিয়ে। সেই জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়োসড়ো ফটকিরি খণ্ড। ফটকিরি অ্যান্টি সেপটিক। ফলে বাড়িতে বাড়িতে কামাতে আসা নরসুন্দর, সেলুন— সবখানেই উপস্থিত ফটকিরি।
একদা ‘দ্য স্টেটসম্যান’, লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, আমেরিকার ‘টাইম লাইভ’, তখনকার বম্বে থেকে প্রকাশিত ‘ব্লিৎস’, সাপ্তাহিক ব্লিৎস ও কলকাতার সাপ্তাহিক দর্পণে একসঙ্গে সাংবাদিকতা করা প্রশান্ত সরকার দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক হন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে ১৯৭৭ সালের পর। প্রশান্ত সরকার দর্পণে চাণক্য সরকার নামে লিখতেন।
‘দৈনিক বসুমতী’ থেকে প্রথম পর্যায়ে অবসর নেওয়ার পর প্রশান্ত সরকার একটি অতি বড় ফটকিরির খণ্ড কিনে আনলেন বাজার থেকে। তারপর বললেন, দুটো প্যান্ট, দুটো শার্ট এই ফটকিরি খণ্ড আর ব্লেডের কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে তিনি চলে যাবেন হুগলিতে। তাঁর গ্রামের বাড়িতে। সেই গুড়াপ বা গুড়ুপ নামের গ্রামে যেতে হয় ধনেখালি অথবা পলাশী স্টেশনে নেমে। কর্ড লাইনের ট্রেন। প্রশান্ত সরকার ঠিক করলেন এই সব জিনিস পত্র— মানে দুটো ফুল প্যান্ট, দুটো শার্ট, একজোড়া লুঙ্গি ও ফটকিরি-ব্লেড ইত্যাদি নিয়ে চলে যাবেন দেশের বাড়িতে। থাকবেন সেখানে। পড়াবেন লোকাল হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে বিনা পয়সায়। এবং একই সঙ্গে পড়াবেন স্থানীয় বাচ্চাদের উইদ আউট টিউশন ফি।
প্রশান্ত সরকার বা প্রশান্তদার সেই ‘ইউটোপিয়া’ সফল হয়নি। তাঁর বড়োসড়ো ক্যানসার— কোলন ক্যানসার অপারেশন হয়। ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে। এই বিষয়ে পরে বিস্তারিত লিখব এখানেই।
প্রশান্ত সরকার পুনরায় ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক হন। কলকাতার ‘দৈনিক বসুমতী’ বন্ধ করে দিল বামফ্রন্ট সরকার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রীও। চালু হল ‘দৈনিক বসুমতী’-র শিলিগুড়ি এডিশন। সে এক দীর্ঘ কাহিনি। ঐ সময়টায় প্রশান্ত সরকারের এডিটোরিয়াল অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে ভাউচারে দেড় হাজার টাকা পাই মাস গেলে।
প্রশান্ত সরকার রোজ দাড়ি কামাতেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত তখন ক্ষুরেও দাড়ি কামান কেউ কেউ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেণী সংহার’-এ আছে দাড়ি কামানোর জন্য এই ক্ষুরের ব্যবহার এবং ক্ষুর দিয়ে খুনের কথা। কলকাতা ময়দানে একটি বিশেষ দলের ফুটবল ম্যাচ থাকলে ক্ষুরের ব্যবহার যথেষ্ট। যথেচ্ছ।
মেট্রো গলিতে বিক্রি হত ‘মেড অ্যাজ জার্মানি’ ক্ষুর— রেজার। ‘মেড ইন জার্মানি’ নয় কিন্তু। দাম দশ টাকা।
ক্ষুর থাকলেই, তা ধার করার জন্য থাকবে ‘চামাতি’। চামড়ার তৈরি ধার দেওয়ার সরু ফালি। বেশির ভাগই বাতিল পুরনো চামড়ার বেল্ট। বেল্টকে হিন্দিতে বলে ‘পেটি’, বিশেষ করে জেলে। সেলুন ঘরের দোকানে, দেওয়ালে টাঙানো থাকে বাতিল বেল্ট।
যাঁরা— যে নরসুন্দর বা পরামানিকরা বাড়িতে বাড়িতে কামাতে আসতেন, তাঁদের কাছে ক্ষুর বা হিন্দি বলয়ের ‘উস্তরা’ ধার দেওয়ার জন্য আয়তাকার পাথর বা চামড়ার টুকরো রাখতে দেখেছি।
ক্ষুর, নরুন দিয়ে অনেক ছোট খাট সার্জারি সারতেন নরসুন্দররা। ফোড়া কাটায় তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শরীরের ছোট ‘আব’, ‘আঁচিল’ও কেটে দিতেন তাঁরা অনায়াসে। তাতে যে বিপদ একেবারে হত না তা নয়। দুর্ঘটনাও ঘটত। শরীরের আঁচিলে ঘোড়ার ল্যাজের চুল, বালামচি বাঁধার রেওয়াজ ছিল, ষাটে-সত্তরে। তার ওপর পান খাওয়ার চুনের প্রলেপ। তাতেই আঁচিল পড়ে যাবে। সঙ্গে হোমিওপ্যাথি দাওয়া ‘থুজা’।
ব্লেড দিয়ে হাত-পায়ের শিরা কেটে ‘সুসাইড’ বা সুইসাইডের বিষয়টি তখনও ফিল্মে ও জীবনে আসেনি। তখনও ইংরাজিতে ‘পয়জন’ লেখা শিশি খুলে নিয়ে তার ভেতর থেকে বড়ি, ক্যাপসুল বা লিকুইড খেয়ে নাটুকে আত্মহত্যার চেষ্টা চিত্রময়তায় বহমান।
সত্তর দশকের গোড়ায় বোতাম, পেরেক, স্ক্রু, চিনা বাদামের খোসা, সাবান, মোম, দরজার কবজা, বাঁশ, কঞ্চি, বাখারি, বরফ, ভাঙা ও গোটা ব্লেড দিয়ে সরস্বতী, দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়ে থাকে। পুজোর জন্য ছোটো মাটির মূর্তি থাকত। কালী ঠাকুর তৈরিতে এইসব উদ্যোগ দেখিনি।
মনে পড়ে একজন, দুজন মানুষ পথে-ঘাটে, ট্রেনে ভাঙা ব্লেড, পেরেক, স্ক্রু খেয়ে খেলা দেখাতেন, আয় করার জন্য।
‘জিন্দাল’দের ব্লেড কারখানা ছিল হাওড়ার বেলুড়ে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সেই কারখানা থেকে আবারিত দামি প্যাকেট। ভালো খাবার তার ভেতরে, মনে পড়ে।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor