হাওয়াই চপ্পল, সাংবাদিকতা, দণ্ডী কাটা

১৯৬৯ সালের পয়লা মে— মে দিবসের মঞ্চে দুপুর পেরনো বিকেলে প্রবল সংঘর্ষ গোটা ধর্মতলা— এসপ্ল্যানেড জুড়ে। ধু-উ-ড়ু-ম-ধু-উ-ড়ু-ম বোমা, সকেট বোমা, ‘ক্লোরামাইন’ গ্রেনেড, সেইসঙ্গে কাঁদানে গ্যাস— টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার শব্দ। কলকাতায় তখন অনেক অনেক হাইড্র্যান্ট— গঙ্গা জলের কল। কলকাতা তখন বিস্তৃত এক রণক্ষেত্র। কে কোথায়, কোথা দিয়ে দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে, ছুটে গিয়ে বোমা ছুঁড়ছে পুলিশ ও বিপরীত রাজশক্তির বিরুদ্ধে— তা বলা মুশকিল। সমস্ত ধর্মতলা অঞ্চলই রণক্ষেত্র। পায়ের চটি আর পায়ে থাকছে না, ছিটকে যাচ্ছে অন্য কোথাও— দূরে, কাছে। ছিঁড়ে যাচ্ছে পায়ের জীর্ণ চপ্পল, হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ। তখন ‘বাটা’ ছাড়া ‘ট্রট’ কোম্পানির হাওয়াই চটি খুব চলে। আর ছিল ‘পান্ডা’ কোম্পানির হাওয়াই। নীল স্ট্র্যাপঅলা ‘ট্রট’ কোম্পানির মজবুত হাওয়াই তখন দশটাকা— এক পেয়ার মানে এক জোড়া। ‘বাটা’-র দামও দশ টাকা। বাটার— বাটা কোম্পানির হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ পাল্টাতে লাগে পঞ্চাশ নয়া পয়সা। ছেঁড়া স্ট্র্যাপ অনেকেই সেফটিপিন গুঁজে গুঁজে চালান। স্ট্র্যাপ আবার দু-রকমের তখন, একটা ডাবল ফিতের। অন্যটা চওড়া ফিতে। রং বলতে নীল সবুজ, হলদে। কালো কখনও কখনও, সাদা খুব কম। ‘ট্রট’ কোম্পানি হাওয়াই চপ্পল বহু বছর চলেছিল। পুরো সাত দশক জুড়ে। ‘পান্ডা’ কোম্পানির জুতো খুব বেশিদিন বাজারে পাওয়া যায়নি। পরে আট দশকে ‘অজন্তা’ হাওয়াই এল। ‘সন্তোষ’ কোম্পানির ট্রানজিস্টার যেমন, তেমনই তারা বাজার দখল করল। খবরের কাগজে কাগজে, বিজ্ঞাপন। ‘জোড়া মুগুর মার্কা’ অজন্তা হাওয়াই। পাশাপাশি ‘খাদিম’-এর হাওয়াই কিছুদিন চলল। বিএসসি— বাটা শ্যু কোম্পানিও বার করেছিল হাওয়াই চটি। সেও তো খুব পোক্ত, একদম মালমুগুর যাকে বলে। ‘মালমুগুর’ অর্থে পোক্ত, খুব মজবুত। ‘বিএসসি’-র হাওয়াই চলেনি বেশিদিন, বাজারে থাকেনি। এছাড়াও আরও ছোটো খাটো কোম্পানি ছিল হাওয়াই চটি তৈরির। ‘বণিক রাবার ইন্ডাস্ট্রি’ তৈরি করে অজন্তা। তার মালিক চন্দন বণিক জড়ালেন দেবযানী বণিক খুনের মামলায়। সে এক অতিদীর্ঘ ইতিহাস। বাংলার দৈনিকে দৈনিকে তখন দেবযানী বণিক হত্যা মামলার বিবরণ, রোজ। যেমন সাত দশকের সুরূপা গুহ হত্যা মামলা। সুরূপা গুহ হত্যা মামলায় সাউথ পয়েন্ট স্কুলের তখনকার সর্বেসর্বা শশিকান্ত গুহ, ইন্দ্রনাথ গুহ, প্রীতিলতা গুহ এবং তাঁদের বাড়ির কর্মসায়ক ঝাঁটুচরণ বা ঝন্টুচরণ দত্ত অভিযুক্ত। যতদূর মনে পড়ে ঝাটুচরণ বা ঝন্টুচরণ দত্তর সাজা হয়েছিল লোয়ার কোর্টে। আলিপুর জাজেস কোর্টে রণবীর মহাপাত্রর এজলাসে সুরূপা গুহ হত্যা মামলার শুনানি হয়। তখন রোজ ‘দৈনিক বসুমতী’-র দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে। তখন এক কলাম খুর দৈনিক বসুমতীতে ছাপা হলে পাঁচ টাকা পাই। টানা এক কলাম খবর ছাপা হলে পাঁচ টাকা। কেবল সুরূপা গুহ হত্যা মামলার রিপোর্ট যতটাই ছাপা হোক, তার জন্য পেতাম দশ টাকা। বিল করে দিতে হত মাসের শেষে। সেই বিল বাবদ টাকা পেতে জুতোর শুকতলা— সুকতলা ক্ষয়ে যেত। সেসব কথা তো আগেও লিখেছি। শচীনবাবু ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র অ্যাকাউন্টসে। তাঁরই যত অনীহা আমার বিল দেওয়ার— বিল পেমেন্টের ব্যাপারে। ১৯৭৮-৭৯-৮০ সালে মাস গেলে খবর করা বাবদ আয় হয় একশো কুড়ি, একশো পঁচিশ, একশো তিরিশ টাকা। তা দিতেই তো অ্যাকাউন্টেন্টবাবুদের হাত-পা সেঁধিয়ে যায় পেটের ভেতর। ‘বাবু’-র এত এত টাকা নিয়ে যাচ্ছেন, এভাবে ‘বাইরের লোক’। নিচে ক্যাশ ডিপার্টমেন্ট। সেখানে বিষ্টুবাবু, বিলাশবাবু, তাঁরা অত্যন্ত ভদ্র। বিশেষ করে বিষ্টুবাবু। ধুতি শার্ট। বাংলা শার্ট— কেমব্রিজের। যেমন পরতেন উত্তমকুমার পঞ্চাশ ও ষাট দশকে— পাঁচ ও ছয়ের দশকের বহু বাংলা সিনেমায়। হেমন্তদা— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও এই পোশাকেই ফাংশান করতেন। গান গাইতেন ‘জলসায়’— ‘জলসা’-র ভরা আসরে। তো সেই বিষ্টুবাবু সম্ভবত বাঁকড়ে বা বাঁকুড়ার মানুষ। কথায়— মুখের ভাষায় কেমন যেন বাঁকড়ি টান। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ কালো— কার্লি হেয়ার। শার্টের হাতা গোটানো। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁত করে কামানো, পায়ে স্যানডেল— অত্যন্ত ভদ্রজন। পাশেই বসতেন বিলাসবাবু— দৈনিক বসুমতীর ক্যাশ ডিপার্টমেন্ট। তিনি নিত্যদিন পাট ভাঙা ধুতি— মিলের ধুতি, তার ওপর ফাইন হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিতে কড়া মাড়, কড়া করে ইস্ত্রি। হাতা সামান্য গোটানো। যথেষ্ট নস্যি নেন। মুহুর্মুহু। তাঁর উচ্চারণ তাই খানিকটা নস্য ভারাক্রান্ত। অনুনাসিক বলা যাবে না সেই কথাযাপনকে। কিন্তু কেমন যেন গম্ভীর, সামান্য। তাঁর উচ্চারণে মিশে আছে পূর্ববঙ্গ। তিনিও বেশ মানুষ। এঁরা দুজন ছাড়া দৈনিক বসুমতীর ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে ছিলেন আরও একজন। বিষ্টুবাবু বা বিষ্ণুবাবু ছিলেন হেড ক্যাশিয়ার। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ক্যাশ ডিপার্টমেন্টের অজিতবাবুর কথা। অজিতবাবুও খুব স্বজন মানুষ। থাকতেন বেহালার দিকে। মালকোঁচা করা মিলের ধুতি, তার ওপর টেরিকটের চুরিদার পাঞ্জাবি। মাথাজোড়া টাক। আবার সেই টাকার সামনে বাহারি টেরি, যতটুকু কেশ অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে। শীতে তিনি কলকাদার রঙিন শাল, নয়তো উল-কাঁটায় বোনা, হাতে বোনা— বুনে দেওয়া বুক কাটা সোয়েটার। অবশ্যই হাত কাটা, হাফ হাতা সোয়েটার। ঘি রঙের, ঘিয়ের পাশাপাশি সাদাও। ‘যুগান্তর’-এ ছয়ের দশকে ক্যাশিয়ার ছিলেন পান্নাবাবু। তখন যুগান্তর-এর একটা বাড়ি, বাগবাজার স্ট্রিটের ওপর, পাশেই হরলাল মিত্র স্ট্রিট। সেই বাড়ি ভাঙা পড়ে যায়। এবাড়ির প্রায়ান্ধকার একতলায় যুগান্তর সাময়িকী, ছোটোদের পাততাড়ি, সিনেমা ও নাটক বিভাগ। ষাট দশকের— ছয়ের দশকের শেষে, সাতের দশকেও যুগান্তর-এর পাঁচ-ছটি পাতা— বিভাগ দেখতেন কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ‘যুগান্তর’-এর রবিবারের সাময়িকী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়- আশুদার আগে দেখতেন পরিমল গোস্বামী। তিনি ‘একবলম্বী’ নামে ইতশ্চেতর বলে একটি কলাম লিখতেন নিয়মিত। এই লেখার হেডপিস এরকম ছিল— ইতশ্চেতর একবলম্বী। সেইসময় দিলীপ রায়— তিনি ‘অঘটন আজও ঘটে’ লিখতেন রবিবারের সাময়িকীতে। তখন শিল্পী কালিকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদার যুগান্তর সাময়িকীতে আছেন কর্মসূত্রে। ফ্রিলান্স করেন সূর্য যায়, মৈত্রেয়ী, নৃপেন। মৈত্রেয়ী ছিলেন একজন ফিটফাট নারী, সসজ্জিতা সবসময়। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের শৌখিন চশমা, জর্জেট অথবা সিল্কের শাড়ি। মুখে পাউডারের হালকা প্রলেপ। রং খুব ফর্সা নয়, তাই ফেস পাউডারের ব্যবহার। এই বিভাগে গল্পকার ধর্মদাস মুখোপাধ্যায় চাকরি করতেন।  ধর্মদাস মুখোপাধ্যায় বামপন্থী বিশ্বাসের জন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তেভাগা-নীতি, তেভাগা আন্দোলন নিয়ে তাঁর গল্প আছে। তেভাগা আন্দোলন ও কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়— বড়মলশ্বের মাঠ, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্মাণ করেছেন ‘হারানের নাতজামাই’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’। নারায়ণবাবুর ‘নহ্নচরিত’, মাণিকবাবু ও নারায়ণবাবুর ‘দুঃশাসনীয়’ ও ‘দুঃশাসন’ দুর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলন কেন্দ্রিক, তার কাছাকাছি গল্প। বাংলা সাহিত্যে ‘তেভাগা’-র ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে মিহির সেন, ননী ভৌমিক, সৌরী ঘটক আছেন। ননী ভৌমিক তো বিখ্যাত তাঁর ‘ধান কানা’ ও ‘ধুলোমাটি’-র জন্য। সৌরী ঘটক ‘কমিউনিস্ট পরিবার ও অন্যান্য গল্প’, ‘কমরেড’-এর জন্য টিকে থাকবেন বাংলা সাহিত্যে। কবি ও গদ্যকার গোলাম কুদ্দুস লিখেছেন তেভাগা নিয়ে লিখেছেন ‘জনযুদ্ধ’-র পাতায়। গোলাম কুদ্দুসের বিখ্যাত কবিতা তেভাগার ইলা মিত্রকে নিয়ে। তাঁর সেই অতিবিখ্যাত— স্মরণযোগ্য লাইন বার বার মনে পড়ে— ইলা মিত্র স্তালিন নন্দিনী/ ইলা মিত্র ফুচিকের বোন…’। কুদ্দুসদা— গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে খুব আলাপ ছিল। বার বার গেছি এই নিঃসন্তান মানুষটির বাড়ি। দোতলায়, প্রায় টঙের ঘর বলা যেতে পারে তাকে। তবে তা আয়তনে বেশ বড়ো এবং সাজানো। সেখানেই থাকতেন ‘মরিয়ম’-সহ অন্যান্য আখ্যানের আখ্যানকার, একদা ‘জনযুদ্ধ’-র রিপোর্টার, যিনি অখণ্ড বঙ্গের গ্রামে গ্রামে ঘুরে তেভাগার রিপোর্ট তৈরি করেছেন, আর তা ছাপা হয়েছে ‘জনযুদ্ধ’-তে। জনযুদ্ধর পাশাপাশি ‘পিপলস ওয়ার’-এও ছাপা হয়। তখনকার ‘জনযুদ্ধ’ বা ‘পিপলস ওয়ার’— আমি তেভাগা পর্বের কথা বলছি, উল্টেপাল্টে দেখলে মনে হবে, এই মুখপত্র আসলে এমসিসি— মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার, ‘পিপলস ওয়ার গ্রুপ’ বা পিডব্লুজি, সিপিআই (এম-এল) পিপলস ওয়ার গ্রুপ, সিপিআই (এমএল) পিইউ— পার্টি ইউনিট-এর সম্মিলিত দল সিপিআই এম (মাওবাদী)-র রেপ্লিকা একেবারে। হুবহু কার্বন কপি বা ফটো কপি। এমনকি পয়লা পাতায় বন্দুক বা রাইফেল হাতে যে জনযোদ্ধা, তাও যেন সিপিআই (মাওবাদী) পরে হুবহু কপি করেছে। তেভাগা নিয়ে ছবি এঁকেছেন চিত্রপ্রসাদ। ছবি নির্মাণ করেছেন সোমনাথ হোর। তাঁর অতি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তেভাগার ডায়েরি’ তো প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয় এক্ষণ পত্রিকায়, স্কেচ সহ। পরে সেটি বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। কবি কমলেশ সেন সাত দশকের প্রায় শেষ পর্বে এসে তেভাগার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে একটি গল্প সংকলন সম্পাদনা করে। সুশীল জানাও ছিলেন তেভাগা পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি— ভারতের না-ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টির ছাতার মধ্যে। যতদূর জানি, তিনি টুকরো না হওয়া সিপিআই-এর মেম্বার ছিলেন। তাঁর কাকমারাদের নিয়ে অতি বিখ্যাত গল্পটিকে ধরে ‘দখল’ নামে সিনেমা নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ। তার আগে তিনি ছবি করেছিলেন তেলেঙ্গানার কৃষক সংগ্রাম নিয়ে। সেই ছবির নাম ছিল ‘মা ভূমি’। তেলেঙ্গানার ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রাম নিয়ে কিষণচন্দর লিখেছিলেন ‘যব ক্ষেত জাগে’। ‘মা ভূমি’ ও ‘দখল’ দেখে গৌতম ঘোষের সিনেমা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। পরে তা প্রায় নষ্ট হয়ে যায় তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। তবু গৌতম ঘোষের ‘পার’ ভালো লেগেছিল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন গৌটম ঘোষ, এক সাংবাদিকের চরিত্রে, খুব লেগেছিল সেই অভিনয়। এছাড়াও আরও দু-একটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন গৌতমবাবু— চমৎকার সেই চরিত্রচিত্রণ। গৌতম ঘোষদের প্রজন্মের যাঁরা চিত্র পরিচালক, যাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বিপ্লব রায়চৌধুরী, অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথা। কবি ও চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে আমার মনে হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবি হিসাবেও স্বতন্ত্র। তাঁর সিনেমা শটের পরতে পরতে কবিতা কবিতা এবং কবিতাই যেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর ভাগ্নে। তাঁর ছবি— সেই ‘দূরত্ব’ ‘নিম অন্নপূর্ণা’ থেকেই মুগ্ধ করেছে আমায়। তো সে যাই হোক, তেভাগা নিয়ে লেখালিখি হয়েছে অনেক। সবই তো মহাকালের ধোপে টিকেছে, এমন তো নয়। সৌরী ঘটকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ‘পরিচয়’ দপ্তরে। ননী ভৌমিকের সঙ্গেও দেখা হয়েছে ‘পরিচয়’ অফিসেই। সেই সময়টা রূপবান ননী ভৌমিকের যাপনে খুব ভালো যে  চলছে, এমন তো নয়। তাঁর রুশী সহজীবনের মানুষ— স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। একটি পুত্র সন্তান সম্ভবত ‘স্পেশাল চাইল্ড’। ননী ভৌমিক তখনও মস্কোতেই আছেন। প্রগতি প্রকাশন— প্রগ্রেস পাবলিশার্স-এ অনুবাদক হিসাবে। যেমন ছিলেন অরুণ সোম, কামাক্ষীপ্রসাদs চট্টোপাধ্যায়, অমর সেনরা। একটা সময়, আটের দশকে কথা হয়েছিল একটা আমারও অনুবাদক হিসাবে অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার ব্যাপারে। নানা কারণে যাওয়া হল না। তারপর তো সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সমস্ত পূর্ব ইউরোপ— যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। পরিকল্পিত বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, শুরু হয়ে গেল তথাকথিত কমিউনিস্ট শাসন ও শাসকের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত পতন হল ‘সো কল্ড সোসালিজম’-এর। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সৌরী ঘটককে যখন পরিচয় দপ্তরে দেখি, তখন তাঁর নাকের নিচে ফৌজি স্টাইলের পাকাশে, চওড়া— পুরুষ্টু কাঁচা-পাকা গোঁফ। সৌরীদা— সৌরী ঘটকের এই মোচ-বাহার দেখতে দেখতে আমার কেন জানি না ম্যাক্স গোর্কি বা ম্যাকসিম গোর্কির গুম্ফবাহার ‘কঠিন’ মুখটাকে মনে পড়ে যেত। যতদূর মনে পড়ে সৌরীদা বর্ধমানের মানুষ। সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন তেভাগা আন্দোলনে। ‘পিপলস ওয়ার’— ‘জনযুদ্ধ’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর একসময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— না-ভাঙা সিপিআই-এর অরগ্যান দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ‘স্বাধীনতা’-য় সাংবাদিকতা করতেন সরোজ দত্ত, সোমনাথ লাহিড়ী, নৃপেন চক্রবর্তী প্রমুখ। সোমনাথ লাহিড়ী— পার্টি মহলে যিনি লাহিড়ী হিসাবে পড়িচিত, কী অসামান্য বাংলা লিখতেন। তাঁর সেই ‘বাংলা লেখার হাত’ টের পাওয়া যায় ‘কলি যুগের গল্প’ পড়লে। রিপোর্টাজের পাশাপাশি গল্পও লিখতেন সোমনাথ লাহিড়ী। ধুতি— টেনে পরা, হাফ শার্ট, সাইকেল, হাতে হাত ঘড়ি— সব মিলিয়ে সোমনাথ লাহিড়ী— ‘লাহিড়ী’। পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান সরোজ মুখার্জি— সরোজ মুখোপাধ্যায়ও সাংবাদিকতা করতেন ‘স্বাধীনতা’-য়। সাংবাদিকতার এক অন্যতম মাত্রা তৈরি করেছিল ‘স্বাধীনতা’ দৃষ্টান্তও। আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি হুগলি জেলার তারকেশ্বর, রাম চ্যাটার্জি, শান্তি চ্যাটার্জি, তারকেশ্বরের ‘দুধ পুকুর’, ইত্যাদি প্রভৃতি। তারকেশ্বরের আঁকা— ছাপা ছবিতে কেন যে ‘রাঢ়ে চ তারকেশ্বরয়’ লেখা থাকত তখন বুঝতাম না। একটি ছবি দশ নয়া পয়সা থেকে পঁচিশ নয়া পয়সা— ছয় ও সাতের দশকে। কাচ-কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো হলে তিনটাকা, দরাদরি করে আড়াই কাটা বড়োজোর। এছাড়াও লক্ষ্মীর পাঁচালি যেমন, তেমনই পাওয়া যেত তারকেশ্বরের— ‘বাবা’-র পাঁচালি। দাম পঁচিশ নয়া পয়সা। প্রতি বৃহস্পতিবার মা— গায়ত্রী রায় লক্ষ্মীর পাঁচালির পাশাপাশি পড়তেন তারকেশ্বর— বাবা তারকনাথের পাঁচালি, সুর করে করে—

‘বন্দিলাম জলার মধ্যে
ক্ষ্যাপা পশুপতি
চারিদিকে উলুখাড়া, বেনার বসতি…’

কে ছিলেন এই ‘বাবা’-র পাঁচালির পাঁচালিকার? এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে। জানবার উপায় আছে কিনা জানি না। গ্লসি পেপারে ছাপা মলাটে তারকেশ্বর— লিঙ্গ মূর্তি। তাঁর মাথায় গর্ত। সারা পাথুরে শরীর বেড়িয়ে রৌপ্য নির্মিত সর্প, বেশ বড়ো, এছাড়াও রুপোর— রজত নির্মিত সর্প ছিল আরও। এখনও হয়তো আছে। ছিল রুপোর ঘণ্টা। এখনও হয়তো আছে। ওখানে ভক্তজনের মানত করে ‘হত্যে দেওয়া’— হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, দুধপুকুর থেকে ডুবিয়ে— অবগাহন স্নান সেরে মাটিতে শুয়ে পড়ে— একেবারে ষষ্টাঙ্গ প্রণাম স্টাইলে— প্রণাম মুদ্রায় শুয়ে পড়ে, বুকে ভর দিয়ে দিয়ে ‘দণ্ডী কাটা’, দণ্ডী কাটতে কাটতে তারকেশ্বর মন্দিরের দিকে যাওয়া— এখনও চোখে ভাসে। স্মৃতি দর্পণে জেগে থাকে ভিজে, নতুন গামছা গায়ে জড়ানো কোনো পৃথুলা নারী, তাঁর স্তনভারে ভোরের অথবা দ্বিপ্রাহরিক আলো, সঙ্গে প্রবল ঢাক-ঢোল, কাঁসি, কাঁসর— ঘড়ি-ঘণ্টা— কলরব। কোলাহল।

Powered by Froala Editor