১৯৬৯-এর পয়লা মে ছিল ঘোর দাবদাহ। তার মধ্যেই কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে সিপিআই (এম-এল) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিবস। আগেই বলেছি, সভামঞ্চে কানু সান্যালের ডান হাতে চিনের— সাম্যবাদী চিন— গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে ছাপা রেডবুক— লাল বই। তখনও দেশব্রতী প্রকাশনীর রেডবুক প্রকাশিত হতে আরও এক বছর দেরি। সেদিন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বামফ্রন্টের ডাকে কেন্দ্রীয় সমাবেশ। প্রবল সংঘর্ষ সেদিন, হাতবোমা, হ্যান্ড গ্রেনেড, মলোটভ ককটেল। মূলত সিপিআই (এম) বনাম সিপিআই (এম-এল)। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি, তিনি হুগলির তারকেশ্বর কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় জিতে আসা বিধায়ক। তাঁর রাজনৈতিক দলের নাম মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক। মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের আত্ত্বিক নেতা ছিলেন সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী। মিলের ধুতি, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি। শীতের দিনে তার ওপর জহরকোট বা বুক কাটা শোয়েটার। রামদা— রাম চাটুজ্জে বা রাম চ্যাটার্জি শীতে জ্যাকেট, ফুলপ্যান্ট। সর্বদা গতিময় মোটর সাইকেলে, কালো রঙের। ‘বুলেট’, ‘রাজদূত’ নয়— ‘রয়্যাল এনফিল্ড’। বড়োসড়ো মোটরবাইক। নইলে বারোমাস তিনি সাফারি স্যুট। রাম চ্যাটার্জির নামের সঙ্গে নানা গল্পকাহিনি, অতি-কাহিনি জড়িয়ে, তাঁর ‘রবিন হুড’ ইমেজের জন্য। ‘বড়োলোকের থেকে কেড়ে নিয়ে গরিবদের দাও— গরিবদের বিলিয়ে দাও’, এমন একটা বিশ্বাস নিয়ে তিনি চলতেন। তাঁর নিজস্ব ‘ছেলেপুলে’— বাহিনী ছিল। সিপিআই (এম) নেতা পিডিজি— প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে পছন্দ না করলেও জ্যোতি বসুর রাম চ্যাটার্জিকে খুব পছন্দ করতেন। ফলে রামবাবু যুক্তফ্রন্ট-এর সময়ও মন্ত্রী। বামফ্রন্টের সময়েও মন্ত্রী। রাম চ্যাটার্জি, অসামরিক প্রতিরক্ষা— দমকল মন্ত্রী ছিলেন। রামবাবুর প্রয়াণের পর পর প্রতিম চ্যাটার্জি দমকল মন্ত্রী হন। তিনিও মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের। প্রতিমবাবু দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ, পায়জামা-আদ্দির পাঞ্জাবি, হাতে দামি— বিদেশি ঘড়ি, গ্রহরত্ন বসানো ভারতীয় জ্যোতিষ মতে কুপিত-সহ ফাঁড়া আটকানোর আংটি। ওঁদের হিরের ব্যবসা, সঙ্গে অন্য অন্য গ্রহরত্ন— পৈতৃক। হিরে ছাড়াও অন্য অন্য দামি পাথর— চুনি, পান্না, পোখরাজ, গোমেদ, মুনস্টোন, ক্যাটসআই সহ নানা পাথর। প্রতিমবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ ছিল। তিনি প্রায়ই আসতেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমীতে, তখনকার বাংলা অকাদেমী সচিব সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রতিম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। প্রতিম চট্টোপাধ্যায়ের সামান্য শখ ছিল লেখালিখির। তাছাড়া তিনি পপুলার বাংলা সিরিয়াল ও বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। বেশ কয়েকটি বাংলা সিরিয়াল ও সিনেমায়। তাঁর নিজের কাছে সাইলেন্সড রিভলভার থাকত। সেইসঙ্গে দেহরক্ষী। প্রতিম চ্যাটার্জিকে ‘প্রতিমদা’ বলতাম। রাম চ্যাটার্জিকেও ‘রামদা’। মনে আছে আটের দশকে হাওড়া জেলার বালির তরুণ সংঘ— নবীন সংঘ মাঠে— দুটো ফুটবল মাঠই তো একেবারে গা লাগোয়া, একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে পুরস্কার দিতে এলেন। বর্ষাদিনের ফুটবল প্রতিযোগিতা। কালো রঙের হেভি মোটরবাইক— ‘রয়্যাল এনফিল্ড’ চালিয়ে এলেন তিনি। তরুণ সংঘ মাঠে যাওয়ার জন্য— পৌঁছানোর জন্য একটি জলভর্তি খানা লফ দিয়ে পেরিয়ে মাঠে ঢুকতে হয়। রাম চ্যাটার্জি সেই পথেই গেলেন। তিনি দিব্যি এক বড়ো লাফ দিয়ে খানা— নর্দমা পেরলেন। তারপর মাঠে ঢুকে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে ব্যস্ত হলেন। এই ছিলেন মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চ্যাটার্জি। তাঁকে, তাঁর রবিন হুডগিরি নিয়ে বহু গল্প আছে। তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর স্ত্রী শান্তি চ্যাটার্জি মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের নির্বাচনী প্রতীক সাইকেল চিহ্ন নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াতেন তারকেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। শোনা কথা, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। বিধানসভা ভোটের আগে নাকি রাম চ্যাটার্জি তারকেশ্বর মন্দিরে ঢোকার মুখে খালি গায়ে ভিজে গামছা পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তার আগে তারকেশ্বর অতি বিখ্যাত দুধপুকুরে তিনি স্নান সেরে আসতেন। ‘দুধ পুকুর’ তো পরে ‘দূষণ পুকুর’ নামে চিহ্নিত হয়। বাল্যকালে বহুবার তারকেশ্বর গেছি। আমার রেলচাকুরে পিতৃদেব অমরনাথ রায় বছরে তিন সেট পাস আর দুটো পিটিও পেতেন। তাঁর পাস ও পিটিও অধিকাংশ সময়েই অর্থ ও ছুটির অভাবে ‘পচে’ যেত। সবটা ‘খরচ’ করা হয়ে উঠত না। পিটিও-তে ওয়ান থার্ড টাকায় যাওয়া যেত। তো সে যাই হোক, বাবা পিটিও নিয়ে আমাদের সঙ্গে করে তারকেশ্বর যেতেন। তারকেশ্বরের আলু-কুমড়ো, তরমুজ তখন অতিবিখ্যাত, সস্তাও। পোড়া মাটির ছোটো কুঁজো— লাল ও কালো রঙের, খুব কাজের, জল অসম্ভব ঠান্ডা হয়। এছাড়াও পোড়া মাটির সরায় রোলা বা রলা— শক্ত গোল গোল চিনির মিঠাই। ঠিক বাতাসা নয়, বাতাসা থেকে থেকে গড়নে সামান্য স্বতন্ত্র। আর ‘রোলা’ বা ‘রলা’ ভাঙতে দাঁতের জোর লাগে। সেইসঙ্গে নকুলদানা, ‘প্রসাদী’। আকন্দফুল, ফুল-বেলপাতা, পোড়া মাটির ঘটিতে আলাদা করে ‘চরণামৃত’। ‘বাবার চরণামৃত’। দুধ মেশানো জল। কী করে অবলীলায় সেই চরণামৃত পান করে বেঁচে আছি আজও, তা ভাবি। ওই দুগ্ধমিশ্রিত চরণামৃতর ভেতর বেলপাতা, একটি দুটি ফুল। আশ্চর্য হয়ে যাই এখনও ভেবে— এইসব ‘বিষ’ পান করে এখনও বেঁচে আছি। ‘দুধ পুকুরে’ তখন স্নান— অবারিত স্নান, সেই জল পান করা অবারিত। তারকেশ্বরের পিল খানায় তখন জোড়া হাতি। তারকেশ্বরে অবাঙালি মোহান্তদের প্রয়াতপ নেই। ‘মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ’, ‘তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ’, চিত্তরঞ্জন দাশ, জাতীয় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা— কিছুই সেভাবে জানি না। ‘মোহান্ত এলোকেশী’-র বিদ্যা নিয়ে বেরোয় কালীঘাটের অতি বিখ্যাত সব পটচিত্র, যা কালীঘাটের পটুয়াদেরই আঁকা। আর্চার সাহেব তাঁর বইয়ে এইসব পটের একরকম ব্যাখ্যা করেছেন। আবার তার অন্যতর ব্যাখ্যাও আছে। সেসব নিয়ে বিস্তারে যাচ্ছি না। রাম চ্যাটার্জি নাকি বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে দুধ পুকুরে অবগাহন— স্নান সেরে দাঁড়িয়ে থাকতেন মন্দিরের মূল দরজার একটু আগে। রোমশ খালি গা, রোমদার বলিষ্ঠ নগ্ন পা। হাতে পোড়ামাটির ছোটো ঘটি ভর্তি ‘বাবা’-র চরণামৃত, ফুল। মন্দির— তারকেশ্বর মন্দিরের থেকে বেরনোর পর ‘দর্শন’ করে আসা মানুষদের তিনি বলতেন, লী বলতেন একটু পরে আসছি। পাঁচ, ছয়, সাতের দশকে তারকেশ্বর খুব ‘জাগ্রত’। তখনও এভাবে বাঁকে করে জল নিয়ে যাওয়ার ব্যাপক ব্যাপারটা চালি হয়নি। লোকনাথ, পাগলা কালী ছুঁইয়ে যান কেউ কেউ মানতের শর্ত পূরণ করতে। শেওড়াফুলির নিমাইতীর্থর ঘাট থেকে জল নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। কেউ কেউ আবার কালীঘাট থেকে জল নিয়ে হাঁটেন। আসলে সত্তর দশকে— সাতের দশকে নকশালবাড়ির ধারায় আন্দোলন স্তিমিত ও ছিন্নভিন্ন হওয়ার পর পরই ‘বাবা তারকনাথ’ বলে একটি সিনেমা আসে। সেই ছবির নায়ক বিশ্বজিৎ, নায়িকা সন্ধ্যা রায়। অসম্ভব হিট করে যায় ‘ভোলে বাবা পার লাগাও/ ত্রিশূলধারী শক্তি যোগাও…’। এই সিনেমার অন্যতম হিট গান। এছাড়া ‘আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান…’ সম্ভবত এই সিনেমারই গান। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে থাকে ‘বাবা তারকনাথ’। কলকাতার ‘মেট্রো’ সিনেমা হল সহ বহু সিনেমা হলে ছবিটি মুক্তি পায়। ‘মেট্রোতেও চলতে থাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এর কাছাকাছি সময়েই ‘জয় সন্তোষী মা’ বলে একটি হিন্দি সিনেমা সুপার ডুপার হিট করে। নতুন দেবী সন্তোষী মা ঢুকে পড়েন বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত জীবনে। প্রতি শুক্রবার শুক্রবার তাঁর ব্রত। নিরামিষ আহার, ছোলা ভেজানো, টক খাওয়া নিষিদ্ধ, ব্রতীদের। এই সময়েই সত্য সাঁইবাবা। তাঁর ঝাঁকড়া চুল। হাতে করে শূন্য থেকে ‘জিনিস’ আনার ম্যাজিক। সাঁইবাবার ছবির সাঁইকীর্তন। সেই ছবির কাচ থেকে ‘মধু’, ‘বিভূতি’, ‘ছাই’ ঝরে পড়ে ভক্তদের সামনে। এর কিছুদিন পরই জাদুকর জুনিয়ার পিসি সরকার সাঁইবাবার তথাকথিত অলৌকিত্বর রহস্য ফাঁস করলেন এখনকার ভাষায় তা ‘পর্দা-ফাঁস’। তা নিয়ে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপ’-এর সর্বভারতীয় ইংরাজি সাপ্তাহিক ‘সানডে’-তে কভার স্টোরি— মলাট কাহিনি হয়। জুনিয়ার পিসি সরকার নিজেই লেখেন। তখন এমজে আকবর সাপ্তাহিক ‘সানডে’-র এডিটর। এমজে আকবর ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক। তখন জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর খুব দহরম-মহরম। পরে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টি ও ‘সিটু’-র অভিযোগে অভিযুক্ত। সাঁইবাবা— সত্য সাঁইবাবার অনেক আগে সিরডিতে সাইবাবা ছিলেন। তিনি মহাপুরুষ। সিরডিতে তাঁর সেই ধুনি— অখণ্ড জ্যোতি এখনও প্রজ্জ্বলিত। তাঁর মূর্তি আছে দেশের নানা জায়গায়, কলকাতাতেও। দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের কাছাকাছি একটা পেট্রোল পাম্পের উল্টোদিকে সিরডি কে সাঁইবাবার মন্দির ও মূর্তি আছে। ‘সাঁই রাম’, ‘সাঁই রাম’ বলে কথিত এই মহাজনের একটি বাণী— ‘সবকা মালিক এক’। তাঁর জীবনকথা নিয়ে সিরিয়ালও হয়েছে। থাক সেসব কথা আপাতত। তারকেশ্বরে ভক্তের ভিড়, বাঁকে করে গঙ্গাজল নিয়ে যাওয়ার ভিড় ক্রমে বাড়তে থাকে ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমাটির পর। তথাকথিত ‘প্রান্তিক’, ‘অন্ত্যজ’ জনেরা চললেন বাঁক কাঁধে নিয়ে। বৈশাখ ও শ্রাবণে ভয়ানক ভিড়। বিশেষ করে সোমবার। সোমবার নাকি ‘বাবার বার’, তাই। হাওড়া থেকে শেওড়াফুলি— মারামারি ভিড়। তো সেই যাই হোক রাম চ্যাটার্জি যেখানে দাঁড়াতেন, তার পেছনেই দিঘাপতি ভট্টাচার্যর ধর্মশালা। এই ধর্মশালাটি যথেষ্ট পুরনো। গরমে দিঘাপতি খালি গা, খাটো ধুতি, গলায় পৈতে। দিঘাপতি ভট্টাচার্য ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তাঁর গলার স্বরটি বাঘাটে। আর রাম চ্যাটার্জি, তিনি তো দাঁড়িয়ে, হাতে ‘বাবা’-র পুজো করা— পুজো দেওয়া চরণামৃতের ঘট আর ফুল-বিল্বপত্র— বেলপাতা নিয়ে। তারকেশ্বর এখনও ‘বাবার লাইন’, তখনও ‘বাবার লাইন’। আমি তারকেশ্বর লাইনের কথা বলছি। হাওড়া-তারকেশ্বর মেন লাইন। আমার তখন উত্তরপাড়ার রাজা পিয়ারীমোহন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। ফার্স্ট ইয়ার কমার্স। আমরা অবলীলায় তারকেশ্বর, কৈকলা, লোকনাথ, হরিপাল, সিঙ্গুর, নানুর— সবই তো ‘বাবার লাইন’ বলতাম। তো সেই রাম চ্যাটার্জি দিঘাপতি ভট্টাচার্যর ধর্মশালার দিকে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে। তারকেশ্বরে তখন ‘দণ্ডী কাটা’ হত। ‘স্বপ্নাদ্য ওষুধ’, ‘স্বপ্নাদেশ’ পাওয়া ছিল ডালভাতের ব্যাপার। যেখানে নিজস্ব মনোকামনা নিয়ে হত্যে দেওয়ার জায়গা ছিল, সেখানে বেশ বড়োসড়ো পোক্ত টিনের ওপর প্রলয় নৃত্য নাচার মাসক্যুলার শিব, তাঁর কাঁধে মৃত সতী। মহাদেবের দুচোখে অগ্নি। ডান হাতে ত্রিশূল। প্রলয় নাচন নাচার আগের অবস্থায় হয়তো। বাঙালির— হিন্দু বাঙালির শিব বলতে ‘ব্যোমভোলা— কাছাখোলা’, তাঁর ভুঁড়িটি প্রকট। ভুঁড়িতে জড়ানো বাঘছাল, সর্প বন্ধনে বাঁধা সেই বাঘছাল মাঝে মাঝে খুলে যায়। মাথায় জটা, হাতে ডম্বরু, নাকের নিচে কখনও গোঁফ থাকে, কখনও নেই। যেমন মর্জি শিল্পীর। এই শিব অন্নপূর্ণার কাছে অন্নপ্রত্যাশী, ভিক্ষা চান। প্রায় অচৈতন্য হয়ে শুয়ে থাকেন কালীর পায়ের নিচে। গাঁজা, ভাঙ সেবন করেন নিত্য। দুর্গার চালচিত্রে তিনি থাকেন। আবার আশ্বিনে অকালবোধন কালে দুর্গা— উমা বাপের বাড়ি আসতে চাইলে বৎসরান্তের সেই ঝগড়া— আকাশে মেঘ ডেকে ওঠে। শিব দুর্গাকে বকছে। বাপের বাড়ি— চার দিনের জন্য বাপের বাড়ি মর্তলোকে আসতে দিতে চায় না। মা-মাসি-কাকি-পিসিরা আমাদের বোঝান। ইদানিং মহাদেব— শিব-শঙ্কর মাসলপ্রিয়— জিম করা চেহারা যেন, সিক্সপ্যাক, এইটপ্যাক। বলশালী— পেটানো স্বাস্থ্য। মাথার জটায় ডিজাইন মুখে নিষ্ঠুরতা— সর্বদা ‘তাণ্ডব’ ভাবে। তখন তিনি ‘নটরাজ’। প্রলয়ঙ্কর, সংহারকর্তা। নতুনভাবে ডিজাইন অরা গেরুয়া বা হলদের ওপর কালচে ‘বজরংবলী’-ও তাই, ভয়দেখানিয়া চেহারা। ‘এই হনুমান কলা খাবি/ জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি/ বড়ো বউয়ের বাবা হবি’— এরকম শোনা হালকা-পুলকা ব্যাপার নয় মোটেই। এই নব্যশিব কয়েকজন বিশেষ ধর্মগুরুর তৈরি। যাঁরা শিবরাত্রি— মহাশিবরাত্রিতে নিজেদের পাবলিসিটির জন্য স্পেশাল টিভি শো করান। আর বজরংবলিও— ভয়াল কালো চেহারার ‘পবনপুত্র’, ‘অঞ্জনিপুত্র’, মারুতি বেরিয়ে আসেন, উঠে আসেন ‘হনুমান চালিশা’-র পাতা থেকে। তাঁর মডেল তৈরি হয় নাগপুরে। সেই মডেল ছড়িয়ে পড়ে অতিদ্রুত। তো সে যাক, একসময় প্রচুর বাঁদরের উৎপাত ছিল তারকেশ্বরে। হনুমানও কিছু। পাঁচ-ছয়-সাত দশকের গোড়ায় তারকেশ্বরের পাশাপাশি দক্ষিণেশ্বরের খোলামেলা পঞ্চবটীতে প্রচুর মুখপোড়া হনুমান। ইদানিং ছবি কিছু বদলেছে। দিঘাপতি ভট্টাচার্যের ধর্মশালা প্রায় তারকেশ্বর মন্দির লাগোয়া। রাস্তা ঘেঁষা, অনেকটাই উঁচু। সেই ধর্মশালায় অনেক চৌকি। বিক্রি হয় পুজোর সামগ্রী— আকন্দফুল, বেলপাতা, ধুতরো, ধূপকাঠি, চৌকির ওপর মালপত্র রাখা যায়। অন্ধকার অন্ধকার ধর্মশালার ঘর ভাড়া নিলে বড়োজোর আট আনা একটানা, ঘণ্টার হিসেবে। আমি পাঁচ, ছয় দশকের কথা বলছি। রাম চ্যাটার্জির গলায় পৈতে, হাতে মাদুলি, তাগা। তিনি শিব দর্শন সেরে আসা লোকাল লোকেদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, বাবা, মহিলা হলে মা— হিন্দুর সন্তান আপনারা। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান, ভোটে দাঁড়িয়েছি, বরাবর যেমন দাঁড়াই তেমন। আপনি, আপনার ভোটটা দিন, এই হিন্দুর সন্তান, ব্রাহ্মণ সন্তানকে। ভোট দিন, আমি জিতব। আপনাদের জন্য কাজ করব। যিনি বা যাঁরা শুনছেন, তাঁদের শুধুমাত্র ঘাড় নেড়ে, সম্মতি জানিয়ে চলে যাওয়ার উপায় নেই। রাম চ্যাটার্জি তাঁকে নিজের হাতে রাখা ফুল-বেলপাতা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতেন ভোটটা রাম চ্যাটার্জির মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের সাইকেল চিহ্নতেই আসছে। এভাবেই চলত তাঁর ইলেকশন ক্যামপেন— নির্বাচনী প্রচার। এসবই লোক মুখে শোনা। ঘটনার সত্য-মিথ্যের দায় আমার নেই। সাইকেল চিহ্ন— এই প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াতেন রাম চ্যাটার্জি, পরে তাঁর স্ত্রী শান্তি চ্যাটার্জি। শোনা যায়, রাম চ্যাটার্জির ধনুকধারী— তীরন্দাজ বাহিনী ছিল। গুলিবাজ, তলোয়ারবাজ, লাঠিবাজদের সঙ্গে। ১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গায় রাম চ্যাটার্জির বাহিনী নাকি ইসলাম ধর্মাবলম্বী নিধনে সক্রিয় ছিল। এও শোনা কথা। মিনা পেশোয়ারির গুণ্ডাদের টক্কর নিতে রাম চ্যাটার্জির বাহিনী। এরকম বাহিনী আরও ছিল। বামফ্রন্টের মন্ত্রী হয়েও মরিচঝাঁপিতে তিনি উদ্বাস্তুদের ডেকে এনেছিলেন বসতির জন্য, এই কথাও শুনেছি আমরা। শোনা কথাই। সেখানেও অ্যাকটিভ রাম চ্যাটার্জির ধনুর্ধরেরা। ১৯৬৯ সালের পয়লা মে মনুমেন্ট ময়দানে সিপিআই (এম-এল)-এর প্রথম প্রকাশ্য সভা। ব্রিগেডে— ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে যুক্তফ্রন্টের মে দিবসের সভা— কেন্দ্রীয় সমাবেশ। সেদিন প্রবল সংঘর্ষ— সিপিআই (এম) বনাম সিপিআই (এম-এল)। সে কথা আগেই লিখেছি। রাম চ্যাটার্জি ও তাঁর বাহিনী ১৯৬৯ সালের পয়লা মে— মে দিবসের দিন ব্যাপকভাবে বোমা ও মলোটভ ককটেলের ব্যবহার করে সিপিআই (এম-এল) –এর ক্যাডারদের ওপর। জিপের পর জিপ— ‘উইলিস’ কোম্পানির জিপ ভর্তি করা সশস্ত্র ‘রাম-বাহিনী’। সিপিআই (এম-এল)-এর পক্ষ থেকেও হাতবোমা, পেট্রল বোমা, ‘চুড়ির’ মাল— ‘এক চুড়ি’ থেকে ‘ন চুড়ি’ পর্যন্ত, ‘প্লাস্টার মাল’, সুতলি দড়ির পেটো— ‘ছোটো মাল’, গ্যানা— দেশি গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়, রাম-বাহিনীর ওপর। পুলিশ যথেচ্ছ, কাঁদানে গ্যাস— টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটায়। দুচোখে জ্বালা করে— জ্বলতে থাকে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায়। সেদিনই শিখি কীভাবে পকেটের রুমাল বা মাথায় বাঁধা গামছা ভিজিয়ে চোখে দিলে কাঁদানে গ্যাসের জ্বালা কমে। সে এক অভিজ্ঞতা। চারদিক থেকে ‘পেটো’ পড়ছে— গিদিম-গিদিম-গিদিম— ধু-উ-ড়ু-ম, পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাচ্ছে। কোনো কোনো না ফাটা টিয়ার গ্যাসের শেল তুলে পাল্টা চার্জ করছেন বিপ্লবী যুব-ছাত্ররা— পুলিশের দিকে।
Powered by Froala Editor