‘গড়ের মাঠ’, ‘অলিম্পিক’, ‘স্টেডিয়াম’, ‘ময়দান’, ‘গ্যালারি’-র পরবর্তী সময়েই তো ‘খেলার আসর’, ‘খেলার কথা’, ‘খেলার দুনিয়া’, খেলা’, ‘ক্রীড়া আনন্দ’। এদের মধ্যে ‘হেলার আসর’-ই সবচেয়ে বেশি প্রচারিত। নামিও। ‘খেলার কথা’ একটু যেন তুলনায় কম প্রচারিত পত্রিকা। ‘খেলার আসর’ ছিল ‘ইত্যাদি’ প্রকাশনার পত্রিকা। যারা পাক্ষিক ‘পরিবর্তন’, ‘নবম দশম’— পড়ুয়াদের জন্য পত্রিকা, ‘কিশোর দুনিয়া’— ছোটোদের পত্রিকা প্রকাশ করত। ‘কিশোর দুনিয়া’-র সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সায়েন্স ফিকশন লেখক, গোয়েন্দাকাহিনি নির্মাতা, অনুবাদক অদ্রীশ বর্ধন। অদ্রীশদার গোয়েন্দা চরিত্রটির নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র। অতি সুদর্শন বুদ্ধিদীপ্ত এই বাঙালি গোয়েন্দা ধুতি-পাঞ্জাবি, মুখে-ঠোঁটে সর্বদা ‘কাঁচি’— সিজার্স সিগারেট। তাঁর তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁকে ধোঁয়াদার বা ধোঁয়াধার সিগারেট। ‘কাঁচি’ সিগারেট— সিজার্স ব্র্যান্ড। ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে নিয়ে কেউই কোনো কথা বলেন না আজকাল। যেমন বলেন না হিমানীশ গোস্বামীর অতি বুদ্ধিমান গোয়েন্দা কিট্টু লাহিড়ী আর আফজলকে নিয়ে। আফজল কিট্টু লাহিড়ীর সহকারি— অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিট্টু লাহিড়ীর গোয়েন্দাগিরি বা ডিটেকটিভগিরির খুব ভালো কাহিনি ‘ভুবনদার কালো পেঁচা’। এই কাহিনিটি বই হিসাবেও পাওয়া যায় এখন। বহু বছর আগে ছাপা। তো সে যাই হোক, ‘কিশোর দুনিয়া’-তে লিখেছি— গল্প। অদ্রীশদা ডেকে লিখিয়েছেন। তিনি ‘ফ্যান্টাস্টিক’ নামে একটি সায়ফি— সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, সাতের দশকে। ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’-এর ময়ূখ বসুর সহায়তায় সেই পত্রিকা বেরত। মাসপত্র। ‘ফ্যান্টাস্টিক’-এ লিখেছি। ময়ূখ বসু ছিলেন কথাকার মনোজ বসুর ছোটো পুত্র। বড়ো পুত্র মনীশ বসু। তাঁরা দু’জনে ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’ ও ‘প্রকাশ ভবন’-এর একটা অংশ দেখতেন। মনোজ বসুর অতিবিখ্যাত বই ‘বন কেটে বসত’, ‘নিশিকুটুম্ব’। ‘নিশিকুটুম্ব’ চোর— তস্করদের নিয়ে লেখা। ‘ফ্যান্টাস্টিক’-এ প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, অনীশ দেব, সিদ্ধার্থ ঘোষরা তো লিখেছেনই, সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ও। ‘ফ্যান্টাস্টিক’-এর লেটারিং— লোগোটি সম্ভবত সত্যজিৎ রায়েরই করা। প্রসঙ্গত মনে পড়ল, এই সময় কলেজস্ট্রিট পাড়ায় কুমার অজিত নামে একজন ফটোগ্রাফার কাম কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন। আর্টিস্ট হিসাবে যেমন কিছু ওজনদার নন, কিন্তু তাঁর আঁকা প্রচ্ছদ চলত ওইপাড়ায়। বিশেষ করে ‘কথাকাহিনী’ প্রকাশন সংস্থায়। কুমার অজিত রোগা, ছিপছিপে, ফর্সা। মাথার চুল উল্টে আঁচড়ানো, ফলে সামনে খানিকটা ইন্দ্রলুপ্ত— টাক। ক্লিন শেভেন। সুন্দর কথা বলেন। তাঁর সহোদরা— বোনকেই পরে বিবাহ করেন ‘ক্রিমিনাল’ পত্রিকার সম্পাদক সহদেব সাহা। ‘ক্রিমিনাল’ ছিল মাসপত্র। সহদেব সাহা আগে যুক্ত ছিলেন রামচন্দ্র সাহা প্রতিষ্ঠিত দীনেশচন্দ্র সাহা সম্পাদিত ‘ক্রাইম’-এর সঙ্গে। আর ‘বর্ণালী’ প্রকাশন-এর সঙ্গেও। যাই হোক, ‘ক্রীড়া আনন্দ’ প্রকাশিত হত প্রখ্যাত ক্রীড়াভাষ্যকর অজয় বসুর সম্পাদনায়। অজয় বসু তখন ‘যুগান্তর’-এ। ‘যুগান্তর’ ক্রীড়া বিভাগের প্রধান। শ্যামদুলাল কুণ্ডু ছিলেন যুগান্তর-এর আর্টিস্ট। আর্টিস্ট কিন্তু ছবি আঁকতে পারতেন ভালো। সাদা ফাইন ধুতি, মিলের, সেইসঙ্গে চুড়িহাতা আদ্দির পাঞ্জাবি। মাথার চুল উল্টে আঁচড়ানো। মাথার, মধ্যিখানে সামান্য টাকের আভাস। শ্যামদুলালদা ‘যুগান্তর’-এর ‘শব্দছক’ নির্মাণের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন। ‘ক্রীড়া আনন্দ’-র লে-আউট ইত্যাদি দেখতেন শ্যামদুলালদা, মূলত। শিবরাম কুমার— ‘গ্যালারি’ সম্পাদক তিনি। তাঁর বিয়ের আগে ধুতি আর বাংলা শার্ট। বিবাহের পর রঙিন টেরিকটের ফুলপ্যান্ট আর রঙিন টেরিকটের ফুলহাতা শার্ট, ফুলপ্যান্টের ভেতর গুঁজে— ইন করে পরা। পায়ে স্যান্ডেল। বিয়ের পর ধুতি ছেড়ে ফুলপ্যান্ট অনেকেই পরেছেন। বাংলা শার্টের বদলে বুক কাটা ফুল শার্ট। ‘দৈনিক বসুমতী’-র অ্যাকাউন্টসের শচীনবাবু আর ‘গ্যালারি’ সম্পাদক, ক্রীড়া সাংবাদিক শিবরাম কুমারের কথা এই পোশাক বদল প্রসঙ্গে মনে পড়ল। এরকম আরও কেউ কেউ হয়তো আছেন। তাঁদের কথাও লেখা যায়। আপাতত এই ধুতি থেকে ফুলপ্যান্টে আসার প্রসঙ্গ স্থগিত থাক। কেবল কবি ও সাংবাদিক বিপ্লবী সরোজ দত্ত ধুতির নিচে পায়জামা বা ফুলপ্যান্ট পরতেন, মূলত পুলিশ, আইবি, ডিআইবি, সাদা পোশাকের পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। অন্তত যতদিন না তিনি রাষ্ট্রের খাতায় ‘নিঁখোজ’ হয়ে যান। আসলে পুলিশ তো কলকাতা ময়দানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে সরোজ দত্তকে। সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় চিরকাল ধুতি-হ্যান্ডলুম বা খাদির পাঞ্জাবি পরেছেন, পরেন। কিন্তু মহাশ্বেতা দেবী— মহাশ্বেতাদির ভাড়া ফ্ল্যাটে, সেটি ছিল সিপিআই(এম) এমপি জ্যোতির্ময় বসুর ফ্ল্যাট। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ রোডের সেই বাড়িতে— দোতলায় উঠে আসতে হত লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। ঠিক একইরকম লোহার তৈরি সরু ঘোরানো সিঁড়ি ছিল দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে প্রেমেন্দ্র মিত্রর বাড়ি। মহাশ্বেতাদি এবং প্রেমেনদার বাড়িতে প্রচুর বেড়াল। অনেক অনেক হুলো-মেনি, বিল্লি-বিল্লা। এই ঢালাই করা কারুকার্যময়, লোহার সিঁড়ি একসময় কলকাতার বহু বাড়িতেই। কখনও কখনও মেথর আসার সিঁড়ি হিসাবেও ব্যবহৃত হত এই সিঁড়ি। একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, কলকাতায় যখন খাটা পায়খানার যুগ, তখন কিন্তু তথাকথিত ‘ভদ্র-গেরস্থ— গৃহস্থ বাড়িতে ধাঙড়, মেথর— ভাঙ্গি বা সাফাইকর্মী যাই বলি না কেন, তাঁদের ব্যবহার করার সিঁড়ি একেবারেই স্বতন্ত্র— একেবারেই ছুয়া-ছুত মেনে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য স্বীকার করে তাঁদের— গান্ধীজির হরিজনদের যাত্রা— আগমন-নির্গমন। মফস্বল তো বটেই সারা কলকাতা জুড়ে একসময় খাটা পায়খানা। মাথার করে মনুষ্যমল, মনুষ-পুরীষ বহনের কুপ্রথা। সেই প্রথা— বিশ্রীকাণ্ড বন্ধ হয়েছে অনেক বছর পর। কালীঘাটে থাকতেন ‘একক’ পত্রিকা সম্পাদক শুদ্ধসত্ব বসু। শুদ্ধসত্ব বসু রোগা, ছিপছিপে, লম্বা। মিলের বা আদ্দির ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে পা ঢাকা পাম্প শ্যু। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। তিনি ‘দেশবন্ধু কলেজ ফর গার্লস’-এ পড়াতেন। পরে প্রিন্সিপ্যালও হয়েছেন। কালীঘাট নিবাসী আমার বড়ো মেসোমশাই মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য— ডাকনামে গণেশ, কবি শুদ্ধসত্ব বসুর সহপাঠী— সহধ্যায়ী ছিলেন চেতলা বয়েজ-এ। ‘চেতলা বয়েজ হাইস্কুল’-এ। শুদ্ধসত্ব বসু খুবই অমায়িক মানুষ। কিন্তু কবিতায় তেমন বিষ নেই। তাঁর মাথাভর্তি কার্লিহেয়ার— কোঁচকানো চুল— চালো করে নারকেল তেল দিয়ে টেনে আঁচড়ানো। সুন্দর কথা বলতেন সদাহাস্যময় শুদ্ধসত্ব বসু। কালীঘাটে কালী লেনের ভেতর থাকতেন কবি পলাশ মিত্র ও তাঁর সহজীবনের মানুষ সুচেতা মিত্র। দুজনেই অধ্যাপক। সুচেতাদি ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের কন্যা— সম্ভবত একমাত্র কন্যা। ফর্সা, রূপময়ী। ছাত্রী হিসাবেও পলাশদার তুলনায় অনেক ভালো। ওঁরা দুজনে মিলে ‘জীবনানন্দ’ নামে একটি সিরিয়াস লিটল ম্যাগাজিন করতেন। পলাশ মিত্রর বাবা ঐতিহাসিক সুধীর কুমার মিত্র। যিনি ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’ নামক অতিবিখ্যাত গ্রন্থপ্রণেতা। প্রথমে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’। এই গবেষণামূলক পৃথুল গ্রন্থটি ছাপার ব্যাপারে অর্থ সহযোগিতা করেছিল তখনকার পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই সময় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন— পিসি সেন। সুধীরবাবু— সুধীরকুমার মিত্র জাতীয় কংগ্রেসের কর্মী ও সংগঠক ছিলেন সেই প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকেই। তাঁর সঙ্গে, তাঁর এই পক্ষ— মানে দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র সন্তান পল্লব— রামকৃষ্ণর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ ও সখ্য ছিল, ১৯৭৫-৭৬-৭৭-এ। এমনও হয়েছে ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট— ১৫/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও এ মুখার্জি পাড়া লেনের বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে কালী লেন। সুধীরকুমার মিত্রর বাড়ি, মুখে ‘দাঁত মাজার’ বেবি ব্রাশ, ‘কোলগেট’ কোম্পানির। বেবি ব্রাশে দাঁত মাজলে দাঁত-এর মাড়ি ভালো থাকে, এমনই বিশ্বাস তখন। আমার পরনে ডোরাকাটা হালকা নীল শেডের পায়জামা আর পুরোহাতা হ্যান্ডলুমের শার্ট, কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে পরা। পায়ে ‘বাটা’-র হাওয়াই চটি, অবশ্যই নীল স্ট্র্যাপের। রামকৃষ্ণ বা পল্লবের গর্ভধারিনী ঐতিহাসিক, গবেষক সুধীরকুমার মিত্রর দ্বিতীয় পক্ষ, সে কথা তো আগেই লিখেছি। রামকৃষ্ণ বা পল্লব টুকটাক লিখত। সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অনেক খবর রাখত। সাহিত্য-সংস্কৃতি জগত তখনকার বহু দিকপালের সঙ্গেই তার যথেষ্টা জানাশোনা ছিল। সে নিশীরঞ্জন রায় হোক, রবিপ্রসাদ গুপ্ত— আরপি— সাঁটুলবাবুই হোন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র তখনকার কিং মেকারদের একজন শ্রীপান্থ— নিখিল সরকারই হোন। নিখিলচন্দ্র সরকার নামে একজন অধ্যাপক-গল্পকার ছিলেন। উপন্যাসিকও। তাঁর কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল। নিখিলচন্দ্র সরকার তুলসী সেনগুপ্ত, প্রলয় সেন, রঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রভাতদেব সরকার, শিশির লাহিড়ী, সত্যেন্দ্র আচার্য, এঁরা এক সময় ‘দেশ’— সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা, রবিবাসরীয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’-য় কত কত লেখা লিখেছেন, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি সাহিত্য মানচিত্রে নেই। নেই। কেশব দাস নামে একজন গল্পকার ছিলেন। মূলত ‘পরিচয়’-এ লিখেছেন, পরে ‘দেশ’ পত্রিকাতেও। তাঁর কথাই বা কে মনে রেখেছেন? মহাকাল বড়োই নিষ্ঠুর পাথর। কাকে যে কখন, কীভাবে থেঁতো করে দেবে, কেউ জানে না। জানা সম্ভব নয়। কবি পলাশ মিত্র ছিলেন সুধীর কুমার মিত্রর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান। পলাশদা ও সুচেতাদির একটিই সন্তান— কঙ্কাবতী— কঙ্কাবতী মিত্র। তাকে একেবারে যাকে বলে গুড়গুড়িয়া দেখেছি। বুদ্ধদেব বসুর অতি বিখ্যাত কবিতা ‘কঙ্কাবতী’-র কথা মনে পড়ল এই প্রসঙ্গে। সাতের দশকের প্রায় মাঝামাঝি রামায়ণ আগে না বৌদ্ধজাতক কাহিনি রাময়ণের পূর্বসূরি, এ নিয়ে বিরাট বিতর্ক হয়। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আচার্য সুকুমার সেন, জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী, এঁরা সকলেই এই বিতর্কে জড়ান। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’চারের পাতায় এই বিতর্ক নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আচার্য সুকুমার সেন— এঁরা সবাই রামায়ণের উৎপত্তি বৌদ্ধজাতক থেকে, এমন মন্ত্রে স্থির ছিলেন। জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী ছিলেন এর বিপরীত মেরুতে। ডঃ ত্রিপুরা শঙ্কর সেনশাস্ত্রী আদৌ এই রামায়ণ বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কিনা, এমন আর স্মরণে নেই। ডঃ ত্রিপুরা শঙ্ক্র সেনশাস্ত্রী ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী জয়শ্রী সেনের পিতা। জয়শ্রী সেন একসময়ে মঞ্চে— বাংলা পেশাদার রঙ্গালয়ে— বোর্ডে ‘চমৎকার প্লে’ দিতেন যে খুব, হয়তো এমন নয়। আবার অনেকের মুখে ভালো অভিনেত্রী। কিন্তু তাঁর নাম হয়েছিল যথেষ্ট। সম্ভবত বাংলা সিনেমাতেও তিনি ‘কাজ’— অভিনয় করেছেন, একাধিক বাংলা সিনেমা। তো সে যাই হোক, ডঃ ত্রিপুরা শঙ্কর সেনশাস্ত্রীর সঙ্গে আলাপ ছিল। পার্ক সার্কাস অঞ্চলে তাঁর বাড়ি। এই রামায়ণ বিতর্কের কোনো মীমাংসাই হয়নি। অধিকাংশ একরার— বিতর্কই থাকে অমীমাংসিত। সে কূটতর্ক হলেও। পলাশ মিত্র, সুচেতা মিত্র জীবনানন্দ নামের কৃশ কিন্তু সিরিয়াস লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। ‘জীবনানন্দ’ পত্রিকার রামায়ণ— বিতর্ক সংখ্যাটি চোখে পড়ার মতো ছিল। অনেক বছর পর কোরক পত্রিকা ‘রামায়ণ’ সংখ্যা করে। কোরক সম্পাদক তাপস ভৌমিক সাংবাদিক ধীরেন ভৌমিকের পুত্র। পলাশ মিত্র খুব আসতেন সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর ১৫বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। কালী ল্লেনের বেশ কাছেই ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। কালী লেনে আমার এক বন্ধু মহাদেব মুখার্জি থাকে। তারা হালদারদের দৌহিত্র বংশ। পলাশদা ধুতি, হালকা রঙের হ্যান্ডলুম পাঞ্জাবি। অধ্যাপনা করেন দেশবন্ধু কলেজে। খুব শৌখিন। মাথার চুল পাতলা, তাতেও কল্প। ধুতির বদলে ঢিলা ঘেরের পায়জামাও পরতেন কখনও কখনও। কদাচিৎ প্যান্ট-শার্ট। চমৎকার কথা বলতেন। বলতেনও খুব ভালো। আমি বক্তৃতা পেশের কথা বলছি। কবি পলাশ মিত্রর বন্ধু ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক, অধ্যাপক ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত। পল্লব সেনগুপ্তর বেশ কয়েকটি বই আছে লোকসংস্কৃতির গবেষণার ওপরে। তিনি রবীন্দ্র-স্নেহধন্য কবি ও সংবাদিক প্রাবন্ধিক নন্দলাল সেনগুপ্তর পুত্র। নন্দলাল সেনগুপ্তর জন্মশতবর্ষ চলে গেল বছর চৌদ্দ-পনেরো আগে, সম্ভবত। অটোগ্রাফের খাতায় নন্দলাল সেনগুপ্ত প্রায়ই চায়ের কাপ আঁকতেন। সেই সময়টাই ছিল অটোগ্রাফের যুগ। আলাদা করে পাওয়া যায় অটোগ্রাফের খাতা। আমি পাঁচ, ছয়, সাত, আট দশকের কথা বলছি। তখন ‘অটোগ্রাফ শিকারি’রা প্রায় সর্বত্র। সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর, খেলোয়াড়, ফিল্মমেকার— সকলেরই হস্তাক্ষর চাই, শুভেচ্ছাবাণী সহ। তখন তো ফিল্ম অ্যাকটর-অ্যাকট্রেসরা সকলেই প্রায়, বিশেষ করে যাঁরা ‘নক্ষত্র’ মানে যেমন বাংলা ও বাঙালির উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী— সুপ্রিয়া দেবী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ, অনীল চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, অনুপকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অসিতবরণ, ছায়াদেবী, অনুভা গুপ্ত, সুলতা চট্টোপাধ্যায়, বাসবী নন্দী, শর্মিলা ঠাকুর— তিনি অবশ্য বম্বেরও, নিজেদের পোস্টকার্ড সাইজ ছবির ওপর অটোগ্রাফ দিয়ে ভক্ত— দর্শকের চাহিদা পূরণ করতেন। বাই পোস্ট— সাদা খামে ভরে ভরে যেত সেইসব চিত্র শুভেচ্ছা। বোম্বাই বা বম্বে ছবির মায়ানগরীর দিলীপকুমার, দেবানন্দ, রাজ কাপুর, মধুবালা, মিনাকুমারী, নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা, শর্মিলা ঠাকুর— পরে, নবাব পতৌদির সঙ্গে বিবাহের পর আয়েষা সুলতানা, যদিও ফিল্মে তিনি শর্মিলাই, ওয়াহিদা রহমান, আশা পারেখ, সাধনা, সায়রা বানু, নূতন, তনুজা, মালা সিনহা— মালা সিনহা বহু বাংলা ছবিতেও ‘কাজ’— অভিনয় করেছেন, অশোককুমার, প্রাণ, কেএন সিং, রাজকুমার, সুনীল দত্ত, শাম্মি কাপুর, শশী কাপুর, আইএস জোহর, মেহমুদ, টুনটুন, অরুণা ইরানি, হেলেন, বিন্দু, শশীকলা, নিশি, দারা সিং, রণদাওয়া, ড্যানি, বিনোদ খান্না, বিনোদ মেহেরা, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, রেখা, রাখী, মুমতাজ, ফিরোজ খান, সঞ্জয়, জিনা আনম, আমজাদ খান, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, রেহানা সুলতানা, লীনা চন্দভারকর, মিঠুন চক্রবর্তী— এরকম প্রায় সকলেরই পোস্ট কার্ড সাইজের ছবিতে তাঁদের সই-সহ ফ্যানেদের সঙ্গে নক্ষত্রযাত্রায় যেতেন ইন্ডাস্ট্রিতে। বিলিকুমার বলে কথিত, দিলীপ কুমারের কপি রাজেন্দ্রকুমারও ছিলেন sএই তালিকাতে। ছিলেন জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির পক্ষে থাকা মনোজ কুমারও। জানি না নাসিরুদ্দিন শাহ, ফারুখ শেখ, ওমপুরি, অমৃশপুরিরা এই ছবি পাঠানেওয়ালা তালিকাতে ছিলেন কিনা বা কৌতুক অভিনেতা আসরানি, ফরিদা জালাল? যখন অটোগ্রাফের যুগ, তখন তো খাতা-পেনের যুগ। আর এখন, বেশ অনেক বছরই হল সেলফি বা গ্রুপির যুগ। জীবন কত দ্রুতই না বদলে যায়। আমাদের বাল্যকালে টেলিফোন, ফ্রিজ, এসব তো অতি বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। টেলিফোন, ফ্রিজ, গাড়ি— এসব থাকত নামকরা, পশারদার চিকিৎসক, উকিল-ব্যারিস্টার, ‘মালদার’ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী, এমএলএ-এমপিদের বাড়ি। সিনেমা-চলচ্চিত্র, সবমিলিয়ে কোনো এক নক্ষত্রখচিত জগৎ। স্টারডম। মায়ানগরী। মায়ানগরী বোম্বাই। কত বিচিত্র মাফিয়াজগৎ, হাজিমাস্তান, রাজনৈতিক ক্ষমতার আড়ালে দেশি বাল ঠাকরে, শিবসেনা। শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’। বালাসাহেব ঠাকরের বাড়ি— প্রসাদ যেন ‘মাতুশ্রী’। খবরের কাগজে একসময়ে কার্টুন আঁকা বাল ঠাকরে বোম্বাই ফিল্ম— ক্যাপিটাল স্টার কাস্টিংয়ের নিয়ন্ত্রক। দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা রাজন, মহেশ গাউলি ওম্বে— বম্বে— বোম্বাই— মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হর্তা-কর্তা-বিধাতা সব। হাজি মস্তান, দাউদ ইব্রাহিমদের ছায়ায় সিনেমা তৈরি হয়েছে বোম্বা-মুম্বাইয়ে, একাধিক। নানা নামে, নানা বেশে— ‘ভেষে’ হিন্দি সিনেয়ার সেইসব প্রধান চরিত্ররা ‘সরকার ১ ও ২’, ‘কোম্পানি’, ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন বম্বে’, এরকম কত কত বিগ বাজেটের ছবি। হাজি মস্তান নিরক্ষর ছিলেন। মহেশ গাউলি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। গ্রেফতার বলে দাউদ ইব্রাহিমের ভয়ানক শত্রু ছোটা রাজন। আর দাউদ ইব্রাহিম— ডি কোম্পানির প্রভাব, তাও তো প্রায় সমস্ত পৃথিবী জুড়ে।
Powered by Froala Editor