উত্তর কলকাতার বাগবাজারের ‘দুল্লভি’ ভট্টাচার্য— আমাদের চেনা কাপ্তেন দুল্লভি ভট্টাচার্য ও ‘নেতাজি দাদু’ ঘোর মোহনবাগানী। পাঁড় মোহনবাগান সাপোর্টার। মোহনবাগানের খেলা থাকলেই মাঠে যেতেন। কোনোরকম ফরিদপুরিয়া নস্টালজিয়া তাঁর অন্তত ফুটবলের ব্যাপারে ছিল না। তিনি কথা বলতেন এক দম খাস উত্তর কলকাত্তাইয়া ঘটি টোনে। ‘এয়েচে’। ‘করেচে’। ‘গেসলুম’। ‘খেলুম’। ‘করলুম’। এমন আরকি। ফরিদপুর— ছেড়ে আসা ‘দেশ’— ‘দ্যাশ’ ফরিদপুরের জন্য তাঁর জিভে কোনো হা-হুতাশ ফুটে ওঠেনি। তাঁর মেজো পুত্র মদন ভালো ফুটবল খেলতেন। ‘বাটা’-য় খেলতেন তিনি। খেলা সূত্রেই চাকরি। তখন তো খেলোয়াড়রা তাঁদের দু’পায়ের ক্যারিশমায় ‘বাটা’, ইস্টার্ন রেল, বিএনআর— বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে, স্টেটব্যাঙ্ক— ইত্যাদি প্রভৃতি চাকরি পেতেন। খেলোয়াড়দের নগদ পেমেন্ট আর কী ছিল? ছিলই না কিছু বলতে গেলে। ‘বাটা’ তখন ফুটবল টিম করত। কলকাতা লিগে ফার্স্ট ডিভিশন। জুতা কোম্পানির মাস-মাইনে যথেষ্ট ভালো। মদনকাকা, বাগবাজারের ধনী, নামকরা বর্ধিষ্ণু পরিবার ‘সেনবাড়ি’-র কন্যাকে পরিণয় সূত্রে লাভ করেন। তাঁর এই পরিণয় পরিণতি দেখে কেউ কেউ পেছনে বলেছিলেন, ‘স্যান গো বাড়ি আড্ডা দ্যায়/ স্যান গো বাড়ি আড্ডা দেয়/ স্যান গো বাড়ি জামাই হইয়া গেল…।’ মদনকাকার বড়োসড়ো চেহারা। মাথা জোড়া টাক, অল্পবয়সি। মাথার কুঞ্চিত কেশ ক্রম ক্ষয়িষ্ণু। একটা ব্যাপার নানাভাবে, নানাসময়ে খুব মন দিয়ে লক্ষ করে দেখেছি কোঁচকানো চুল— হিন্দিতে যাকে ‘ঘুঙরেলা বাল’ বলে অন্য অন্য প্রদেশ— মূলত হিন্দি বলয়, উত্তরপ্রদেশে। তা বড়ো তাড়াতাড়ি খসে যায়। সম্ভাবনা তৈরি হয় ইন্দ্রলুপ্তির— ইন্দ্রলুপ্ত হয়ে যায়— সাদা বাংলায় যার নাম টাক। টাক থেকে টেকো। অর্থাৎ, যার মাথায় টাক আছে। টাক আবার দু’রকমের সামনে, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে কপাল ক্রমশ ক্রমশ চওড়া, তারপর তো কপাল-ই— কপাল— কপাল-সর্বস্ব। এই টাককে উত্তর কলকাতার ভাষায় বলে ‘সুখটাক’। আর মাথার মাঝখানে— মধ্যস্থলে যে ইন্দ্রলুপ্তি, তা দুখটাক। টাক সাধারণভাবে বংশানুক্রমিক, এমনই বলে থাকেন অভিজ্ঞরা। আর টাকের কোনো— মানে টাক আটকানোর কোনো ওষুধ নেই, অন্তত আমার জানার মধ্যে নেই। পুরুষ মানুষের টাক বড়োই দুঃখের, শোকেরও। সে যার মাথাভর্তি চুল টাকে টাকে মরুভূমি, সে-ই জানে, হৃদয়ঙ্গম করে। অনেক টেকো লোকের যুক্তি— টাক নাকি ব্যক্তিত্ব— পার্সোনালিটি বাড়ায়। ধ্যুস। ধ্যুস। ধ্যুস। একদম মানতে পারি না এই কথা। মাথার চুল, মুখের শোভা রীতিমতো কমিয়ে দেয়, দিতে থাকে বয়স। আর পুরুষের টাক তো আছেই। কিন্তু নারীদের কারও কারও মাথায় ব্যতিক্রমী হলেও যখন টাক পড়ে, তখন তো অতি ভয়াবহ দশা। পুরুষের চোখে টেকো মহিলা অপছন্দেরই তো। কারণ কেশবাহার পুরুষ ও নারী সৌন্দর্যের চিহ্ন। ইদানিং অবশ্য হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন— শরীরের অন্য অন্য স্থান ও মাথার পেছন থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কেশ উৎপাদন করে এনে তারপর জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণা ধারায় এসো ইত্যাদি থিম সঙের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রলুপ্তে কেশ বপন। খরচ এক থেকে দু লাখ। টাক ঠিক কতটা বড়ো— বিস্তৃত, তার ওপর নির্ভর করছে এই খরচাপাতি। আমাদের কৈশোরে ১৯৭০-৭১-এ ‘ওয়েসিস’ বলে একটি চুল পড়া রোধক লোশন জাতীয় জিনিসের বিজ্ঞাপন খুব নজরে পড়ত খবরের কাগজে কাগজে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বিজ্ঞাপন- ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি দৈনিকে। এছাড়াও বিবিধভারতী— আকাশবাণী কলকাতা খ-এ নিয়মিত ‘ওয়েসিস’ বিজ্ঞাপন-আসর। ‘ওয়েসিস’-এর নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রোগ্রাম হত বিবিধভারতী, কলকাতা গ-এ। গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া-মোজা আর ‘ওয়েসিস’। তখন ‘ওয়েসিস’ খুব বাজারে চলে, বিক্রি হয়। এছাড়া ছিল টাকে চুল গজানোর নানারকম কেশতৈলের বিজ্ঞাপন। টাকে চুল গজাবার জন্য ‘হরমোন ইঞ্জেকশন’। সে সবই তো ব্যর্থ অভিযান। মাথায় নিতে হত সুঁই ফোঁড়— ইঞ্জেকশন। অনেক অনেক অনেক টাকা দাম তার। আমাদের চেনা— শেওড়াফুলির বদ্যিপাড়ার তারাদির ভাই টাকে চুল গজানোর ইঞ্জেকশন নিয়ে শেষ পর্যন্ত ডাহা ফেল। তারাদির বাবা রেলে চাকরি করতেন। ১৯৭৬ সালে ঐতিহাসিক রেল স্ট্রাইক— রেল ধর্মঘটে তিনি নিয়মিত অফিস করেছেন— স্ট্রাইক ব্রেকার ছিলেন। সম্ভবত তাঁর দুই কন্যা বা তিন কন্যা। তারাদি ও আরও একজন। একই পুত্র। সেই পুত্রকে নিয়ে আদিখ্যেতা অন্তহীন। তো সে যাই হোক ‘তারাদির মা’ আমার শাশুড়ি মা আশালতা দেবীর বান্ধবী— সিনেমাসঙ্গী ছিলেন। ম্যাটিনি শো— ‘নতুন বই’। তাদের নিবাস শেওড়াফুলিতেই। সে যাই হোক, ইঞ্জেকশন দিয়ে শিরে কেশোদ্গমের চেষ্টা ব্যর্থ। ব্যর্থই হল। ফিরে যাই আবার মদন ভট্টাচার্য— মদনকাকা প্রসঙ্গে। মদন ভট্টাচার্য উত্তর কলকাতার বাগবাজারে অতিবিখ্যাত পরিবার সেন বাড়ির কন্যাকে বিবাহ করলেন, লাভ ম্যারেজ। সেন বাড়ির সেই শ্রীমতি মদনপত্নী, যথেষ্ট পৃথুলা। সাধারণত বাঙালি, মারোয়াড়ি বড়োলোক বাড়ির মেয়েরা যেমন হয়, তেমনই। মদনকাকা প্রথমে ‘বাটা’ ফুটবল টিমে, পরে ইস্টার্ন রেল— ইস্টার্ন রেলওয়ে। টিম বদলের ফলে চাকরিও বদল হয়। মদন ভট্টাচার্যর বড়ো চেহারা, রোমশ। সারা গায়ে থোকা থোকা, কোঁকড়ানো রোম। ফর্সা বেশ। তাঁর মাথাজোড়া টাকের কথা তো আগেই বলেছি। বেশিদিন কলকাতা ফুটবলের এ ডিভিশনে থাকতে পারেননি মদনকাকা। ফিটনেস কমে যাচ্ছিল ক্রমেই। শরীরে চর্বি। পরে তিনি শুধুই অফিস লিগ খেলতেন। যেমন হয় তখন। কেবল অফিস লিগ। ফার্স্ট ডিভিশনের খেলা আর নয়। সেখান থেকে বিরক্তি। ইস্টার্ন রেলওয়েতে তখন পিকে ব্যানার্জি— প্রদীপদা। মিরকাশিম, কাজল মুখার্জি, পি বর্মণ— প্রদ্যোৎ বর্মণ, অসামান্য ভালো গোলরক্ষক— গোলকিপার। ডাইভ দিয়ে, একদম ঈগল অথবা বাজপাখি হয়ে শূন্য থেকে নেমে এসে যেন গোলরক্ষা করতেন তিনি। পরে পি বর্মণ— প্রদ্যোৎ বর্মণ মোহনবাগানে চলে যান। তাঁর সমসাময়িক বা প্রায় সমসময়ের গোলরক্ষকরা ছিলেন অবনী বসু, সনৎ শেঠ, দীপক দাস, কমল সরকার, সি মুস্তফা। অবনী বসু খেলতেন ইস্টবেঙ্গলে, সনৎ শেষ্ঠ এরিয়ান্সে, দীপক দাস বিএনআর— বিএন রেলওয়ে। কমল সরকার ইস্টবেঙ্গল, সি মুস্তফা মহামেডান স্পোর্টিং। তাঁর চেহারা অনেকটা যেন রোগা জিরাফ। এত ভালো সেভ করতেন গোল, বলার নয়। সনৎ শেঠ সোদপুরের বাসিন্দা ছিলেন। এরিয়ান্স ছাড়াও বড়ো টিমে খেলেছেন। চমৎকার গোলকি— গোলকিপার ছিলেন। বিএনআর-এ খেলতেন কি তিনি? নাকি মোহনবাগানে? ইস্টার্নরেলের মিরকাশিম ছিলেন অনেকখানি লম্বা গলার প্লেয়ার। অনেক পরে বিশ্বকাপে ফ্রান্সের খেলা দেখতে দেখতে টিগানার সঙ্গে মিরকাশিমের কোথা যেন একটা মিল খুঁজে পেয়েছি। বল নিয়ে— স-বল, বল ছাড়াও অতি দ্রুত ছুটতে পারতেন মিরকাশিম। তখন কলকাতা ফুটবল লিগ ঘিরে ‘স্টেডিয়াম’, ‘অলিম্পিক’, ‘গড়ের মাঠ’, ‘খেলার মাঠ’ নামে অনেকগুলো ট্যাবলয়েড বেরোয়। একটা ‘খেলার মাঠ’ সাধারণভাবে বেরত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান— ইস্ট-মোহনের বড়ো ম্যাচের আগে আগে। ‘গ্যালারি’ বলে এমনই একটি ট্যাবলয়েড বেরত ফুটবলের— কলকাতা ফুটবল লিগ, আইএফএ শিল্ড ইত্যাদির খবর নিয়ে। শিবরাম কুমার নামে একজন ক্রীড়া সাংবাদিক এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। শিবরাম কুমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাস লিখেছিলেন। পরে মোহনবাগানেরও ইতিহাস নিয়ে আলাদা বই বার করেন। সবই চটি চটি— পাতলা পেপারব্যাক। শিবরাম কুমার ধুতি আর ছিটের রঙিন বাংলা শার্ট, ফুল হাতা। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ— মাঝখানে সিঁথি। গোলমাথা, একটু মজাদার— আধুনিকের উচ্চারণে ‘ফানি’। প্রায় দাড়ি-গোঁফ শূন্য বাদামি মুখ। দু-এক পিস খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, না-কামালে। খানিকটা যেন ‘মাকুন্দ চোপা’-র কাছাকাছি। তো যাই হোক, শিবরাম কুমারের ‘গ্যালারি’ বেরয় ‘অলিম্পিক’, ‘গড়ের মাঠ’, ‘স্টেডিয়াম’, ‘খেলার মাঠ’ ইত্যাদির একটু পরে। এইসব সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড-এ খোলোয়াড়দের একই ছবি ঘুরে ফিরে। জিঙ্ক অথবা তামার ব্লকে অনেকটা রঙ দিয়ে একটু ধ্যাবড়া ছবি। সাদা কালো বেশরভাগ সময়। তখন কলকাতার এ ডিভিশন ফুটবল রিটার্ন লিগ— ফিরতি লিগ। ফুটবল টিম বলতে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং, বিএনআর, ইস্টার্ন রেল, পোর্ট কমিশনার্স, বাটা, রাজস্থান, এরিয়ান্স, বালি প্রতিভা, কালীঘাট, জর্জ টেলিগ্রাম, হাওড়া ইউনিয়ন। ফেন বলে রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড় ছিলেন। জার্নেল সিং ছিলেন বিখ্যাত স্টপার, মোহনবাগানে খেলেছেন, তার আগে খেলতেন রাজস্থানে। তাঁর মাথার ঝুঁটিতে লেগে বল গোলে ঢুকে গেছে, তখন তিনি রাজস্থানে। এই জার্নেল সিং বা জার্নাল সিং ছিলেন মোহনবাগান রক্ষণের প্রধান স্তম্ভ। তিনি ভারতীয় দলে তো খেলেছেনই, খেলেছেন এশিয়ান অলস্টার টিমেও। তিনি ও অসামান্য গোলরক্ষক পিটার অঙ্গরাজ— পি অঙ্গরাজ। অঙ্গরাজ একসময় সার্ভিসেস-এ খেলতেন। তখন হায়দরাবাদ পুলিশ, সার্ভিসেস দারুণ দল করে। হায়দরাবাদ পুলিশ-এ— অন্ধ্র জাতীয় দলে খেলা ইউসুফ খান ছিলেন খুব বড়ো স্ট্রাইকার। তাঁকে বহুবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে আনার চেষ্টা করেছেন খেলোয়াড় চেনা ‘জহুরি’— জেসি গুহ। জ্যোতিষচন্দ্র গুহ। জেসি গুহ ব্যর্থ হয়েছেন। তখন মোহনবাগানে ধীরেন দে। তিনিও ফুটবলার আর তাঁর পা চিনতেন। গোলরক্ষকের ভূমিকায় দীর্ঘদেহি পি অঙ্গরাজ তাঁর হাত দিয়ে অনায়াসে মাথার ওপরের বার পোস্ট ছুঁয়ে ফেলতেন। সদা হাস্যময় মুখ। একসময় ফরোয়ার্ড খেলতেন বলে পেনাল্টি কিক মারতে অসম্ভব দড়। খুব ভালো পেনাল্টি শ্যুটার ছিলেন তিনি। ওপরের দিকের বলে তাঁকে পরাস্ত করা মুশকিল। নিচের দিকে— গ্রাউন্ড ছেঁড়া শট-এ তাঁকে পরাস্ত করা— পরাজিত করা তুলনায় সহজ ছিল। তবুও ফার্স্ট বার, সেকেন্ডবারে রাখা— তিন কাঠির মধ্যে রেখা বুলেট শটে তিনি বহুক্ষেত্রেই অপরাজিত— অপরাজেয়। পিটার অঙ্গরাজের সময় ইস্টবেঙ্গল রক্ষণে পি দেবনাথ-বিক্রমজিৎ, নাকি বিক্রম দেবনাথ, যিনি ইডেনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান চ্যারিটি ম্যাচে হাফ গ্রাউন্ড থেকে গোল দিয়েছিলেন। এইরকম গোল বহু বছর পর কুয়ালামপুরে ‘মারডেকা কাপ’-এ করেছিলেন সত্যজিৎ মিত্র। যিনি ডাকনামে বাবুল। কালীঘাটের সন্তান বলে সত্যজিৎকে ডাকনামেই ডাকতাম। ওঁরা পাঁচ ভাই— তপন, তরুণ, তুতু, জিতু, বাবুল। তাঁদের এক দিদি ছিলেন, তিনি অকালপ্রয়াত। বাবুলদের গর্ভধারিণীও খুব ছোটোবেলায় প্রয়াত হন। কালীঘাটে ছেষট্টি পল্লির কাছে ভাড়া বাড়িতে একতলায় তাঁরা থাকতেন। পাশেই ফ্রি প্রাইমারি স্কুল— কর্পোরেশনের। খানিক দূরেই কেওড়াতলা মহাশ্মশান, কালীঘাট ব্যায়াম সমিতি, কালীঘাটের কালী মন্দির, পাথরপট্টি, ছাগল হাটা, জনমঙ্গল সমিতি, আদি গঙ্গা, ভুজঙ্গবাবুর পাঠশালা, অতি বিখ্যাত। সেখানেও নানানজনের প্যাঁড়ার দোকান। বাবুলদের ভাড়াবাড়ির কাছাকাছি একটি অতি বিখ্যাত মুদিখানা। মুখার্জিদের মুদিখানা। কালীঘাট বাজারের লাগোয়া জহর-এর মুদিখানা ও নাইনের মুদিখানা বিখ্যাত। জহরের দোকানের মশালা খুব ভালো। মুখার্জিদের মুদিখানার পাশেই কালীঘাট জনমঙ্গল সমিতি, তাদের নিজস্ব মাঠ। ব্যান্ড পার্টি। সেই ব্যান্ড পার্টি ভাড়াও খাটত। যদিও মুখে বলা হত অ্যামেচার। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ভেতর ১৬/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও মুখার্জি পাড়া থেকে আমার বড়োমাসিমার বাড়ি। এই বাড়ি এক আশ্চর্য বাড়ি। শতায়ু অতিক্রান্ত এই বাড়ি সম্প্রতি ভাঙা পড়েছে। নতুন কনস্ট্রাকশন, নতুন বিল্ডিং, নতুন স্ট্রাকচার, খাম্বা। বড়ো মাসিমা— ঊষারানি ভট্টাচার্যের প্রয়াণের বছর চারেকের মধ্যেই এই তিনতলা বাড়ি গ্রাস করল প্রোমোটার। এই বাড়ি কিনেছিলেন বড়ো মাসিমার শ্বশুরমশাই অক্ষয়কুমার ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন আলিপুর কোর্টের দেওয়ানি উকিল। তাঁর পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা। পুত্রেরা— রবীন্দ্রনাথ ভট্টচার্য, মহেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য, যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, চুনিলাল ভট্টাচার্য। তিন কন্যা— মুকি, বুলি এবং মানু। আমার বড়ো মেসোমশাই মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডাকনামে গণেশ। তিনি এজি বেঙ্গল-এর সিনিয়ার ক্লার্ক ছিলেন। বড়ো মাসিমার ছয় পুত্র, এক কন্যা। জ্যোতির্ময়, হিরন্ময়, কিরন্ময়, পার্থসারথি, বিশ্বজিৎ। কন্যা আমিরা। বিবাহের পর আবিরা চক্রবর্তী। এই বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যই ভারতবিখ্যাত ফুটবলার ও কোচ। বিশ্বজিতের ডাকনাম— বিশ্ব, আদর করে তাকে বড়োমাসিমা ডাকতেন বাবুলি নামে। আমিও তাকে বাবুলিই বলি। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য— বিশ্ব— কলকাতা ফুটবল ময়দানের ‘বিশু’ আমার সহোদর অধিক। কালীঘাট জনমঙ্গল সমিতির পাশেই মুখার্জিদের অতিপ্রাচীন, অতিবিখ্যাত মুদিদোকান। গলির ভেতর ছিল ভুজঙ্গ ভট্টাচার্যের পাঠশালা। নেই। বহুবছরই নেই। সেই বাড়ি ছিল লিজের বাড়ি। নিরানব্বই বছরের লিজ। মাটি, টিন, টালি, পাকা ছাদ— সব মিলিয়ে। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে— ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ‘মাতৃকাশ্রম প্রণব সংঘ’-র একদম উল্টোদিকে। তারপর মুদিখানার বেশ বড়ো দোকান। sএই পাড়ায় তিনজন তারা— প্রথমজন সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী— যিনি থাকেন ১৫বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে, মাতৃকাশ্রম-প্রণবসংঘে। তারাকাকু— তারাপদ দালাল। হ্যাঁ, দালাল পদবি। বড়ো বাড়ি, তিনতলা। দুই স্ত্রী। এক স্ত্রীর প্রয়াণের পর অন্য স্ত্রীর পানিগ্রহণ। তারাকাকুর দুই পক্ষের ছেলেমেয়ে— প্রথম পক্ষের মায়া পিপি, ভুটি পিপি, দুই কন্যা। দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র— তপন ও গোপাল। এক কন্যা— অঞ্জু সম্ভবত তার নাম। তারাকাকুর ছাদে বড়োসড়ো পাখির খাঁচা। বদ্রি পাখি। তাঁর বড়োসড়ো প্যাঁড়ার দোকান কালীঘাটের কালী মন্দির চত্বরে। রামনবমীর দিন দোল হয় কালীঘাটে। বলির খাঁড়া— রামদা ধোয়া জল দেওয়া হয় তখন সর্বরোগহর ওষুধ হিসাবে। সেইসঙ্গে ছাগ ও মহিষ বলির যুপকাষ্ঠের মাটি। তখন— পাঁচের দশকে কালীঘাটে মূর্তি এনে পুজোর রেওয়াজ ছিল হয়নি। নিষেধ ছিল। কালীঘাটের কালী মন্দিরের পালাদার হালদাররা ও তাঁদের দৌহিত্র বংশ মুখার্জি— মুখোপাধ্যায়রা কালী মূর্তির বস্ত্র— বেনারসি শাড়ির টুকরো, ছাগ-মহিষ বলির খড়গ— রামদা ধোয়া জল, বলির যূপকাষ্ঠের— হাঁড়িকাঠের মাটি সবই দিতেন তাঁদের প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবদের। ‘পালা’ পড়ে হালদারদের ও তাদের দৌহিত্রদের— মুখার্জি— মুখোপাধ্যায়দের। হালদারদের মধ্যে খুবই নামকরা ছিলেন গুরুপদ হালদার, অমিয় হালদার প্রমুখ। তো সেই তারাকাকু রোজ আচার খেতেন ভাতের সঙ্গে। গলা ধরনের আচার। তাঁর দুই পুত্র ভোম্বল ও কেষ্টা, কন্য অনু। এই নিয়ে তখনকার ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। মূলত হালদারদের কব্জায় থাকা কালীঘাটের মন্দির, দেবী প্রতিমা ইত্যাদি থেকে আয় প্রচুর। কেউ কেউ বলতেন এই কালী হলেন হালদারদের কালো গাই। গাই দুইলে দুধ, কালী দুইলে পয়সা। পালাদারদের খালি চাহিদা— দাও দাও দাও। টাকা, সোনা— সোনার রোগা ও মোটা অলঙ্কার। দামি দামি শাড়ি— সিল্কের, সুতির। আবার অর্ডিনারি শাড়িও আছে। লালপাড় সাদা শাড়ি। কোরা শাড়ি, লাল পাড়— সেও থাকে। শাঁখা, নোয়া ও পালিশ করা লোহা, আলতা, সিঁদুর, সিঁদুর পাতা— সব দিয়েই পুজো, মানতের পুজো হয়। থাকে ‘সাবিত্রী’ সিঁদুর। এইসব ‘প্রসাদী’ শাড়ি বিক্রিও হত, এখন হয়। বাজার দরের তুলনায় বেশ সস্তায়। কালীঘাটের পালা বিক্রিতে সাত-আট দশকে হাজার হাজার টাকা। এখন— এইসময়ে হয়তো তা লক্ষ ছুঁয়েছে। এই পালা কেনাবেচার জগৎ এক আশ্চর্য অন্যরকম জগৎ। সেই জগৎ— দুনিয়া প্রায় অনাবিষ্কৃত থেকে গেল বাংলা গল্প-উপন্যাস-আখ্যানে।
Powered by Froala Editor