ন্যাড়া পোড়ার আগুন-ফুলকি বসন্তের চাঁদমাখা আকাশে কোমল জোনাকি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জ্যোৎস্না ভাসা দোলের আধাররাতে সে এক আশ্চর্য ছবি। ন্যাড়া পোড়া হত ফাঁকা, বড়ো মাঠে। আশেপাশে বাড়ি না থাকলেই ভালো, তেমন জায়গাতেই ন্যাড়া জ্বালানো। বড়োসড়ো— দীর্ঘকায় ন্যাড়ার পায়ের কাছে বস্তা বস্তা শুকনো বাঁশপাতা— সবই হারা ঘোষ— কেষ্টা ঘোষদের খটখটি বাগান থেকে আনানো। চটের বস্তা বস্তা সেই শুকনো বাঁশপাতা জ্বালানি হিসাবে খুবই ভালো, ন্যাড়া পোড়া ছাড়াও গ্রামদেশে শুকনো বাঁশপাতা ভালো ‘ইন্ধন’— জ্বালানি। সেই বাঁশপাতা দিয়ে ন্যাড়ার পা পর্যন্ত একটা নয়, অনেকগুলো বর্ডার কাটা। তাতেই প্রথম অগ্নিসংযগ জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি সহযোগে। তারপর তো আগুনের বৃদ্ধি হতে থাকবে। তখন কাঁসর, ঘণ্টা, ঘড়ি-ঘণ্টা সহযোগে সমবেত কণ্ঠে সুরে ও বেসুরে— ‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া/ কাল আমাদের দোল/ পুন্নিমাতে (পূর্ণিমাতে) চাঁদ উঠেছে/ বল হরিবোল…’। এই যে অতিপ্রচলিত ন্যাড়া পোড়ার ছিকুলি তার একটি প্যারোডি ছিল হাওড়া জেলার বালিতে— ‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া/ কাল আমাদের দোল/ টিকটিকিতে পেদে দিয়েছে/ বল হরিবোল…’। ন্যাড়ার আগুনে চিনির তৈরি সাদা ও রঙিন মঠ, ফুটকড়াই ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়ার রীতি-রেওয়াজ ছিল আগেই বলেছি, চিনির তৈরি রঙিন মঠ— লাল, হলুদ, গোলাপি, সবুজের সঙ্গে সাদা মঠও থাকত। মঠের ডিজাইনে মন্দির, রথ, ময়ূর, পাখি, হরিণ। সেইসঙ্গে মেম-পুতুল। মঠ, ফুটকড়াইয়ের সঙ্গে গুড়ের তৈরি লাল বাতাসা, চিনির তৈরি সাদা বাতাসা— তাও দেওয়া হত ছুঁড়ে ছুঁড়ে ন্যাড়ার জ্বলন্ত পেটের ভেতর। দোলে পশ্চিমবঙ্গে বড়ো, গোটা আলু কেটে তারপর তার ওপর পেরেক দিয়ে ৪২০ বা গাধা খদাই করে বাঁদুরে রঙে চুবিয়ে সেই আলু দিয়ে ছাপ দেওয়া হত জামা বা গেঞ্জির পিঠে। মোম গলিয়ে তার ভেতর রঙ পুরে পিঠে মারার রেওয়াজ ছিল। তারপর তো এল জলভরা আর রঙভরা বেলুন, সেটা সাতের দশকের শেষ। পচা টম্যাটো, পচা ডিম— এসবও তো ছিল দোল খেলার সামগ্রী। বিশেষ করে উত্তর কলকাতায়। মনে আছে আমার, ছোটোমাসি নমিতা ভট্টাচার্যর বড়ো ও মেজোপুত্র প্রণব— অপু, দেবব্রত— বুলোর উপনয়ন হয়েছিল দোলের খানিকটা আগে, রঙায়িত সময়ে। অপু-বুলোর একমাত্র ব্যাচেলার কাকা দুই ভাইয়ের পৈতেতে— তেরোদিনের নিয়মভঙ্গে অতিথি আপ্যায়নের জন্য বড়োবাজারের কাছাকাছি কোনো দোকান থেকে লাড্ডু নয়, মাথায় কিশমিশ বসানো ‘দরবেশ’ আনতে গেছেন, তিনি খালি পা, খালি গা। তাঁর ডাকনাম ‘ধলু’, আমার ছোটো মেসোমশাই প্রণব— ইন্দ্রাণী-দেবব্রত-সুব্রতদের বাবা লোকরঞ্জন ভট্টাচার্য ডাকনামে ‘কালু’, অথচ তিনি সাধারণ বাঙালির তুলনায় ফরসা। অখণ্ডবঙ্গের পাবনায় জন্মানো লোকরঞ্জন, তাঁর কবিরাজ পিতৃদেব মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য— সকলেই প্রায় নিত্য বিভোর পাবনা— পাবনা জেলার স্মৃতিতে। সিরাজগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের রুই। পাবনায় পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ, রাঢ়ী শ্রেণীরা— রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ তুলনায় সংখ্যালঘু বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের তুলনায়। লাহিড়ী, সান্যাল, মৈত্র, বাগচি, ভাদুড়ি— তাঁদের প্রতাপ। তাঁরাই সম্পন্ন, তাঁরাই ‘লেখাপড়া’— ইংরাজি শিক্ষাতেও অগ্রণী। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্যও হতেন। পাশ্চাত্য বৈদিক সবই প্রায় ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, কিছু রায়। রায়, চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য কোনোটাই পদবি নয়, উপাধি। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণের পদবিতে বশিষ্ট, শাণ্ডিল্য, ভরদ্বাজ ইত্যাদি গোত্রনামও জুড়ে যায়। রাঢ়ী শ্রেণী ব্রাহ্মণদের পদবি ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়। উপাধ্যায় পদবির বৈদিক ব্রাহ্মণ হয়। বন্দ্যোপাধ্যায়রা শাণ্ডিল্য গোত্র। আর শাণ্ডিল্য গোত্র হলেই সামবেদ। সামবেদী দেব পৈতে বড়ো হয়। ঋকবেদীদের পৈতে ছোটো, নাভির ওপরে। সামবেদীদের নাভির নিচে। যজুঃ ও অথর্ববেদীদের যজ্ঞসূত্র সামবেদীদের থেকেও বড়ো, লম্বায়। ন দণ্ডি— নটি সুতো, সকলেরই। নটি সুতো আসলে নবগুণের প্রতীক। থাক সেসব কথা আপাতত। আমি বরং সেই দরবেশ-বোঁদের নাড়ু আনতে যাওয়ার স্মৃতি বলি। সেই যে দোলের আশপাশ, তখন তো রাস্তায় রং, আবির, হুল্লোড়, মাতাল, হাফ মাতাল, হাফ ভাঙগুলিদার, ফুল ভাঙ গোলাখোর, তার মধ্যে দিয়েই তো আমাদের ‘দরবেশ যাত্রা’। চারপাশেই আবহাওয়া, মানে ‘দোল দোল’— ‘দোলে দোদুল দোলে দুলনা… দুলনা…’। ‘দেয়া-নেয়া’ সিনেমার সেই বিখ্যাত— অতিবিখ্যাত হিট গান। উত্তমকুমার ও অরুণকুমার দুজনের লিপে, শ্যামল মিত্র আর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— ‘মাধব কহিছে ওগো রাধা… তুমি আমি একই সুরে বাঁধা— সে বাঁধন কভু খুল না…।’ কি আশ্চর্য ডুয়েট। তখন তো চারপাশেই দুয়ারে দুয়ারে রং। বাড়ির সিঁড়ি, রোয়াক— সব রঙে— রঙিনতর— টইটম্বুর একেবারে যাকে বলে। রং, রঙান্তি। মনে আছে টিনের পিচকারি বা পিচকিরি সরিয়ে যখন প্লাস্টিকের বোতল পিচকিরি বা পিচকারি এল, তখন তার শেপ— চেহারায় থোকা আঙুরগুচ্ছ, ‘কোকাকোলা’-র বোতল, ‘জুসলা’-র বোতল। বালতি থেকে গোলা রং টেনে তোলার যে পদ্ধতি, তার প্লাস্টিক এডিশন তখনও আসেনি। পরে তো চলি এল বাজারে। আর সবই তখন ‘চিনা মাল’, যা অতীব বিষাক্ত বলে কথিত। প্রমাণিতও। পিচকিরি যে মেটিরিয়ালে তৈরি, তাই বিষ। বিষ। বিষ। তো সে যাই হোক, পুরনো সেই প্লাস্টিকের পিচকিরি, সাদা হলুদ, লাল, বেগুনি রঙের। সবুজও। আর তার আয়ুষ্কাল বেশ দীর্ঘ। অন্তত তিন বছর— তিনটে দোল তো বটেই— অনায়াসে, হাসতে হাসতে। সেইসব প্লাস্টিক পিচকিরি ছ আনা— সাঁইত্রিস নয়া পয়সা থেকে পাঁচ সিকে— একটাকা চার আনা, দুটাকা বড়ো জোর। বেশ শক্তপোক্ত প্লাস্টিক। শিব ঠাকুরের জটাযুক্ত মুখ, কোকিল— সবই তো এই প্লাস্টিক পিচকিরির ডিজাইনে থাকে। সেটা ছয়ের দশকের শেষ। আবির বলতে লাল, নয়তো ম্যাজেন্টা। সবুজ আবির তখনও আসেনি বাজারে। হলদে বা গেরুয়া আবির তো অনুপস্থিত একেবারেই। কিন্তু গো-বলয়ে বা হিন্দি বলয়ে সেখানে ‘রুড়ি’ দেখেছি নানা রঙের। বর্ণিল— মালটিপল কালার, কুম্ভভূমিতে— ইলাহাবাদে, সেখানে রঙের খেলা। লাল-সবুজ-বেগুনি-হলদে-ম্যাজেন্টা— রং আর রং। ছয়ের দশকে রাধাকৃষ্ণ চেহারার প্লাস্টিক পিচকিরি দেখেছি। আপেল, রকেট, এরোপ্লেন। মন রঙিন। সেইসঙ্গে ট্যাঙ্ক, বন্দুক, রিভলভার, পিস্তল— এ সবই দোল বা হোলি খেলার প্লাস্টিক-পিচকিরি বা পিচকারি। আর এটা তো অনেকেই আমরা জানি বা জানি না, হিন্দিতে পিচকিরি বা পিচকারিকে পিচকারিই তো বলা হয়। আর পিচকারি নিয়ে কত কত গান দোল-হোলি জড়ানো সঙ্গীতমালায়। কত, কত রং তাতে, ফাগুয়া-আবিরের উচ্চারণ। ছয়ের দশকে ভুট্টা চেহারা, আতা চেহারার, গ্রেনেড— আতা গ্রেনেড চেহারার, জিপগাড়ি চেহারার পিচকারি, ফুটপাথে দোলের আগে আগে। সঙ্গে একটু মোটা কাগজে তৈরি নেহরু-গান্ধি ক্যাপ স্টাইলের টুপি। বেনারস— কাশীতে হোলির ‘হুড়দঙ্গ’— শোর মাচানো, লাগাঙ্গাগিরি তিন দিনের। টানা তিনদিন। বৃন্দাবন, মথুরাতেও তাই। পাটনা বা পটনাতে, মুঙ্গেরে, হোলি আর হোলি। আগেও লিখেছি বৃন্দাবনে দেখেছি রাধাষ্টমীর দোল। আর আছে শূন্যে রঙিন-রঙদার আবির ছুঁড়ে দেওয়া। তখন ফাগুয়ার রঙে, পিচকারি, কুমকুম, গুলাল ছাড়াই মথুরা-বৃন্দাবনের আকাশ রঙমোহন। রঙমোহন। সূর্যাস্তবেলার কাছাকাছি সময়ে রাধাষ্টমীর আবির সাজ, আকাশের মুখে— আননশোভায়— মুখমণ্ডলে। আকাশ তখন পিচকারি, রঙের ভাণ্ডকে যেন উপুড় করে দিয়েছে। রং আর আবির। ফাগুয়া— ফাগ উড়ছে বাতাসে। হিন্দির— হিন্দি বলয়ের ফাগুয়া বাংলায় আবির— ফাগ। মনে পড়ে ‘রক্তকরবী’-র ফাগুলালের কথা। ‘ফাগ’ থেকেই কী ফাগুলাল হল? মনে আছে, একসময় হিন্দু বাঙালি নারী নিজেদের মধ্যে সই, টগর, বকুলফুল, সাগর, ফাগ, মিতেনি পাতাতেন। সেই সঙ্গে কাচের গেলাস। দোলের দিন দুই নারী পরস্পর পরস্পরের গালে ফাগ-চিহ্ন— সোহাগ চিহ্ন এঁকে ফাগ পাতাতেন। সেই দুই নারী মানসে তখন তো ভালোবাসার উদ্বেল-চিহ্ন। তা কি সমপ্রেম? তা কি সমকাম? তা কি লেসবিয়ানিজম-এর বঙ্গীয় সংস্করণ? জানি না। আমার মায়ের পাতানো ফাগ ছিল। সেই ফাগ-এর নাম গীতা। আমরা গীতা মাসি বলতাম। গায়ের রং সামান্য চাপা। সামান্য খর্বকায়ও। কিন্তু ছয়ের দশকেই তিনি সাজনতারা। পাশ্চাত্য বৈদিক ঘরের কন্যে ছয়ের দশকেও বিএ পাস। কলেজ। ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে। মাথায় চুড়ো করা খোঁপায় সোফিয়া লোরেন বা সুপ্রিয়া চৌধুরী অথবা পরবর্তীর সুপ্রিয়া দেবী। নাইলন শাড়ি, লাল রঙের। মেগি হাতা বা ম্যাগি হাতা নয়, হাত কাটা— বগল দেখানো ব্লাউজ। লোকাট, ফলে স্তনসন্ধি— ক্লিভেজ— স্তনাভাস দেখা যায়। নাইলন শাড়ির অবাধ্য অঞ্চল— আঁচল খসে গেলে। গীতা মাসি হাইহিল। পেনসিল হিল। স্টিলেটো হিল। তার নাইলন শাড়ির আঁচল সরে গেলে বালকের দু’চোখে স্তনবৈভবের বিপুল মায়াযাত্রা। সেই গীতা মাসি গলায় দড়ি দিল। কেন? অত সুন্দর মুখশ্রী, মাথার চুলের ডিজাইনে কখনও কখনও ছয় দশকের সাধনা-কাটিং। সেই গীতা মাসী আত্মঘাতী হল— সুইসাইড করল, কেন? ‘বধূ শুয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল/ তবু দ্বার ভেঙে গেল ঘুম…’ গীতা মাসি আমার একমাত্র পিসেমশাই গীষ্পতি ভট্টাচার্যর বড়ো মামার কন্যা। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ আর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা সকলই প্রায় সকলের আত্মীয়। ফলে গীতা মাসির বাবা ‘দুল্লভি’, তিনি এই নামেই পরিচিত ছিলেন মহলে, কুঞ্চিত কেশ উঠে গিয়ে টাক, বড়ো বড়ো চোখ, গাত্রবর্ণ শ্যাম। তাঁরা তিন ভাই। দুল্লভি, উদাই, ফুদাই। উদাই হদ্দ বেকার, রেসের মাঠ, ঘুড়ি, বেশ্যাবাড়ি। বাগবাজার থেকে চেতলায় হেঁটে হেঁটে রোজ আসতেন তিনি ভাই গীষ্পতির সংসারে দুপুরে অন্নাহার করার জন্য। হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন তিনি, কোনো পয়সা দেনেওয়ালা রোগী ছাড়াই। হোমিওপ্যাথ— বই দেখে দেখে, মহেশ ভট্টাচার্যর ওষুধ কোম্পানির ছাপা বই। তা দেখে দেখে প্র্যাকটিস। আর হ্যানিম্যান সাহেবের বই। ব্রায়োনিয়া, পালসিটিলা, খুজা— মাদার টিঞ্চার, থার্টি, ফর্টি, টেন, হানড্রেড, টু হানড্রেড— পাওয়ার। ‘দুল্লভি’-র পুত্ররা— অনু, মদন, সমীর মিহির। দুই কন্যা মঞ্জু, গীতা। গীতা বড়ো, মঞ্জু ছোটো। মঞ্জু খুব রোগা বলে তাকে পেছনে ‘সেপাই’ বলত অনেকে। অনুকে অনুকাকা বলতাম, মদনকাকা, মিহিরকাকা, সমীরকাকা। অনুকাকার মোটর গ্যারাজ ছিল। নকশালবাড়ির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন অনুকাকা। সমীরকাকা, মিহির কাকারা সিপিআই (এম)। বাগবাজারেই থাকতেন তাঁরা। ‘দুল্লভি’ ভট্টাচার্য মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন নেতাজি বেঁচে আছেন। তিনি ফিরে আসবেন পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু ও তাঁর পরিবারকে বিতাড়িত ক্রে ‘প্রকৃত স্বরাজ’, ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ অবশ্যই আনবেন। তিনি চেহারায়, অনেকটা যেন শেষ বয়সের কাজী নজরুল ইসলাম। সাদা আদ্দির অথবা সফেদ কেমব্রিজের ফুলহাতা বাংলা শার্ট, হাতা গুটিয়ে পরা। সেইসঙ্গে কালো— কালাপাড় ধুতি, মিলের, ‘সেনগুপ্ত’-রই হবে। নরুন পাড় ধুতিও কখনও কখনও, মিলের। ছয়ের দশকে সেনগুপ্তর ধুতি— ফাইন পাঁচটাকা জোড়া, সুপার ফাইন ছ’টাকা। ভালো আদ্দির দর তিন টাকা মিটার— কেলিকো কোম্পানির ‘শাহজাদা’ ব্র্যান্ডের। অন্য ব্র্যান্ড আরেকটু কম। ‘দুল্লভি’ ভট্টাচার্যকে তাঁর ‘নেতাজি’ প্রেমের জন্য আমরা অনায়াসে ডাকতাম ‘নেতাজি দাদু’ বলে। তাতে অবশ্য তিনি ক্ষুণ্ণ হতেন না। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা আমার একমাত্র আপন পিসিমার বাড়ি— চেতলায়, কাজে-কম্মে, বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশনে। তাঁর পায়ে মসমসানো চিনে বাড়ির জুতো। চকচকে, অতিচকচকে— পালিশদার। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে রাস্তার কল, ফুটপাথের ওপর। সেখানে লোহার বালতি কলের মুখে ধরে, গায়ে মাথায় ‘মলয়চন্দন’ সাবান বা মহীশূর— মাইশোর স্যানডাল সোপ মেখে তিনি স্নান সারতেন। পরনে উত্তর কলকাতার টিপিক্যাল রঙিন গামছা। রেসের মাঠে আগ্রহ ছিল তাঁর, মদ্যপানেও। তাঁর একেবারে ছোটো ভাই— ডাকনামে ফুদাই, তাঁরও মোটর গ্যারাজ, অনুকাকার যেমন। ‘নেতাজি দাদু’-র চার বোন। জহরলাল বলে সম্বোধন করতেন জবাহরলাল নেহরুকে। বলতেন, নেড়ু। ইংরেজির ‘চ্যাটারবক্স’— বাচাল— অতিরিক্ত কথা বলা জনকে চ্যাটারবক্স বলতেন তিনি। ভোট দিতেন ফরোয়ার্ড ব্লককে। ‘টগর’ পাতানো হত টগরফুল দিয়ে। ‘বকুল’ পাতানো হত বকুল ফুল দিয়ে। সাগরদ্বীপে, গঙ্গাসাগরে গিয়ে পাতানো হত ‘সাগর’। সই, মিতেনি— বাড়ি বসে বসেই। ছেলেরাও তখন— চার, পাঁচের দশকে নিজেদের মধ্যে ‘সখা’, ‘মিতে’ ইত্যাদি সম্বোধন অভ্যাসে আনতেন। আমরা সেই কোথায় ফেলে এসেছি ‘দরবেশ যাত্রা’-কে। সেই দরবেশ যাত্রায় অপু-বুলো-বুলি-রিন্টুদের কাকার খালি পা। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে তাঁর টেলারিং শপ। সেই দর্জি-দোকান চলে কি চলে না। তবে আড্ডাবাজি খুব হয়। তো সেই ধলুকাকা, আমার ছোটো মেসোমশাই ছিলেন ডাকনামে ‘কালু’, ভালো নাম লোকরঞ্জন ভট্টাচার্য, আমরা তো চলেছি অপু-বুলোর কাকার পেছু পেছু। কাকা বলছে, আমাকে সবাই চেনে। এইসব রাস্তায়, রঙের ভয় নেই, চলে আয়। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গোপন গেরিলা হানার মিশাইল বা সাত দশকের পেটো— হাতবোমা হয়ে ছুটে এল পচা টোম্যাটো, তখনকার দোলের অস্ত্র, তারপর পচা ডিম। ওফ, কি ভয়ানক দুর্গন্ধ পচা ডিমের। বিভৎস। নির্বাচনী সভা, রাজনৈতিক সভায় পচা ডিম, পচা টোম্যাটো ছোঁড়ার ফায়দা ছিল পশ্চিমবাংলায়। পাঁচ, ছয় ও সাতের দশকে। পাশাপাশি পচা ডিমের, সড়া হুয়া টোম্যাটো বা টমাটর বা টমেটোর ফেটে যাওয়া রসের আলপনা গায়ের জামা— শার্ট বা টিশার্টে অনবরত। ‘জলসা’-য়, গানের জলসায় ভালো না গাইতে পারলে কুকুরের ডাক, শৃগাল চিৎকার, বাঘের হু-ম-ম গর্জন— সব ভেসে আসত শহরে, মফঃস্বলে, গ্রামদেশে— অনামি আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে। সেইসঙ্গে পচা টোম্যাটো বা টমাটর, টমেটো। পচা ডিমও ছয়ের দশক, সাতের দশকে। চালানি মাদ্রাজি হাঁসের ডিম বারো আনা— পঁচাত্তর নয়া পয়সা জোড়া। তখন পোলট্রি আন্ডা, পোলট্রি মাংসের এত এত রমরমানি শুরুই হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। তখন সবে ব্ল্যাকমিনার, রোডাইল, লেগহর্ন মুরগি-মোরগরা আসছে বা আসব আসব করছে। বাকি সব দেশি বা দিশি মোরগ-মুরগি। ‘ব্ল্যাক মিনার’ ব্রিডের মুরগি-মোরগ কালো, রোডাইল লাল। আর লেগহর্ন সাদা, লাল ঝুঁটি। সবচেয়ে রূপবান লেগহর্ন আর ব্ল্যাক মিনার মোরগ। এদের মাংস, ডিম বাজারে আসতে শুরু করেছে। মাদ্রাজি হাঁসের ডিম একটা ছ আনা— সাঁইত্রিস নয়া পয়সা। ফাটা— ফেটে যাওয়া মাদ্রাজি হাঁসের ডিম চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা। বাবা সেই ফাটা ডিম বাজার থেকে কিনে আনলে মা তাকে দিয়ে ওমলেট বানিয়ে, আমরা বলতাম ‘মামলেট’, তা নিয়ে আদা-জিরে বাটা বা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে ঝোল বানিয়ে দিতেন। বড়োসড় ‘মামলেট’ দুটো ডিম। একটা ডিম থাকলে তাতে আটার মিশেল। ব্যস, বড়ো মামলেট হয়ে গেল। সেই মামলেট লম্বা লম্বা করে কাটা আলু দিয়ে তরকারি। দোবেলা হয়ে যাবে। লোহার কড়ার ভেতরই হয়তো লোহার ধারাল খুন্তি দিয়ে আস্তে ধীরে কেটে দিতেন, কী অসাধারণ, চমৎকার শিল্পসম্মতভাবেই না অনায়াস কাটুনি তাঁর, মামলেটের মোড়কে থাকা ওমলেটকে। এমন শৈল্পিক রন্ধন— মামলেট-আলুর ঝোল আমার কাকিমাও তো করতেন, খড়দা— রহড়া-মধ্যপাড়ার বাড়িতে। কাকিমা— রেণুকা রায়। বাংলার ঘরে ঘরে তখন ‘সর্বজয়া’রা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সর্বজয়া’-র আরেও অন্য সর্বজয়ারা।
Powered by Froala Editor