ইলাহাবাদে কাউকে একেবারে নস্যাৎ করে দিতে হলে ‘নো লিফট’— এই শব্দটা ব্যবহার হত ছয়, সাত, আটের দশকে, তার আগে তো বটেই, তথাকথিত ভদ্রজনের মধ্যে বিনিময় ভাষায়। চমকে যাওয়াকে তারা বলত, ‘সকপকায় গ্যয়ে’। ‘নো লিফট’ অবশ্য তথাকথিত ভদ্র— ভদ্দর লোক— এলিটজনের ভাষায় হয়তো, আবার সাধারণ জন— আহির, পাশি, কাহার, চামার, কুনকি, খটিক, নিষাদ, শিকারি এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও ব্যবহার করতেন। রেণু মাসি— বড়ো মাসির জ্যেষ্ঠপুত্র মনকু— মঙ্কুদা বা খোকনদা— রঞ্জিত ভট্টাচার্যর দুই জিগরি দোস্ত ছিলেন ইকবাল আর সিদ্দিকি। ইকবাল ছিলেন আরপিএফ— রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সে, যেমন কারছানার শুকুল বা শুক্লাজি। করছানা বা কারছানা ইলাহাবাদের খুব কাছে, নৈনির লাগোয়া। ঝুসি, নৈনি— সব পাশাপাশি— কাছাকাছি। নৈনি ছোটো স্টেশন, ঝুসিও ছোটো স্টেশন। নৈনিতে বড়ো জেল আছে। সেখানে স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু গ্রেফতার হওয়ার পর ছিলেন অনেকদিন, সে তো ঐতিহাসিক সত্য। ঝুসি গঙ্গাজির ওপারে। সেখানে অনেক অনেক সাধু-সন্তের বাস— ডেরা। কতবার যে ঝুসি গেছি, তার ইয়ত্তা নেই। মাল্লা— নাওঅয়ালাদের সহায়তা নিয়ে। সে সব নয় পরে বলা যাবে। নৈনির লাগোয়া কারছানা বা করছানা শুক্লাজি বা শুকুলজির বাড়ি। ফর্মা, রোমহীন বক্ষের শুক্লাজির দুই বউ। এসব কথা আগেও লিখেছি। শুক্লাজির মাথার চুল লালচে, প্রায় দাড়ি-গোঁফহীন কাটাকাটা মুখ। শুক্লাজির মাথার চুলে কোনো বাহার নেই, অনেকটা যেন শুয়োরের কুচি— শুয়োরের লোম। অনেকবার চিরুনি দিলে— কঙ্খি করলে তবে ঠিকঠাক বসে— সেট হয়, নচেৎ নয়। তার আগে অবশ্য মাথায়- শর পে প্রচুর কড়ুয়া তেল মলতে হয়— মাখতে হয়। কড়ুয়া তেল অর্থে সর্ষের তেল। শুক্লাজি ম্যাট্রিক পাশ, পয়সাকড়ি যথেষ্ট, তবু আরপিএফ। কারছানার শুক্লাজির বাড়ির আশেপাশে প্রচুর ছাড়া মোর— ময়ূর। যেমন উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে, রাজস্থানের প্রায় সর্বত্র, এই ময়ূরবাহার, যার কথা আগেও লিখেছি। কলকাতা— ‘গ্রেটার ক্যালকাটা’-র রাজারহাটেও অনেক ময়ূর, বর্ষায় তাদের তীব্র কেকারব, অণ্ডপ্রসব— ডিম পাড়া, তারপর সেই ডিম চুরি। আবার হ্যাচারিতে বসিয়ে সেই ডিম থেকে খোকা বা খুকি ময়ূর। এইসব সংবাদ নয়ের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা খবরের কাগজ, ইংরেজি খবরের কাগজ— ডেইলিতে অনেক, অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের ইস্মরণে আছে সেই খবর, অনেকের নেই। তখন ‘রাজারহাটে ময়ূর’ একটা ভালো আইটেম ছিল নিউজের। তো যা বলছিলাম, শুক্লাজি বা শুকুলজি ছিল খোকনদার বেলতুতো বন্ধু। আবার ইকবাল ভাই-ও তাই। সিদ্দিকির খুব বড়ো ব্যবসা ছিলকাঠের আসবাবের। বড়ো দোকান ফার্নিচারের। বড়ো বড়ো লোগো কাটিয়ে আনিয়ে, অ্যাকস্যাক— দারুণ দারুণ— ‘অ্যাকস্যাক’ কথাটিও খুব প্রচলিত ইলাহাবাদে, যেমন ‘পুরখিন’ বা ‘কিনার’ শব্দটি— বৃদ্ধা অর্থে। এমনই এই অর্থ বোঝাতে ‘আবাহিন’। তো সিদ্দিকির ফার্নিচারের দোকান ‘লছমি টকিজ’ লাগোয়া, পুরানা কাটরা বা কটরাতেই। সিদ্দিকির ভারি চেহারা, গোল, ওজনদার মুখ, ক্লিন শেভেন। মাথাজোড়া টাক। খুব ভদ্র, আস্তে আস্তে কথা বলেন। সাধারণত টেরিকটের কালো ফুলপ্যান্ট আর ঘিরে রঙের ফুলহাতা শার্ট ইন করে— ভেতরে গুঁজে পরা। পায়ে চপ্পল। ফুলহাতা শার্টের হাতা গোটানো। সিদ্দিকি বিবাহিত। তিন বাচ্চার বাপ— তিন সন্তানের পিতা। ইকবাল সবসময়ই প্রায় হাফহাতা বুশ শার্ট। হালকা রঙের, ঘিরে বা অফ হোয়াইট। প্যান্ট টেরিকটের, তাও সাদা, নয়তো ঘিয়ে রঙের— শুধ্ গাওয়া ঘি— গব্য ঘৃতর রঙা হাতে ঘড়ি। সিদ্দিকির হাতেও স্টিল ব্যান্ডের, ঝোলা, ভারি দামি ঘড়ি। সেই ওয়াচ ব্যান্ড— ঘড়ির ব্যান্ড ‘বেনটেক্স’-এর ছিল কিনা বলতে পারব না। তখন— ছয়, সাতের দশকে ‘বেনটেক্স’-এর ঘড়ির ব্যান্ড খুবই নামি, সেই সঙ্গে সঙ্গে মজবুত ও টেকসই। সিদ্দিকি কথা কম বলেন। ইকবাল একেবারে বিপরীত। প্রচুর কথা— চপর চপর চপর চপর। ইকবাল বিবাহিত। দুটি সন্তান। খোকনদা— রঞ্জিত ভট্টাচার্য তার এই দুই খাস দোস্তকে নিয়ে খুব আড্ডা মারেন পুরানা কাটরায় লছমি টকিজ লাগোয়া কফি হাউসে। পুরানা কাটরার এই কফি হাউসটি খুব খানদানি নয়। ইলাহাবাদের খুব মশহুর— অতিবিখ্যাত, ঐতিহ্যময় কফি হৌজ সিভিল লাইনসে। সেখানে ইলাহাবাদের বহু এলিটজন আড্ডা মারতে— ‘গপ লড়াতে’— আড্ডাবাকি করতে আসেন। মঙ্কুদা— খোকনদা বা মঙ্কুদা সেই কফিখানাতেও যেতেন সিদ্দিকি আর ইকবালের সঙ্গে। তখন খোকনদার সাইকিল— সাইকেল। সাইকেল চেপেই তিনি পুরানা কাটরা থেকে ইলাহাবাদ স্টেশনে রেলওয়ের নোকরি— রেল-চাকরি করতে যান। তিনি প্রথমে ছিলেন টিসি— টিকিট কালেকক্টর। পরে হলেন টিটি। রানিং টেচিং স্টাফ। গাড়ি নিয়ে যেতেন— ট্রেন নিয়ে যেতেন মুঘলসরায় বা মুগলসরায় পর্যন্ত। এখন— ইদানিং ঐতিহ্যময় মুগলসরায় নাম বদলে ভারতীয় জনসঙ্ঘ নেতা, আরএসএস— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘর প্রচারক— সংগঠক, মুগলসরায় স্টেশনের কাছে ট্রেন কামরার মধ্যে অথবা বাইরে খুন হয়ে যাওয়া দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে হয়ে গেছে— বদলে দেওয়া হয়েছে মুঘলসরায়— মুগলসরায় বা বাঙালি জিভে ‘মোঘলসরাই’ স্টেশনের নাম। এই নাম বদলাবদলি ব্যাপারটাই আমার বিপুল অপছন্দের। নাম বদলে দিলে— আইন করে এক নাম থেকে অন্য নামে গেলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা চাপা পড়ে যায়। সেজন্য কলকাতার অ্যান্টনিবাগান, পটুয়াটোলা লেন, কলাবাগান, মেছুয়া বা ফলপট্টি, মেছুয়াপট্টি আমার পছন্দের। এই স্থাননামে ইতিহাস উঠে আসে। প্রকাশিত হয়। নাম বদল করে শ্রদ্ধা দেখানো যায় না। ময়রা স্ট্রিট, তাই ময়রা স্ট্রিটই ভালো ছিল। উত্তমকুমার সরণী হয়ে তার গায়ে কোনো নতুন ল্যাজ বা আঁশ গজায়নি। চৌরঙ্গীও তাই। যাক সেসব কথা, আবার খোকনদা, সিদ্দিকি, ইকবালের কথায় ফিরি। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে, এই ইকবালের একটা মন্তব্য ঘিরে খোকনদার সঙ্গে ইকবালের ব্যাপক মন কষাকষি, ঝগড়া, প্রায় হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যায়। পরে কথা তো বন্ধই, মুখে দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়। আসলে ‘বাংলাদেশ’ যুদ্ধের সময় একদিন শীতের অপরাহ্ন বেলায় লছমি টকিজের পাশে কফি হৌজে কথার ফেরে, কথার পিঠে কথায় ইকবাল বলে ওঠে বাঙালিরা দোপলা— অর্থাৎ বাঙালিদের কোনো জন্মের ঠিক নেই। ব্যস, আর যায় কোথায়। খোকনদা ভয়ানক অপমানিত হয়ে, একেবারে খিসিয়ায় গিয়ে— ভীষণ রাগান্বিত যাকে বলে— ইকবালের এই উচ্চারণের প্রতিবাদ করেন। দীর্ঘদেহী খোকনদা বিরল কেশ। তিনি উঠে দাঁড়ান উত্তেজনায়। ব্যস, হাতাহাতির অবস্থা প্রায়, ইকবালের সঙ্গে। একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া সিদ্দিকি আর কফি হৌজের অন্য অন্য বেয়ারাদের, কর্মীদের, অন্য অন্য আড্ডাধর বা আড্ডাধারীদের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা সাময়িকভাবে সেই সময়ের জন্য মিটে যায়। কিন্তু ‘খার’ থেকে যায়। রাগ। ইকবালের সঙ্গে সেই থেকে পাকাপাকি ‘কাট্টি’— আড়ি— বন্ধুবিচ্ছেদ। তো সে যাই হোক, শুকুল বা শুক্লাজি খুব বলতেন ‘নো লিফট’ কথাটি, তার ম্যাট্রিকের জ্ঞান নিয়ে। জিৎ সিং পুণ্ডির নামে একজন এক্স আর্মি ম্যান— প্রাক্তন ফৌজি আসতেন ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায়। তাঁর কথায় মাত্রা ছিল— এ বহেনচোদ— মাইকা ভোঁসড়ি, ভোঁসড়ি কাঁহিকে— বহেনচোদ— বাংলায় বানচোত। আমরা বলনি ‘বানচোত’ বা ‘বাঞ্চোত’ প্রায়ই। কথার মাত্রা হিসাবেই অনেকে ‘বাঁড়া’, ‘ল্যাওড়া’, ‘ধুর বাল’ বলে থাকেন। বলেন, ‘ঝাঁট উখাড়েঙ্গে হামার’। ‘বাল’ হিন্দি কথা যার অর্থ চুল। আর বাংলায় যাঁরা ‘বাল’ বলেন হিন্দিতে তা ‘ঝাঁট’। তো জিৎ সিং পুণ্ডির— তিনি এক্স মিলিটারি— অনায়াসে বহেনচোদ বলেন, তাঁর কথার মাত্রা হিসাবে। ইলাহাবাদ-প্রবাসী বাঙালিরা অনেকেই এই বিষয়টিকে— ‘বহেনচোদ’ ইত্যাদি, ‘তেরি বহেন চোদ’, ‘তেরি মা চোদ’-কে মা-বোনের গালি বলেন। ভোঁসড়ি অর্থে গুদ। ‘মাইকা ভোঁসড়ি’ অর্থে মায়ের গুদ। যাক এসব কথা। কোম্পানিবাগে যেটুকু জলা— জলের সংস্থান, সেখানে লাখনোয়া ধোবি— লাখন বা লখন ধোপা তার পাছাচুতর— গাঁড় মটকে মটকে মেহরুল বা মেহেরু— হিজরে, নয়তো হিজরা বিশেষণ মাথায় নিয়ে কাপড় কাচে চাড্ডি পরা অবস্থায়। গায়ে গেঞ্জি, কখনও খালি গা। তার তামাটে, নির্লোম বুকে কোম্পানিবাগের ঋতুবদলের সূর্য। সেই জলের উৎসেই মোষ চরাতে আসে পরেট লাগোয়া আহিরপল্লির মূলনারায়ণ— মূলে, শিউ— শিউনারায়ণ, বাচাউ— নিজের নিজের মোষ নিয়ে। গরমের দিনে— ঘোর গ্রীষ্মে এইসব মোষেরা ঘাষ চরতে চরতে— দাঁতে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে নেমে যায় জলের ভেতর। তারপর নিজেদের গায়ের গরম কমাতে কর্দমকেলি— কাদা খেলা করে তারা। এইসব ভঁইসি, ভৈঁসারা যখন দিন শেষ, উঠে আসে জল থেকে তখন তারা কর্দমলিপ্ত। শমনবাহন— যমবাহন মহিষরা জলে থাকলে অনেকটা যেন জলমহিষয়— ওয়াটার বাফেলো। এইসব ওয়াটার বাফেলো— জলমহিষদের নিয়ে কাজ করেছেন কনকতিলক মুখোপাধ্যায়। নয়ের দশকে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ ‘যুগান্তর’ সাময়িকী দপ্তরে। তার আগে বাগবাজারে তিনতলায় ‘যুগান্তর’ সাময়িকী দপ্তরে বেশ অনেকবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। কনকতিলক মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদেহী শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস টেরিকটের রঙিন সাফারি স্যুট। পায়ে শ্যু। এক সময়ের ভালো হান্টার— শিকারি— খুব ভালো শ্যুটার। বন্দুকবাজ। নানাধরনের বন্দুক, রাইফেল তাঁর করায়ত্ত। ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। পয়সাঅলা ঘরের ছেলে। জঙ্গল, শিকার, জীবজন্তু, সাহসীজীবন পছন্দ করেন। বাংলায় লিখতেন জঙ্গল, জীবজন্তু, শিকার নিয়ে। তখন তিনি হান্টার— শিকারি থেকে অরণ্যপ্রেমি। ভারতবর্ষের নানা জঙ্গলের প্রচুর অভিজ্ঞতা সেইসঙ্গে সিকিম, নেপাল আর আফ্রিকার বনজঙ্গলও। কনকতিলক ওয়াটার বাফেলো— জলমহিষ জনেন। তাদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেই গবেষণা। কনকতিলক মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ‘কাজ’-এর ক্ষেত্র ‘ওয়াটার বাফেলো’— ‘জলমহিষ’ নিয়ে প্রথম ‘যুগান্তর’ সাময়িকীর পাতায় লেখেন বাংলা তথা ভারতীয় ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার, হৃদয়বান শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘যুগান্তর’ সাময়িকীর প্রচ্ছদ কাহিনি— মলাট কাহিনি হয়েছিলেন সেবার কনকতিলক মুখোপাধ্যায়। আর সেই সঙ্গে তাঁর ‘ওয়াটার বাফেলো’— জলমহিষেরা। কনকতিলক সিকিমের একটি বিশেষ জঙ্গলেও বার বার গেছেন জীবজন্তু দেখতে। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘যুগান্তর’ সাময়িকীর পাতায়। কিস্তিবন্দি, একাধিক কিস্তিতে। তাঁর বাংলা অবশ্যই খুবই খারাপ। হাতের লেখাও। হাতের লেখা তথৈবচ। একেবারে হদকুচ্ছিৎ— কদাকার— কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং— চলতি ‘ঘটি’ জিভে ‘কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং’ যাকে বলে। তো সেই লেখাকে পরিমার্জন— পরিশোধন— রিপেয়ার— মেরামত করতে হত আমায় নিয়মিত। ‘যুগান্তর’ সাময়িকী এবং ‘দৈনিক বসুমতী’ সাময়িকীর জন্য এরকম বহু লেখাই মেরামত করেছি। ‘যুগান্তর’-এ মাস মাইনে পেয়ে, ‘দৈনিক বসুমতী’-তে কোনো মাস মাইনে না পেয়ে। কনকতিলক মুখোপাধ্যায় খুবই রসিকজন— জীবনরসিক। পানে, ভোজনে আগ্রহী। তাঁর চোখের সাইজ বেশ বড়ো— যাকে ‘ডাকা ডাকা চোখ’ বলে পুব বাংলার ভাষায়। কনকতিলক মুখোপাধ্যায়ের কথা লিখতে লিখতে আর এক কনক মুখোপাধ্যায়— কনক মুখার্জির কথা মনে পড়ে গেল। তিনি ছিলেন বাণিজ্যসফল বাংলা ও হিন্দি ছবির পরিচালক। এই কনকদাও টেরিকটের সাফারি স্যুট, অ্যাশ কালার— ছাই রঙের। শীতে টেরি উলের সাফারি সস্যুট। মাথা ভর্তি থাক থাক কোঁচকানো, কাঁচা-পাকা চুল। তাতে বেশ ভালো করে তেল দিয়ে অতিযত্নে ব্যাক ব্রাশ করা। গোল, ভারি মুখ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, ক্লিন শেভেন। তিনি কালীঘাটের ১৫বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আসতেন মাতৃকাশ্রম— প্রণবসঙ্ঘে সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর কাছে। ততদিনে হিন্দি ও বাংলায় ‘লালু কুঠি’ রিলিজ করে গেছে। সুপার ডুপার হিট ছবি। ড্যানি ডেনজাজাংপা সেই ছবির প্রধান চরিত্র। এই ছবির একটি অতিবিখ্যাত গান, তখন বহু মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বড়ো অভিনেতা ড্যানির লিপে গানটি গেয়েছিলেন কিশোরকুমার। সময়টা সাত দশকের প্রায় শেষ লগ্ন। সেই গানের কথা এইরকম— কারও কেউ নইকো আমি/ কেউ আমার নয়/ কোনো নাম নেইকো আমার/ শোনো মহাশয়…। কনকদা চমৎকার মানুষ। কোনো আহিঙ্কে বা অহঙ্কার— ‘বোকা বোকা’ অহঙ্কার দেখিনি তাঁর আচরণে। কালীঘাটের ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের একতলায় সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজির প্রায়ান্ধকার ঘরে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলে যেতেন রহস্যময় গলায়। তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজির ‘সম্মেহন’ নামে আখ্যানের দুটি পাতায় কনকদা— পরিচালক কনক মুখার্জির ভাষা হুবহু আছে। ‘সম্মেহন’, ‘নেপথ্যলিপি’ নামে কালীশ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত রূপমঞ্চতে ধারাবাহিক বেরত। ‘রূপমঞ্চ’ তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। কালীশবাবুর দুই বিবাহ। এক স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি অন্য নারীকে বিবাহ করেন। তখন ‘জলসা’, হেমেন্দ্রকুমার রায় সম্পাদিত ‘নাচঘর’ ছিল। ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’, ‘ঘরোয়া’ আরেকটু পরে আসে। আরও পরে ‘উত্তম’, ‘মৌসুমী’, ‘রজনীগন্ধ’। ‘নবকল্লোল’ অনেক বছরের পত্রিকা। তো সেই কনক মুখার্জি নেপথ্যলিপি বা ‘সম্মেহন’-এর পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন হয়ে ‘সম্মোহন’, তার নায়িকা শ্রীলেখার মনোবিশ্লেষণ দু পাতায় চমৎকার করেছিলেন। সেইসঙ্গে একটা সাসপেন্সের সিন— রোমাঞ্চকর বর্ণনা অন্য একট গ্রন্থে। তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজি দুটি উচ্চারণই রেখে দিলেন, তাঁর এত এত পছন্দ হয়েছিল কনক মুখার্জির ভাষা। কনক মুখার্জিকে ‘কনকদা’-ই বলতাম। তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন, সানন্দে। দিলখোলা মানুষ। কমার্শিয়াল ফিল্ম— বাণিজ্যিক ছবির বাংলা ও হিন্দি চিত্রনাট্য— স্ক্রিপ্ট চমৎকার লিখতেন তিনি। এমনই একজন কমার্শিয়াল হিট ফিল্মের পরিচালক ছিলেন বীরেশ্বর সরকার। ‘সোনার খাঁচা’ নামে ছবিটি তাঁর করা। সেইসঙ্গে আরও অনেক হিট ছবি। তাঁর সঙ্গে আলাপ কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এজমালি বাড়ি, ২৮ প্রতাপাদিত্য রোডে।
Powered by Froala Editor