মুছে যায়? – ১৩
আগের পর্বে
‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে দাঁতের মাজন...’ লিখেছিলেন কবি রুদ্রেন্দু সরকার। তবে এই মাজন বা মঞ্জনের উত্তরসূরি হল দাঁতন বা দাতুইন। নিম, বাবুল, আটকিরের ডাল দিয়ে তৈরি হত এই দাঁতন। সত্তর দশকে জেলে যার প্রভূত ব্যবহার ছিল। রমরমা ছিল কুম্ভের মেলাতেও। ইসলান ধর্মালম্বীরা ব্যবহার করতেন আরেকটু মোটা মেসওয়াক। পরে বাজারে এসেছিল বিনাকা, কোলগেট, কলিনোস, নিম, সাধনা দশন প্রভৃতি ব্র্যান্ডের গুঁড়ো মাজন। রেডিওতে সম্প্রচারিত হত ‘বিনাকা গীতমালা’। আরও পরে আসে পেস্ট মাজন। একেক রকম ব্র্যান্ডে তার একেক রকম ফেনা। সুস্বাদু। দাঁত মাজতে গিয়ে সেই ফেনা খায়নি এমন বালক-বালিকা ছিল দুর্লভ।
আমার প্রথম ট্রেঞ্চ বা পরিখা দেখা ১৯৬২ সালের অতি দুঃখজনক চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময়।
হাওড়া জেলার বালিতে আমাদের স্কুল— ‘বালি জোড়া আশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’-এর ফাঁকা জমিতে। পরে এই জমিতে তৈরি হয় ‘প্রবোধ ভবন’। ‘বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’ই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বিদ্যালয়, যার কোনো বাউন্ডারি ওয়াল, গেট— কিছুই নেই।
অন্য অন্য বাড়ি— ‘আশুতোষ ভবন’, ‘বামাচরণ ভবন’, ‘বঙ্গশিশু ভবন’, ‘প্রবোধ ভবন’ ইত্যাদি প্রভৃতিসহ চারখানা বাড়ি। তাতেই ক্লাস ওয়ান থেকে ইলেভেন। নিজেদের বড় লাইব্রেরি, চমৎকার ল্যাবরেটারি। বড়সড় রেডিও। তো সে যাক গে, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘর্ষের পরই আমরা খবরের কাগজের পাতায় পাতায় তেজপুর, বমডিলা, নেফা, লাদাখ ইত্যাদি প্রভৃতি নাম শুনতে পেলাম।
রেডিও সম্প্রচারে ‘লাল চীন’ ‘কতটা খারাপ’ তাও শুনতে পেলাম। চীনে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’— তথাকথিত ‘বৃহৎ উল্লম্ফনে’ কত লোক মারা গেলেন দুর্ভিক্ষে তার বিবরণ, চীনারা আরশোলা, টিকটিকি, ব্যাঙ— সর্বস্ব খায়। মাও-সে-তুঙ, চৌ-এন-লাই কত খারাপ, তার কথা সত্য মিথ্যা মিলিয়ে প্রচারিত হতে থাকল।
তখন তিনটি গান খুব বাজত রেডিওতে—
‘জিঘাংসা লোভ তির্যক চোখ
ড্রাগন নখর দাগে
... মহাভারতের সীমানায়
রণদানবেরা পা বাড়ায়’
আর একটি গান নির্মলেন্দু চৌধুরীর কণ্ঠে -
‘শোনো শোনো ভাই জওয়ান...
তোমার রক্তে ভিজা মাতৃভূমির উত্তর সীমানা...
ঐ বিশ্বাস হন্তা দস্যু দলে হঠাৎ দিল হানা
আর লাল ড্রাগনের থাবায় ভাইরে
বুকটা ফানা ফানা
ও জওয়ান...’
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গেয়েছিলেন—
‘...পুরাও মনস্কাম
অঙ্গে আমার দাও মা লিখে
ভারত মাতা নাম
পুরাও মনস্কাম
...রাবণ আবার জানবে মাগো
আজও আছে রাম, পুরাও মনস্কাম...’
এই সময়েই, ঐ ১৯৬২ সালেই ‘আকাশবাণী’ থেকে বাজান একটি গান মনে পড়ে গেল, গানটি এরকম—
‘স্বর্গাদপী গরিয়সী তুমি মা
বীর প্রসবিনী জননী
জাগুক নিত্য কালের চিত্তে
তোমারই জয়ধ্বনি—
জয় হিন্দ জয় হিন্দ
এ নাম জাগুক যুগযুগান্তে
মোদের জীবন জুড়ে...’
তখন রেডিওতে অনর্গল দেশাত্মবোধক গান। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন সহ বিভিন্ন ধরণের স্বদেশি চিন্তা, স্বদেশ বোধকে জাগানোর সঙ্গীত।
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ তাঁর জাদুকণ্ঠে শ্রাদ্ধ করতেন ‘লাল’ চীনের। খবরের কাগজ, রেডিও ‘লাল’ চীন শব্দটাকে মান্যতা দেয়। চীনের তথাকথিত আগ্রাসী মনোভাবকে চিহ্নিত করা হয় ‘ড্রাগন’ বা ‘ড্রাগনের নিঃশ্বাস’ বলে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র বিষয়টিকে কথাভাষ্যে আনতেন। সেই সঙ্গে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ বা ‘বৃহৎ উল্লম্ফনের’ ‘ব্যর্থতা’ও।
অথচ কিছুদিন আগেও ছিল ‘জোট নিরপেক্ষ’ আন্দোলনের কর্মসূচি, পঞ্চশীল প্রভৃতি। জোট নিরপেক্ষ বা ‘গোষ্ঠী নিরপেক্ষ’ আন্দোলনের শরিক ছিল পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর ভারত, সোয়েকর্ণ বা সুকর্ণর ইন্দোনেশিয়া, তথাকথিত ওয়ারশ প্যাকট— ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত যে সব দেশ— সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, আলজেরিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া— সোভিয়েত ব্লকের এই সব দেশের সঙ্গে যুগোশ্লাভিয়াও ছিল। মার্শাল টিটোর যুগোশ্লাভিয়া ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে। আবদুল গামাল নাসেরের মিশর।
বান্দুং সম্মেলন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে আলাদা গুরুত্ব দেয়। সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমিউনিস্ট চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই। পঞ্চশীলের কথা সেখানে উঠে আসে বারবার। জোট নিরপেক্ষ বা গুট নিরপেক্ষ অথবা নির্জোট আন্দোলনের পেছনে নাকি ছিল ‘রুশ’ মস্তিষ্ক। তারপরই চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ, ম্যাকমেহন বা ম্যাকমোহন লাইনকে কেন্দ্র করে। ততদিনে তিব্বতের দখল নিয়েছে চীন। দালাই লামা আর তাঁর সঙ্গীরা— এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ‘খাম্পা বিদ্রোহী’, ঘোড়ার পিঠে দুর্গম বরফিলা পথ পেরিয়ে পালিয়ে এসেছেন ভারতবর্ষে। লাসা থেকে ইন্ডিয়া। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দলাই লামার ভারতে আসাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
ফরমোজা বা তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ড নয়। সেই দ্বীপভূমির রাষ্ট্র প্রধান চিয়াং কাইশেক।
চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে কমিউনিস্টদের— মাও-সে-তুঙ, চৌ-এন-লাই, মার্শাল চুতে, ‘হাউ টু বি আ গুড কমিউনিস্ট’ গ্রন্থের লেখক লিউ-শাও-চি, কাং শেংদের দ্বন্দ্ব বহু প্রাচীন। ফরমোজা বা তাইওয়ানই তখন রাষ্ট্রসংঘ— ইউএনও-র যে পাঁচজন স্থায়ী সদস্য দেশ, যাদের ‘ভেটো’ প্রয়োগের অধিকার আছে, যে কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে, তারা হল আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং তাইওয়ান।
ভারত দীর্ঘ দিন ধরে প্রস্তাব রাখছে রাষ্ট্রসংঘে— রেড চায়নাকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করে নিতে। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তখন উ থান্ট।
তো সে যাই হোক, বান্দুং সম্মেলনের রেশ কাটতে না কাটতেই তখন চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ বিতর্কিত ম্যাকমেহন বা ম্যাকমোহন লাইনকে নিয়ে। চীনা রেড আর্মি নেমে এল আসামের তেজপুর পর্যন্ত। আবার ফিরেও গেল। জেনারেল কল, ওয়েস্টমুর ল্যান্ড, জেনারেল কারিয়াপ্পা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, এঁদের নাম তখন বারবার বাতাসে ভাসছে। চীন যুদ্ধের পর শুরু হল প্রতিরক্ষা তহবিল— ডিফেন্স ফান্ড গঠন।
‘যুগান্তর’-র কার্টুনিস্ট পি সি এল— একটি নিয়মিত স্ট্রিপ আঁকতেন। তার ছদ্মনাম ছিল ‘খুড়ো’। সেই পি সি এল- প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ী তাঁর কার্টুনে দেখালেন চৌ-এন-লাই ও পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করছেন। তারপর প্রীতিময় কোলাকুলি শেষ হওয়ার পর পণ্ডিত নেহরু বলছেন তাঁর কুর্তার দুই পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে, ‘একি আমাদের নেফা আর লাদাখ?’
১৯৬২-র চীন যুদ্ধের সময় দেখলাম মাঠে মাঠে ট্রেঞ্চ খোঁড়া। আধ মানুষ গভীর সেই পরিখার ভেতর বৃষ্টি হলে জল জমে। সেখানে সোনা ব্যাঙ। গ্যাঙোর গ্যাঙ। ছেলেরা অনায়াসে ট্রেঞ্চ শুকনো থাকলে তার ভেতর লুকোচুরি খেলে।
সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র হয়ে চলে গেলেন চীন যুদ্ধের রিপোর্ট করার জন্য। তাঁর প্রতিবেদন নিয়মিত বেরতে থাকল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রথম পাতায়। জবজবে মাখা মাখা ‘দেশপ্রেম’। স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করলেন মোরারজি ভাই দেশাই-এর কাছাকাছি সময়ে। চৌদ্দ ক্যারেট, আঠারো ক্যারেট, বাইশ ক্যারেটের হিসাব শুরু হল।
‘যুগান্তর’ পত্রিকায় এই যুদ্ধকালীন সময়ে কমিউনিস্ট চীনকে খানিকটা সমর্থন করে একটি চিঠি প্রকাশিত হল। তারপরই শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ, সুকমল কান্তি ঘোষ প্রমুখ ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ গোষ্ঠীর মালিকেরা ‘যুগান্তর’-এর দায়িত্বে থাকা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে কৈফিয়ত তলব করলেন এ ব্যাপারে।
বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় নাকি সেই সম্পাদক সমীপেষুকে পাঠানো পাঠকের চিঠির মূল কপি পেশ করতে পারেননি। ফলাফলে তিনি পদত্যাগ করলেন বা বাধ্য হলেন রেজিগনেশান দিতে।
‘যুগান্তর’ ছেড়ে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার অশোক সেনের ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। অশোকবাবু বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী শুধু নয়, তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার আইনমন্ত্রীও ছিলেন। শোনা যায় লন্ডনে তাঁর বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।
অশোক সেনকে নিয়ে ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এর প্রথম সংখ্যার মলাট হয়েছিল।
তখন ‘দৈনিক বসুমতী’-র সঙ্গে সাপ্তাহিক ও মাসিক ‘বসুমতী’ও বেরোয়। প্রেসিডেন্সির ছাত্র, বিশিষ্ট লেখক প্রাণতোষ ঘটক তখন ‘বসুমতী’-তে। তিনি আবার সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর সহধ্যায়ী। সম্ভবত মাসিক ‘বসুমতী’ সম্পাদক জয়শ্রী সেন। ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রী, জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তীরা লেখেন মাসিক ও সাপ্তাহিক ‘বসুমতী’তে। ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রীর কন্যা— জয়শ্রী তাঁর নাম নিয়মিত অভিনয় করেন কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয়ে। বসুমতীতে তখন চাঁদের হাট। নামকরা লেখকেরা তখন সবাই লেখেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-কে দিয়ে প্রাণতোষ ঘটক লেখান ‘প্রসাদপুরী কলকাতা’।
সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দৈনিক বসুমতীর সংবাদ-প্রধান হলেন। ১৯৬৬-র মার্চে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনে ‘দৈনিক বসুমতী’ ‘সৈনিক বসুমতী’-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কোনো একটি মন্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন, ‘দৈনিক বসুমতী বরাবরই সৈনিক বসুমতীর ভূমিকা পালন করেছে। সৈনিক এবার সেনাপতি হও।’
১৯৬৬-র মার্চে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনে ‘দৈনিক বসুমতী’ ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দাঁড়ালেন কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীদের পাশে। ছবিতে, লেখায় সে তো প্রকৃতপক্ষে জনদৈনিক। তখনকার ‘দৈনিক বসুমতী’র একটা ক্যাপশান মনে আছে— ‘ঢালাও হুকুম, চালাও গুলি’। সেই সময় হলধর পটলও ‘বসুমতী’র সাংবাদিক। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী পি সি সেন— প্রফুল্লচন্দ্র সেন। তিনিই ‘স্বরাষ্ট্র’ ও পুলিশ দেখেন।
কৃষ্ণনগর, বসিরহাট, দমদম, খড়দা, সোদপুর, বেলঘরিয়া অগ্নিগর্ভ। পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত, বাবলু রজক। হাবড়ার স্বরূপনগরে চলল গুলি।
প্রফুল্ল চন্দ্র সেন রস করে বললেন, ‘কৃষ্ণনগর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায় রে।’ দৈনিক বসুমতী এই সব খবর করতে থাকল। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘সাবধান সাবধান’ নামে পুস্তিকা। যাতে থাকল অত্যাচারী শাসকের প্রতি সাবধানবাণী।
অতি সস্তার সেই পুস্তিকা অত্যন্ত খেলো, নিউজ প্রিন্টে ছাপা। পিন স্টিচিং। ভাঙা টাইপ। হ্যান্ড কমপোজ। দাম দশ নয়া পয়সা কি? নাকি পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনা? তাই পড়তে পারছে না। কী তার বিক্রি!
কৃষ্ণনগরে সামরিক বাহিনী নামল। চব্বিশ, আটচল্লিশ, বাহাত্তর ঘণ্টার বনধ ডাকছেন বামপন্থীরা। বামপন্থী নেতা, কর্মীরা— সব জেলে। সফল হচ্ছে সেই বনধ। যাকে বলা যেতে পারে, সর্বাত্মক সফল হচ্ছে হরতাল। খাদ্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে আগেই ‘দমদম দাওয়াই’-এর কথা আমরা শুনলাম।
আচমকা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান চালালেন সাধারণ মানুষ। শুরু হল মার মার আর মার। ‘দমদম দাওয়াইয়ের’ পেছনে অবশ্যই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী ‘আলট্রা লেফট’ অংশ। ততদিনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সি পি আই ভেঙে সি পি আই ও সি পি আই (এম)। সেটা ১৯৬৪ সাল।
১৯৬২-র চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় ট্রেঞ্চ বা পরিখা কাটার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বোমা পড়লে ট্রেঞ্চের ভেতর আশ্রয় নিতে হবে। দু দুটো বিশ্ব মহাযুদ্ধ - ওয়ার্ল্ড ওয়ার বা গ্রেট ওয়ার তাই শিখিয়েছে। ইয়োরোপকে, ইয়োরোপের কলোনিদেরও। ১৯৬২-তে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ম্যাকমোহন লাইন ঘিরে সামরিক উত্তেজনা শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। দালাই লামা যখন তিব্বত থেকে ভারতে ঢুকছেন, তখন ‘স্টেটসম্যান’-এর প্রশান্ত সরকার এলিফ্যান্ট ট্র্যাকে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দালাই বা দলাই লামার প্রবেশ মুহূর্তের জন্য।
হস্তীপথ বা এলিফ্যান্ট ট্র্যাকের ওপর দুপাশে দীর্ঘ গাছেদের মাথায় মাথায়, ডালে-পাতায় এক বিঘদ সমান পাহাড়ি জোঁক। হাতির দল আসে, যায় সেই রাস্তা দিয়ে। আর তাদের কোনো একটি, দুটি বা তিনটির মাথায় থপ করে খসে পড়ে সেই বৃহদাকার রাক্ষুসে জলৌকারা, তারপর তারা আকণ্ঠ শুষে নিতে থাকে হাতির রক্ত। হাতি কোনোভাবেই ঝেড়ে ফেলতে পারে না তাদের মাথার ওপর থেকে। রক্ত খেয়ে টাব-টুব হয়ে গেলে তারা এমনি এমনিই খসে পড়ে পাতা ঝরা পথের ওপর।
প্রশান্তদা যখন ‘দৈনিক বসুমতী’র সম্পাদক, তখন তাঁর মুখ থেকে এইসব কথা শুনেছি। একজন বিদেশি সাংবাদিক, সম্ভবয় রয়টার-এর, তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন ভেরিয়ার এলুইনের ট্রাইব সংক্রান্ত বই, তাঁর স্টোরির ইন্ট্রো তৈরি করার জন্য।
প্রশান্ত সরকার— সাংবাদিক, সম্পাদক, মানুষ প্রশান্ত সরকারকে নিয়ে একটি কলাম— ‘মুছে যায়?’-এ লেখার ইচ্ছে আছে।
মনোজ বসু ১৯৬২-র চীন যুদ্ধের আগে তাঁর ‘চীন দেখে এলাম’, যেখানে চীন সরকার ও শাসকদের জন্য প্রভূত প্রশংসা ছিল, সেই সব বই কলেজস্ট্রিটে প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দেন। আর তারপর চীনকে সমালোচনা, গালাগালি দিয়ে গ্রন্থ নির্মাণ করেন, ঐ একই নামে। ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ এই পর্যায়ে লেখা শুরু হয়, সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। শুরু হয় সই সংগ্রহ। সমরেশ বসু এই ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’র পক্ষে সই দেননি। যেমন সই দেননি সত্যজিৎ রায় ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার সমর্থনে ও ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধ সত্ত্বেও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেননি পণ্ডিত জবাহারলাল নেহরুকে নিয়ে।
তখন সর্বত্র চীন বিরোধী প্রচার। আক্রান্ত হচ্ছেন চীনা ধোবিখানা— লন্ড্রিরমালিক-মালকিন, চীনা ডেনটিস্ট ও চীনা বাজারের জুতোর দোকানদাররা, লুট হচ্ছে তাঁদের দোকান।
কলকাতায় চীনা লন্ড্রি, চীনা রেস্তোরাঁ, চীনা ডেনটিস্ট, চীনা জুতোর দোকানদার ১৯৬২-তে প্রচুর। ট্যাংরায় চীনা খাবারের রমরমা আরও অনেক পরে।
‘হকিকত’ নামে একটা পাক্কা চীন বিরোধী সিনেমা বানালেন চেতন আনন্দ। প্রিয়া, ধর্মেন্দ্র ছিলেন সেই ছবিতে। সেই সিনেমায় লতা মঙ্গেশকর গাইলেন কবি প্রদীপের লেখা গান— ‘ও মেরে বাতন কি লোগো’। সে গান শুনে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন নাকি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। তাঁর দু’চোখে জল। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
আরও পরে বানানো হল ‘কিসমাত’— বিশ্বজিৎ-ববিতা। সেই ছবি বোমা মেরে বন্ধ করলেন নক্সালপন্থী যুব-ছাত্ররা। ‘প্রেমপূজারি’— যাতে দেবানন্দ ছিলেন ও ‘সাতরঞ্জ’ নামে একটি ছবি— তাদেরও বোমা মেরে বন্ধ করানো হয় জোর করে চীন বিরোধিতার অজুহাতে।
১৯৬২-র ট্রেঞ্চ খোঁড়া, সাইরেন, অলক্লিয়ার পরীক্ষা, এ সবই চোখের সামনে। ব্ল্যাক আউট, বিমান বিধ্বংসী কামান— অ্যানটি এয়ারক্র্যাফট গান বসানো সবই দেখতে পেলাম। ব্ল্যাক আউটকে বাংলা কাগজে নিষ্প্রদীপ বলা হতে থাকল।
কাচ বসানো জানলায় জানলায় সস্তার, কাটা কাগজের গুণচিহ্ন। পাছে বোমার দমক-কম্পনে কাচ ভেঙে গেলে অন্য বিপত্তি ঘটে, তাই এই ব্যবস্থা।
১৯৬২-তে ভারতের আকাশে যুদ্ধ বিমান, উড়ছে। সম্ভাব্য চীনা বিমান হানা রোখার জন্য। তখন অবশ্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান বলতে ব্রিটিশের ফেলে দেওয়া ‘হানটার’, ‘ভ্যামপায়ার’, ‘ন্যাট’। ‘স্পিট ফায়ার’-ও ছিল কি? সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স, এন সি সি-র তিনটে শাখাতেই ভর্তি বাড়ান হচ্ছে, কলেজ, স্কুলে। আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সে বাড়ান হচ্ছে রিক্রুটমেন্ট।
১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আবার সাইরেন, অলক্লিয়ার প্র্যাকটিস শুরু হয়, ব্ল্যাক আউট— নিষ্প্রদীপ রাত্রি।
‘ওঁ-ওঁ-ওঁ’ করে বাজে সাইরেন। ‘শত্রু’ বিমান ঢুকে পড়েছে আমাদের দেশে। রাডারে ধরে পড়ে সে সব। গোলা দাগে অ্যান্টি এয়ার ক্র্যাফট গান। দক্ষিণেশ্বর— বালির বিবেকানন্দ ব্রিজ লাগোয়া অ্যান্টি এয়ার ক্র্যাফট গান বসে। তার গায়ে কালো, বড় ঢাকনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি যুদ্ধ বিমান, আয়তনে তা বেশ ছোটো ও হালকা, তারা বোমা ফেলে যায় হাতিবাগানে। তখনও বাঙালি, শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত ব্যস্ত সাইরেন, অলক্লিয়ারের ভূমিকা বুঝতে। সাইরেন যেমন ‘ওঁ-ওঁ-ওঁ’ করে বাজে। অলক্লিয়ার তেমনই টানা সুরে— সমান্তরাল। ১৯৭১-এর পাকিস্তান যুদ্ধেও বাঙালি তথা ভারতীয়রা সাইরেন ধ্বনি, অলক্লিয়ারের শব্দ টের পায়।
১৯৬৫ বা ১৯৭১-এর পাকিস্তান যুদ্ধে ট্রেঞ্চ বা পরিখা খোঁড়া হয়নি। ১৯৬২-র বালি জোড়া অশ্বস্থতলা বিদ্যালয়ের ‘প্রবোধ ভবন’ মাঠে, তখনও তৈরি হয়নি ‘প্রবোধ ভবন’, যে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল চীনা বিমান আক্রমণ বা এয়ার রেডের ভয়ে, তার আশেপাশের স্কুলবাড়ির দেওয়ালে কারা যেন লিখেছিল— জহর + বাণী, স্বপন + শিখা, ঝুপু + চৈতালী, সুধীর + শিবানী।
বাঙালি বিপ্লবী বীরদের প্রথম পরিখা যুদ্ধ— ট্রেঞ্চ ফাইট ততদিনে কি ভুলে গেছে সাধারণ বাঙালি? ওড়িশার বুড়ি বালাম নদীর তীরে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন) আর তাঁর সঙ্গীরা— চিত্তপ্রিয়, নীরেন, জ্যোতিষ প্রমুখ বিপ্লবীরা রডা কোম্পানির লুট করা জার্মান মাউজার পিস্তল নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে আসা বি-ই-শা-ল পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে।
অস্ত্র বোঝাই ‘ম্যাভেরিক’ নামক জাহাজ এসে পৌঁছানোর কথা ছিল সুন্দরবন এলাকায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাভেরিক পৌঁছাতে পারেনি। বাঙালি বিপ্লবীরা মাউজার নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বৃটিশ শক্তির মুখোমুখি।
সেই অসম যুদ্ধকে সম্মান জানিয়ে লেখা হয়েছিল,
‘বাঙালির রণ দেখে যারে তোরা
রাজপুর, শিখ, মারাঠা, জাঠ,
বালাশোর বুলিবালামের তীরে
নবভারতের হলদিঘাট...’
সেও তথাকথিত ‘নন মার্শাল’ বাঙালি বিপ্লবীদের পরিখা যুদ্ধ— ট্রেঞ্চ ফাইট যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে।
‘লাল চীন’ প্রসঙ্গে মনে পড়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর ঘনাদা সিরিজের একটি কাহিনী ‘ঘনাদাকে ভোট দিন’ লিখেছিলেন—
‘সফেদ হবে লাল চীন
ঘনাদাকে ভোট দিন।’
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor