ইলাহাবাদ, বেনারস-সহ উত্তরপ্রদেশের— অখণ্ড উত্তরপ্রদেশের— ‘উত্তরাখণ্ড’ হওয়ার— আলাদা রাজ্য হিসাবে উত্তরাখণ্ড চিহ্নিত হওয়ার আগে পর্যন্ত গোদনাগোদাই শব্দটি মানুষের— সাধারণজনের মুখে মুখে ঘুরেছে, এখনও ঘোরে। এর সঙ্গে আছে ‘গোদভরাই’— এই শব্দটিও। ‘গোদনাগোদাই’ ইলাহাবাদে সাধভক্ষণ এই অর্থে ব্যবহার হত, এখনও হয়। ‘গোদভরাই’-এর অর্থও একই। অর্থাৎ ‘সাধ খাওয়া’ বা ‘সাধ ভক্ষণস’। ‘পাওভারি’ অর্থে গর্ভবতী, গর্ভিনী। ‘পাওভারি’ হওয়ার সঙ্গে ‘গোদনাগোদাই’ ও ‘গোদভরাই’-এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বাঙালি জীবনে, সংস্কারে পাঁচ মাস, সাত মাস, ন-মাসে সাধ দেওয়া হয় গর্ভবতী নারীদের। যিনি গর্ভবতী, তাঁর পছন্দের নানা ব্যঞ্জন তাঁকে চমৎকার কাঁসা বা খুব সম্পন্ন হলে রজতাভ— রুপোর থালায় সাজিয়ে দেওয়া, এইসব প্রথাকেই কুপ্রথা মনে হয়, তার কারণ সন্তান হতে গিয়ে— বাচ্চা বিয়োগের সময় মেয়েটি— বধূটি যদি আর না বাঁচে, তা হলে কী হবে? তারই প্রস্তুতি হিসাবে, তাকে— সেই গর্ভিনী নারীকে তার পছন্দের খাদ্যসামগ্রী খাইয়ে দাও। বড়োসড়ো কাতলা মাছের মুড়ো, বাটি ভর্তি পায়েস— পরমান্ন। আরও অনেক অনেক— বিবিধ রান্না করা উপকরণ। এই যে সাধভক্ষণ, তাতে নানা মেয়েলি— মহিলা-সংস্কার আছে। যেমন বড়ো হাঁ করে যে কোনো ব্যাঞ্জন বা পায়েস খাওয়া যাবে না। তাতে নাকি গর্ভস্থ সন্তানের হাঁ মুখ বড়ো হবে। গ্রহণের সময়— সে চন্দ্রগ্রহণই হোক আর সূর্যগ্রহণই হোক, বেরনো যাবে না বাইরে, প্রকাশ্য স্থানে। ছাদ বা উঠোন— কোথাও গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। তাতে নাকি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হবে। এমনকি গ্রহণের প্রভাবে গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভের সন্তান, পুত্র নাকি কন্যা, তা জানার জন্য দুটি ‘তুক’ আছে। বড়ো ঝুড়ির নিচে চাপা দেওয়া থাকে প্রদীপ ও শিলের বোড়া। গর্ভবতী রমণী, যাঁর সাধ দেওয়া হচ্ছে, তিনি যদি ঝুড়ি ঢাকা প্রদীপ বার করেন, তাহলে কন্যা সন্তান। ঝুড়ি চাপা দেওয়া পাথরের নোড়া বার করলে তা হবে পুত্র সন্তানের প্রতীক স্বরূপ। অর্থাৎ, ঝুড়ি ঢাকা পিদ্দিম বেরিয়ে এলে কন্যা। পাথরের নোড়া বেরলে পুত্র। প্রায় এইরকমই রূপ অনুকল্প আছে অন্যভাবে, পুত্র নাকি কন্যাসন্তান হবে আগামীতে, গর্ভবতী নারী পুংসন্তান নাকি কন্যাসন্তানের মা হবেন, তারও ভবিষ্যৎ ফলাফল প্রকাশ করা হয় খেঁজুরের আঁটি আর ছোলার দানা দিয়ে। ছোলার দানা হলে পুং-সন্তা— পুত্র, খেঁজুর আঁটি হলে কন্যা-সন্তান— নারী। সাধভক্ষণ— গর্ভিনী নারীকে সাধভক্ষণ করানো হয় বাচ্চা ছেলে অথবা বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে। তারাই চামচ করে তুলে পায়েস দেয় সেই ভাবি-জননীর মুখে। আর যে কথা আগেও লিখেছি, এখনও লিখছি, এই পায়েস বা অন্য অন্য ব্যঞ্জন গ্রহণের জন্য মুখের মুদ্রায়, বেশি হাঁ করা যাবে না কিছুতেই। ভাবি মা বেশি হাঁ করলে পুত্র বা কন্যার হাঁ-মুখ বড়ো হবে, এমনই প্রচলিত সংস্কার। সাধ, সাধভক্ষণ, গোদনাগোদাই, গোদভরাই— এইসব বিষয় নিয়েই কিছু কিছু বলা গেল। পুনরায় ইলাহাবাদ, তার পুরানা কাটরা, পাতলি গল্লি, পাশিয়ানাতে ফিরি। ৮৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরায় আশুতোষ ভট্টাচার্যর যে কিরায়া মকান— ভাড়াবাড়ি, তার উল্টোদিকে চুন্নু-মুন্নু, মুন্নি আর কট্টন, চুন্নু-মুন্নু-মুন্নিদের মা আর খারেবাবুর সংসার। দোতলা মকান। সামনেটায় খানিক চৌতারা বা চবুতরা। সেখানেই খাটিয়া পেতে খারাবাবু। তিনি একসময় ইলাহাবাদের উত্তরপ্রদেশ সরকারের চাকুরিয়া ছিলেন। এজি অফিস। রিটায়ারমেন্টের অনেক আগেই তিনি এই ইসলাম ধর্মাবলম্বী নারীর প্রেমে পড়েন। কীভাবে, কীভাবে তিনি এই নারীর প্রেমে পড়লেন, তা প্রায় দুর্ভেদ্য রহস্য বিশেষ। তেমন করে সবটা— সব তথ্য তো জানাও যায় না। চুন্নু-মুন্নু-মুন্নিদের মা অতিব মুখরা, ঝগড়ুটে। প্রায়ই তো খারেবাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া। ইলাহাবাদের স্থানীয় জিভে যা ‘লড়াই’ বলে চিহ্নিত। তো সেই খারেবাবুর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকা চুন্নু-মুন্নু-মুন্নিদের মায়ের নিত্য কাজিয়া। রোজ রোজ গোলমাল।
এই গলির বাসিন্দাই ইন্দে সাকসেনা, মেনা সাকসেনার কথা বলেছি আগে। মেনার দাদ্দা— ঠাকুর্দা মহা পিয়ক্কড়— পাক্কা মাতাল। মেনাও ইউপির কায়স্থ। তার দাদার বউ খুবই অল্পবয়সে, তিরিশেরও কম উম্রমে ভগওয়ানকা পেয়ারা হো গ্যয়া। হিন্দি বলয়ে হিন্দি-সনাতনধর্মীরা মৃত্যুকে বলে, ‘ভগওয়ান কা পেয়ারা হো গ্যয়া’। আর এই মওত বা ইন্তেকালকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বলেন, ‘আল্লা কা পেয়ারা হো গ্যয়া’। মুন্নিদের বাড়ি আছে এক পোষা তোতা— বড়োসড়ো টিয়াপাখি, চন্দনাও হতে পারে। হিন্দিতে টিয়াকে বলে শুগগা আর বাড়ির পালতু— পোষা টিয়া— সবসময় না হলেও প্রায় সময়েই মিঠঠু। শুগগা— টিয়াকে— বাড়ির— ঘরেলু পালতু টিয়াকে আদর করে মিঠঠু বলে ডাকা। তো সেই মুন্নি-চুন্নু-মুন্নুদের পিঞ্জরা— খাঁচায় পালতু শুগগা। সে নানা কথা রটে— বলে। কট্টন— কট্টন— ডামিশ— বদমাইশ কট্টনের কথা আগেই বলেছি। পুরানা কাটরার পরেট পেরিয়ে বড়ো রাস্তা দিয়ে ডানদিকে হাঁটলে ‘হাথি পারক’— হাতি পার্ক, আনন্দভবন। ভরদ্বাজ আশ্রমও যাওয়া যায় এই রাস্তা দিয়ে। ‘আনন্দভবন’ মোটিলাল নেহরু-স্বরূপ রানি নেহরু-পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গান্ধী-কমলা নেহরু— সকলের বাসভবন। ঐতিহাসিক সে বাড়ি। হাতিপার্ক থেকে ইলাহাবাদ মিউজিয়াম— সংগ্রহশালা— জাদুঘর খুব কাছে। কলকাতার পার্কস্ট্রিটের ভারতীয় জাদুঘর— ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম-এর সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না। ইলাহাবাদের সেই মিউজিয়াম বা জাদুঘরে শুধুমাত্র পাথরের মূর্তি, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বড়ো— আসল মূর্তির রেপ্লিকাও থাকতে পারে সেই মিউজিয়ামে। ভারতীয় জাদুঘর— কলকাতার পার্কস্ট্রিটের ভারতীয় জাদুঘরকে আমরা বাল্যকালে— কিশোরবেলায় ‘মরা চিড়িয়াখানা’ বা ‘মড়াদের চিড়িয়াখানা’ বলতেম। কেন যে বলতাম, কে জানে। অথচ দিনের পর দিন বলে গেছি। ‘আলিপুরের চিড়িয়াখানা’। ‘পার্কস্ট্রিটের মড়া চিড়িয়াখানা’। আসলে হয়তো এত এত ফসিল— জীবাশ্ম, মমি, জীবজন্তু, মানুষের কঙ্কাল, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে, তার জন্যই হয়তো। থাক, ওসব কথা। ইলাহাবাদে ‘মধুশালা’-র কবি হরিবংশ রাই বচ্চন, তেজি বচ্চন, অমিতাভ বচ্চন, অজিতাভ বচ্চনদের আদি বাড়ি। অমিতাভ বচ্চন যে স্কুলে পড়তেন, সেটি ইলাহাবাদের খুব নাম করা স্কুল। তার বাড়ির রঙ লাল। সেই কুল বাইরে থেকে নয়, ভেতরে ঢুকে দেখেছি। অমিতাভ বচ্চনের বিদ্যালয় বলে নয়। ভালো বিদ্যালয় বলে, তাই দেখা। ইলাহাবাদের সনাতন ধর্ম— হিন্দু ধর্ম ছাড়াও ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্ম, শিখ ধর্মের বেশ কিছু মানুষ আছেন। আছেন শিখ এবং মোনা পাঞ্জাবি— হিন্দু পাঞ্জাবিরা। তিরভুবন মিশ্রায় ‘মোনিতা স্টোর্স’ বা ‘মোনিকা স্টোর্স’-এর কথা আগেই বলেছি। ‘মোনিকা স্টোর্স’-ই হবে। ভিরভুবন বা ত্রিভুবন মিশ্র— মিশ্রার ঠাকুর্দা— দাদা ইলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেস, পরে ইন্দিরা কংগ্রেসের ‘বড়ো হস্তি’— নেতা। দাদ্দার কাছে সারাদিন সাধারণ মানুষজনের ভিড়, সমস্যা নিয়ে। মেনা সাকসেনার ভাইয়ের— দাদার বউ— ভৌজি জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলে, আসলে নবজীবন গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পর ল্যাসেন্টা— ফুল পড়বার সময়ই বিপত্তি ঘটল। মারা গেল বান্টি, রোজিদের মা। বান্টি ছেলে, রোজি মেয়ে। রোজি তার মা যেমন কাটা কাটা মুখ, একহারা, রোগা রোগা, লম্বা চেহারা। এখনও চোখে ভাসে, সেই শকল। পুরানা কাটরার লালজি পণ্ডিত। কলাপে আতপ চালসহ কুমকুম আর হলুদের টিপ দিয়ে লোকজনের ভাগ্য গোনা-গাঁথা করে। লালজি খাটো ধুতি, সরু লাল পাড়। সস্তা, খাপি, মোটা ধুতির ওপর ছিটের শার্ট। শীতে তার ওপর কালো রঙের গরম কোট। এই গরম কোট তাকেও রেণুমাসির বড়ো ছেলে মঙ্কু— মঙ্কুদা— খোকনদা বা রঞ্জিত কুমার ভট্টাচার্য দিয়েছে। রেলওয়ের কোট। লালজিকে বেশিরভাগ লোকাল লোকজন ‘লালজিউনা’ বলেন সম্বোধন করে। লালজির মাথার চুল অতি অল্প বয়সেই পেকে গেছে। মামু— কালুমামা— খগেশচন্দ্র রায় আর রঞ্জিত কুমার ভট্টাচার্য— দু-জনেই গণ্ডিত— জনেউ— পৈতেধারী বামহন— বামুন— লালজির বন্ধু। লালজির সাইকেল আছে একটা আধভাঙা। সেই সাইকিল বা সাইকেল ঠেলেই সে প্রায় সারা ইলাহাবাদ করে বেড়ায়। লালজি নগ্নপদ— পায়ে জুতো, চপ্পল কিছুই নেই। ইলাহাবাদের প্রবল শীতে লালজি— লালজিউনার পায়ের গোড়ালি হাঁ হয়ে ফেটে যায়। সেখানে প্রয়াগরাজের ধুলো। লালজির বউ ফর্সা, কেমন যেন কলধরা কাঁসার রঙ। খুব মোটা। ভুঁড়ি আছে। তার তিনটে সন্তান— পুত্র। বড়ো কবুতর, তারপর পাপ্পু, তারপর গাপ্পু। গাপ্পুর পেটে যথেষ্ট ভুঁড়ি, বয়সের তুলনায়। লালজিউনার বউয়ের অ্যানিমিয়া— রক্তাল্পতা— রক্তশূন্যতা, ফ্যাকাশে। তার হাতে হিন্দু সাধুনার চিহ্ন লাল-লাল সুতোর দড়ি। চুড়ি নেই কোনো, না সোনার, না কাচের অথবা রুপোর। কবুতর লালজির বড়ো পুত্র। কবুতরকে ‘কবুতরোয়া’ বলে ইলাহাবাদি ঢঙে অনেকেই ডেকে থাকেন, এই মহল্লায়। তারপর আরও, আরও দুই পুত্র— পাপ্পু আর গাপ্পু। পাপ্পু প্রায় সময়ই ল্যাঙ্গটো থাকে, জামা-প্যান্টের অভাব। ফলে তার পুরুষাঙ্গটি মাঝে মাঝেই অত্যাচারের শিকার হয়, অন্য জনেদের আঙুলের। কবুতর তার মা যেমন, তেমনই ফর্সা, তবে রক্তশূন্য নয়, কলধরা কাঁসার রঙের। লালজি ভবিষ্যৎবক্তা, কিন্তু তার নিজের ভবিষ্যৎ? একেবারে যাকে বলে হতদরিদ্র। লালজিউনা সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থক। লোহিয়াজি— রামমনোহর লোহিয়ার চ্যালা। মুখে অবশ্য অত কিছু বলে না লালজি। কিন্তু কখনও কখনও তার মুখ থেকে সময়ের আড়াল ভেঙে বেরিয়ে আসে কথা— কথারা। এই যে গল্লি— পুরানা কাটরার গলির ভেতর থাকেন ঠাকুরাইন চাচি। বিধবা। তাঁর সহজীবনের জন— ঠাকুর সাহাব আর্মিতে ছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী। তিনি রিটায়ারমেন্টের পর প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর ফৌজি পেনশন পান ঠাকুরাইন চাচি। অসামান্য সুন্দরী ছিলেন ঠাকুরাইন যৌবনবেলায়, তা এখনও তাঁকে দেখলে বোঝা যায়। চোখের তারায় নীল, খুব ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক। মাথায় ঘোমটা। রেণু মাসি— বড়োমাসির সঙ্গে গল্প করতে ৮৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরার বাড়িতে আসতেন ঠাকুরাইন চাচি, লালজিউনা, কবুতর, পাপ্পু, গাপ্পু, পাপ্পুদের গর্ভধারিনী। ঠাকুরাইন চাচির নাম জানা নেই। তাঁকে তাঁর সমবয়সিরা ‘ঠাকুরাইন’ আর ছোটোরা ঠাকুরাইন চাচি বলে সম্বোধন করে থাকে। আমার বড়োমাসি— রেণু ভট্টাচার্যের কাছে একাদশীর দিনে সিঙাড়ার— পানিফলের আটার হালুয়া খেতে আসেন ঠাকুরাইন। রেণুমাসির বলাই আছে। সেইসঙ্গে ঘি দিয়ে— শুধ্ দেশি ঘিতে ভাজা পনজেরি, ময়দা-চিনি-ঘি-সুজি দিয়ে শুকনো খোলায় নেড়ে নিয়ে সে এক খাবার। আর থাকে রামদানা। গুড় দিয়ে— আখি গুড় দিয়ে নেড়ে নিয়ে রামদানার পাক। সেও তো খাদ্যবিশেষ। ঘিরে— শুধ্ দেশি— দিশি ঘিউয়ে ভাজা মখানা— সেই মখানা বা মাখানা গাজরের— গাজরকে হালুয়াতে যায়। পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, ক্ষীর-পায়েসেও। পায়েসে মখানা যায়, সঙ্গে কাজু-কিশমিশ-মুনাক্কা। পনজেরি বা পঞ্জেরি ভারি সুন্দর খেতে, অন্তত আমার তো লাগত। বড়োমাসি— রেণুমাসি আর একটা আইটেম খুব চমৎকার বানাতেন। কড়ি-ভাত। তাঁর হাতের আমিষ-নিরামিষ— দুধরনের রান্নাই ছিল অসামান্য। মেসোমশাই— আশুতোষ ভট্টাচার্যের প্রয়াণের পর আমিষ আহারের তো কোনো প্রশ্নই ছিল না রেণুমাসির। কিন্তু ছেলেরা— বিশেষ করে মঙ্কুদা— মনকুদা— খোকনদা খাবে, তাই বাজার থেকে— কর্নেলগঞ্জ বাজার থেকে মাছ নিয়ে এসেছে, তো সেই মাছ— তা বাঁশপাতি চেলা মাছ হতে পারে, হতে পারে রেকদার— ধারিদার— গায়ে লম্বা লম্বা দাগঅলা ছোটো ট্যাঙ্গরা বা বুজুরি ট্যাংরা— সবটাই রেণুমাসি কেটে কুটে, রান্না করে দিতেন সকলের জন্য। তারপর বড়োসড়ো আঁশবঁটি ধুয়ে স্নান সেরে আসতেন ভালো করে। রেণুমাসির কড়ি-ভাত-এর কথায় আবার ফিরি। পেতলের কড়াইতে জল দিয়ে, সেইজল ভালো করে ফুটে উঠলে, তারপর বেসন— ভালো বেসন— ছোলার ডালের, তাকে মেখে, লেচি করে, লম্বা লম্বা করে আটার লেচি যেমন, বানিয়ে, ছড়ি দিয়ে ভালো করে চাক চাক কেটে, তারপর গরম জলে ফেলে দেওয়া— ফেলে দেওয়া না বলে ছেড়ে দেওয়া বলা হয়তো ঠিক হবে। তারপর সেই বেসনের টুকরোগুলি গরম জলে খানিকটা ফুটে উঠে সেদ্ধ হয়ে গেলে তখন সেই অতিরিক্ত জল একটা আলাদা পাত্রে রেখে তারপর ভাজা জিরে গুঁড়ো, নুন, ভাজা গরম মশলা, টক দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিয়ে, তার মধ্যে গরম জলে সেদ্ধ করা বেসনের টুকরোগুলো দিয়ে আবার আস্তে আস্তে দই-মিশ্রণে দিয়ে দেওয়া। ব্যস, এবার একটু ফুটে উঠলেই তারপর তাকে নামিয়ে নেওয়া। কড়ি-ভাত খেতে চমৎকার। ভাত দিয়ে, রুটিতে— রুটির সঙ্গে, শুধু সবেতেই অতি উপাদেয়। বর্ষায় ইলাহাবাদে তরকারি-সবজির খুব সংকট। তখন ভালো স্বাদের বানডা— বানডা কচু পাওয়া যায়। বানডাকে অনেকেই পুং অশ্বের লিঙ্গর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। বলেন, ঘোড়ে কা বানডা। বানডা খেতে সুস্বাদু। কিন্তু আর তরকারি? সবজি প্রায় নেই বাজারে। দু-একধরনের শাক, পাহাড়ি আলু, দেশি আলু, নেনুয়া— ঝিঙে, তরুই— ধুঁধুঁল— ব্যস। বাগেন— বেগুন, যাঁকে ভাঁটাও বলা হয়ে থাকে ইলাহাবাদে, পরোল— পটোল, সবই অপ্রতুল। সাতের দশকেও বাজারে গিয়ে জিনিস কেনাকাটার সময় খরিদ্দার আড়াইশো গ্রাম জিনিস কিনলে পাও ভর— এক পো— এক পোয়া চান। দোকানি জরাজু— দাঁড়িপাল্লায় মেপে জিনিস দেন। পাও ভর— তারপর আধা কিলো। এভাবেই চলে কেনাবেচা। ইলাহাবাদে আখি গুড়— এখো গুড়— আখি গুড় খুব চমৎকার। কিন্তু খেজুর পাটালি, তাল পাটালি পাওয়া যায় না। কারও যদি আত্মীয়-স্বজন থাকে পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় তা হলে সেখান থেকে আনানো হয় তালগুড়, খেজুর গুড়, খেজুর পাটালি, তালপাটালি। কোম্পানি বাগান— কোম্পানি বাগের ভেতর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ— আরএসএস-এর নিয়মিত কুচকাওয়াজ— গেরুয়া ধ্বজ— গেরুয়া ঝান্ডা টাঙিয়ে। ইলাহাবাদে ছয়ের দশকে, সাতের দশকে জাতীয় কংগ্রেস যেমন আছে, তেমনই আছে সোশ্যালিস্টরা— পিএসপি— প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি, এসএসপি— সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি, পাশাপাশি আছি অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ। সেই সঙ্গে আরএসএস— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। তো যা বলছিলাম, কোম্পানি বাগ— কোম্পানি বাগানের ভেতর খোলা ময়দানে আরএসএস-এর নিয়মিত কুচকাওয়াজ, শরীরচর্চা, লাঠিখেলা। অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর লোকজন মাথায় গেরুয়া ক্যাপ পরে বাঙালি মহল্লায় এসে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি— শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নাম করে বাঙালি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করত, ভোট চাইবার নাম করে। ভারতীয় কংগ্রেস তখন অনেকটাই অটুট। দিল্লি মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনে অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ ক্ষমতা দখল করে সেই ষাটের দশকেই। তখন তো গো-হত্যা বিরোধ আন্দোলন, আচার্য বিনোবাভাবেন ভূদান আন্দোলন— ভূদান যজ্ঞ, চম্বলের বেহোড়— অতিএরদ— অতিবিপজ্জনক ডাকু— ডাকাতদের অস্ত্র-সহ আত্মসমর্পণ করানো শুরু হল আর একটি পরে। সোশ্যালিস্ট— সমাজপন্থী জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন এই ডাকু— চম্বলের ‘বাগি’ বেহোড় বা বিহোড়বাসীর অটোমেটিক ওয়েপনসহ আত্মসমর্পণ— সারেন্ডার করানোর ব্যাপারে অন্যতম আয়োজক।
Powered by Froala Editor