ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা তার মহামহিম গলি, পাতলি গল্লি, পাশিয়ানা নিয়ে চমৎকার জেগে থাকে। কত কত বছরের স্মৃতি জমা আছে গল্লির প্রতিটি ইটে, পাথরে। ইলাহাবাদের এই গলি, গলির ভেতর তস্য গলি, তস্যগলির ভেতর আরও আরও তস্যগলি, এমন তো নয় মোটেই, বরং তার এই গলি বাসে একটা নিজস্ব চাল, চলন আছে। যা কোনোভাবেই কাশী, লখনৌ অথবা উত্তর কলকাতার গলিযাত্রার সঙ্গে কিছুতেই মেলে না। পাশিয়ানার ভেতর চাটের ব্যবসা চালাতেন সোমানতিয়া আর সুরাইয়া নামের দুই বোন। তাঁদের মুখশ্রীতে খানিকটা সৌন্দর্য-আভাস তো আছেই। সৌন্দর্য আভাস না বলে তাঁকে চটল বলাই ভালো, আলগা চটন। চাটের মধ্যে মকোড়া, দমালু, ফুলকি। মকোরা— টক মিষ্টি স্বাদ, মুখরোচক, দমালু— তাও যথেষ্ট মুখ রুচি কারক— অনেকটা শুকনো শুকনো আলু কাবলি যেন, আর ফুলকি হল গিয়ে ফুচকা। হিন্দি বলয়ে আর অন্য অন্য জায়গায়, মুম্বাইতেও ফুলকি না বলে ‘গোলগাপ্পা’ বলা হয় ফুচকাকে। বলা হয় পানিপুরি। আন্দামানে দেখেছি ফুচকার মশলায় আলু-চানা সেদ্ধ, কাঁচা লঙ্কাকুচির সঙ্গে অবলীলায় কুঁচনো পেঁয়াজ দিতে। দই-ফুচকা দেখেছি। দেখেছি, খেয়েওছি বহুবার। কিন্তু আন্দামান ছাড়া আর কোথাও ফুচকাতে পেঁয়াজ কুচি দিতে দেখিনি। আমরা বাল্যকালে ১৯৬০-৬১-তে দশ নয়া পয়সায় বারোটা ফুচকা খেয়েছি। মশলামাখা আলু, ছোলা বা মটর সেদ্ধ, শীতে ধনেপাতা কুচি, এখন তো বারো মাসই ধনেপাতা পাওয়া যায়, সেইসঙ্গে কাঁচালঙ্কার কুচি দেওয়া হয়, যেমন ফর্মুলা আর কি ‘ফুচকা’— ‘ফুচকে’— পানিপুরি— গোলগাপ্পা— যে নামেই ডাকি না কেন তাঁকে। সোমানতিয়া আর সুরাইয়া— দুই সগে বহেন— মায়ের পেটের বোন, তারাই চাট তৈরি করে, চাটের গাড়ি লাগায় পুরানা কাটরায়। পুরানা কাটরায় প্রচুর চাটভক্ত, চাট ভালোবাসা লোকজন— ইলাহাবাদি জিভে— ইলাহাবাদি উচ্চারণে ‘চাটোরি’। তো সেই দুই বোনের তৈরি চাট খুবই মশহুর— প্রসিদ্ধ। নামকরা। চার আনা, আট আনা— আটান্নি, পঞ্চাশ নয়া পয়সা, একটাকা— সবই চাটের মূল্য। আর দুটাকা, পাঁচটাকা হলে তো কোনো কথাই নেই। শালপাতার তৈরি সাবেক ডিজাইনের কোনা টাইপ পাত্রে চাট। একদম ভরে ভরে দিচ্ছে এককথায় যাকে বলে। চাট বিক্রির সময় দুই বোনের মুখেই হালকা হালকা পাউডার প্রলেপ— লালচে ফেস পাউডার, ঠোঁটে ওষ্ঠরঞ্জনী— লিপস্টিক। তারাই চাট বানায়, কাঠের তৈরি ঠেলা গাড়িতে লাদাই করে। তারপর ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে গ্রাহক— দরিদ্দারদের কাছাকাছি। তাদের দুজনেরই পরনে চমৎকার ডিজাইনদার কুর্তা, পায়জামা, সালোয়ার-কামিজ। দুজনেই— দুই বোনই একেবারেই লম্বা নয়। বরং তাদের খানিকটা খর্বই তো বলা চলে। কিন্তু মুখশ্রীতে আলগা মায়া, যে কথা আগেই বলেছি। মিশ্রা কোম্পানির মালিক মিশ্রাজির বড়ো কন্যা অঞ্জলি খানিকটা দুলে দুলে হাঁটে রাস্তা দিয়ে— যেন কোনো সাবেক ওয়ালক্লক বা গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পেন্ডুলাম। দোলে দোলে। দোলে। অঞ্জলির স্তন ও নিতম্ব বিভার কথা বলেছি আগেই। সেই কপোত হেন স্তনযুগলে পুরানা কাটরার গলির যে আলো, তা আলগা মনে হলেও যেন লেগে থাকে। বদরিপ্রসাদের মামা ছোটে— ছোটেলাল— ছোটেলাল প্রসাদ— দিব্যি কলাব— ক্লাব থেকে কুকিং— রান্না-বান্না সেরে ফেরে। ক্লাবের বাচাখুচা খাবার— গ্রাহকের পাতের নয়, কিন্তু বেঁচে গেছে, খানিকটা রান্না করা চিকেন, কয়েকটা হাতরুটি, অথবা কচুরি, নয়তো রুমালি রুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে। এইসব বাচাখুচা খাদ্য সামগ্রী— লেফটওভার ছোটেলাল প্রসাদ— যে আবার কখনও কখনও বেশি খেয়ে ফেলে একটু টিপসি হয়ে বলতে থাকে, ম্যায় ছোটে, ছোটে হুঁ, ছোটে লাল সিং— থোড়ি না ছোটেলাল পরসাদ— প্রসাদ— ছোটেলাল প্রসাদ হুঁ। ম্যায় ছোটে— ছোটে লাল— ছোটেলাল সিং— কলাব কা কুক— কুক হুঁ। খানা পাকাতা হুঁ ম্যায়। সারেক্কে সারে আদমিয়োঁ নে মেরা পাকায়া হুয়া খানা লেতে হ্যায়— জজসাহাব, পুলিশওয়ালা, ভকিল— উকিল সাহাব— সব। বামহন, ছত্রী, কায়স্থ— সব খানা লেতে হ্যায় মেরে হাত সে বানায়া। এই যে তার অহঙ্কার— ছোটেলাল চামারের অস্মিতা— তার রান্না করা খাবার সকলে খাচ্ছে— সব জাত, উঁচানিচা— সকলে তার হাতে তৈরি করা খাদ্য খায়। এই যে অহঙ্কার— অস্মিতা— এটাই দেখার ছিল তখন। মাল— মদ খেতে ছোটেলাল চামার বওয়ায়— বাজে কথা বলে— খিস্তি-খামারি— সব চলে— আচাপাচা কথা। সব। পুরানা কাটরার এই গল্লির পেছনদিকে থাকে ইন্দে সাকসেনা আর তার পরিবার। ইন্দের পুরোনাম ইন্দিবর— ইন্দিবর সাকসেনা। কে জানে বোম্বাইয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মশহুর গীতিকার ইন্দিবরের নামে তার এই নামকরণ হয়েছিল কিনা। এই গোটা ব্যাপারটা সবটাই আমার কল্পনা, ভাবনা-গভীরের তরঙ্গ। ইন্দিবর— ইন্দে সাকসেনার গালে ঘোড়ায় কামড়ে দেয়। আর তা নিয়ে জীবন সংশয়ে পড়ে গেছিল ইন্দে। এই মহল্লার সকলেই বলে থাকে ইন্দের পেটে পেটে যত খুরখুন্দি ভাবনা, খুরাফাতি পরিকল্পনা। ভিটভিটে শয়তান যাকে বলে, বেড়ুদা— দিলীপ ভট্টাচার্যর ‘লঙ্গোটিয়া ইয়ার’— ছোটোবেলার বন্ধু ইন্দে সাকসেনা তাই। ঘোড়ার পশ্চাদ্দেশে মিথিলেটেড স্পিরিট ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জি করে ছুড়ে দিয়ে ইন্দে বেশ খেপিয়েই দেয় পুরানা কাটরার গলিতে রাখা তাঙ্গা নয় ইক্কা— এক্কা গাড়ি ঘোড়াদের। তিরথের স্পিরিটের দোকান থেকে মেথিলেটেড স্পিরিট আর মিত্রা কোম্পানির কম্পাউন্ডারের থেকে হাতিয়ে নেওয়া কাঁচের সিরিঞ্জ, তা দিয়েই স্পিরিট ছোঁড়া ঘোড়ার মাগগে— গুহ্যদ্বারে— ঘোড়ার পোঁদে। ব্যস, ইক্কা— এক্কার ঘোড়া তো খেপে গিয়ে ইন্দের গালে বসাল কামড়। তারপর তো রক্তারক্তি কাণ্ড। মাংস খুবলে তুলে নিয়েছে ঘোড়া। তারপর দাওয়া— দারু— আংরেজি দাওয়া— সুঁইউঁই— ইঞ্জেকশন। সেলাই। এই দাগ ষাট— ছয়ের দশকে ইন্দের বাঁগালে ছোট তেঁতুলে বিছে হয়ে পড়ে আছে। মাথায় টাক, দাড়ি-গোঁফ কামানো নিপাট মুখ। সবসময় ফিটফাট ইন্দে সাকসেনা চাকরি করত ইলাহাবাদের এজি অফিসে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের পাকা চাকরি। মহিলাদের ব্যাপারে খুব আগ্রহ ইন্দের। যাকে বলা যেতে পারে উওমেনাইজার— নতুন নতুন মেয়ে পটানো তার চরিত্রের অন্যতম গুণ। বিবাহিত, কিন্তু পরনারীতে তুমুল আসক্ত এবং সেইসঙ্গে বেশ্যাসঙ্গত। বেশ্যাবাড়ি যাওয়া। আগেই বলেছি, অর্থাৎ লিখেছি— ইলাহাবাদে কায়স্থরা হলেন— খাড়ে, শ্রীবাস্তব, সাকসেনা। শুধু ইলাহাবাদ কেন, সমস্ত উত্তরপ্রদেশ জুড়েই আছেন এই পদবির কায়স্থরা। উত্তরপ্রদেশের বাইরে, বিহারেও। পুরানা কাটরার গলিতে চানকুর চায়ের দোকানের কথা আগেই বলেছি। চানকুর চায়ের দোকান ছিল অতি বিখ্যাত— মশহুর সেখানে শুধুমাত্র দুধ-চিনি দেওয়া একগজ— মাটির বড়ো উনোনে তিন বার ফুটে ওঠা ‘তিন ফুট— এক গজ চা’— এই তিন ফুট— বার বার ফোটানো চা খেতেই কিন্তু বহু লোকের ভিড় চানকুর চা দোকানে। ইন্দেবরের জ্ঞাতিভাই মেনা। মেনাটা— স্থানীয় বাঙালিরা এভাবেই বলে থাকেন, মেনা অসম্ভব পিয়ক্কড়। প্রচুর খায়— মদ খায়। ইউপিতে ঘুমক্কড় অর্থে যে ঘুরতে ভালোবাসে, পিয়ক্কড় অর্থে যে খুব খায়, মদ। দিনরাত খেয়েই থাকতেন— ঠররা— দেশি বা বিদেশি মদ। ‘আংরেজি’— ‘বিলাইতি’ রাম-হুইস্কি কম। ছয়ের দশকে ‘ভোদকা’ তেমন করে কোথায়? বিয়ার আছে। জিন আছে। কিন্তু ভোদকা— ভদকা বা ভডকা তেমন করে পাওয়া যায় না। ইলাহাবাদের সিভিল লাইন্স সবচেয়ে পপ এলাকা, অন্তত ছয় বা সাত দশক পর্যন্ত। এলেনগঞ্জ, কর্নেলগঞ্জ, টেগোর টাউন, পুরানাগঞ্জ— সর্বত্র বাঙালি মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের, মানে উচ্চবিত্তদের বোলবোলাও যাকে বলে। চওক হল বাজার। চওকে বা চকে সবধরনের জিনিসপত্র কেনাবেচা। ঘড়ি, সাইকেল, রেডিও, বাসন-কোসন— বর্তন-উর্তন— তামা, পেতল, কাঁসার, হাঁড়ি, কলসি, বাটলোই— বোখনো, ঘটি, বাটি। স্টিলের বর্তন— বাসনের দোকানও আছে। সঙ্গীত-সঙ্গতের বাজনা— হারমোনিয়াম, বাঁয়া, তবলা, তানপুরা, সারেঙ্গী, এসরাজ— সব, সবকিছু। এছাড়া তারের বাজনা— সেতার, সরোদ, বীণা, বেহালা। ছয়ের দশকে একটা বেহালার দাম দুশো টাকা। হ্যাঁ, দুশো, দুশো টাকা। সারেঙ্গ বা সারঙ্গের কথায় মনে পড়ে গেল ‘সারঙ্গা’ নামে একটি হিন্দি সিনেমার কথা। তাতে মুকেশজির একটি অসামান্য গান আছে— ‘সারঙ্গা তেরি ইয়াদ মে…’। চওক বড়ো মজার জায়গা কত কত কত দোকান সেখানে। গল্লেকা দুকান— মুদির দোকান— চাল-গম-আটা-চিনি-কড়ুয়া তেল— সঁর্শো কা তেল— সর্ষের তেল, দাল— ডাল, কত রকমের ডাল— উরদ, অরহড়, মুঙ্গ, মুসুর। চানাই তো কত কত কত ধরনের। গেঁহু— গম, চাওল— চালেও ভিন্নতা— দাম ও কোয়ালিটির হেরফের। সেলা চাওল— চাল— সেদ্ধ চাল ব্রাহ্মণরা, এমনকি ইলাহাবাদবাসী বাঙালি ব্রাহ্মণরা খান না। তাঁরা গ্রহণ করেন আলো— আতপ চাল। সেলা চাল— সেদ্ধ চাল দিয়ে ভালো রান্না করেন মূলত তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষজন। আহির, গরেরিয়া, পাশি, চামার, কুনতি, ধানুক, খটিক, নিষাদ— শিকারিরা। বামুন, কায়েত, ক্ষত্রিয়রা— আতপ চাল— আতপ তণ্ডুল— আতপ চাওল খেয়ে থাকেন। ইলাহাবাদের গম— গেঁহু ছয়ের দশকে ভারি সুন্দর, স্বাদু আটা আর স্বাদ্বিষ্ট রুটি— ফুলকা রুটি হয় তার থেকে। মখানা, কিশমিশ, লাড়ু, জায়ফল, জৈবী— সব পাওয়া যায় ইলাহাবাদে। সঙ্গে গুলাব পানি। জেনারেল স্টোর বা জেনারেল স্টোর্স বইলতে ‘মনিহারি দোকান’। সেখানে সবধরনের স্টেশনারি গুডস পাওয়া যায়। মখানা ইলাহাবাদে গিয়েই প্রথম দেখি। স্বাদও পাই তার। মখানা ব্যবহার করা হু ক্ষীর-পায়েসে। পায়েসকে ‘ক্ষীর’ বলা হয়ে থাকে উত্তরপ্রদেশে। ইলাহাব্দে তো বটেই। করঞ্জিও প্রথম দেখি ইলাহাবাদেই। ইলাহাবাদে ডাব— সুন্দর, সবুজ কচি ডাব পাওয়া যেত না ছয়ের দশক, সাতের দশকেও। ভালো কোয়ালিটির পোস্তও মিলত না তখন। ফলে কলকাতায় যদি ইলাহাবাদ প্রবাসী বাঙালি বাঙালিনীরা আসতেন কোনো রিসতেদার— আত্মীয় বাড়ি বা বন্ধুবাড়ি, তাহলে তখন পোস্ত, বার্মিজ চটি, ভালো ভালো তাঁতের শাড়ি— যে শাড়িকে ধোতি বলেন ইলাহাবাদের মানুষ, ঝুনো নারকেল, হাঁসের ডিম নিয়ে যান। আগেও লিখেছি, ইলাহাবাদে গজধর-এর আইসক্রিম অতি বিখ্যাত আর চাঢঢার হালুয়া— গাজর কা হালুয়া, তাতে কাইজু— কাজু বাদাম, মখানা পড়ে। সেইসঙ্গে সঙ্গে দুধ কা লড্ডু— ক্ষীরের লড্ডু— কী যে চমৎকার স্বাদ, বলে শেষ করার নয়। ইলাহাবাদে এক সময় খুবই প্রভাবশালী ছিলেন বাঙালি— বাঙালিরা। তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতেন সংস্কৃতি, খানিকটা খানিকটা রাজনীতি, অর্থনীতি ও বৌদ্ধিক জগৎ। এলেনগঞ্জ, টেগোর টাউন— স্থানীয় জিভে গ্যাগোর টাউন, কর্নেল গঞ্জ, লুকারগঞ্জ— সব জায়গাতেই বাঙালিদের বড়ো বড়ো মকান— বাংলো— বাড়ি— দোতলা, তিনতলা বাড়ি। আলিশান সব কোঠা। বাঙালি তখন— ছয় আর সাতের দশকেও ইলাহাবাদের অনেক অনেক অনেককিছুর নিয়ন্ত্রক— নিয়ন্ত্রণকারী। সে এক গৌরবের অতীত— বাঙালির।
Powered by Froala Editor