এই দু-লাইনের শের কোথায় শুনেছিলাম? ইলাহাবাদে? নাকি বনারস অথবা লখনৌতে? মনে পড়ল, ইলাহাবাদেই। হ্যাঁ, ইলাহাবাদেই। এই শের বা শায়েরির সঙ্গে অবশ্য ছোটে নাউ আর তার খাটা পায়খানা কামানো— পরিষ্কার করা মেথরাইন— মেথরানি প্রেমিকার কোনো সম্পর্ক নেই। ইলাহাবাদে একটা কহাবত খুব চালু ছিল। ‘যো হাঁসি/ য়ো ফাঁসি’। অর্থাৎ, যদি কোনো মেয়ে— লড়কি তোমায় দেখে হাসল, তো ধরে নাও সে ফেঁসে গেল। এই কহাবত অবশ্য সর্বদা মান্য বা গ্রাহ্য নয় একেবারেই, কারণ বহু কন্যের হাসি— মুস্কুরাহাট বার বার সামনে ফুটে উঠলেও তাদের কোনো তল-কূলই পাওয়া যায়নি এজীবনে। না মনের, শরীরের তো নয়ই। ‘ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িয়াল বাজাওয়ে…’ এই শের অথবা শায়েরিটি বলত বদরিপ্রসাদ। যার মাথায় একমাথা পাকা চুল কোলগেট তেল দিয়ে জুবজুবে করে তারপর কাঙ্খি করা। কাঙ্খি করা অর্থে আঁচড়ানো। বদরিপ্রসাদ ঈষৎ ট্যারা। কালোর ওপর কাটা কাটা মুখশ্রী। দাড়ি-গোঁফ কামানো। নিপাট মুখ। ঈষৎ ট্যারা বলে ‘কানিয়ায়কে’ তাকায়। আর ট্যারা বলেই তাকে ‘ফুত্তু’ বলা হয়, ইলাহাবাদী কলোক্যালে। ‘ইলাহাবাদী বড়ি ফাকাদি’— ইলাহাবাদের লোকজন খুব ঝামেলা বাজ— মার-দাঙ্গার লোক, এমনও একটা কহাবত উড়ত পুরানা কাটরার গলিতে। ‘ফুত্তু’ বদরির মামা কলাবের— ক্লাবের কুক— রাঁধুনি আনোখিলাল। তার একটা ডাকনাম আছে ‘ছোটে’। ছোটে মামার এবং ছোটে নাউ, এইভাবেই চিহ্নিত করা হত ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার দুই ছোটেকে। আসলে তাঁরা দুজনেই ছোটেলাল। সংক্ষিপ্তকরণের পর, শুধু ছোটে। ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার ঘটক গিন্নি— মায়া-সোনা ঘটকের বাড়ির সামনে মাসুয়াদের বড়োসড়ো দুধেল মোষ মোটা লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। কাছেই পাশিয়ানা— পাশিদের থাকার বস্তি। সেখানে দুই বোন— সিতারা আর সুরতিয়া। তারা দুজনেই মদ বিক্রি করে গোপনে— ঠররা— বেআইনি চোলাই মদ। মাঝে মাঝেই পুলিশ আসে রেড-এ। থানা, থানেদার, সিপাহি— সবাই পেয়ে থাকে সাপ্তাহিক পয়সা। তবু আসতে হয়। আসে, শুয়োরের মাংস— ঝালঝাল— কড়া চাট। সিতারা আর সুরতিয়া— শুয়োর পোষে, ছাগল-পাঁঠা— বকরা-বকরি। সব পাশিরাই শুয়োর পোষে। সমস্ত আহির— গোয়ালারা পালে ভঁইয়স— মোষ, গায়— গরু। দুধ বিক্রিই তাদের প্রধান আয়ের উৎস। আহির পল্লীতে দারু, ঠররা— দিশিমদ, ইংলিশ-দিশি হুইস্কি, রাম যেমন চলে, তেমনই চলে ভাঙ। সিদ্ধি। ভাঙ ঘোঁটা হয় রোজ। আহিরপল্লীর মূলনারায়ণ— মূলে সর্বক্ষণ ভাঙ খেয়ে বুত্-নেশামগ্ন। ভাঙের গুঞ্জাইশ আছেই। ভাঙ ভেজানো, ভাঙ পেষা— শিল-নোড়ায়। তারপর দুধ, কালিমির্চ— গোলমরিচ বাটা— গুঁড়ো করে তা দিয়ে নেশার আয়োজন। মূল নারায়ণ— মূলের তিন ভাই। মূলে, শিউ, নাচাউ। মূলের দুটি কন্যা— বিমলি আর খিট্টো। বিমলি বড়ো, খিট্টো ছোটো। খিট্টোর কানে সারা বছর পুঁজ— তাই তার নাম কান সড়ি— কান পচা, এর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জুঁ— উকুন তো আছেই। বিমলি বড়ো— তারও মাথাভর্তি উকুন। বিমলিকে বউলি— পাগলি, বউখাল— বোকা কিন্তু মাথার ঠিক নেই, স্ক্রু আলগা— এসব বলা হত। লীনা, আমার রেণুমেসির ছোটো মেয়ে কুক্কু— যাকে রেণুমাসি বা বড়োমাসি ‘কোক্কা’ বলে ডাকতেন, সেই লীনার পাঠ্যপুস্তকে, বইতে ছিল— ‘বিমলা গাগরি লা’। বিমলা বা বিমলা পড়াশোনার ধার ধারে না। তার মুখে শুধু সিনেমা আর ড্রেসের— জামাকাপড়ের গপপো, রেণুমাসির— বড়োমাসির মেজোমেয়ে রঞ্জনা— মানুদির বন্ধু হাইমা, রইস, কনিজ, মিথিলেশ, সরোজ। মেয়েদের নাম কী করে সরোজ আর মিথিলেশ হয়, কে জানে? সরোজ, মিথিলেশ দুজনেই উত্তরপ্রদেশের কায়েব— কায়স্থ— শ্রীবাস্তব। শ্রীবাস্তব ছাড়া খারেও হয় কায়স্থ। হাইমা মদ্রদেশীয়। রইস, কনিজ— দুই বোন— তাঁরা ইউপি-র ইসলাম ধর্মাবলম্বী। হাইমার সহজীবনের মানুষ অবশ্য ইলাহাবাদের কায়স্থ। সিভিল লাইনসে ‘প্যালেস’, নাকি প্লাজা— প্লাজাই হবে, তাঁর বেশ ভালো রেস্তোরাঁ। সেখানে একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে মশালা ধোসা বা মশালা দোসার আপ্যায়ন জুটেছিল। কমপ্লিমেন্টারি, অবশ্যই। সঙ্গে কফি। ‘চৌরঙ্গী’ দেখতে গেছিলাম ইভনিং শোয়ে। বাবা, মা, আমি, বড়ো মাসি, মানুদি, বুড়িদি— মঞ্জুদি। এই হলেই দেখি ‘তালাশ’। সেই সিনেমাতে মান্নাদের কণ্ঠে অসামান্য গান— ‘তেরে নয়না তালাশ কর…’। এই ছবির মিউজিক ডিরেক্টার শচীনকত্তা— শচীন দেব বর্মণ। চৌরঙ্গী দেখি ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে। ‘তালাশ’-ও তাই। তো সে যাই হোক বদরিপ্রসাদ অনেকরকম শায়েরি বলত। তার একটি ‘আ কর মেরি কব্র পে/ কিসনে দিয়া জ্বালা দিয়া/ বিজলি তড়প কর গির পড়ি/ সারা কান জ্বলা দিয়া/ চ্যায়ন সে শোয়ে থে হম কব্র পে/ য়ঁহা ভি সতানে আ গ্যয়ে কিসনে পতা বতা দিয়া—’। বদরিপ্রসাদের মুখে আরও একটি শায়েরি শুনি— নিদ আয়ে তো খোয়াব আয়ে/ খোয়াব আয়ে তো তুম আয়ে/ লেকিন যব তুম আয়ে না নিদ আয়ে না খোয়াব আয়ে’। এরকম অ্যাকস্যাক শায়েরি শুনি বদরির মুখে প্রায়শই। তার মুখে একটা কথা— বাংলা বলার প্রয়াস— বদরি শুনে মনে করত এটা খুব চমৎকার বাংলা সে বলছে। কী তুমি বিপিন বিপিন ঘুমবে? এই বাক্যটির অর্থ হল, কী তুমি, কোথায় কোথায় এলোমেলো ঘুরছো? রেণুমাসিদের বৈঠক— বৈঠকখানা বা বোঠকখানার উল্টোদিকে বাচ্চা কোলে বদরিপ্রসাদের ‘ওয়াহিদা’, সিমেট বাঁধানো রোয়াকের ওপর মহা পিয়ক্কড়— চব্বিশোঁ ঘণ্টা পিয়ে— ‘খেয়ে’ থাকে, হাফ প্যান্ট, বুশ শার্ট পরা টেকো শ্বশুর— শ্বশুরজি— তার নাকের নিচে পাকানো পাকা গোঁফ। সেই বুঢ়োউ— বুড়ো মানুষ সবসময়ই ঝুম হে। ‘ওয়াহিদা’— বদরিপ্রসাদ যার ওপর মরে— ফিদা একেবারে, সেই একই বাড়িতে মুন্নি আর লাল্লি দুই বোন। মুন্নির মা-র আরও দুই ছেলে চুন্নু আর মুন্নু। মুন্নু বা ল্যাংড়া— মুন্নুর কথা আগে বলেছি। চুন্নুও খুব ‘ডামিশ’— পাজি। মুন্নির বর কট্টন। কট্টন ইলাহাবাদের নাম করা ‘দাদা’। সবসময় নিভাঁজ ফুল প্যান্ট, হাতা গোটানো ফুল শার্ট, বড়ো বড়ো চোখ কিন্তু দুচোখ তুলে খুব একটা কথা বলেন না। পায়ে শ্যু। তার এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ের কথা আগেই লিখেছি। এত রোগা, এত রোগা যে তাকে সবাই ‘সারস’ বলে আড়ালে। কট্টনের ‘ল্যামব্রেটা’। ‘ল্যামব্রেটা’ আর ‘ভেসপা’— এই দুই স্কুটারের খুব চল। দুই কোম্পানিই ইটালির। অনেক পরে ‘ভেসপা’— ভেসপা-বাজাজ হয়ে যায়। স্কুটার, মোটরবাইক— সবই ইলাহাবাদী বোলিতে ‘ফটফটিয়া’। তখন মোটরবাইক বলতে ‘রয়্যাল এনফিল্ড’, ‘বুলেট’ আর ‘রাজদূর’। ‘ল্যামব্রেটা’ স্কুটার ‘ভেসপা’-র থেকে সাইজে সামান্য বড়ো। কট্টন আর মুন্নির বড়ো কন্যা মহল্লার লোকমুখে যে ‘সারস’, সে তো ‘লুনা’-এই ব্র্যান্ডনামের অতি ফঙ্গবেনে দুচাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, এদিক ওদিক। প্রধানত পা চাপা ‘স্ল্যাকস’ পরে ‘সারস’। তাতে তার লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ দেখায় আরও লম্বা। সেই সময়টায়— সাতের দশকের গোড়ায় গোড়ায় ইলাহাবাদে মেয়েদের কুর্তা-চুরিদার, পায়জামার পাশাপাশি স্ল্যাকস, শারারা, গায়ারার, লুঙ্গির খুব চল। এছাড়া মেয়েদের ধোতি-শাড়ি তো আছেই। শাড়িকে শাড়ি ও ধোতি— দুইই বলা হয় ইলাহাবাদে। তখন ‘গুপ্তজ্ঞান’ নামে একটি যৌন শিক্ষামূলক সিনেমা রিলিজ করে। রেহানা সুলতানা— তাঁর নামই হয়ে গেল নঙ্ঘি লেড়কি, ‘চেতনা’ ও ‘দস্তক’ নামের দুটি সিনেমা করে, সেই সঙ্গে ‘পাকিজা’, ‘কৌশিশ’-ও রিলিজ করে ১৯৭১-এ ইলাহাবাদে। ‘পাকিজা’ কামাল আমরোহি সাহাবের ছবি। ছিলেন মীনাকুমারি, দাদামণি— অশোককুমার, রাজকুমার। ‘পাকিজা’-তে মনে আছে একটি, দুটি দৃশ্যে মীনাকুমারি রঙিন, বাহারি লুঙ্গি পরেছিলেন। রাজকুমারের সঙ্গে জ্যোৎস্নারাতে ডুয়েটে— মহম্মদ রফি সাহাব আর লতাজির কণ্ঠে ‘চল দিলদার চল চাঁদকে পার চল…’ এখনও মনে আছে। ‘পাকিজা’-তে আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ি, কাটা ঘুড়ির ইমেজারি, খুবই চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন পরিচালক কামাল আমরোহি সাহাব। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালকও তিনি। এই ফিল্মের মিউজিকে— সুরারোপে নওশাদ সাহাবের প্রভাব কেমন যেন কানে ভেসে ওঠে। মীনাকুমারি চমৎকার কবিতা লিখতেন, উর্দুতে। তার বঙ্গানুবাদও হয়েছে। তাঁর আত্মকথাও আছে একটি। ফুল অওর পাত্থর করার সময় ধর্মেন্দ্রজির সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় প্রেম হয়। একসঙ্গে বসবাসও শুরু করেন মীনাজি ও ধরমেন্দ্রর সাহাব। মীনাকুমারির অ-ফিল্মি নাম ছিল মেহজবিন। খুব অল্প বয়সে, চল্লিশ ছোঁয়ার আগেই— মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ। ১৯৩৩-এর ১ আগস্ট তাঁর জন্ম তখনকার বোম্বাইয়ের দাদারে। বাবার নাম আলি বক্স। ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ অসুখি, অ্যালকোহলিক মীনা বোম্বাইতেই প্রয়াত হন। যিনি সাত বছর বয়সে বেবি মীনা নামে ফিল্মে অভিনয় করতে এসেছিলেন মূলত তাঁর আব্বা আলি বক্সের ইচ্ছেয়। চিত্র পরিচালক কামাল আমরোহি সাহাবের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু সে বিবাহও খুব সুখ বা সোয়াস্তির হয়নি। দূরত্ব দূরত্বই ছিল তাঁদের— কামাল সাহাব আর মীনাজির জীবনের খেলার সাথী। ১৯৩৩-এ তাঁর জন্ম। বিবাহ কামাল আমরোহি সাহাবের সঙ্গে যৌথ জীবনের শুরু ১৯৫২ সালে। আর ‘ফুল অওর পাত্থর’-তে। ছয়ের দশক— ষাটের দশকের সিনেমা। ইলাহাবাদে ‘লছমি টকিজ’, ‘প্লাজা’, ‘পুষ্পরাজ’, ‘প্যালেস’, মানসরোবর’ ছাড়াও যতদূর মনে পড়ছে ‘শিশমহল’ নামে একটি সিনেমা হল ছিল। ‘প্যালেস’, ‘প্লাজা’, ‘পুষ্পরাজ’, ‘লছমি টকিজ’, ‘মানসরোবর’-এর তুলনায় ‘শিশমহল’ বেশ নবীন। কিন্তু বড়ো সুন্দর হল। পুরানা কাটরার কাছেই ‘লছমি টকিজ’-এ ‘উড়োন খাটোলা’ দেখি। নিম্মি ছিলেন, ছিলেন জীবন আর দিলীপসাহাব— দিলীপকুমার। অসামান্য সব গান ‘উড়োন খাটোলা’-য়— ও দূর কে মুসাফির হমকো ভি সাথ লে লে— হম রহে অকেলে…। সামান্য নাক চেপ্টি নিম্মি, মুখের আদলে একটু যেন হলিউড হলিউড। ‘ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িয়াল বাজাওয়ে…’ বদরিপ্রসাদের বলা এই শের দিয়ে শুরু করেছিলাম। পুরানা কাটরার আংরেজি দাবাখানা— মিশ্রা কোম্পানির মালিক মিশ্রাজির বড়ো মেয়ে অঞ্জলি— যাকে পাড়ার লওনডা, লাপাড়িরা— চ্যাংড়া-প্যাংড়ারা সবাই ‘ঘড়ি’ বলে, সেই মাথা নিচু করে, একেবারে রাস্তার দিকে চোখ রেখে দুই বিনুনি ঝোলানো ‘ঘড়ি’। যার লম্বা ঝুল ফ্রকে হাঁটু ঢাকে কি ঢাকে না, ‘ঘড়ি’ তো এমনিতেই লম্বার দিকে গড়ন, তারপর তার বিস্কুট কালারের ফুলছাপ ফ্রকের নিচে ব্রাহীন দোলায়মান জোড়া কবুতর মহল্লার লওনডা-লাপাড়িদের উত্তেজিত তো করেই। অঞ্জলিদের বাড়ির প্রায় লাগোয়া যে ছাত্রদের মেস, সেখানে এক ‘পণ্ডিত’— ব্রাহ্মণ সন্তান, সামান্য কুঁজো খাপটা গাল, হাড় হাড় চেহারা, সে তো অঞ্জলিকে দেখলেই গান ধরে— মতলব নিকল গ্যয়া তো পহেচনতে নেহি’। এই গানটি মহম্মদ রফি সাহাবের গাওয়া, খুবই হিট করেছিল, তো সেই স্টুডেন্ট— বিদ্যার্থী, তাকে দেখলেই মনে হয় হস্তমৈথুন— খ্যাঁচা মাস্টার, সে যখনই সুযোগ পেত, লাইন মারত অঞ্জলিকে। টেরিকটের ঘিয়ে রং ফুলহাতা শার্ট, কনুই পর্যন্ত গোটানো, ক্রিম রঙের ফুল প্যান্ট, ডান হাতে দু-আঙুলের ফাঁকে— তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট— ‘পানামা’ নয়তো ‘সিজার্স’— কাঁচি। এই দুই ব্র্যান্ডের সিগারেট তখন— সাতের দশকে ইলাজাবাদে খুব চলে। আমরা সেই পণ্ডিতের নাম দিয়েছিলাম ‘মতলব গুরু’। ইলাহাবাদে সম্বোধনে ‘কাশ মে’, ‘কাশ বে’, ‘আরে রাজা’, ‘আরে গুরু’ খুব চলে। ফাইলু গুরু বলতে বোঝায় যে কেবল ঘুরে ঘুরে কথা চালাচালি করা। ‘অনোখি’ বলে কোনো কন্যা বিষয়ে বলার অর্থ এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি— অদৃষ্টপূর্ব। খিচড়ি নাহান— পৌষ সংক্রান্তির দিন ইলাহাবাদে খুব ঘুড়ি ওড়ে— পতঙ্গবাজি হয়। সে-কথা তো আগেই লিখেছি। সরস্বতী পুজোর দিন আর সরস্বতী পুজোর আগে পরে— ঘন শীতে ইলাহাবাদের আকাশ ছেয়ে থাকত ঘুড়ি আর ঘুড়িতে। সেই সময়ই বুলবুলির লড়াই। শীতে মূলত আহির, পাশি, কাহার, চামাররা খেলতেন বুলবুলির লড়াই। ইংরেজির ‘ওয়াই’ চেহারার লোহার বা শক্ত-পোক্ত কাঠের তৈরি আড্ডায় বুলবুল। ঝুঁটি ফোলানো পুং-বুলবুলির পা বাঁধা কালো, রেশমী কার দিয়ে ‘আড্ডা’-র সঙ্গে। বুলবুলির লড়াই জমত চলত শীতকাল জুড়েই। সেই সঙ্গে সঙ্গে কবুতরবাজি— পায়রা ওড়াই। মিশ্রাজির দোতলা বাড়ির পেছনে সেই স্টুডেন্ট হোস্টেলের ছাদে ওড়াই পায়রার ভিড়। কারা কারা যেন পায়রা পুষত ওই বাড়ির ছাদে, এছাড়াও অন্যত্র। পায়রা শৌখিন— কপোতবাজি করা বহু মানুষ ছিলেন তখন ইলাহাবাদে। শংকরগড়ের জঙ্গল ছিল ইলাহাবাদের কাছাকাছি। সেখানে ছয়ের দশক, সাতের দশকে ‘শিকার খেলতে’ যেতেন অনেকে। হরিণ মারা হত, গুলবাঘ। ইলাহাবাদের পরের স্টেশন নৈনি। সেখানে— নৈনিতে কারছানা নামে গ্রামে মোর— ছাড়া ময়ূর দেখেছি। অনেক, অনেক ময়ূর, যেমন রাজস্থানে। ছয়ের দশকে, সাতের দশকেও কারছানাতে অনেক অনেক ময়ূর শস্যক্ষেতে। হরিণও। শিকারক্ষেত্রও ছিল সেসব। আরপিএফ-এ চাকরি করতেন শুক্লাজি। তাঁকে শুকুল বলে সম্বোধন করতেন পুরানা কাটরার কেউ কেউ। রেণুমাসি— বড়োমাসির বড়ো পুত্র খোকনদা— মঙ্কুদা— রঞ্জিত ভট্টাচার্যর বন্ধু ছিলেন আরপিএফ-এর শুক্লাজি। শুক্লাজির দুই স্ত্রী। দুই বউ নিয়েই তিনি এক বাড়িতে থাকেন। দুপক্ষেরই সন্তানাদি আছে। খোকনদা— মঙ্কুদাকে ‘মনকু’ বলেও সম্বোধন করতেন কেউ কেউ। তো সেই খোকনদার আর এক বন্ধু ছিলেন জিৎ সিং মুণ্ডির। জিৎ সিং মুণ্ডির ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন, আর্টিলারি। তাঁর মুখ থেকে শুনেছিলাম এক গ্রাম আর্মির লোকের নিহত হওয়ার গল্প, মানে এক গ্রাম থেকে যত জন ভারতীয় ফওজ গেছিলেন। সেটা ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
Powered by Froala Editor