ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার সেই বিখ্যাত গলির কথা আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি। সে তো অদ্ভুত এক জগৎ। মিশ্রা কোম্পানি— আংরেজি দানাখানা— অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকানের কথা লিখেছি আগে। লিখেছি তিরথের স্পিরিটের দোকানের কথা। মিশ্রা কোম্পানি নামে যে আংরেজি দানাখানা— দাওয়াখানা, তার মালিক মিশ্রাজির দুই মেয়ে, এক ছেলে। দুই মেয়ে বড়ো, লিখেছি তাদের কথাও। তবু আবার বলি, বড়ো মেয়েটির নাম অঞ্জলি। ছোটোটি সবিতা। অঞ্জলিকে পাড়ার লওন্ডারা ‘ঘড়ি’ বলে ডেকে থাকে পেছনে। অঞ্জলি সবসময় মাথা নিচু করে চলে, মানে রাস্তা হাঁটে। হাঁটু ঝুল রঙিন, ফুলছাপ ফ্রক। মাথায় দুটি বিনুনি। দীর্ঘ পালক সমেত টানা দুই চক্ষু। মিশ্রাজি বউ— অঞ্জলি আর সবিতাদের মা, তাঁর দু’চোখে অনবরত খাই-খাই আকাঙ্খা। খুব ফর্সা। দু’হাতে কাচের রঙিন চুড়ি, বেশ কয়েক গাছা করে। নিন্দুকজনে বলে মিশ্রাজি আসলে মেহেরুল-থেকেরা। নপুংসক। তাঁর ছোটো— সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান, ছেলেটি তাঁর তো নয়ই, মেয়ে দুটোও তাঁর নয়। মিশ্রাজি মোটার দিকে গড়ন, প্যান্ট, শার্ট। গোল, দাড়িওয়ালা ফর্সা মুখ। মাথার পাকা চুল, খুব যত্নে পাট পাট করে উলটে আঁচড়ানো। কঙ্খি করা— চিরুনি চালানো। মিশ্রাজি রোজ আসেন, তাঁর আংরেজি দানাখানায় বসেন, চেয়ারে। অঞ্জলি ও সবিতা— দুজনেই স্কুলে পড়ে। সবিতা ক্লাস ফাইভ, অঞ্জলি ক্লাস এইট। সবিতা ইংলিশ মিডিয়াম লেডি ওয়ার্নামেকার স্কুল— মিস চরণ, মিস বেলি যার টিচার। একথাও তো আগে লিখেছি আর ঘড়ি বা অঞ্জলি হিন্দি মিডিয়াম স্কুলে। এই গলির মধ্যেই বদরিপ্রসাদ আর তাঁর নানা— দাদু। ইলাহাবাদের কোনো এক নামকরা ক্লাবে বদরিপ্রসাদের নানাজি সার্ভ করেন। খাবার ও মদ। বড়োদিন থেকে আংরেজি নিউ ইয়ার— এই সময়টা তাঁর খুব ব্যবসা, টিপসে টিপস। এক্সট্রা টাকা। এই গলিতেই আর একটি পরিবার— তাঁরাও চামার সম্প্রদায়ের। তাঁদের পুরুষ মানুষটি রাঁধিয়ে— ক্লাবে। নাম করা ক্লাবের— স্থানীয় উচ্চারণে ‘কলাব’। সেখানে কুক। ভালো মাইনে। উত্তম খাবার রোজই। সঞ্জয় গান্ধীর প্রতাপে— অনুশাসনে, ঠেলায় তিনি নাসবন্দি বা নসবন্দি করিয়েছেন। অতি সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। সেই কুক মহোদয়ের তিন কন্যা, এক পুত্র। বড়োটি বোবা— তাকে সবাই নাম ‘গুঙ্গি’ বলে। ‘গুঙ্গা’ হচ্ছে বোবার হিন্দি— পুংলিঙ্গ। গুঙ্গি— বোবা শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। কন্যাদের নাম যথাক্রমে লতা, আশা ও ঊষা। ‘গুঙ্গি’ বড়ো, লতা কথা বলতে পারে, আধফোটা স্বরে, কিন্তু মহল্লার লোকজন সবাই ‘গুঙ্গি’ বলে। আশা— মেজো, কথা বলতে পারে স্পষ্ট। আবার ঊষা ও তার পরের ভাই বোবা। বদরিপ্রসাদের মামা হন সম্পর্কে এই লতা-আশা-ঊষাদের বাবা। কালো, মোটা-শোটা, কথা কম বলেন। তাঁর নাম আনোখিলাল। ইলাহাবাদে আহিরপল্লি, পায়িয়ানা পল্লি— পাশিদের নিবাস, কাহারপল্লি, সর্বত্র মেয়েদের মাথাতেই জুঁ— জুঁহা, উকুন— উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদ, বারাণসীতে উকুনকে জুঁ বা জুঁহা বব্লে। বিহারে কোথাও কোথাও উকুনদের নাম ‘চিল’। আবার অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগের মানুষেরা উকুনকে বয়স অনুযায়ী— তার আকার-সাইজ ধরে ধরে নামের বিভাজন করেন। যেমন, বয়স্ক উকুনের নাম বুইড়া, তারপর ছানাপোনারা পুইজাসি। তাঁরা মাইজালি বলেন কাঠপিঁপড়েকে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন পিঁপড়েকে বলেন পিমড়ে, ডেঁয়ো ইত্যাদি প্রভৃতি। তো সে যাই হোক, ইলাহাবাদে আহির, কাহার, চামার, পাশি— প্রায় সবার মাথাতেই জুঁ— জুঁহা— উকুন। পাশিয়ানার ওয়াদিয়া আর তাঁর বোন শুয়োর পোষেন। পাশিরা শুয়োর পালন করেন। শূকরের চর্বির তেল ব্যথাবেদনা নাশক। মারামারিতে লাঠির ব্যবহার ষাটের দশকে ইলাহাবাদে অবশ্যম্ভাবী ছিল। ছুরা— ছোরা, পাঁচাসা, ফেঁউসা, পিস্তল— দনাদ্দন পিস্তল চলে, গুলি ছোটে, লাশ পড়ে। দেশি কান্ট্রি মেড কট্টা বা তামানচা— আংরেজি দাওয়া, আংরেজি ডকডর, আংরেজি পিস্তল ডি-অটোমেটিক, ফরেন মেড, ইন্ডিয়া মেড। এসবেরই ব্যবহার খুব ইলাহাবাদে, ‘দাদা’-দের হাতে। সেখানে ইলাহাবাদে বঙ্গালি— বাঙালি ভদ্রলোকও দাদা, রংবাজও ‘দাদা’। তো সেই লাঠিবাজি, সেখানে মোটা পোক্ত বাঁশের লাঠির আঘাতে ফেটেফুটে যাওয়া শরীর রিপেয়ার করতে শুয়োরের চর্বির কোনো জুড়ি নেই। আর সেই শুয়োরের চর্বি পাওয়া যায় পাশিয়ানায়, কারণ পাশিরাই শুয়োর পোষেন। ইলাহাবাদে কথা-ছিকুলিতে আছে— ‘আহির ড্যাপোর/ ভুজাওয়ে মাঠা—‘ এই কথাটুকু যে অর্থ বহন করে, তা মোটেই সদর্থ নয়। বাংলায় বলা হয়, শেয়ালের আশি বছরেও বুদ্ধি হয় না। এই কহাবতটিও প্রায় সমার্থক। আরও একটি কথা প্রচলিত আছে ইলাহাবাদ-বেনারসে— ‘আহির গাড়েরিয়া পাশি/ তিনোঁ সত্যনাশী’। এইসব কহাবত— কথা-বার্তা— সবই তথাকথিত এলিটজনের। তাঁরাই নির্মাণ করেন এইসব কথা। ইলাহাবাদে ষাট-সত্তরের দশকে বোমার— হাত বোমার তেমন ব্যবহার নেই। নকাশকোনা বলে একটি জায়গা সেখানে মূলত বসবাস করেন ইসলামধর্মের মানুষ, তাঁদের কেউ কেউ বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এমন কথা শুনেছি। ১৯৭০-৭১-৭২-এ ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়— ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির দেওয়াল লিখন চোখে পড়ে নকশালপন্থীদের— ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’। দেবনাগরী হরফে লেখা সেইসব স্লোগান— পুরানা কাটরা লাগোয়া, এককথায় পুরানা কাটরার মধ্যেই ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে দেওয়াল। এছাড়াও ইংরেজি হরফে— ‘লং লিভ রেভেলিউশন’। আবার দেবনাগরী হরফে ‘চিন কা চেয়ার ম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’, ‘চিনের পথ আমাদের পথ’-এর হিন্দি। অথবা ‘বিশ্বক্রান্তি কা লাল দুরগ— লাল চিন অমর রহে…’। বিশ্ববিপ্লবের লাল দুর্গ লাল চিন চীরজীবী থাক। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে নকশালবাড়ির রাজনীতির সমর্থনে দেওয়াল লিখন হওয়ার পর ইলাহাবাদে পুলিশ এবং ইনটেইজেন্স অতি সতর্ক হয়ে যায়। কিছু কিছু ধরপাকড় ইত্যাদি হয়। এখানে এই সময়টাতেই নকশালি-বোমাও চলে আসে, হাত বোমা। ইলাহাবাদে পুরানা কাটরা, নয়া কাটরা, কর্নেলগঞ্জ, এলেনগঞ্জ, জর্জটাউন, টেগোর টাউন, মুঠঠিগঞ্জ, দারাগঞ্জ, সবোতিয়াবাগ, অলোপিবাগ, তুলারামবাগ, সিভিল লাইনস চওক, সুলেমরায়, এসব অঞ্চলে সেভাবে নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রভাব পড়েছে বলে শোনা যায়নি। ‘আনন্দভবন’— মোতিলাল নেহরু, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু, স্বরূপরানি নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীদের বাড়ি, অলোপি দেবীর মন্দির, হাথিপার্ক, মিউজিয়াম, প্রয়াগ সঙ্গীত সম্মিলনী— কোথাও নকশালবাড়ির রাজনীতির ধারার দেওয়াল লিখন নেই। বরং আনন্দমার্গের রাজনৈতিক সংগঠন প্রাউটিস্ট ব্লক-এর রাজনৈতিক স্লোগান লেখা আছে দেওয়ালে দেওয়ালে ইংরেজি হরফে— ‘ক্যাপিটালিজম মেকস দ্য ম্যান বেগার। অ্যান্ড কমিউনিজম মেকস দ্য বেগার লিস্ট’। অর্থাৎ, ক্যাপিটালিজম— ধনতন্ত্র মানুষকে ভিখারি তৈরি করে। আর সেই ভিখিরিদের পশুতে পরিণত করে কমিউনিজম। সেই সঙ্গে সঙ্গে ‘কির্লোস্কার পাম্প’, ‘জিপ শেরোয়ানি’-র ‘জিপ’ টর্চ-এর বিজ্ঞাপন। পাশাপাশি ‘সুফলা’ ইউরিয়া সার— দেওয়াল জুড়ে জুড়ে। সেই সঙ্গে সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনার লাল ত্রিকোণ চিহ্ন সমন্বিত— ‘হাম দো হামারা দো’— এই স্লোগান। অর্থাৎ, আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী— আমাদের দুটি সন্তান। রেডিও থেকে সম্প্রচারিত আকাশবাণী— কলকাতা ‘গ’— বিবিধ ভারতীর প্রচারতরঙ্গে— ‘সুখ কা রাজ হ্যায় ব্যস দো বাচ্চে/ সুখ কি নিশানি লাল ত্রিকোণ লাল ত্রিকোণ, লাল ত্রিকোণ…’। এই বিজ্ঞাপন জিঙ্গেল ভেসে আসছে। আর পাশাপাশি একইসঙ্গে বাংলায়— ‘তুমি নিরোধকে সাথি কর/ তুমি নিরোধকে সাথি কর…’। ‘নিরোধ’ নামের জন্ম নিরোধক থেকে। লিঙ্গ ক্যাপ— ওদিকে এসে গেছে বাজারে, সরকারি লিঙ্গ-টুপি প্রথমে একটা পাঁচ নয়া পয়সা, তিনটে পনেরো নয়া পয়সা। তারপর তিনটে পাঁচ নয়া পয়সা, অবশেষে সবটাই বিনামূল্যে— সরকারি বিলি বন্টনের মাধ্যমে। দেওয়ালে দেওয়ালে— আমি ইলাহাবাদের দেওয়ালে দেওয়ালে বলছি— সবুজ বিপ্লবের সাফল্যবাণী লেখা হচ্ছে। ইলাহাবাদের সিনেমা হলগুলি ‘প্যালেস’, ‘প্লাজা’, ‘পুষ্পরাজ’, ‘মান সরোবর’, ‘লছমি টকিজ’— এদের আশেপাশে কোনো দেওয়াল লিখন নেই। ইলাহাবাদে সিনেমা হলে কোনো সিটের সিটনম্বর নেই। যে যেখানে পারে গিয়ে বসে পড়ে, হুড়মুড় করে। সিভিল লাইনসে ‘প্যালেস’, ‘প্লাজা’ চওকে। নাকি উল্টোটাই হবে? ‘লছমি টকিজ’ পুরানা কাটরায়। ‘প্লাজা’ অথবা ‘প্যালেস’-এ ১৯৬৯ সালে ইভনিং শোয়ে ‘চৌরঙ্গী’। উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ, শুভেন্দু, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, অঞ্জনা ভৌমিক, সুপ্রিয়াদেবী। মান্না দে-র গলায় ‘বড়ো একা লাগে এই আঁধারে…’ উত্তমকুমারের লিপে। আর বিশ্বজিতের লিপে হেমন্তদার— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কাছে রবে… কাছে রবে… জানি কোনোদিন হবে না তো দূর…।’ ১৯৭১ সালে ‘এখানে পিঞ্জর’— উত্তমকুমার, অপর্ণা সেন…। তখনও মর্নিং শোয়ে রবিবার রবিবার ‘প্লাজা’-তে, নাকি ‘প্যালেস’-এ বাংলা সিনেমা। তারপর ধীরে ধীরে সব— বাংলা সিনেমা শো বন্ধ হয়ে গেল। আসলে ইলাহাবাদ— বড়ি স্টেশন— জংশন থেকে আসতে গেলে হয় চওকের দিক— চকের দিক থেকে আসতে হবে, নয়তো সিভিল লাইনস হয়ে। সিভিল লাইনস হচ্ছে ইলাহাবাদের অন্যতম প্রিদ্গাই এলাজা। যেখানে কফি হাউস, ‘গজধর’-এর আইসক্রিম, গাজর কে হালুয়া— শীতে অবশ্যই, দুধ কে লাড্ডু— খোয়া ক্ষীরে তৈরি লাড্ডু, বেসনকে লাড্ডু বা লড্ডু— মগধকে লাড্ডু বা লড্ডু— বোঁদের লাড্ডু বা লড্ডু— দরবেশ, মুঙ্গকে লাড্ডু— মুগ ডালের লাড্ডু। ইলাহাবাদে শুধ্ দেশি ঘি সে বনা হুয়া সমোসা— শিঙ্গারা, মিষ্টি আর শুধ্ বনস্পতি সে বনা হুয়া সমোসা— ডালডায় ভাজা সিঙ্গারা ও মিষ্টি পাওয়া যায়। শুধ্ দেশি ঘি সে বনা হুয়া জলেবি— জিলিপি, সমোসা, লড্ডু— সবই ‘বনস্পতিতে’— ডালডায় তৈরি নোনতা ও মিষ্টির তুলনায় ডাবল দামের। সাতের দশকের গোড়ায় গোড়ায় ‘বনস্পতি’-তে ভাজা সমোসা দশ নয়া পয়সা, শুধ্ দেশি ঘি সে বনা হুয়া সমোসা এক-চৌআন্নি— মানে একটা চার আনা। এতটাই ফারাক। বেসনকে লাড্ডু— মগধকে লাড্ডু নয়, মুঙ্গকে লাড্ডু পরসাদি হিসাবে খুব প্রিয় নাকি বজরঙ্গবলী— হনুমানজির। মঙ্গলবার মঙ্গলবার লাড্ডু বা লড্ডু চড়ানো— দেওয়া হয় হনুমানজিকে। তাঁর আলাদা আলাদা থান আছে প্রতি মহল্লায়, সেখানে তিনকোণা লাল পতাকা ওড়ে, তার গায়ে গন্ধমাদনবাহী আকৃতি— পবননন্দনের স্কেচ-ছবি। সেইসব থান বা বজরঙ্গবলীজির ছোটো আস্তানায়, যা মূলত অশ্বত্থ গাছের নিচে, যাকে পিপপল কি পেঁড় বলা হয়, সেখানে রাখা থাকে গোরক্ষপুরের ‘গীতা প্রেস’-এ ছাপা ‘হনুমান চালিশা’, যা থেকে শুধ্ মনে, শুধ্ বস্ত্রে যে কেউ পাঠ করতে পারেন। ইলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম— যমুনাজির কাছাকাছি, আকবর বাদশার তৈরি লাল রঙের কিলা— দুর্গ। তারপাশেই অক্ষয়বট। কুম্ভ, অর্ধকুম্ভ নহারের সময় যথেষ্ট ভিড় হয় এখানে। থিকথিকে ভিড়। সেনাবাহিনীর তৈরি পলটুন— ব্রিজ। আমি ইলাহাবাদ— প্রয়াগ, হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জ্বয়িনী— সবকটা কুম্ভ এবং অর্ধকুম্ভ করেছি। টানা এক এক মাস কাটিয়েছি কুম্ভমেলায়, অর্ধকুম্ভযোগে সাধু, যোগীদের তাঁবুতে। ইলাহাবাদে গৃহস্থজন মাস মাস ভর কল্পবাস করেন গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম থেকে অনেকটা দূর যমুনাজি— যমুনার বালি ছোঁয়া পাড়ে। নানারকম বিতর্কিত নিয়ামনিষ্ঠা, ‘সংযম’ ইত্যাদি পালন তথাকথিত শুদ্ধ আহার, মূলত নিরামিষ ভক্ষণ— সবমিলিয়ে কল্পবাসী জীবন। সেখানে ছোটো, বড়ো তাঁবু পড়ে, কল্পবাসীদের। আমি কোনো নিয়ম না মেনে কল্পবাস করেছি এইসব তাঁবুতে। মেলায় আলো আর আলো। সারা রাত। সমস্ত কুম্ভ— পূর্ণকুম্ভ আর অর্ধকুম্ভ জুড়ে মৌনি অমাবস্যার স্নান, পৌষ সংক্রান্তি— নাহানের স্নান, এই নহান বা নাহানকে ‘খিচড়ি’ নাহানও বলা হয়, কারণ সেদিন খিচুড়ি হয় ইলাহাবাদের হিন্দু গৃহস্থর ঘরে। ঘুড়ি ওড়ে ইলাহাবাদে, পৌষ সংক্রান্তির দিন। তারপর সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে, সরস্বতীপুজোর দিন আর তার আগেপরে। শ্রীপঞ্চমীর নাহান, সরস্বতী পুজোর দিন। এছাড়াও আছে শিবরাত্রির স্নান। এই সমস্ত তিথির নাহানই আমি সেরেছি, ইলাহাবাদের কুম্ভে গিয়ে। আসলে ইলাহাবাদ কুম্ভমেলায় গিয়ে তার যে বিস্তার ও বিস্তৃতি দেখেছি, তার কোনো তুলনা অন্য অন্য ভূমিতে বসা কুম্ভমেলার সঙ্গে হয় না। কিছুতেই নয় না। ইলাহাবাদে কুম্ভের পরই হরিদ্বারের কুম্ভমেলার ব্যপ্তি ও বিস্তার। নীলধারা, চণ্ডীপাহাড়, যেন নীলাভ আকাশের গায়ে জেগে থাকা কোনো জলরঙের কাজ। এদিকে কুম্ভমেলার খানিকটা অংশ হর কি গৌড়ির দিকে। নাগা সন্ন্যাসীদের শাহি স্নান, অগ্নি আবাহনী, নির্মোহি, জুনা-সহ অন্যান্য আখড়া বা আখাড়া— সেসবই তো হর কি গৌড়ির দিকে। সাজগোজ করা বড়োসড়ো হাতির পিঠে সুসজ্জিত রুপোর, চকচকে পেতলের হাওদা, তার ওপর বসা, দাঁড়ানো নাগা সাধু-সন্ন্যাসী। প্রায় সব নাগা সন্ন্যাসীদের আখড়া বা আখাড়া, সেখানে বন্দুক, রাইফেল, টোটা-গুলি, তলোয়ার, ফেঁউসা— টাঙি, গাঁড়াসা— অনেকটা যেন অর্ধচন্দ্র চেহারার বেশ বড়োসড়ো টাঙি, ভালো বল্লম— প্রাচীন ভল্ল শব্দটি থেকে ভালা, বর্শা, মোটাসোটা বড়োসড়ো মজবুত লাঠি থাকে। সেইসব অস্ত্র নিয়ে খেলা-প্রদর্শন, লাঠিবাজি, বন্দুকবাজি, গাঁড়াসাবাজি, ফেঁউসাবাজি— সবই হয়। এইসব অস্ত্রদের ডাবড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে আখড়া বা আখাড়ার এক কোণে রাখা হয়, পুরো কুম্ভকাল, এক মাস। সেই অস্ত্রদের নিয়মিত পুজো হয়। অস্ত্রপূজা। রীতিমতো তেল, সিঁদুর, মালা, চন্দন দিয়ে। হাতির পিঠে রাখা হাওদায় বসা, দাঁড়ানো, নাগা-সাধুরা। সেইসব নাগা সন্ন্যাসীরা কেউ বা অগ্নি, কেউ বা বাহনী, নিমোহি বা জুনা হয়তো অগ্নি। এঁরা সবাই সশস্ত্র। হরিদ্বার বা হরদোয়ারের তুলনায় উজ্জয়িনী আর নাসিকের কুম্ভমেলা আয়তনে নেহাৎই বালখিল্যদের ক্রীড়াভূমি যেন। কালিদাসের উজ্জয়িনীতে মহাকালের মন্দির আছে। কিন্তু শিপ্রা নদীতে তেমন জল কই? সেখানে তো জল সরবরাহ করতে হয় নিয়মিত শিপ্রা নদীকে বহমান রাখার জন্য, কোনো কোনো কুম্ভকালে। নাসিকেও প্রায় একই দশা। সেখানে— এইসব কুম্ভভূমির তুলনায় ইলাহাবাদ— কুম্ভ আড়ে-বহরে, আয়োজনে অনেক অনেক বড়ো, বিস্তৃত। তারপরই তো হরদোয়ার— হরিদ্বার বা হরি কি দুয়ার বা হর কি দুয়ার। ইলাহাবাদে দেখেছি কুম্ভমেলার শেষ দিকে যখন বাতাসে প্রায় ফাল্গুনী মরশুম, সেইসময় শ্রীপঞ্চমী বা বসন্তপঞ্চমী আগত প্রায়, তারপরই দোল আর শিবরাত্রি, সেইসব সময়ই কুম্ভ নহান বা কুম্ভ নাহান আছে, সবকটা তিথি স্নানই করেছি আমি। হরিদ্বারে চৈত্র-বৈশাখ কুম্ভ নাহান। ইলাহাবাদে পৌষ-মাঘ, ফাল্গুন জুড়ে নাহান বা নহান। সে এক উন্মাদনাই। বলতে গেলে আস্ত— সম্পূর্ন একটা নগর পত্তন, নব নগর। ইলাহাবাদে কুম্ভ-সময়েই তো অনুচর করেছি ঘোর শীতে। সেই শীতে— ঠকঠকানি তোলা, ঠকঠক করে কাঁপা— কাঁপতে থাকা শীতে ত্রিবেণী সঙ্গমে, গঙ্গাজিতে— গঙ্গায়, যমুনাজি— যমুনায় মৌনি অমাবস্যা সংক্রান্তির নহান। বসন্ত পঞ্চমী— শ্রীপঞ্চমী, বাতাসে বাতাসে তখন বসন্ত-বাস— সুবাস— আম্র-মুকুলের সুঘ্রাণ, শিবরাত্রি, দোল-হোলির নাহান— স্নান সেরেছি। এমন কি প্রায় শেষ রাতে ব্রাহ্ম মুহূর্তে স্নান। তখনও সূর্য উঠে আসেনি। আকাশে হিম, জলে হিম— কনকনে ঠাণ্ডা, বাতাসে— চারপাশে হিম। হিমমাখা চরাচর। কুম্ভমেলায় রুড়ি— নানারঙের সিঁদুর, আবিরও দেখেছি বিক্রি হতে। রং আর রং। কি উজ্জ্বল সব বর্ণ। লাল, হলুদ, বাসন্তী, সবুজ, নীল। সেইসঙ্গে পোড়া লাল, মারুন— মেরুন। দোল বা হোলির আগেই শ্রীপঞ্চমীতে আবির খেলা— রং আর রং। রঙের ঝাপটায় মন থেকে সমস্ত বিষাদ যেন চলে যায়। কুম্ভমেলায় স্থির থাকলে তো চলবে না। পুরানা কাটরা, ৮৫৩/৭৩২ নম্বরের মাটি-ইটের গাঁথনির দোতলা, সেই মাটির গাঁথনিতে হয়তো বা আছে চুনের মিশেল, তবু সেখানে দিমক— উলিপোকা— উইপোকার বসত। সেই উই বা দিমক মারার জন্য— ‘টারমাইট’ খতমে জন্য কোনো কড়া ধরনের বিষাক্ত কোনো লিকুইড। ‘টারমাইট’ মারার জন্য ‘টারমেন্স’ ছিল কী? নাকি অন্য কোনো কিছু তার নাম? ‘মিশ্রা কোম্পানি’, ‘তিরথের স্পিরিটের দুকান’— দোকান, পাশিয়ানা, পাশিয়ানাপল্লি, ‘ওয়াহিদা’, নেশায় চুড় হয়ে বসে থাকা তার ঝিম ধরা শ্বশুর, ঢোলা হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট, প্রবল গরমে, মাথা জোড়া টাক, সেই টাকও ঘেমে ওঠে প্রবল গরমের দিনে। তাঁর দিশি নেশার— অতি কড়া ঠররা, তার কামাই নেই। পরের অংশটিতে বাস ল্যাংড়া মুন্ন, মুন্নি— তার দিদি, বোন লাল্লি, মুন্নির মেয়ে— অতি রোগা ‘সারস’ নাম হয়েছে তার সেই জন্য, সে তো ‘লুনা’ নামের ফটফটিয়া চেপে সারা রাজ্য চড়ে বেড়ায়।
Powered by Froala Editor