পুনরায় ভূত চক্কর, ভূত ডম্বরু, শূন্য ভবিষ্যৎ

ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার ৮৫৩/৭৩২ বাড়ির সামনে যে গলি, তার বিবরণ তো দেওয়ার চেষ্টা করেছি মোটামুটিভাবে। বড়ো রাস্তা দিয়ে সোজা চলে এসে ডান দিকে ৮৫৩/৭৩২ ঠিকানার যে বাড়ি, তার গা ঘেঁষে মোড় নিলে বাঁদিকে ঘটকদের বাড়ি। সেখানে ঘটক গিন্নি— মায়া সোনা তাঁর নাম। আলাদা আলাদা করে মায়া নাকি সোনা কে বলবে? ঘটক কত্তা পাক্কা মাতাল ঠররা— সস্তার দিশি মদ পান করে টলতে টলতে ঢোকেন রোজ রাতে। প্রায় বেহেড দশা। তাঁকে লোকাল লোকজন ডাকে ‘পোড়া বুড়ো’ বলে। অতি সস্তার দিশি খেয়ে খেয়ে তাঁর সমস্ত গাল, কপাল— গোটা মুখমণ্ডলই কয়লা-কালো বা আলকাতরা-কালো। আলকাতরাকে তথাকথিত ভদ্দরলোকেদের অনেকেই কোল-তার বা কোল-টার বলতেন। কয়লা থেকেই তো উৎপত্তি আলকাতরার। ‘গঙ্গাজল’ মার্কা আলকাতরা ছিল অতি— অতি বিখ্যাত। সেইসঙ্গে ফিশ— মাছ মার্কা— পুকুর, দিঘি বা নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্যটুকু— জালে মাছেরা আটকে পড়ে খলবল খলবল করছে, লাফাচ্ছে, সেই জাল ঘিরে আছেন কয়েকজন। তার মধ্যে যাঁর মুখ স্পষ্ট, তাঁর মাথায়— সেই জাল ফেলে মৎস্য আটক করা জনের মাথায় পাগড়ি বাঁধা। ব্র্যান্ড ভ্যালু এই মার্কেট সর্বস্ব বাজারে সব-সময়ই কিছু না কিছু আছে। যেমন হলদের ওপর খেঁজুর গাছ মার্কা ‘ডালডা’ বা ‘বনস্পতি’— ডালডা-ঘি, বনস্পতি-ঘি সবচেয়ে বেশি পপুলার— প্রচলিত ছিল ষাট— ছয়ের দশক আর সত্তর— সাতের দশকে। এছাড়াও ‘বেলুন’ মার্কা ‘ডালডা’— বনস্পতি ছিল পাশাপাশি। আর ছিল ‘প্যারাসুট’ ব্র্যান্ড ডালডা বা বনস্পতি। ‘বনস্পতি’— বনস্পতি-ঘি, ‘ডালডা’— ডালডা-ঘি— সব ধীরে ধীড়ে উঠে গেল, মূলত মানুষের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে। কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারাইট— এইসব ক্ষতিকারক জিনিস বাড়ে ‘ডালডা’— বনস্পতি-তে। ডালডা বা বনস্পতির রং সাদা। তা দিয়ে লুচি-পরোটা, সিঙারা-নিমকি, কচুরি-রাধাবল্লভী, পুরি ভাজা অতিপ্রশস্ত ব্যাপারে একেবারে। এছাড়াও ফুলকপি-কড়াইশুঁটি, টোম্যাটো, আলুর ঝাল ঝাল ‘দম’ টাইপের তরকারি— হিন্দিবলয়ের ‘সবজি’-তে বনস্পতি বা ডালডার অমোঘ ব্যবহার আমাদের জিভে— রসনার রসে অন্যতর স্বাদ বহে আনে। হিন্দি বলয়ে— ইলাহাবাদ, বেনারস, লক্ষনৌতে রান্নায় ‘ডালডা’-র ব্যবহার দেদার— যা ইচ্ছে, যত ইচ্ছে ব্যবহার তরকারির স্বাদ বাড়িয়ে দিচ্ছে দেখেছি। কারণ এই ধরনের ডালডা-চর্চা, চর্চিত সবজি- তরকারি, যার ওপর যে বাড়ি, কাঁসি বা পাত্র— তাদের শরণে রাখে— ‘আশ্রয় দেয়’, সেই পাত্রের ওপর থকথকে ‘ডালডা’ বা ‘বনস্পতি’-র অবশিষ্টাংশ। আগুন— আগুনতর গরম গরম খেলে তার— সেই ডালডার ব্যঞ্জন অতীব স্বাদু। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা এখনও ডালডা ব্যবহার করেন তাঁদের ব্যঞ্জনাভাসে। উত্তরপ্রদেশে আটের দশকেও ছয়-সাতে তো বটেই, আটের দশকে ডালডা— বনস্পতির ব্যবহারের ব্যাপারে দেখেছি। ইলাহাবাদে সাতের দশকে— সত্তর দশকে খাসির মাংস, পাঁঠার মাংস, ভেড়ার মাংস রান্না করতে করতে ডালডার ব্যবহার— যথেষ্ট পরিমাণে দেওয়া চোখে পড়েছে। মাংসর জন্য আদা-রসুন বাটা, জিরে বাটা, পেঁয়াজ বাটা— পেঁয়াজ কুচির সঙ্গে ভালো করে কষার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। বাটা মশলা কড়াইতে কষার আগে গরম ডালডায় সামান্য চিনি দিয়ে নেড়েচেড়ে নিলেই একটা লালচে ভাবের উদয় হয়। এই লাল-লাল রঙের জন্যই চিনি দেওয়া, ডালডা বা বনস্পতির উনোন— আঁচের তাপে গলে গিয়ে তরল হয়ে ওঠার বুকে চিনি ছড়ানো, বেশি নয়, সামান্যই। সর্ষের তেলের বদলে ‘ডালডা’-য় রান্না করা তরকারি স্বাদু নয় আরও অনেকটাই বেশি— সুস্বাদু। ইদানিং ‘ডালডা’-র ব্যবহার নেই-ই প্রায়। লুচি-পুরি-রাধাবল্লভী-বিরিয়ানি-পোলাও-ফ্রায়েড রাইস— সবেতেই তো ‘একমেব দ্বিতীয়ম’। ‘ডালডা’ আর ‘ডালডা’ ছিল বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন বাড়িতে ঠাকুর মশাইদের যথেষ্ট ব্যবহারের জন্য। সেই ব্যবহারের দিকটাই প্রায় নেই। কেবল বিরিয়ানি— পোলাও ফ্রায়েড রাইস-এ ডালডা— বনস্পতি আছে। তার আছে ইসলামধর্মাবলম্বী জনেদের বাড়ি। বিশেষ করে নেমন্তন্ন বাড়ি— খানাবাড়িতে। ‘আকিকা’, ‘মুসলমানী’— চ্যাঁটকাটানি— ছুন্নত বা সুন্নত— শাদি— বিয়ে পড়ানো, কুলখানি— ‘কুলপড়া’— সবেতেই যে রান্নাবান্না— খানা পাকানো, তাতে ডালডা জেগে থাকে। ‘মাছ মার্কা’ শুধুই ‘মাছ’— সেই যে কোলতার— আলকাতরা দিয়ে শুরু করেছিলাম উপক্রমণিকা হিসাবে, তার কথায় আবার ফিরে আসি। হাওড়ার অতি বিখ্যাত, পুরনো বাজার কালিবাবুর বাজারের যথেষ্ট নাম। আয়তনেও তো তা বেশ বড়ো। কালিবাবুর বাজারে ‘কোলতার’— আলকাতরার বড়ো দোকান ছিল অনিলদের। অনিল আমার থেকে অনেকটাই বড়ো। তাকে ‘কাকা’ বা ‘জ্যেঠু’ বলে ডাকা নই তো কখনও, ‘দাদা’-ও বলিনি। অনিলকে সোজাসুজি নাম ধরে— ‘অনিল’। অনিলদের পদবি ছিল সাধুখাঁ। তো তাদের সেই কোলতারের— আলকাতরার বড়োবড়ো ব্যবসা হাওড়ার কালিবাবুর বাজারে, এখনও মনে পড়ে। ছয়ের দশক, সাত আর আটের দশকে কোলতার— আলকাতরার ব্যবহার যথেষ্ট। ‘কাঁচা বাড়ি’— বাঁশ, বেড়া, দরমা— সবেতেই টারমাইট— উহিপোকা— উলিপোকা আর ঘুণ নিরোধক আলকাতরা। আলকাতরা দিয়ে অনেক সময়ই কাঠের জানলা, দরজা, গ্রিল রং করান মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরা। একবার আলকাতরা বুলিয়ে নিয়ে পারলে জানলার লোহার ঝিক, গ্রিল— সব মরিচা— জং মুক্ত। তবে ব্ল্যাক জাপান বা আলকাতরার কালো একবার কোনো কিছুর ওপর বুলিয়ে দিয়েই হয়ে গেল। ব্যস, তাতে আর অন্য কোনো রং কিছুতেই ধরবে না। সাতের দশকে— সত্তর দশকে আলকাতরা আর ‘ব্ল্যাক জাপান’-এর কালো দিয়ে দেওয়াল লিখন করলে সেই দেওয়ালে, দেওয়ালে আঁকা অক্ষর বা কোনো প্রতীক-ছবিকে মোছে— তোলে কার সাধ্যি! ভালো করে চাচলেও তা ওঠে না। কথা হচ্ছিল ইলাহাবাদে পুরানা কাটরার গলিটি নিয়ে, সেখানে ঘটক পরিবার থেকে। ‘পোড়া বুড়ো’ আর মায়া-সোনার চার ছেলে, এক মেয়ে। অজয়, অজিত, সুঁটু, পাহলেওয়ান বা পালোয়ান। এক মেয়ে লাল্লি। অজয় ঘটক ইন্ডিয়ান নেভি। অজিত ঘটকও ইন্ডিয়ান নেভি। ভারতীয় নৌবাহিনী— নৌসেনার সঙ্গে দুই সহোদর। অজয় অফিসার। বাড়িতে যখন দুটিতে আসে তখন অ্যাপ্রিকট ব্র্যান্ডি, চিকেন কিউব আনে। অ্যাপ্রিকট ব্র্যান্ডি নিজে নেয়, মা-বাবা, ছোটো ভাইদের দেয়। একসঙ্গে গোল হয়ে বসে খানা-পিনা— খাওয়া-দাওয়া। তাসের জুয়ে নিজেদের ভেতর। রামি, ফ্ল্যাশ, কাটপাত্তি। পয়সার বাজি ধরে। পার কার্ড এক নয় পয়সা। সুঁটু, পালোয়ান ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের সকলের সাইকেল। লাল্লি বা লালিরও আলাদা সাইকেল। সুঁটু-পালোয়ান— দুভাইয়ের জন্য দুটো ‘সাইকিল’। ঘটক গিন্নি সোয়েটার বোনেন। উলের মোজা, টুপি। তখন ইলাহাবাদের ঘরে ঘরেই প্রায় উল— উল-বাঁটার নিনাই— বুনুনি। বোনা চলতেই থাকে অধিকাংশ মেয়েলি আড্ডার মধ্যেও। কথাও হয়, বোনাও হয়। কলকাতা বা কলকাতার গা-লাগোয়া মফস্বলে একই দৃশ্য— একই ছবি। উন— উল, পিওর উল— ভেড়ার লোম থেকে তৈরি। ‘ক্যাশমিলন’— সিন্থেটিক উল। তখনও মেশিনে সোয়েটার বোনার রেওয়াজ আসেনি বাজারে। তো সেই ছোটে নাউ— ইলাহাবাদের ছোটে আর তার ‘টাট্টি কামানো’— মেথরানি প্রেমিকার কথা বলার আগে ঘটক গিন্নির কথা সেরে নিই। মায়া-সোনা খুবই গল্প করতেন ফৈজাবাদ বা ফয়জাবাদের। সেখান থেকেই অযোধ্যা। সরযূনদী। বাবরি মসজিদ বা রামলালার তথাকথিত ‘জন্মস্থান’, ‘সীতামাইয়ার রসুইয়ৎ’, ‘রামগড়ি’— কোনো কিছুর কথাই শুনিনি। ঘটক গিন্নি যেটা বলতেন, তা হল তিনি কীভাবে কীভাবে সরযূ নদীর বুক থেকে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় স্নান সেরে উঠে চার পুত্রের পর একটি কন্যা সন্তান প্রার্থনা করেছিলেন, তার বিস্তৃত বিবরণ মাঝে মাঝেই পেশ করতেন। তাঁর সেই আকুল প্রার্থনা সরযূ-মাঈ নাকি শুনেছিলেন, আর তারপরই লাল্লি বা লালির জন্ম। লালি বা লাল্লি তার মায়ের হাতে বোনা সোয়েটার পরে, স্কার্ট ও বইয়ের ব্যাগ সহ স্কুলে যেত। আমি তার নাম বেঙি দিয়েছিলেন, কারণ আমার মনে হত লালির মুখটা ব্যাঙের কায়দারই। কেমন যেন ওলটানো ঠোঁট, ভালো নয়। সেই ‘বেঙি’ নামটা নিয়ে আমার দুই দিদি, বুড়ি— মঞ্জু আর মানু— রঞ্জনা এবং এক বোন কুক্কু— লীনা খুব মজা— মজাক-উজাক করত। এখনকার ভাষায় যাকে ‘খিল্লি ওড়ানো’ বলে। ঘটক-গিন্নি— মায়া-সোনা ঘটক, তাঁর এই সরযূ স্নানের কথা, কন্যাপ্রাপ্তির খবর কাহানি করে বলতেন। বাচ্চাদের, শুধু বাচ্চাদের কেন কমবয়েসি, মাঝবয়েসি সবাইকেই তিনি ‘গোপাল’, ‘লাল’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর বাড়িতে ‘যুগান্তর’ আসত নিয়মিত। সেইসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা-যুগান্তর বাড়ির নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ইলাহাবাদ এডিশন, যা আগে ইলাহাবাদ থেকেই প্রকাশিত হত, তাই নাম বদলে ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা’ হয়ে গেছে বহু বছর। যদিও ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা’-র সম্পাদক— এডিটর শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ। ইলাহাবাদে সিভিল লাইনসে পত্রিকাবাড়ি। নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা অফিস। ইলাহাবাদে চওক— চক, সিভিল লাইনস, পুরানা কাটরা, নয়া কাটরা, আলোপি বাগ, তুলারাম বাগ, নকাশকোনা, দারাগঞ্জ, মুঠঠিগঞ্জ, এলেনগঞ্জ, টেগোর টাউন, জর্জ টাউন, সবোতিয়া বাগ, সুলেমসরাই— অতি বিখ্যাত সব মহল্লা। সামান্য দূরে নৈনি, নৈনৈ জেল, করছনা। নৈনিতেই নৈনি জেল। আবার মির্জাপুরও আছে। সেখানেই বিন্ধ্যাচল। বিন্ধেশ্বরী মন্দির। ইলাহাবাদ থেকে কাশী বাসে বা ট্রেনে কয়েক ঘণ্টা মাত্র। ইলাহাবাদ থেকে মোঘলসরায় বা মুঘলসরাইও তাই। যদিও বেশ কয়েক মাস হল মুঘলসরায়ের নাম বদলে গিয়ে স্টেশনটির নতুন নাম হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে। দীনদয়াল উপাধ্যায় আর এসএস— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক ছিলেন। তাঁকে হত্যা করা হয়। তবে অতি রহস্যজনক তাঁর মৃত্যু। হাওড়ার দিক থেকে ট্রেনে রওনা দিলে নর্দার্ন রেলওয়ের হাতার ভেতর ঢুকে পড়ার আগে মুঘলসরায় বা মোঘলসরায় পূর্ব রেল— ইস্টার্ন রেলের সর্বশেষ স্টেশন। তারপরই তো নর্দার্ন রেলওয়ের এক্তিয়ার। যাক সে-সব কথা। ঘটক গিন্নি— মায়া-সোনা ঘটক বাংলা বই পড়তেন। ঘন ঘন জর্দা-পান। ফর্সা, বড়ো মুখ, কোঁচকানো কেশ। পৃথুলা। অসম্ভব বড়ো আর ভারী স্তন। ভারী পাছা। বড়ো বড়ো চোখ। কিন্তু সেই চোখে বাহার কম। বরং যা আছে, তা আগ্রাসী ‘খাই-খাই’। ফৈজাবাদ বা ফয়জাবাদে তিনি তাঁর সন্তানদের খুব কষ্টে বড়ো করেছেন। আর্থিক সংকট তীব্র ছিল। ফলে তাঁকে রোজগারের জন্য সেলাই-ফোঁড়াই, মেশিন চালানোর ব্যবস্থা রাখা— রাত জেগে সীলনকর্ম— সেলাইয়ের কাজ করা রোজগারের জন্য— নানাধরনের পরিশ্রম করতে হয়েছে। এদিকে পোড়া বুড়ো— ঘটককর্তা তো চাকরি করতেন এজি অফিসে। সেখানকার মাইনে— সরকারি আপিসের বেতন যেমন, এজি অফিসেরও তাই। মায়া-সোনা ঘটকের ভূত, প্রেত, পিশাচ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। তিনি খবর রাখতেন ‘বিখ্যাত বিখ্যাত’— ‘অতি বিখ্যাত’ সব তান্ত্রিক ও আওঘর— অঘোরিদের বিষয়ে। তারা নাকি হয়কে নয়, নয়কে হয় করতে পারে। ভূত-প্রেত-বেতাল-পিশাচ-দানো তাদের বশীভূত। এইসব পোষা অপশক্তি দিয়ে তারা বহু কাজ করায়, করিয়ে নেয়। ইলাহাবাদের কোম্পানিবাগ বা কম্পানিবাগের ভেতর একটি পিরসাহাব বা পিরবাবার মাজার। বাইরে আর একটি মাজার, সেও আর একটি পির সাহাবের— এঁরা দুজনেই খুব জাগ্রত— এমন কথা ভেসে বেড়ায় ইলাহাবাদে। ইচ্ছে করলে নাকি এই দুই কারনুমা দেখানো পিরেদের একজন নাকি গরমের রাতে হাওয়া খেতে বেরোয়। বাতাসে তখন বসন্ত দিনের আম্রমুকুলের গন্ধ। আকাশ জুড়ে ভরাচন্দ্রমা। এই দুই পিরের একজন আবার তাঁর পালতু— পোষা পিশাচটিকে নিয়ে বেরতেন। পিশাচের নিয়ন্ত্রণ সবটাই তাঁর মনে ও হাতে। কম্পানিবাগ— কোম্পানিবাগ বাগানের থেকে বেরিয়েই, গা লাগোয়াই বলা যেতে পারে, আলফ্রেড পার্ক। এই আলফ্রেড পার্কেই বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একটি প্রাচীন গাছের নিচে গুলিযুদ্ধে শহিদ হন চন্দ্রশেখর আজাদ। হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান আর্মির অন্যতম প্রধান তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব, আসফাকউল্লা খান, রামপ্রসাদ বিসমিল, সকলেই এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। অত্যাচারী পুলিশ অফিসার সন্ডার্সকেও চরম শাস্তি দিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। লালা লাজপত রায়কে হত্যা করানোর পিছনে সন্ডার্সের মদত ছিল। আলফ্রেড পার্কের নাম বদলে এখন আজাদ পার্ক। সেখানে বসেছে বীর বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের বড়ো স্ট্যাচু— মূর্তি, অনেক অনেক বছর হল। যে পিরবাবা অথবা পিরসাহাব তাঁর পোষা পিশাচটিকেসঙ্গে নিয়ে বেরোন, কেউ কেউ নাকি শুনতে পান ডম্বরু ধ্বনি— ডম্বরুর শব্দ। কেউ বা শোনেন শিঙার গর্জন। আবার কখনও কখনও সব চুপচাপ। কোম্পানি বাগানে ধোবি— ধোপাদের কাপড় কাচার একটা বড়োসড়ো ব্যবস্থা ছিল পাঁচ, ছয়, সাত, আটের দশকে। বাগ— বাগানের জল ধরার ইন্তেজাম— আয়োজন। পোক্ত বাঁশের সঙ্গে খাটানো দড়িতে ঝোলে ধোয়া কাচা কাপড়। পুরানা কাটরার লাখনোয়া অথবা লখনোয়া— লক্ষ্মণ নাম আসলে, লাখনোয়া ধোবি যেখানে কাপড় কাচে, শুকোয়, পাট করে, ময়লা কাপড় ধোয়ার জন্য sভাটি জালে, কাঠের জ্বালে বড়োসড়ো উনোন, তার ওপর পোড়া মাটির গামলায় সোডা সাবানের জলে ফুটে ওঠে ময়লা কাপড়, সেই জায়গাটা ঘিরেই প্রায় অনেক অনেক তালগাছ, ‘তাড়বান্না’ যাকে বলে। তো সেই লাখনোয়ার ধোয়া-কাচা কাপড়ে নাকি মাঝে মাঝে ছাপ পড়ে যায় পিশাচের পায়ের। কোম্পানির বাগানে শেয়াল আছে, আছে ভাম, বাঘডাসা, নানা ধরনের সবিষ আর নির্বিষ সাপ। রয়েছে বিচিত্র ধরনের সব পাখি। রঙিন, রঙদার, পাখির কণ্ঠে কণ্ঠে গান। তালগাছ থেকে ভাদ্র মাসে গাছপাকা তাল পড়ে মাটিতে— ধুপ। ধাপ। ময়ূরও আছে এই কোম্পানি বাগ বা কম্পানি বাগে। এরই মধ্যে পল্লবিত হতে থাকে পিশাচের কিস্যা। যে পিশাচ পিরসাহাবের পোষা। তাঁর কথাতেই ওঠে, বসে। এই দুই পিরসাহাব, যাঁরা শুয়ে আছেন সমাধিভূমির গভীর অন্ধকারে, তাঁরা দুজনেই প্রায় সিপাহী মিউটিনির সময়কার।

Powered by Froala Editor