আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় ‘কানহোলা’-র গপপো শোনাতেন। ‘কানহোলা’ অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগে সাধারণজনের মুখে ম্যখে বেঁচে থাকা এক প্রেত। ভয়াল খানিকটা, সেই সঙ্গে দিব্যি রসিকও। এমনিতেও তো ভূত-প্রেতের শেষ নেই এই বঙ্গভূমে, মানে ছিল না। যেমন একনেড়ে বা একনড়ে, যার একটাই ঠ্যাঙ— অন্য ঠ্যাঙ কাটা, ব্রহ্মদৈত্য বা বেম্মদত্যি— যা বামুন মরে হয়, এমন বিশ্বাস। মাথায় টিকি, গভলায় ন দণ্ডির যজ্ঞসূত্র— হিন্দিবলয়ের জনেউ বা জেনেউ, বাঙালির পৈতা বা পৈতে। তো সেই ব্রহ্মদৈত্যর বাস সাধারণভাবে বেলগাছে। একানড়ে এক পা— ঠ্যাঙ ঝুলিয়ে বসে থাকে তালগাছে। আবার মুসলমান মরলে মামদো— মামদোভূত। গলা কাটা প্রেত গন্নাকাটা, কবন্ধ সেই প্রেতের আর এক নাম স্কন্দকাটা বা শ্কন্দকাটা। মুণ্ডহীন, চক্ষুবিহীন সেই কবন্ধ প্রেত ঘন নিশীথে দু হাত দুপাশে দিয়ে, যেন বা বাতাস সাঁতরাতে সাঁতরাতে হেঁটে চলে সোজা, পাকা রাস্তা, কাঁচা রাস্তা, নয়তো মেঠোপথে দুহাত দিয়ে হাওয়া কাটতে কাটতে। তার সেই সর্বনাশা গতিপথের সামনে পড়লে একেবারে ফিনিশ— শেষ, এমন বিশ্বাস ছিল গ্রামদেশে। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র হেন তার চলন। হাতের নাগালে পেলেই বুকের মধ্যে নিয়ে একেবারে পিষে দেওয়া যাকে বলে। পুং ভূতের সঙ্গে স্ত্রী ভূত বা নারী ভূতও যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান তখন। যেমন শাঁকিনী বা শাঁখিনী, প্রেতিনী, নারকেলমুখী, শাঁকচুন্নি, পেত্নী, জলার পেত্নী। পুং ভূতের মধ্যে মেছোভূত, গেছোভূত। গো ভূত— গো ভূত অবশ্য মনুষ্য নয়। তেমনই শেয়ালভূত, কুকুর ভূত, সবই ছিল আলোচনায়। হয়তো বা ভুয়ো দর্শনেও। যাঁরা ভূত দেখেন বা দর্শন করেন, তাঁরা কিন্তু কোনোভাবেই এইসব ভূত দেখাদেখিকে ‘ভুয়ো দর্শন’ ভাবেন না। এবার মেয়েভূতেদের কথায় অল্পবিস্তর আসা যাক। যেমন নারকেলমুখী। ছাড়ানো নারকেল মালা হেন মুখ যার, সেই তো বা তারাই তো নারকেলমুখী। এছাড়াও অন্য অন্য যে ভূতিনীরা, তাদেরও কিন্তু অপদেবতার স্ত্রীলঙ্গি অপদেবী হিসাবে আলাদা পরিচয়। এসব নিয়ে বিস্তারে আলাদা একটি লেখা হতে পারে। তো সে যাই হোক, আমার বাবা তো বলে যাচ্ছেন, ‘কানহোলা’-র কথা। সেই ‘কানহোলা’ যদি একবার কাউকে পায়, মানে কবজা করতে পারে, তা হলে তো হয়েই গেল। একেবারে ‘শেষ’— ‘ফিনিশ’ যাকে বলে। তখন তো ‘কানাহোলার কবলে’। ‘জটায়ু’ সিরিজে নতুন গোয়েন্দা গল্প হতে পারত ‘কানাহোলার কবলে কানাই’। অথবা ‘কানাহোলার কবলে কালিধন’। আমার বাবা অমরনাথ রায় বলতেন, তাঁদের দেশের বাড়ি ঢাকার মানিকগঞ্জ সাবডিভিশনের পাটগ্রামে ‘কানাহোলা’-র উপদ্রব। বেশ নিষ্ঠুর তো বটেই ‘কানাহোলা’, তবে আবার চমৎকার রসিকজনও। ঘন, শুনশান দুপুরে, ঘোর রজনী, অমাবস্যা নিশীথে অথবা পূর্ণ চাঁদের মাথায়— পূর্ণিমা যাপনের নিশিকালে, সে যেন কোনো রসিকতার রসে টইটম্বুর কোনো এক জন। খোলা রাস্তায়, ফাঁকা মাঠে, বড়োসড় দিঘির পাড়ে, পুকুর ধারে, নদীর চড়ায় তার যত নাচনকোঁদন। দিঘির গভীরে মুখ ঠুসে দিয়ে ঘাট ভাঙিয়ে একদম পটল তোলায় কানাহোলায় পাওয়া পথিককে। বড়োসড়— আলিশান, মোটা গুঁড়ি আর কাণ্ডর তালগাছের গায়ে কানাহোলায় পাওয়া পথিককে টেনে এনে মুখ— মাথা ঠুকে দিয়ে একেবারে টাটকা পটল তোলানোর ব্যবস্থা করা। আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় তীব্র ঈশ্বর বিস্বাসী। কিন্তু ভূত, প্রেতাত্মা, জ্যোতিষ— এসবে নৈব নৈব চ। কিন্তু তিনি গল্প পরিবেশন করতেন খুব চমৎকার। বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, সাপ, জঙ্গল, আফ্রিকা, সুন্দরবন— সব যেন জ্যান্ত হয়ে উঠত তাঁর বর্ণনা শুনে। এত এত চমৎকার বলতেন সেইসব রোমাঞ্চকথা, অভিযান-কাহিনি, মনে হত তিনি সবকটা অভিযাত্রাতে অভিযাত্রী হয়ে থেকেছেন। থাকছেন। অথচ অমরনাথ রায় বেশি সাহিত্যপাঠ করেননি। মানে করতে পারেননি। সাহিত্যপড়ার সময় কোথায় তাঁর? রেলের চাকরি করতেন, নাইট ডিউটি— সপ্তাহে দু দিন। সেই সঙ্গে ডে ডিউটি, মর্নিং ডিউটি— দুদিন করে। এক দিন রেস্ট। এইভাবে সব দিনের হিসেব। তার সঙ্গে সঙ্গে এক কোটি কাজ আছে, সংসারের— বাজার করা, মা— নিজের সুন্দরী সহজীবনের মানুষটির সংসারের নানা কাজেকর্মে— হাতে হাতে সহায়তা করা। সেইসঙ্গে বাজার করা, সাপ্তাহিক রেশন কেনা ইত্যাদি প্রভৃতি। নিজের গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার, ফর্মাল, অন্য জামা-কাপড়— ছিটের ফুল শার্ট, ধুতি ইত্যাদি কাঁচা, তারপর অ্যারারুট জাল দিয়ে মাড় দেওয়া, রাঢ়ের তেল দিয়ে জামাকাপড়ে মাড় দেওয়া হত না তখনকার দিনে। ব্রাহ্মণবাড়িতে, আমি ষাট-সত্তর দশকের কথাই বলছি, যাঁদের ছয় বা সাতের দশক বলা হয়ে থাকে কখনও কখনও, তো সেই ছয় বা সাতের দশকই হোক আর ষাট বা সত্তর দশকই হোক, পাশ্চাত্য বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের কাপড়-জামা মাড় ও ইস্ত্রি-সহ ধোপার বাড়ি থেকে ধুয়ে এলে, তখন তো তাকে ফের ধুয়ে ফেলা। কারণ, ভাতের ফেন তো আইঠা— এঁটো, এঁটোকে সকড়ি বা সগড়ি বলে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পূর্ববঙ্গের জনেরা বলেন আইঠা। এঁটো থেকে ‘আইঠা’। ‘এঁটো করে দেওয়া’-র অর্থ আবার ভিন্নতর। কোনো নারীকে সঙ্গম করার পর আর তেমন করে পাত্তা না দিলে সেই ‘গৌরব’ (অগৌরবই আসলে) পুংতন্ত্র— এঁটো করে দিয়েছি, তোকে— যাহ্। এই যে আস্ফালন, তা তো পুরুষতন্ত্রেরই রীতি— রেওয়াজ। হিন্দি বলয়ে তেমন এই একই বাক্যবধকে বলা হয়ে থাকে— যা তো ছোড়, চল, উসকে জুধা কর দিয়া। জুধা মানে ‘এঁটো করা’, মুখ লাগানো। পশ্চিমবঙ্গে এই যে যৌনকম্মের পর কোনো মেয়েকে সরিয়ে দেওয়া, সেখানে বলা হয়ে থাকে যা পালা, ভাঁড় ফেল। যার হিন্দি বলয়ের ভার্সান— চাড় পিয়ো, কুলহড় ফেঁক। ‘কুলহড়’ মানে মাটির— মৃন্ময় নির্মিত পোড়া মাটির ভাঁড়। আবার হুলহাড়ি মানে কুঠার, কুড়ুল। মনে আছে ইলাহাবাদ যাওয়ার সময় ট্রেনে— বোম্বে মেলে কলকাতাইয়া ‘বঙ্গালি দাদা’ স্টেশনে টি-ভেন্ডার— চাঅলাকে বলছেন, এই চায়ওয়ালা চায় কুলহাড়ি দাও। ‘বঙ্গালি দাদা’-র হিন্দি শুনে চায়ওয়ালা তাঁর গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে মুচকি হাসছেন। তাঁর ‘মন কি বাত’ কী, তা আমরা কেউ কেউ পড়ে নিতে পারলাম অনায়াসে, অবলীলায়। সেই ট্রেন কামরাতেই শুনি দুকলি গানের লাইন, যা মনে আছে এখনও— ‘মন না রাঙ্গায়ে কি ভুল করেছো, কাপড় রাঙ্গায়ে যোগী’। যে কথায় ছিলাম, সেই কথাতেই আবার ফিরি। ফিরে আসি। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে ছয় ও সাতের দশকে— ষাট অথবা সত্তরের দশকে— রজকালয়— ধোপাবাড়ির মাড় দেওয়া, ইস্ত্রি করা কাপড়— জামা, ধুতি, শার্ট বাইরে ধুয়ে এনে তারপর ঘরে তোলা হত। একে ভাতের মাড়— এঁটো-সকড়ি— আইঠা— তার ওপর ধোপাবাড়ির উচ্ছিষ্ট। একে তো উলাইল্লা বুড়ি/ আর ওপর চাকের বাড়ি…’। এই যে কহাবত বা কাহাবত, ছিকুলিটি, সেও অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগ— পূর্ববঙ্গের— পুব বাংলার প্রচলিত ছিকুলি— ‘একে তো উলাইল্লা বুড়ি/ তার ওপর চাকের বাড়ি’। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার এই ছিকুলিটি আমায় ত্রিপুরায় হয়ে যাওয়া এনবিটি— ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের এক ওয়ার্কশপে শুনিয়েছিল শর্মিলা আব্রাহাম। শর্মিলা— শর্মিলা আব্রাহাম খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরার রায়ধোবী, আগ্রতলায় তিন দিনের এনবিটি ওয়ার্কশপে। খুবই জমজমাট সেই ওয়ার্কশপ। দীর্ঘ টানা সেশান। আমি কলকাতা থেকে প্রায় এক বস্তা কম্পোজ করা কাটা প্রুফ নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন এয়ার ইন্ডিয়ার বড়োসড় বিমান। চল্লিশ কিলো পর্যন্ত লাগেজ অ্যালাউড। পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লাগে কলকাতার নেতাজি বিমানবন্দর থেকে আগরতলা। পথে খেতে দেয় এয়ারইন্ডিয়া, বেশ ভালোই খাবার। সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্ক হিসাবে আছে ফ্রুটি। কেক, স্যান্ডুইচ, ভেজ-ননভেজ ভাগ আছে— নন ভেজদের চিকেন স্যান্ডুইচ বা এগ স্যান্ডুইচ, কচুর বা সিঙাড়া। ভেজদের ‘বালুকা ডাইনি’— স্যান্ডউইচের বদলে কেক। এমনিতেই কাঁচা পাউরুটির ভেতর মাংস, তরকারি বা ডিমের পুর দেওয়া বালুকাডাউনি— স্যান্ডউইচ, খাদ্য হিসাবে একেবারেই পছন্দ নয় আমার। তবু খিদের মুখে সব সই। সেই কথায় বলে না, ‘অ্যাপেটাইট ইজ দ্য বেস্ট সস’। তো শর্মিলা আব্রাহাম— ফরিদপুরের ‘কামনি’— বিয়ে করল আব্রাহাম পদবির সিরিয়ান চার্চের অনুগামী এক যুবককে। শর্মিলা যথেষ্ট কৃষ্ণা। কিন্তু কথাবার্তার স্টাইল, যাকে হিন্দিতে বলা হয়ে থাকে ‘আদা’, তাতে দারুণ ঝকঝকে। এই ‘আদা’ মশলার আদা নয় কোনোমতেই। বাঙালি যাকে আদা বলে, হিন্দিবলয়ে তাই আদ্রক বা অদ্রক। সিরিয়ান ক্রিশ্চানরা ছড়িয়ে আছেন সমস্ত দুনিয়া জুড়ে। শর্মিলার সহজীবনের মানুষ, আব্রাহাম পদবিধারী সেই মানুষটি খুব ঘর গুছোনো, ব্যায়াম করেন, বডি বানান। অকারণ ছাদের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী যেন কী গোনেন। কে জানে কী গুনতে থাকেন। সেই আব্রাহাম মশাই কেরালাইট— কেরলের মানুষ। আগেই বলেছি ঘর পরিষ্কার করা, ঘর গুছোনো তাঁর অন্যতম প্যাশন। শর্মিলা দিল্লিতে থাকে। খুব নাম করা, বড়োসড় বিদেশি পাবলিকেশন— প্রকাশনালয়ে চাকরি করে। অনেক টাকা মাইনে। দু হাজার সালের গোড়াতেই তো তার নিয়মিত ল্যাপটপ, বিমানে চলাফেরা করে ল্যাপটপ আর ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে। শর্মিলা লম্বা, রোগা, কাঠকাঠ। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের সুমিতদা— সুমিত চক্রবর্তী শর্মিকাতে ফিদা একেবারে। ফিদা আরও অনেকেই। তাঁদের মধ্যে একজন ত্রিপুরার দৈনিক— ত্রিপুরা দর্পণ-এর সম্পাদক সমীরণ রায়। সমীরণদার ‘ত্রিপুরা দর্পণ’ অফিসে রোজ সান্ধ্যকালীন আড্ডা— মদ, খাবার, নিয়মিত। সেখানে অনেক অনেক গুণীজন আসেন নিয়মিত। তাঁদের মধ্যে প্রাবন্ধিক রসিকজন বিকচ চৌধুরী, গদ্যকার অরুণোদয় সাহা, যিনি অতুলপ্রসাদ সেনকে নিয়ে একটি গ্রন্থ নির্মাণ করেছেন, ছবি আঁকিয়ে স্বপনবাবু, এমন অনেকে আছেন। তো সেই সমীরণ রায়ের উদ্যোগেই আমরা গেছিলাম ত্রিপুরার ‘নীরমহল’ দেখতে। রাতে আলোর জাদুতে নীরমহল অপূর্ব। কিন্তু দিনেরবেলা নীরমহল রাজাদের প্রাচীন প্রাসাদ দেখে আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। বরং অনেক অনেক সুন্দর গোমতী নদীর পাড়ে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, ভাঙা প্রাসাদের ইট বার করা দেওয়াল, দেবীর সামনে যূপকাষ্ঠ— হাড়িকাঠ— মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক থেকে উঠে এসেছে সশরীরে, একেবারে ফোটোকপি হয়ে। মনে পড়ে যায় রঘুপতি, জয়সিংহদের। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্য। খুব স্বপ্ন দেখতাম তখন ঐ পরিবেশে যদি ‘বিসর্জন’ নাটকটি করানো যায়। খোলা আকাশের নিচে। স্বপ্ন স্বপ্ন। একেবারে গ্রিক নাটক যেমন হত খোলা আকাশের নিচে, ভারতীয় নাটকও, পুরনো দিনের সংস্কৃত নাটক। শূদ্রকের মৃচ্ছকটীক বা এরকম কিছু। শর্মিলা আব্রাহাম কেন জানি না অভিনেতা জন আব্রাহামের নাম শুনলেই মহা চটে যেত। সেকী আব্রাহাম পদবির জন্য? নাকি জন আব্রাহামের অভিনয় অনেকের যেমন, সেভাবেই তারও পছন্দ হত না? জানি না। সুমিতদা শর্মিলাকে দেখলেই খুব চিৎকার করে মান্নাবাবুর— মান্না দের বিরহ ও মিলনের গান শোনাতেন। তাঁর গলা ছিল বেশ সুরে বাঁধা। আমি খুব পেছনে লাগতাম শর্মিলার, সুমিতদারও— এই গান গাওয়া নিয়ে। সুমিতদার শ্বশুরবাড়ি হাওড়ায়, তস্য তস্যগলির ভেতর, সেখানেও নিয়ে গেছেন সুমিতদা। মনে আছে বাজার থেকে বেশ কয়েকটা গন্ধলেবু কিনে দিয়ে গেছেন তিনি তাঁর শ্বাশুড়িমা আর সহজীবনের মানুষটির জন্য।তখন গ্রীষ্ম ঋতু। সকালের হাওড়ার ভরা বাজার। লন্ড্রি থেকে নিজের কাচতে দেওয়া জামা-কাপড়ও নিলেন। পুরনো দিনের ডাই-ক্লিনিং যেমন হয়— বিবর্ণ সাইনবোর্ড সেই ধোপাখানার। নিচু ঘর। কাচবন্দি শো-কেসে ঝোলানো শাড়ি, প্যান্ট। শো কেস ঢাকার কাচ ধুলোমলিন। দোকানের- ধোবিখানার মালিকের চোখে-মুখে স্থায়ী বিষণ্ণতা। যেমন তথাকথিত অসফল মানুষদের হয়ে থাকে। এরপর শর্মিলার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। একবার তাকে দুপুরে আমাদের ব্রহ্মপুরের ফ্ল্যাটে ডেকেছিলাম, বাঙালি রান্না খেতে চেয়েছিল। সেদিন সাদা খোলের লাল পাড় শাড়ি পরে এসেছিল শর্মিলা। অনেকক্ষণ আড্ডা, গল্প। নানা কথা। কথায় কথায় বলছিল, আব্রাহামদের আমার শুঁয়োপোকা বা কেঁচো-কেন্নোর থেকেও খারাপ লাগে। টেলিফোনেও যোগাযোগ ছিল কিছুদিন, তারপর আর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ নেই। মনে আছে 'ত্রিপুরা দর্পণ'-এর মালিক, সম্পাদক সমীরণদা— সমীরণ রায় সেই সময়ে বরফের বাক্স করে দু দুবার আস্ত ইলিশ মাছ পাঠিয়েছিলেন বিমানে— শর্মিলার সঙ্গে। একাধিক ইলিশ— গোটা। শিল্পী স্বপন নন্দী ছিলেন সমীরণ রায়ের 'ত্রিপুরা দর্পণ'-এর আড্ডার অন্যতম জন। স্বপনবাবু খুবই গোফফে মানুষ। এত এত কথা এল 'কানাহোলা'— আমার পিতৃদেব বর্ণিত 'কানাহোলা'-র কথা বলতে গিয়ে। 'কানাহোলা' যেমন, তেমই 'ভুলো'— ভুলো ভূত আছে বীরভূমে। 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত', 'কানাহোলা' যেমন প্রায় তেমনই। সেও তো ধূধূ প্রান্তরে, দীঘির পাড়ে প্রবল মধাহ্ণ অথবা রাতবিরেতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাজেহাল করে। একই পথে নিয়ে এসে ফেলে বার বার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেব সাহিত্য কুটীরের অতিবিখ্যাত ছোটোদের পুজোবার্ষিকীতে গল্প লিখেছিলেন 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত'-কে নিয়ে। সে গল্পে অনেক অনেক চমক। 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত'-ও বেশ রসিক। তার আচার-আচরণও বেশ আকর্ষণীয়। ভয় আছে, মজাও আছে। অনেকটা যেন 'কানাহোলা'-ই অন্য নামে। 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত', 'কানাহোলা'-র পাল্লায় পড়া তো বেশ বিপজ্জনক ব্যাপার। সামনের সপ্তাহে 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত', 'কানাহোলা' নিয়ে কিছু বলব।বলতে থাকব অন্য অন্য ভূত-পিরেত নিয়েও। রাজশেখর বসু— পরশুরামের 'ভুশণ্ডীর মাঠ'-এ অনেক অনেক বিচিত্র ভূতেদের কথা বলেছেন। থাক সেসব কথা। এখন ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা বা পুরনো কাটরায় আবার ফিরি। সেই পাতলি গল্লি, পাশিয়ানা গল্লি, পরেট— সব কথাই হয়তো আবারও একটু একটু করে অন্যভাবে। অন্যতর কথায়। ছোটো নাউ আর তার মেথরানি প্রেমিকা, তাদের নিয়ে নিয়মিত এক কিস্যাই তো জেগে থাকে। তো সেই ছোটে এবং তার প্রেমিকাও যেন 'কানাহুলো' নয়তো 'ভুলো' বা 'ভুলো ভূত'-এ পাওয়া জন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন, মান-অভিমান— সবমিলিয়ে রামায়ণ-মহাভারত হয়ে যায়। সেই কথা, মেথরানির— সাফাইকর্মিনীর সহজীবনের মানুষটি, সে তো প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়, যাকে বলে খাপ পেতে থাকে, তার সহজীবনের মানুষ— সেই সাফাইকর্মিনী আর ছোটে নাউ, যে কিনা তার স্ত্রীর উপপতি বা নাং, তাকে হাতেনাতে ধরবার জন্য। সে এক অতিকায় কিসসা, সে কিসসার ধারেকাছে থাকতে পেরে, অথবা কিসসার সঙ্গী ও সাক্ষী হতে পেরে জীবন যেন বা হয়ে ওঠে এক বহতা প্রাণজল সাক্ষী। আশ্চর্য হয়ে দেখি সেই প্রেম-কাতরতা, সৌকর্য, অন্ধ-অন্ধকার এবং আলোময়তা। জীবন কত যে ফুল্লকুসুমিত অথবা কণ্টক-আশ্রিত হয়।
Powered by Froala Editor