কলপ— মাথায় দিয়ে পাকা চুল ‘কাঁচা’ করার, মানে সাদা কেশ কালো— ব্ল্যাক, ব্রাউন করার কথা বলতে বলতে মনে পড়ল গজেন্দ্রকুমার মিত্রর কথা। কথাকার গজেন্দ্রকুমার মিত্র— অনেকের মুখে মুখে তিনি ‘কাকাবাবু’— বলেছিলেন, পাকা-সাদা চুল কালার— কালো করার জন্য তিনি— তাঁর বাড়ির কর্মসহায়িকাই করেছেন, আমলকী শুকনো করে তার কুচি লোহার কড়াইতে খুব ভালো করে ফুটিয়ে, সেই জল একেবারে নেড়ে কৃষ্ণ হয়ে গেলে, তা দিয়েই চুলে রং করান। আর ন্যাচারাল— প্রাকৃতিক রং হলেও তা বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয় আর পাশাপাশি মাথার চামড়া ও কেশের কোনো ক্ষতি করে না। যেহেতু আমলা— আমলকী, তাই। অনেকে আবার আমলা বা আমলকীর সঙ্গে শিলে পেশা, মিক্সিতে বাটা মেথি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে। এই পদ্ধতির মিশ্রণ ব্যবহারে চুল নাকি ভালো থাকে। কেউ বা ব্যবহার করেন হেনা, আমলা— আমলকী আর মেথির সঙ্গে মিশিয়ে। আমলা বা আমলকী গুঁড়ো, মেথি গুঁড়ো, সবই পাওয়া যায় এখন, প্যাকেটবন্দি হয়ে। অবশ্য এরা কতটা ভেষজ আর কতটাই বা সিন্থেটিক, তা বলা মুশকিল। কেউই হয়তো বলতে পারবেন না এই ব্যাপারটা ঠিকঠাক। কলপচর্চা কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের খুব প্রাচীন নয় মোটেই, আমি এই কেমিক্যাল— রাসায়নিক কলপের কথা বলছি। এখন যেমন বয়স যাই হোক, কাঁচা মাথা— রং করা চুল সকলেরই প্রায়। কেউ-ই আর পাকা চুল নিয়ে বাঁচতে চান না। ইউরোপ বা আমেরিকায় যতদূর জানি মাথার চুল পেকে গেলে কারওরই তেমন অসুবিধা নেই। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গতে কিন্তু এই পাকা চাউল— চুল পেকে যাওয়ার হীনমন্যতা আছে। আর তার জন্যই কলপ— ‘গোদদেজ’, ‘লোরিয়েল’ ইত্যাদি প্রভৃতির সঙ্গে একদা ‘ভাসমল’ এবং ‘ট্রু টোন’— যাঁদের কথা বলেছি আগের সপ্তাহের লেখায়। ‘লোরিয়েল’ বেশ দামি। ‘লোরিয়েল’ কোম্পানি কলপ তৈরি করার যে একটি সাদা লিকুইড ও অন্যটি পেস্ট ধরনের জিনিস থাকে, তাঁকে যে বাক্সর ভেতর রাখা হয়, সেই বাক্স বা বক্সের গায়ে ঐশ্বর্য রাইয়ের ছবি, কখনও বা ক্যাটরিনা কাইফ। এঁদের বদলে কখনও কখনও বিদেশি কোনো মডেল বা অভিনেত্রীর হাস্যোজ্জ্বল চুল খোলা মুখ। সেই হেয়ার কাটিংয়ে রবই বেশি। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে, আমি দৈনিক সংবাদপত্রের কথাই বলছি, সেখানে ‘ভাসমল’, ‘ট্রু টোন’, ‘গোদরেজ’ একটি সময় পর্যন্ত। তারপর ‘লোরিয়েল’ কখনও কখনও সময়ে সময়ে, ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় মূলত। বাঙালির মাথা কালো করার প্রবণতা ষাটের দশকে তেমন নেই। সত্তরের দশকেও তেমন করে কোনো প্রবণতা নেই। বাংলা খবরের কাগজ, ইংরেজি খবরের কাগজ, হিন্দি খবরের কাগজ, উর্দু খবরের কাগজ, সবেতেই তেমন করে কলপের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি ষাট ও সত্তরের দশকে। বাঙালি মহিলা, পুরুষ তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, চল্লিশের পর পরই পক্ককেশ। একটা অতিচেনা ছিকুলি ছোটোবেলা থেকেই শুনতাম মায়ের কাছে। ছিকুলিটি এরকম—
“এই যে কেশ দেখতে বেশ
পাকলে শণের দড়ি
এই যে দত্ত তেজমত্ত
পড়লে হবেন খোকা
এই যে রাজা হবেন গোঁজা
যাবেন যমের বাড়ি…।’
বৃদ্ধ হওয়ার চিহ্ন নিয়ে এই ছিকুলিটি চলত আমাদের বাল্যকালে, বালক বা বালিকাবেলায়, কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে। বুড়ো হওয়া বা বার্ধক্য নিয়ে হিন্দি বলয়ে— মূলত ইলাহাবাদে একটি ছিকুলি আছে এরকম—
‘পুথ গ্যয়ে মির্চা
তিত হ্যায় উতনি
বুঢ়া ভয়ো বাবা
শখ হ্যায় উতনি’
এই হিন্দি কাহাবতের বাংলাটি এরকম— লঙ্কা শুকিয়ে শুকনো হয়ে গেলেও তেমনই ঝাল আছে। বয়সে— আয়ুতে বুড়ো হলে কী হবে, মনে শখ তেমনই আছে, যেমন কিনা যৌবনবেলায়। রাজ কাপুরের ‘মেরা জোকার’-এ ইন্ডিয়ান সিনেমার ম্যাজিক্যাল পার্সন— অতি বিখ্যাত শো ম্যান— রাজ কাপুর— রাজ কাপুর সাব বা রাজসাব দেখিয়েছেন, শুনিয়েছেন এক ‘এনমোল’ জীবনমেলা— শৈশব, বালকবেলা, বার্ধক্যের কাহিনি। এই সিনেমার জোকার— রাজসাবের লিপে মান্না দের— মান্নাবাবুর সেই অসামান্য গান, তাঁর সুর ও কথা— ‘এ ভাই জরা দেখকে চল, আগে ভি নহি পিছে ভি, ডায়ে ভি নজি বাঁয়ে ভি, উভর ভি নহি নিচে ভি…’। কী অসামান্য সুর আর কথা সেই গানের। রাজ কাপুর সাবের লিপে মান্না দে গেয়ে যাচ্ছেন— বলে যাচ্ছেন, রাজ কাপুরও বলছেন, হাঁ বাপু, ইয়ে সার্কাস হ্যায়… অওর সার্কাস হ্যায় তিন ঘণ্টে কা। পহেলা ঘটা বচপন, হাঁ বাপু, দুসরা জাওয়ানি, তিসরা বুঢ়াপা— এই যে জীবনসত্য, তা রাজসাব উপলব্ধি করেছিলেন ‘মেরা নাম জোকার’-এ। তারই ফলাফল এই গানের ভাষার ও সুরে। বুকের ভেতর— নিঝুমপুরে— হয়তো হৃদয়পুরেও বাজরে থাকে সেই গান। এ ভাই জরা দেখকে চল…। বাঙালির কলপ বিলাসের পাশাপাশি অবাঙালি কলপ-বিলাসও আছে। সত্তর দশকে ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় ছোটে নাউকে মেথি। নাউ অর্থাৎ নাপিত। ছোটে মিলের ধুতি, পায়ে নাগরা, গায়ে টেরিকটের ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। হাতা গুটানো। ছোটের নাকের নিচে শখদার, কালো, পাকানো মোচ— মোছা— সেই গোঁফে মর্দাঙ্গি— পুরুষালি চিহ্ন বর্তমান। অন্তত সেই সময়ের ইলাহাবাদ-সহ সমস্ত হিন্দিবলয় বা গোবলয়, গোবলয়ের বাইরেও মোচ— মোছা, তাগড়া, পাকানো গোঁফ মর্দাঙ্গি— পুরুষালির চিহ্ন। ইলাহাবাদে ডাঁটকে তখনও— সেই সত্তর দশকেই অনেকে বলেন, ‘মোছা রাখতা হুঁ বেটা’। মোছ, মোছা বা গোঁফে তাও দিতে দিতে শত্রুপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানো, মেয়েদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয়, নিজেকে আরও অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই এই প্রয়াস, এমন ধারণা তখন ভাবনাস্রোতে ভেসে চলে। তা ছোটে নাউ বা ছোটে নাপিতের কাছে একটা কাঠের চৌকোবাক্স। তার গায়ে পেতলের চকচকে সাজ, স্বর্ণাভ, স্বর্ণপ্রতিম। এই বাক্সের চার কোণে পেতলের কোণ, মানে কাঠের কোণ চাপা দেওয়া পিত্তল অলঙ্করণ। ছোটে— ছোটে নাউ খুব রংদার, রসিয়া, রসিক মানুষ। তার ‘আদা’— চালচলন, পোশাক-আশাক, সবই রংদার, রসিকজনের। ছোটে ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা, নয়া কাটরা, সবখানেই যথেষ্ট পরিচিত, তার নাউগিরিতে। তার দু-হাতের দশ আঙুলে সাত-আটটি আংটি, সবই যে সোনার এমন তো নয়। রুপো আছে, অষ্ট ধাতু এবং কিছু ঝুটো স্টোন, ঝুটি পাথর— ঝুটি পাথর, লাল-নীল এবং সবুজ বা খয়েরি রং-এরও। ছোটের হাতে কোনোদিন রিস্টওয়াচ— হাতঘড়ি দেখিনি। ইলাহাবাদের ছোটের হাতে কেন রিস্টওয়াচ— হাতঘড়ি দেখিনি, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মনে জাগে। যে ছোটে নাউ দু’হাতের দশ আঙুলে সাত-আটটি আংটি রাখেন— পরেন, তিনি কেন ঘড়ি পরেন না কবজিবন্ধতে, মানে ‘ঘড়ি লাদেন’ না? ইলাহাবাদে হাতে ঘড়ি পরাকে ঘড়ি ‘লাদকে’ বলেন হিন্দিভাষীরা। বাঞালিরা অনেক সময়ই বলে থাকেন— ঘড়ি লাদকে, অন্তত সত্তর দশকে। ছোটের— ছোটে নাউয়ের এক মেথরানি প্রেমিকা ছিলেন। তিনি পুরানা কাটরার বিভিন্ন বাড়িতে পায়খানা কামাতেন— পরিষ্কার করতেন। ষাট দশকে শেষে, সত্তরের দশকের গোড়ায় গোড়ায় ইলাহাবাদে সব খাটা পায়খানা। মাথায় করে মলবহনের অতি নিন্দাজনক, অমানবিক, কুপ্রথা তখন ইলাহাবাদে। সারা উত্তরপ্রদেশেই প্রায়। পশ্চিমবঙ্গেও— কলকাতার গা লাগোয়া মফস্বল এলাকাতে মুখ-সহ সারা গায়েই প্রায় উল্কি করা মেথরানি বা রমণীরা মাথায় করে গুয়ের টব বহন করেন। এ নিয়ে বিস্তারে লিখেওছি কয়েকবার। তো সেই ডাঙ্গি রমণীদের নাকে সোনার অথবা পেতলের নাকফুল। কানেও। চকচক করে তা সূর্যের আলোয়। এইসব নারীদের গায়েও রুপোর আংটি, নুপুর। সেই নুপুর শোয়ানো থাকে তাম্র বা কালো পায়ের পাতায়। পশ্চিমবঙ্গে যেমন গুয়ের ডাবা ছিল লাল রঙের, পোড়া মাটির, বড়ো ছোটো, মাঝারি নানামাপের। সেখানে গুয়ের পোকা— সাদা সাদা থলথলে পোকা— কিলবিল। কিলবিল। কিলবিল। ইলাহাবাদে খাটা পায়খানায় কোনো ডাবা নেই। অনেকটা উঁচু মঞ্চের খাটা পায়খানা। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যায়, তলপেটে চাপ বাড়তে থাকলে বেশ অসুবিধাই হয়। তখনও বহু পায়খানায় গাড়ু— পুতলের গাড়ু— পুতলের বদনা। গাড়ু সাবেক হিন্দু পরিবারের শৌচকর্মে লাগে। বদনার ব্যবহার মুসলমান পরিবারে, পিতলের গাড়ু, বদনা চুরি হয়ে যেত বহু সময়ই। তারপর অ্যালুমিনিয়ামের গাড়ু জল, অ্যালুমিনিয়ামের বদনা। তারপর রঙিন প্লাস্টিকের বদনা, গাড়ু। গাড়ু ও বদনার মধ্যে গড়নের ফারাক তো অবশ্যম্ভাবী। তা নিয়ে নানা রসিকতা, কথাবার্তা আছে। বদনা আর গাড়ুর গড়নেরু ফারাক নিয়ে লিখি একটু। বদনা থেকে কল ঢালার নল সোজা। গাড়ুর নল বাঁকা একটু ছোটো ঢেউ খেলানো যেন। গাড়ু, বদনা— পেতলের গাড়ু-বদনার চল প্রায় নেই-ই। ইসলাম ধর্মাবলম্বী পরিবারে— একটু যাঁরা বর্ধিষ্ণু, তাঁদের বাড়ি পিতল বা পেতলের বদনা তখনও দেখা যায়, ক্বচিৎ কদাচিৎ, নয়তো অ্যালুমিনিয়ামের। প্লাস্টিক— শক্তপোক্ত রঙিন প্লাস্টিকের বদনা দেখা যায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী কোনো কোনো জনের পায়খানায়। গ্রামের মুসলমানজন এখনও পায়খানা করাকে ‘পটি’ করা বলেন না। হাগা ইত্যাদিই বলেন। তো ছোটে নাউ— ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় এসে নানা বাড়িতে ‘বাল কামায়’— কেশকর্তন করে— চুল কাটা, ডাঢ়ি— দাড়ি কামায়— দাড়ি নামায়। ছোটের এই প্যানডোরাস বক্স— প্যানডোরার বাক্সে আছে উস্তরা— খুর, দু-তিন রকমের চিরুনি— তাদের বাঁট বা হাতল পিতলের, মোষের শিঙের, উটের হাড়ের, প্লাস্টিকের। সেই সঙ্গে ছোটো, বরো কাঁইচি, কেঁইচি— কাঁচি। সেইসব কাঁচির হাতল কখনও কখনও চকচকে পেতলে বাঁধানো। এর সঙ্গে পায়ের নখ, পায়ের কড়া, অতিরিক্ত মাস কাটার নরুন, পাকা চুল তোলার শন্না— ছোটো, বড়ো। উস্তরা— ক্ষুর— দাড়ি কামানোর ক্ষুর ধার দেওয়ার চামড়ার টুকরো— চামড়ি বলে যাকে, সেই সঙ্গে ক্ষুর আরও তীক্ষ্ণ করার পাথর, ছোটো আয়তাকার পাথর, তার গায়ে অনেকটা যেন সিমেন্টের রং, সেইসঙ্গে জল, কড়ুয়া তেল— সর্ষের তেল রাখার আলাদা আলাদা বাটি। এমন চেহারার বা সাইজের বাটিকেই নাপতে-বাটি বলতেন পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি একসময়, কারণ তখন সারা গায়ে, পিঠে সর্ষের তেল, মাথায় তিল বা নারকেল তেল মাখার রেওয়াজ ছিল। সেই তেলের বাটির সঙ্গে সঙ্গে রান্নার তেল মাপা লোহার পলাও ছিল। পলা মেপে তেল দেওয়া হত কড়াইয়ে, চাটুতে— তরকারি রান্নার সময়, পিঠে-পানা— পিঠে-পুলির উৎসবে। বাড়িতে জন খাটলে— গ্রামে ভাগচাষি, মুনিশ, আধা শহরে ‘মিতা’— যে সাঁওতাল বা মুণ্ডা মানুষেরা বনেদ কাটেন, চমৎকার হিসেব করে, মাটি যাতে না ধ্বসে, তার ব্যবস্থা রেখে, সেই সাঁওতাল বা মুণ্ণডা-ভাইদের বলা হত ‘মিতা’। তো সেই ‘মিতা’রা পাঁচিলের বনেদ, ঘরের, পায়খানা বা রান্নাঘরের বুনিয়াদ— বনেদ কাটতে কাটতে টিফিনবেলায় অথবা খানিক ক্লান্ত হলে স্থানীয় পুকুরে স্নান সারার জন্য তেল চাইতেন। আট-ন ঘণ্টার পরিশ্রমের পর সারা গায়ে দেওয়া, বুলোবার জন্য সর্ষের তেল চাইতেন গিন্নিমা— বাড়ির প্রধান গৃহিণীর কাছে, তখন তো তাঁদের পলা দিয়ে মাপ করা সরিষার তেল— সর্ষের তেল। অখণ্ড বঙ্গের পূর্ব ভাগ থেকে আসা জনেরা কেউ কেউ সম্বোধনে গৃহিণীকে বলতেন মা ঠাইরেন ত্যাল দ্যান। তখন তো পলা মেপে তেল। আবার ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজমিস্ত্রিরা, জোগাড়েরা তাঁদের আট-ন ঘণ্টা কাজের শেষে স্নান সেরে তৈল প্রদান করতেন নিজেদের সমস্ত পায়ে, যাতে ‘খড়ি’ না ওঠে। জোগাড়ে অবশ্য খুব কমই হতেন ইসলাম ধর্মের মানুষ। সাধারণভাবে তাঁরা রাজমিস্ত্রিই বা রাজমিস্তিরির কাজই করতেন। মিস্তিরি-জোগাড়েদের কথা যখন হচ্ছে, তখন ‘ফুরোনে’ শব্দটা খুবই প্রচলিত ছিল একসময়, এখনও হয়তো আছে, তার কথা মনে পড়ে গেল। ‘রোজ’ আর ‘ফুরোনে’। রোজ অর্থে দৈহিক শ্রম, সেই অনুযায়ী টাকা। জোগাড়ে দেড় টাকা। তাও অতি দড়— দক্ষ জোগাড়ে হওয়া চাই, ঠিক এই পরিমাণ মজুরি পেতে গেলে। আমি হাওড়া জেলার বলিতে ১৯৬২-৬৩ সাকে জোগাড়ে ও রাজমিস্ত্রিদের দৈনিক রেটের কথা বললাম। আর ‘ফুরোনে’ হল কন্ট্র্যাক্ট। ছাদের ঢালাই হবে আরবি বা সিমেন্ট ঢালাই। আরবি ঢালাই হলে রেট কম, আরবিতে গোটা গোটা ইট আর সিমেন্ট, সাধারণভাবে পায়খানার ছাদ এইভাবে ঢালাই করা হত। আমাদের বালির বাড়ির পায়খানার ছাদ আরবি ঢালাই। ঘর সিমেন্ট-স্টোন চিপ বা খোয়া, বালি দিয়ে। তার আগে রঙ বাঁধা, তক্তা ফিট করা, তক্তা সাজানো। লাগানো ভাবি সিলিং জুড়ে। তখন সিমেন্টের বস্তা কন্ট্রোলে ছয় টাকা, ব্ল্যাকে দশ টাকা। এক গাড়ি বালি তিন টাকা। এক গো গাড়ি ভর্তি বালি। আমি ১৯৬২-৬৩ সালের কথা বলছি। মাখলার ইট— প্রিয় কোম্পানি, এইচএলকে একটা দশ নয়া পয়সা, অর্থাৎ একশো টাকায় হাজার খানেক ইট। হ্যাঁ, একশো টাকায় হাজার ইট। চুনের বস্তা ছ আনা। সুরকি এক বস্তা দেড় টাকা। ঘেঁষও— যা দিয়ে ঘেঁষ চুনের গাঁথনি হয়, সেই ঘেঁষও এক-দেড় টাকার মধ্যে এক বস্তা। ১৯৬২-৬৩ সালে সিমেন্ট, লোহার রড সব কন্টোলে— সরকারি নিয়ন্ত্রণে। বাড়ি করা বা অন্য অন্য সারাই কাজ— অবশ্যই বাড়ি-সারানো কাজের ব্যাপারে সিমেন্ট কিনতে গেলে সরকারি অনুমতিপত্র— পারমিট লাগবে। না হলে কালোবাজার— কালোবাজারি— ব্ল্যাক মার্কেট। কালোবাজার— কালোবাজারি শব্দ দুটি তখনই শুনি নতুন করে আবার। তার আগেও শুনেছি বাবা— অমরনাথ রায়ের মুখে।
Powered by Froala Editor