এই জীবাশ্ম সময়ে সে কেন যে বেঁচে আছে, কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা বুঝতে পারে না। আসলে রাস্তার কাছাকাছি প্রায় বন্ধ হয়ে আসা পোস্ট অফিস— যাকে বালে তার মফস্বলি চৈতন্যে সে তো পোস্টাপিসই বলত। আর কারও হাফ পেন্টুল-পুর, হাফ প্যান্ট বলা তখন সে শেখেইনি, তখনও জিপার-চেন আসেনি প্লাস্টিক বা পিতলের চেন আসেনি প্যান্টের— ফুল ও হাফ প্যান্টের তলপেট আটকাতে। তখনও পোক্ত বোতাম— বোতামই— পূর্ববঙ্গে যাকে অনায়াসে বলা হয়ে থাকে ‘বুতাম’, তো সেই বোতাম, বুতাম বা বাটন আটকানো প্যান্টের কথায় তার মনে পড়ে যায় তাঁর বাবা অমরনাথ রায় নিজেদের বাল্যে ‘ইংলিশ কাটিং’ হাফ প্যান্ট পরার কোনো সুযোগ পাননি। কেনার প্যসা তো সমস্যাই, ইংলিশ কাটিং প্যান্টের দাম বেশি। তাই দড়ি ভরা, কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা যে প্যান্টের, সেই ‘অগরপাতার প্যান্ট’ তাঁরা পরতেন। একটি চার আনা, ১৯৩০ সালে। এই প্রসঙ্গে তার মনে পড়ল ১৯৭০ সালে ‘গোপাল’-এর গেঞ্জি মেটিরিয়ালে তৈরি জাঙিয়ার দাম এক টাকা। হ্যাঁ, এক টাকাই— একশো নয়া পয়সা। আর পিথ্রি কোম্পানির জাঙিয়া তিন টাকা, এক পিস। ১৯৭০ সালে তাদের স্কুল বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়-এর একদম গা লাগোয়া ‘কল্পনা স্টোর্স’-এ এক টাকায় দড়ি ভরা পায়জামা সেলাই করা যায়। পকেটঅলা হলে তার সেলাই খরচ আর একটু বেশি। পকেটঅলা পায়জামা প্যান্ট কাটিং। তার কোমরে ‘বুতাম’, ‘বাটন’ বা বোতামের ব্যবস্থা। তো যা বলছিলাম, আমাদের বাল্যকালে প্যান্টের বোতাম খোলা থাকলে বলা হত, তোর পোস্টাপিস খোলা। আবার কোনো নারী যদি যৌন প্রস্তাবে যথেষ্ট সহজে সড়গড় হতেন, তাহলে তাঁকে ‘পোস্টাপিস’ বা ‘লেটারবক্স’ বলার রীতি ছিল। এখনও আছে কিনা জানা নেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, জিপিও ছাড়া কলকাতা শহরের বড়ো বড়ো পোস্ট অফিসরা প্রায় অনেকটাই ব্যস্ততাহীন হয়ে পড়েছে। স্পিড পোস্ট ছাড়া তাদের আর খুব কোনো বড়ো ভূমিকা আছে কি? তাও সব পোস্ট অফিস স্পিড পোস্ট নিতে পারে না। আনডার সার্টিফিকেট অফ পোস্টিং বলে একটা ব্যাপার ছিল ডাকঘরে। একটি ছাপানো ফর্মে যাকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে তার নাম-ঠিকানা লিখে যে ডাকঘর থেকে চিঠিপত্র পোস্ট করা হচ্ছে, তার সিল— সেই পোস্ট অফিসের রাবার স্ট্যাম্প নয়, লৌহ নির্মিত স্ট্যাম্প মারিয়ে নেওয়া। আনডার সার্টিফিকেট অফ পোস্টিং উঠে গেছে সম্ভবত। যেমন বন্ধ হয়ে গেছে পুরনো স্টাইলের মানি অর্ডার করা। ষাট, সত্তর, আশির দশকেও দ্রুত— অতি দ্রুত টাকা পৌঁছানোর জন্য টিএমও— টেলিগ্রাম মানি অর্ডার করা হত। বলা বাহুল্য, টেলিগ্রাম মানি অর্ডার যেমন, সেভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে, বহু বছর বন্ধ হয়েছে টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাফ— টরে টক্কা, টক্কা টরে— মর্সকোড নেই। ‘খবর আসছে ঘর ভেঙেছে দারুণ ঝড়ে/ তারের ভাষায় সংকেতে টক্কা টক্কা টরে/ টক্কা টরে…’। অপরেশ লাহিড়ি গেয়েছিলেন এই গান। তিনি ও বাঁশরী লাহিড়ি অনেকেরই ‘বাপ্পিদা’ বাপ্পি লাহিড়ির মা, বাবা। আর বাপ্পি লাহিড়ির আবার পরিচিতি লাগে নাকি? অথচ অপরেশ লাহিড়ি তো এক সময়ের গুণী গায়ক। তাঁর গান আকাশবাণীর প্রচার তরঙ্গে বহুবার শুনেছি। কলকাতা শহরে বহু লেটার বক্সই তো ভেঙে গেল। অকেজো হয়ে বাতিল হয়ে গেল। জিপিও, ধর্মতলা— এসপ্ল্যানেড ইস্টের বড়ো পোস্ট অফিসের সামনে, ধর্মতলায় কলকাতা কর্পোরেশন অফিসের গা লাগোয়া ফুটপাতে লেটারবক্স আছে এখনও। তবে ডাকবাক্সে এই শহরে অন্তত কাউকেই চিঠি ফেলতে দেখি না। সব এখন এসএমএস, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার। দ্রুত, দ্রুত, অতি দ্রুত। খুব তাড়াতাড়ি। তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’-তে রেল স্টেশনে টরে টক্কা মেশিন পোস্ট অফিসে, আবার ‘ঝিন্দের বন্দী’-তেও পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট, স্টেশনে। টেলিগ্রামে, টেলিগ্রামে ‘সু’ আর ‘কু’ দু-ধরনের সংবাদই আসত। মৃত্যুসংবাদ, টেলিগ্রামেই— লেখাপড়া জানা উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-কখনও কখনও নিম্নবিত্ত পরিবারেও, দুঃসংবাদ ও আনন্দ সংবাদ বাহক টেলিগ্রাম। সেসবই এখন স্মৃতির তলদেশে ঝাপসা শৈবালজল। আবার চাকরি পাওয়ার খবর, পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার সংবাদ— সবই তো টেলিগ্রাম মারফত আসে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারে। মূলত হিন্দু বাঙালি ঘরে। কলকাতায় খুব সুন্দর কাজ করা চিঠি পোস্ট করার জায়গা— লেটারবক্স, রং লাল, ওপরে কালো বর্ডার দেওয়া লাল, উধাও হয়ে গেল সম্পূর্ণ। চোখের সামনে থেকে মোটামুটি ভ্যানিশ। লেটারবক্সের ঢাকনাটি যেন কোনো মধ্যযুগভীয় নাইটের শিরস্ত্রাণ। কি যে সুন্দর দেখতে লাগত। রাস্তার ওপর বহু বাড়ির দেওয়ালে ঝুলত লাল লেটারবক্স। এখনই মনে পড়ছে দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে সদানন্দ রোডের ওপর রাস্তার ডানদিকে। লাল ডাকবাক্স। পাশেই— একেবারে গা ঘেঁষে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। সেই লেটারবক্সে চিঠি ফেলার কি যে রোমাঞ্চ। যাকে বা যাঁকে চিঠি লেখা, তার ঠিকানা লিখে পাঠাচ্ছি, সে বা তিনি যেন দাঁড়িয়ে আছেন চোখের সামনে। পিন কোড চালু হল অনেক পরে, হয়তো সত্তর দশকে। তার আগে আর সেই সময়েও শুনেছি, পড়েছি ‘ডেডলেটার বক্স’-এর কথা। ‘মৃত চিঠিরা’— হয়তো ভুল ঠিকানায় যেতে গিয়ে, দিকভ্রান্ত হওয়া চিঠিরা জমা পড়ে গেছে ডেড লেটার বক্সে। ষাটের দশকেও কালির কলমে— ঝর্ণা কলমে— ফাউন্টেন পেনে চিঠি লেখা। বর্ষণ কালে— বর্ষা ঋতুতে বা হঠাৎ হঠাৎ অকাল বরিষণে এইসব চিঠির বাক্যবলী ভিজে, ধেবড়ে, এলোমেলো। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের কোনো চিঠি কি বর্ষায় ভেজেনি অথবা স্বামী বিবেকানন্দের চিঠি? জানতে ইচ্ছে করে। আমি তিন নয়া পয়সার পোস্টকার্ড দেখেছি। পাঁচ নয়া পয়সার ইনল্যান্ড, দশ নয়া পয়সার এনভেলপ। পোস্টকার্ডে উপনিবেশকালে ‘কিং’, ‘কুইন’ ইত্যাদি প্রভৃতির ছবি। তখন এক পয়সা, পরে আধ আনা-হাফ আনা পোস্ট কার্ডের দাম। তখন ব্রিটিশ শাসন। আমি পোস্ট কার্ডে কোনার্কের ঘোড়া, বাঘ, গান্ধীজি দেখেছি ছবি হিসাবে। আরও কিছু ডিজাইন। ইনল্যান্ড ময়ূর, অশোকস্তম্ভ। পোস্টকার্ডে ফ্যামিলি প্ল্যানিং— পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপন। যার মূল কথা হল— সুখ কা রাজ হ্যায় দো বাচ্চে/ সুখ কি নিশানি লাল ত্রিকোণ লাল ত্রিকোণ… ‘তুমি নিরোধকে সাথী কর/ তুমি নিরোধকে সাথী কর…’। পরিবার পরিকল্পনা— ফ্যামিলি প্ল্যানিং— সাদা কালোয় লাল ত্রিকোণ-রেপ্লিকা সবই ছিল। জেলখানায় চিঠি লেখার জন্য সত্তর দশকে মূলত পোস্টকার্ড। তখন পোস্টকার্ড পাঁচ নয়া পয়সা, ইনল্যান্ড লেটার পনেরো নয়া পয়সা। জেলখানার চিঠি সেনসর হয়, হতে থাকে, সে উপনিবেশ-জালে, ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে পরবর্তী সময়— জাতীয় কংগ্রেস ও যুক্ত ফ্রন্ট আমলে রাষ্ট্রপতি শাসনের নামে জাতীয় কংগ্রেস জমানায় জেলখানায় সেনসরশিপ জাগ্রত ছিল প্রবলভাবে। তখন বেশিরভাগ চিঠিই পোস্টকার্ড। খোলা, উন্মুক্ত, সেনসরড সেই সময়টায় পোস্টকার্ডের দাম পঁচিশ নয়া পয়সা। তখনও কলকাতায় শীতের সার্কাস— ‘ওরিয়েন্টাল সার্কাস’, ‘জেমিনি সার্কাস’, ‘ওরিয়েন্ট সার্কাস’। সার্কাসের তাঁবু পড়ে পার্ক সার্কাস ময়দান, হাওয়া ময়দানে। তখনও বাঙালি মালিকানায় কোনো কোনো সার্কাস কোম্পানি। ‘জেমিনি সার্কাস’, ‘ওরিয়েন্ট সার্কাস’— সবার মালিকই বাঙালি। ষাটের দশকে হাওড়া ময়দানের সার্কাস-আলো— ফোকাস পৌঁছে যায় আকাশের কালচে নীলিমা চিরে দিয়ে বেলুড়, বালিতে— বেলুড়, বালির আকাশে। সার্কাসে তখন বাঘ, সিংঘ, ঘোড়া, হাতি, ভাল্লুক, কাকাতুয়া, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, টিয়াপাখি, চন্দনা, ম্যাকাও। কাকাতুয়া, শিম্পাঞ্জি— সকলেই কামান দাগতে পারে। ছোটো কামান, পলতেয় আগুন দিয়ে তারপর ধু-উ-ড়ু-ম। ধা-আ-ড়া-ম—। ধোঁয়া। রিং মাস্টারের ব্যাটারির চাবুকের ভয়ে বাঘ, সিংহ, কুকুর— স-বা-ই আগুনের রিং পেরোয়। পেরতে থাকে। এখন— মানে ইদানিং বেশ অনেক বছর হল সার্কাসে জীবজন্তুর খেলা নেই। সার্কাসের বাঘ, সিংহ, হাতি— সবই পুনর্বাসনকেন্দ্রে। সরকারি আইন খুব কড়া। তার বদলে ট্রাপিজের খেলায় লাল ব্রা আর প্যান্টি পরা ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নারীরা। নয়তো আফ্রিকি কন্যারা। তাদের স্বাস্থ্যই সম্পদ, সার্কাসের সম্পদ। স্তনবিভাগ, ঊরু, পায়ের গোছ— সর্বত্রই যৌনতা, যৌনতা এবং অপার যৌনতা। যৌনতার সমুদ্র। সার্কাসে সে কামান দাগত কাকাতুয়া, ম্যাকাও অথবা শিম্পাঞ্জি, কখনও কখনও বাঁদররাও— তারা সবাই যথেষ্ট সাহসী, অন্তত সার্কাসের নিরিখে, এই বলাটুকু। প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সার্কাস নিয়ে একটা বড়ো অংশ আছে আমার ‘ধুলিচন্দন’ নামের আখ্যানে। সেই আখ্যান পর্বে আছে কাতু-কুতু, লাড্ডু নামে জোকারদের কথা। পূর্ব ইউরোপ, মূলত ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ফর্সা ফর্সা, স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ কন্যারা এই সার্কাসের সম্পদ। সার্কাসের মালিকানা প্রায় বেরিয়ে গেছে বাঙালির হাত থেকে। অথচ গায়িকা ইন্দুবালার মা-¬বাবা ছিলেন সার্কাসে। সার্কাস নিয়ে অনেক অনেক তথ্য, ইতিহাস, কুশীলবদের প্রেম-ভালোবাসা-হাসি-কান্না। সার্কাস— বাঙালির সার্কাস নিয়ে একসময় আরপি— রাধাপ্রসাদ গুপ্ত— শাঁটুলবাবু বড়ো কাজ করেছিলেন, তিনি তখন ‘টাটা’-র পাবলিক রিলেশন অফিসার— পিআরও। শাঁটুলবাবুর সেই লেখা যতদূর জানি বই হিসাবে প্রকাশিত হয়নি। সেই লেখাটা গেল কোথায়, জানা নেই। পূর্নেন্দু পত্রীর কাছে সার্কাস বিষয়ক এই লেখাটির অনেক প্রশংসা শুনেছি। আমি নিজেও পড়েছি লেখাটি। কিন্তু তার ঠিকানা বা হদিশ কোথায় আছে, জানা নেই। শাঁটুলবাবু নস্য নিতে, সপাটে টানে। থ্যাবড়া মুখ। চখে কালো ফ্রেমের চশমা। মাথা ভর্তি চুল। ক্লিন সেভেন। বাঙালির মাছ বিষয়ে তাঁর বই ছিল। বই ছিল ফেরিওয়ালা আর তার ডাক নিয়ে। খুবই চমৎকার কাজ, দুটোই। সুভো ঠাকুরের প্রাণের বন্ধু শাঁটুলবাবু, যাকে বলে একেবারে হলায়গলায় বন্ধুতা, প্রায়ই আসতেন হোয়াইট লেডলয়ে বিল্ডিং-এ, সুভো ঠাকুরের ফ্ল্যাটে। তারপর যখন মূলত পূর্নেন্দু পত্রীর আহ্বানে পাক্ষিক প্রতিক্ষণ-এ নিয়মিত কলাম লিখতে আরম্ভ করলেন পাতা জোড়া, তখন তো ‘প্রতিক্ষণ’-এ আসতেন নিয়মিত প্রায়। হাফ হাতা টেরিকটের বুশ শার্ট, টেরিকটের ফুল প্যান্ট। পায়ে চামড়ার ব্যাকবেল্ট। ‘প্রতিক্ষণ’-এ নিয়মিত কলাম লিখেছেন অরুণ সিংহ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অশোক রুদ্র, অরুণ সেন, দেবেশ রায়, পুর্ণেন্দু পত্রী। শান্ত দত্ত লিখেছেন। দেবী খান উপন্যাস লিখেছেন, শারদীয় প্রতিক্ষণ-এ। তাঁর বইও হয়েছে ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে। ধারাবাহিক লিখেছেন দেবেশ রায়, সলিল চৌধুরী, অরুণ মিত্র, সিদ্ধার্থ রায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়। পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এ নিয়মিত কলাম লিখেছি, ‘গড়ন গঠন’ নামে। কলকাতার নানা প্রান্তে, কলকাতার বাইরেও sছড়িয়ে থাকা নানাধরনের সামাজিক— কল্যানমূলক কাজ— ফুটপাতের বাগান, বস্তির বাচ্চাদের পড়ার নাইটস্কুল ইত্যাদি, নারী ও বয়স্ক শিক্ষার চেষ্টা— বিনা পারিশ্রমিকে, গাছ লাগান— সব নিয়েই এই লেখা। এইসব কর্মকাণ্ড প্রায় সময়ই বৃহৎ মিডিয়া— অতি বড়ো প্রচার মাধ্যম বাড়িতে— ‘অনুপ্রাণিত হয় না’, নিভৃতে, আড়ালে কাজ করে যান তাঁরা, চুপচাপ। কোনোরকম অর্থ, ব্যক্তিপ্রচার ছাড়াই। খুঁজে খুঁজে বার করতাম এইসব ব্যক্তি ও সংগঠনকে। তারপর তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। এই যে তথাকথিত ঘরের খেয়ে অরণ্যের মোষ— ‘ঘরের খী বনের মোষ’ তাড়ানোর কথা লিখলাম, তার নানা নিদর্শন এই বছর— আমার শহর— শহর কলকাতার আনাচেকানাচে ছড়ানো ছিল। কালীঘাট, চেতলা, পার্ক সার্কাস, মেটেবুরুজ, শ্যামবাজার, বিবেকানন্দ রোড, এইরকম কলকাতার নানা অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। একেবারেই যা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এইসব কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ল দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে মুখার্জি পাড়া লেনের ওপর বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গায় টিনের দেওয়াল, টিনের চালের ঘরের ভেতর এসইউসি-র অবৈতনিক নৈশ্য বিদ্যালয়। তখনও এসইউসি এসইউসিআই বা এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) হয়নি। রণজিৎ ধর ছিলেন এই অঞ্চলের পুর-প্রতিনিধি। কুঠার চিহ্ন নিয়ে জিততেন। তখনও এসইউসি তার নির্বাচনী প্রতীকে বাইসাইকেল, পরে টর্চ লাইট আসে। রণজিৎ ধর খুব ভালো সংগঠক। মালকোঁচা মারা মিলের ধুতি তার ওপর সাদা বা ঘি রঙের টেরিলিন বুশ শার্ট। নাকের নিচে বুড়লে— ডাকাতিয়া গোঁফ। পেটানো স্বাস্থ্য, বলশালী চেহারা, তেমন লম্বা নন। শ্যামলা রং। মাঝখান থেকে সিঁথি করা মাথাভর্তি কালো চুল— প্রায় বাবরি, তিনি বিধানসভা আসনেও ভোটপ্রার্থী হতেন এসইউসি-র হয়ে রাসবিহারী কেন্দ্রে। এই অঞ্চলেই এসইউসি-র আর এক নেত্রী ছিলেন সাধনাদি। সদা বিষণ্ণ মুখ। খুব রোগা। এত রোগা যে দেখলে অসুস্থ মনে হয়। ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। সাধনাদির পদবী এখন আর মনে নেই। তিনি এসইউসি-র বড়ো নেত্রী ছিলেন। রাসবিহারীর যে লোকসভা মিট, সেখান থেকে দাঁড়াতেন— নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। বেশ কয়েকবার তাঁর নাম দেখেছি রাসবিহারী— কালীঘাট অঞ্চলে, দেওয়াল লিখনে, সাদার ওপর রঙিন অক্ষর ছাপা পোস্টারে। চেরলা-কালীঘাট অঞ্চলে একসময়— ষাট দশকে এসইউসি-র খানিকটা প্রভাব ছিল। ষাট দশকে, সত্তর দশকেও সিপিআই (এম)-এর বড়ো সমাবেশ থাকলে, যেমন বাড়ি বাড়ি রুটি তৈরি করে, তা সমাবেশে আসা মানুষদের জন্য পাঠানো হত, তেমনই এসইউসির বড়ো কেন্দ্রীয় সমাবেশ থাকলে রুটি তৈরি করানো হত, বিশেষ করে ২৪ এপ্রিল, তাদের পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসে, শহিদ মিনার মনুমেন্ট ময়দানে যে সভা হত, সেখানেই যেত এই রুটি। গ্রাম থেকে আসা মানুষদের জন্য। জয়নগর¸ক্যানিং-সহ দক্ষিণবঙ্গের sকিছু কিছু ‘পকেটে’ এসইউসি-র সংগঠন ছিল। সংগঠন ছিল বীরভূমের সিউড়ি, রামপুরহাটসহ কোনো কোনো অঞ্চলে। সিউড়ি থেকে ১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এসইউসি-র প্রতিভা মুখার্জি— প্রতিভা মুখোপাধ্যায় বিজয়ী হন। তিনি প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। প্রতিভা মুখার্জিকে বেশ সুশ্রীই বলা যায়। পরে তো সাত পার্টির এমএলএ-র সঙ্গে— এসইউসি-র সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হল। শুধু এসইউসি নয়, এমএলএ-র সঙ্গে, ফরোয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে, সিপিআই-এর সঙ্গেও সিপিআই (এম)-এর সশস্ত্র সংঘর্ষ ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল।
Powered by Froala Editor