বাংলা খবরের কাগজ— দৈনিকের কাগজ নিয়ে বলা যায় কত কত কথা। দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন জগৎ— মানে বিজ্ঞাপন পাওয়ার যে ক্ষেত্র, তা ছিল আরও বিচিত্র। তখন তো লেটার প্রেস— উতর সাইনো-মোনোর যুগ। চমৎকার বিজ্ঞাপন লে আউট করতে সি গাঙ্গুলি, ডি কে। সত্যজিৎ রায় তো চাকরিই করতেন ডি কে-র কোম্পানিতে। আশির দশকে রামরে-র বিজ্ঞাপন কোম্পানি যথেষ্ট নামি। রাম রে নিজে ছিলেন বিজ্ঞাপনের মানুষ। তখন ‘ক্ল্যারিঅন’ খুব নাম করা বিজ্ঞাপন কোম্পানি। অতি নামি ডি জি কিমার। পূর্ণেন্দু পত্রী চমৎকার লেআউট করতেন বিজ্ঞাপনের। বহু কাজ তিনি করেছেন। সুভো ঠাকুর— সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো পুত্র সিদ্ধার্থ ঠাকুর কলকাতায় বিজ্ঞাপন কোম্পানি খুলেছিলেন। তাঁর কোম্পানির কথা কিছু কাজে আমার ছড়া গেছে। এমনকি ‘শ্রীলেদার্স’ নামে জুতোর কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও। সোমনাথ ঘোষও কাজ করতেন বিজ্ঞাপনের। ‘আমুল’— এই যে মাখন, তার চমৎকার বিজ্ঞাপন হোর্ডিং পাল্টে যেতে দেখতাম প্রতি সপ্তাহে। টালিগঞ্জ বা গড়িয়া থেকে যাওয়ার সময় পার্ক স্ট্রিটের আগে সেই হোর্ডিং-স্থল। শূন্যে ভেসে থাকা ‘আমুল’-এর অ্যাড-মহিমা ক্রিকেট থেকে দেশ-বিদেশের রাজনীতি— সবই আছে এর মধ্যে। সেই বিজ্ঞাপন— ক্যাপশন ও ছবি খবরের কাগজ, সাময়িক পত্রের পাতাতেও। ক্রিকেট ও রাজনীতি নিয়ে বহু কথা বলেছে আমুল মাখন বিজ্ঞাপন। তার একটি ক্যাপশন, অবশ্যই ইংরেজি ক্যাপশন মনে আছে— ‘আটারলি কাটারলি আমুল’। সিদ্ধার্থ ঠাকুরের বিজ্ঞাপন কোম্পানি বাজারে চলেনি। কিন্তু তিনি তাঁর অ্যাড এজেন্সির জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। পরিশ্রম অর্থে সিদ্ধার্থ ঠাকুর যতটা শ্রম করতে পারেন, তেমন আর কি। তাঁর পৃথিবীর ও মর্জি অনুযায়ী এই শ্রমের গতি-প্রকৃতি। শাঁটুল বাবু— আরপি— তিনি ছিলেন টাটা কোম্পানির চিপ আরও। পুরনো কলকাতা নিয়ে আরপি— রবিপ্রসাদ গুপ্তর ছিল প্রচুর আগ্রহ। কাজও করেছেন তিনি কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর মাছ নিয়ে। সার্কাস নিয়েও একটা বড়ো কাজ ছিল আরপি-র, সেই প্রসঙ্গে আগেও লিখেছি ‘মুছে যায়?’-তে। আপাতত, থাক সেই প্রসঙ্গ। ‘জনসন অ্যান্ড নিকলসন’— রং কোম্পানির এই বিজ্ঞাপন হোর্ডিংও ছিল দেখার। বারে বারে, সম্ভবত সপ্তাহে সপ্তাহে পাল্টে যেত সেই টালিগঞ্জ বা গড়িয়া থেকে পার্কস্টিট যাওয়ার আগে ডান পাশে টাটা সেন্টারের কাছাকাছি সেই হোর্ডিং। যা কলকাতার আকাশে উজ্জ্বল ফুল হয়েই ফুটে থাকে। রাম রে স্থূল, চেহারায় অনেকটা যেন স্বরাজ পাল। এই স্বরাজ পাল বা স্বরাজ পল— ভারতীয় শিল্পপতি আশির দশকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তখন খবরের কাগজ, সাময়িকপত্র জুড়ে স্বরাজ পল, স্বরাজ পল। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি— সব পত্রপত্রিকাতেই স্বরাজ পল, প্রায়ই কখনও কভার স্টোরিতে, কখনও খবরে। খবরের কাগজে সবসময়ই ফার্স্ট পেজের— পয়লা পাতার লেআউটকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয় তখনও। ইংরেজি স্টেটসম্যান— তখনও বাংলা স্টেটসম্যান প্রকাশিত হয়ইনি, অথচ বাজারে একটা এই কথা বলার রেওয়াজ আছেই— ‘স্টেটসম্যান’ বাংলা দৈনিক নিয়ে বাজারে আসছে। সেটা আশির দশকের কথা। ফার্স্ট লিড, সেকেন্ড লিড, অ্যাংকার স্টোরি, বড়ো, দামি বিজ্ঞাপন থাকলে খবরের কাগজের ডান দিকের একেবারে নিচে— কোণের দিকে, এই যে ব্রিটিশ— কনভেনশনাল পেজ মেক আপের ধারা, তা স্টেটসম্যান অনুসরণ করত। প্রথম পাতায় বড়ো জোর দুটো ডাবল কলাম, একটা সিঙ্গল কলাম খবর, যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলেই। আমি সিঙ্গল কলাম খবরের ব্যাপারে বলছি। এর সঙ্গে একটা চার বা ছকলাম ছবি, নয়তো কার্টুন। পরে ‘টেলিগ্রাফ’ আসার পর গোটা প্রথম পাতাটাই ভাঙচুর হয়ে গেল আমেরিকান জার্নালিজম-এর স্টাইলে। খবর সাজানোর গোটা ব্যাপারটাই— লে আউট, ভেঙে দিল আমেরিকানরা। আর তাকেই মোটামুটি অনুসরণ করল কেউ কেউ। আনন্দবাজার বাড়ির ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ বন্ধ হয়ে গেল। এই ইংরেজি দৈনিকে কিন্তু খুব বেশি ভাঙাভাঙি ছিল না। আমি পয়লা পাতা— ফার্স্ট পেজ-এর কথা বলছি। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-কেও এই লে-আউট ভাঙার তরঙ্গ স্পর্শ করেনি। মাস্ট হেড— খবরের কাগজের নাম ঠিকঠাক একদম পয়লা পাতায় রাখার ব্যাপারটা তেমনই রইল। নয়ের দশকে ‘যুগান্তর’-এর প্রথম পাতা, খবর সাজানো, তার সঙ্গে ছবি, ফিচার পাতার ছবি— সবকিছু বদলে দিয়ে তথাকথিত ‘আকর্ষণীয়’ করে তুলতে চাইলেন তুষারকান্তি ঘোষের জ্যেষ্ঠা কন্যা রীতা দত্ত ও তুষারবাবুর নাতি তুহিনকান্তি ঘোষের স্ত্রী— সুবর্ণা ঘোষ। তাঁরা দুজনেই তখনকার সময় ঘিরে মনে করলেন ছবি সাজানো ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ভেতরের পাতায় ছবি সোজা নয়, বাঁকিয়ে দেওয়াটাই হচ্ছে আধুনিক পেজ মেকআপ ও লেআউট। এ ব্যাপারে তিনি ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র আর্ট ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দিলেন আর শুধু নির্দেশই দিলেন না, কোনাকুনি, বাঁকা করে বসানো যে আধুনিক লে আউটের নিদর্শন, তাও বললেও, আদেশের ছলেই। ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র আর্ট ডিপার্টমেন্টে তখন অতনু— অতনু বসু, শান্তি গোপাল প্রমুখেরা রয়েছেন। আছেন আরও দু-চারজন। এক অতনু ছাড়া এঁরা কেউ-ই ‘আর্টিস্ট’ নন। তাঁরা রাবার সলিউশান দিয়ে পিটিএস-এ কম্পোজ করা ম্যাটার কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে লাগান পাতার মাপে তৈরি ‘ব্লুশিট’-এর গায়ে। তারপর জমানো রাবার সলিউশনের ছোটো-বড়ো রাবার ব্ল বানিয়ে সেই পেস্ট করা পাতা পরিষ্কার করা, নাহলে ছাপায় ময়লা দাগ এসে যাবে। তখন আশি-নব্বই দশকের কথা বলছি। রোটারিং কলমে সরু, মোটা রুল টানা হত। বিভিন্ন মাপের কলম ছিল। তা দিয়েই সরু, মোটা রুল হত। ফিচার-পাতায় ছবিরা ঝুলত নিমকি হয়ে। অদ্ভুত তাদের সাজানো। তিন কোনা, বাঁকানো ছবি। রীতা দত্ত তুমুল ফর্সা, একেবারে দীর্ঘদিন ইট চাপা গায়ের রং। ফ্যাটফ্যাটে সাদা। আগেও একবার লিখেছি, আবার লিখছি— তিনি কবি ও সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তর ছোটো ভাই সমীর দত্তকে বিবাহ করেন। সমীর দত্ত একসময়— গোড়ার দিকের ‘আজকাল’-এর রবিবাসরীয় দেখতেন। সেখানেও বাঁকা করে বসানো ছবির খেলা দেখেছি। জ্যোতির্ময় দত্ত জরুরি অবস্থা উত্তর জেল মুক্তির পর ‘যুগান্তর’-এর পরের পাতায় ‘কোমল ক্যাকটাস’ লিখতেন। ‘কোমল ক্যাকটাস’ ছাড়াও অন্য অন্য নানা লেখা। কলকাতা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি, লিটল ম্যাগাজিন। জরুরি অবস্থা কালে ‘কলকাতা’, ‘কলকাতা’-র সম্পাদক— সবাই গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের নজরে পড়ে। এই নজরদারি ছিল আগে থেকেই। গ্রেপ্তার হন জ্যোতির্ময় দত্ত। পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ‘যুগান্তর’। চাকরি করতেন না। আশির দশকে ‘বঙ্গোপসাগর’ নামে একটি ট্যাবলয়েড বার করেন। খুব বেশিদিন বেরোয়নি। শম্ভু রক্ষিত— কবি শম্ভু রক্ষিত খুব প্রিয়জন ছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত ও তাঁর পরিবারের। রীতা দত্ত আর্ট ক্রিটিক হিসাবে ‘টেলিগ্রাফ’-এ চিত্রকলা সমালোচনা করেন বহু বছর। তাঁর ও সমীর দত্তর সহজীবনে— দাম্পত্যে কোনো সন্তানাদি নেই। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ পরে তাঁকে— রীতা দত্তকে ‘যুগান্তর’-এর নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকের বাড়িতে অকারণেই হঠাৎ হঠাৎ দৌড়ে যেতে দেখেছি। তাঁর মাথার চুল ঈষৎ লালচে, দীর্ঘ, গোছও আছে। মুখশ্রী খুব খারাপ। সুবর্ণা ঘোষের— তুহিনবাবুর স্ত্রী সুবর্ণা ঘোষের কেশও দীর্ঘ। তিনিও যথেষ্ট ফর্সা। ওড়িশার কন্যা তিনি। এসব কথা ‘মুছে যায়?’-তে লিখেছি আগে, অন্যভাবে। তাঁতে বোনা রঙিন শাড়ি পরতেন তিনি। রীতা দত্তর পায়ে ব্যাকবেল্ট। সুবর্ণ ঘোষ চামড়ার স্যান্ডেল। সোমেন মুখার্জি ছিলেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র বহু পুরনো সাংবাদিক। সোমেনদা ডক্টরেট। ক্যানসারে মারা যান। ঈষৎ খর্বকায় সোমেন মুখোপাধ্যায় বিবিধ বিষয়ে কথা বলতেন। প্রশান্ত সরকার— প্রশান্তদা দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক হয়ে এলে সোমেনদা মাঝে মাঝে ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে আড্ডা মারতে আসতেন। হাফ শার্ট— বুশ শার্ট, ফুল প্যান্ট— টেরিকটের। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় সিনিয়ার সাংবাদিক প্রদীপ্ত সেন। প্রদীপ্তদা সিনেমাটা খুব বুঝতেন। সিনেমা নিয়ে তাঁর বহু লেখালেখি। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-তেও ফিল্ম নিয়ে লিখতেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি চমৎকার লিখতেন। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট, সাদা-রঙিন ডোরাকাটা কলারঅলা টিশার্ট, চোখে বাহারি, রিমলেস চশমা, হাতে ঘড়ি নেই, পরতেন না, যতদূর মনে পড়ে। কাঁচাপাকা কোঁকড়া চুল উলটে আঁচড়ানো। ফর্সা, চওড়া কপাল। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মুখ, কথাও। ক্রিকেট আর সিনেমা তাঁর প্যাশন। বরাবর বামপন্থী। খুব ভালো সম্পর্ক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-সহ আরও কয়েকটি পত্রপত্রিকায় সিনেমা নিয়ে লিখতেন মৃগাঙ্কশেখর রায়। একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়। মাথায় কোঁকড়া চুল উলটে আঁচড়ানো, দাঁত প্রায় সব পড়ে গেছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। প্রবল মদ, অনবরত সিগারেট। সিনেমাটা ভালো বুঝতেন। কলকাতা ফিল্মোৎসবে মৃগাঙ্কশেখক রায় ও প্রদীপ্ত সেন বেশ বড়ো ভূমিকা পালন করতেন, তখন বামফ্রন্টের শাসনকাল। মৃগাঙ্কশেখর রায় ‘যুগান্তর’-এও লিখেছেন ফিল্ম নিয়ে। তাঁর পরনে ঢিলে পায়া পায়জামা আর হ্যান্ডলুম বা খাদির পাঞ্জাবি, শীতে জহর কোট তার ওপর— এই তো চেনা, অতিচেনা পোশাক। মৃগাঙ্কশেখর রায় একটি অতি বড়ো অভ্যাস হাতের নখ ক্রমাগত দাঁতে কাটা ও ‘থুথু-থু’ করে ফেলা। ফেলে দেওয়া। এই করতে করতে তাঁর ডান, বাঁ— দুহাতের নখই সরে গিয়ে সাদা, ফ্যাকফ্যাকে চামড়া। তাঁর অতি পরিচিত কেউ কেউ রসিকতা করে বলতেন, মৃগাঙ্কশেখর রায় নিজের হাতের আঙুলের নখ খেতে খেতে খেতে কনুই পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকার অফিসে, তাঁকে কখনও কখনও সামান্য অস্থির অবস্থায় সিগারেট ধরাতে দেখেছি, কাঁপা আঙুলে। দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেটের মাথায় সংযোগ করতে গিয়ে আঙুল রতিমতো কেঁপে কেঁপে ওঠা দেখেছি। তাঁর চোখে চশমার কাচে কাচে তখন দেশলাইয়ের জোড়া আলো। কল্যাণ চৌধুরী ছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকার সিনিয়ার রিপোর্টার। খুব গুণের জন। প্রখ্যাত অভিনেতা— আমি ইচ্ছে করে অভিনেতাই লিখলাম, অভিনেত্রী নয়, অত্যন্ত সচেতন ভাবেই, কাজল চৌধুরী ছিলেন তাঁর সহজীবনের মানুষ। কল্যাণদা প্রখ্যাত ডাক্তার নর্মান বেথুনকে নিয়ে লেখা গ্রন্থ— ‘স্ক্যালপেল অ্যান্ড সোর্ড’ অনুবাদ করেছিলেন ‘মহাচীনের পথিক’ নামে। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘সুবর্ণরেখা’ ছিল এই বইয়ের প্রকাশন। মোটা মোটা বই। প্রচ্ছদে ডাক্তার নর্মান বেথুনের ছবি। মাও সে তুঙের ‘তিনটি লেখায়’ ‘নর্মান বেথুন স্মরণে’ বলে একটি ছোটো লেখা আছে। তাতেই নর্মান বেথুনকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মাও-সে-তুঙ লিখেছেন— ‘জনগণের জন্য যাঁরা প্রাণদান করেন, তাঁদের মৃত্যু ঘাই পাহাড়ের থেকে ভারি। আর ফ্যাসিস্টদের জন্য যারা প্রাণ দেয়, তাদের মৃত্যু বেলেহাঁসের পালকের চেয়ে হালকা’। সত্তর দশকে মাও-সে-তুঙের কোটেশন সংগ্রহ— ‘রেডবুক’-এর সঙ্গে ‘তিনটি লেখা’-ও খুব চলত। এসব ছাপা পিকিং-য়ে। তখনও পিকিং হয়নি বেজিং আর মাও-সে-তুঙ হননি মাও-জে-দং। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশব্রতী প্রকাশনী ‘মাও-সে-তুং’-এর রেডবুক ছাপে ১৯৭৩ সালে। দশটাকা দাম ছিল। তবে চীনে ছাপা রেডবুক-এর— লাল বইয়ের সাইজ নয় একেবারেই। খানিকটা লম্বাটে গড়ন। বইয়ের ফিনিশিং বা কাগজের কোয়ালিটি ভালো নয়। পিকিং থেকে ছাপা বইটির কাগজ অনেকটা যেন টিস্যু পেপার, বেশ পাতলা। তো সে যাক গিয়ে। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সাংবাদিক কল্যাণ চৌধুরীর মাথা জোড়া টাক। চোখে রিমলেস চশমা। গরমে কলারঅলা টিশার্ট, কটনের। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট। পায়ে স্যান্ডেল। নাকের নিচে চওড়া সাদা— পাকা গোঁফ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র প্রথম পাতায় প্রকাশিত আরকে লকসমনের কার্টুনের অতি চেনা ‘কমন ম্যান’। অন্তত টাকে ও গোঁফে সেই সাদৃশ্য বিদ্যমান। লক্ষ্মণ বা লকসমন, যাই বলি না কেন, অসাধারণ আঁকতেন কার্টুন, সেখানে ‘কমনম্যান’— দুর্দান্ত। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র পয়লা পাতা ছাড়াও ভেতরের পাতায় কার্টুনের ‘কমনম্যান’ হাজির, ব্যঙ্গচিত্রের অন্যতম অভিব্যক্তি হিসাবে। আরকে লকসমন ছাড়াও অনু আব্রাহাম, সুধীরদা (ধর?) আঁকতেন সর্বভারতীয় পত্রিকা, দৈনিকের কার্টুন। যতদূর মনে পড়ে আবু আব্রাহামের কার্টুন বেরোত ‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এ। কল্যাণ চৌধুরী- কল্যাণদা হিন্দু পত্রিকার ম্যাগাজিন ‘ফ্রন্টলাইন’-এ লিখতেন প্রায় নিয়মিত। কল্যাণদার আর একটি ‘বড়ো কাজ’ ভোগপুরে নকশালপন্থীদের সংগঠন, সংগঠন বিদ্রোহের শাহদত নিয়ে। একেবারে রক্তাক্ত, অখণ্ড শাখা। কল্যাণ চৌধুরী ছিলেন অসামান্য। তাঁর ঘাড় থেকে ঝুলে থাকা টাকের অবশিষ্টও দেখবার। সবটা মিলিয়ে কল্যাণদা— কল্যাণ চৌধুরী খুবই গুণের মানুষ। তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল নাটকে, গানে। সিনেমাতেও। ‘সুবর্ণরেখা’-র ইন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন তাঁর ‘বিশিষ্ট’ বন্ধু। প্রায় বিকেলেই তাঁকে দেখা যেত ‘সুবর্ণরেখা’-র গুদাম-সদৃশ বইঘরে। ভেতরে ইন্দ্রনাথ মজুমদার। দেওয়ালে সাঁটা একটি সাদা-কালো ছবিতে ইন্দ্রনাথ ও কমলকুমার মজুমদার। সম্ভবত হ্যারিকেনের আলোয় তাঁরা পানে, ভোজনে। সে যেন এক রঙিন জীবনোৎসব। কল্যাণদা— কল্যাণ চৌধুরীর সঙ্গে খুব সখ্য ইন্দ্রদার, ইন্দ্রনাথ মজুমদারের। পান ইত্যাদিতে, যদিও ইন্দ্রদা ‘বাংলা’-র পক্ষে— ‘বাংলা’-র কনোশার। কল্যাণদা— কল্যাণ চৌধুরী তা একেবারেই নন। তিনি হুইস্কি। কল্যাণদা ভালো ক্রিকেটও খেলতেন। সিপিআই (এম)-এর সঙ্গে তাঁর খুবই সুসম্পর্ক। বিশেষ করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জ্যোতি বসু, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, সকলের সঙ্গেই আছেন কল্যাণদা। ভালো সম্পর্ক। আবার তথাকথিত র্যাডিক্যাল রাজনীতির মানুষজনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক খুবই ভালো। কল্যাণদা, কাজলদি প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর। চলে যাওয়ার আগে কাজলদি দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। উঠতেই পারতেন না প্রায়। আগেই বলেছি। খুব বড়ো অভিনেতা কাজলদি— কাজল চৌধুরী। প্রায় নিঃশব্দেই চলে গেলেন। এমনই হয় এই পোড়া বঙ্গভূমে। তৃপ্তি মিত্র (ভাদুড়ী) তাঁকেই বা মনে রেখেছেন কজন? ক্যানসারের ক্ষয় একটু একটু একটু করে গ্রাস করল তৃপ্তিদিকে। একাই থাকতেন, প্রায়। শম্ভুদা— শম্ভু মিত্রর সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই প্রায়।
Powered by Froala Editor