ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস প্রতি মাসে, প্রতি সপ্তাহের হিসাবেও হয়তো, প্রকাশ করত কাহিনিগ্রন্থ। ঘনাদার ওপর লেখা প্রেমেন্দ্র মিত্রর বই ওরা প্রকাশ করত, প্রায় একচেটিয়া ভাবে। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড-এর ঘনাদা— ঘনশ্যাম দাস অজিত গুপ্তর আঁকাই সব থেকে বেশি প্রচারিত, প্রচলিতও। অজিত গুপ্ত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সত্তর দশকে ছবি তোলা ও ইলাসট্রেশন করা কুমার অজিতের কথা মনে পড়ল। বেশ ফর্সা, সুদর্শন, মাথাভর্তি চুলের অধিকারী কুমার অজিত গল্পের সঙ্গে ছবি আঁকতেন, বইয়ের মলাট নির্মাণ করতেন, খুব ভালো ফোটোগ্রাফি করতেন। তখন তো লেটারপ্রেসের যুগ। সীসের টাইলে ফর্মা কম্পোজ করে— টাইপ গেঁথে ফর্মা স্ট্যান্ডিং রাখার যুগ, পনেরো, ষোলো আবার সতেরো ফর্মাও একসঙ্গে স্ট্যান্ডিং। বিমল মিত্রের ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’, বিনয় মুখোপাধ্যায়— ‘যাযাবর’-এর গ্রন্থ— ‘হ্রস্বদীর্ঘ’, ‘ঝিলম নদীর তীরে’ ছাড়াও আর একটি বই— ‘দৃষ্টিপাত’ সবসময় স্ট্যান্ডিং থাকত। ‘শীতে উপেক্ষিতা’— রঞ্জন-এর বইটির ভালো বিক্রি থাকলেও, তার যে খুব স্ট্যান্ডিং ফর্মা থাকত, এমন তো নয়। শংকর— মণিশংকর মুখোপাধ্যেয়ের ‘চৌরঙ্গী’, ‘কত অজানারে’, কালিকানন্দ অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’, সব সময় বিক্রির শীর্ষবিন্দুতে থাকত। কালিকানন্দ অবধূতের ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’, ‘হিংলাজের পরে’, ‘ফক্কড়তন্ত্রম’— সবই ভালো বিক্রি হত। তবে খুব ভালো বিক্রির তালিকায় ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ আর ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’। ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’-এর ‘কুবের বাবা’ নামের চরিত্রটি এক অতিঅদ্ভুত মানবদর্পণাভাস— বাংলা সাহিত্যে। কুবার বাবা খানিকটা অন্যরকমও বটে। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে এক অদ্ভুত রস নিয়ে এল, অদ্ভুত রস না বলে, তাকে বীভৎস রস বলাই ভালো। অবধূতবাবা, ভৈরবী-মা, কুন্তি, থিরুমল— একের পর এক চরিত্র। মরুতীর্থ হিংলাজ সিনেমা হিসাবেও যথেষ্ট নাম করে। যাকে বলে, হিট ছবি। অভিনয়, গান— সবমিলিয়ে সে এক আশ্চর্য অভিযাত্রী-কথা। হিংলাজমাতা, আকাশগঙ্গা, চন্দ্রকূপ সবই কেমন যেন সহস্যমাপা, ছায়া ছায়া বর্ণনাঘোর। কালিকানন্দ অবধূত থাকতেন চুঁচড়োতে। সেই বাড়িতে আমি একাধিকবার গেছি। লিখেওছি ‘মুছে যায়?’-তে আগে আগে। কালিকানন্দ অবধুতের সেই বাড়িটিও বেশ রহস্যাতুর। তা নিয়ে পুনরায় কোনো উচ্চারণে আপাতত আর যাচ্ছি না। অবধূত— কালিকানন্দ অবধূতের সেই বাড়ি লাগোয়া গঙ্গা। গঙ্গার ঘাট। গঙ্গার ঘাটে অনেক অনেক কুকুর। বেশ তাগড়া। এরা সবাই নাকি ভৈরবী মায়ের পোষা কুকুর-কুক্করীদের কালীনন্দ অবধূতের ভৈরবী, এইসব কুকুরদের দেখাশোনা করতেন, যতদিন তিনি বেচে ছিলেন, যতদিনে তাঁর শারীরিক সামর্থ ছিল। কালিকানন্দ অবধূতের আরও যে লেখাটি নিয়ে বেশি আলোচনা— তার নাম ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’। অবধূতবাবার গদি ছিল উদ্ধারণপুরে অতিবিখ্যাত। মড়ার— শ্মশানে আসা মৃতদেহের কাঁথা, কম্বল, চাদর— সবই ছিল অবধূতবাবার গদির উপকরণ। একটার ওপর আর একটা, তার ওপর একটা। এভাবেই ক্রমশ উঁচু হতে থাকে অবধূতের গদি। এই আখ্যানে ‘অন্তা’ বলে একটি চরিত্র আছে। যাঁকে বার বার সম্বোধন করেছেন, ডাক দিয়েছেন অবধূত। তাঁর কলমে ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট হাসিকান্নার ঘাট’— এই কথাটি বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে আখ্যানযাত্রায়। আর এসেছে অন্তার কথা। অন্তাকে ডাকাডাকি করার কথা। আজ থেকে অন্তত পঁচিশ বছর আগে উদ্ধারণপুরের ঘাট দেখতে গেছিলাম, ভরা জষ্ঠিতে— দশহরার দিনে। দশহরার দিন অর্থে গঙ্গাপুজো। সেই গঙ্গাপুজোর দিনেই উদ্ধারণপুরের ঘাটজুড়ে মেলা— জিলিপির দোকান, বেশ কয়েকটি আর সেইসঙ্গে অন্য অন্য সামগ্রী। কাটোয়া থেকে গেছি উদ্ধারণপুর, নৌকোতে। গঙ্গা ধরে ধরে। যতদূর মনে পড়ে বাসও যায় উদ্ধারণপুরে। পাতাসে অমধুর গরম। যদিও আকাশে ক্বচিৎ মেঘের আনাগোনা। কখনও কখনও বৃষ্টি। আবার রোদ। উদ্ধারণপুরের ঘাটে শবদাহে আসা লোকজনের কী কী অভিজ্ঞতা, তা তো বিস্তারে লিখেছি আগে, এই কলমে। পুনরায় নতুন করে আর যাচ্ছি না সেই পথে। কালিকানন্দ অবধূতের ‘হিংলাজের পরে’ একটি চমৎকার গ্রন্থ। কীভাবে হিংলাজ ফেরত একজন সনাতনধর্মী যাত্রী কোটেশ্বর ভৈরব— শিবের কাছে এসে ত্রিশূল পরশ করে পায়ের ছাপও নেয় ও ‘শুদ্ধ’ হয়, সে এক অতি রোমাঞ্চময় বিবরণ। লোহার আগুনে গনগনে অতিতপ্ত ত্রিশূল শরীরে ছাপ দিলে বড়ো ফোসকা, তারপর ঘা। এ যেন এক মরণস্পর্শ বিশুদ্ধির আয়োজন। মরণস্পর্শ জনিত যে পাপ, তারই— তা থেকে ‘মুক্তি’-র জন্যেই ত্রিশূলের ছাপ। কালিকানন্দ অবধূত তাঁর বই বিক্রির নিরিখে তখনকার বহু বেস্ট সেলারি ‘লেখকবাবু’-কে ধরাশায়ী করেছেন যখন, তখন ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর অন্যতম কর্ণধার, কথাকার গজেন্দ্রকুমার মিত্র, যাঁকে আমি ‘কাকাবাবু’ বলেই সম্বোধন করতাম, তিনি আমায় জানিয়েছিলেন, তোরা কী ‘বেস্ট সেলার, বেস্ট সেলার বলিস’! অবধূতের বই বেরব— এমন একটা কথা ঘোষণা লাল শালুতে লিখে ‘মিত্রও ঘোষ’-এর কলেজস্ট্রিট কাউন্টারে টাঙিয়ে দিলেই মানুষের লাইন দেওয়া ভিড়। লোক আর লোক। সকলেই বই কিনতে আগ্রহী, কালিকানন্দ অবধূতের নতুন বই। অবধূত নিজে কালীপুজো করতেন তাঁর চুঁচড়োর বাড়িতে। বহু নামকরা জন— সাহিত্যিক, প্রকাশক, পুলিশের বড়োকর্তা, আমলা, ভাগ্যান্বেষী— সবাই হাজির থাকতেন কালীপুজোর রাতে— চুঁচড়োর বাড়িতে। ভিড়ে-ভিড়াক্কার দশা। কালিকানন্দ অবধূত নাকি স্বাধীনতা আন্দোলনে— অগ্নিপথের পথিক, সশস্ত্র বিপ্লবের পথে হাঁটা মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশের হুলিয়াতেই তিনি নাকি বেঘর হন— ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর তাঁর সন্ন্যাসজীবন। যে ভৈরবী মা-র কথা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ নামের গ্রন্থে আছে, সেই ভৈরবী-মা বাস্তবেই ছিলেন। কালিকানন্দ অবধূতের প্রয়াণের বেশ কিছু বছর পর তিনি প্রয়াত হন। সেই খবর নাম করা বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত হয়। মরুতীর্থ হিংলাজ-এ ভৈরবী-মাতার ভূমিকায় অভিনয় করেন চন্দ্রাবতী। কালিকানন্দ অবধূত চরিত্রটি করেন বিকাশ রায়। কুন্তি— সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, থিরুমল— উত্তমকুমার। ছড়িদার— অনিল চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও ছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। খুব হিট ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। তা নিয়ে আর একটি কথাও আর বিস্তারে বলছি না। খবরের কাগজ কেন্দ্রিক পাবলিকেশন— বই ইত্যাদি ছাপা পঞ্চাশ-ষাটে তেমনভাবে কোথায়? তবু বলি, প্রায় তখন থেকেই লেখকদের ওপর এই চাপটা বহাল থাকে। পশ্চিমবাংলার বাইরে এভাবে প্রায় সাঁড়াশি হয়ে চেপে বসা শর্তাবলি একটু একটু করে কঠিনতর হয়। খবরের কাগজ কেন্দ্রিক সাহিত্য ভারতবর্ষের আর কোনো রাজ্যে কিন্তু প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যত আক্রমণ, দায়, রফা পশ্চিমবাংলায়। বহু দিন ধরে লক্ষ্য করে দেখেছি—
১। দৈনিক পত্রিকা তথাকথিত সাহিত্যনিয়ন্ত্রক।
২। দেশের অন্য কোথাও এমনটি হয় না।
৩। খবরের কাগজ— বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র থেকে মানুষ ‘সত্য’-র মাপকাঠি বলেছে, তবে থেকে সাহিত্যের বিভিন্ন সংগঠন। এই সংগঠন কখনও কখনও গোলমাল পাকিয়ে দেয়। সমস্যা সেটাই। সাহিত্য যখন সাংগঠনিক শেকলের মধ্যে বাঁধা পড়ে, তখন তার চরিত্র বদলে দেওয়া হতে থাকে। পশ্চিমবাংলায় হয়েছে মূলত ষাট দশক থেকে। বাংলা ভাষার মিডলরোড পত্রিকা— সিনেমা সাহিত্য সব একসঙ্গে থাকত, এক এক করে উঠে গেল। কালীশ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘রূপকথা’, হেমেন্দ্রকুমার রায় সম্পাদিত ‘নাচঘর’, ‘জলসা’, ‘উল্টোরথ’, ‘উচ্চরথ’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘মৌসুমী’, ‘উত্তম’— সব এক এক করে বন্ধ হয়ে গেল। ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শনিবারের চিঠি’ বন্ধ হল ধীরে ধীরে। কোনোরকমে জেগে থাকল ‘নবকল্লোল’, ‘প্রসাদ’। ‘ঘরোয়া’ বন্ধ হয়ে গেল। সেইসঙ্গে সাহিত্য কাম সিনেমার অন্য অন্য পত্রিকাও। টুলু দাস খুব ছবি তুলে দিতেন ‘প্রসাদ’ পত্রিকায়। মোনা চৌধুরী ছবি তুলতেন ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়’। ‘যুগান্তর-এর ফটোগ্রাফি বিভাগটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। শ্যাম মল্লিক ‘দৈনিক বসুমতী’ থেকে সাংবাদিকতা করতে চলে আসেন ‘যুগান্তর’-এ, ঘরবদল করলেন। শ্যাম মল্লিক পান-রসিক, সন্ধ্যার পর বহুদিনই কলকাতা প্রেস ক্লাবে তাঁর সরব উপস্থিতি দেখেছি। টুলু দাস উত্তমকুমার, তার সাদা প্যান্ট, সাদা টিশার্ট, সাদা কেডস পরা টেনিস খেলার আগে-পরের ছবি আমরা দেখেছি ‘প্রসাদ’-এর পাতায়। ‘তুলি’ বলে একটি সিনেমা পত্রিকা বেরত চেতলা থেকে। তপন দাস (?) ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। ইংরেজিতে ‘প্রেস’ লেখা। ‘ভেসপা’ স্কুটারে চড়ে তপন ছুটে বেড়াত এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। তার বাড়ি চেতলায়। আমরা অনেকেই তাকে পেছনে ‘ছাগল তপন’ বলতাম। তপন তার কাগজে প্রায়ই ‘তুলি’ পড়ছেন উত্তমকুমার, পাশে পত্রিকা সম্পাদক তপন… ইত্যাদি প্রভৃতি। অথবা ‘তুলি’ পড়ছেন সুচিত্রা সেন, ‘তুলি’ পড়ছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ‘তুলি’ পড়ছেন মাধবী মুখার্জি, ‘তুলি’ পড়ছেন মাধবী মুখোপাধ্যায় নয়, মাধবী মুখার্জি। ‘তুলি’ পড়ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ‘তুলি’ পড়ছেন অনিল চট্টোপাধ্যায়— ইত্যাদি প্রভৃতি। কারোর ওপর ভরসা নয়। স্কুটার— ভেসপা স্কুটার নিয়ে একাই শশব্যস্ত খবর সংগ্রাহক তপন দাস। বেশ মোটাসোটা। চেহারায় শারদীয় ‘তুলি’-র অধিকাংশ লেখাই পুরনো ‘প্রসাদ’ আর ‘উল্টোরথ’ থেকে নেওয়া। তপনের চরিত্র-কথার কোনো শেস নেই। হবেও না। সিনেমার খবরও ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে, নিজের কাগজে ছাপতে দেওয়া, এই আরকি। বিকাশ বসু ছিলেন ‘উল্টোরথ’-এর মালিক, সম্পাদক। তাঁর বাড়িতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছি। কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে কাজের লোক দরজা খুলে দিয়েছেন। দোতলায় থাকেন তিনি। সাদা ধুতি, সাদা— হাতকাটা সামারকুল, স্যান্ডো গরমের দিনে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। বিকাশ বসু দিলীপবাবুর ওপর উল্টোরথের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেকটাই। এই দিলীপবাবুই একটু একটু করে ‘উল্টোরথ’-এর দখল নেন। তিনি ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। সব সময় গম্ভীর। সদাগম্ভীর। রোগা, চোখে চশমা, গাল বেশ কাপটা, অনেকটা যেন অজিত গুপ্তের আঁকা ঘনাদা। দিলীপবাবু কথা বলেন অতি কম। যেন প্রায় না বলাই তাঁর ধর্ম— এটা ঘোষণা না করেও তো বুঝিয়ে দেওয়া যায়, এভাবেই— এমন করেই তার জীবন যাপন, অন্তত সেই স্বপ্নঘোর না রেখেও দিলীপবাবু কত কি করেন। তাঁর পরনে প্রায় ডাংরি ধরনের, মুখে হাসি। খুব গম্ভীর সদা। সর্বদা। দিলীপবাবু বেশ কয়েক বছর উল্টোরথ চালিয়েছেন। মোটা মোটা পুজো সংখ্যা প্রকাশ করেছেন, উল্টোরথ-এর সঙ্গে ‘সিনেমাজগৎ’ নামে একটি সিনেমা-পত্রিকা বেরত। সিনেমাজগৎ যেন ‘উল্টোরথ’-এর তুলনায় খানিকটা কমা ছিল। অর্থাৎ ‘উল্টোরথ’-এ লেখা আর ‘সিনেমাজগৎ’-এর লেখার মধ্যে— দুইয়ের মধ্যে ফারাক অনেক অনেক। ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’, ‘সিনেমাজগৎ’— সবেতেই পুজো সংখ্যায়— শারদ সংখ্যায় উপন্যাস বেরত। ‘ঘরোয়া’-তেও। ‘সিনেমাজগৎ’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’-এ উপন্যাস লিখতেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ বিশ্বনাথ রায়— এই বিশ্বনাথ রায় আবার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের জামাই। তিনি পেশায় চিকিৎসক। ‘নবকল্লোল’ পত্রিকায় নিয়মিত শারীরিক সমস্যার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে আলাপ ছিল। ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকা দপ্তরে তিনি প্রায়ই আসতেন কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর স্ত্রীর নাম বাণী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যারা ছিলেন গঙ্গা, বাণী। পুত্র সনৎকুমার, সরিৎকুমার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক কন্যা অকালপ্রয়াত হন। সেই দুঃখ বহুবছর আছন্ন করে রেখেছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাণী রায় নামে এক অধ্যাপক গল্প, উপন্যাস লিখতেন। গ্রিক মাইথোলজি ভেঙে বিষ্ণু দে যেমন বহু কবিতা নির্মাণ করেছেন, বাণী রায়ও তাই। বাণী রায় বিবাহ করেননি। দক্ষিণ কলকাতার লেকের কাছে তাঁর দোতলা বাড়ি। খুব সাজতেন তিনি, একা একাই সাজতেন। মুখে সবসময় ফেস-পাউডার, চোখে কাজল। তিনি দাবি করতেন কথাকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গুণমুগ্ধ। জীবনানন্দ দাশ বাণী রায়ের কথা বলেছেন তাঁর লেখায়। বাণী রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘রামায়ণী’ প্রকাশভবন থেকে। রামায়ণী প্রকাশ ভবনের সঙ্গে জড়িত আর একটি সংগঠন ছিল ‘স্যাঙ্গুইন পাবলিশার্স’। বাণী রায়ের একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ‘রামায়ণী’ প্রকাশভবন থেকে। তখন কথাকার অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রামায়ণী প্রকাশভবন ও স্যাঙ্গুইন পাবলিশার্স-এর উপদেশক। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনে— কথায় অনেক বই প্রকাশিত হত এই সংগঠন থেকে। ‘লেখকের লেখক দস্তয়েভস্কি’-র নির্মাতা যজ্ঞেশ্বর রায়ও ছিলেন ‘রামায়ণী’-র অন্যতম উপদেশক। ‘রামায়ণী’ থেকে যজ্ঞেশ্বর রায়ের বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘লেখকের লেখক দস্তয়েভস্কি’ ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কার পেয়েছিল। যজ্ঞেশ্বর রায় ‘চিল’ বলে একটি লিটল ম্যাগাজিন করতেন। সেই পত্রিকা নিরীক্ষামূলক লেখা ছাপত। যেমন ছিল ‘ঈগল’। যজ্ঞেশর রায় ‘চিল’ করে ষাটের ‘এই দশক’ গোষ্ঠীর অনেক অনেক গল্প ছেপেছেন। তখন তো ‘না কাহিনির যুগ’— এমন একটা প্রদর্শন করছিলেন এই দশক গোষ্ঠী। রমানাথ রায়, শেখর বসু, বলরাম বসাক, সুনীল জানা, কল্যাণ সেন, কল্লোল মজুমদার— এরকম অনেকে ছিলেন এই দশক গোষ্ঠীতে। তাঁদের সাহিত্য ভাষা ছিল একদম অন্যরকম। সুব্রত সেনগুপ্তও ছিলেন ‘এই দশক’-এ। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন ‘গোলগল্পের লোকেদের গুলি করা হবে’। সুব্রত সেনগুপ্তর ‘টোমাটো’ এই দশক ধারার গল্প। বলরাম বসাক শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন শিশুসাহিত্যে। তার আগে তাঁর লেখায় ‘মা মা মা মা। হাঁস হাঁস হাঁস হাঁস…’ ইত্যাদি সব লাইন। অমল— এখনই পদবি মনে পড়ল না, তিনিও ছিলেন ‘এই দশক’-এর অন্যতম লেখক। তিনি প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর। কথা হচ্ছিল কালিকানন্দ অবধূতকে নিয়ে। কালিকানন্দ অবধূত মারা গেছেন বহু বছর হয়ে গেল। জীবনের শেষ দিকে ‘দুরি বৌদি’ ধরনের লেখা লিখে তিনি খানিকটা তাঁর লেখকধর্মচ্যুত হলেন। কালিকানন্দ অবধূতের যে যে লেখা, তা মূলত বীভৎসরস আশ্রিত। পরবর্তী সময়ে যৌনতা ও শৃঙ্গারকে মূল উপজীব্য করে তথাকথিত ‘আধুনিক’ হতে গিয়ে তিনি নিজের সাহিত্যক্ষেত্রটি নষ্ট করলেন। অবধূতের লেখায় যৌনতা, শৃঙ্গারের অনুপান বরাবরই ছিল। কিন্তু তাতে বীভৎস রসই প্রধান। তন্ত্র সাধনা, ভৈরবী চক্র, ভৈরবী, শ্মশান, অজানা, প্রায় অজানা সাধনভূমি— এসবই তো কালিনন্দ অবধূতের লেখার মূল ক্ষেত্র। ভয়ানক প্রকৃতির শ্মশান, চিতাগ্নি, শ্মশানের পাশে বহে যাওয়া নদী— সবই অবধূতের সাহিত্য পরিমণ্ডল। এক সময় তাঁর চুঁচড়ার বাড়িতে বহুবার গেছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষরা। অবধূতের— কালিকানন্দ অবধূত বিরচিত পুস্তক একসময় খুবই বিক্রি হত, সে কথা তো বলেছি খানিক আগেই। তাঁর ‘ফক্কড়তন্ত্রম’ আরও একটি অদ্ভুত গ্রন্থ। সেই গ্রন্থের পরিচিতি তেমন খুব একটা নেই ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’, ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’-এর তুলনায়। কিন্তু ‘ফক্কড়তন্ত্রম’-এর ফক্কড় বিষয়ে যেভাবে লেখা হয়েছে, তা সত্যিই অভিনব।
Powered by Froala Editor