বাঙালির বই প্রকাশনা ছিল গোড়ায় গোড়ায় কম পুঁজির, অতি কম পুঁজির ব্যবসা। সবই প্রায় ধারে— কাগজ, ছাপার কালি, আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকানো ছবি আর লেখক— অথর, সে তো বিনা পয়সাতেই প্রায়। মলাটের ব্লক, ভেতরের ছবির ব্লক তৈরি— কোনোটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যাশ টাকায় নয়। আগেও লিখেছি, আবার লিখছি, বহু প্রকাশনের মালিকই ছিলেন হয় জেল খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী, নয়তো কমিউনিস্ট পার্টি করে জেলবাস করা মানুষজন। প্রখ্যাত পড়ুয়া লেখক ও তাত্ত্বিক রেবতী বর্মণ এভাবেই খুলেছিলেন তাঁর প্রকাশন সংস্থা। সম্ভবত সেই সংস্থার নাম বর্মণ পাবলিকেশন হাউস বা এরকম কিছু। কমিউনিস্ট পার্টি— অখন্ড ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি করা রেবতী বর্মণের কুষ্ঠ হয়েছিল। এভাবেই তৈরি হয়েছে ‘জিজ্ঞাসা’। শ্রীশচন্দ্র কুণ্ডা ছিলেন এর মালিক বা কর্ণধার। লেখক গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্য, যিনি কথাকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসম্ভব স্নেহধন্য ছিলেন আর বিভূতিভূষণ যাঁকে আদর করে ‘ফোতো’ বলে ডাকতেন। সেই গৌরী শঙ্কর ভট্টাচার্যর প্রকাশন সংস্থার নাম ‘মিত্রাণী’। বামপন্থী আদর্শ মনস্ক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুলেছিলেন ‘বিদ্যোলয় লাইব্রেরি’। দীনেশবাবুর এই প্রকাশন সংস্থা থেকে সুপ্রকাশ রায়ের অতিবিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ প্রকাশিত হয়। সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ খুবই পরিশ্রমী কাজ। সত্তর-একাত্তর সালে র্যাডিক্যাল রাজনীতি করা অখণ্ড সিপিআই (এম-এল) সমর্থক সদস্যরা অনেকেই এই কেতাবটিকে রাখতেন নিজেদের কাছে। সুপ্রকাশ রায়ের আরও একটি বই— ‘গান্ধীবাদের স্বরূপ’। তখন— ১৯৭০-৭১-এ এই বইটির অন্যরকম গুরুত্ব ছিল আমাদের অনেকের কাছে। এখন অবশ্য নতুন করে পাঠ করে সুপ্রকাশ রায়ের এই বইটি তেমন করে গা-গরম করতে পারে না। সে কথাও স্পষ্ট করে বলার সময় বহু বছর আগেই। আর বলেওছি, অন্যত্র। সে যাক গে, দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘কিশোরভারতী’ নামে ছোটোদের একটি অসামান্য পত্রিকা— মাসপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। শারদীয় সংখ্যা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘কিশোরভারতী’। মলাট এঁকেছিলেন তখনকার দিনের প্রখ্যাত শিল্পী সূর্য যায়। সূর্য রায় ধুতি, হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবির দুই হাতা সামান্য গোটানো। মাথার চুলে বয়সের চিহ্ন। সাদা, সাদা, সাদার ভাগ বেশি। পায়ে কমদামি চপ্পল। সেই পাদুকা ঘিরে ধুলো, ময়লার জাল। সূর্য রায়ের হাতে কোনোরকম আংটি বা গহনা নেই। থাকার কথাও তো নয়, যেমনটি হওয়ার কথা চেহারার বিবরণ, তেমনই ছিল তা। সূর্য রায়ের আঁকা মূলত রেখায়। কুচি কুচি, ছোটো বড়ো রেখা, তা থেকেই বেরিয়ে আসে ছবি। একেবারেই সূর্যবাবুর নিজস্ব স্টাইল বা ভঙ্গিমা। যাই হোক, তা রঙিন বা সাদা-কালোয় একইভাবে সূর্য রায় তাঁর আঁকা ইলাসট্রেশন, মলাট, ছবির কোণে ‘সূ’ লিখতেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল দেবসাহিত্য কুটির-এর পূজা বার্ষিকী— শারদীয় সংখ্যায় বীতপাল নামে বা দৃখ নামে একজন ছবি আঁকতেন। ছিলেন এরকম আরও দু-চারজন। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনাদা— ঘনশ্যাম দাস এঁকেছেন, সে-কথা আগেও লিখেছি। যতীন সেন ছিলেন অত্যন্ত বিখ্যাত ইলাসট্রেটর। পরশুরাম— রাজশেখর বসুর নানা অতিবিখ্যাত কাহিনির ইলাসট্রেটর তিনি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল যম দত্ত নামে একজন কলামিস্টের কথা। যম দত্ত থাকতেন বরানগরের দিকে। তখন বরানগর বা বরাহনগর মানে কলকাতা দূরবর্তী এক স্থান। থাক সেসব প্রসঙ্গ। পুনরায় ফিরে আসি প্রকাশন সংস্থা প্রসঙ্গে। ‘ভারতবর্ষ’-র প্রকাশক আর পাশাপাশি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় সব বইয়ের প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স, কার বই না ছাপেনি তারা। সেইসঙ্গে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবাসী’-র সঙ্গে একইসঙ্গে উচ্চারিত হওয়া সাহিত্যপত্র ‘ভারতবর্ষ’-র নাম। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশন-সূর্য বহু বছরই অস্তমিত। পাশাপাশি ডিএম লাইব্রেরির কথাও বলা চলে। গোপালদাস মজুমদার ছিলেন এর সর্বময় কর্ণধার। গোপাল দাস মজুমদার মানবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। একেবারে শেষ বয়সে তাঁকে দেখেছি ছোটো গামছা পরে কাউন্টারের পেছনে নিজেকে প্রায় অর্ধলুক্কায়িত করে বসে থাকতেন গরমের দিনে। গোপাল দাস মজুমদারকে কেউ কেউ— তাঁর ঘনিষ্ঠরা গোপা মজুমদার বলতেন। একমাথা কদমছাঁট পাকা চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ের রং বেশ কালো। বিডন স্ট্রিট— বিবেকানন্দ ক্রসিং-এ, ডিএম লাইব্রেরির বড়োসড় কাউন্টার। এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা, বিষের বাঁশি। সঞ্চিতা ও বিষের বাঁশি প্রকাশ, তারপর সেই বই বাবদ প্রাপ্য টাকা নিয়ে গোলযোগ, সবই তো ইতিহাসের অংশ। সেসব নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। কাজী সাহেব— কাজী নজরুল ইসলাম বড়োসড় বিদেশী গাড়ি কিনেছেন তখন তার খরচ আছে। স্ত্রী প্রমীলার দীর্ঘ অসুস্থতা, কোমরের অসুবিধা— সবই আছে। প্রভূত ব্যয়। তার মধ্যে নজরুলের কপিরাইট বিক্রি করে দেওয়া, সুযোগসন্ধানী প্রকাশক। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস, তা নিয়ে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। আমার চোখের সামনে বন্ধ হয়ে গেল বেঙ্গল পাবলিশার্স, প্রকাশভবন, র্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, মনীষা প্রকাশক— যা তৈরি করেছিলেন কয়েকজন লেখক মিলে। তাঁরা মহাশ্বেতা দেবীর গ্রন্থ ছেপেছিলেন, নয়ন পাবলিশার্স, চোখের সামনে বন্ধ হল দিলীপবাবু— পিন্টুবাবুদের সাহিত্যপ্রকাশ। যাঁরা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, কৃষাণু বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁদের বই ছেপেছেন। দিলীপবাবুর বিশেষ অনুরোধে সমরেশ বসুর ‘নয়নপুরের মাটি’এই গ্রন্থটি আমি অনেক কসরত করে যোগাড় করি, পৌঁছে দিই দিলীপবাবুকে। দিলীপবাবু সেই গ্রন্থর সাহিত্যপ্রকাশ এডিসন ছাপেন। বন্ধ হয়ে গেল আশা প্রকাশনী। যাদের অন্যতম বিশেষ গ্রন্থ ছিল বিষ্ণু দে-র যামিনী রায়। একের পর এক বন্ধ হয়েছে শঙ্খ প্রকাশন, আনন্দধারা। শঙ্খ প্রকাশন, সাংবাদিক রণজিৎ রায়ের ‘ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ তার ইংরেজি ‘অ্যাগোনি ইন ওয়েস্টবেঙ্গল’ ছাপে। শঙ্খ প্রকাশন ও আনন্দধারার মালিক ছিল একইজন। অয়ন প্রকাশনী উঠে গেল। মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর সুবর্ণরেখার পাশেই ছিল অয়ন। কসমস বলে আর একটি প্রকাশন সংস্থা ছিল সুবর্ণরেখার তলাতেই। সুবর্ণরেখা নিয়ে লক্ষ কথা বললেও শেষ হবে না কোনোভাবেই। সুবর্ণরেখার মালিক ইন্দ্রনাথ মজুমদার। ইন্দ্রদার চরিত্রে একটা রঙিন চিত্ররূপ ছিল। স্কচ এবং বাংলা সমানভাবে, যত্ন করে নিতেন। বরং বলা যেতে পারে বাংলাতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। শান্তিনিকেতনে ফ্রিডরিখ বা ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস-এর নাতনির বাড়ি কিনে নেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার। অনেক বলেন, তিনি নাকি এঙ্গেলস-এর নাতনির বাড়ি লিজ নিয়েছেন। কিন্তু ইন্দ্রদা আমায় নিজে বলেছেন, তিনি এঙ্গেলস-এর নাতনির বাড়িটি কিনেছেন। ইন্দ্রনাথ মজুমদার সব সময়ই প্রায় এক পোশাক— খদ্দরের সরু পাড় ধুতি, তার ওপর খাদির মোটা, খাপি অথবা সাদা পাঞ্জাবি। পায়ে গান্ধীজি ডিজাইনের পাদুকা। মাথার চুলে পাক, চোখে চশমা— পড়ার সময়। কমলউমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা, সুহাসিনীর পমেটম, পিঞ্জরে বসিয়া শুক— এইসব গ্রন্থের প্রকাশক ইন্দ্রনাথ মজুমদার। কমলকুমার মজুমদারের শ্রেষ্ঠ গল্পও পরে বেরয় সুবর্ণরেখা থেকে। তার আগে অবনীবাবুর কথাশিল্প থেকে প্রকাশিত হয় কমলকুমারের শ্রেষ্ঠ গল্প ইন্দ্রদা— ইন্দ্রনাথ মজুমদার তখন যুক্ত কথাশিল্প-র সঙ্গে। অবনীবাবুর কথাশিল্প থেকে নানা কারণে নিজেকে বিযুক্ত করেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার। তারপর সুবর্ণরেখা-র গতিবেগ ক্রমবর্ধিত। কথাশিল্প থেকে প্রকাশ পেত প্রস্তুতিপর্ব নামে একটি পত্রিকা। ‘প্রস্তুতিপর্ব’-র আড্ডায় নিয়মিত আসতেন প্রাবৃট দাস মহাপাত্র, দেবব্রত পাণ্ডা, সিদ্ধার্থ ঘোষ, শিল্পী প্রবীর সেন, তখনও তিনি আনন্দবাজারীয় প্রবীর সেন হয়ে ওঠেননি। প্রবীর সেন তখন ‘প্রস্তুতিপর্ব’-র মলাট আঁকেন নিয়মিত। ‘প্রস্তুতিপর্ব’-র সুকুমার রায় সংখ্যাটি এখনও মনে আছে। সম্পাদনা করেছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক ও সায়ফি— সায়েন্স ফিকশন লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষ। প্রস্তুতিপর্ব সম্পাদনা করতেন দেবব্রত পাণ্ডা ও প্রাবৃট দাস মহাপাত্র। তাঁরা দুজনেই সিপিআই (এম-এল) নয়, সম্ভবত এমসিসি অথবা সিপিআই (এম-এল) পার্টি ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। প্রাবন্ধিক পুলক চন্দ যেতেন ‘প্রস্তুতিপর্ব’-র আড্ডায়। আসতেন সিদ্ধার্থ ঘোষ ও সিদ্ধার্থ ঘোষের বান্ধবী কবি রমা ঘোষ। আসতেন কবি অমল চক্রবর্তী। কিছুদিন আগে প্রয়াত হলেন দীর্ঘদেহী অমল চক্রবর্তী। খুব ঢিলে পায়জামা— মানে বড়ো পায়ের ঘের, তার ওপর আদ্দির বা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। অশোক রুদ্র-র একটি বই— বই না বলে তাকে চটি পুস্তিকা বলাই ভালো। সেই সিরিজে অনেকের বইও বেরয়। অর্থনীতিবিদ অশোকরুদ্র তাঁর গ্রন্থে পশ্চিমবাংলায় বান্ধুয়া মজদুর বা বন্ডেড লেবার নেই বলে দাবি করেছিলেন। তা নিয়ে বিতর্কও হয় প্রচুর। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর সম্পাদনায় ‘বর্তিকা’ প্রকাশ করতেন। ‘বর্তিকা’-র একটি সংখ্যায় বন্ডেড লেবার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়, ঠিক করে বললে এই সংখ্যাটাই বন্ডেড লেবার নিয়ে বিশেষ সংখ্যা। ‘বান্ধুয়া মজদুর’— বন্ডে লেবার নিয়ে সেই সংখ্যাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমপি অগ্নিকেশ তখন ‘বান্ধুয়া মজদুর’-দের মুক্তির জন্যও চেষ্টা করছেন। তখনও আলাদা রাজ্য ছত্তিশগড় হয়নি, সবটাই মধ্যপ্রদেশ। ‘ভাতুয়া’ শব্দটা পশ্চিমবাংলায় তখন খুবই পরিচিত। জোতদার, জমিদারদের বাড়ি পেট ভাতে কাজ করা ‘ভাতুয়া’। ‘ভাতুয়া’-দের নিয়েও মহাশ্বেতা দেবী— মহাশ্বেতাদির অনেক অনেক লেখা আছে। সেই প্রসঙ্গে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। কথাশিল্পর আড্ডাতে অবনীবাবু ছিলেন মধ্যমণি। একমাথা পাকা চুল। যদিও তিনি খুব বেশি কথা বলতেন না। গরমের দিনে কনুই পর্যন্ত হাতাঅলা গেঞ্জি আর মিলের সরু পাড় সাদা ধুতি পরে তিনি ‘কথাশিল্প’-তে থাকতেন। নতুন বই যে খুব বেশি ছাপা হত এমন তো নয়। তবু অবনীবাবুর কথাশিল্প নামে প্রকাশন সংস্থার আলাদা গুরুত্ব ছিল। মিত্র ও ঘোষ-এর ছাতার মধ্যে ছিল অমর সাহিত্য প্রকাশন। মূলত মিত্র ও ঘোষ-এর কর্মচারীদের কথা ভেবেই এই প্রকাশন সংস্থা তৈরি করেছিলেন ‘কাকাবাবু’— গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও তাঁর বন্ধু, সাহিত্যিক আর ব্যবসায়িক অংশীদার সুমথনাথ ঘোষ। সুমথবাবুর হাতের লেখা ছিল অতি খারাপ। প্রমথনাথ বিশী এবং সুমথনাথ ঘোষ— দুজনের হস্তলিপি— হাতের লেখা হদকুচ্ছিৎ বললে কম বলা হয়। গজেন্দ্রকুমার মিত্র বাঁহাতে লিখতেন। তাঁর হাতের লেখা মোটেই ‘আহামরি’ কিছু ছিল না। কিন্তু বড়ো বড়ো অক্ষর— ফাঁক ফাঁক করে লেখা— আতের লেখা বোঝা যেত তো বটেই। আর তা ছিল একেবারে আদর্শ প্রেস কপি। ‘উত্তর বাহিনী’ নামে আখ্যান, তেমন বড়ো নয় মোটেই, কাশীকে নিয়ে লেখা এই আখ্যানই সুমথনাথ ঘোষের সেরা লেখা। সেই অমরসাহিত্য প্রকাশন থেকে কর্মীদের জন্যও শেয়ার ছাড়া হত। কর্মীরা কিনতেন সেই শেয়ার। গজেন্দ্রকুমার মিত্র ‘যুগান্তর’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমাকে মিত্র ও ঘোষ অথবা অমরসাহিত্য প্রকাশন-এ আমাকে চাকরি নিতে বলেন। আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করি সেই প্রস্তাব। এই তথ্য সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের (ভানুবাবু) ও মনীশ চক্রবর্তী জানেন। গজেন্দ্রনাথ মিত্র আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখ অমরসাহিত্য প্রকাশন-এর শেয়ার হোল্ডার হলে তোর লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। এরপর বছর বছর শেয়ার হোল্ডার হিসাবে আলাদা ডিভিডেন্ট, সেটা তোর মালিকানার শেয়ারটুকু অনুযায়ী। তোকে বা কাউকে তো অমর সাহিত্য প্রকাশন-এর কর্মচারী হিসাবেই, শেয়ার কিনে দিচ্ছে মিত্র ও ঘোষ। তাতে মিত্র ও ঘোষ-এর কিনে দেওয়া শেয়ার তোর কাছে থাকছে। তার থেকে ভালো ডিভেডেন্ট পাবি তুই, আলাদা করে। কাকাবাবু— গজেন্দ্রকুমার মিত্রর অ্যাত অ্যাত প্রস্তব আন্তরিকতার সঙ্গে আমি সবিনয়ে ফিরিয়ে দিই। বেঙ্গল পাবলিশার্স ছিল সাহিত্যিক মনোজ বসুর প্রকাশন সংস্থা। ‘বন কেটে বসত’, ‘নিশিকুটুম্ব’— এমন নানান লেখা আছে মনোজ বসুর। রয়েছে ‘চীন দেখে এলাম’, ‘আবার চীন দেখে এলাম’। ‘চীন দেখে এলাম’-এ চীন সমাজ ব্যবস্থার কিছু গুণগান ছিল। ১৯৬২-র অতি দুঃখজনক চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর, মনোজ বসু তাঁর বই ‘চীন দেখে এলাম’ প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোড়ান। তখন ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ নিয়ে ব্যস্ত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘সাপ্তাহিক দেশ’। ‘শিল্পীর স্বাধীনতায়’-য় সমরেশ বসু লেখেননি। আবার পরে অনেকটা ‘বাম’ শক্তির কাছাকাছি চলে আসা কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত শিল্পীর স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছিলেন। মনোজ বসুর নিশিকুটুম্ব— চোরদের নিয়ে লেখা আখ্যান। একসময় এই লেখাটি নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়েছে। পরে তা মিলিয়ে গেছে বাতাসে। কালিকানন্দ অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’, ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’, ‘হিংলাজের পরে’, ‘যাযাবরের দৃষ্টিপাত’, ‘হ্রস্বদীর্ঘ’, বিমল মিত্রর ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘একক দশক শতক’ ইত্যাদি প্রভৃতি। আবার শঙ্করের কত অজানারে, চৌরঙ্গী— এই বই দুখানিও তখন বিয়েবাড়িতে খুব চলত উপহার হিসাবে। সেইসঙ্গে রঞ্জনের ‘শীতে উপেক্ষিতা’। রঞ্জন মানে এখনকার বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত রঞ্জন নয়, তা বলাই বাহুল্য। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’, সুভাষচন্দ্রের ‘তরুণের স্বপ্ন’, বিবেকানন্দের ‘রাজযোগ’, ‘কর্মযোগ’ দেওয়া হত উপনয়নের অনুষ্ঠানে। রঞ্জন তো সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে দ্বন্দ্বমধুর, তাও চলত বিবাহ অনুষ্ঠানে উপহার হিসাবে। বেঙ্গল পাবলিশার্স একসময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ গল্প বার করেছিল। এর কোনোটাই এখন পাওয়া যায় না, সম্ভবত। মহাত্মা গান্ধী রোড— এমজি রোডের ওপর বাড়ির দোতলায়, ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সুবর্ণরেখা। সুবর্ণরেখার পাশাপাশিই একরকম বলতে গেলে কসমস। সেই কসমস-এর মালিক তাপসী সেনগুপ্ত, তাঁর সজজীবনের মানুষ কল্লোল সেনগুপ্ত থ্রিলার লেখেন। সেই থ্রিলার একাধিক। কল্লোল সেনগুপ্ত এইসব থিলার লেখা ছাড়া চাকরি করতেন কিনা জানা নেই। সহদেব সাহার মডার্ন কলাম এখনও আছে। তাঁর ছোটো ভাই স্বপন সাহাও প্রকাশন সংস্থা খুলেছিলেন। স্বপন চাকরি করতেন কলকাতা কর্পোরেশনে। কিছুদিন চলার পর স্বপন সাহার পাবলিকেশন ‘স্বপ্নদীপ’-ই নাম নাম ছিল তার সম্ভবত, বন্ধ হয়ে গেল। বদ্বীপ বলে একটি প্রকাশন সংস্থা খুলেছিলেন মীনাক্ষী দত্ত ও তাঁর প্রথম স্বামী কল্যাণ। কঙ্কাবতী গল্প উপন্যাস লিখতেন। প্রখ্যাত সব প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নই। কল্যাণ নাকি একসময় সিপিআই (এম-এল) রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। কল্যাণের মৃত্যুর পর উঠে গেল বদ্বীপ। কবি-সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্ত ও প্রতিভা-বুদ্ধদেব বসু কন্যা মীনাক্ষী দত্তর কন্যা কঙ্কাবতী। মীনাক্ষী নিজেও ভালো লিখতেন। ছিলেন রূপময়ী। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি ‘বনজ্যোৎস্না’ নিয়ে যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবি নির্মিত হয় সত্তর দশকে মীনাক্ষী বা মিমি তার হিরোয়িন ছিলেন। সেই ছবি অবশ্য খুব বেশি সপ্তাহ চলেনি। প্রকাশনা হয়েছে, প্রকাশনা উঠে গেছে, এমন তো বারে বারেই হয়েছে। কম পুঁজিতে, সব ধারে— সর্বস্ব ধার করে, চালানো হবে, এই ভাবনার দৃশ্য বহু বছরই শেষ। তবু নতুন নতুন কিছু প্রকাশন সংস্থা আবার নতুন নতুন বই বার করার জন্যও হাজির হয়। বাজার থেকে অতি দ্রুত আউট হয়ে যান তাঁরা। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ছিল এরকমই এক প্রকাশনা সংস্থা। ঘনাদাকে নিয়ে তাঁরা— ঘনাদার সমস্ত বই প্রকাশ করতেন। ঘনাদার বইয়ে ঘনাদাকে আঁকতেন অজিত গুপ্ত।
Powered by Froala Editor