দৈনিক পত্রিকা— খবরের কাগজ তেলেভাজা-মুড়ি

খবরের কাগজের অফিস তখন তো অনেকটাই খবরের কাগজের আপিস। আমি ষাট-দশকের শেষ অথবা পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি সত্তর দশকের শেষ লগ্নের কথা। যখন বাংলা খবরের কাগজ, ইংলিশ ডেইলি, ওড়িয়া বা হিন্দি দৈনিকেও শুধুমাত্র হট মেটাল, লাইনো টাইপ। একটা পুরো লাইন কম্পোজ হয় তারপর তা পর পর পর পর গাঁথা হয়। ভুল হলে কম্পোজ করা পুরো লাইনটাই ফেলে দিতে হবে, আবার নতুন করে কম্পোজ করতে হবে লাইন। দৈনিক বসুমতীতে আবার মোনো টাইপ, লাইনো টাইপ— দুই-ই— একথা বলেছি বহুবার। খবরের কাগজের— বিশেষ করে বাংলা দৈনিকের অফিস মানেই একটু পুরনো খবরের কাগজের ওপর স্তূপ করা মুড়ি। অবশ্যই ইউরিয়া ছাড়া এবং উইথ ইউরিয়া। মুড়ির সঙ্গে অবধারিতভাবে কাঁচালঙ্কা, সম্ভব হলে পেঁয়াজ কুচি। কারণ, বহুক্ষেত্রেই আট-দশ টাকা কিলো ‘পেঁয়াজ’ ব্রাত্যই থেকে যায়। সেইসঙ্গে ক্বচিৎ চানাচুর— সেটা প্রকৃত প্রস্তাবে আলঙ্কারিকই বটে, আর যা মূল অনুপান মুড়ি সঙ্গে, তা হল তেলেভাজা— ইংরেজিতে যাকে বলে অয়েল কেক, কিন্তু অয়েল কেক তেলেভাজার ঠিকঠাক ইংরাজি, এমন তো মনেই হয় না, তো সে যাই হোক, তেলেভাজা বলতে তো ইংরেজির অয়েল কেকই, আর তেলেভাজার নানান ভ্যারাইটি, বিভিন্ন ধরনের আকার-স্বাদ ও নাম। যেমন আলুর চপ, আলুরি, ফুলুরি, বেগুনি, পেঁয়াজি, কুমড়ি, পটলি। আলু দিয়ে তৈরি আলুর চপ, আলুরি। আলু সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে, তাতে পরিমাণ অনুযায়ী নুন, শুকনো লঙ্কা ভাজা, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে শুকনো করে মেখে তার পর গুঁড়ো বেসন হাতে নিয়ে সেটাকে চেষ্টা করা। আসলে বেসনের কথা একটু আগে পরে হয়ে গেল। আলুর শুকনো করে মাখা ব্যাপারটাকে হাতে থাবড়ে-থুবড়ে গোলাকার দেওয়া। পূর্ববঙ্গের বাঙালরা বলেন, ‘চোকলা’, হিন্দিবলয়ের মানুষজন বলেন, ‘ছিলকা’। তারপর বেসনে ডুবিয়ে নিয়ে সেই বেসনটুকু কাচিয়ে নিয়ে প্রায় কড়া ভর্তি ফুটন্ত সর্ষের তেলে সেই প্রস্তাবিত আলুর চপ একটা একটা করে ছাড়া। তারপর একদিকটা আলো করে ভাজা হলে তখন উল্টে দেওয়া বাঁশের তৈরি সরু একটি কাঠি ধরনের মুখ-ছুঁচল জিনিস, তার হাতলটা যেন এমনি এমনিই হয়ে গেল গোলা বেসনের তৈরি হাতল, যা শুকিয়ে উঠল ধীরে ধীরে তারপর হ্যান্ডেল হয়েই থেকে গেল। এ এক আজিব দাস্তান ও কিস্যা। সেই হাতল তৈরির কথাকলিতে আর বেশি দূর যাচ্ছি না। 

এতো গেল আলুর চপ কথা। সেইসঙ্গে ফুলুরি, বেগুনি, কুমড়ি, পটলি-কথাও। ফুলুরি বেসন দিয়ে, পটলি পটল দিয়ে, বেগুনি বেগুন দিয়ে, আলু দিয়ে আলুরি। খেসারির ডালের বেসন, মটর ডালের বেসন, ছোলার ডালের বেসন। ষাটের দশকে একটা আলুর চপ চার নয় পয়সা, পাঁচ নয়া পয়সা। বেগুনি, কুমড়ি, ফুলুরি— এক একটা তিন নয়া পয়সা। তিন নয়া পয়সা অর্থে দু-পয়সা। চার নয়া পয়সা দু পয়সার থেকে একটু বেশি। বালি গোস্বামীপাড়া রোডের ওপর কাঁঠাল তলায় ছিল একটা নাম করা তেলেভাজার দোকান। আবার বালি গোস্বামী পাতিদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তার ঠিক আগে বাচ্চুর মায়ের তেলেভাজার দোকান। বাচ্চু আমাদের সঙ্গে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে, বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ে। যাকে আমরা মুখে মুখে অনেকেই ‘জোড়া অশ্শতলা’ বলতাম। সেই বাচ্চু ফরসা, তার ভালো নাম আজ আর মনে নেই। তার মা-ও ফরসা যথেষ্ট। চোখের দু মণিতে বেড়াল। বাচ্চুর মা চপ ভাজতেন। বিক্রিও করতেন। বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি বাড়ি বাচ্চুদের। একেবারে রাস্তার ওপর, ‘ওপর’ বললে কম বলা হয়, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে রাস্তা ঘেঁষে। তো এই তেলেভাজার দোকানে উনোন জ্বলে, কয়লার উনোন। তার ওপর লোহার বড়ো কড়াই। তার ভেতর কুচকুচে কালো তেল। তেলেভাজা— রসিকজনেরা বলেন, তেলেভাজার দোকানে লোহার ভারী, পুরু কড়াইয়ের ভেতর জমে থাকা পুরু-তেলরহস্য, সেই সঙ্গে কালো কুষ্টি তেল, যবে থেকে এই দোকান চালু হয়েছে, তবে থেকেই এই সর্ষের তেলও কড়াই না-মাজা অবস্থায় বিদ্যমান। বাচ্চুর মায়ের তেলেভাজা ছিল অতিবিখ্যাত, তেমনই কাঁঠালতলার তেলেভাজার দোকান। ১৯৫০-১৯৬০-এর দশকে দক্ষিণ কলকাতার চেতলায় ছিল ওড়িয়াদের তেলেভাজার দোকান। হোগলার ঘরের ভেতর সেই দোকানে, গলায় পৈতে কপালে তিলক, মুখে গুণ্ডিপান, জর্দাপান বা দোক্তা পান-সমেত, ওড়িয়া তেলেভাজাদার। এইসব তেলেভাজার দোকান চিহ্নিত হত ‘উড়েদের তেলেভাজা দোকান’ বলে। তথাকথিত অতি ভদ্রবাবু— বাঙালি ভদ্রবাবুদের মুখে মুখে সামান্য সংক্ষেপ করে উড়ের দোকান। কলকাতার পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটি-দোকান, অতিবিখ্যাত ছিল একসময়। মালিক ওড়িয়া। সেইসব দোকানকে কেউ কেউ ‘ঠাকুরের দোকান’, ঠাকুরমশাই-এর দোকানও বলতেন। ওড়িয়া প্লাম্বার— কল মিস্ত্রি, টিউবওয়েল— টিউ কল আর পাইপলাইনের জল, পাইপ লাইনের জল মানে মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশনের জল। সকাল সাতটা থেকে নটা, বেলা বারোটা থেকে দেড়টা, যা আসত বালি শান্তিরাম রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির কলে। সিংহের মুখ ডিজাইনের কল ছিল কলকাতার রাস্তায়, বেশ কয়েকটা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক সিংহ-মুখ। আবার ফরাসি চন্দননগরের রাস্তায় রাস্তায়, ফুটপাথের ধারে যেসব বড়োসড় লোহার ঢালাইকল, সেখানে ফরাসি সাম্রাজ্যের এমব্লেম। সেসব কলও চন্দননগরের রাস্তায় বহু বছর দেখা যায় না। উধাও হয়ে গেছে হয়তো কোনো অ্যান্টিক-বিলাসীর সৌন্দর্য সংগ্রহে। কিংবা আরও অন্য অন্য কোথাও। কলকাতার ওড়িয়া জলবহনকারী জলের ‘ভারী’ অথবা ‘ভারি’ দেখেছি ষাট-সত্তর দশকে, আশিতেও। ‘বেলুন মার্কা’ বা ‘খেজুরগাছ’ মার্কা রুপো রঙ বড়ো ডালডার টিনে তাঁরা জল ভরে আনতেন রাস্তার কল বা টিউবওয়েল থেকেও। এক ‘ভার’ মানে দুই টিন জল তাঁরা দিতেন ২৫ নয়া পয়সা, চল্লিশ নয়া পয়সা, পঞ্চাশ নয়া পয়সার বিনিময়ে। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতায় ভারি বা ভারীরা জল বহন করে পৌঁছে দিতেন, গৃহস্থর ঘরে ঘরে। শক্তপোক্ত— বাঁশের তৈরি অতি শক্তপোক্ত বাঁকের দুপাশে জল ভর্তি করা টিন। বাঁক থেকে টিন পর্যন্ত নেমে এসেছে কাতা দড়ির তৈরি কয়েক পাক মোটা বাঁধন। কলকাতার জলের ভারি বা ভারী নিয়ে বসতেন ওড়িয়া মাংসওয়ালারা। ষাটের দশকে কলকাতায়, শালপাতায় কচ্ছপের মাংসর আয়োজন। তখনও দুরো বা কালি কাউঠঠা, বিক্রির জন্যও বাজারে আসে। আসে ইলাহাবাদের সঙ্গম থেকে বড়োসড় কচ্ছপ। অনেক মাংস তার গায়ে। এছাড়াও ওড়িয়া বামুন— ওড়িয়া ব্রাহ্মণ পুরোহিত কলকাতার সোনাগাছি নামের বৃহৎ নারী মাংস বিপণীতে রাখা দেবী-দেবতার ছবিতে চন্দনের টিপ, ফুলমালা, ধূপ, বাতাসা, নকুলদানা দেওয়ার দায়িত্ব, মাস খরচে। সব বেশ্যার ঘরেই তো তাঁরা কাগজের আপিসে নিউজ প্রিন্টের ওপর, নয়তো বাতিল, পুরনো খবরের কাগজের ওপর মুড়ি, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, বাদাম, চানাচুর, তেলেভাজা, তার সঙ্গে ভাঁড়ের চা। চিনি সহ। এমনি করেই খবরের কাগজের আড্ডা। তার সঙ্গে মুড়ি-তেলেভাজা। খবরের কাগজের আপিসে তখনও কর্পোরেট ভাত আসতে বহু দেরি। আনন্দবাজার যদিও তার ঘেরা টোপ বহু বছর আগে থেকেই খানিকটা বাধো বাধো করছিল। গেটে মণিমেলা করা মোটা গোঁফের শান্তিবাবু তিনিই পাহারাদার। ‘মণিমেলা’-র জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সঙ্ঘও সম্ভবত করতেন, তিনি প্রত্যক্ষত। শান্তিবাবুর ‘লোক আটকানো’ নিয়ে নানা কথা, গল্প-কাহিনি প্রচলিত আছে। সেসব কথায় যাচ্ছি না। সুতারকিন স্ট্রিটে তখন আনন্দবাজার। সেই প্রসঙ্গে আর বিস্তারিত যাচ্ছি না। খবরের কাগজের আড্ডা ছিল বিখ্যাত, অতি বিখ্যাত, সেইসঙ্গে সঙ্গে সাময়িক পত্রের আড্ডাও। ‘দৈনিক বসুমতী’-র আড্ডা, ‘যুগান্তর’-এর আড্ডা, ‘সাপ্তাহিক আদৃত’ পত্রিকা, সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এর আড্ডা— সবই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রায় অমরাবতী। ‘পরিচয়’-এর আড্ডা, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠির আড্ডা’— সবই ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’-এর আড্ডা, সুভো ঠাকুর সম্পাদিত ‘সুন্দরম’, ‘অগ্রগতি’, ‘ভবিষ্যত’-এর আড্ডা, ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’, ‘মাসিক বসুমতী’-র আড্ডা সবই তো নানাভাবে নিজেদের আড্ডাধারীদের নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত। এছাড়াও ‘এম সি সরকার’-এর আড্ডা, ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর আড্ডা— এই সব আড্ডা নিয়ে বহু লেখালিখিও হয়েছে। ইদানিং নির্ভেজাল সাহিত্যের আড্ডা ক্রমশ কমে এসেছে। কমে আসছে বললে ভুল বলা হবে কমে এসেছে প্রায় তিন দশক ধরে। কলেজস্ট্রিট কফি হাউস, বসন্ত কেবিন, ধর্মতলা কফি হাউসের আড্ডা এসব তো আছে। আবার ‘বসন্ত কেবিন’-এর আড্ডা নেই-ই প্রায়। ‘হিমনীল’-এ ‘প্রমা’-র আড্ডা— আড্ডা— আড্ডা হিসাবে প্রমার আড্ডা নেই বহু বছর। কিন্তু গত তিরিশ বছরে বাংলা খবরের কাগজ— দৈনিক সংবাদপত্র যেভাবে কর্পোরেট কর্পোরেট হয়ে উঠেছে, উঠছে দ্রুত, তার দিকে তাকিয়েই আমা হেন অভাজনের বেশ কষ্টই তো হয়। সেই অর্থে বাংলা বা ইংরেজি দৈনিকের বুদ্ধিদীপ্ত আড্ডার দিন শেষ প্রায়। সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, আরপি— রাধাপ্রসাদ গুপ্ত— সাঁটুল গুপ্ত, সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর— সুভো ঠাকুর— সেই অর্থে খবরের কাগজের আড্ডাধর বা আড্ডাধারী ছিলেন না। কিন্তু কফি হাউসে— হাউস বা হাউস অফ কমনস ছিল এইসব অতিবিখ্যাত জনেদের মেলা ও মেলানোর ঠাঁই। সত্যজিৎ রায় জেডি কিমার-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি তখন সিনেমা নির্মাণের পথে। সিগনেট বুক শপ-এর কর্ণধার ডিকে— দিলীপকুমার গুপ্ত ছিলেন বিশিষ্ট আড্ডাধর। আমরা বার বার দেখেছি সত্যজিৎ রায় থেকে নবীন কৃত্তিবাসী— ‘কৃত্তিবাস’ নামের পত্রিকায় একসঙ্গে জমা হওয়া কয়েকজন তরুণ কবি ও গদ্যকার গড়ে তুললেন আড্ডার নতুন মহাল— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, আনন্দ বাগচী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু— সবাই মিলিয়ে মিশিয়ে আবার না মিলমিশ করেও এক সমবেত আড্ডাধ্বনি। বড়ো— নাম করা সেইসব টানা আর খণ্ড-বিখণ্ড আড্ডাস্মৃতি। আড্ডাধর, আড্ডাধারী— এঁদের কথা তো বহু লেখা হয়েছে। কিন্তু আড্ডাধারিণী, আড্ডাধারী, আড্ডাবতী— এঁদের কথা সেভাবে লেখা হল না আলাদা করে? অথচ নবনীতাদি— নবনীতা দেবসেন খুব ভালো আড্ডা দিতে পারতেন। যাঁরা তাঁর সঙ্গে দিনের পর দিন মিশেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, তাঁরাই অনুভব করবেন, করছেন এই সত্য। বাংলা দৈনিক, ইংরেজি দৈনিকের নিজস্ব গাড়ি থাকত তখন। সেইসঙ্গে ভাড়ার গাড়ি। ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র যৌথ গাড়ি, রাখা থাকে বি-ই-শা-ল মোটর গ্যারেজে। নিউজ প্রিন্টের রোল বা রিল আনা নেওয়া, খবরের কাগজ ছাপা হলে সেই ছাপানো পত্রিকা বিভিন্ন সেন্টারে, গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ‘ওভারল্যান্ড’ নামে চিটফান্ডের যে বাংলা দৈনিক প্রকাশিত হত, তার গাড়ি সমস্ত কলকাতায় তো বটেই, কলকাতার বাইরে অনেক দূর চলে যেত পত্রিকা— ‘ওভারল্যান্ড’ নিয়ে। ঘাটশিলাতেও দেখেছি ‘ওভারল্যান্ড’ পৌঁছে যাচ্ছে। জনৈক ভাওয়াল ছিলেন সেই পত্রিকার মালিক, প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ গ্রুপ ‘ওভারল্যান্ড’-এর এই বাড়-বাড়ন্ত সহ্য করতে পারেনি। পত্রিকা বের হওয়ার পর একইভাবে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ গ্রুপ তাকে রুখে দেওয়ার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করে। ‘মহানগর’ পত্রিকা বেরনোর পরও একই প্রয়াস হয়। তখন— ষাট, সত্তর-আশির দশকে বাংলা বা ইংরেজি খবরের কাগজের ‘ডাক সংস্করণ— ডাক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশ হত ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ। ‘হট মেটাল’— লাইনো মোনোর যুগে একটু পুরু বোর্ড ধরনের কাগজের ওপর, পাতাদের প্লেট তৈরি হত। সেই প্লেট বদলে বদলে যায় বিভিন্ন সংস্করণে, ডাক সংস্করণে। তখন ‘যুগান্তর’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘স্টেটসম্যান’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’— সকলেরই তৈরি হয় ডাক সংস্করণ। পুরী, কাশী, ইলাহাবাদ— সর্বত্র বাংলা পত্রিকার দৈনিক বিকেল, বিকেল বেলা একটা-দেড়টার পর থেকে পৌঁছতে থাকে। ট্রেনে, প্লেনে আসে পত্রিকা। দিল্লিতেও পৌঁছয় বাংলা দৈনিক পত্রিকা। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের ছবি— চিত্রমালা এই-ই। এখন তো স্যাটেলাইট যুগ চলে এসেছে খবরের কাগজেও। প্রুফ রিডিং বিভাগটাই উঠে গেছে প্রায় অথচ প্রতিটি খবরের কাগজের প্রুফ রিডিং একটা বড়ো ব্যাপার ছিল। ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘যুগান্তর’-এ দেখেছি সেইসব প্রতিভাময় প্রুফ রিডারদের। যাঁদের অসামান্য ব্যাকরণ ও বানানজ্ঞান বিস্মিত করত। বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ এটি দেবের— আশুতোষ দেবের ডিকশনারি— ইটুবি, বিটুই, ‘সুবল মিত্র’-র বাংলা অভিধান— হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান— সব তাঁরা খবর রাখতেন। রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ তখন বেশি চলে। সংসদের— সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত বাংলা অভিধান তখন এতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ‘চলন্তিকা’-ই ভালো বাংলা অভিধান, তাকে ‘ঠিকঠাক’ আধুনিকীকরণ করা হল না। এরপর অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অভিধান, বাংলা-বাংলা অভিধান প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বাংলা বানানবিধি অনেকটাই অন্যরকম। স্বতন্ত্র। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স তো প্রায় বন্ধের মুখে শমিত সরকারের মৃত্যুর পর। সুপ্রিয় সরকার— বাচ্চুদার পুত্র শমিত। শমিতের দিদি আছেন। তিনি sকিছুদিন এমসি সরকার দেখার চেষ্টা করেছিলেন। পরশুরামের সমস্ত বই— ‘ধুস্তুরী মায়া’, ‘গড্ডলিকা’, ‘কজ্জলী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন ও অন্যান্য’— এছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ কেতাব আছে রাজশেখর বসু— পরশুরাম বিরচিত। ‘মহাভারত’ রাজশেখর বসুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেইসঙ্গে আরও অন্য অন্য বই। এমসি সরকার থেকে প্রখ্যাত নাট্যকার শম্ভু মিত্রর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে শরৎচন্দ্র রচনাবলী, খণ্ডে খণ্ডে। এভাবেই এমসি সরকারের বিচিত্রমুখী প্রকাশনা মানুষের কাছে— পড়ুয়া জনেদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য ‘জিজ্ঞাসা’, ‘মিত্রালয়’, ‘বিদ্যোদয় লাইব্রেরি’, ‘বর্মণ পাবলিশিং হাউস’— যা তৈরি করেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা রেবতী বর্মণ। ‘অমর সাহিত্য প্রকাশন’, যা ছিল ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর মিস্টার কনসার্ন, গ্রন্থালয়, সাহিত্য প্রকাশ, মডার্ন কলাম, ‘প্রকাশক’, ‘নয়ন প্রকাশনী’— এরকম কত কত প্রকাশন সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। ‘মুছে যায়’-এর সামনের পর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলা প্রকাশনী নিয়ে নতুন কথা বলব।

Powered by Froala Editor

Latest News See More