নানচাকু থেকে জীবনানন্দ

নানচাকু বা নানচাক্কুর কথা, সেইসব কথালাপ অবশ্য সামান্যই লিখেছি। লিখে রেখে এসেছি গত সপ্তাহের ‘মুছে যায়?’-তে। ব্রুস লি, ক্যারাটে, কুংফু, ব্ল্যাক বেল্ট, এরকম নানা কথা ঘুরেছে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ নামের সিনেমাকে কেন্দ্র করে ব্রুস লি-র উত্থানে, প্রচারে। ষাটের দশকে বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজ— দৈনিকে ‘বুল ওয়ার্কার’ নামে একটি ব্যায়াম করার যন্ত্রর ছবিসহ বিজ্ঞাপন ফুটে উঠতে দেখেছি। ‘বুল ওয়ার্কার’-এর পাশে একজন নাভি পর্যন্ত নগ্ন ‘ব্যায়ামবীর’-এর ছবি দেওয়া থাকত সেই বিজ্ঞাপনে আর তিনি অবশ্যই সাহেব। এখনকার ‘সিক্স প্যাক’ মণ্ডিত তার শরীর। তখন ‘বুল ওয়ার্কার’ কেনার একটা ঝোঁক দেখেছি বাঙালি মধ্যবিত্ত মহলে, উচ্চবিত্ত মহলে তো বটেই। দুপাশে দুটি হ্যানডেল। পুরোটাই স্টিলে তৈরি, এরকমই মনে হয়েছে। প্লেটেড লোহারও হতে পারে। তবে হাত দিয়ে, হাতে করে ছুঁয়ে দেখেছি ‘বুল ওয়ার্কার’, মনে হয়েছে ঝকঝকে ইস্পাতে তৈরি হ্যানডেল। খুব ইচ্ছে ছিল ‘বুল ওয়ার্কার’ কেনার। সম্ভবত শ দুই তিন টাকা দাম হবে এখন। সেটা ষাটের দশক। দু তিন শো টাকার মূল্য তখন অনেক। টাকার— রুপির মূল্য হ্রাস, ‘ডিপ্রেশন’— অর্থনীতির মানডণ্ডে, আমাদের জানিয়ে দিয়েছে খবরের কাগজ— দৈনিক সংবাদপত্র। যাই হোক, তখন দৈনিক পত্রিকা ও ইংরেজি-হিন্দি সাপ্তাহিক-পাক্ষিকে ‘বুল ওয়ার্কার’-এর বিজ্ঞাপন দেখে, তা কেনার কিছু কিছু ঝোঁক দেখা গেছিল। থাক, আপাতত সেই প্রসঙ্গ। 

একেবারে রাস্তার ধারে, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ওপর ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর লাল বাড়ি। কত কত কত স্মৃতি, সেই বাড়ি ঘিরে। ‘বসুমতী’-র দোতলার ছাদ। সেখানে কত কত কত আড্ডা, দিনের পর দিন। সামনেই ট্রাম লাইন। টং-টং টং-টং করে ঘণ্টি বাজিয়ে চলে যায়, জীবনানন্দঘাতী কলকাতার ট্রাম। ছাদ থেকে রাস্তা চোখে পড়ে। সামনে, পাশে, উল্টোদিকের ফুটপাতে অনেক অনেক স্বর্ণবিপণি— স্যাকরার দোকান। ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের একেবারে গা লাগোয়া ‘বি সরকার’-এর সোনার দোকান। গয়না, গিনি।  অনেক অনেক ধরনের অলঙ্কার। বড়োসড় সোনার দোকানে, নামকরা কাপড়ের দোকানে তখন অনেক অনেক ঝকঝকে দেওয়াল-আয়না ফিট করা। সেই দর্পণে ‘চোর’— হস্তলাঘবকারী-তস্কর ধরা পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, অন্তত এমনই মনে করেন বিপণি মালিকেরা। খুব কড়া নজরদারি ভেতরে, সবসময় ‘পাহাড়াচোখ’ ঘুরছে ভেতরে। বাইরের গেটে ডবল ব্যারেল— দোনলা বন্দুক সমেত গান ম্যান। তাঁর পরনে ইউনিফর্ম। ফুলপ্যান্ট, ফুল শার্ট, অলিভ গ্রিন। সাধারণত রিটায়ার্ড পুলিশ ও আর্মির লোকজনই গানম্যান হতেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন— ছোট বক্স বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণত চাকরিতে নেওয়া হত এঁদের। তখন এই ধরনের বহু বক্স বিজ্ঞাপনেই বক্স নম্বর থাকে, ঠিকানা ও ফোন নম্বরের বদলে। এসব কথা আপাতত তুলে রেখে ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসের ছাদ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেই ছাদ লম্বাই-চোড়াইয়ে অনেকখানি। শীতের দুপুর, গরমের সন্ধ্যা বেশি উপভোগ্য এখানে। ১৬৬ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে এসে প্রথমেই বিজ্ঞাপন বিভাগ, সার্কুলেশন। ডান দিকে ক্যাশ কাউন্টার। ক্যাশ কাউন্টারের মাথার ওপর অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। আর একটু এগোলে বাঁ দিকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘর, ডানদিকের ঘরে সম্পাদক প্রশান্ত সরকার। আগে আগে কেদার ঘোষের সময়, ‘স্টেটসম্যান’ প্রাক্তনী কেদার ঘোষ যখন ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক ও এমডি— ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তখন তো তাঁর কামরার উল্টোদিকের ঘরে সহযোগী সম্পাদক— অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর— প্রণবেশ চক্রবর্তী আর রামেন্দু মুৎসুদ্দি। পরে আর এক ‘স্টেটসম্যান’-প্রাক্তনী প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক হয়ে আসার পর তিনি এই ঘরেরই বসার ব্যবস্থা করলেন। এর আগে আগে সম্পাদক কবি গোপাল ভৌমিক আর প্রভাত গোস্বামী অন্য আর একটি ঘরে বসতেন। ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘর পার করে ডানদিকে ওয়াশরুম, পায়খানা, বাথরুম। তারপরই সাংবাদিকদের বসার জায়গা। চিফ রিপোর্টার বিজয় রায়, কোণা করে নেওয়া একটি বড়ো টেবলের সঙ্গে চেয়ার লাগিয়ে। তার পাশে রঞ্জিত বসু। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মাথায় কলপ, টেরিকটের হাফ শার্ট, ফুলপ্যান্ট, ঘন ঘন সিগারেট, একদা ফরওয়ার্ড ব্লক। তিনি তাঁর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের ঘরের সামনে ‘অনশন’-এ বসেছিলেন। আর সেই অনশন-সংবাদ ছাপা হয়েছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত দু-চারটে ফোটো ট্যাবলয়েডে। এরকম ‘ফোটো ট্যাবলয়েড’ তখনও কিছু কিছু বেরয়। যেখানে খবর ছাপার মিথ্যা, অর্ধসত্য খবর ছাপা ছাড়াও অনেক অনেক ব্ল্যাকমেলিং ইত্যাদির ব্যাপারও ছিল, খবর ছাপার ভয় দেখিয়ে। একসময়— ষাটের শেষ, সত্তর দশকের গোড়ায় সাপ্তাহিক ‘দর্পণ’, সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ এইসব রাজনৈতিক সংবাদ-টাবলয়েডের অনেক অনেক গুরুত্ব ছিল। পরে ‘দর্পণ’ তো ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ, ক্রমক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেল। সম্পাদক হীরেন বসু এত মদ্যপান করতেন, সেইসঙ্গে অনর্গল সিগারেট, সে তো আর কিছু বলার অয়। দিলীপ চক্রবর্তী সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ করতেন। গণি খান— কেন্দ্রীয় মন্ত্রী— ইন্দিরা মন্ত্রী সভার মন্ত্রী বরকত গণি খান চৌধুরীর অনেক অনেক মদ ও মহিলাজনিত কেচ্ছা ছাপে বাংলাদেশ, মদের বিলের ছবিসব, ইত্যাদি প্রভৃতি। বরকত গণি খান চৌধুরী ছিলেন মালদহের কংগ্রেসের রাজনীতির শেষ কথা। কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী থাকার সময় উনি নাকি মালদহের ‘ভূমিপুত্রদের’ শুধু নয়, তার বাইরেও অনেক লোককে চাকরি দিয়েছেন, এমন কথা বহুজনের কাছে শুনেছি। তো সে যাই হোক, ‘বাংলাদেশ’— অনিয়মিত ছাপা হওয়া ‘বাংলাদেশ’ খানিক খানিক সেনশেসানাল। নিউজ তৈরি করতে থাকে। তার মধ্যে ‘দৈনিক বসুমতী’ ও ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকারকে নিয়ে অনেক অনেক অর্ধ সত্য বা অর্ধ মিথ্যা সংবাদ ছাপা হত মাঝে মাঝেই। তো সে যাই হোক, এভাবেই ‘দৈনিক বসুমতী’ কেন্দ্রিক সংবাদ নিয়ে অনেক অনেক সেনশেসনাল নিউজ তৈরি করে হয়েছে। এমনকি সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের মদ্যপান করা নিয়ে। সেইসঙ্গে তাঁর সুন্দরী বান্ধবী রেবাকে জড়িয়ে অনেক মুখরোচক সংবাদ। রেবা বিমানবালা— বিমানসেবিকা— এয়ার হোস্ট্রেস ছিলেন। পরে তিনি গার্হস্থ্যে ফেরেন। আর তারও পরে তিনি ইসকন-এর সন্ন্যাসিনী হয়ে যান। রথের মিছিলে— রথ যাত্রার মিছিলে তাঁকে নৃত্যুরত অবস্থায়, মাথের ওপর দুহাত তুলে কীর্তন-হরিনাম করতে দেখা গেছে। প্রশান্তদা অবশ্য বলেছেন, সুমন্ত ব্যানার্জি— একদা স্টেটম্যান-এর নামকরা সাংবাদিক এবং ‘ইন দ্য ওয়েক অফ নকশালবাড়ি’-সহ আরও কিছু বইয়ের লেখক সুমন্তদা প্রশান্তদার ভাড়া ফ্ল্যাট, যে ফ্ল্যাটের মালিক একদা কলকাতা পুরসভার মেয়র গোবিন্দ দে। সেই ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় প্রশান্ত সরকার, নীহারকণা সরকার সেইসঙ্গে ওঁদের দুই সন্তান চাণক্য— চালু আর গার্গী, সব মিলিয়ে চারজন, সেখানেই একটি ঘরে স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে প্রশান্ত সরকার ‘কেমিস্টেন’ টাইপ রাইটারে স্টোরি ফাইল করছেন আর পাশের ঘরে সুমন্ত ব্যানার্জি সেই সুন্দরী ‘এয়ার হোস্ট্রেস’ রেবার সঙ্গে শারীরিক সঙ্গমে আছেন। তো সে যাই হোক, এইসব ফোটো ট্যাবলয়েড-এ ‘দৈনিক বসুমতী’ তার টাকা নয়ছয়, অন্য কেলেঙ্কারি, প্রশান্ত সরকারের ব্যক্তিগত কেচ্ছা— সবই ছাপা হতে থাকে। প্রশান্ত সরকার নাকি ‘গুল’ আর ‘ঢপের’ এডিটর, এমন কথাও প্রকাশিত হয়েছে এইসব কাগজে। ‘কিছু না পারলে গুল দিয়ে দাও’ ইত্যাদি প্রভৃতি প্রশান্ত সরকারের মুখ দিয়ে বলানো, এমনও হয়েছে। প্রশান্তদা অবশ্য প্রেম করাকে ‘প্রেম দিচ্ছে’ বলতেন অনায়াসে। খুন করাকে বলতেন, ‘কিলো দিয়ে দিল’। এসবই ছিল তাঁর নিজস্ব ভোকাবুলারি। বসুমতী সাহিত্য মন্দির-এর বাড়িতে রিপোর্টার আর এডিটরদের যে বসার জায়গা, সেখানে রিপোর্টার ভোলা রায়চৌধুরী, হয় ধুতি-পাঞ্জাবি, গরমের দিনে, নয়তো সাফারি স্যুট, এই পরে আসতেন। ভোলাদা সাধারণভাবে পুলিশ বিট করতেন। পুলিশে— বেঙ্গল পুলিশ এবং ক্যালকাটা পুলিশে তাঁর প্রভূত জানাশোনা। ওঠাবসা। সাংবাদিকদের পুলিশ সংগঠন— আইজেএ এবং এনইউজেএ, আগেই বলেছি। ভোলা রায়চৌধুরী ছিলেন এনইউজেএ-র অন্যতম নেতা। ‘দৈনিক বসুমতী’-র নিউজ এডিটর সুধাংশু মাধব দে। রবিবারের সাময়িকী সম্পাদক কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়— সবাই এনইউজেএ, ‘যুগান্তর’-এর দেবব্রত মুখোপাধ্যায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন এনইউজেএ। আবার ‘দৈনিক বসুমতী’-র সাবএডিটররা— তাপস— তাপস দাস, শিখর— শিখর মজুমদার, ত্রিবিব। এঁরা সকলেই আইজেএ। ইউজেএ নবীন সংগঠন, আইজেএ পুরনো। বিজয় রায় ছিলেন চিফ রিপোর্টার। ঋজু রায় নামে তিনি কিশোর লেখা লিখতেন। অজয় কানুনগো বিজয় রায় রিটায়ার করলে চিফ রিপোর্টার হন। তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি। হাত গোটানো পাঞ্জাবি আর ধুতি। সেই পাঞ্জাবি হ্যান্ডলুম, কখনও কখনও আদ্দির। বিস্কুট রঙের হ্যান্ডলুম পাঞ্জাবি। হাত গোটানো। হালকা কোঁচকানো চুল, তেল দিয়ে ভালো করে সেজে উল্টে আঁচড়ানো, মুখে সর্বদা জর্দা সহ পান। কল্যাণদা— কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় অজয় কানুনগোকে বলতেন, ‘আইন-কানুন গো’। কল্যাণদা— কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় এইভাবে বিভিন্নজনের নামকরণ করতেন। ‘দৈনিক বসুমতী’-র যাঁরা ক্লাস ফোর— বেয়ারাদের কথা তো আগেই বলেছি। তার মধ্যে মনোহর ছিলেন কল্যাণদার খাস বেয়ারা। মনোহরের একটি নেয়াপাতি ভুঁড়ি ছিল, প্রতি সন্ধ্যায় ‘বাংলা সেবন’-এর ফলাফল। সেই মনোহর ভাই— অখণ্ড বিহারের বাসিন্দা— অজয় কানুনগোকে ‘অ্যাজোবাবু’ বলতেন তাঁর নিজস্ব ভোকাবুলারিতে। কল্যাণাক্ষদাকে বলতেন, কোল্যোণাক্ষবাবু, প্রলয় দাসকে ‘পেলেবাবু’, প্রণবেশ চক্রবর্তীকে ‘পরমেশবাবু’, প্রশান্তদা— প্রশান্ত সরকারকে ‘পোশানটোবাবু’, আমাকে— কিন্নর রায়কে ডাকতেন ‘ভোল্লোরবাবু’। রামেন্দু মুৎসুদ্দিকে অদ্ভুত এক নামে সম্বোধন করতেন, ‘মাগচুদ্দিবাবু’— মুৎসুদ্দিবাবু থেকে ‘মাগচুদ্দিবাবু’। অসামান্য পরিবর্তন, ভাবলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। ‘দৈনিক বসুমতী’-র রিপোর্টার ছিলেন সৌমেন গোস্বামী। ড্রাইভার সহ গাড়ি— কার ব্যবহার করতেন তিনি। কীভাবে সেই অর্থ আসত, বসুমতীর সাংবাদিকতা করে, কে জানে। উত্তর শহরতলির সংবাদদাতা ছিলেন উমাশংকর দাস, তিনি ছিলেন স্কুল টিচারও, ডানলপে বাড়ি ছিল কি তাঁর, অথবা সোদপুরে? কবি, ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকা সম্পাদক জীবনানন্দ দাশের খুব কাছের মানুষ স্নেহাকর ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর দাদা, তিনি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য। জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের দাদা চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। স্নেহাকরদা ক্যানসারে মারা যান। খুব বেশি তো বয়স হয়নি তাঁর। ছোট করে ছাঁটা গোঁফ। পাকা চুল উল্টে আঁচড়ানো। ক্লিন শেভেন। স্নেহাকর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘ময়ূখ’ পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশ সংখ্যা, যা জীবনানন্দের প্রয়াণের পর প্রকাশিত হয়েছিল, তার সম্পাদক ছিলেন স্নেহাকরদা— স্নেহাকর ভট্টাচার্য। জীবনানন্দের মারা যাওয়ার পর জীবনানন্দ অনুরাগীরা ‘এই জীবন ফড়িঙের দোয়েলের নয়’ অথবা ‘এই জীবন ফড়িঙের দোয়েলেরই’ করে শ্মশান যাত্রায় চলে গেলেন অতিজীবিত কবির শব্দহীন অথবা বাঙময় শব নিয়ে, তাঁদের মধ্যে ‘ময়ূখ’ সম্পাদক কবি স্নেহাকর ভট্টাচার্য অন্যতম। স্নেহাকরদা সরকারি ব্যাঙ্কে চাকুরে, স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। প্রচুর বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দিতেন লিটল ম্যাগাজিন নির্বিশেষে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। আলাপ হয়েছিল সামান্য। ভূমেন্দ্র গুহ কবি, খুব বড়ো চিকিৎসক, জীবনানন্দ গবেষক ও সংরক্ষক— তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যথেষ্ট। মূল আলাপ হয়েছিল শ্যামল— আমার বন্ধু শ্যামল, বিশিষ্ট কথাকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। বাড়ি মানে বড়ো ফ্ল্যাট। টালিগঞ্জের ঘড়িঘর নামের বাড়িতে দোতলায় থাকতেন শ্যামল। একেবারে পাশেই তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, সাংবাদিক ভাই— তাপস গঙ্গোপাধ্যায়। তাপসদা অতি সজ্জন মানুষ। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছিলেন প্রথমে। তার আগে সিনেমা করেছেন শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে। খুব ইচ্ছে ছিল নায়ক হবেন। তাঁর চেহারাও নায়কোচিত। ‘দ্য উইক’ নামের ইংরেজি সাপ্তাহিকের পূর্বাঞ্চলের ‘ব্যুরো চিফ’ ছিলেন তিনি। ‘দ্য উইক’-এর সার্কুলেশন প্রচুর। সব থেকে বেশি প্রচারিত ইংরাজি সাপ্তাহিক। ‘মালায়লম মনোরমা’ বা ‘মলয়ালম মনোরমা’ খুব বেশি প্রচারিত দৈনিক। তাদেরই ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘দ্য উইক’। তাপসদা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ ইত্যাদি প্রভৃতি। চমৎকার বাংলা ও ইংরাজি লেখেন। তাপস গঙ্গোপাধ্যায়ের জিভে ক্যানসার, অপারেশনের পর ভালো আছেন। তাপসদার ঠিক ওপরের ভাই বরুণ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও অতি বিখ্যাত সাংবাদিক শ্যামলদা তাঁকে ডাকনামে ‘গদা’ বলে ডাকেন। তাপসদার ডান নাম ‘তপা’। শ্যামলদা তাপসদাকে ‘তপা’ বলেই ডাকেন। বরুণদা আনন্দবাজার বাড়ির ইংরেজি দৈনিক ‘টেলিগ্রাফ’-এর সাংবাদিক। এক সময় দীর্ঘদিন ‘টেলিগ্রাফ’-এর লিখিয়ে ছিলেন। তাঁর একটাই কন্যা। তাপসদারও একটিই কন্যা। তাপসদার সহজীবনের সাথী— স্ত্রী মণি বর্মা— বিখ্যাত রহস্য কাহিনির লেখক মণি বর্মার কন্যা। মণি বর্মা একসময় মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করা মাসিক রোমাঞ্চ পত্রিকায় খুব লিখতেন। এছাড়াও বহু সফল সিনেমার চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। তাপসদা ও শ্যামলদা টালিগঞ্জেও ‘ঘড়িঘর’-এর দোতলায় থাকতেন। অনেকটা উঁচু সিঁড়ি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর— গগন ঠাকুরের আঁকা সিঁড়ি। দুটি ফ্ল্যাটই নয় বছরের লিজে নেওয়া, প্রচারক বোর্ডের সভাপতি ভূমেন্দ্র গ্রুহ— ‘যম’ নামে কবিতার বই সহ বহু কবিতা গ্রন্থ নির্মাতা, ভাবুক, জীবনানন্দ দাশের ভূমেন্দ্র, তাঁর সঙ্গে আলাপ শ্যামলদার বাড়িতেই।

Powered by Froala Editor