শান্তিদা ‘দৈনিক বসুমতী’-র লাইব্রেরিতে যখন চাকরি করেন, তখন তাঁর পাশের চেয়ারে নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী আর না-ভাঙা সিপিআই (এমএল)-এর নেতৃত্বের একজন, অসীম চট্টোপাধ্যায় (কাকা)-র প্রথম স্ত্রী রমা চট্টোপাধ্যায়। রমাদির সঙ্গে তখনও কাকার অফিসিয়াল ডিভোর্স হয়নি। রমাদি ও কাকার দুই মেয়ে। তারা তখন খানিকটা বড়ো। রমাদি খুবই শান্ত, ধীরে কথা বলেন। প্রয়োজনের কোনো বই চাইলে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য করেন। যদিও ১৯৭৮-৭৯ সালে, ১৯৮০ সালেও ‘দৈনিক বসুমতী’-র গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ নয় একেবারেই। কিছু পুরনো ফাইল, খবরের কাগজের। ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘যুগান্তর’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘স্টেটসম্যান’, ‘অমৃতবাজার’, ‘হিন্দু’, ‘পেট্রিয়ট’, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’। ‘পেট্রিয়ট’ সিপিআই পন্থীদের কাগজ। অরুণা আসফ আলি সেই কাগজের এডিটর ছিলেন কি? এছাড়া ছিল ‘আজকাল’, ‘সান্ধ্য আজকাল’। আনন্দবাজার বাড়ির ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ ততদিনে বন্ধ হয়ে গেছে। ‘মিড ডে’ নামে একটি ট্যাবলয়েড দেখি দিল্লিতে দুপুরবেলার কাগজ। অনেক পরে খানিকটা ‘এবেলা’-র যেমন পরিকল্পনা— তার কথা মনে পড়ত— ‘মিড ডে’-র লে আউট, খবর সাজানো দেখে। এই ‘মিড ডে’ দিল্লি, মুম্বাই— দু জায়গা থেকেই বেরত সম্ভবত। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ নামে একটি দৈনিক বার করেছিল ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’, গোয়েঙ্কাবাড়ির এই দৈনিক বেশি দিন চলেনি। খুব ছিমছাম, ঝকঝকে, দারুণ ছাপা, বড়ো বড়ো ছবি— সব মিলিয়ে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’। ‘সান’ নামে একটি প্রায় গুজব— গসিপ ট্যাবলয়েড আর অবশ্যই স-সি বেরত নব্বই দশকে। ব্রুসলির রহস্যময় মৃত্যু, নাকি হত্যা, এইসব নিয়ে তুমুল গসিপবাজি, সেইসঙ্গে ব্রুস লির বড়ো, ছোটো, মেজো ছবি। ব্রুস লির ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’, ‘ফিস্ট অফ দ্য ফিউরি’ সিনেমা হয়েছিল। ব্রুস লিকে নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি সিনেমা হয়েছে। তা এক সময় ‘হিট’-ও হয়েছিল খুব। ব্রুস লির সঙ্গে সঙ্গে ক্যারাটে, কুংফু— মার্শাল আর্ট যথেষ্ট জনপ্রিয় হল। পশ্চিমবাংলার পাড়ায় পাড়ায় প্রায় ক্যারাটে ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়ে গেল। দক্ষিণ ভারতের ‘কয়ারিপায়ত’, ক্যারাটে-কুংফুর সহোদর— এরকম বলেন অনেকে। ব্রুস লি, তাঁর বোন লিন্ডা লি— এঁদের কথা একসময় কমবয়সিদের মুখে মুখে ঘুরতে দেখেছি। ‘বিগ বয়েজ প্লে অ্যাট নাইট’— এমন কথা লেখা গোল গলা টি-শার্ট তখন খুব চলে। সেইসঙ্গে ব্রুস লির খালি গায়ের ছবি দেওয়া টি-শার্ট। কখনও বা লম্বা ল্যাজঅলা, মুখে আগুন সমেত ড্রাগন আর ব্রুস লির মুখ, নয়তো ব্রুস লির সারা শরীর। সত্যি বলতে কি, ব্রুস লির সেই প্রতিষ্ঠা— পপুলারিটি এখন আর কিন্তু নেই। বেশ অনেক বছরই তো নেই। ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ কী বার বার ঘুরে ফিরে আসে সিনেমা হলে? নাহ্। ইউটিউবে আছে বেশ কয়েকটি ব্রুস লি-ছবি— সিনেমা। ব্রুস লির অন্যতম অস্ত্র তার হাত— হাতের চেটো, হাতের তালু, হাতের আঙুল, পা, পায়ের পাতা আর চিতা হেন ক্ষিপ্রতা। ব্রুস লির সঙ্গে সঙ্গে নানচাকু, লোহার তৈরি একটি অস্ত্র চলে এল আমাদের সামনে। ব্রুস লি— মুভি ছাড়া অন্যান্য সিনেমাতে— হলিউডে তো বটেই, টালিগঞ্জ এবং বোম্বাইয়া সিনেমায় ব্রুস লি মুভির স্টাইলে নানচাকু বা নান চাক্কু জায়গা করে নেয় অনায়াসে। ক্যারাটে, কুংফুর লড়াই দেখানো হতে থাকে বিভিন্ন শটে। ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’-এ ‘হান’ নামে একটি ভয়ানক চরিত্র ছিল, যাকে ব্রুস লি হাত পা চালিয়ে খতম করে তার শক্তি ও ক্যারিশমায়, লড়াইয়ের টেকনিকে, কায়দায়। ‘ফিস্ট অফ দ্য ফিউরি’-ও দুর্ধর্ষ ছবি। আশির দশকে তো ব্রুস লি-ই হিরো। তাকে নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র, বই— আলাদা জীবনকথা, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দিতে। অন্য অন্য ভারতীয় ভাষা আর বিদেশি ভাষাতেও। সেইসব কেতাবের বিক্রিও অনেক। আর এইসব বইয়েরা মূলত পেপারব্যাক। বহু বছর হল সেই ব্রুস লি-ওয়েভ চলে গেছে। ব্রুস লিকে নিয়ে সেইসময় কিছু পোস্টারও তৈরি হয়েছিল। অনেকেই শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে ব্রুস লি-পোস্টার ঝোলাতেন, মনে পড়ে। ক্যাপসুলও হয়েছে ব্রুস লি-কে নিয়ে। নগ্নগাত্র, পটর্নপরা, দু’চোখে আক্রমণের সম্ভবনা— এই হচ্ছে ব্রুস লি। আপাতত ব্রুস লি থাক। পুনরায় ‘দৈনিক বসুমতী’ গ্রন্থাগার কথায় ফিরে যাই। সাপ্তাহিক ইংরেজি ‘ব্লিৎস’-ও রাখা হত ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। রাখা হত ‘হিন্দুস্থান টাইমস’। ‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর খবর পরিবেশনার চরিত্র এখন যেমন স-সি, তখন তো তেমন ছিল না মোটেই। ‘দৈনিক বসুমতী’ গ্রন্থাগারে— লাইব্রেরিতে রমা চট্টোপাধ্যায় চাকরি পান তখনকার তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সুপারিশে। লাইব্রেরিতে বিশেষ কোনো কাজই নেই, অথচ মাস গেলে বাঁধা মাইনে। রমাদি খুবই সিম্পল পোশাক, কৃশকায়, সাদা খোলের শাড়ি, তাঁতের। এই মানুষটি অসীমকে তাঁর ইউজি— আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে আগলেছেন খানিকটা তাঁর মা হয়ে, খানিকটা স্ত্রী হিসাবে। যেমন, একদা ভারতীয় নারীরা করতেন। এসব কথা শুনে তথাকথিত নারীবাদীরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু যা সত্য, তা তো সত্যই। প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক থাকার সময় শুধুমাত্র লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর করেসপন্ডেন্ট— সংবাদদাতা ছিলেন। তখন মার্গারেট থ্যাচারময় ইংল্যান্ড, টোরি পার্টির— কনজারভেটিভদের শাসন। তো সেই কনজারভেটিভদের শাসনের প্রধান, তথাকথিত ‘লৌহমানবী’ ম্যাগি বা মার্গারেট থ্যাচার। কাছাকাছি সময়েই ভারতে ইন্দিরা গান্ধী, ইংল্যান্ডে মার্গারেট থ্যাচার, ইজরায়েলে গোল্ডা মেয়ার আর একদা সিলোন— পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কায় সিরিমাভো বন্দরনায়কেই শাসক। মার্গারেট থ্যাচার তো টোরি পার্টি— কনজারভেটিভদের নেতা। তিনি বেশ দরিদ্র ঘর থেকে উঠে আসা জন। যেটুকু পড়েছি তাঁর সম্বন্ধে। টোরি পার্টির বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে লেবার পার্টি আছে ইংল্যান্ডে। আছে লিবারেলরা ও ক্রমক্ষয়মান ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিজিবি। নির্বাচনী যুদ্ধে একটা সময়ের পর লিবারাল আর কমিউনিস্টরা প্রায় প্রান্তিক। অথচ সিপিজিবি-র হ্যারি পলিট আর রজনীপাম দত্ত বা রজনীপালমে দত্তর কথা কে না জানে? প্রশান্ত সরকার তখনও লন্ডনের টোরিদের মুখপত্র ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এর করেসপনডেন্ট। ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর লন্ডন অফিস থেকে বলা হত, কলকাতার ফুটপাতে জ্যাক প্রেগার নামে এক আধবুড়ো সাহেব ‘কাজ’ করছে। ডেস্টিটিউটদের সরাচ্ছে। তুলে দিচ্ছে মাদার টেরেজার আশ্রমে। তখন কালীঘাটে মাদার টেরেজার বড়োসড় হাসপাতাল, শরণার্থী রাখার, শরণার্থী অর্থে যাঁরা রাস্তায় শুয়ে থাকেন, প্রায় মৃত্যুর মুখের মধ্যে। তাঁদের নাকি মরার আগে কানে খ্রিষ্টনাম দেওয়া হয়, দেখানো হয় ইনি ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। অনেক টাকা-পয়সার লেনদেন আছে এর পেছনে, তেমন অভিযোগও আছে। তো যাক সেসব কথা, এই অভিযোগের সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। তখন ‘নির্মল হৃদয়’-এর খুব, খুব রমরমা। মাদার টেরেজাকে নিয়ে সদা-সর্বদা হইচই। পৃথিবীজুড়ে, দেশজুড়ে, রাজ্যজুড়ে। জ্যাক প্রেগার নামে সেই আধবুড়ো সাহেব, কলকাতার ফুটপাত থেকে তথাকথিত ‘ডেস্টিটিউটদের’ সরাচ্ছে ভাবলে কেন জানি না আমার ‘এত বড়ো রঙ্গজাদু/ এতো বড়ো রঙ্গ’— এই লাইনটা মনে পড়ে। জ্যাক প্রেগার সাদা ফুলপ্যান্ট, ভেতরে গুঁজে পরা সাদা বুশ শার্ট, কোমরে বেল্ট, না রোগা না মোটা। তেমন দীর্ঘকায়ও নয়। মাথার চুল পাকা। মাথায় একটি কাপড়ের হ্যাট। তখন গ্রীষ্মদিন। প্রশান্তদা— প্রশান্ত সরকার আমাকে নিয়ে বেরিয়েছেন। জ্যাক প্রেগারের লিরিগ কাজ দেখবেন তিনি। লিখতেন তা নিয়ে। জ্যাক প্রেগারকে— কলকাতার ফুটপাতে তার কাজ নিয়ে লিখতেন লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ। বাইলাইন বেরল, ছবি-সহ সেই স্টোরি। আর প্রশান্তদা ‘দৈনিক বসুমতী’-তে বিশেষ সংবাদদাতা বলে লিখলেন জ্যাক প্রেগারের কাজ— অবশ্যই সচিত্র। সুধীর মল্লিক, বিনয় মুখার্জি, নাকি সানুদা— সুদর্শন মুখোপাধ্যায় কে যে জ্যাক প্রেগারের ছবি তুললেন, এমন আর স্মরণে নেই। তবে সানুদা হওয়াই সম্ভব। সানুদা— সুদর্শন মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিশু সাহিত্যিক বিশু মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো। বিশুদার ভাই শিশুবাবু বা শিশুদা— শিশু তো শিশুই, নামেও শিশু, কাজেও শিশু। চাকরি-বাকরিও যে কী করতেন শিশুবাবু সে তো ‘ভগায়’ জানে। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা অবস্থায় তাঁকে দু-একবার দেখেছি। ফর্সা খুব, চোখে চশমা। মাথার চুল হাত কোঁচকানো, এলোমেলো। সুদর্শনদা— সানুদা নাকি এক সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। এটা সানুদার মুখেই শোনা, স্বঘোষিত নকশাল, যেমন হয়। সানুদাকে যখন আমি ‘দৈনিক বসুমতী’-র ফোটোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে দেখি, তখন তিনি নিয়মিত কালীপূজক অথবা কালী সাধক। গালে ট্রিম করা ফ্যাশানেবল দাড়ি। কপালে লম্বা করে টানা সিঁদুর টিপ। তেল-সিঁদুরের টিপ। কালী সাধক অথবা কালীপূরজ। নিত্য পূজা করতেন সানুদা। তাঁদের বাড়িতে ‘প্রতিষ্ঠা’ করা কালীমূর্তি, ঘট। সেই ঘটে পুজো করতেন অকৃতদার বিশু মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন আবার তন্ত্রসাধক— প্রথমে ‘মাতৃসঙ্ঘ’, পরে ‘মাতৃসঙ্ঘ জনকল্যাণ আশ্রম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুদীনকুমার মিত্র মশাইয়ের শিষ্য। সুদীনকুমার মিত্র খুব বড়ো তন্ত্রবেত্তা ছিলেন। সে সব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। সাধক সুদীনকুমার মিত্রকে নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে আপাতত যাচ্ছি না। জ্যাক প্রেগারের ‘কাজ’ নিয়ে লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ও কলকাতার ‘দৈনিক বসুমতী’-তে রিপোর্ট বেরল। অবশ্যই প্রশান্ত সরকারের লেখা। সমাজকর্মী জ্যাক প্রেগারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত সরকার। সদাহাস্যময় মানুষ। চোখে চশমা। মাথায় হ্যাট ইত্যাদির কথা তো আগেই বলেছি। সেইসঙ্গে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট। কোমরে চামড়ার সরু বেল্ট, যা চলে গেছে প্যান্টের নুপের ভেতর দিয়ে। পায়ে শ্যু। বাঁ হাতে ঘড়ি। জ্যাক প্রেগারকে ফেলে আবার ফিরি ‘দৈনিক বসুমতী’-র লাইব্রেরি আর রমা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। রমাদির মুখে সব সময়ই একটা বিষণ্ণতা বিরাজ করত। কেন জানি না দেখেও মনে হত তা। জেল থেকে যেদিন মুক্ত হলেন অসীম চট্টোপাধ্যায়, সেদিন তাঁর মুখে-ঠোঁটে আগুন ছুঁইয়ে দিচ্ছেন রমা চট্টোপাধ্যায়, চার কলম জোড়া এই ছবি ছাপা হয়েছিল ‘যুগান্তর’-এর প্রথম পাতায়। যে কথা আগেও লিখেছি, তবু মনে আছে সেই ছবির কথা, যা ভেসে ওঠে স্মৃতিতে। কালোর ব্যাকগ্রাউন্ডে সেই ছবি। অসীম চট্টোপাধ্যায়— কাকা জেল থেকে বেরিয়ে কিছুদিন কানুদা— কানু সান্যালের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করেছিলেন। তরাই রিপোর্ট নতুন করে প্রকাশ করলেন তাঁরা। তরাই রিপোর্ট কানু সান্যালের, কানুদার লেখা, সে তো আমরা অনেকেই জানি অথবা জানি না। ‘দেশব্রতী’ প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল ‘তরাই রিপোর্ট’, সাদা মলাট, কোনো ছবি নেই কোথাও। শুধু সাদার ওপর টাইপে নাম। খুব বিক্রি হয়েছিল তখন কানুদার ‘তরাই রিপোর্ট’। অনেক অনেক বছর পরে নতুন করে বেরয় ‘তরাই রিপোর্ট’। যার নাম শুনলেই ‘হুনান রিপোর্ট’-এর কথা এসে যায় মনে। চিন বিপ্লবের সঙ্গে ‘হুনান রিপোর্ট’ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাক সেসব কথা। এখন কোথায়ই বা সেই গণচিন আর চিন বিপ্লব? সবই তো মায়াবন্দর। যা আমাদের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ নাড়িয়ে দিয়েছিল, যে লাল চিনের সম্ভাবনাময় সঙ্গীয় উপস্থিতি, তা এখন বৃহৎ— অতিবৃহৎ বাজার। পুঁজিতন্ত্রের বেসাতি তাকে ঘিরে। বেওসায়ী— ব্যবসায়ী— সাম্রাজ্যবাদী ‘লাল চিন’। রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ ও একই সঙ্গে— পাশাপাশিও বলা যায়, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। সামনে লাল ঝান্ডা রেখে চিনের এই দ্বিচারিতা, আসলে স্টেট ক্যাপিটালিজম— পুঁজিতন্ত্রের সেবা করা, পীড়ন করে আমাকে বা আমার সত্তা যেমন আহত হয় সিপিসি— চিন কমিউনিস্ট পার্টির এই আচরণে, তেমন আহত হওয়ার ভাব তো অনেকেরই মন ও মননে আছে, বিশেষ করে যাঁরা সত্তর দশকে চিনকে সামনে রেখে, চিন কমিউনিস্ট পার্টি, মাও-সে-তুঙ, চৌ-এন-লাই, লিন-পি-য়াওদের পতাকা করে। বিপ্লবের ঝান্ডা ওড়াতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা। ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’, ‘চেয়ারম্যান মাও লাল সেলাম’, ‘চেয়ারম্যান মাও জিন্দাবাদ’ বলে। সময় কত দ্রুত বদলায়, অথবা বদলায় না। ‘চিংকাং পাহাড়ের সংগ্রাম’— এই নামে আরও একটি চটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল দেশব্রতী প্রকাশনী, সেইসময়। চিন বিপ্লবের ইতিহাস পড়তে পড়তে, জেলে উদ্বুদ্ধ হতাম, নতুন স্বদেশ— নতুন স্বাধীন ভারতবর্ষ গড়ার জন্য। সেইসব কথায়, সেথায় হয়তো ছিল কিছু অতিকথন। নবম কংগ্রেসের রিপোর্ট— সিপিসি-র নাইন্থ কংগ্রেস নিয়ে আমাদের উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। কিন্তু অবাক হলাম, আহতও হলাম ভেতরে ভেতরে— যখন দেখলাম চেয়ারম্যান মাও, ভাইস চেয়ারম্যান লিন-পি-য়াও-কেই তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে উত্তরাধিকার হয়? এ কি পৈতৃক সম্পত্তি নাকি? এভাবে হয় নাকি? নাইন্থ কংগ্রেসের রিপোর্টের সঙ্গে ছবি এল পিকিং রিভিউ-এ। সেখানে মাও ক্যাপ, মাও কোট পরা লিন-পি-য়াও ‘রেড বুক’— অতিবিখ্যাত ‘রেডবুক’ হাতে লিন-পি-য়াও দাঁড়িয়ে আছেন মাওয়ের পাশে, পার্টি কংগ্রেসের সময়। তখন মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছি সব। কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্ন— প্রশ্নের খোঁচা তো থেকেছেই। সেই খোঁচার ঘা নিয়ে জেগে থেকেছি। প্রশ্নাতুর হয়েছি মনে মনে কিন্তু প্রশ্ন তো করতে পারিনি। কেন পারিনি? কেন এই অন্ধ আনুগত্য? আসলে কাকে প্রশ্ন করব? কে উত্তর দেবে? কারা উত্তর দেবে? কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেই তো ‘রেডিগেড’— ‘দলত্যাগ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’— এইসব বিশেষণ শুনতে হবে। এমনকি জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। বহু বছরের ‘শ্রেণী মিত্র’, রাতারাতি পরিণত হবে ‘শ্রেণীশত্রুতে’। এই বিশ্বাসহীনতা, বিশ্বাসকে খুন করা, আমাকে নতুন নতুন জিজ্ঞাসার অথই সমুদ্রে ফেলে দেয়। সেই পাথরকে অতিক্রম করতে চাই নানাভাবে। পারি না, ব্যর্থ হই। সম্পূর্ণ ব্যর্থ। মনের ভেতর জিজ্ঞাসা জমে, অভিমান, ভয়। একক হয়ে যাব না তো— এই জিজ্ঞাসা, গূঢ় প্রশ্ন নিয়ে এইধরনের ভয়। ভয়। ত্রাস। অন্ধ কোকিল গান গেয়ে ওঠে মধ্যরাতে। তার কাছে জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্নাময় আকাশ, মেঘালু আশমান— সব— সবকিছু এক হয়ে ওঠে। সেই এক হয়েছে, এক হয়ে গেছে, এই দেখার যে যন্ত্রণা, তা তো সকলে অনুভবই করতে পারবেন না। পার্টিমনস্ক স্বপ্ন দেখা জনের এই সমস্যা।
Powered by Froala Editor