‘সত্যযুগ’-কথা

সত্তর দশকের শুরুতে ‘সত্যযুগ’ নামের বাংলা দৈনিকটি বামপন্থীদের পক্ষে অনেক কথা বইলতে থাকে, বিশেষ করে সিপিআই (এম) সহ অফিসিয়াল বামদের সমর্থনে। সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায় ‘সত্যযুগ’-এর ছাপা কাগজ তেমন ভালো ছিল না। জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাই যতনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ‘সত্যযুগ’-এর হর্তা-কর্তা-বিধাতা। জীবনলাল ঢুলু-ঢুলু— বড়ো বড়ো চোখ। সেই একজোড়া চোখে কী যেন মায়া। মাথার মাঝখানে সিঁথি কাটা, কোঁকড়ানো চুলের বাবরি। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট ও হাফ শার্ট— টেরিকটের বুশ শার্ট। ক্লিন শেভেন, শ্যামলা রং, তবু মুখে যেন একটা কাজী নজরুল ইসলাম কাজী নজরুল ইসলাম। যতন— এক্সসারসাইজ করা চেহারা। পেটানো স্বাস্থ্য। একটু ‘সেকেলে গুণ্ডা গুণ্ডা’ ভাব। 

১৯৭৭ সালে এই রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পর সত্যযুগ-এর আরও বাড়-বাড়ন্ত হয়, সে কথায় পরে আসছি। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপ পশ্চিমবাংলায় একটি বাংলা কাগজ তৈরি করার চেষ্টা করে সম্ভবত পঞ্চাশ দশকের শেষ লগ্নে অথবা ষাটের দশকের গোড়ায়। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাংবাদিক ও লেখক গৌরকিশোর ঘোষ, সাংবাদিক প্রশান্ত সরকার কর্মী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন সেই সত্যযুগ— ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র ‘সত্যযুগ’-এ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দৈনিকটি প্রকাশিত হয়নি। শুনেছি ‘ডামি রান’ পর্যন্ত শুরু হয়ে গেছিল সেই ‘সত্যযুগ’-এর। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপের সত্যযুগ বেরলে নিঃসন্দেহে আনন্দবাজার-গ্রুপ সহ বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র, খবরের কাগজের ‘ভাত মারা’ যেত। প্রশান্ত সরকার ইউপিআই থেকে সেই ‘সত্যযুগ’-এ এসেছিলেন। ইউপিআই ছিল সংবাদ সংস্থা ইউএনআই-এর পূর্বতন রূপ ও নাম। পিটিআই— প্রেস্ট ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া এবং ইউএনআই— ভারতীয় সংবাদ সংস্থা। যেমন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘তাসে’, আমেরিকানদের ‘রয়টার’, ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’ বলে দাবি করা চীনের ‘সিনহুয়া’। ইংল্যান্ডের বিবিসি— ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন তখন খুব শক্তিশালী, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণহীন বেতার সংস্থা। বিবিসি-র টিভি চ্যানেলও হয় পরে। এছাড়া আমেরিকার রেডিও স্টেশন ভিওএ— ভয়েস অফ আমেরিকা, চিনের ‘রেডিও পিকিং’, তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মস্কো রেডিও খুবই শক্তিশালী মাধ্যম সংবাদ প্রচারের। অখণ্ড পাকিস্তানের ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’র সম্প্রচারও ছিল খুবই শক্তিশালী। তো সে যাই হোক ১৯৭৭-এর পর ‘সত্যযুগ’— জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সত্যযুগ’ বেশ শাঁসে জলে বেড়ে ওঠে। শাসন ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআই (এম) নেতাদের একটা অংশ ‘সত্যযুগ’-কে আনুকূল্য দিতে থাকেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার জরুরি অবস্থা পর্বে তৎকালীন যুবরাজ সঞ্জয় গান্ধী বিরুদ্ধে করা কোনো একটি মন্তব্য তখনকার নব কংগ্রেসি— ইন্দিরা কংগ্রেসি সরকারের পছন্দ হয়নি। ফলে যতদূর জানি সম্পাদক জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সঞ্জয় গান্ধী বিষয়ক মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। এই তথ্য আমাকে দেন সাংবাদিক কল্পতরু সেনগুপ্ত। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ। মাস্টারদা— সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, এমন দাবি করতেন। এছাড়াও কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে তাঁর গবেষণা, গবেষণাগ্রন্থ আছে। এখন ছাপা আছে কীনা জানি না। কল্পতরুদা ধুতি, পায়ে পা ঢাকা কালো চামড়ার পাম্প শ্যু। এরকম জুতো আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায়ও পরতেন। তিনি অবশ্য তা কিনে আনতেন কলেজস্ট্রিট মার্কেটের ভবিচরণ দাসের দোকান থেকে। এক জোড়া জুতো চল্লিশ টাকা, ১৯৬০-৬১-৬২-র দর বলছি আমি। ভবিচরণ দাস-এর বিদ্যাসাগরী— লাল বিদ্যাসাগরী চপ্পলও খুব বিখ্যাত। একজোড়া ‘বিদ্যাসাগরী’-র দাম ছিল দশ টাকা। হ্যাঁ, দশ টাকা। আমি আগ্রায় ১৯৬২-৬৩ সালে এক টাকায় একজোড়া নাগরা বা নাগরাই জুতোবিক্রি হতে দেখেছি দয়ালবাগের পাশেপাশে ছড়ানো জুতোর দোকানে। তার ভেতর পিসবোর্ড আছে বা ছিল কিনা জানা নেই। দয়ালবাগ-এর মন্দির তৈরি হচ্ছে কত কত কত দশক পার হয়ে গেল। এখনও তার ‘কাজ’ সম্ভবত শেষ হয়নি। রাধেস্বামী সম্প্রদায়ের এই মন্দির নাকি সর্বধর্ম সমন্বয়কারী মন্দির। সেই মন্দিরে পাথরে ফুটিয়ে তোলা গোলাপ ও রজনীগন্ধার ‘কাজ’ ভোলার নয়। কয়েকতলা নির্মাণ হচ্ছে পর পর। সম্প্রতি— কয়েক বছর আগে গিয়েও দেখেছি দয়ালবাগের পাথর খোদাই চলছে। এই মন্দির রাধেস্বামী সম্প্রদায়ের। রা-স্বা যাঁদের মুলমন্ত্র। ‘সৎসঙ্গ’-র অনুকূলচন্দ্র ও তাঁর গর্ভধারিনী এই রা-স্বা মন্ত্রেরই প্রচারক ছিলেন। অনুকূলচন্দ্রের গর্ভধারিনী সম্ভবত দয়ালবাগের এই রা-স্বা পন্থীদের কাছেই দীক্ষা পেয়েছিলেন। রা-স্বা শব্দের অর্থ রাধেস্বামী। দয়ালবাগের যাঁরা রাধেস্বামী সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁদের প্রচুর বই-পুস্তক ইত্যাদি আছে। একসময় তাঁদের নিয়ে কিছু কাজ করব বলে রাধেস্বামী সম্প্রদায়ের বেশ কিছু বইপত্র কিনেছিলাম। আর সবটাই হিন্দিভাষায় ছাপা। আপাতত থাক সেসব কথা। কলেজস্ট্রিট মার্কেটে ভবিচরণ দাসের উল্টো ফুটপাতে ‘রাদু’-র জুতোর দোকান। ‘রাদু’-র কাবলি জুতো একসময় অতিবিখ্যাত আর একটু দামিও ছিল। ১৯৬০-৬২ সালে আমার পায়ের ‘রাদু’-র কাবলি একজোড়া তিরিশ টাকা। সেই কালো রঙের কাবলি— ব্যাক বেল্ট পরেছি। খুব ভালো চামড়া, নরম। পাশেই শীতলা মন্দির, একটি অতি চমৎকার কচুরির দোকান। সেখানে কচুরি ও ছোলার ডাল অতিবিখ্যাত। খুব স্বাদের। সেই কচুরির দোকান বহু বছর হল নেই। শীলতা বা শেতলা মন্দিরটির সামনে যূপকাষ্ঠ— হাঁড়িকাঠ, তার মানে পাঁঠা বলির ব্যবস্থা ছিল সেখানে। এই ফুটপাত ধরে হাতিবাগান, শ্যামবাজারের দিকে এগোলেই ডান দিকে ‘বাটা’-র অতি বিখ্যাত শো-রুম। বেশ বড়ো বড়ো, সাজানো। দোতলা দোকান। পাশ দিয়ে— একেবারে গা ঘেঁষে চলে গেছে কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট। ‘বাটা’-র দোকানের গা ঘেঁষে এইউসি— আমেরিকান ইউনিভার্সিটি সেন্টার। দোতলা এই বাড়িতে ইংরেজি বইয়ের আয়োজন— লাইব্রেরি। সরু, সংকীর্ণ সিঁড়ি। ধর্মতলার আমেরিকান লাইব্রেরি— আমেরিকান সেন্টার, যার সঙ্গে জোড়া পুরনো দিনের হোয়াইট লেডলয়-এর বড়োসড় বিল্ডিং, বেশ কয়েকতলা, আমেরিকান লাইব্রেরি অবশ্য একতলাই। হোয়াইট লেডলয় বিল্ডিং-এর দুটি দরজা তখন, দেখেছি। এই বাড়িতেই জীবনবীমা— এলআইসি অফিস। ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার— পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এর দপ্তরও এখানেই, দোতলায়। তিন তলায় সুভো ঠাকুর থাকেন। ‘প্রতিক্ষণ’ দপ্তর— পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’ দপ্তর প্রথম তিন তলাতেই ছিল। সেখানে কাজ করতে করতে আমরা কলকাতা ময়দানে ফুটবল ম্যাচের জয়ধ্বনি, সমর্থকদের হু-হুঙ্কার, জনকল্লোল হয়ে যেন ভেসে আসত। জনকল্লোল— ময়দানি শীৎকার।

কল্পতরু সেনগুপ্তকে ফেলে এসেছি বেশ খানিকটা আগে। আবার ফিরি কল্পতরু সেনগুপ্ততে। কল্পতরুদা সিপিআই (এম)-এর সদস্য ছিলেন। রাজ্য কমিটিতে ছিলেন কী? তিনি জ্যোতি বসু ও পিডিজি প্রমোদ দাশগুপ্ত— দুজনেরই কাছে মানুষ। কল্পতরু সেনগুপ্ত নিয়মিত উত্তর সম্পাদকীয়— পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতেন সত্যযুগে, এক সময়। পরে জীবনলাল— যতন কোম্পানির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ তীব্র হলে দৈনিক বসুমতী সম্পাদক হয়ে প্রশান্ত সরকার আসার পর তিনি কল্পতরুদাকে ডেকে নেন, ‘দৈনিক বসুমতী’ পোস্ট এডিটোরিয়াল ও কোনো কোনোদিও সম্পাদকীয় এডিটোরিয়াল লেখার জন্য। দৈনিক বসুমতীতে পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতেন প্রণবেশ চক্রবর্তী— তাঁর কলমের নাম একসময় ছিল ‘সরাসরি’, তখন কেদার ঘোষ দৈনিক বসুমতী সম্পাদক। প্রশান্তদা— প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক হয়ে আসার পর ‘সরাসরি’ নামে প্রণবেশ চক্রবর্তীর কলম উঠে গিয়ে, কোনো নির্দিষ্ট কলম-শিরোনাম ছাড়াই বেরতে থাকে। ‘দৈনিক বসুমতী’ পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতেন রামেন্দু মুৎসুদ্দি। তিনি ‘দৈনিক বসুমতীর’-র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। প্রণবেশ চক্রবর্তীই তাই-ই ছিলেন। কল্পতরুদা পোস্ট এডিট লিখতেন সে তো আগেই লিখেছি। তিনি আবার বসুমতী ইউনিয়নের সভাপতি। প্রভাত, বেণী— এঁরা ছিলেন বসুমতী ইউনিয়নের পাণ্ডা— সবাই সিটু— সিপিআই (এম)। প্রভাব পদবী ঘোষ— সম্ভবত, খুব দাপট ছিল তাঁর এক সময়। বেণীরও। ‘অশোর সেনের আমল’ বা ‘ঘটকবাড়ির’-র আমলে নীলমণি মণ্ডল নামে একজন কংগ্রেসি ট্রেড ইউনিয়ন নেতার— আইএনটিইউসির নেতা তিনি খুবই দাপট ছিল। পরে সত্তর দশকের শেষে যে নীলমণি মণ্ডলকে দেখি, তিনি তখন ভগ্নস্তূপ। মাথার কলপ করা চুল তা দিয়ে কোনোভাবে ‘টালি’-টীকা সামলানো আছে। বাড়িতে কাচা, বেশি ‘রবিন-ব্লু’ বা ‘টিনোপল’ দেওয়া সরু পাড় মিলের ধুতি ও টেরিকটের ফুলহাতা সাদা শার্ট বা পাঞ্জাবি। হাতা গুটিয়ে পরা। পায়ে স্যান্ডেল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। সর্বদা ঠোঁটে জ্বলন্ত বিড়ি, ক্বচিৎ-কদাচিৎ সিগারেট, প্লেন ‘ইউলস’ অথবা ‘চারমিনার’। একটু ঝুঁকে হাঁটেন নীলমণি মণ্ডল। দখিনের মানুষ। তিনি ‘দৈনিক বসুমতী’-তে অশোক সেনের আমল, ‘ঘটকবাড়ির আমল’, দেখেছেন। দেখেছেন সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক হলধর পটল ও কৃত্তিবাস ওঝাদের। এই দুটি নামই অবশ্য ছদ্মনাম। ‘দৈনিক বসুমতী’-র একটা বামপন্থী ভূমিকা ছিল, বিশেষ করে ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন। তখন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ পুড়েছে গণরোষ আর ‘দৈনিক বসুমতী’-র পাঠক-গ্রাহক-প্রচার-সার্কুলেশন বেড়েছে হু-হু-হু-হু করে। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় সেই সময়কার পশ্চিমবাংলার জাতীয় কংগ্রেস সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে খুব খেলো নিউজপ্রিন্ট আর ভাঙা টাইপে ছাপা ‘সাবধান! সাবধান!!’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন ‘দৈনিক বসুমতী’ থেকে। সেই পুস্তিকার দাম ছিল দশ নয়া পয়সা। হু-হু করে বিক্রি হয় ‘সাবধান! সাবধান!!’ সাধারণ মানুষ অনেক অনেক কপি সংগ্রহ করেন একসঙ্গে। ঈষৎ খর্বকায়, ধুতি-হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি— রঙিন, পা ঢাকা জুতো— এই হলেন সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি আগুন ঝরানো ভাষায় সম্পাদকীয় লিখতেন। সবে ছেড়ে এসেছেন ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদনা। তিনি একইসঙ্গে মার্কসবাদী আবার কালীপুজোর উদ্বোধনও করতেন। শোনা যায় একবার ‘দৈনিক বসুমতী’ বার্ষিক পিকনিকে গিয়ে তিনি মহিলা জাদুকর ভি পুষ্পার প্রতি খানিকটা দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলেন, এই তথ্য আমায় দিয়েছিলেন বাবু কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পিকনিকে কল্যাণদা নিজে উপস্থিত ছিলেন। পানের ব্যবস্থা ছিল, ভার্বে ও নাউনে। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ভালো পান করতে পারতেন। তাঁর সম্বন্ধে কেউ কেউ ‘ডলার, ডালেস’ ইত্যাদি অপবাদ দিতেন। ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস’ বিবেকানন্দবাবুর অতিপ্রতিশ্রমী কাজ। বহু সংস্করণ হয়েছে এই বইয়ের। ‘সাক্ষরতা প্রকাশন’, ‘নবপত্র’, ‘নবপত্র’-র প্রসূন বসু এই মহাগ্রন্থটি ছাপেন। নীলমণি মণ্ডল— ‘বসুমতী’-র আইএনটিইউসি-র ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। আমি যখন তাঁকে দেখি ১৯৮০ সালটাল নাগাদ, তখন তিনি ভগ্ন স্বাস্থ্য। সামনে খানিকটা যেন ঝুঁকে গেছেন, এমনটি মনে হয় তাঁর চেহারা দেখে। তবে পোশাক— আশাক, ডাবল ঘরের পাঞ্জাবিতে সোনার কালো ফ্রেমের চশমা— সব ঠিক আছে। তখন আর নীলমণি মণ্ডল সক্রিয়ভাবে আইএনটিইউসি করেন না বসুমতীতে। সামনের পাটির ওপরের দু-তিনটে দাঁত অ্যাসিড ক্ষয়। একটানা কথা বলতে গিয়ে সামান্য হাঁপানোও হয়তো। তাঁর হাতে ফোলিও ব্যাগ, চামড়ার। ধুতিটি সামান্য তুলে পরা। আমার গর্ভধারিনী গায়ত্রী রায় একটা গান বারবার গাইতেন— ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়/ আজ যে রাজা ধীরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়/ সমান নাহি যায়…’ মায়ের খুব প্রিয় গান ছিল এটি। এই গান ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গেছেন, তাঁর অতুলনীয় কণ্ঠবাহারে। নীলমণি মণ্ডল তখন তাঁর দখিন— দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাড়ির পাশে একটি বড়োসড় শিবমন্দির তুলছেন, পাথরের মন্দির। কাজ চলছে। পাশে পুকুর। নীলমণির এই মন্দিরের বাজেট অনেক অনেক অনেক টাকার। তার জোগাড়যন্ত্র চলছে। নীলমণি মণ্ডলের সেই আইএনটিইউসি দাপট আর নেই। বরং, তুলনায় অনেক স্তিমিত। এই তথ্য দিয়েছেন কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কল্যাণদার ঘর— ‘দৈনিক বসুমতী’ রবিবাসরীয় বিভাগে এসে বসেন নীলমণি। কথা বলেছেন অনেক্ষণ ধরে। পুরনো দিনের বসুমতীর অনেক স্মৃতি দুজনের উচ্চারণে ভেসে উঠত বার বার। নীলমণি মণদলের উচ্চারণে বুঝতে পারি তিনি কবি, ঐতিহাসিক ও সাংবাদিক কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কতটা ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। ‘সত্যযুগ’ সম্পাদক জীবনলাল বন্দ্যপাধ্যায়ের কথা আগেই বলেছি। ওয়াকার্স পার্টির একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জীবনলাল। তিনি বিপ্লবী— ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র পথের পথিক । ‘ডেমোক্রেটিক ভ্যানগার্ড’ ছিল ওয়াকার্স পার্টির পলিক্যাল অরগ্যান, মুখপত্র। ‘ডেমোক্রেটিক ভ্যানগার্ড’ সত্তর দশকের শেষ লগ্নে রাস্তায় মারা হত। উত্তর কলকাতার ক্রিক রো-র কাছাকাছি কোনো এক গলিতে। সেখানে কী কোনো ওয়াকার্স পার্টির লোক ছিলেন? এই বিপ্লবী জীবনলাল ও ওয়াকার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জীবনলালের পদবী কী জীবনলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিল? নাকি জীবনলাল মুখোপাধ্যায়, ঠিক স্মরণে আসছে না। ওয়াকার্স পার্টির জ্যোতি ভট্টাচার্য যুক্তফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল প্রার্থীর হয়ে জয়লাভ করেন বিধানসভা নির্বাচনে। অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সোভিয়েত কৃষি ব্যবস্থার ওপর তাঁর একটি ভালো বই আছে। বইটি সম্ভবত এখন আর ছাপা নেই। এই গ্রন্থের প্রকাশক ‘প্রমা’। ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, সুদর্শন অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। তাঁকে বক্তৃতা করতে দেখেছি, শুনেছি চমৎকার বক্তব্য পেশ করতেন। তো সে যাই হোক, নীলমণি মণ্ডল তাঁর প্রস্তাবিত শিব মন্দির শেষ করতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই। ‘দৈনিক বসুমতী’ লাইব্রেরিটি ছিল একেবারে টঙে। তিনতলায়। শান্তিদা বসতেন লাইব্রেরিতে। একসময় কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য হৃদয়ের বন্ধু। পরে দূরত্ব তৈরি হয়। শান্তিদার একমাথায় কালো চুল, পাটপাট— উল্টে আঁচড়ানো, মনে হয় এই স্নান সেরে এলেন। টেরিকটের রঙিন বুশ শার্ট, টেরিকটেরই রঙিন ফুলপ্যান্ট, পায়ে চপ্পল। খুব ফর্সা। দাড়ি-গোঁফ প্রায় নেই বললেই চলে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘পর্নপুট’-এর জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘সাগর থেকে ফেরা’ কবিতাটি কপি করে দিলেন

Latest News See More