‘যুগান্তর’-এর সাবএডিটাররা অনেকেই ঘোষ বাড়ির কারু না কারও কথায়— সুপারিশে চাকরিতে জয়েন করেছেন। অবশ্যই জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে কিছু একটা করা বা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ভিড় বাড়ানোর জন্য। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বহু সম্পন্নদের কাছেই ‘কমি’ বা কমিউনিস্ট ছিল গাল বিশেষ। ওঁরা অবশ্য বানান ও উচ্চারণ করতেন ‘কম্যুনিস্ট’ বা ‘কমিনিস্ট’। তুষারকান্তি ঘোষ, তরুণকান্তি ঘোষ, সুকমলকান্তি ঘোষ, প্রফুল্লকান্তি ঘোষ (শত) সবাই ছিলেন ‘যুগান্তর’ বা পত্রিকাবাড়িতে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। বিশেষ করে ‘বড়বাবু’— তুষারকান্তি ঘোষ এবং তাঁর পুত্র তরুণকান্তি ঘোষ, যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকায় চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে। তুষারবাবু অধিকাংশ সময় থাকতেন বারাসাতের ‘শিশিরকুঞ্জ’-তে। সেই বড় বড়ো বড়ো গাছওয়ালা বি-ই-শা-ল প্রাসাদ কবেই চলে গেছে প্রোমোটারের থাবার নিচে। মধুপুর, ইলাহাবাদেও বড়ো বড়ো বাড়ি ছিল তুষারকান্তি ঘোষের। ঘুরে ফিরে থাকতেন তিনি এইসব বাড়িতে। খুব পড়ুয়া ছিলেন। পড়তে ভালোবাসতেন বিচিত্র বিষয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রর ঘনাদা তাঁর অতিপ্রিয় চরিত্র। বিশেষ বন্ধুও ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, এছাড়াও ভবানী মুখোপাধ্যায়— ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখক, পরে মূলত অনুবাদক, ছিলেন তুষারবাবুর বন্ধু-তালিকায়। বন্ধু ছিলেন শিশুসাহিত্যিক বিশু মুখোপাধ্যায়ও। বিশুবাবু ‘দৈনিক বসুমতী’ ছোটোদের পাতা দেখতেন আর বিষ্ণু শর্মা নামে এই পাতায় চিঠি লিখতেন ছোটোদের জন্য— ছোটোদের উদ্দেশ্য করে। এভাবেই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় সাপ্তাহিক ‘আনন্দমেলা’-র পাতায় ছোটোদের জন্য চিঠি লিখতেন বিমলচন্দ্র ঘোষ— ‘মৌমাছি’। এই বিমলচন্দ্র ঘষ (মৌমাছি) শিশুসাহিত্যিক। আর একজন বিমল ঘোষ ছিলেন, যিনি কবি। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দর্শন হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন বামপন্থাকেই। অসামান্য সব গান লিখেছেন তিনি। খুব নামী গীতিকার, সিনেমার গানও লিখতেন তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় উত্তরকুমারের লিপে— ‘শোনো বন্ধু শোনো/ প্রাণহীন এই শহরের ইতি কথা/ ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা/ এখানে আকাশ নেই, এখানে বাতাস নেই…’। আরও বহু ভালো, হিট গানের গীতিকার এই বিমলচন্দ্র ঘোষ। যেমন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায়— ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়, সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে…’। ‘যুগান্তর’-এর ছোটোদের পাতা ‘ছোটোদের পাততাড়ি’ দেখতেন অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো)। অখিল নিয়োগী শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতেন। ‘যুগান্তর’-এর পাততাড়ি তখন মাঝে মাঝে রঙিন। লম্বা দাড়িওয়ালা, বিরল কেশ স্বপনবুড়োর একটা ক্লাপনিক ছবি। তখন ‘মণিমালা’ হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র ছোটোদের পাতা ‘আনন্দমেলা’— মূলত বিমলচন্দ্র ঘোষের পরিচালনায়। আর ‘যুগান্তর’-এর ‘ছোটোদের পাততাড়ি’-র সম্পাদক স্বপনবুড়ো— অখিল নিয়োগীর সার্বিক উপস্থিতিতে মান্যতা দিয়ে ‘সব পেয়েছির আসর’। ‘সব পেয়েছির আসর’ ও ‘মণিমেলা’-র শাখাকেন্দ্র সমস্ত পশ্চিমবাংলা জুড়ে। ‘মণিমালা’, ‘সব পেয়েছির আসর’-এর নানা অনুষ্ঠান বছরভর। মনীষীদের জন্মদিন পালন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ড্রিল, প্যারেড, গান। সেইসব ছবি— ‘মণিমালা’-র সদস্যদের নানা ধরনের কাজ-কর্ম। সেইসব অনুষ্ঠানের সিঙ্গল কলাম ছবি, বেশ ছোটো করেই ছাপা হয় ‘ছোটোদের পাততাড়ি’ ও ‘আনন্দমেলা’-র— আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে দেওয়া একটি পাতার আনন্দমেলায়। তখনও পাক্ষিক বা মাসপত্র হিসাবে বেরোয়নি ‘আনন্দমেলা’। ‘মণিমেলা’ করতেন অনেকেই, পাড়ায় পাড়ায় ছিল ‘মণিমেলা’। পাশাপাশি একইসঙ্গে ‘সব পেয়েছির আসর’। প্রতি পাড়াতে অনেকেই উৎসাহী হতেন ‘মণিমেলা’ বা ‘সব পেয়েছির আসর’-এ যোগ দেওয়ার জন্য। এছাড়াও যতদিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক ‘স্বাধীনতা’-কে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি, ততদিন ‘স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত ছিল শিশুকিশোর সংগঠন ‘কিশোরবাহিনী’। পরে ‘স্বাধীনতা’-কে সরকার ঘোষিত ফতোয়ায় ব্যানড করা হলে ‘কিশোরবাহিনী’-র কাজে ভাটা পড়ে। আমরা অনেকেই জানি অথবা জানি না সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন ‘কিশোরবাহিনী’-র সদস্য। শিশুসাহিত্যিক খগেন্দ্রনাথ মিত্রর সম্পাদনায় বেরত কিশোরদের দৈনিক পত্রিকা। শিশুসাহিত্যিক হরেন ঘটক, হরেন ঘটক মাস্টারদা নামে ‘যুগান্তর’ পাততাড়িতে লিখতেন। তিনি ছিলেন বামপন্থী জন। ‘যুগান্তর’-এর ‘ছোটোদের পাততাড়ি’ পরিচালনা করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, হয়তো বা প্রবোধকুমার সান্যালও কিছুদিন। অখিল নিয়োগ (স্বপনবুড়ো)-র কথা তো আগেও বলেছি। স্বপনবুড়ো কলেজস্ট্রিটের অশুতোষ লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত ছোটোদের মাসপত্র ‘শিশুসাথী’-তে লিখতেন। তাঁর বিখ্যাত লেখা ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’ ধারাবাহিকভাবে বেরত ‘শিশুসাথী’-তে। তখনকার সময়ে ‘শিশুসাথী’ খুবই বিখ্যাত পত্রিকা ছিল ছোটোদের। ঝকঝকে ছাপা, চমৎকার কাগজ, ভালো মলাট। ‘শিশুসাথী’-র পুজো সংখ্যাটিও খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হত। অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো) ‘যুগান্তর’-এর অনেক অনেক পাততাড়ি পাঠকের কাছে ছিলেন স্বপ্নের মানুষ। তখন বাঙালির এক নম্বর দৈনিক ‘যুগান্তর’। আমি স্বপনবুড়োকে সামনাসামনি বেশ কয়েকবার দেখেছি। তিনি মোটেই বড়োসড় দাড়ি-গোঁফ সমেত অনেকটা যেন সান্টা ক্লজ চেহারার, মোটেই তো তেমন ছিলেন না। বরং কামানো মাথা, তা বিরল কেশের জন্য হতে পারে, গেরুয়া হাফ পাঞ্জাবি আর গেরুয়া রঙেরই— পাট করা ধুতিতে কেমন যেন ‘মিশন মিশন’ ভাব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, ক্লিন শেভেন। তেমন লম্বা নন। কিন্তু বেশ পেটাই চেহারা। বেলুড়ের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। ‘পর্ণপুট’ নামে একটি পত্রিকা সত্তর দশকের মাঝামাঝি ১৯৭৫-৭৬ নাগাদ সম্পাদনা করতেন সরল দে। বেলুড়ের পিয়ারিমোহন মুখার্জি রোড থেকে বেরত সেই পত্রিকা। খুব বেশি দিন চলেনি ‘পর্ণপুট’। তবে পরিচ্ছন্ন সাহিত্য পত্রিকা হয়েছিল। এই পত্রিকার মলাট করেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ১৯৭৪ সালে বেরয় এই পত্রিকা। ‘জনপদ বধূ’, ‘তোমার পতাকা’-খ্যাত শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পত্রিকায় ম্যানহোল খুলে নর্দমা পরিষ্কার করা এক শিশুশ্রমিককে নিয়ে গল্পটি লিখেছিলেন, আবছা মনে পড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নিয়ে ভালো ছবি বানিয়েছিলেন বিমল ভৌমিক। এই সিনেমায় ছিলেন বসন্তদা— বসন্ত চৌধুরী, মাধবী মুখোপাধ্যায়। হেরম্ব, আনন্দ ইত্যাদি সব চরিত্রের নাম। বিমল ভৌমিকের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ রিভিউ করেছিলেন আকাশ পারিয়াল। তিনি টুকটাক লিখতেন। ‘পর্ণপুট’ পরিচ্ছন্ন পত্রিকা। ‘পর্ণপুট’-এ ১৯৭৪ সালের ৮ মে যে ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘট হয়, সমস্ত ভারত জুড়ে, তার ওপর ভিত্তি করেই ‘রথ’ নামে একটি গল্প লিখি। সেই গল্পটির কোনো কপি আজ আর আমার কাছে নেই। কালের গহ্বরে মিশে গেছে। ১৯৭০-৭২-৭৫ সালে বার বার পুলিশ রেড হয় আমার বাড়ি। সিআরপি, মিলিটারি— সবাই আসে। আমাকে খুঁজতে, সেইসঙ্গে আইবি, ডিআইবি-র লোকজন। নানারকম কাগজপত্রর সঙ্গে তারা আমার লেখালিখিও— মানে যেসব পত্র-পত্রিকায় সামান্য সামান্য কিছু লিখেছিলাম তা সিজ করে, নিয়ে যায়। তখন আমার পলাতক জীবন। কখনও ভেসে উঠি, আবার ডুবে যাই। সরল দে বেলুড়ের মিউনিসিপ্যালিটির— পুরসভার প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। আগাগোড়া সিপিআই (এম)। বালির সিপিআই (এম) নেতা পতিতপাবন পাঠকের অতি ঘনিষ্ঠ জন। পতিতপাবন পাঠক বালি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন জাতীয় কংগ্রেস নেতা অতি সৎ, সজ্জন মানুষ শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। শৈলবাবুকে ‘শৈলদাদু’-ও বলতেন অনেকে, তাঁর কাশফুল রঙের কেশ ও গোঁফের জন্য। সারাদিন প্রায় একটা পুরনো সাইকেলে এলাকায় চক্কর দিতেন শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। খদ্দরের হাফ পাঞ্জাবি, হাঁটুর কাছে তোলা খাদির খাপি ধুতি, পাড়ছাড়া, পায়ে গান্ধীজি-ডিজাইনের চপ্পল। পরে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে দু টুকরো হল— সিন্ডিকেট কংগ্রেস— ইন্দিরা কংগ্রেস। আদি কংগ্রেস— নব কংগ্রেস। মাদার কংগ্রেস— নাদার কংগ্রেস। ‘মাদার’ বলতে ইন্দিরা গান্ধী আর নাদার বলতে কামরাজ নাদার। কেউ কেউ আবার সামান্য ব্যাড সাউথ করে বলত, আদি কংগ্রেস আর মাদি কংগ্রেস। তো সে যাই হোক, শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আদি কংগ্রেস বা সিন্ডিকেট কংগ্রেসেই থেকে যান। এখন মনে পড়ল তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে একটি দম দেওয়া হাতঘড়িও থাকত। সম্ভবত ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ কোম্পানির। ‘বেনটেক্স’-এর দশক টাকা দামের স্টিলের ব্যান্ড থাকত সেই ঘড়ির সঙ্গে। তো সে যাই হোক, সরল দে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতেন। তাঁর একটি পা কাটা পড়েছিল বড়োসড় গানের জলসা ফাংশানে স্টেজের পাটাতনের ভেতরে পা ঢুকে গিয়ে, তেমনই শুনেছি। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। সেই যে পায়ের অসুবিধা হয়ে গেল, তা আর মিটল না। ফলে কাঠের ক্রাচ। স্কুলে যেতে সাইকেল রিকশা। তখন তিনি এশিয়া পাবলিশিংয়ের ‘ঝুমঝুমি’ সম্পাদনা করেন। ছোটোদের মিনি পত্রিকা। সরল দে-র যে জলসায় দুর্ঘটনা ঘটে, তাঁর পা বাদ যায়, সেই জলসায় সম্ভবত উত্তমকুমার এসেছিলেন। ভিড়ের চাপে স্টেজের দফারফা। পলকা স্টেজ, অত বড়ো রাশ সামলাতে পারেনি। সরল দে ধুতি, হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির হাতা গুটনো। বেলুড়ের পিয়ারি মোহন মুখার্জি রোড বা প্যারিমোহন মুখার্জি রোডে ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। পরে সেই বাড়ি থেকেও চলে এসে বালি পাঠক পাড়ার একটি বাড়িতে থাকতেন। অনেকটা যেন পেয়িং গেস্ট। তখন ‘টগবগ’ নামে ছোটোদের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘টগবগ’-এ আমার লেখা হয়নি। এত এত পরিচয় সত্ত্বেও সরলদা ‘টগবগ’-এর জন্য লেখা চাইতেন খুব ক্যাজুয়ালি। ওভাবে কেউ লেখা চাইলে কোনোদিনই আমার লিখতে ইচ্ছে করে না। তখনও না, এখনও তো নয়ই। সেসব নিয়েও হয়তো কিছু অভিমান ছিল সরলদার। তাঁর প্রথম ছড়ার বই ‘ইস্টিশানের মিষ্টি গান’। সেই ছোটোদের জন্য লেখা ছড়ার বইয়ের চেহারা অনেকটা ড্রইং খাতা যেন। অর্ধেন্দু দত্ত সম্ভবত মলাট করেছিলেন এই বইয়ের। ভেতরের ছবিও। লালের ওপর, গ্লসি পেপারে ছাপা। ভেতরে দামি আর্ট পেপার। সরল দে-র একটি ছড়ার লাইন এখনও মনে আছে— ‘ফুটপাতে সে ঘুমোয় যদি কে দেয় তাকে বালিশ/ না দিক তবু কারোর কাছে করবে না সে নালিশ’ আর একটি ছড়ার লাইন ‘দুরগা আসে দূর গাঁ থেকে’। অসামান্য সব লাইন। এ বই খুব যে বিক্রি হয়েছে, এমন তো নয়। এর অনেক অনেক বছর পর বালি মিউনিসিপ্যালিটি থেকে সরল দে-র ছড়া সমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বইয়েরও যে কী অবস্থা, জানা নেই। সরল দে-র আর একটি বই ‘বাঘুকে নিয়ে গপপো’। ছোটোদের জন্য ছড়া লিখতেন সরল দে, আগেই লিখেছি। ছোটোদের জন্য গদ্যও লিখেছেন তিনি, ‘বাঘুকে নিয়ে গপপো’ সেই গদ্যেরই সংকলন। এখনও সরল দে-র চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে— ভেসে ওঠে। কাঠের শক্ত ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন, দেড় পায়ে। এক জোড়া চটি নয়, এক পাটি চটি হলেই তো তাঁর চলে যায়। নীল স্ট্র্যাপের ‘বাটা’-র হাওয়াই চটি পরতেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা হাতে ঘড়ি নেই। সিম্পল লাইফ। দীপা ও প্রদীপ সরলদার সঙ্গে নানাভাবে সেঁটে থাকত, বিশেষ করে পর্ণপুট-পিরিয়াডে। প্রদীপ থাকত উত্তরপাড়ায়, লালচে দাড়ি, একটু— সামান্য ধূসর চোখ। সুতির প্যান্টের ওপর খাদির রঙিন পাঞ্জাবি বা হ্যান্ডলুমের। প্রদীপের মাথার চুলও লালচে। প্রদীপ আর দীপা পরে বিবাহ করে। প্রদীপ একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করত। পরে তা প্রকাশন সংস্থাও হয়ে ওঠে। ‘পর্ণপুট’ বেশিদিন চলেনি। খান চার-পাঁচ সংখ্যা বড়োজোর। সরল দের বাড়িতে ‘পর্ণপুট’-এর আড্ডা বসত, রবিবার রবিবার। একটা জিনিস খুব বিসদৃশ মনে হত আমার চোখে লেখা না চাইলেও, বিশেষ করে পুজো সংখ্যা ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে দিতেন সরল দে, ডাকে অথবা নিজের লোক মারফত। পায়ের অসুবিধার জন্য বেলুড় থেকে কলকাতায় টানা আসতে বেশ অনেক টাকা পড়ে যেত। হলুদ ট্যাক্সিতে বেলুড় থেকে কলেজস্ট্রিট, আবার কলেজস্ট্রিট থেকে বেলুড় ফেরা শ পাঁচ-ছয় টাকা লেগে যেত, কারণ গাড়ি ওয়েট করত। এছাড়াও গাড়ি ভাড়া করে আসতেন সরল দে। এশিয়া পাবলিশিং, ‘ঝুমঝুমি’ রোশনাই দপ্তর। প্রাইভেট গাড়ি হলে ভাড়া বেশি, স্বাভাবিক ভাবেই। হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল সরল দে-র গোটা গোটা, পরিচ্ছন্ন অক্ষর। ‘পর্ণপুট’-এর জন্য তিনি কবিতা চেয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র সরল দে-কে লোক পাঠাতে বললে, তিনি আমাকে পাঠালেন। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরব, ট্রেন, বাস, কালীঘাট নেমে আবার হাঁটা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখনও তো আমার ‘প্রেমেনদা’ হয়ে ওঠেননি। সবে আলাপ হল। তিনি ‘সাগর থেকে ফেরা’, তাঁর অতিবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ— যা রবীন্দ্রপুরস্কার পেয়েছিল, তখন রবীন্দ্রপুরস্কার খুবই সম্মানজনক পুরস্কার, তো সে যাই হোক, ‘সাগর থেকে ফেরা’-র নাম-কবিতাটি— ‘সাগর থেকে ফেরা’ সম্ভবত নিজের বড়ো বৌমাকে দিয়ে কপি করিয়ে দিয়ে দিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সাদা ফুলস্কেপ কাগজে কবিতাটি কপি করা নিচে তাঁর সই। আমি তো প্রায় নাচতে নাচতে আস্ত রাজ্যজয় করে ফেলেছি, এমন একটা ভাব নিয়ে সরলদার ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। কবিতাটা দেখেই তিনি বললেন, এতো ওঁর অতিবিখ্যাত পুরনো কবিতা— ‘সাগর থেকে ফেরা’। কপি করে দিলেন, আর তুমি নিয়ে চলে এলে? আমি কী বলব? কোনো উত্তর দেওয়ার ভাষাই আমার ঠোঁটে বা জিভে নেই। সেটা ছিল ‘পর্ণপুট’-এর প্রথম সংখ্যা। তাতে অবশ্য প্রেমেনদার কবিতাটি আর প্রকাশ পায়নি। কিন্তু ঘটনাটা আমার খুব মনে আছে, এখনও সেই ছবি— প্রেমেন্দ্র মিত্রর বাড়ির দোতলার টঙের ঘর, লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, বাড়িতে খান চারেক বেড়াল— সবই প্রেমেন্দ্র মিত্রর নাতনি থিয়ার পোষা। থিয়া খুব বেড়াল পছন্দ করত। বেড়াল ভালোবাসতেন প্রেমেন্দ্র মিত্রর বড়ো বধূমাতাও।
Powered by Froala Editor