‘গয়লা দিদি লো
ময়লা তোমার প্রাণ
সেরেক্কে জল কেঁড়েয় ঢেলে
দুধে ডাকাও বান।’
চার লাইনের এই ছিকুলিটি শুনেছি যতীন মাইতির মুখে। আগেই লিখেছি তিনি ছিলেন ১৬৬ নম্বর বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট— এই ঠিকানায় যে ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’ সেখানে দোতলায় যে দৈনিক বসুমতী অফিস, তার প্রেস সুপার ভাইজার। প্রেস সুপারভাইজার শিফটে শিফটে বদল হয়। যতীন মাইতি, জিতেন সাহা ও তুলসীবাবুর কথা আগেই বলেছি। যতীন মাইতিতে ‘বসুমতী’ অফিসে সকলেই যতি মাইতি বলতেন। একটা বিষয় লক্ষ্য করার, কলকাতার সমস্ত প্রেস লাইনে, খবরের কাগজের প্রেস ডিপার্টমেন্টেও অখণ্ড মেদিনীপুরের মানুষদের প্রাধান্য। কলকাতার ছোটো-বড়ো প্রেসে তাঁরা টাইপ লিখতেন প্রায়ান্ধকার বা অন্ধকার ঘরের ভেতর, মলিন থেকে মলিনতর হয়ে ওঠা ঝুলকালিমাখা ষাট পাওয়ারের আলোয়। বাল্বটি ঝোলে শূন্য থেকে। নিচে সারি সারি চৌকো টাইপ ফ্রেম, কাঠের তৈরি। বেশিরভাগই গরান কাঠের। তার ভেতর সিসের টাইপ, রূপশী, দেবশ্রী। আরও কত কত কোম্পানি, নাম বাহার। এই সব টাইপ করিয়েদের পরনে প্রেসের কালি ধরা রঙিন লুঙ্গি, গ্রীষ্মদিনে বেশিরভাগ জনেরই নগ্নগাত্র। কারও কারও পরনে প্রেসের কালি লেগে যাওয়া, হাজার ফুটোসমেত স্যান্ডো গেঞ্জি। এটাই সাধারণ জগতে লেটার প্রেস কম্পোজিটারদের ইউনিফর্ম। শীতে একটু স্বতন্ত্র পোশাক, হয়তো স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর গাঢ় রঙের হাতা গোটানো ফুলশার্ট অথবা হাফশার্ট ঢোলা হাতার, বুক পকেট, পাশ পকেট সমেত, ফুলশার্টও তো তাই। আমি এরকম অনেক প্রেস দেখেছি। দম চাপা, অন্ধ অন্দরমহল— কাজের জায়গা। বাণীশ্রী প্রেস, সত্যনারায়ণ প্রেস, এরকম বেশ করেকটি ছাপাখানায় নয় কম্পোজ করার জায়গায়। এঁদের কারও কারও ট্রেডল মেশিনও ছিল। তাতে বিয়ের কার্দ, শ্রাদ্ধের কার্ড, অন্নপ্রাশনের কার্ড ছাপা হত। ছাপা হত রসিদ বই বা বিল বই— ক্যাশমেমো। ছোটোখাটো জব ওয়ার্ক করতেন ওঁরা। বাণীশ্রী প্রেস ছিল বিবেকানন্দ রোড ছাড়িয়ে বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন বসুর বাড়ির কাছাকাছি বড়ো প্রেস। সুকুমারদা আর সুকুমারদার কাকা চালাতেন প্রেস। টাইপ গেঁথে— কম্পোজ করে, তার ওপর লম্বা করে কাটা নিউজ প্রিন্ট দিয়ে প্রুফ তুলতেন তাঁরা। কম্পোজড ম্যাটারের ওপর নিউজ প্রিন্টের ফালি রেখে তার ওপর হাওয়াই চটি পায়ে ধপ ধপ ধপ ধপ করে লাফানো। সুকুমারদা দে’জ-এর প্রচুত কাজ করতেন আশি-নব্বইয়ের দশকে। একবার গৌরকিশোর ঘোষের ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী হা হা’-র নতুন মুদ্রণ বেরবে দে’জ থেকে পয়লা বৈশাখে। সেই বইয়ের ফর্মা ছাড়ছি, প্রিন্ট অর্ডার দিচ্ছি, প্রেসে বসেই। ভেতরে শেষ চৈত্রের গরম। এর মধ্যে দিন দুই গৌরদা— গৌরকিশোর ঘোষ এসেছেন বাণীশ্রী প্রেসে। খাদির ধুতি, মোটা খদ্দরের হাতা গোটানো পাঞ্জাবি। বগলে ভাঙা ছাতা— বড়ো ছাতা, পায়ে কেডস। অনেকটা যেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য আখ্যান ‘কুবেরের বিষয় আশয়’-এর পাতা থেকে উঠে আসা ব্রজফকির। তো সে যাক গিয়ে, কলেজস্ট্রিট থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্যামবাজার হাতিবাগানের দিকে যেতে গেলে বিবেকানন্দ রোড পেরিয়ে ঠিক হেদুয়া— হেদোর আগে আগে গলি। সেই গলিতেই বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন বসুর বাড়ি। রাস্তার এপাড়েতেই অতিবিখ্যাত তেলেভাজার দোকান, যেখানে সাইনবোর্ডে শুধুই সুভাষচন্দ্র বসু আর সুভাষচন্দ্র বসু। অশ্বপৃষ্ঠে সামরিক পোশাকের সুভাষচন্দ্র বসু। সেই অতিপরিচিত তেলেভাজার দোকান থেকে ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে গরম গরম তেলেভাজা বিলি হয়। মূলত বেসনের ফুলুরি। তার মধ্যে মৌরির ঘ্রাণ, লঙ্কাকুচো থাকে। একবার তেলেভাজা নিলেই বাঁ হাতের তর্জনীতে আলতার ছোট্ট গোল টিপ। ‘অয়েল কেক’— তেলেভাজা গ্রহণের চিহ্ন। বিনা পয়সার ফুলুরি যাতে কেউ দুবার নিতে না পারে, লাইনে দাঁড়িয়ে। এইভাবে লাইন দিয়ে বিনি মাগনার তেলেভাজা তো আমিও নিয়েছি— বেশ কয়েক বছর। যেমন উত্তর কলকাতার মল্লিকবাড়ি থেকে রোজ রোজ ‘কাঙালিদের’ জন্য যে পাতা পরে ভোজনের ব্যবস্থা, তাতেও বসে খেয়েছি। অবশ্য ভোজন না বলে তাঁকে খাওয়া বলাই হয়তো ভালো। কারণ ‘ভোজন’, ‘অন্নগ্রহণ’, ‘আহার’— এইসব পরিশীলিত শব্দরা, এই ‘কাঙালিসেবা’ বা ‘দরিদ্রনারায়ণ সেবা’, ‘কাঙালিভোজন’— যে ভাষাই প্রয়োগ করা হোক না কেন, তাঁরা তো খানই। ভিক্ষুক, ভবঘুরে, কাঙালিরা পাত পেতে খান। তাঁদের খাদ্য নেওয়া— ‘খাওয়া’-ই তো। সে যাই হোক, বাণীশ্রী প্রেসের কথাতে আবার ফিরি। আশির দশকেও সেই প্রেস-গলিতে সাবেক দিনের ডিমের ঝুড়ির কায়দায় তৈরি বাতি-ঢাকনি, মোটা তারের জালিতে তৈরি। তার ভেতর একশো পাওয়ারের ডুম। সন্ধের মুখে মুখে সেইসব আলো জ্বলে ওঠে, পর পর, জ্বেলে দিয়ে যান কলকাতা কর্পোরেশন থেকে মাস মাইনে-পাওয়া বাতিওয়ালা বা লাইটম্যান। তাঁর হাতে থাকে লোহার সরু ‘এস’ লাগানো কাঠের দণ্ড। এ তারেই জ্বলে ওঠে একটার পর একটা আলো। তখনও সর্বত্র হ্যালোজেন-যুগ বা ফ্লুরোসেন্ট যুগ শুরুই হয়নি। বাণীশ্রী প্রেসের সুকুমার সামন্ত, বেঁটেহাটো, গোলগাল, শ্যামবর্ণ না বলে কৃষ্ণবর্ণ বলাই হয়ত বিধেয়। দাড়িগোঁফ কামানো গোল মুখ। স্পষ্ট বক্তা। বাড়ি মেদিনীপুরের ঘাটাল— বারোমেসে বন্যা যেখানে। তাঁর কাকা কম্বা, কোঁচাটি ফেত্তা দিয়ে ধুতির ওপর পরেন। ভেতরে আন্ডারওয়ার। পাশে কনুই পর্যন্ত হাতাঅলা ফরসা গেঞ্জি, সামারকুল নয়, প্লেন। মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ। তেমন ঘন নয় চুল, তবে আছে। চোখে কালো ফ্রেমের সস্তার চশমা। বেশ ভদ্র, প্রকাশকদের ও প্রকাশকদের তরফে প্রুফ দেখতে আসা জনেদের সম্বোধন করতেন ‘বাবু’ বলে। এটা মেদিনীপুর বা অন্য অন্য মফঃস্বলের ট্র্যাডিশন। ‘দাদা’ নয় ‘বাবু’। যদিও সুকুমার সামন্ত সম্বোধনে ‘দাদা’-তে চলে এসেছিলেন। খর্বকায় সুকুমার সামন্ত টেরিকটের প্যান্ট-শার্ট। ফুলপ্যান্ট আর হাফশার্ট। সুকুমার সামন্তই আমাকে শিখিয়েছিলেন একবার প্রুফ তুলতে কুঁড়ি টাকা খরচ। গেলি প্রুফ তুলতে গেলে টাইপ গাঁথা গেলির ওপর হাওয়াই চটি পরা পায়ে হালকা হালকা লাফানো, সে তো বলেছি আগেই। সেই ভঙ্গিটাও অনেকটা হনুমান-লাফানো যেন, জোড়া পায়ে, অল্প খানিকটা শূন্যে উঠে। সত্যনারায়ণ প্রেস, বাণীশ্রী প্রেস, মা কালি প্রেস— সকলের স্মৃতিই মনে আছে। বহু বছরের স্মৃতি। স্মরণে আছে নিশিকান্ত হাটুই বা নিশিকান্ত হাটাইয়ের কথাও। নিশিবাবু ফিটফাট, প্যান্ট-শার্ট। ফুলপ্যান্ট, হাফ হাতা বুক কাটা বুশ শার্ট, গরমে। মাথার টেরিতে অনেকটা যেন দেবানন্দ ফিফটিজ, সিক্সটিজের। সামান্য লক্ষ্মীট্যারাও নিশিকান্ত হাটাই বা নিশিকান্ত হাটুই মশাই। তিনিও জেলা মেদিনীপুর। তবে কথায় বার্তায়, চলনে, সাজ-পোশাকে সিগারেট ধরানোয় পুরোটায় ক্যালদেশিয়ান। বেশ চালিয়াতও— ওপর চালাকও বলা যায় তাঁকে। আর একজন আসতেন দে’জ-এ। তিনি যে একদা পূর্ববঙ্গের ছিলেন, মানে তাঁর শিকড় পূর্ববঙ্গে ছিল, তা বোঝা যায়, তাঁর উচ্চারণে। তিনি কড়িতে ধোলাই করা— কাঁচা ধুতি, টেরিকটের সাদা পাঞ্জাবি, কাচতে কাচতে প্রায় ঘিয়ে রং, এমন একটি পাঞ্জাবি, একটি পাশপকেট, দুটি বুক পকেট-সহ পরে আসতেন দে’জ পাবলিশিংয়ে। খুবই ভদ্রজন। কথা কম বলেন। বেশিরভাগটাই নিজস্ব হাসিতে ম্যানেজ করেন। বড়ো গ্রেস। অনায়াসে দশ, বারো, কুড়ি ফর্মা স্ট্যান্ডিং রাখেন। তখন তো তেমনই নিয়ম ছিল। খুব বাজার কাটতি চালু বই— যেমন ধরুন বিমল মিত্রর ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘যাযাবরের দৃষ্টিপাত’, কালিকানন্দ অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘উদারণপুরের ঘাট’, রঞ্জনের (রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নন) ‘শীতে উপেক্ষিতা’, আরও এরকম কিছু বই। মনিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়— শঙ্কর-এর ‘চৌরঙ্গী’, ‘কত অজানারে’ ছিল এই তালিকায়। আমি আশির দশকের গোড়াতেও দেখেছি দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে-র যে চোয়ারে বসেন, মাথার পেছনে সেই চেয়ারের দেওয়ালের ঠিক পেছন দিকে একটি বড়োসড় ইংরেজি ও বাংলা তারিখ-ওয়ালা, ছবিহীন ওয়াল ক্যালেন্ডার। তাতে বিয়ের দিন— তারিখ লেখা। বাইন্ডিংখানাকে বলে রাখা ছাপা ফর্মা গেলেই তা বাঁধাই করে বই হিসাবে দিতে হবে। গলতি ফর্মা অর্থে যে বইয়ের কয়েকটি ফর্মা মিসিং, তার অভাবটুকু পূরণ করার জন্য যেটুকু ছাপা ফর্মা নেই, তা ছাপিয়ে নেওয়া। সাধারণত ষোল পেজে এক ফর্মা। টাইটেল আট পাতা, তাতে ভূমিকা, উৎসর্গপত্র, যে লেখকের বই, তাঁর অন্য অন্য গ্রন্থের নাম ইত্যাদি। নয় থেকে মূল টেক্সট শুরু। ডান দিকের পাতা থেকেই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য শুরু হবে তেমনই অঙ্ক। দে’জ পাবলিশিং-এর ভেতরে— এখন যেখানে অনেক অনেক বুক শেলাই বই, সেখানেই আশির দশকে, নব্বই দশকে সুধাংশুশেখর-দের চেয়ার-টেবিল্ টেবিলে স্তূপাকার ফাইল, কাগজপত্র। পান চিবোতে চিবোতে বা অনায়াসে দোক্তাগালে রেখে সুধাংশু কথা বলছেন সুকুমার সামন্ত, নিশিকান্ত হাটাই বা নিশিকান্ত হাটুই, দিলীপ দে, অজিত দের সঙ্গে। তাঁরা সবাই প্রেসের মালিক, এসেছেন ‘বাবু’-র কাছে কাজ নিতে। নতুন কপি অথবা পুনর্মুদ্রণ রিপ্রিন্ট, যাই হোক না কেন, সবটাই চামড়ায় বাঁধানো বড়োসড় জাবদা খাতায় এনট্রি করে সুধাংশু দেবেন, এমনই রীতি। তো যা বলছিলাম, বিয়ের তারিখ থাকলেই তখন চালু, অতিচালু বই বাইন্ডিংয়ের জন্য তাড়া থাকে। ক্যালেন্ডারের বিয়ের সব তারিখে তাই লাল গোল দাগ, ডট পেনের। এতো আমার চোখে দেখা। বইপাড়ায় শরৎচন্দ্রের বিক্রি— মানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিক্রি বরাবরই ভালো। পরে রয়্যালটির নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সকলেই তো শরৎচন্দ্র ছাপতে শুরু করলেন, সে এক অন্য ইতিহাস। প্রথমে তো এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স ছাপেন শরৎ-রচনাবলী খণ্ডে খণ্ডে, তখন সুপ্রিয় সরকার— বাচ্চুদার বাবা সুধীরচন্দ্র সরকার জীবিত। ছোটোদের পত্রিকা ‘মৌচাক’ সেটিও বেরত এখান থেকেই। ‘মৌচাক’-এর আড্ডা— আসলে এমসি সরকার-এর আড্ডা অতিবিখ্যাত। সেই আড্ডায় কে না এসেছেন? শিব্রাম চক্রবর্তী, বিশু মুখোপাধ্যায়, ভবানী মুখোপাধ্যায়-সহ অনেকেই আসতেন। শিবরাম চক্রবর্তী— শিব্রাম চক্কোত্তি তো নিয়মিত আসতেন এই সুধীরবাবু— এমসি সরকারের আড্ডায়। কতগুলো ছোটোদের পত্রিকা তখন ‘পাঠশালা’, ‘রামধনু’, ‘শিশুসাথী’, ‘রংমশাল’, ‘মৌচাক’, ‘শুকতারা’। মাসের কাগজ ‘শুকতারা’-র পুজো সংখ্যা— শারদীয় সংখ্যা বেরয় না তখন। দেবসাহিত্য কুটির থেকে বেরত হার্ড বোর্ড বাঁধাইয়ের ‘দেবালয়’, ‘পারিজাত’, ‘ইন্দ্রধনু’, ‘দেববাউল’। কী সুন্দর ছাপা। তেমন সুন্দর কাগজ, তেমনই তার লেখনসূচি। কে না লিখতেন সেখানে? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মনোজ বসু, শিবরাম চক্রবর্তী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্যার, বিধায়ক ভট্টাচার্য, প্রতিভা বসু, এরকম অনেকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন এই দেবসাহিত্য কুটিরের বার্ষিকীতে। সে অবশ্য আমার জন্মের আগে। যাই হোক, আবার দৈনিক বসুমতীর প্রেসে ফিরি। ‘গয়লাদিদি লো ময়লা তোমার প্রাণ…’ ইত্যাদি প্রভৃতি ছিকুলি কাটতেন যতীন মাইতি জিতেন সাহার প্রেসের কাজকে ব্যঙ্গ করে। দৈনিক বসুমতী প্রেসে ছিলেন সীতাংশু মাইতি নামে একজন অতিদক্ষ মেকআপ ম্যান। তিনি অখণ্ড মেদিনীপুরের মানুষ। হাঁটুর কাছে তুলে পরা সরু পাড়ের মিলের ধুতি। ওপরে তিলে পড়ে— খানিক মরচে ধরা টেরিকটের ফুল হাতা শার্ট, অফ হোয়াইট হয়ে গেছে। হয়তো কোনো কালে সাদা ছিল। সেই ফুল হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল উল্টে আঁচড়ানো। তেমন লম্বা নন সীতাংশু মাইতি। তাঁর ওপর পাটির সামনের দুটি দাঁত অ্যাসিডে খাওয়া, ক্ষয়াও। কথা বললেই মুখের থেকে ভেসে আসে পায়োরিয়ার অতি উৎকট কুবাস। সীতাংশু মাইতি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, দু ঠ্যাঙ জুড়ে রোম। গেলিতে সাজানো ম্যাটার খুঁজে বার করে, তা মিলিয়ে দেখতে সীতাংশু মাইতির জুড়ি মেলা ভার। দৈনিক বসুমতীর রবিবাসরীয়-র চার পাতা মেকআপ শনিবার, সেই সঙ্গে বইয়ের পাতা। সব মেকআপ, লে-আউট, ছবি ইত্যাদি কী বসবে, আমার দায়িত্ব। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবারের সাময়িকী দেখতেন। কিন্তু সব কাজটাই সামলাই আমি। লেখকদের জন্য সাময়িকীর কপি নিয়ে আসা, তারপর সেই কাগজ লেখকদের ডাকে পাঠানো, ঠিকানা লিখে, সেইসঙ্গে মানি অর্ডার করা, মানে মানি অর্ডার ফর্ম লেখা। ১৯৭৯-৮০ সালে ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবাসরীয়তে গল্প লিখলে কুড়ি টাকা পাওয়া যায়। ফিচারে দশ টাকা, পনেরো টাকা। বারাকপুরের স্বপনকুমার ঘোষ, তিনিও ছিলেন এই বিভাগে। আমি যেমন অবৈতনিক, তিনিও তাই। আমার থেকে বয়সে খানিকটা বড়ো। ‘দৈনিক বসুমতী’-তে তাঁর চাকরি হয়, নন-জার্নালিস্ট। আমার হয়নি। কেন আমার চাকরি হল না ‘দৈনিক বসুমতী’-তে, তা নিয়ে বিস্তারে লিখব। আগেই লিখেছি ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র চিপ ক্যান্টিন ছিল, সত্যিকারের চিপ ক্যান্টিন। অতি সস্তায় খাবারদাবার সব, তার দরও আগে বলেছি। ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ক্যান্টিনকে আআদের ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা বিষ্ণুদা বা বিষ্টুদা উচ্চারণ করতেন, ‘কেলটিন’। কেলটিন থেকে তিনি আমাদের খাবার এনে দিতেন। বাগবাজারে যখন ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ছিল, তখন জামাইষষ্ঠীর দিন সেখান থেকে পাড়ার শ্বশুরবাড়িতে আসা জামাইদের জন্য ফিশফ্রাই, মাটন কাটলেট, ডিম-চপ, ভেজিটেবল চপ, ডিমের ডেভিল— সব যেত। সবই চিপ রেটে। আর বাগবাজার পাড়ার— হরলাল মিত্র স্ট্রিট, আনন্দ চ্যাটার্জি লেন, বাগবাজার স্ট্রিটের ‘যুগান্তর’— অমোত্তোবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন।
Powered by Froala Editor