নামজাদা দুঁদে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যর বিশেষ বান্ধবী অভিনেত্রী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়— মুখোপাধ্যায়ও হতে পারেন, তাঁর আত্মকথা বেরতে শুরু করল ‘যুগান্তর’ সাময়িকীতে। প্রতি রবিবার বেরয় ধারাবাহিক লেখা। ফলে, অপেক্ষায় থাকতেই হয় লেখাটির জন্য। প্রথম প্রথম ঠিক ছিল, পরে একটু দেরি করেই আসতে থাকে। কেমন যেন ঢিলে ভাব। মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু কিছু বললেন তাঁর স্মৃতিকথায়। অনিলদা সাময়িকীর যে যে সংখ্যায় মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মকথন বেরচ্ছে, তার দু-কপি করে নিয়ে যেতেন। প্রফুল্লদা— প্রফুল্ল রায় তাঁর জন্য— অনিলদার জন্য দু-কপি করে ‘যুগান্তর’ আনিয়ে রাখতেন। অনিলদা আবার তা পৌঁছে দিতেন তাঁর প্রিয় বান্ধবী মীরার কাছে। সেই সময়টায় অনিল ভট্টাচার্য ‘যুগান্তর’-এর খুবই ক্ষমতাবান মানুষ। মালিকপক্ষ— ঘোষেদের সঙ্গে জ্যোতি বসু ও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম সেতু তিনি। তাঁর ক্ষমতার হাত বহু দূর বিস্তৃত। ফলে ‘যুগান্তর’-এর মালিকরা তাঁকে দিয়ে অনেক ডিল করান। এমনকি নোনাপুকুরে যুগান্তর বাগবাজার থেকে সমূলে উঠে আসার পর ঋতা দত্ত— তিনি কবি ও সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তর ছোটো ভাই সমীর দত্তকে বিবাহ করেন। সম্ভবত তুষারকান্তি ঘোষের মেজোমেয়ে তিনি। বড়ো কন্যাটি থাকতেন বম্বেতে। এই জ্যেষ্ঠা কন্যাটি শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রর খুব ভক্ত, ‘বহুরূপী’-রও। বিশেষ করে শম্ভু মিত্রর। তাঁরই উৎসাহে শম্ভু মিত্রর ওপর ‘যুগান্তর’ সাময়িকীতে বড়োসড় সাপ্লিমেন্ট বেরোয়। ততদিনে শম্ভু-তৃপ্তির ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শুনেছি শম্ভুবাবু নাকি তাঁর ফোনের রিসিভার ধরেই ‘হ্যালো’-র বদলে বলতেন, ‘এপারে শম্ভু, ওপারে কে?’ সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। তৃপ্তি-শম্ভুর সন্তান শাঁওলি মিত্র থাকেন শম্ভু মিত্রর সঙ্গে। তৃপ্তি মিত্র আলাদা। ‘বহুরূপী’-র সাজানো সংসার ছিন্নভিন্ন। কুমার রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (মহর্ষি), গঙ্গাপদ বসু— সবাই আছেন। তৃপ্তি মিত্র (ভাদুড়ি) নেই। ঋতা দত্তর মাথায় গোছ ভরা চুল, রোগা-পাতলা, ‘যুগান্তর’-এর নোনাপুকুর বাড়ির তিনতলায় হঠাৎ হঠাৎ দৌড়তে থাকেন। ফর্সা খুব, কিন্তু দাঁত উঁচু। বিশেষ করে ওপর পাটির। তুষারবাবুর নাতি— তরুণকান্তি ঘোষের পুত্র তুহিনকান্তির স্ত্রী সুবর্ণা ঘোষ। সবর্ণাও এইসব পত্রিকা সংক্রান্ত কাজে রোজ আসেন। সবর্ণা ওড়িশার কন্যা। কিন্তু বাংলা খুব ভালো বলেন। তাঁর মাথাতেও কেশভার, যত্নে এলো খোঁপা করে রাখা। ঋতা দত্তরও তাই। যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ঋতা নিয়মিত আর্ট রিভিউ করতেন আনন্দবাজার বাড়ির ‘টেলিগ্রাফ’-এ। চিত্রকলা— ছবি দেখে সমালোচনা। স্কাল্পচারও। ঋতা-সমীর নিঃসন্তান। সমীর দত্ত একসময়— সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে ‘আজকাল’ বেরনো মাত্র তাঁর রবিবারের পাতা দেখতে শুরু করেন। জ্যোতির্ময় দত্ত সেখানে ‘সোনালী’ চা বাগানের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেন। বি-ই-শা-ল রিপোর্ট। তুহিনকান্তি ঘোষের স্ত্রী সুবর্ণা ঋতার স্টাইলে দৌড়তেন না, শান্ত, পরিমার্জিত চেহারা। ঋতা দত্ত ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সোজা করে ছবির ডিসপ্লের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমি ফোটোগ্রাফির কথাই বলছি। একটু বাঁকিয়ে কোনাকুনি রাখা হোক ছবি, লেখার সঙ্গে— এমন একটা দাবি ছিল তাঁর। সেই দাবি ও আবদার যে সবসময় সবাই মেনেছেন, এমন তো নয়। ঋতা দত্ত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সিনেমা-সম্পাদক প্রদীপ্ত সেনকেও এ ব্যাপারে সাজেশন দিয়ে টলাতে পারেননি। প্রদীপ্তদা ফর্সা, লম্বা, খুব সুন্দর চেহারা, ভালো ক্রিকেট খেলতেন, শৌখিন মানুষ। গরমের দিনে বেশিরভাগই কলারঅলা গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট। ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রদীপ্তদা একটি ছোটোমোটো বৈদ্যুতিন চ্যানেলে যোগ দেন। সেখানে তিনি আমাকে ডেকেছেন অনুষ্ঠান করার জন্য। গেছি। প্রদীপ্ত সেন আগাগোড়া বামপন্থী।গাল, চিবুক নিখুঁতভাবে কামানো। চোখে বাজারি চশমা, চমৎকার কথা বলেন। সর্বদা হাসিমুখ। প্রদীপ্ত সেন বেশ বড়ো মাপের একজন ফিল্মবোদ্ধা। কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত। সিনে সেন্ট্রাল-এর কর্তাব্যক্তি একজন। বামফ্রন্টের সরকারিভাবে ফিল্ম উৎসব শুরু হওয়ার আগে সিনে সেন্ট্রাল-এর উদ্যোগে এসএসকেএম-এর উল্টো ফুটপাতে ‘সরলা মেমোরিয়াল হল’-এ চলচ্চিত্র উৎসব। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়ার ছবি এখানেই দেখি। যদিও সিনে সেন্ট্রাল-এর সদস্য পদ পাওয়ার যোগ্যতা আছে বলে সিনে সেন্ট্রাল-এর ফিল্মি মাতব্বররা মনে করেননি। সে যাই হোক, সেই সময়টায়— সত্তর দশকের শেষ লগ্নে নৈহাটি সিনে ক্লাব, বালি সিনে ক্লাব, উত্তরপাড়া সিনে ক্লাব— সবই ফিল্ম সোসাইটির যে মুভমেন্ট, তার সঙ্গে জড়িত ছিল। সম্ভবত ছিল বালিগঞ্জ সিনেক্লাবও। বাগীশ্বর ঝা— সাধারণের মুখে ঝা-জি এবং এনকেজি— সকলেই ছিলেন যথেষ্ট ফিল্মবোদ্ধা। বাগীশ্বর ঝা— ঝা-জি পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এ লিখতেন প্রতি সংখ্যায়। ‘যুগান্তর’-এর মালিক গোষ্ঠীর প্রফুল্লকান্তি ঘোষ— শত ঘোষ বাজারে ‘হান্ড্রেড ঘোষ’ নামেও পরিচিত ছিলেন নিন্দুকমুখে। আমার মনে আছে জ্যোতি বসু একটি নির্বাচনী জনসভায়— কাশীপুরে এইরকম বলেছিলেন, মনে আছে— কী শব সত সহস্র এরকম আবার হয় নাকি? শত ঘোষ-কে কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ঘরের— ২৮ প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে দোতলায় ঘরের সামনে লাঠি হাতে দেখেছি। কোনো কাজে এসেছিলেন হয়তো প্রফুল্লকান্তি ঘোষ। আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর জ্যাঠামশাই তারানাথ ন্যায়তর্কতীর্থ আর সরযূদেবীর সংসার। আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় তরুণকান্তি ঘোষ, প্রভাতকান্তি ঘোষ, অসিতকান্তি ঘোষ— এঁদের সঙ্গে গলি-ফুটবল বা গলি-ক্রিকেট খেলতেন। এঁরা সকলেই ঘোষ বাড়ির ছেলে। তুষারকান্তি ঘোষের শাকাহ-প্রশাখা বহুদূর ছড়ানো। হয় বলা হত ‘ঘোষবাড়ি’, নয়তো বলা হত তুষারবাবুর বাড়ির ছেলে। প্রফুল্লকান্তি ঘোষের পরিচিতি শত ঘোষ নামে। জ্যোতি বসু একবার একটি নির্বাচনী সভায় বলেছিলেন, মনে আছে। সম্ভবত আশির দশকে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর হয়ে কাশীপুর অঞ্চলে একটি নির্বাচনী সভায় গিয়ে, এরা সব কারা? শত, সহস্র? কারা এরা সব— একেবারেই জ্যোতি বসুর স্টাইলে। কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার অন্যতম স্থপতি শত ঘোষ— প্রফুল্লকান্তি ঘোষ, এমন অভিযোগ আছে, ছিলও। নব কংগ্রেস— ইন্দিরা কংগ্রেসের খুনে বাহিনীর সঙ্গে সেইন নাকি সিপিআই (এম)-এর বাহিনীও ছিল। স্থানীয় দাপুটে সিপিআই (এম) নেতা লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য আর তার পুত্র বাচস্পতি ভট্টাচার্যও ছিল নাকি এই হত্যা অভিযানকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। বড়ো রাস্তার ওপর— বিট রোডে নাকি মানব মানব বন্ধন হয়েছিল সিপিআই (এম)-এর, যদিও এই তথ্যের কোনো সমর্থন মেলে না পিইউসিএল-এর কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ওপর যে পুস্তিকা, তাতেও। সাদা মলাটের চটি বই। প্রফুল্লকান্তি ঘোষ বরাবরই গুণ্ডা পোষক। একদা হেমেন মণ্ডল— উত্তর কলকাতার গৌরীবাড়ির হেমেন মণদলের উত্থানের পিছনে যেমন অজিত পাঁজার হাত ছিল বলে অভিযোগ আছে, সত্যি-মিথ্যে বলতে পারব না আর এই বিষয়ের সত্যি-মিথ্যের কোনো দায়ও আমার নেই, কিন্তু হেমেন মণদলের বাড়াবাড়ির মূলে অজিত পাঁজা, শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজিতবাবুর সুরক্ষা মূলক হাত ছিল হেমেন মণ্ডলের মাথার ওপর। অতি বাড়াবাড়ির পর শেষ পর্যন্ত গণরোষে গৌরী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় হেমেন। আমি কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কালীঘাটের ২৮ প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে শত ঘোষকে দেখি, আগেই বলেছি। সকলকেই প্রায় ‘ভাইটি, ভাইটি’ বলে সম্বোধন করার রীতি-রেওজায় ছিল শত ঘোষের। ‘ভাইটি-ভাইটি ভাইটি’ বলতে বলতে কখন যে কার গলায় ছুরি বসবে, বা কপালে ‘দানা’ ভরে দেওয়ানো হবে, কেউ জানে না। এরকম অভিযোগ শতবাবু সম্বন্ধে। কোনো এক গরমের দ্বিপ্রহরে শত ঘোষ— প্রফুল্লকান্তি ঘোষকে, আশুদা— আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এজমালি বাড়ির দোতলায় দেখি, আশুদার দোতলার ব্যালকনিতে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। লাঠি মানে বাহারি রুপোর কাজটাজ করা, স্টিক— কাঠের যথেষ্ট শক্তপোক্ত। মিলের অতি ফাইন কালোপাড় ধুতি, ‘শাহজাদা’-র খুব পাতলা— ফাইন যাকে বলে আদ্দির। বুকের ওপর বুক পকেট। পায়ে চটি। বেশ কৃষ্ণবর্ণ, খুব লম্বা নয়, আবার বেঁটেও বলা যাবে না একেবারে। মধ্যম আকৃতিই বলা যেতে পারে, মানে দেহের উচ্চতায় মধ্যম। মাথার চুল প্রায় সবই উঠে গেছে প্রায়, যেটুকু অবশিষ্ট কেশালাপ, তার বেশিরভাগই পাকা। অভিযোগ নকশালপন্থীদের প্রাণঘাতী বোমা শত ঘোষ— প্রফুল্লকান্তি ঘোষকে খোঁড়া— খঞ্জ করে দেয়। প্রাণে মারতে পারেনি। সেই জন্যই মজবুত, বাহারি স্টিক। কাঠের মনে হয়েছিল প্রথমে, এখন মনে হয় মোষের শিঙেরও হতে পারে। সেই ছড়িতে রুপোর গাঁট বাঁধুনি। ছড়ির মুণ্ডু বাঘমুখো ডিজাইনের, সেও রুপোর, ঝকঝক করছে সবসময়। সেই এক ঝলকই তাঁকে দেখা, নির্বাচনী সভার বাইরে। যতদূর মনে পড়ে মানুবাবু— সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী শতবাবু। প্রফুল্লকান্তি ঘোষের তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, যাকে বলে, তাই। মানুবাবু— সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের উদ্বোধন হওয়ার পর কলারঅলা লাল গেঞ্জি পরে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় টেবিল টেনিস খেলছে, এমন একটা চার-পাঁচ কলাম ছবি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়। সিদ্ধার্থশঙ্কর টেনিস, টেবিলটেনিস, ক্রিকেট— সবই ভালো খেলতেন। ধুতি-পাঞ্জাবি আবার স্যুটও, বুশ শার্ট প্যান্ট, মাথার চুল বেশ বড়ো, চোখে অনেকটা উত্তমকুমার কাটিং যেন এমন ভারী, কালো, লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা। ক্লিন শেভেন। তার স্ত্রী মায়া রায়ও খুব বরো আইনজীবী। নিঃসন্তান এই দম্পতি। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার পর প্রেস কনফারেন্স করে বলেছিলেন, যারা মারা গেল, তারা সবাই শান্তিপ্রিয় ছিল কিনা দেখতে হবে। এই কথা ছাপা হয়েছে তখনকার দৈনিকে। ২০১১-তে বামফ্রন্টের পরাজয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বড়োসড় জোড়া ইলিশ মাছ আর মিষ্টির বেশ বড়ো হাঁড়ি পাঠানো হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। কাশীপুর-গণহত্যার আগে নবজীবন সঙ্ঘ অথবা নবযুবক সঙ্ঘের নির্মল চ্যাটার্জি খুন হল। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। নবজীবন সঙ্ঘ অথবা নবযুব সঙ্ঘের নির্মল চ্যাটার্জি খুন— কংগ্রেসি রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক কাটাকাটি বলে অনেকে মনে করেছেন। ‘নবযুব সঙ্ঘ’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, নির্মল চ্যাটার্জির ক্লাবের নাম। উত্তর কলকাতার ‘ফাটাকেস্ট’, সেও নবকংগ্রেসি মাস্তান, অতিবিখ্যাত তার বারোয়ারি কালীপুজো, রাস্তার ওপর প্যান্ডেল বেঁধে কালীপুজো, পাশেই সোমেন মিত্রের কালী। আমহার্স্ট স্ট্রিট আলোয় আলো, উৎসব, মোচ্ছব। খুব বড়োসড় স্যুভেনির— স্যুভেনির না বলে তাকে বই বলাই ভালো, সুন্দর ছাপা, ভেতরে আর্ট প্লেট, সুন্দর মলাট। এই বইটির সম্পাদনা করতেন ‘যুগান্তর’-‘অমৃত’ পত্রিকার চাকুরে কমল চৌধুরী। কমলদা অতি সজ্জন, বিনয়ী। রোগা, পাতলা ঘাড় পর্যন্ত চুল। খাদি অথবা হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি। নানারকম রঙের। গেরুয়া, বাসন্তী, হালকা খয়েরি। কমল চৌধুরী— কমলদাকে আচার্য কমল চৌধুরী বলতাম। কমলদা এবং কবি ও ‘আত্মপ্রকাশক’ সম্পাদক সমরেন্দ্র দাস আমাকে একটি উপন্যাস লিখে দিতে বলেন শারদীয় ‘অমৃত’-এর জন্য। ‘সংঘর্ষ’ নামে সেই আখ্যান লিখে জমা দিই সময়ে। তাপস কোনার ছবি আঁকেন সেই উপন্যাসের। ‘যুগান্তর’ ততদিনে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে— তিনতলায় উঠে এসেছে। ভুতোরিয়াদের সেই বাড়ি, তা নিয়ে প্রচুর ডিসপিউট, মামলা। যাই হোক, সেবার শারদীয় অমৃত বেরলই না। পাতা তৈরি হল, পেস্টিং হল। মালিকরা শেষ পর্যন্ত শারদীয় ‘অমৃত’ বার করলেন না। সেটা ১৯৯০-এর কাছাকাছি কোনো সময়। পরে ‘সংঘর্ষ’ বই হিসাবে প্রকাশিত হয় মডার্ন কলাম থেকে, সে এক অন্য সময়। কমল চৌধুরী বহু বিষয়ে কাজ করেছেন। জেলার ইতিহাস, খণ্ডে খণ্ডে— ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান— তখন কার পূর্ব পাকিস্তান, অখণ্ড বঙ্গের জেলার ইতিহাস ধরে ধরে লিখেছেন। ‘যশোর-খুলনার’ ইতিহাস বইটিকে তিনি পুনর্মাজিত করে ছাপার ব্যবস্থা করেন। কমল চৌধুরী ডান কাঁধে কাপড়ের সাইডব্যাগ— অতি পোক্ত, মজবুত রঙিন ঝোলা, যাকে ওড়িশায় ‘গান্ধী ঝোলা’ বলে। কমলদা ‘যুগান্তর’-এর যে কোনো বিজ্ঞাপন সাপ্লিমেন্টে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। এই ব্যাপারটা কখনও ভুলব না। সে রুমাল হতে পারে, কলকাতার হকার, ফেরিওয়ালা হতে পারে, ‘বেলফুল চাই বেলফুল’ হতে পারে, ইলিশ মাছ হতে পারে, বাঙালির টিপিন বাসকো— বাঙালির টিফিন বক্স হতে পারে। মানে ‘ফ্রম ভিটামিন টু ভিয়েতনাম’। ‘আলমায়রা টু আলিগড়’। যেকোনো বিষয় তিনি আমাকে এসে বললেই এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশো-ছ’শো শব্দ রেডি। তো সেই কমল চৌধুরী ফাটাকেষ্ট বা ফাটাকেষ্টর স্যুভেনিরের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ভালো টাকা পেতেন সম্পাদনা ফিজ বাবদ। ওঁর এক ছোটো ভাই পরিমল— পরিমল চৌধুরী, সে তো ছবি আঁকতে পারে না, কিন্তু আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা আর্টিস্ট। শিল্পী। পরিমল চৌধুরী এই স্যুভেনির কাম বই তৈরির ব্যাপারে সহায়তা করতেন কমলদাকে। পরিমল বয়সে আমাদের থেকে কিছুটা বড়ো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা, মাথা ভরা চুল। পরিমল চৌধুরী ‘যুগান্তর’-এ চাকরি পান। সেখান থেকে ‘প্রতিদিন’— পেস্টিং আর্টিস্ট। ‘যুগান্তরs’-এর নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে ভুতোরিয়াদের জমি ও বাড়ির ওপর, তিনতলায় ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ অফিসে তিনি চাকরি করতেন। পরে ‘প্রতিদিন’— ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ যান।পরিমল মাদক বা ড্রাগ নিতেন। কথা জড়ায়, চোখ সবসময় ঢুলুঢুলু। ঠোঁট, জিভ ভারি। পরিমলের কি সব অশান্তি ছিল সংসারে, তেমনই শুনেছি। মারাও গেলেন কম বয়সে। ‘যুগান্তর’-এ আরও একজন কমল ভট্টাচার্য ছিলেন। তিনি অবশ্য বেতারের ক্রীড়া ভাষ্যকার কমল ভট্টাচার্য নন। যিনি আকাশবাণী থেকে খেলার রিলে দিতে দিতে বলতেন, পেছিয়ে এসে ব্যাক খেলেছেন। ব্যাক ফুটে খেলাটাকে তিনি ব্যাখ্যা করতেন এভাবে। কমল ভট্টাচার্য নাম করা সাংবাদিক ছিলেন ‘যুগান্তর’-এর। পরে ‘যুগান্তর’ লক আউট হয়ে গেলে স্টিভি— একটি ছোটো প্রাইভেট চ্যানেলে যোগ দেন। খুব সুভদ্র মানুষ। একসময় নকশালবাদী রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল কমল ভট্টাচার্যর, তেমনই শুনেছি।
Powered by Froala Editor