প্রফুল্ল রায়ের স্ত্রীর নাম ছিল বাদল। অসামান্য মানুষ। মুখে, গালে সবসময় পান-জর্দা। মাথার চুলে গাঢ়, কালো কল্প। খুব কষ্ট করছেন প্রথম জীবনে। তাঁর হাতের রান্না অসাধারণ বহুবার আহার করেছি, দুপুরে, রাতে, তাঁদের সেলিমপুরের ভাড়া বাড়িতে। তখন যুগান্তর সাময়িকী বিভাগে এক হাজার পাঁচশো টাকার চাকরি করে, মাস মাইনে। ভাউচারে মেনেন্ট। ১৯৮৫-তে যুগান্তর সাময়িকীতে চাকরিতে ঢুকি। আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন প্রতাপকুমার রায়। এমনি এমনি ঘরোয়া কথাবার্তা। সেখানে পাশে প্রফুল্ল রায়। সেটা ১৯৮৫ সাল। আমায় নানা বিচিত্র বিষয়ে লেকালেখি করা, বিশেষ করে নানারকম খাওয়া-দাওয়া, বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড রেস্তোরাঁর নানা খানা নিয়ে লেখার নির্মাতা লেখক ও জীবন রসিক প্রতাপকুমার রায়, যিনি একই সঙ্গে ‘আজকাল’ ও ‘যুগান্তর’-এর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন প্রতাপবাবু, প্রতাপকুমার রায়। সাধারণভাবে তিনি টেরিকটের বা টেরিনের সাফারি স্যুট পরতেন। শীতে গরম সাফারি— টেরি উলের। সেই সময়টা ১৯৮৩-১৯৮৪-১৯৮৫ বা একটু পরেও সাফারি স্যুটের যুগ। গাড়ি বলতে বিড়লাদের অ্যামবাসাডার, ফিয়াট, নতুন মডেলের ‘প্রিমিয়ার পদ্মিনী’, বেশ দেখতে। আর আছে ‘মারুতি’— ‘মারুতি’ ভ্যান। ‘জাপানি’ কোলাবরেশনে তৈরি। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী ‘সস্তার’ গাড়ি বাজারে দেওয়ার জন্য কারখানা করতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে অনেক অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারি। সিপিআই(এম)-এর সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু পার্লামেন্টে প্রচুর তর্কের ঢেউ তুলেছিলেন বিষয়টি নিয়ে। সেই সময়কার খবরের কাগজ দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার করে সামনে আসবে, নতুনভাবে। মারুতি-কেলেঙ্কারি নিয়ে তখন অনেক অনেক কথা। সংসদে, সংসদের বাইরে। সঞ্জয় গান্ধী এবং তাঁর পারিষদরা তখন যুব কংগ্রেসের— ইন্দিরা কংগ্রেস— নব কংগ্রেস-এর সর্বময় কর্তা। সেটা অবশ্য ১৯৭২-৭৩-৭৪-৭৫-এর সালের কথা।
তখন সঞ্জয় গান্ধীর চারপাশে অম্বিকা সোনি, ভজনলাল, দেবীলাল, বংশীলাল, পিএন হাকসার, দেবকান্ত বড়ুয়া, যিনি বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’, সন্তোষ মোহন দেব, সোমেন মিত্র। এছাড়াও আরও আরও অনেকে। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন এল জরুরি অবস্থা— ২৫ জুন মধ্যরাতে। তখন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবাংলায় সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের চণ্ডশাসন। অবশ্যই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর খাস পার্সন। যেমন ছিলেন দীনেশ সিং, করণ সিং, ভূপেশ গুপ্ত সহ আরও কেউ কেউ।
যুগান্তর-এর এই অন্ধকার মাখা ঘরে দুটো দেওয়াল আলমারি। সাবেক দিনের মেহগিনির আলমারি একটা। তখনও ‘যুগান্তর’-এর নিউজ এডিটর দক্ষিণারঞ্জন বসু। যিনি নিজে কবিতা লিখতেন। কবিতার বইও ছিল তাঁর। সুকমলকান্তি ঘোষ তখন ‘যুগান্তর’-এর কিং মেকার। তাঁর হাতেই ‘যুগান্তর’-এ চাকরি-বাকরির অনেকটা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ‘যুগান্তর’-এ চাকরি দিয়েছিলেন তিনি। সুকমলকান্তি ঘোষ ছিলেন বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক— অনেকভাবে গায়ক শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন, নিয়মিত— নিজ উদ্যোগে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সুকলমলকান্তি ঘোষকে ‘সুকমলদা’ বলে সম্বোধন করতেন। সম্প্রতি সুকমলকান্তি ঘোষের শতবর্ষ আমরা পার হয়ে গেলাম। অতি কুখ্যাত প্রফুল্লকান্তি ঘোষ, যিনি ইন্দিরা কংগ্রেস, তার আগে জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়াতেন, কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। তার দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। ১৯৭১ সালের আগস্টে হল কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা। লাশ লাশ আর লাশ। লাশেদের মুখে আলকাতরা মাখিয়ে, ভাসিয়ে দেওয়া হল গঙ্গায়। যতে চট করে চিহ্নিত করতে না পারে কেউ, সেইসব খুন হওয়া শরীরদের। বরাইনগর বা বরানগরের কুঠিঘাট, রতনবাবু ঘাট, সর্বত্র লাশের পর লাশ। গোপাল লাল ঠাকুর রোডে রক্তচিহ্ন। আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে রক্তের। দক্ষিণারঞ্জন বসু ছিলেন ‘যুগান্তর’-এর নিউজ এডিটর, সে কথা আগেই বলেছি। ধুতি-পাঞ্জাবি, চাদর। পায়ে পাম্প। তাঁর পুত্র চাকরি করতেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় চিফ রিপোর্টার। প্রাক্তন পুত্রবধূ ছিলেন ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-য়। যতদূর জানি পরে ওঁদের বিবাহ ভেঙে যায়। দক্ষিণারঞ্জন বসুর পুত্র টাক মাথা, সামান্য ট্যারা। দক্ষিণারঞ্জন বসু ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ নামে একটি ফিচার চালু করেন যুগান্তর-এর পাতায়, ‘যুগান্তর’-এর এই ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’— অনেক অনেক অজানা মানুষ— আসলে তাঁরা সকলেই হয়তো তেমন নামি— প্রচারিত নাম নন, কিন্তু তাঁর খণ্ডবঙ্গের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এই ফিচারটি লিখেছেন, চোখের জলে। ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বা মৈমনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহি, নোয়াখালি— সব সব কষ্টের বিবরণ। ঈশ্বরদি, তারপাশা, শোল, পাটগ্রাম, মাদারিপুর, ধাউনকা, আকসা-ভোজেশ্বর, ইদিলপুর, মানিকগঞ্জ, মাধবপাশা, গোয়ালন্দ, এইসব জায়গা শুধুমাত্র স্থান নাম নয়। এইসব জায়গা আসে স্মৃতিময় বেদনাস্তম্ভ। দ্যাশ-গেরাম-গ্রামের কথা বলতে বলতে অনেকেরই চোখের জল তরল অগ্নিতে রূপান্তরিত হয়। ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ খণ্ডে খণ্ডে বেরতে থাকে বই হিসাবে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’-এ লিখছেন ‘গ্রামের চিঠি’। সেই লেখা নিয়ে অবশ্য অনেক মতামত— দ্বিমত থাকত। তবু তো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর লেখা। ‘যুগান্তর’ তখন হিন্দু বাঙালির পছন্দের তালিকায় এক নম্বর দৈনিক পত্রিকা। অন্তত অক্ষরপরিচয় সম্পন্ন অথবা তথাকথিত লেখাপড়া জানা— শিক্ষিত বাঙালি কী বলতে পারি তাঁদের, তো সেই তাঁদের বাড়ি ‘যুগান্তর’। ‘যুগান্তর’ আর ‘যুগান্তর’। ‘স্টেটম্যান’— যাকে অনেকেই ‘সটেসম্যান’ বলত ব্যঙ্গ করে, যেমন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-কে অমোত্তবাজার, সে কথা লিখেছি বহু আগে, আর একথাও লিখেছি, ‘অমোত্তবাজার’-এর ইংরাজি পড়েই নাকি ব্রিটিশ সিংহ এদেশ থেকে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল। বাগবাজারের পাড়ার কাগজ ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। ‘পত্রিকা বাড়ি’ যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকা বাড়ির শান-শও কত অন্যরকম। ‘যুগান্তর’ বারিতে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ মহাপ্রচুর দারুময় বিগ্রহ ছিল। প্রায় মানুষ সমান সেই মূর্তির সামনে কীর্তন চলত অষ্টপ্রহর। বিরতি নেই। শোনা যায়, এইসব কীর্তনিয়ারা সব এডিটরের পে স্কেলে মাইনে পেতেন। খাতায়-কলমে তাঁদের সাব এডিটর বলে দেখানো হত ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ক্যানটিন ছিল খুব সস্তা। চিপতো চিপই। এই ক্যানটিনকে বিষ্টুদা বলতেন ‘কেলটিন’। বিষ্টুদা বা বিষ্ণুদা ‘যুগান্তর’ সাময়িকীর খাস বেয়ারা। ঢোলা পায়জামা আর ছিটের হাতা গুটনো শার্ট। সামান্য নীলচে রঙের। ‘যুগান্তর’-এর ক্লাস ফোরদের মধ্যে ছিলেন কেষ্ট, বিষ্টু, হরি, শশ, রবি। শশ, রবি দুই ভাই। তাঁরা ছিলেন ওড়িয়া, অতীব হুশিয়ার, হিসেবি ও চালাক। কেষ্টদা ও হরিদা কিছু আগেই রিটায়ার করেন, তাঁরা আর পার্কসার্কাসের ‘নতুন’ বাড়িতে যাননি। ‘যুগান্তর’-এর ক্যানটিনে লুচি দশ নয়া পয়সা, ঘুগনি চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা— সাব সিডাইসড— ভর্তুকি দেওয়া ক্যানটিনে ভালো ফিশ ফ্রাই পঞ্চাশ নয়া পয়সা— আট আনা। মাংসের কাটলেট ষাট নয়া পয়সা যুগান্তর-অমৃতবাজার ক্যানটিনের অতি কুচ্চিত চা দশ নয়া পয়সা। ক্যানটিনে হাতরুটি পাওয়া যেত, একটা আটার তৈরি হাতরুটি দশ নয়া পয়সা। আমি এই দর বলছি ১৯৮৫-৮৬ সালের। ১৯৮৭-১৯৮৮-তেও। তখন আমি ‘যুগান্তর’ সাময়িকী বিভাগে কন্ট্রাকচুয়াল জব করি। প্রতি বছর কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ হয়। আর রিনিউ হওয়ার সময় এলেই বুক শুকিয়ে আসে। ভাবি হবে তো, হবে তো আবার, নতুন করে। একটা সামগ্রিক অনিশ্চয়তা রীতিমতো কুরে কুরে খায়। শেষ পর্যন্ত হয়ে যায়, ১৫০০ টাকার মাস মাইনেতে ঢুকেছিলাম ‘যুগান্তর’-এ। তারপর সেই টাকা বেড়ে ১৬০০, পরে ১৮০০ হয়। তারপর তো বন্ধই হয়ে গেল ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। বেলা বারোটা নাগাদ অফিস ঢুকতাম, বেরতে বেরতে সন্ধে ছটা। পাতা ছাড়া থাকলে সাতটা বেজে যেত। বৃহস্পতিবার পাতা ছাড়তে হত। কখনও শুক্রবার। যুগান্তর সাময়িকী বিভাগে সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় ছিলেন প্রধান। ছিলেন কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক, শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত। আর সেই সঙ্গে ক্লাস ফোর বিষ্ণুদা বা বিষ্টুদা। একটা বড়োসড় কাঠের চেয়ারে বসতাম, হাতল ভাঙা। সেই ভাঙা হাতলেই বসে গেছি, বার বার বলা সত্ত্বেও চেয়ার বদল হয়নি। কেদারা হাতলও বদলায়নি। অথচ পীযূষ গুহঠাকুরতা বলে একজন বরিশালের মানুষ বার বার বলতেন বদলে দেওয়া হবে চেয়ারের হাতল, বদলায়নি। অনিল ভট্টাচার্য ছিলেন ‘যুগান্তর’-এর খুব নামকরা সাংবাদিক। অনিলদা খর্বকায়, ক্রিম রঙের হাফ হাতা বুশ শার্ট, সাদা প্যান্ট। মাথার পাকা চুল পাতলা হয়ে এসেছে, ক্লিন শেভেন। পায়ে কালো শ্যু, ফিটফাট সবসময়। ভালো মদ পছন্দ করতেন। ভালো খাদ্য। প্রতি নতুন ইংরেজি বছরে আমাকে বড়োসড় নতুন ডায়েরি উপহার দিতেন। অনিল ভট্টাচার্য ডিসি মেহেতা মার্ডার আর তারপরে এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ইন্দ্রিসকে লকআপে পিটিয়ে মারার ঘটনা নিয়ে অসম্ভব ভালো রিপোর্ট করেন ‘যুগান্তর’-এ। প্রতিদিন ভোড়ে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করে গঙ্গাস্নানে যেতেন অনিল ভট্টাচার্য। রেড রোডের এক পাশে গাড়ি রেখে তিনি পয়দল— হন্টন আর হন্টন, যেতেন গঙ্গাস্নানে। সঙ্গে থাকত তাঁর পোষা কুকুর। গাড়িতে প্যান্ট-শার্ট রেখে গামছা পরে খালি গায়ে তিনি যেতেন গঙ্গা অবগাহনে। পোষা কুকুরটি চেনে বাঁধা। তখন মেটিয়াবুরুজে কলকাতা পুলিশের ডিসি মেহেতা হত্যা ও সেই হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ইদ্রিসকে লালবাজার লকআপে পিটিয়ে পিটিয়ে খুনের ঘটনার পর অনিলদার পর পর রিপোর্ট পশ্চিমবাংলার প্রশাসন, সেই সঙ্গে অপরাধী জগৎ ও পুলিশ প্রশাসনকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। তখনকার বামফ্রন্ট সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক অনিল ভট্টাচার্য। এই কথা আগেও হয়তো লিখেছি, অনিল ভট্টাচার্যর কন্যার সঙ্গে জ্যোতি বসুর একমাত্র পুত্র— চন্দন বসুর বিবাহ সম্পর্ক নাকি প্রায় পাকা হয়ে গেছিল। কিন্তু মাঝে চলে এলেন অভিনেতা ও নানান গুণের গুণী ডলি বসু। ফলে অনিল ভট্টাচার্যর কন্যার বদলে এলেন ডলি। এই কথা থেকে সামান্য দূরে সরে গিয়ে একটা কথা বলা খুবই দরকারি মনে করছি। তা হল অনিল ভট্টাচার্য ছিলেন অসম্ভব মুসলমান বিরোধী। ইসলাম ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মানুষদের তিনি ঘৃণা করতেন। হয়তো দেশভাগের নানা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন তাকে এই বিদ্বেষের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অনিল ভট্টাচার্য— অনিলদা ইসলাম ধর্মের মানুষদের অতি অন্যায়ভাবে ‘নেড়ে’ ছাড়া সম্বোধন করতেন না। খুব খারাপ লাগত আমার। অনিলদা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অ্যাত অ্যাত কথা বলছে। তিনি ছিলেন এক নম্বরের কমিউনাল। কলকাতায় নাকি ১৯৪৬-এর ভয়ঙ্কর সময়ে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা খোলা জিপে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে ঘুরে বেড়াতেন। সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে নয়া এ তকদির— আল্লাহো বা আল্লাহু আকবর। এই কথা বিশ্বাস হয়নি, বিশেষ করে বাঙালি জাতি সত্তার অন্যতম মুখ, সুভাষচন্দ্র বসুর পর এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম বাঙালিদের একজন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আত্মত্যাগ, বাংলা, বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি ভালোবাসা, আবেগ আমাকে মুগ্ধ করে রাখে আজও। তো সে যাক গে, অনিলদাকে রেড রোডের ওপর গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। পুলিশের কালো ভ্যান। এই বড়োসড় ভ্যানের ধাক্কায় অনিল ভট্টাচার্যর সাদা স্পিটজটি মারা যায়। যাকে বাংলা খবরের কাগজের ভাষায় বলা হয়, ঘটনাস্থলেই মৃত। ‘স্পট ডেড’ কথাটা আমরা অনেকেই ব্যবহার করি এই ব্যাপারে। অনিল ভট্টাচার্য বলেছেন, আমার চোখের চশমা ছিটকে মাটিকে। বাঁ হাতে চেনে ধরা প্রিয় কুকুর ভূ-পাতিত। গঙ্গা চানের ধুতি পরে আমি খালি গায়ে মাটিতে গড়াগড়ি। গড়াগড়ি। চোখে চশমা নেই, তাই পুলিশ ভ্যানের, তা কলকাতা পুলিশেরই হবে হয়তো, দেখতে পেলাম না। অতি দ্রুত ছুটে গেল সেই ভ্যান। আকাশ জুড়ে তখন ভোরের ফুটিফুটি আলো। গেরুয়া গঙ্গায় স্নান করতে করতে গঙ্গার গেরুয়া জলে জলে বদলে গেছে সাদা ধুতির রং। সেও যেন খানিকটা গেরুয়া।
কোনোরকম হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অনিল ভট্টাচার্য। পায়ের জুতো গাড়িতে। চটি পরেও আসেননি। নগ্নপদ। এই কাহিনি বলতে বলতে, তাঁর মন্তব্য—বুঝলি আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে গেল, হয়তো লাস্ট ওয়ার্নিং। বলল, বেশি বাড়াবাড়ি কর না। বাড়াবাড়ি করলে, বেশি কৌতূহল দেখালে তোমারও দশা হবে, এই রকমই— তোমার পোষা কুকুরের যে হাল করে দিলাম আজ, ঠিক সেই রকম। অনিলদা বলতেন, মেটিয়াবুরুজ বা মেটেবুরুজ হচ্ছে ‘মিনি-পাকিস্তান’। পাকিস্তান ক্রিকেটে জিতলে এখানে— মেটেবুরুজে প্রচুর বাজি-বোমা ফাটে। যাচ্ছেতাই অবস্থা। মেটিয়াবুরুজেই কলকাতা পুলিশের ডিসি মেহেতাকে খুন করা হল নৃশংসতমভাবে। তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হল ধারাল ছুরির ঘায়ে। সেই সঙ্গে সঙ্গে মাংস কাঁটা চপারের কোপ, একের পর এক, এক অন্ধগলির ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে ইঁদুর মারা স্টাইলে খতম করা হল কলকাতা পুলিশের ডিসি অতি সুদর্শন, ডিউটিতে নামী, সাহসী, কর্তব্যপরায়ণ অফিসার মেহেতাকে। তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়া হল, কি ভয়ানক ক্রুয়েলটি। কেড়ে নেওয়া হল তাঁর রিভলবার— সেটি আর উদ্ধার হয়নি। তারপর এই মেহেতা হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ইদ্রিসের লকআপ খুন হয়ে গেল। লালবাজার লকআপে মারতে মারতে মারতে লিভার ফাটিয়ে দেওয়া হল তার। তারপর গলগল গলগল করে রক্ত— ইদ্রিসের মুখ দিয়ে। ইদ্রিস ফিনিশ। এসব বলতে বলতে অনিল ভট্টাচার্য সামান্য চুপ করলেন। তারপর বললেন, কিন্তু লেখা আমি লিখে যাবই। বরুণ— বরুণ সেনগুপ্ত ‘বর্তমান’-এ যা যা লিখবে, আমি তো তার ঠিক উল্টোটাই লিখব। এভাবেই কথা বলতেন তিনি। তাঁকে পুলিশের গাড়ি চাপা দিয়ে মারার চেষ্টা, হাতের চেনে বাঁধা পোষা কুকুরটাকে মেরে ফেলা, ইদ্রিস হত্যা— এসবের পরও তিনি থামেননি কলকাতা পুলিশের ডিসি মেহতা হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখালেখিতে। তারপর অবশ্য তাঁর ওপর এই ধরনের পুলিশি মৃত্যু-হামলা হয়নি। অনিল ভট্টাচার্যের বন্ধু ছিলেন— ঘনিষ্ঠ বান্ধবীই বলা যেতে পারে এককালের অতি বিখ্যাত অভিনেত্রী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখোপাধ্যায়ও হতে পারেন, ‘যুগান্তর’ সাময়িকী-তে তাঁর একটি আত্মস্মৃতি ছাপা শুরু হল। খুব কুচ্ছিত হাতের লেখা, অনেক অনেক বানান ভুল, তবে বহু তথ্য আছে, না জানা তথ্য মীরা ব্যানার্জির আত্মকথনে। এই লেখাটার কঙ্কাল থাকত শুধুমাত্রা। তাকে রিরাইট করতে হয় আমায়। সাময়িকী সম্পাদক প্রফুল্ল রায় বাধ্য হয়েই ঢোঁক গিলেছিলেন, অনিলদার অনুরোধ ফেলতে না পেরে।
আরও পড়ুন
‘যুগান্তর’-‘দৈনিক বসুমতী’-কথা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
খবরের কাগজের ভাষায় আসতে গিয়ে