‘যুগান্তর’-‘দৈনিক বসুমতী’-কথা

‘দৈনিক বসুমতী’-র দুই প্রেস সুপারভাইজার— জিতেনবাবু এবং যতীনবাবুর মধ্যে তীব্র আকচা-আকচির সম্পর্ক। জিতেন সাহা পূর্ববঙ্গের মানুষ, ঢাকার। যতীন মাইতি অখণ্ড মেদিনীপুরের। কথার ফাঁকে প্রশান্তদা— ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের সামনে পরস্পর পরস্পরকে ঠেস দিয়ে কথা বলতেন। দুজনেই দুজনের কাজের খুঁত ধরতেন, সমালোচনা করতেন। ‘দৈনিক বসুমতী’-র লালবাড়ির তিন তলায় হ্যান্ড কম্পোজ সেকশন, সেখানে হাতে করে ‘টাইপ গাঁথা’— টাইপ সাজানো হয়। কিছু কিছু ‘জব কাজও’ হয় বাইরের। হ্যান্ড কম্পোজ সেকশনে কাঠের চৌকো ডালার ভেতর অনেক অনেক অনেক খোপ। তার মধ্যে সিসের টাইপ। ‘রূপশ্রী’, ‘গীতশ্রী’, ‘দেবশ্রী’— এইসব নাম টাইপের। সত্তর দশকের একেবারে শেষে, আশির দশকের গোড়াতেও, যখন অফসেটে ছাপা শুরু হয়ে গেছে ‘দৈনিক বসুমতী’-তে তখনও ‘রূপশ্রী’, ‘দেবশ্রী’-তে হেডিং কম্পোজ হয় বহু সময়েই। ‘হট মেটাল’— গরম সিসের তৈরি অক্ষরমালা, যতি চিহ্ন সব সেজে ওঠে পরপর— লাইনো টাইপ, মোনো টাইপ। কিন্তু সিসের তৈরি কম্পোজ করা ম্যাটার গ্যালি প্রুফের আগের অবস্থা— গ্যালি বা গেলি দড়ি বাঁধা অবস্থায় কাঠ বা পেতলের কেসের ভেতর শণের দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে, শক্ত করে। যাতে না সহজেই সেই সব টাইপ স্থানচ্যুত হয়, তাহলে তো সাড়ে সব্বোনাশ একেবারে। আবার নতুন করে গাঁথতে হবে। সাজাতে হবে। প্রয়োজনে কম্পোজ করতে হবে। সীতাংশুদা— সীতাংশু মাইতি ছিলেন অত্যন্ত পাকা একজন পাতা মেকআপ করিয়ে। পুরনো গ্যালি প্রুফ কোথায় আছে, সর্বস্ব তাঁর মুখস্থ। সামান্য কুঁজো মতো, প্রায় হাঁটুর কাছে তুলে পরা লালচে ধুতি। তার ওপর টেরিকটের সাদা ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে উল্টে আঁচড়ানো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। তাঁর পাতা মেকআপের ধারণা অসাধারণ। দু-একবার কাজ করতে গিয়ে যে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ হয়নি, এমন তো নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই দেখেছি তাঁর পেজ মেকআপ সেন্স। ‘দৈনিক বসুমতী’-তে রবিবারের সাময়িকী মেকআপ হত শনিবার, শুক্রবারও। আর ‘যুগান্তর’-এ বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়তো শুক্রবার বিকেলে। ফি শনিবারে ছাপা ‘যুগান্তর’ সাময়িকী চলে আসত আমাদের সাময়িকী দপ্তরে। টেবলে টেবলে। প্রফুল্লদা— প্রফুল্ল রায় তখন ‘যুগান্তর’-এর সাময়িকী সম্পাদক। আছেন কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক। তিনিও সাময়িকীর সঙ্গে যুক্ত। দেখেন ‘ছোটোদের পাততাড়ি’। গৌরাঙ্গদা প্রেসে থাকতেন পেজ মেকআপের সময়। তখন পিটিএস-এর যুগ। 

আমি খবরের কাগজে হ্যান্ড কম্পোজ হট মেল্টার— সিসের টাইপের লাইনো, মোনো— সব দেখেছি। ‘আজকাল’ প্রকাশের আগে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত ‘কম্পু কম্পোজিং’— বিষয়টা আমার কাছে তখন পরিষ্কার ছিল না, এখন হয়তো তুলনামূলক একটু বেশি পরিষ্কার হয়েছে। ‘দৈনিক বসুমতী’-র ছাপার ব্যাপারেও সেই অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া সময়ে বিজ্ঞাপন করা হত বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যন্ত্রে মুদ্রিত। আমি গরাণহাটায় কাঠের ব্লক তৈরি হওয়া দেখেছি। দেখেছি তামার ব্লক, সিসের ব্লক তৈরি হত। তামার ব্লক, পেতলের ব্লক, সিসের ব্লক— সব ব্যবহার দেখেছি। ব্লক তৈরি হতে দেখেছি। ‘যুগান্তর’-এর সিসের ব্লক তৈরি হত বাইরে থেকে। সবই ‘জব কাজ— জব ওয়ার্ক’-এর ভিত্তিতে, অন্য জায়গা থেকে। ‘যুগান্তর’-এর’ ‘ছোটোদের পাততাড়ি’, রবিবারের সাময়িকী-র ব্লক তৈরি করে আনতেন দ্বিজেনবাবু। দ্বিজেনবাবু খর্বকায়, কৃষ, মিলের ধুতি, পায়ে স্যান্ডেল, গায়ের শার্টটি টেরিকটের, হয়তো এইট্টি-টোয়েন্টিও হতে পারে। কখনও সাদা টেরিকটের পাঞ্জাবি। আর সেই পাঞ্জাবির নয়তো শার্টের গায়ে বাঙালের উচ্চারণে ‘তিলা’, ঘটি জিভে ‘তিলে’ বা ‘মইশে’, বর্ষায় যেমন হয় সাধারণত সাদা জামা-কাপড়ের ওপর হঠাৎ হঠাৎ সররেষে চাহারার কালো কালো বিন্দু, ভিজে— জলে ভেজা, নয়তো ঘামে ভেজা কাপড়-জামায়, সাদা টুপিতে এই ‘মইশে’, ‘তিলা’ বা ‘তিলে’। তো সে যাই হোক, দ্বিজেনবাবুর চোখে সাদাটে ময়লা ধরা কালো ফ্রেমের চশমা, চশমার কাচেও ঝাপসা অপরিচ্ছন্নতা। তিনি প্রায় রোজ ব্লক তৈরি করিয়ে নিয়ে আসতেন। সিঙ্গেল কলাম, ডাবল কলাম। বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে আর তার বাইরে যে বাড়িতে ‘যুগান্তর’ সাময়িকী, ছোটোদের পাততাড়ি, সিনেমা-থিয়েটার বিষয়ক বিভাগের ঘর, তার ওপরে দোতলায় ক্যাশ যুগান্তর সাময়িকী, ছোটোদের পাততাড়ির ক্যাশ বিভাগ। নগদ। সেখানে পান্নাবাবু প্রধান। খুব স্নেহ করতেন আমায় এই উত্তর-পঞ্চাশ ‘ক্যাশুড়ে’— কথাটা তৈরি করলাম আজই, বাংলা বাজার নেবে কিনা জানি না। সেখানে পান্নাবাবু, অজিতবাবু। অজিতবাবু থাকতেন বেহালার দিকে। তিনি তাঁদের পাড়ার লাইব্রেরিতে আমাদের অনুষ্ঠান করে অনারারি সদস্য করেছিলেন। পান্নাবাবু সদাশয়, ধুতি-পাঞ্জাবি। একটু মোটার দিকে গড়ন। চোখে সোনালী ফ্রেমের বাহারি চশমা। টাকা দেওয়ার ব্যাপারে— মানে ভাউচার— নীলচে ভাউচার সই করিয়ে লেখা বাবদ প্রাপ্য সম্মান দক্ষিণা দিতে কখনও কার্পন্য করেননি। অজিতবাবুও না। সাধারণভাবে এইসব খবরের কাগজের বাড়িতে ক্যাশ ও অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের লোকজনেরা অনেকেই ভাবতেন নিজের বাড়ির টাকা তাঁরা দিচ্ছে। সেই মতো কথাবার্তাও বলেন তাঁরা, লেখক-কবিদের সঙ্গে। ক্যাশ ডিপার্টমেন্ট ও অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের অনেকেই ভাবতেন লেখক-কবিরা অকারণে বেশি বেশি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। আর তিনি যদি সেই ‘বাড়ির’ লেখক হন, তাহলে তো আরও মুশকিল। ‘বাবু’-র টাকা ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন। তখন যেকোনো ‘বই’-তে কবিতা ছিল অত্যন্ত হেলাছেদ্দার জিনিস। সাধারণভাবে উপন্যাস, গল্পের সঙ্গে পাদপূরণ বা পাদটীকা হিসাবে কবিতা যেত। মনে আছে, কথাটা বলেছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’ রবিবারের সাময়িকী সম্পাদক কবি কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কল্যাণদা বলেছিলেন কবিতা দিয়ে একটি পাদপূরণের ব্যাপারে ‘বসুমতী’-র প্রেসের লোক, সম্ভবত তাঁকে ভণ্ডুল নামে ডাকতেন কল্যাণদা, কারণ যেকোনো কাজ— প্রেসের গেলি ইত্যাদি গোলমাল করার ব্যাপারে ভণ্ডুল অদ্বিতীয়। বসুমতী প্রেসের কল্যাণদা কথিত ‘ভণ্ডুল’-কে প্রেসেরই আর একজন হিন্দিভাষী কর্মী অনায়াসে ‘বাণ্ডুল’, ‘বান্ডুল’ বলে ডাকতেন। কল্যাণদা ‘দৈনিক বসুমতী’-র সব চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদেরই নিজস্ব নামে ডাকতেন। ‘বসুমতী’-র বেয়ারাকূল ছিল এরকম— মনোহর, সমচম বা সঞ্চম, ভীম, দিলীপ, নন্দবাউল, দীপনারায়ণ, মৌজি। ভীম ও নন্দবাউল ছাড়া সবাই হিন্দিভাষী। কল্যাণদার খাস বেয়ারা ছিলেন মনোহর। সন্ধ্যার পর নিয়মিত বাংলু-সেবনে তাঁর একটি সরেশ নেয়াপাতি। কল্যাণদা অনায়াসে তাঁকে সুচিত্রা, ফুটবল, পোয়াতি ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতেন। আর মনোহরও সাড়া দিতেন সেই ডাকে। কেবল ‘মনোহর’ বলে ডাকলেই তিনি কিছুতেই সাড়া দিতেন না। ভীমকে ভীমা, নন্দবাউলকে ‘বাউল’, এইসব অনায়াস সম্বোধন কল্যাণদার মুখে ছিল। কেউ তাতে রাগঝাল করতেন না। যে কথাটা বলতে গিয়ে এত এত কথা, তা হল— একদিন বাবু কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় দৈনিক বসুমতী অফিসে বসে আছেন, তার দপ্তরে, ঘরে। হঠাৎ শারদীয় ‘দৈনিক বসুমতী’-র পাতা মেকআপ করতে থাকা সেই ‘ভণ্ডুল’ প্রায় দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল কী যেন। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে যতীন মাইতি, যিনি মুখে মুখে কখনও কখনও জ্যোতি মাইতিও হয়ে যেতেন। তিনি বললেন, কিরণশঙ্করকে মহাশ্বেতার পোঁদের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। এই কথা শুনে কল্যাণাক্ষ বোনার্জির তো ‘ধরণী দ্বিধা হও’ দশা। কল্যাণদা ব্যানার্জি নয়, বোনার্জিই লিখতেন। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তকে— মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য— তখন তিনি তো ঐ নামেই লেখেন। অর্থাৎ কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তর কবিতাকে মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যর বড় গল্পের পাদপূরণ হিসাবেই রাখা হয়েছে, মূল ব্যাপারটা এই। 

‘যুগান্তর’-এর ব্লক তৈরি হত হরলাল মিত্র স্ট্রিটে, সম্ভবত। বাগবাজারের মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ-এর নামাঙ্কিত রাস্তার ওপরই সেই দোতলা নাকি তিনতলা বাড়ি। পরে তা ভাঙা পড়ে। সম্ভবত সত্তর দশকে। শিশির কুমার ঘোষ— যিনি তুষারকান্তি ঘোষের পিতৃদেব, তাঁর নামে নামাঙ্কিত রাস্তায় শিশির কুমার ঘোষ ইনস্টিটিউট, সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র। এখানে হয়তো হলও ছিল একটা। আবার আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের ওপর ‘অমৃত’ পত্রিকা অফিস, বাঁদিকে পড়ে ‘যুগান্তর’-এর সেই ভাঙা পড়ে যাওয়া বাড়ির দিক থেকে আসতে গেলে। সেখানেই ‘যুগান্তর’-‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র নামে আলাদা ডাকঘর। ডাকঘরের লোহার ঝকঝকে লাল বাক্স বাইরের দেওয়ালে লোহার পোক্ত হুকে ঝোলানো। তার মধ্যে ঢুকে এলেই ডাকঘর আর সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকার অফিস। তখন মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ সরণীর ওপর যে যুগান্তর-বাড়ি, পরে যা ভাঙা পড়ল, সে তো আগেই বলেছি, সেখানে প্রায় অন্ধকার একতলা। সেখানে ছুটি কাঠের চেয়ার। একটিতে যুগান্তর সাময়িকী সম্পাদক কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। অন্যটিতে প্রফুল্ল রায়। পাশের ঘরে আশিসতরু মুখোপাধ্যায়, সিনেমা-থিয়েটার-বিনোদনের পাতায় সহযোগী সম্পাদক। আসলে আশুদা— আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯৬৯-৭০-এ পাঁচটি পাতার এডিটর। যুগান্তর সাময়িকী, ছোটোদের পাততাড়ি, সিনেমা-থিয়েটার, বিনোদন ও আরও একটি পাতার দায়িত্বে। ছোটোদের পাততাড়ি— যুগান্তর-এ ছোটোদের যে পাতা, তার পুরো দায়িত্ব পরে কথাকার প্রফুল্ল রায়ের ওপর বর্তায়। আসলে আশুদা তেমন করে ‘পাতা’-র নজরদারি, নিজের ক্ষমতা নিজেরই কাছে কুক্ষিগত করে রাখা, প্রভুত্ববাদী সুরে কথা বলা, এই ব্যাপারে বিশ্বাসীই ছিলেন না। দরাজ দিল— খোলামেলা, হৃদয়বান মানুষ। যুগান্তর সাময়িকী বিভাগে ঢুকতেন বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ। তখন ‘বাহাদুর’ সম্বোধনের এক নেপালী কাম গোর্খা চালক তাঁর সাদা অ্যাম্বাস্যাডার চালান। আশুদা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে আসতেন যুগান্তর-বাড়িতে। তাঁর পরনে মিলের ফাইন পাটভাঙা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি। ফাইন আদ্দির, ‘মহারাজা’। পুরো হাতা— চুড়ি হাতা। কখনও কখনও গিলে করা। পায়ে সরু সোলের চপ্পল। মাথার চুল পাট পাট করে আঁচড়ানো। দাড়ি-গোঁফ কামানো, ক্লিন শেভেন। মুখে সামান্য পাউডারের ছোঁয়া। রুমাল, সাদা রঙের, ‘কেলিকো’ কোম্পানির। সেই রুমালের ভাঁজে ফেস পাউডার। রুমাল মুখে বোলালে পাউডার লেগে যায়, এমনিতেই— এমনি, এমনি। আশুদা— আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সাধারণভাবে সরু পাড়ের মিলের ধুতি। আদ্দির পাঞ্জাবি। তিনি সবচেয়ে দামি ‘মহারাজা’ আদ্দির ছাড়াও ‘কেলিকো’ মিলের দুধ রং আদ্দির পরতেন। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের, সোনার ফ্রেমই হবে, ভালো রোল্ড-গোল্ডও হতে পারে, দামি চশমা। ডান হাতে কালীর মুখ প্রমবস করা শঙ্খ কেটে তৈরি করা একটি আংটি পরতেন। যতদূর জানি দক্ষিণেশ্বর থেকে কিনেছিলেন। সুন্দর ফিনিশিং। এটা অবশ্য বাগবাজারের সেই প্রায়ান্ধকার যুগান্তর সাময়িকী দপ্তরে বসার সময় নয়। অনেক পরে, যখন তাঁর একমাত্র পুত্র জয় দুরারোগ্য জিনঘটিত অসুখ মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ক্রমত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এই যে যুগান্তর সাময়িকী দপ্তর, সেখানে হাতাঅলা কাঠের চেয়ারে বসতেন প্রফুল্ল রায়। তিনি ছোটোদের পাততাড়ি দেখেন আবার যুগান্তর সাময়িকীর সঙ্গে যুক্ত। প্রফুল্ল রায় খাদি অথবা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরতেন, হাতা গুটিয়ে। সাদা এবং রঙিন। সেইসঙ্গে ধুতি। পায়ে সাধারণ চপ্পল। তখন প্রফুল্ল রায় তাঁদের বেহালার এজমালি বাড়ি ছেড়ে, দুই কন্যা— দোলা আর সনাদের নিয়ে, সঙ্গে অবশ্যই বৌদি, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কাছেই দু কামরার ভাড়া বাসায়। সেখানে তাঁর এক শ্যালকও থাকেন। তিনি শারীরিকভাবে খানিক কমজোরি, দেখে মনে হত। আমি সে বাড়িতে গেছি বহুবার। প্রফুল্লদার এক ভাইয়ের নাম শান্তি। এই শান্তি মাঝে মাঝেই আসতেন ‘দুগান্তর’ দপ্তরে। তাঁদের আর এক সহোদরও ছিলেন। তাঁকেও দেখেছি ‘যুগান্তর’ দপ্তরে আসতে। ওঁদের আর এক ভাই আত্মঘাতী হয়েছিলেন। সেই দুর্ঘটনার পর গভীর মন খারাপের গভীরে চলে যান প্রফুল্লদা। সেই ডিপ্রেসশন কাটতে সময় লাগে অনেকটাই। প্রফুল্ল রায়ের গল্প খণ্ডে খণ্ডে বের করার কথা ছিল নিউ বেঙ্গল প্রকাশন থেকে। এটি ‘দেবসাহিত্য কুটির’-এর ‘নবকল্লোল-শুকতারা’-র প্রকাশন ঘর। দেব সাহিত্য কুটির থেকে বেরত অসামান্য সব পুজোবার্ষিকী— পারিজাত, দেবদেউল— এমন সব নাম। সেই গল্পগ্রন্থ সাজানোর ব্যাপারে আমারও কিছু ভূমিকা ছিল। সেটা ১৯৭৪ সালটাল হবে। এরপর প্রফুল্ল রায় চলে আসেন ঢাকুরিয়ার সেলিমপুরে। সরকারি কোটায়, অতি সস্তায় জমি কেনেন সল্টলেকে। এই জমি কেনার কয়েক বছর পর সেই প্লট বিক্রিও করে দেন, অনেক অনেক বেশি টাকায়। নিউ বেঙ্গল থেকে প্রফুল্ল রায়ের গল্প সংগ্রহ একটা বা দুটো খণ্ডে বেরয়। তারপর বন্ধ থাকে। যুগান্তর-এর সেই বাড়িটি তো বাগবাজারের হরলাল মিত্র স্ট্রিটের গায়ে, এ-কথা আগেই বলেছি। সেই প্রায় অন্ধকার ঘরে একটাই জানালা। এখানেই বসতেন গল্পকার ধর্মদাস মুখোপাধ্যায়। তিনি আগাগোড়া বামপন্থী জন। সেখানে আসতেন শিল্পী কালীকিঙ্কর ঘোষদস্তিদার। আসতেন শিল্পী সূর্য রায়, মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ী বেশ টিপটাপ চেহারা। ছবি আঁকতেন, তেমন কিছু নয়। কিন্তু খুব ছিমছাম চেহারা। আসতেন শিল্পী— পরে ভাষা নিয়ে ‘যুগান্তর’-এর শব্দছক ভাবা, শব্দছক নির্মাতা শ্যামদুলাল কুণ্ডু। শ্যামদুলালদা টিপটপ, পাট ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে স্যান্ডেল। শ্যামদুলালদা ভালো ছবি আঁকতে পারতেন না। পরে ‘ক্রীড়া আনন্দ’ নামে একটি খেলার— ক্রীড়াবিষয়ক কাগজ বেরয়, প্রখ্যাত রেডিও ভাষ্যকার অজয় বসুর সম্পাদনায়, সেই পত্রিকার আর্ট ডিরেক্টর হলেন শ্যামদুলাল কুণ্ডু।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
খবরের কাগজের ভাষায় আসতে গিয়ে